সেই সন্ধ্যা পর্ব-৪

0
2110

#সেই_সন্ধ্যা
#সুমাইয়া_সিদ্দিকা_আদ্রিতা
#পর্ব_৪
.
আগের সকাল আর এখনকার সকালের মধ্যে কোনো তফাৎ নেই। শুধু আগে যে জিনিস গুলো বুঝতো না সে জিনিস গুলো এখন মোটামুটি বুঝতে শিখেছে। আর দুষ্টুমিটা কমিয়ে দিয়েছে। সকাল নিজের বাবার হাতে ব্রেকফাস্ট করে বাবা-মা’কে জড়িয়ে ধরে বেরিয়ে গেল মেডিক্যালের উদ্দেশ্যে। সামনে ১ টা গাড়ি পেছনে ১ টা গাড়ি আর মাঝখানে সকালের গাড়ি। দুই গাড়িতে বডিগার্ড দিয়ে পাঠিয়েছে সকালকে ওর বাবা। সকালের বাবার শত্রুর অভাব নেই বলে উনি নিজের মেয়ের সেফটির জন্য বডিগার্ড রেখে দিয়েছেন। কলেজের একটু দূরেই সকাল ড্রাইভারকে গাড়ি থামাতে বললো। সকাল চায় না কেউ ওর সাথে ওর বাবার নাম শুনে বন্ধুত্ব করুক। বডিগার্ড গুলোকে কলেজের বাইরেই থাকতে বলে ও ভেতরে চলে গেল। ভেতরে ঢুকেই লম্বা একটা নিঃশ্বাস নিলো সকাল। মুডটা আজকে অনেক ফ্রেশ। আশপাশটা ভালো করে ঘুরে ক্লাসে চলে এলো। ক্লাসরুমে ঢুকে দেখলো অনেকেই আছে। কিন্তু এর মধ্যে মেয়েদের সংখ্যা বেশি। হঠাৎ সকালের মনে পরলো স্নিগ্ধর সাথে প্রথম এই হসপিটালেই দেখা হয়েছিল। মুহূর্তেই ওর মনটা খারাপ হয়ে গেল। একদম ফার্স্ট বেঞ্চে বসে পরলো সকাল। একটু পরেই একটা মেয়ে এসে সকালের কাঁধে হাত রাখলো। সকাল মেয়েটিকে দেখে হেসে জড়িয়ে ধরলো।

-“বেঁচে আছিস? আমি তো ভাবলাম কবে মরে গিয়ে হাত-পা টানা দিসিছ।”
-“শুরু হইছে তোর ডায়লগ।”
-“ইয়্যার আফি! আমি দুই-আড়াই বছর আগে এই হসপিটালেই এ্যাডমিট ছিলাম জানিস তুই?”
-“বলিস কি?”
-“হ্যা।”
-“আরে ব্যাপার না। তোর মাথায় তো ওই অ্যাক্সিডেন্টের আগে থেকেই প্রবলেম আছে।”
-“আমিও জানি সেটা….. ওই তুই কি বললি?”
-“কই কি বললাম? আমিতো বললাম ক্লাসরুমটা অনেক সুন্দর।”
-“সত্যি তাই বলেছিস?”
-“হ্যা তাই তো বললাম।”
-“কিন্তু আমি তো অন্য কিছু শুনলাম মনে হলো।”
-“কি শুনেছিস?”
-“বাদ দে। কিছু না।”

আফি মুখ লুকিয়ে হেসে ফেললো। একটু পরেই ক্লাসে টিচার ঢুকলো। প্রথম ক্লাস বলে শুধু পরিচয় পর্ব সারলো আজকে। এভাবেই আফির সাথে মজা-মাস্তি আর স্যারদের সাথে টুকটাক কথা বলে দু’টো ক্লাস শেষ করলো সকাল। লাস্ট ক্লাসে সকাল একটা ক্যাডবেরি চকলেট বের করে প্যাকেটটা ছিঁড়তে গেলেই ক্লাসে স্যার ঢুকলো। সকাল চোখ দু’টো বড় বড় করে তাকিয়ে রইলো। স্যার ক্লাসে সবার সাথে পরিচিত হতে হতে সকালের সাথে পরিচিত হতে গেলেই স্যারের চোখ দু’টো ছোট ছোট হয়ে গেল। কিছু সময় তাকিয়ে থেকে স্যার বললো,
-“মিস বিকাল!”
-“আমার নাম সকাল সকাল সকাল সকাল! এত গুলো বছর হয়ে গেল অথচ আপনি আমার নামটা এখনো সঠিক ভাবে বলতে পারেন না।”
-“আরে আরে মিস বিকাল আই মিন সকাল কুল। এত হাইপার কেন হচ্ছেন?”
-“হব না! আপনি শুরু থেকেই আমাকে বিকাল বলে ডাকেন কেন? আমার নাম তো বিকাল না। আমার নাম সকাল।”
-“ওকে ওকে মিস… আচ্ছা ছাড়ুন। আপনি এখানে কি করছেন?”
-“ভাঙরা ডান্স করতে এসেছি। আপনি করবেন?”
-“আরে মজা কেন করছেন?”
-“তো আর কি বলবো? মানুষ এখানে কেন আসে?”
-“পড়তে।”
-“তাহলে আমি কি ঝাড়ু দিতে এসেছি?”
-“আরেহ না! তা কেন হবে?”
-“তো জিজ্ঞেস করছেন কেন যে এখানে কি করছি?”
-“আচ্ছা আমার ভুল হয়েছে, আ’ম স্যরি।”
-“হুমম।”
-“আপনার সাথে আবার দেখা হয়ে ভালো লাগলো।”
-“কেন মিস করেছেন না’কি এতদিন আমাকে?”
-“না আমি ঠিক তা বুঝাতে চাই নি।”
-“বুঝেছি। এই নিন আবার দেখা হওয়ার খুশিতে চকলেট খান।”
-“ধন্যবাদ আপনাকে।”

স্নিগ্ধ মুচকি হেসে ক্যাডবেরিটা নিয়ে নিজের জায়াগায় ফিরে আসলো। সকাল আর স্নিগ্ধ এতক্ষণ আস্তে আস্তে কথা বলায় সকালের পাশে থাকা আফি ছাড়া আর কেউ কিছু শুনতে পায় নি। কিন্তু এভাবে সকালের সাথে এতক্ষণ স্নিগ্ধকে কথা বলতে দেখে অনেকেই অবাক হয়েছে। সকাল ভাবতেও পারে নি আবারও স্নিগ্ধর সাথে দেখা হবে। মনে মনে সকাল এত বেশি খুশি হয়েছে যা বলার বাইরে। স্নিগ্ধ সকালের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দিচ্ছে আর সবার সাথে কথা বলছে। সকাল তো এক ধ্যানে স্নিগ্ধর দিকেই তাকিয়ে আছে। ক্লাস শেষে স্নিগ্ধ বের হতেই সকাল আফির হাত ধরে দৌড়ে ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেল। স্নিগ্ধকে ফলো করতে যেয়ে দেখে স্নিগ্ধ অলরেডি প্যান্টের পকেটে দু’হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে একপাশে। সকাল আফিকে নিয়ে স্নিগ্ধর সামনে এসে দাঁড়ালো।

-“আমি জানতাম তুমি আমাকে ঠিক ফলো করবে ক্লাস শেষে।”
-“কিভাবে বুঝলেন? আর এক মিনিট! ‘আপনি’ থেকে ‘তুমি’ এত উন্নতি কিভাবে?”
-“ক্লাসে ছিলে বলে সবাইকে একই ভাবে সম্বোধন করেছি। এখন তো আমরা ক্লাসে নেই। তাই তুমি করে বললাম।”
-“আর আমি যে আপনাকে ফলো করব সেটা কিভাবে বুঝলেন?”
-“সিক্রেট। এনিওয়ে! তুমি তো না’কি রক্ত সহ্য করতে পারো না দেখে ডক্টর হওয়ার চিন্তা ছেড়ে দিয়েছিলে! তাহলে?”
-“আপনিই বলেছিলেন যে ডাক্তারি পড়লে না’কি উল্টো পাল্টা চিন্তা মাথায় কম আসে। তাই ডাক্তারিই পড়ছি।”
-“বাহ! এত মানো আমাকে?”
-“সে কথা ছাড়ুন। আগে বলুন আপনি বিয়ে-শাদি করেছেন?”
-“না।”
-“তাহলে গার্লফ্রেন্ড!”
-“কেন বলো তো!”
-“কিছু না। যাই হোক আসছি। আল্লাহ্ হাফেজ।”
সকাল গাল ফুলিয়ে চলে যেতে গেলে স্নিগ্ধ বললো,
-“এখনো সিঙ্গেল আছি। গার্লফ্রেন্ড বা বউ কোনোটাই পাই নি এখনো।”

স্নিগ্ধর দিকে না ঘুরে মুচকি হেসে কিছু না বলে সকাল আফিকে নিয়ে চলে গেল। স্নিগ্ধও ঠোঁটের কোণে নিজের হাসি বজায় রেখে মনে মনে বললো “সিরিয়াসলি পিচ্চিটা আমার কথা শুনে নিজের ইচ্ছে বাদ দিয়ে ডাক্তারি পড়ছে! স্ট্রেঞ্জ! ওকে দেখে যা বুঝলাম ও এখনো আমাকে পছন্দ করে। কিন্তু দু’বছরের বেশি হয়ে গেছে। এখনো পছন্দ করে এর মানে কি? ও মন থেকে পছন্দ করে আমাকে? না না এসব কি ভাবছি আমি! আমার মাথাটাও গেছে।” স্নিগ্ধ নিজের মাথাটা এপাশ-ওপাশ ঝাঁকিয়ে চলে গেল। সকাল আফিকে স্নিগ্ধর ব্যাপারে সব বলতে বলতে বের হলো। একটা মেয়ের সাথে হঠাৎ ধাক্কা লাগায় থেমে গেল সকাল। ভ্রু কুঁচকে সকাল বললো,
-“এভাবে মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন?”
-“স্নিগ্ধ স্যারকে কিভাবে চিনো তুমি?”
-“কেন জানতে চাইছো?”
-“তুমি আমাকে কোনো কুয়েশ্চন করবে না। তুমি শুধু আমার কুয়েশ্চনের অ্যান্সার দিবে।”
-“বাধ্য নই আমি। আমার রাস্তা ছাড়ো।”
-“আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে তুমি কোথাও যাবে না।”
-“লিসেন এটা আমার আর স্যারের পার্সোনাল ম্যাটার। তোমার জানার কোনো দরকার নেই।”
-“দরকার আছে।”
-“তাহলে অন্য কারও কাছ থেকে জেনে নাও। আমাকে ডিস্টার্ব করবে না।”

আফিকে নিয়ে বেরিয়ে গেল সকাল। স্নিগ্ধ সকালের দেয়া ক্যাডবেরিটা খেয়ে ওয়ালেট বের করে প্যাকেটটা সুন্দর করে ভাঁজ করে সেখানে রেখে দিল। এর আগেও সকাল যে ক্যাডবেরিটা দিয়েছিল তার প্যাকেটও রয়েছে ওয়ালেটে। সকাল এত বেশি খুশি হয়েছে স্নিগ্ধর সাথে দেখা করে যে বাসায় এসেই ও আইসক্রিমের বক্স নিয়ে বসে পরলো।
পরদিন সকাল কলেজে ঢুকে আফিকে দেখতে পেয়ে ওর সাথে ক্লাসে চলে গেল। সকালকে নাক মুছতে দেখে আফি জিজ্ঞেস করলো,
-“কিরে তোর ঠান্ডা লাগলো কিভাবে?”
-“গতকালকে… হাচ্চুউ…. আইসক্রিম… হাচ্চুউ…. বেশি খেয়ে ফেলেছিলাম… হাচ্চুউ…. তাও অতিরিক্ত… হাচ্চুউ…. ঠান্ডা ছিল যেটা… হাচ্চুউ…. সেটা… হাচ্চুউ…”
-“একদম ঠিক হয়েছে। বেশি এক্সাইটেডের ঠ্যালায় তুই নিজের সমস্যার কথা আইসক্রিমের সাথে গুলিয়ে খেয়ে ফেলেছিস।”
-“উফফ… হাচ্চুউ… ভাষণ দিস না তো… হাচ্চুউ…”

ক্লাস শেষ করে বের হতেই স্নিগ্ধর সাথে দেখা হয়ে গেল। স্নিগ্ধকে সালাম দিতে গিয়ে বেচারি সকাল হাঁচি দিতে দিতেই শেষ হয়ে গেল।
-“আ.. হাচ্চুউউ! আ.. হাচ্চুউউ… আস.. হাচ্চুউউ…”
-“আচ্ছা আচ্ছা আমি বুঝতে পেরেছি। ওয়ালাইকুমুস সালাম। কিন্তু তোমার এত ঠান্ডা লাগলো কিভাবে?”
-“আসলে… হাচ্চুউ… আমি… হাচ্চুউ…”
আফি বললো,
-“এই তুই থাম। আসলে সকাল কালকে আপনার সাথে দেখা হওয়ার খুশিতে ঠান্ডা ঠান্ডা আইসক্রিম বেশি খেয়েছে। তাই আজকে ওনারই ঠান্ডা লেগে গেছে।”
-“হায়রে পাগল…”
সকাল বললো,
-“আমার পা… হাচ্চুউ… গোল না… হাচ্চুউ…”
-“স্যরি মাই মিস্টেক। ওটা পাগল না পাগলি হবে।”
-“হুহ, হাচ্চুউ…”
-“আচ্ছা মিস বিকাল আমার সাথে আসো। আফি আপনিও আসুন।”
-“কো… হাচ্চুউ… কো… হাচ্চুউ… কো… হাচ্চুউ…”
-“চুপ! তোমার ‘কোথায়’ ওয়ার্ডটা বলতে বলতে দেখা যাবে আজকের পুরো দিন পাড় হয়ে যাবে। কিন্তু তারপরও তুমি বলতে পারবে না।”
-“আপনি… হাচ্চুউ… ইনসাল্ট… হাচ্চুউ…”
-“আমি তোমাকে ইনসাল্ট করছি না। এবার আসো আমার সাথে।”

সকাল আর আফি স্নিগ্ধর পেছন পেছন স্নিগ্ধর কেবিনে গেল। টেবিলের ড্রয়ার খুঁজে মেডিসিন বের করে একটা মেডিসিন সকালের হাতে দিয়ে পানির গ্লাসটা ধরিয়ে দিল স্নিগ্ধ। বললো,
-“খেয়ে নাও ঠান্ডা কমে যাবে।”
মেডিসিন খেয়ে পানির গ্লাসটা নামিয়ে রাখলো সকাল। স্নিগ্ধ মেডিসিনটা এগিয়ে দিয়ে বললো,
-“তিনবেলা খাওয়ার পর খাবে একটা করে। আশা করি কাল বা পরশুর মধ্যে তোমার ঠান্ডা চলে যাবে।”
-“আ… হাচ্চুউ…. আচ্ছা… হাচ্চুউ…”
-“হায়রে মেয়ে! তোমাকে যে কি বলবো বুঝতেই পারছি না আমি।”
-“হাচ্চুউ…”
-“আফি ওকে নিয়ে যান। ওর বিশ্রাম প্রয়োজন।”
-“আচ্ছা স্যার।”
-“আস… হাচ্চুউ…. আসি স্যা… হাচ্চুউ…”
-“হ্যা বুঝেছি। আসুন আসুন।”

সকাল অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে চলে গেল আফির সাথে। স্নিগ্ধ হাসতে লাগলো সকালের অবস্থা ভেবে। মেয়েটা পিচ্চির সাথে দুষ্টু তো ছিলই। এখন আবার পাগলামিও যোগ হলো। স্নিগ্ধ হাসতে হাসতে নিজের কাজে মন দিল। দু’দিন পর সকাল পুরোপুরি ভাবে ঠিক হলো। কলেজ থেকে এসে ঘন্টা খানেক বিশ্রাম নিয়ে আফিকে ফোন করে বললো বের হতে। শপিংয়ে যাবে ওরা। সকাল আফির বাসার সামনে থেকে আফিকে পিক করে নিলো।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here