সেই সন্ধ্যা পর্ব-৬

0
1715

#সেই_সন্ধ্যা
#সুমাইয়া_সিদ্দিকা_আদ্রিতা
#পর্ব_৬
.
যে লোকটি সকালের গলায় ছুরি ধরে ওকে নিয়ে যাচ্ছে! তাকে কেউ একজন পেছন থেকে লাথি মারতেই লোকটি সকালের কাছ থেকে সরে গেল। তখনি সকালের হাত ধরে টান দিয়ে সরিয়ে নেয় সকালকে। সকাল পাশে তাকিয়ে স্নিগ্ধকে দেখে স্বস্তি পেলো। সব গুন্ডারা একসাথে ওদের দিকে তেড়ে আসতেই সকালের বডিগার্ডরা এসে ওদের ধরে ফেলে। আফি এসে সকালকে জড়িয়ে ধরলো। স্নিগ্ধ বডিগার্ডদের দেখে আফিকে জিজ্ঞেস করলো,
-“এরা কারা?”
-“সকালের বডিগার্ডস।”
-“মিস বিকালের বডিগার্ডস! ওনারা এতক্ষণ কোথায় ছিল?”
-“আসলে সকাল ওনাদের বাইরেই দাঁড়িয়ে থাকতে বলেছিল। তাই ওনারা ভেতরের ঘটনার ব্যাপারে কিছু জানতেন না।”

সকাল হেঁচকি তুলে কাঁদছে এখনো। বেচারি এমনিতেই প্রচন্ড ভীতু। তার ওপর এমন একটা ঘটনা ঘটায় ও অনেক বেশি ভয় পেয়ে গিয়েছে। আস্তে করে নিজের হাতটা গলায় ছোঁয়াতেই ব্যাথায় কুঁকড়ে গেল ও। গলার কেটে যাওয়া অংশটুকু অসম্ভব রকমের জ্বালাপোড়া করছে। কথা বলার শক্তিটুকু পাচ্ছে না ও। হাতের দিকে তাকাতেই রক্ত দেখে ওর মাথাটা ঝিমঝিম করা শুরু করে দিল। জোরে জোরে দু-তিন বার শ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করতে লাগলো। শেষ পর্যন্ত আর সহ্য করতে না পেরে অজ্ঞান হয়ে গেল। আফি দ্রুত সকালকে ধরে নিচে বসে পরলো। আশেপাশে টিচার আর স্টুডেন্টদের ভিড় জমে আছে। স্নিগ্ধ চিন্তিত হয়ে সকালের পালস্ চেক করলো। আশেপাশে তাকিয়ে রাগী চেহারায় চিল্লিয়ে বলে উঠলো,
-“এখানে কি সার্কাস চলছে? এভাবে ভিড় করে আছেন কেন সবাই? যান যার যার কাজে যান। সাহায্য তো করবেনই না! উল্টো তামাশা দেখছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। যত্তসব রিডিকিউলাস্ পিপোল। ২ মিনিটের মধ্যে জায়গা খালি না করলে সবার কপালে দুঃখ আছে।”

স্নিগ্ধর হুমকি দিতে দেরি সাথে সাথেই যে যার মতো চলে গেল। চিন্তিত হয়ে সকালকে কোলে তুলে নিলো স্নিগ্ধ। আফির দিকে তাকিয়ে বললো,
-“মিস আফি!”
-“জ্বি স্যার।”
-“মিস বিকালের বাবা-মা’কে কল করে আসতে বলুন। ততক্ষণে আমি মিস বিকালকে হসপিটালে আমার চেম্বারে নিয়ে যাচ্ছি।”
-” আচ্ছা। কিন্তু স্যার ও অজ্ঞান কেন হয়ে গেল?”
-“ভয় পেয়ে অজ্ঞান হয়ে গেছে। চিন্তা করবেন না খুব শীঘ্রই ওনার জ্ঞান ফিরে আসবে।”
-“ঠিক আছে। আমি আঙ্কেল-আন্টিকে কল করে আসছি।”
-“হুম।”

হসপিটালের বেডে শুয়ে আছে সকাল। এখনো জ্ঞান ফিরে নি। পাশেই স্নিগ্ধ বসে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। “মেয়েটা এত কিউট কেন? চেয়েও কোনো খুঁত খুঁজে পেলাম না ওর ভেতরে। একদম নিখুঁত ভাবে তৈরি করেছে সৃষ্টিকর্তা ওকে।” এসব ভেবে মুচকি হাসলো স্নিগ্ধ। তখনি হুড়মুড় করে কেবিনে ঢুকলো সকালের বাবা-মা আর আফি। সকালকে দেখে ওর বাবা স্নিগ্ধকে জিজ্ঞেস করলেন,
-“আপনি….”
-“আমি ডক্টর স্নিগ্ধ।”
আফি বললো,
-“আঙ্কেল উনিই সকালকে বাঁচিয়েছেন ওই লোকগুলোর কাছ থেকে।”
-“আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ ডক্টর। মামনি কেমন আছে এখন?”
-“ভালো আছে। জ্ঞান ফিরলে তবেই বাসায় নিয়ে যেতে পারবেন।”
-“ঠিক আছে।”
সকালের মা স্নিগ্ধকে ভালো ভাবে পর্যবেক্ষণ করে বললেন,
-“প্রায় আড়াই বছর আগে সকালের যে অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিল তখন আপনিই তো সকালের অপারেশন করেছিলেন তাই না?”

স্নিগ্ধ মুচকি হেসে বললো,
-“জ্বি।”
-“আপনাকে যে কি বলে ধন্যবাদ দিব বুঝতে পারছি না। তখনো আমার সকালকে আপনি বাঁচিয়ে ছিলেন। এখনো আবার আপনিই ওকে বাঁচালেন।”
-“এটা আমার কর্তব্য।”

সকালের বাবা আরিফুল ইসলাম সকালের মা’কে সকালের কাছে থাকতে বলে বেরিয়ে গেলেন হসপিটাল থেকে। স্নিগ্ধ ওনার পেছন পেছন গেল। আরিফুল সোজা সকালের কলেজে ঢুকে বডিগার্ড গুলোর কাছে গেলেন। ওই লোক গুলোকে মাঠের মাঝখানে হাঁটু গেড়ে বসিয়ে হাত বেঁধে রেখেছে সকালের বডিগার্ডরা। সব গার্ডদের হাতে গান রয়েছে। আরিফুল লোক গুলোর মধ্যে একজনকে জিজ্ঞেস করলেন,
-“কে পাঠিয়েছে তোদের? বল কে পাঠিয়েছে নয়তো এখনি সব গুলো বুলেট তোদের এক একটার মাথায় ঢুকিয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় করে দিব।”

লোকগুলো ভয় পেয়ে গেল। তাদের ভেতর একজন বলে উঠলো,
-“না না মারবেন না। আমি বলছি সব।”
-“শীঘ্রই বল।”
-“জামান খান আমাদের পাঠিয়েছেন। উনি বলেছিলেন আপনার মেয়েকে যদি কিডন্যাপ করে ওনার হাতে সপে দিই তাহলে উনি বিনিময়ে আমাদের ৫০ লাখ টাকা দিবেন।”
-“জামান খান! আমার বিজনেস পার্টনার জামান খানের কথা বলছিস?”
-“জ্বি। উনিই বলেছিলেন আপনার মেয়েকে কিডন্যাপ করতে।”

আরিফুল ইসলাম রেগে বডিগার্ডদের দিকে তাকিয়ে বললেন,
-“ওদের থানায় নিয়ে যা। আর হ্যা! কমিশনারকে বলবি আমি বলেছি ওদের স্পেশাল খাতির-যত্ন করতে। আর রইলো বাকি জামান খান! ওকে তো আমি দেখে নিবো। আমার কলিজার টুকরো মেয়ের দিকে ও যেই হাত বাড়াতে চেয়েছে! সেই হাত তো আর আমি রাখতে দিব না। যা নিয়ে যা এদের। আর জামান খানকে আমার আস্তানায় নিয়ে আয়।”

আরিফুল ইসলাম কথা গুলো শেষ করে আবার সকালের কাছে চলে গেলেন। স্নিগ্ধ সবটা শুনে অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে হয়ে রইলো। সকালের জ্ঞান ফিরতেই ও চিৎকার করে লাফ দিয়ে উঠে বসলো। আরিফুল ইসলাম আর রেহেনা বেগম তাড়াতাড়ি সকালের কাছে এসে দাঁড়ালেন। বাবা-মা’কে দেখে সকাল শান্ত হলেও জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগলো। আফি পানি এগিয়ে দিল সকালের দিকে। এক নিমিষেই পানির গ্লাসটা খালি করে ফেললো। কিছু একটা বলতে চাইছিল সকাল। কিন্তু গলার ব্যাথার কারনে কথা বলতে পারছে না ও।আরিফুল বললেন,
-“এখন কোনো কথা বলো না মামনি। তোমার গলায় চোট লেগেছে। তাই দু-তিন দিন কোনো কথা বলা নিষেধ তোমার।”
রেহেনা বেগম বললেন,
-“তোমাকে বডিগার্ড দেয়া হয়েছিল সাথে রাখার জন্য। বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখার জন্য নয়। কি মজা পাও তুমি আমাদের টেনশনে ফেলে বলো তো!”

সকাল কাঁদো কাঁদো চেহারা নিয়ে আরিফুলের দিকে তাকাতেই আরিফুল ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে দিল রেহেনা বেগমকে। রেহেনা বেগম চোখ রাঙিয়ে তাকালো সকালের দিকে। সকাল ইনোসেন্ট ফেস বানিয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো মায়ের দিকে। স্নিগ্ধ কেবিনের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে সকালের চেহারা দেখে মিটিমিটি হাসছে। রেহেনা বেগমের দৃষ্টি স্নিগ্ধর ওপর পরতেই উনি বললেন,
-“আরে ডক্টর আপনি?”
-“হ্যা দেখতে আসলাম পেশেন্টের জ্ঞান ফিরেছে কি’না।”
-“জ্বি একটু আগেই ফিরেছে।”

স্নিগ্ধ সকালের চেক-আপ করে কিছু মেডিসিন লিখে ওকে রিলিজ করে দিল। সকালকে নিয়ে যেতে গেলে স্নিগ্ধ ওকে ডাক দিল। সকাল মুচকি হেসে পেছন ফিরে স্নিগ্ধর দিকে তাকাতেই স্নিগ্ধ বললো,
-“আপনি আগামী ৩-৪ দিন রেস্ট নিবেন বাসায়। মেডিক্যালে আসার দরকার নেই। এই ক’দিনের নোটস্ আমি রেডি করে দিব আপনাকে। বুঝেছেন!”

সকাল মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানিয়ে চলে যেতে গিয়ে পেছন ঘুরে হাত নাড়িয়ে টাটা দিল স্নিগ্ধকে। স্নিগ্ধও হেসে দিয়ে হাত নাড়িয়ে টাটা দিল। চলে গেল সকাল। দুই দিন পর থেকে সকালের গলার স্বর আবার আগের মতো হয়ে গেল। ঠিক মতো কথা বলতে পারে এখন। তবুও হালকা ব্যাথা হয় মাঝে মাঝে। স্নিগ্ধর কথা মতো ঠিক চার দিন পরে আজ সকাল মেডিক্যালে আসলো। আজকে আর বডিগার্ড বাইরে রেখে আসার মতো ভুল করে নি। আজকে বডিগার্ড গুলো ওর সাথেই আছে। যার ফলে সকালের বেশ আনকমফর্টেবল ফিল হচ্ছে। মুখ গোমড়া করে ক্লাসে এসে বসলো। আফিও আছে ওর সাথে। দু’জন বডিগার্ড ক্লাস রুমের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। আর বাকি বডিগার্ড গুলো পুরো মেডিক্যালে ছড়িয়ে ছিটিয়ে গার্ড দিচ্ছে। স্নিগ্ধ ক্লাসে ঢুকে সবার আগে সকালের কাছে গেল। সকাল মুচকি হাসলো ওর দিকে তাকিয়ে। স্নিগ্ধ মৃদু স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
-“এখন কেমন আছেন?”
-“পুরাই চড়ুই পাখির মতো ফুরফুরে।”
-“হ্যা তাই তো এখন আবার চরকার মতো ঘুরা শুরু করবেন। আগে যেমন করতেন ঠিক তেমন।”
-“হিহিহি…”
-“আচ্ছা এবার তাহলে ক্লাসে মনোযোগ দিন।”
-“ওক্কে ডাক্তার সাহেব।”
-“হুম।”

স্নিগ্ধ সকালের কাছ থেকে সরে ক্লাস নেয়ায় মনোযোগ দিল। ক্লাস শেষে সকাল আফির সাথে কথা বলতে বলতে বের হচ্ছিল। তখন স্নিগ্ধ সকালের সামনে এসে দাঁড়িয়ে ওকে বললো,
-“মিস বিকাল!”
-“সকাআআল।”
-“ওই হলো একটা।”
-“না হলো না। আমার নাম সকাল।”
-“আচ্ছা যাই হোক ফ্রি আছো আজকে?”
-“হ্যা, কেন?”
-“আই মিন এখন ফ্রি আছো?”
-“হ্যা।”
-“তাহলে আমার সাথে চলো।”
-“কোথায়?”
-“কফি খেতে।”

স্নিগ্ধর কথা শুনে সকাল ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইলো ওর দিকে। এমন কোনো কথা স্নিগ্ধর কাছ থেকে কখনো আশা করে নি ও। সকালের এমন চাহনি দেখে স্নিগ্ধ সব সময়কার মতো তার মনোমুগ্ধকর মুচকি হাসিটা দিল। যা দেখে সকালের বুকে এক অদ্ভুত কম্পন সৃষ্টি হলো।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here