সেই সন্ধ্যা পর্ব-৩

0
2118

#সেই_সন্ধ্যা
#সুমাইয়া_সিদ্দিকা_আদ্রিতা
#পর্ব_৩
.
কথাটা বলতে না বলতেই আখিকে কোলে তুলে নিলো পলক। ওর কথার মানে বুঝতে পেরে লজ্জায় গাল দু’টো লাল হয়ে গেল আখির। আখিকে নিয়ে সোজা বেডরুমের দিকে চলে গেল পলক।
সকাল মুখটাকে বাংলার পাঁচ বানিয়ে খাটে বসে আছে। স্নিগ্ধকে দেখতে মন চাইছে কিন্তু তা সম্ভব নয়। এই চারদিন ইচ্ছে মতো জ্বালিয়েছে ও স্নিগ্ধকে। কিন্তু স্নিগ্ধ ওকে একটা বকাও দেয় নি। উল্টো নিজেও একটু-আধটু দুষ্টুমি করেছে সকালের সাথে। কিছু একটা ভেবে সকাল ফোন নিয়ে আখির নম্বরে কল দিল। কিন্তু রিসিভ হলো না। পর পর ৩-৪ বার কল করেও যখন আখিকে পেলো না তখন রাগে ফোনটা বিছানার অপর পাশে ছুঁড়ে মারলো। মন খারাপ করে কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে গেল। ফোনের শব্দে সকালের ঘুম ভেঙে গেল। বিরক্ত হয়ে দেয়ালে থাকা ঘড়িটার দিকে তাকাতেই দেখতে পেলো সকাল ১০ টা বাজে। পুরো বিছানা হাতিয়ে হাতিয়ে ফোন খুঁজে চলেছে ও। অবশেষে বিছানার নিচে পাপোশের উপরে ফোনটা পেলো। স্ক্রিনে আখির নাম দেখে তাড়াতাড়ি কলটা রিসিভ করলো।

-“ওই মহিলা কল রিসিভ করো নি কেন কালকে?”
আখি থতমত খেয়ে বললো,
-“রাগ করে না পিচ্চু।”
-“কই ছিলে কালকে রাতে?”
-“ইয়ে মানে… আমি তো আসলে… আসলে আমি একটা অপারেশনে ব্যস্ত ছিলাম।”
-“ওহ আচ্ছা।”
-“তো এখন কেমন আছে পিচ্চুটা?”
-“সকাল ভালো নেই আপি।”
-“কেন! কি হয়েছে? মাথা ব্যাথা করছে?”
-“আরে না না তেমন কিছু না। ডাক্তার সাহেবকে দেখতে মন চাইছে। কি করি বলো তো!”
-“আচ্ছা এই ব্যাপার?”
-“হ্যা।”
-“কি করা যায় তাহলে?”
-“আপি একটা সাহায্য করবে?”
-“বলো কি সাহায্য?”
-“ডাক্তার সাহেবের নাম্বারটা দাও না প্লিজ!”
-“ওলেলে…. হিহিহি…. আচ্ছা আমি ম্যাসেজ করে পাঠিয়ে দিচ্ছি।”
-“ওক্কে।”

ফোনটা কেটে বালিশের নিচে মাথা দিয়ে কম্বল দিয়ে ঢেকে আবারও শুয়ে পরলো সকাল। আখি স্নিগ্ধর নাম্বারটা সকালকে ম্যাসেজ করে দিয়ে উঠে বসলো। আড়মোড়া ভেঙে হাই তুলে পাশে তাকিয়ে দেখলো পলক ঘুমিয়ে আছে। হাসি মুখে পলকের চুলে হাত বুলিয়ে ওর গালে চুমু দিল আখি। ওমনি পলক একহাত দিয়ে আখিকে নিজের কাছে টেনে জড়িয়ে ধরলো। মুচকি হেসে বললো,
-“আমার ঘুমের সুযোগ নেয়া হচ্ছে তাই না?”
-“সিরিয়াসলি! ঠিকাছে এখন থেকে আর কখনো কাছে আসবো না। হুহ!”
-“আরে বউ রাগ করো কেন? আমি তো মজা করছিলাম।”
-“ওয়েট এ মিনিট! তুমি না ঘুমিয়ে ছিলে?”
-“না তো। আমি তো জেগেই ছিলাম।”
-“ওরে শয়তান! তবে রে….”

পলককে মারতে গেলেই পলক আখিকে নিচে ফেলে হাত দু’টো চেপে ধরে বালিশের সাথে। দুষ্টু হেসে তাকিয়ে আছে পলক আখির দিকে।

-“এই একদম এখন কিছু করবে না। আমাকে হসপিটালে যেতে হবে সরো।”
-“আজকে কোথাও যাওয়া হচ্ছে না তোমার। আজকে সারাদিন আমার সাথে থাকবে। এমনিতেও কালকে আমি চলে যাচ্ছি।”
-“কালকেই চলে যাবে?”
-“হুম। বিজনেসের কাজের জন্য ৩ দিনের কথা বলে বাইরে গিয়েছিলাম। ২ দিনে কাজ শেষ করে চলে এসেছি। আর ১ দিন তোমার সাথে থেকে তারপর বাসায় ফিরে যাব।”
-“পলক!”
-“হুম।”
-“আমাদের বিয়ের ব্যাপারটা কবে জানাবে তোমার ফ্যামিলিকে?”
-“খুব শীঘ্রই।”
-“গত দু’মাস ধরে তো একই কথা বলছো।”
-“বোঝার চেষ্টা করো আখি। আমি মাত্র কিছুদিন হলো বিজনেস জয়েন করেছি। আগে একটু গুছিয়ে নিই নিজেকে। তারপর বাবা-মা’কে তোমার কথা জানাবো।”
-“তোমার বাবা-মা মেনে নিবে তো আমাদের বিয়েটা?”
-“না মানতে চাইলেও মানতে হবে। আমি তোমাকে ভালোবাসি। তোমাকে বিয়ে করেছি আমি। আইনত তুমি আমার স্ত্রী। তাই ওনাদের মানতেই হবে তোমাকে।”
-“যদি না মেনে নেয় তখন?”
-“তখন আমরা দু’জন আলাদা ভাবে নিজেদের একটা ছোট্ট সংসার সাজাবো।”
-“তুমি আমার জীবনের সবচেয়ে বড় উপহার। যখন আমার পরিবার আমার জীবনটা নষ্ট করে দিতে চাইছিল তখন তুমি এসে আমার জীবনটাকে এক টুকরো জান্নাতে পরিণত করেছো। তোমাকে ছাড়া আমি বেঁচে থেকেও মরে যাব পলক।”
-“শশশ…. কিচ্ছু হবে না। আমি তোমার থেকে কখনো দূরে সরে যাব না। সব সময় তোমার পাশে থাকব। তোমাকে সবটুকু দিয়ে আগলে রাখব। ভালোবাসি যে খুব তোমায়।”
-“আমিও অনেক ভালোবাসি। এতটা ভালোবাসি যার পরিমাপ করা অসম্ভব।”

আখির কপালে চুমু দিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরলো পলক। আখিও জড়িয়ে ধরলো তার ভালোবাসার মানুষটাকে।
বিকালে ছাদে বসে স্নিগ্ধর নাম্বারে ডায়াল করছে সকাল। কিন্তু স্নিগ্ধ কল রিসিভ করছে না। প্রথমবার কল কেটে যাওয়ার গেল। দ্বিতীয়বার কল দেওয়ার পর দু’বার রিং হতেই কলটা রিসিভ হলো। পরিচিত মানুষটার কণ্ঠ শুনতে পেয়ে সকালের মুখে হাসি ফুটে উঠলো। ওপাশ থেকে স্নিগ্ধ সমানে হ্যালো হ্যালো করেই যাচ্ছে। বুকে ফু দিয়ে নিজেকে শান্ত করে সকাল ‘হ্যালো’ বললো।

-“কে বলছেন আপনি?”
-“আমি আপনার পেশেন্ট সকাল।”
-“ওহ আচ্ছা। মিস বিকাল!”
-“আমার নাম সকাল সকাল সকাল। আপনি বারবার আমাকে বিকাল বলে ডাকেন কেন?”
-“সে কথা বাদ দিন। আগে বলুন আপনি আমার পার্সোনাল নাম্বার কোত্থেকে পেলেন?”
-“আপনার নাম্বার খুঁজে বের করা সকালের বাম হাতের খেলা ছিল।”
-“ওকে… তো কেন কল করেছেন?”
-“আপনার সাথে কথা বলতে।”
-“মিস বিকাল আর ইউ সিরিয়াস?”
-“ইয়েস। আই অ্যাম ড্যাম সিরিয়াস।”
-“স্যরি মিস বিকাল। আমি আপনাকে হার্ট করতে চাইছি না। বাট তাও আমার মনে হয় আপনি ভুল করছেন।”
-“মানেটা ঠিক বুঝলাম না।”
-“দেখুন প্রথম দিনই আমি বুঝে গিয়েছিলাম যে আপনি আমার ওপর ক্রাশ। বাট মিস সকাল এটা শুধু ভালো লাগা। আর মূল কথা হলো আমার এসব পছন্দ না। তাছাড়া আপনি এখনো যথেষ্ট ছোট মানুষ। আই মিন পিচ্চি মানুষ। তাই এখনি এসবে না জড়ানোই ভালো। এসব আপনার এই বয়সের আবেগ বুঝেছেন? আস্তে আস্তে সময়ের ব্যবধানে এই আবেগ কেটে যাবে। তখন এই দিনের জন্য আফসোস করবেন। তাই বলছি, এসবে মন না দিয়ে পড়াশোনায় মন দিন কাজে দিবে। পারলে মেডিক্যালে পড়ে একজন ভালো ডক্টর হওয়ার চেষ্টা করুন। মেডিক্যালে পড়লে এসব মাথায় ঢুকবে না সহজে।”
-“আবেগ কাকে বলে? জিনিসটা কি?”
-“আমার প্রতি আপনার যে ভালো লাগাটা তৈরি হচ্ছে তা হলো আবেগ।”
-“ভালো লাগা আর ভালোবাসা কি আলাদা?”
-“অবশ্যই এই দু’টো জিনিস আলাদা।”
-“কিভাবে?”
-“আবেগ মানেই হলো কিছুদিনের ভালো লাগা। মানে প্রথম কাউকে দেখে ক্রাশ খেলেন। তারপর তাকে ভালো লাগতে শুরু করলো। তার সব কিছুই আপনার কাছে অনেক ভালো লাগতে লাগলো। কিন্তু আস্তে আস্তে একটা সময় আসবে যখন সেই ক্রাশ নামক মানুষটাকে আপনার আর ভালো লাগবে না। তার কোনো কিছুই আপনার ভালো লাগবে না। বরং তাকে বিরক্ত লাগবে। এটাই হলো আবেগ বা ভালো লাগা।”
-“আর ভালোবাসা?”
-“ভালোবাসা শব্দটা চার অক্ষরের হলেও এর অনুভূতি অনেক গভীর। পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর অনুভূতি হলো ভালোবাসার অনুভূতি। যে মানুষটার প্রতি দিন দিন আপনার ভালো লাগা গুলো কমবে না বরং বাড়তে থাকবে, যে মানুষটার কথা ভেবে আপনি কখনো বিরক্ত হবেন না বরং আপনার মুখে এক প্রশান্তির হাসি ফুটে উঠবে, যে মানুষটার কথা ভাবতে গেলেই আপনার গাল দু’টো লজ্জায় লাল হয়ে আসবে, যাকে দেখে আপনার মনে হবে যে আপনি তাকে দেখেই দিনের পর দিন পাড় করে দিতে পারবেন সেটাই হলো ভালোবাসা।”
সকাল চুপ করে রইলো স্নিগ্ধর কথাগুলো শুনে। স্নিগ্ধ আবারও বললো,
-“কি হলো মিস বিকাল বুঝলেন আমার কথা?”
-“হুমম। এসব কথা মূল উদ্দেশ্য হলো আমি যাতে আপনাকে কল করে বিরক্ত না করি তাই তো?”
-“আরে আপনি তো দেখি আমার কথার উল্টো মিনিং বের করলেন।”
-“না আমি বুঝতে পেরেছি যে আমাকে আপনার পছন্দ নয়। ইট’স ওকে। কথাটা সোজাসুজি বললেই তো হতো এত বড় বড় ভাষণ না দিয়ে। এনিওয়ে! ইট’স ওকে ডাক্তার সাহেব। আমি আর আপনাকে ডিস্টার্ব করব না। এখন রাখছি।”

সকাল কলটা কেটে দিল। স্নিগ্ধ এক দীর্ঘশ্বাস ফেললো। এসব ঝামেলায় ও পরতে চায় না। ও যেমন আছে ভালোই আছে। তাছাড়া সকাল নিতান্তই একটা বাচ্চা মেয়ে। এই বয়সে ওকে এসবে না জড়ানোই ভালো। এমন তো না যে ও নিজেও সকালকে পছন্দ করে। সকাল শুধু মাত্র ওর পেশেন্ট। তাও প্রাক্তন পেশেন্ট। এসব ভেবে নিজের কাজে মন দিল স্নিগ্ধ।
সকাল গাল ফুলিয়ে বসে আছে। ওর রাগ লাগছে প্রচুর। এভাবে স্নিগ্ধ ওকে রিজেক্ট করবে ও ভাবতেও পারে নি। নিজের ভালো লাগার মানুষটা যখন রিজেক্ট করে দেয় তখন যে কি পরিমাণ খারাপ লাগে আর রাগ লাগে তা সকাল এখন ভালো ভাবেই বুঝতে পারছে। সকালের রাগ উঠলেই ও খাওয়া শুরু করে দেয়। তাই ড্রয়্যার থেকে কত গুলো চিপসের প্যাকেট বের করে খাওয়া শুরু দিল নিজের রাগ কমানোর জন্য। সেদিনের পর থেকে সকালও আর কখনো ডিস্টার্ব করে নি স্নিগ্ধকে। দেখতে দেখতে দুই বছরের বেশি পাড় হয়ে গেল। সেদিন স্নিগ্ধর বলা কথা গুলো এখনো ভুলে নি ও। তাই তো স্নিগ্ধর কথা মতো ভালো করে পড়াশোনা করছে। যার ফলে আজকে ও মেডিক্যালে চান্স পেয়েছে। আগের সকাল আর এখনকার সকালের মধ্যে কোনো তফাৎ নেই। শুধু আগে যে জিনিস গুলো বুঝতো না সে জিনিস গুলো এখন মোটামুটি বুঝতে শিখেছে।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here