সূর্য ডোবার আগে পর্ব-১৭

0
2806

#সূর্য_ডোবার_আগে
পর্ব-১৭
লেখিকা ~ #সুমন্দ্রামিত্র
কঠোরভাবে প্রাপ্তমনষ্কদের জন্য।
.
.
.

সপ্তাহ দুই কেটে গেছে সিকিম থেকে ফিরেছে তিন্নি আর নিয়মিত অফিস যাচ্ছে ঠিক আগের মতোই। শুধু অফিসফেরতা আজকাল কিছুটা দেরি করে বাড়ি ফেরে তিন্নি। দুই বছর ধরে চলে আসা একঘেঁয়ে রোজনামচায় মাত্র দুই সপ্তাহে অনেক পরিবর্তন এসেছে শ্রীরামপুরের ফিরিঙ্গিডাঙা মোড়ের আচার্য্যবাড়িতে।

তিন্নির মা, ভাস্বতীদেবী, এখন আর আগের মতো মেয়ের সাথে খোঁচা দিয়ে কথা বলেন না। তিন্নির হঠাৎ শরীর খারাপ, ডাক্তারের বকাবকি, রঞ্জনবাবুর তিরস্কার ছাড়াও এ পরিবর্তনের সবচেয়ে বড় কারণ –শুভদীপ। কানাঘুষোয় এসছে, শুভ যাদের সাথে মেলামেশা করে, এলাকায় তারা কেউই “ভালো ছেলে” বলে পরিচিত নয়। তারওপর আবার পাড়ার অনেকেও শুভকে নিয়ে ভাস্বতীদেবীর কাছে কমপ্লেন করেছেন – শুভ নাকি বারীনদার জিমে গিয়ে বেপাড়ার মেয়েদের উত্যক্ত করে, তাদের ফোন নাম্বার চায়, আরো অনেক কিছু। বাড়িতেও দিনের পর দিন রূঢ় ব্যবহার করে চলে শুভ, অবশ্যই তিন্নির অনুপস্থিতিতে। দিদির আপাত শক্ত আবরণ ভেদ করতে না পেরে মা’কে চাপ দেয় আরো টাকা হাতখরচ করার জন্য। ঘরে বাইরে দুদিকের প্রবল প্রতিক্রিয়ায় একটু একটু করে হয়তো ভাস্বতীদেবীর চোখ খুলছে, শুভ কোনোদিনই ওনাদের দায়িত্ব নেবে না। তাই শুভর ওপর থাকা সব ভরসা-বিশ্বাস সব এখন ট্রান্সফার হয়েছে তিন্নির ওপর। তিন্নি না চাইতেই ওর খাবার সময় মাছের বড়ো পিস্, গরম ভাত, রাতে দুধের গ্লাস সবই চলে আসছে।

অদ্ভুত মানুষের মন – যে মেয়েকে মাস খানেক আগেও প্রতিদিন তাড়াহুড়ো করে নাকে মুখে কিছু গুঁজে বা না খেয়েই বেরিয়ে যেতে হতো অফিসে, আজ সেই মেয়ের অফিসে যাওয়ার আগে ভাস্বতীদেবী খাবার আগলে বসে থাকেন। দিদির প্রতি মা’র এই “আদেখলেপনায়” শুভ আজকাল বেশ তিতিবিরক্ত হয়ে উঠছে তা তিন্নিও বেশ বুঝতে পারে।দিনকয়েক আগেও এসবকিছুর ওপর একচ্ছত্র অধিকার বা পাওনা যে শুভর’ই ছিল। দিদি হঠাৎ করে শুভর একাধিপত্য কেড়ে নিচ্ছে বলে ভেতরে ভেতরে রাগে হিংসায় জ্বলে যাচ্ছিলো শুভ আবার কিছু বলতেও পারছিলো না। যদি দিদি হাতখরচ দেওয়া বন্ধ করে দেয়? সেই ছোট থেকে শুভ ছিল এ বাড়ির সেন্টার অফ আ্যট্ট্র্যাকশন। বাড়িতে কি রান্না হবে , কোনদিন মাছ বা মাংস হবে, পুজোর দুটো এক্সট্রা জামা, জন্মদিনে কেক কাটা স-ব ওকে ঘিরে। মেয়েদের জন্মদিন পালন করতে নেই, মাছের ছোট পিস্ বা কালকের বাসি ভাতটা যে বাড়ির ছেলেদের দিতে নেই সেটা জেনেই তিন্নি বড়ো হয়েছে। এ নিয়ে ওর কোনো অনুতাপ নেই, শুধু মাঝে মাঝে বুকের ভেতরটা চিনচিন করে উঠতো যখন দেখতো স্কুল কলেজের অন্য মেয়েরাও ঘটা করে তাদের জন্মদিনে কেক কাটছে, মেয়েদের জন্মদিনে পাশের বাড়ির কাকিমারা পায়েস বানাচ্ছে। কিন্তু সেসব অনেকদিন আগেকার কথা! এখন আর এসবে যায় আসে না ওর। কিন্তু এই দিনকতকে হলোটা কি? প্রথমদিকে মায়ের ব্যবহারের এই অকস্মাৎ পরিবর্তনের কোনো হেতুই খুঁজে পাচ্ছিলো না তিন্নি। মনে মনে উল্টে খারাপই লাগছিলো, হয়তো একতরফা ভুল বুঝে মা’র্ থেকে ও অনেকটাই দূরে সরে গেছে। ভেবেছিলো পা জড়িয়ে ক্ষমা চেয়ে নেবে। কিন্তু তারপর …… কোনো এক রোববারের সকালে দূরসম্পর্কের এক মাসির সাথে যখন ভাস্বতীদেবী ফোন কথা বলছিলেন, না চাইতেও সবটাই কানে এসেছিলো তিন্নির, নিজের ঘরে বসে থেকেই দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে উঠেছিল সব। ভাস্বতীদেবীও যে ভয় পেয়েছেন … বন্ধুদের সাথে ঘুরে আসার পরই তিন্নির ওমন প্রবল শরীর খারাপের পর এ চিন্তাটাই ঢুকেছে ওঁনার মনে, যদি তিন্নি সত্যিই অসুস্থ হয়ে বিছানা নেয় তবে চাকরি করবে কি করে? আর তিন্নি চাকরি না করলে মাস গেলে অতগুলো টাকা, বেকার ছেলের ভার, পঙ্গু স্বামীর চিকিৎসার খরচ, সংসার —- একা হাতে কি করে সামলাবেন উনি? সংসারে যে তাঁর রাশ আলগা হচ্ছে, বুঝতে পারছেন ভাস্বতীদেবী।

ভারী দীর্ঘশ্বাস পড়েছিল তিন্নির। এখন ও শুধু নিস্পৃহ থেকে মুখ বুজে কর্তব্য করে যায়, শুধুমাত্র বাবার জন্য। বাবার জন্য সব কষ্ট, অপমান, তাচ্ছিল্য সহ্য করে নিতে পারবে তিন্নি, ওই একটা মানুষই তো হুইলচেয়ারে বন্দী থেকেও তিন্নির ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছেন, বারে বারে। ওই একটা মানুষের কাছেই তো মন খুলে নিজের জ্বালা যন্ত্রণাগুলো কিছুটা হলেও বলতে পারে তিন্নি। আচার্য্য বাড়িতে সম্পর্কের সুক্ষ সমীকরণটা যে হঠাৎ বদলে গেছে, তা বুঝেও না বোঝার নিপুন অভিনয় করে চলেছে মা-ছেলে-মেয়ে তিনজনেই।

আর একটাও চেন্জ এসছে তিন্নির ডেইলিকার রুটিনে—

আগেকার মতো অফিস থেকে ফিরেই সোজা বাড়ি আসে না তিন্নি, ট্রেন থেকে নেমে স্টেশনরোডে বিশালাক্ষী মন্দিরে মাথা ঠুকে তারপর বাড়ি ঢোকে। একদিনও এর অন্যথা হয় না। এমনকি অফিস না থাকলেও সন্ধ্যেবেলায় কোনো ছুতোয় বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে স্টেশনরোডে বিশালাক্ষী মন্দিরে অন্তত একটি ধুপ জ্বেলে দিয়ে যায় তিন্নি। অশ্রুসজল চোখে মায়ের পাথরের মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে ওর পাতলা গোলাপি ঠোঁটদুটি নড়ে যায় ব্যাকুল প্রার্থনায়। কোনো মন্ত্র নয়, কোনো রীতিসম্মত পুজো নয়, শুধু “একজনকে” ভালো রাখার আকুল আবেদন।

ভাগ্যের হাতে নিজের ভালোবাসাকে যখন ছেড়ে দিয়েছে ও, ভগবানকে যে বিশ্বাস করতেই হবে! দরকার পড়লে সারা পৃথিবীর সকল পাথরে মাথা ঠুকবে ও, শুধুমাত্র অভিমন্যুর সুরক্ষার জন্য।

**************************__****************************

 

এই যে অপেক্ষা করে করে তুমি ক্যালেন্ডারের পাতা ঝরালে,
আকাশের রঙ পাল্টে দিলে, তবু তোমার অপেক্ষা ফুরালো না,
শেষ হলো না তোমার চেয়ে থাকা, তোমার কান পাতা?
কিন্তু তুমি কার জন্য অপেক্ষা করে আছো সেটাই তো জানো না।
এভাবে অপেক্ষা করতে করতে এক দুই করে করে
এক কোটি বছর গেলো,
কোটি কোটি মঙ্গল বুধ পার হলো, লক্ষ লক্ষ শীত বর্ষা শেষ হলো,
কতো বিমান উড়লো নামলো, কতো জাহাজ
লক্ষ লক্ষ বার আটলান্টিক পাড়ি দিলো
কতো পূর্ণিমার রাত এলো গেলো,
তোমার প্রহর গোনা শেষ হলো না।
কিন্তু তুমি কি ঠিক জানো তুমি কার জন্য দাঁড়িয়ে আছো?

 

ফেসবুক হয়ে এই একটা সুবিধে হয়েছে। হয়তো কত কত সাহিত্য, কবিতার বই সময়ের চাপে কেনা হয়ে ওঠে না, পড়া হয় না, কিন্তু ইলেকট্রনিক মিডিয়ার কল্যানে হঠাৎ হঠাৎ সেইসব অনাস্বাদিত অমূল্য মনিমুক্তা চোখের সামনে এসে ধরা দেয় সহজেই। যেমন “কোটি বর্ষ অপেক্ষা”! মহাদেব সাহার এই কবিতাটি যেন তিন্নির মন বুঝে বুঝে লেখা হয়েছে। যতবার পড়ে ~ প্রতিটি ছত্রে, প্রতিটি শব্দে তিন্নি নিজের সাথে মিল খুঁজে পায় আর একবার করে কেঁপে ওঠে! কবিতায় আশ্রয় নেওয়া যে কি প্রখর শান্তি, তা কবিতা না থাকলে তিন্নি জানতেও পারতো না! একটি মিসডকলের অপেক্ষায় এখন তিন্নির সারাটি দিন অতিবাহিত হয়।

 

হ্যাঁ! কথা রেখেছে অভিমন্যু। প্রতিদিন নিয়ম করে রাত এগারোটা বেজে তিরিশ মিনিট থেকে এগারোটা পঞ্চাশের মধ্যে পর পর দুটো মিসডকল আসে তিন্নির ফোনে, ঠিক এক মিনিটের ব্যবধানে! এক সেকেন্ডও বাজে না ফোনটা, শুধু লাইট জ্বলেই অফ হয়ে যায় – এতো দ্রুত ফোন কেটে দেয় অভিমন্যু! প্রত্যাশিত মিসডকল আসার পর ফোনের ওপরই হালকা করে নিজের ঠোঁট ছোঁয়ায় তিন্নি, যেন অভিমন্যুর কাছে পৌঁছে যাচ্ছে ওর ভেজা চুম্বন। তারপর বালিশের পাশে ফোনটা রেখে অভিমন্যুর মিলিয়ে যাওয়া ঘ্রান লেগে থাকা আর্মি জ্যাকেটটা জড়িয়ে ধরে ঘুমের অতলে ডুবে যায়। অফিসে কাজের ফাঁকে ফাঁকে বারবার নিজের কললিস্ট চেক করে – কাল যেন কখন ফোন করেছিল? পরশু কখন করেছিল?

সারাদিন অধীর আগ্রহে দিন গোনে, সময় গোনে তিন্নি ….. কখন যে রাত হবে, কখন আবার মিসডকল আসবে! রঞ্জনবাবু মাঝে মাঝে মেয়েকে বকেন আদর করে – “সারাক্ষন কি ওই মোবাইল নিয়ে মুখ গুঁজে পড়ে থাকিস বল তো? চোখে ব্যাথা হয় না? বেশি বেশি মোবাইল ঘাঁটলে বুদ্ধি কমে যায়, জানিস? “
ধরা পড়ে যাওয়ার অস্বস্তির হাসি হেসে এড়িয়ে যায় তিন্নি। কাকে বোঝাবে ও? তিন্নির বেঁচে থাকার প্রাণভোমরা যেন লুকিয়ে আছে ওই দুটি মিসডকলের মধ্যে! তবে তার সাথেসাথে এটাও খেয়াল করেছে তিন্নি, প্রথমদিকে মানে প্রথম সপ্তাহ মিসডকল আসতো একটা প্রাইভেট নাম্বার থেকে -যার নাম্বারটাও দেখা যেত না,কলব্যাক করার অপশন তো দূরের কথা! প্রথমদিন তিন্নি শিওরও ছিল না আদৌ অভিমন্যুই ফোন করছে কিনা? পরপর দুই দিন প্রাইভেট নাম্বার থেকে রাত সাড়ে এগারোটা নাগাদ মিসডকল আসতে শিওর হয়েছিল। তার পরের সপ্তাহ থেকে যদিও সেই নাম্বারটা থেকে মিসডকলগুলো আসতে শুরু করে, গ্যাংটক থেকে ফেরার দিন যে নাম্বার থেকে অভিমন্যুর সাথে শেষবারের মত কথা হয়েছিল!

তবে কথা রেখেছে তিন্নিও। ভুলেও কলব্যাক করে নি অভিমন্যুকে, একটা মিসডকলও দেয় নি শুধুমাত্র এই ভয়ে, যদি ফোন আসা বন্ধ হয়ে যায়? অসংখ্যবার চেক করে দেখেছে যদি এই নাম্বারটা হোয়াটসআ্যপে থাকে, অন্তত অভিমন্যুর ফটো দেখতে পাবে! নিজের মনের আয়না ছাড়া তো অভিমন্যুর কোনো চিহ্ন নেই ওর কাছে! মাঝে মাঝে যে বড়ো দেখতে ইচ্ছে করে সেই গাঢ় বাদামী চোখ যা প্রতিরাতে তিন্নির স্বপ্নে আসে। সেই চওড়া কপাল, খাড়া নাক, ভুরুর পাশে কাটা দাগ!
কিন্তু না, ট্রু কলার, হোয়াটসআ্যপ – কোথাও এই নাম্বার রেজিস্টার্ড নয়!

বিগত দুইসপ্তাহ এক রুটিন চলে আসার পর এই প্রথম আজকের ফোনটা আর মিসডকল হয়েই থেমে গেল না। প্রথম দুবার ফুল রিং হয়ে কেটে গেল, তারপর আরো একবার! একদৃষ্টিতে রিং হয়ে চলা ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বুকের ভেতর তখন ঢিপঢিপ করছে তিন্নির, ভয় আর নিষিদ্ধ উত্তেজনায়। কেন ফোন করছে আজ অভিমন্যু? ভালোবাসার মন সবার আগে খারাপ চিন্তায় আনে, তিন্নিরও তার ব্যতিক্রম হলো না। তবে কি অভিমন্যুর কি শরীর খারাপ? কোনো ক্ষতি হলো? ওর ফোন কি অন্য কারো হাতে রয়েছে? কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে হাজারটা খারাপ চিন্তা মাথায় ঘুরতে শুরু করে দিলো!

.

.

.

.

শুক্রবারের রাত, ১২টা বাজতে চলেছে প্রায়, বর্ষার মেঘের আড়ালে আস্তে আস্তে চাঁদ লুকাচ্ছিলো । তিনবারের বারও যখন অনেকক্ষন ফোনটা রিং হয়েই যাচ্ছে, খুব ভয়ে ভয়ে শেষে, কলটা রিসিভ করলো তিন্নি – “হ্যালো???”……..

কয়েক সেকেন্ড শ্মশানের স্তব্ধতা। তারপর ফোনের ওপ্রান্ত থেকে ভেসে এলো চিরপরিচিত সেই হাসি আর গম্ভীর ঘন স্বর, যা শুনলেই তিন্নির বুকের মধ্যে হাতুড়ি পেটানোর শব্দ হয়। কোনো সম্বোধন নয়, হাই হ্যালো নয় – দিন পনেরো কুড়ির পর অভিমন্যুর হাসিমাখা স্বরের প্রথম সম্ভাষণ দুলিয়ে দিলো তিন্নির পৃথিবী, আরো একবার।

— পরীক্ষায় যে ডাহা ফেল করে গেলেন ম্যাডাম। আর তো কাল থেকে ফোন পাবেন না!

ঠিক এই ভয়টাই করছিলো তিন্নির, এই জন্যই ফোন ধরছিল না ও। মোবাইলটা কানে চেপে ধরে প্রায় কেঁদে ফেলে তিন্নি আর কি! কাতর অভিযোগের সুরে বললো —- “কেন? আপনিই তো বারবার ফোন করে যাচ্ছিলেন, কাটেন নি। আমি তিননম্বরের বার রিসিভ করলাম! প্লিজ অভিমন্যু, এমন করবেন না…….”

হুড়মুড়িয়ে আরো অনেককিছু হয়তো বলে যেত তিন্নি, ওকে থামিয়ে দিলো অভিমন্যু। শান্ত স্বরে বললো — “আপনি তো ভারী ছিঁচকাদুনি, সীমন্তিনী? আমার বোনের থেকেও বেশি…”

দুই সেকেন্ডস থমকে গেলো তিন্নি, অভিমন্যুর বোন আছে? অভিমন্যুর ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কিছুই তো জানে না ও! একবারই জিজ্ঞেস করতে গিয়েছিলো আর চরমভাবে প্রত্যাখ্যিত হয়েছিল। এটা কি তবে “স্লিপ অফ টাং”? তারপর আবার ভাবলো, হঠাৎ বোনের কথাই বা তুললো কেন অভিমন্যু? তবে কি অভিমন্যু ওকে নিজের বোনের চোখে দেখছে নাকি?

“না!না!না! অভিমন্যুকে মোটেও আমি দাদার চোখে দেখি না!”

কয়েক মিলিসেকেন্ডে মাথার সবকটা নিউরোন সমবেত বিদ্রোহে চেঁচিয়ে উঠলো। তারপর মনে মনে নিজেকে কষে ধমক লাগলো তিন্নি – “হচ্ছেটা কি! এতদিন পর ফোনে করলো আর আমি কথা না বলে কি সব ভাবছি এসব”!

ফোনে মনোযোগ দিলো তিন্নি। কাতর হয়ে জিজ্ঞেস করলো – “আপনি ঠিক আছেন? হঠাৎ ফোন করলেন যে ….. আপনার কি শরীর খারাপ? কিছু হয়েছে? আমাকে লুকোবেন না প্লিজ!”

ফোনের ওপারে হেসে ফেললো অভিমন্যু। — “এতোগুলো প্রশ্ন একসাথে? কোনটার উত্তর চাই ম্যাডাম?”

শব্দ করে নাক টানলো তিন্নি। চোখ বন্ধ করে শান্ত হয়ে আসা হৃৎপিণ্ডের গতির সাথে তাল মিলিয়ে থেমে থেমে জিজ্ঞেস করলো — “আপনি ঠিক আছেন?”

আবারো সব চুপচাপ!

যেন হাজার বছর পর সুদূর সিকিমের রুক্ষ শীতল পার্বত্য উপত্যকা থেকে নিস্তব্ধ ফোনের ওপারে নেশা ধরিয়ে দেওয়া ঘন গলায় উত্তর এলো — “হুম-ম। শুধু এটুকু জানার জন্য ফোন করলাম….. প্রতিরাতে নিয়ম করে যাকে মিসডকল দিয়ে যাচ্ছি, তার ইনফ্যাচুয়েশন কি কেটে গেছে? নাকি সে সত্যিই প্রতীক্ষা করে আমার জন্য?”

 

ধুকধুক করে বেজে চলা দুর্বল হৃৎপিন্ডটা বোধহয় বুকের পাঁজর থেকে ছাড়া পেয়ে তিন্নির গলার কাছেই লাফিয়ে চলে এলো এবার, আর কি!

**************************__****************************

বিছানার পাশের খোলা জানলা দিয়ে রাতের ঘোর জড়ানো জোলো হাওয়া আসছে, গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে তিন্নির। অদ্ভুত এক শিরশিরানি ছড়িয়ে পড়ছে সারা শরীরে। অনেক চেষ্টার পর কোনোরকমে গলায় স্বর ফুটলে প্রতিটা শব্দ থেমে থেমে উচ্চারণ করলো

— “কি মনে হয় আপনার?”

একটা ভারী নিঃশ্বাসের শব্দ হলো ফোনের ওপারে। হাস্কি ঘন স্বর বলে উঠলো

—”আপনি খুব জেদী।“

— আপনার থেকে কম, অভিমন্যু।

— আমি যে আপনার সাথে কন্টাক্টে আছি, আশা করি সেটা আপনার বন্ধুরা জানে না।

“বন্ধু” শব্দটার ওপর অভিমন্যুর বিশেষ শ্লেষ তিন্নির নজর এড়ালো না, তড়িঘড়ি বললো

— কেউ জানে না আর ওরা আমার “বন্ধু” নয়।

“বন্ধু” শব্দটার ওপর তিন্নির বিশেষ জোর দেওয়াটা অভিমন্যুরও নজর এড়ালো না। গলায় শব্দ করে হাসলো

— “যাক, তাও ভালো! ডাক্তার দেখিয়েছেন?”

উফফ!

আ্যতো “ডাক্তার ডাক্তার” করে কেন সবসময়! চিড়বিড়িয়ে একটা কঠিন জবাব দিতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিলো তিন্নি। অভিমন্যুকে তো আর বলা যায় না, সিকিম থেকে ফিরে এসেই ও যে বিছানা নিয়েছিল? বেজার গলায় শুধু বললো – “হুম-ম।“

— “গুড গার্ল!”

আর একবার অভিমন্যুর মৃদু হাসিতে ফোনের এপাশেও গাল লাল হয়ে উঠলো তিন্নির। মোমের মতো গলে যাচ্ছিলো ও। কোনো জবাব না দিয়ে শুধু ফোনটা কানের কাছে সেঁটিয়ে রেখেছে, শরীরের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গের মতো। কিছুটা নীরবতার পর অভিমন্যু বললো —– “রাখলাম তবে? ভালো থাকবেন।“

এখনই? এতো তাড়াতাড়ি? চট করে ফোনে সময় দেখলো তিন্নি, সবে একমিনিট বাইশ সেকেন্ড হয়েছে। আর একটু কথা বলা যায় না কি? ভাবতে ভাবতেই শেষবারের মতো ব্যাকুলভাবে বলে উঠলো তিন্নি — “কালকেও মিসডকল দেবেন তো?”

গুড়গুড় মেঘের মতো দৃঢ় কঠিনস্বর ভেসে এলো — “না।“

চুপ করে গেলো তিন্নি! অভিমানে ঠোঁট ফুলে উঠলো ওর, এমন কি বিশাল অপরাধ করলো ও ফোনটা রিসিভ করে? অভিমন্যু তো ওকে আগে বারণ করেনি ফোন রিসিভ করতে? বলে দিলে ও করতো না!এবার কি হবে? শেষ যোগাযোগটুকুও থাকবে না? নিজের অজান্তেই টপটপ করে দুফোঁটা গরমজল গড়িয়ে পড়লো চোখের কোণ থেকে।

নিঃশব্দ ফোনের ওপার থেকে তখন অভিমন্যু বললো — “কাল থেকে ফোন করবো, আজকের মতো।“

বর্ষার ফেঁপে ওঠা নদীর মতো ফুলে ওঠা কান্নাগুলো এবার আর আটকে রাখতে পারলো না তিন্নি! ফোনের স্পীকারটা হাতে চেপে রেখে ঝর ঝর করে চোখ থেকে জল পরতে শুরু করলো ওর! তেত্রিশ কোটি দেবতাকে মনে মনে থ্যাংকইউ জানালো, কিন্তু মুখ দিয়ে আরএকটা আওয়াজও বেরোলো না! এপাশ থেকে তিন্নির কোনো সাড়া না পেয়ে অভিমন্যু হাসিমাখা গলায় জিজ্ঞেস করলো

— “কি হলো? করবো না?”

কে জবাব দেবে? তিন্নি তো তখন চোখে জল মুছতে আর হারিয়ে যাওয়া গলার স্বর খুঁজতে ব্যস্ত। জবাবের অপেক্ষায় থাকা মেজর অভিমন্যু সেন কি দেড়-দুইহাজার মাইল দুর থেকেও বুঝে গেলেন সে কথা? তা না হলে অমন রুক্ষ কঠিন স্বরেও কেন মিশে গেলো অত কোমলতা?

— “সীমন্তিনী? এভাবে কান্নাকাটি করলে কিন্ত আপনার সাথে কথা বলা সম্ভব হবে না।“

তড়িঘড়ি হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে চোখের জল মুছলো তিন্নি… কাকে বোঝাবে ও? এ কান্না যে আনন্দের কান্না। মনের যুদ্ধে, ভালোবাসার যুদ্ধে, জিতে যাওয়ার কান্না। … ফিরে আসার দিন থেকে এটুকুইতো চাইছিলো ও, প্রতিদিন, প্রতিঘন্টা, প্রতিসময়। ভাঙা গলা স্বাভাবিক করার যথাসম্ভব চেষ্টা করে শেষে মুখ ফুটলো ওর

– “নাহ্, আর কাঁদবো না! প্রমিস”

নিশ্বাস চেপে ঘন স্বরে অভিমন্যু বললো –”শক্ত হন ম্যাডাম! সামনে যে আরো কঠিন সময় আসবে!…. রাখলাম, গুডনাইট।“

কিসের ইঙ্গিত এ? কি বলতে চাইলো অভিমন্যু?নিজেকে সামলে নিয়ে এপ্রান্ত থেকে তিন্নি “গুডনাইট” বলার আগেই ফোন কেটে গেল।

**************************__****************************

ক্রমশঃ
© সুমন্দ্রা মিত্র। ভালো লাগলে নামসহ শেয়ার করবেন।

বিঃদ্র~
যারা যারা মহাদেব সাহার এই অপূর্ব সৃষ্টি ” কোটি বর্ষ অপেক্ষা” পড়েননি, তাঁদের জন্য তুলে ধরলাম সম্পূর্ণ কবিতাটি

এই যে অপেক্ষা করে করে তুমি ক্যালেন্ডারের পাতা ঝরালে,
আকাশের রঙ পাল্টে দিলে, তবু তোমার অপেক্ষা ফুরালো না,
শেষ হলো না তোমার চেয়ে থাকা, তোমার কান পাতা?
কিন্তু তুমি কার জন্য অপেক্ষা করে আছো সেটাই তো জানো না।
এভাবে অপেক্ষা করতে করতে এক দুই করে করে
এক কোটি বছর গেলো,
কোটি কোটি মঙ্গল বুধ পার হলো, লক্ষ লক্ষ শীত বর্ষা শেষ হলো,
কতো বিমান উড়লো নামলো, কতো জাহাজ
লক্ষ লক্ষ বার আটলান্টিক পাড়ি দিলো
কতো পূর্ণিমার রাত এলো গেলো,
তোমার প্রহর গোনা শেষ হলো না।
কিন্তু তুমি কি ঠিক জানো তুমি কার জন্য দাঁড়িয়ে আছো?
অপেক্ষা করতে করতে কতো কোটি কোটি
নক্ষত্র তুমি গুণে শেষ করলে,
দুই হাতে আরো কতো অযুত নিযুত অর্বুদ
গোলাপ পাপড়ি তুমি নিজেই ছড়িয়ে দিলে,
তুমি নিজেই কতো বার বালক বৃদ্ধ যুবক হলে
কোটি বছরের রোদ বৃষ্টি মাথায় নিলে,
তবু তোমার এই অপেক্ষায় বসে থাকা শেষ হলো না,
কিন্তু তুমি কি জানো তুমি কার জন্য চোখ ভেজাচ্ছো?
এই যে অপেক্ষা করে করে তুমি ক্যালেন্ডারের পর ক্যালেন্ডার শেষ করলে
গাছে সব পাতা ঝরালে,
অস্থির বৃষ্টি বিন্দু আর শিশিরকণা ধরে রাখলে
একটার পর একটা রুমালে
লক্ষ লক্ষ পাখি ও প্রজাপতির এভাবে উড়ে যাওয়া দেখলে
তবু তোমার এই দীর্ঘ অপেক্ষার শেষ হলো না;
কিন্তু তুমি তো জানো না কেন তোমার এই অপেক্ষা, এই বসে থাকা?
তোমার তো অপেক্ষা করার মত কেউ নেই,
তুমি কার জন্য কোটি বর্ষ অপেক্ষা করে আছো?

কবিতা ©মহাদেব সাহা!

.

.
.
.

© সুমন্দ্রা মিত্র। ভালো লাগলে নামসহ শেয়ার করবেন।
ক্রমশঃ (মঙ্গলবার বা বুধবার)

**************************__****************************

বিঃদ্র – আপনাদের যারা এখনো “মন, তোমাকে ছুঁয়ে দিলাম -Mon tomake chhunye dilam – লেখনী সুমন্দ্রা মিত্র ” পেজটি ফলো করেননি, তাদের সকলকে একান্ত বিনীত অনুরোধ মেনপেজটি লাইক ও ফলো করুনএবং পাশে গিয়ে SEE FIRST অপশনে ক্লিক করে রাখুন, পেজে পোস্ট হওয়ার সাথে সাথেই নোটিফিকেশন পেয়ে যাবেন। এছাড়াও Facebook Storyতে চোখ রাখতে পারেন, মেনপেজে কিছু পোস্ট হলে এই পেজের storyতেও লিঙ্ক দেওয়া থাকে। আপনাদের বন্ধু ও পরিবারবর্গদেরও Invite করুন মেনপেজটি লাইক ও ফলো করতে। লিংক 👇
https://www.facebook.com/মন-তোমাকে-ছুঁয়ে-দিলাম-লেখনী-সুমন্দ্রা-মিত্র-110448980674312/

***********************__******************************

সকল পর্বের লিঙ্ক~
Video Teaser
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/145475543838322/?vh=e&d=n
Part 1
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/145129087206301/?d=n
Part 2
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/145859077133302/?d=n
Part 3
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/146221053763771/?d=n
Part 4
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/146595433726333/?d=n
Part 5
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/147293876989822/?d=n
Part 6
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/148075966911613/?d=n
Part 7
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/148530310199512/?d=n
Part 8
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/148951006824109/?d=n
Part 9
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/149405760111967/?d=n
Part 10
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/150313546687855/?d=n
Part 11
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/151106323275244/?d=n
Part 12
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/151923336526876/?d=n
Part 13
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/152353663150510/?d=n
Part 14
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/154065792979297/?d=n
Part 15
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/156163186102891/?d=n
Part 16
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/157132182672658/?extid=QdVQFGSjLzQUsE31&d=n
Part 17
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/157444422641434/?extid=fI3jIc0PCiYXDa0N&d=n
Part 18
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/158095955909614/?extid=1E2JOZfMCmqscBoi&d=n
Part 19
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/158831902502686/?extid=R8zo6L2l274CIQ7r&d=n
Part 20
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/159626782423198/?extid=0e8jrLLhsuLqgsQX&d=n
Part 21
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/160047349047808/?extid=e9DIdFXAkqxTg77U&d=n
Part 22
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/160963752289501/?extid=EgYDh0z3hVr5TCBY&d=n
Part 23
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/161833698869173/?extid=gRK0HHMoLW0bu0gK&d=n
Part 24
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/162740122111864/?extid=KIR9o3zetBHgH9mt&d=n
Part 25
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/163061178746425/?extid=fhzBxEjnlA7n6Ulu&d=n
Part 26
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/163695728682970/?extid=tm0Y81ykORQhpsq9&d=n
Part 27
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/164305438621999/?extid=WsYE2BjXkYvPmqyF&d=n

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here