#সেই_সন্ধ্যা
#সুমাইয়া_সিদ্দিকা_আদ্রিতা
#পর্ব_৪০
.
অসুস্থতার কারণে কলেজে যাওয়া হচ্ছে না বলে বাসায় বসেই পড়াশোনা করছে সকাল। খাটে বসে বালিশের সাথে হেলান দিয়ে হাতে বই নিয়ে পড়ছে সে। আজ তিনদিন হতে চললো সে কলেজে যায় না। এখন প্রায় অনেকটাই সুস্থ সে। স্নিগ্ধর সাথেও বর্তমানে পুরোপুরি ভাবে কন্টাক্ট বন্ধ। শুধু স্নিগ্ধর সাথে নয়, বাড়ির মানুষজন বাদে বাকি সবার সাথেই যোগাযোগ বন্ধ রেখেছে সকাল। ও ঠিক করেছে এখন থেকে পরীক্ষার সময় ছাড়া কলেজে যাবে না। কোচিং এ ভর্তি হয়ে সেখান থেকেই সব পড়া বুঝে নিবে। পড়ার মাঝেই আখি এসে খাওয়ার জন্য ডেকে নিয়ে গেল ওকে।
ডাইনিং টেবিলে বসে সবাই টুকটাক কথা বলছে আর খাবার খাচ্ছে। সকাল খাওয়া বাদ দিয়ে প্লেটে ভাত নিয়ে নাড়াচাড়া করছে। আরিফুল ইসলাম তা খেয়াল করে বললেন,
-“মামনি তুমি খাচ্ছ না কেন?”
-“আমি আসলে একটা কথা ভাবছিলাম পাপা।
-“দরকারি কিছু!”
-“পাপা আমি ভাবছি এখন থেকে আর মেডিকেলে যাবো না। শুধু পরীক্ষার সময় পরীক্ষা দিতে যাবো।”
পলক খাওয়া বাদ দিয়ে ভ্রু কুঁচকে বললো,
-“ডাক্তারী পড়া কি এত সোজা তোর কাছে! মেডিকেলে না গেলে যেই পড়াগুলো বুঝবি না সেই পড়াগুলো কীভাবে পড়বি?”
-“আমি কোচিং এ ভর্তি হবো। যা যা আমার লাগবে তা আমি সেখান থেকেই বুঝে নিবো। কিন্তু তা-ও মেডিকেলে যাবো না। ভালো লাগে না মেডিকেলে যেতে।”
-“আচ্ছা তাহলে আমি আগামীকাল খোঁজ নিয়ে দেখবো ভালো কোচিং কোথায় করায়।”
-“হ্যা আমিও তোমাকেই বলতাম খোঁজ নেওয়ার জন্য।”
-“এবার খেয়ে নে তাড়াতাড়ি।”
সকাল আর কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ খেতে লাগলো। আখি বেশ কিছুক্ষণ সকালের দিকে তাকিয়ে ওকে পর্যবেক্ষণ করলো। কিন্তু বুঝতে পারলো না আসলে সকালের মনে কি চলছে। সকাল খাবার শেষ করে উঠে চলে গেল। আখি আজ কিছুদিন ধরেই দেখছে সকাল কেমন যেন গুটিয়ে গেছে। প্রয়োজন ছাড়া কারও সাথে কথা বলে না। সারাদিন নিজের রুমেই থাকে। আখি বুঝতে পারে সকালের মনের অবস্থা ভালো নেই। কিন্তু কিছু বলতে পারে না। স্নিগ্ধকে সেদিন এত করে বোঝানোর পরও স্নিগ্ধ সকালের সাথে কথা বলেনি তা সকালের ভাবভঙ্গি দেখলেই বোঝা যায়। আখি খুবই চিন্তায় আছে স্নিগ্ধ আর সকালকে নিয়ে।
ওয়াশরুম থেকে ফ্রেস হয়ে বের হতেই ফোনের আওয়াজ কানে ভেসে আসলো সকালের। ওর ফোন বাজছে। তাওয়াল দিয়ে হাত মুছে টেবিল থেকে ফোনটা হাতে তুলে নিতেই দেখলো স্ক্রিনে ডাক্তার সাহেব নামটা জ্বলজ্বল করছে। সকাল চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইলো। একটু পরে কলটা কেটে গেল। সকাল ফোনটা সাইলেন্ট করে আবারও টেবিলে নামিয়ে রেখে দিল। ঘড়িতে সময় দেখে নিলো, এগারোটা তিন বাজে। চুলগুলো উঁচু করে কাটা দিয়ে খোঁপা করে নিলো। বইখাতা নিয়ে টেবিলে বসে পড়লো পড়াশোনা করার জন্য।
ফোন হাতে নিয়ে বসে আছে স্নিগ্ধ। এই পর্যন্ত বেশ কয়েকবার কল দিয়েছে সকালকে। কিন্তু সকাল তার কল রিসিভ করেনি। কলেজে যেয়েও এই ক’দিন সকালের দেখা পায়নি সে। সকাল যে ওকে ইগনর করছে তা বেশ ভালোই বুঝতে পারছে স্নিগ্ধ। আর এটাই তো স্বাভাবিক। ফোনটা পাশে নামিয়ে রেখে দু’হাতে মাথা নিচু করে চোখ বন্ধ করে মাথার চুলগুলো টেনে ধরে বসে রইলো।
স্নিগ্ধ অনেক ভেবেছে সকাল আর নীলামকে নিয়ে। যখনি সে ভেবেছে সকাল ওর আর নীলামের মাঝে এসেছে তখনি ওর মন বলেছে ও যা ভাবছে তা সম্পূর্ণ ভুল ভাবছে। সকাল তো স্বেচ্ছায় আসেনি ওর জীবনে। ও নিজে সকালকে আসার অনুমতি দিয়েছে। কেউ যদি কাউকে নিজের জীবনে আসার অনুমতি না দেয় তবে জোর করে হলেও কেউ তার জীবনে ঢুকতে পারেনা। তাহলে সকাল কি করে তার জীবনে জোর করে ঢুকতে পারে! ও বারবার ভেবেছে ও নীলামকে ভালোবাসে আর সকালকে শুধু পছন্দ করে। কিন্তু সেখানেও ওর মন বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সকালের কথা মনে পড়লেই ওর হৃদস্পন্দনগুলো প্রয়োজনের তুলনায় দ্রুত চলে। কিন্তু নীলামের ক্ষেত্রে আগে এমন হতো কিন্তু এখন হয় না। যে মানুষটা এই পৃথিবীতে নেই সে মানুষটার স্মৃতি আঁকড়ে ধরে কতদিন বাঁচা যায়! নীলামকে সে কথা দিয়েছিল সারাজীবন নীলামের পাশে থাকবে। নীলামও তাকে কথা দিয়েছিল সে-ও সবসময় স্নিগ্ধর পাশে থাকবে। কিন্তু নীলাম নিজের কথা রাখেনি। সে স্নিগ্ধকে ছেড়ে অনেক দূরে চলে গিয়েছে। যেখানে একবার কেউ গেলে আর ফিরে আসেনা সেই না ফেরার দেশে চলে গিয়েছে নীলাম।
এখন স্নিগ্ধর জীবনে সকাল আছে। সকাল ওকে ভালোবাসে। সকালের সাথে এতদিনের কাটানো মুহূর্তগুলো স্নিগ্ধর জীবনে সবচেয়ে সুন্দর মুহূর্তগুলোর ভেতরে অন্যতম। সকালের রাগ করে গাল ফুলিয়ে ফেলা, অভিমান করে কথা না বলা, ওকে হারানোর ভয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরা সব যেন স্নিগ্ধকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে যে ও সকালকে ছাড়া ভালো থাকতে পারবে না। ওর জীবন সকালকে ছাড়া অপূর্ণ। না চাইতেও সকালকে অনেকটা বেশি জায়গা দিয়ে ফেলেছে নিজের জীবনে। এখন আর সকালকে ছাড়া থাকা সম্ভব নয় ওর পক্ষে। এতে যদি নীলামের প্রতি অন্যায় হয় তো হোক। নিজে ধুঁকে ধুঁকে আর মরতে পারবে না। এতদিন নীলামের শূন্যতা ওকে কুঁড়ে কুঁড়ে খেয়েছে। কিন্তু এখন সকালকে হারিয়ে সে নিঃস্ব হতে পারবে না। বাকিটা জীবন সে নিজের অতীতে থাকা নীলামের স্মৃতি আঁকড়ে ধরে নয় বরং বর্তমানে তার জীবনে থাকা সকালকে নিয়ে বাঁচতে চায়। সকালের ভালোবাসায় নিজের অতীত ভুলতে চায়। নিজের বর্তমানকে নষ্ট করতে চায় না স্নিগ্ধ। যেভাবেই হোক সকালের সাথে দেখা করে কথা বলে এই দূরত্ব আর ভুল বোঝাবুঝি মিটিয়ে নিবে ও। সকালের সাথে আগে যেমন খুশি ছিল, তেমনি এর পরেও খুশি থাকতে চায় স্নিগ্ধ।
In CID Headquarter~
-“এই লাশটা মিস্টার নাজিমের হয়ে থাকলে বাকি দুটো লাশ অবশ্যই মিস্টার পাটোয়ারী আর মিস্টার রুবেলের হবে। কারণ কলেজ থেকে উনাদের তিনজনকে একসাথে বের করে দেওয়া হয়েছিল। আর খোঁজ নিয়ে জানা গিয়েছে সেদিনের পর থেকে উনারা তিনজনই নিখোঁজ।”
-“কিন্তু ম্যাম আমাদের কাছে কোনো প্রমাণ নেই যে বাকি লাশ দুটো মিস্টার রুবেল আর পাটোয়ারীর।”
-“উনাদের বাসার ঠিকানা তো পেয়েছো!”
-“জ্বি।”
-“বাসায় যাও। তল্লাশী করে দেখো কিছু পাও কি-না। আর হ্যা! মিস্টার পাটোয়ারী আর মিস্টার রুবেলের বাসা থেকে টুথব্রাশ বা চিরুনিতে থাকা চুল পেলে সেগুলো নিয়ে ফরেনসিক ল্যাবে পাঠিয়ে দিও। আই হোপ তাতে ডিএনএ ম্যাচ হয়ে যাবে। এতে করে আমরা আরও কিছু জানতে পারবো।”
-“ওকে ম্যাম আমরা এখনি দুটো গ্রুপ হয়ে উনাদের দুজনের বাসায় চলে যাচ্ছি।”
-“হুম ঠিক আছে। আমাকে আপডেট দিতে থাকবে।”
-“ওকে ম্যাম।”
শাহিন মিহুর কেবিন থেকে বের হয়ে যেতেই মিহু চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগলো। হাতের ব্যাথাটা বাড়ছে। বাসা থেকে বের হওয়ার সময় হাতে খুব জোরে বারি খেয়েছিল দরজার সাথে। যার ফল তখন তো বুঝতে পারেনি, কিন্তু এখন ঠিকই বুঝতে পারছে।
-“হাত থেকে তো রক্ত বের হচ্ছে! নিশ্চয়ই হাতে ব্যাথা পেয়েছিলে কিছুর সাথে!”
পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনে চোখ মেলে সোজা হয়ে বসলো মিহু। হাতের দিকে একবার তাকিয়ে দেখে আসলেই শার্টের উপর দিয়ে রক্ত ভেসে উঠেছে। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মেঘের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে মিহু বললো,
-“এটা অফিস আর আমি তোমার বস। সো কল মি ম্যাম, নট মিহু।”
-“প্লিজ এখন এসব কথা না বলি আমরা! আগে তোমার সুস্থতা জরুরি।”
-“আপনি ইনভেস্টিগেশনে যান। আমি ব্যান্ডেজ করে নিচ্ছি। আর প্লিজ নেক্সট টাইম থেকে রুলস ভঙ্গ করবেন না। আমার এসব পছন্দ না।”
-“সাট আপ! অনেক কথা বলেছো, এবার চুপ থাকো। আমার কাছে সবার আগে তুমি তারপর বাকিসব। ইনভেস্টিগেশনের জন্য আমি বাকিদের পাঠিয়ে দিয়েছি। এখন আর কোনো কথা বলোনা, নয়তো আমার মেজাজ খারাপ হলে তুমি জানো কি হতে পারে।”
মিহু রেগে কিছু বলতে গেলে মেঘ একহাতে মিহুর মুখ চেপে ধরলো। টেবিলের ড্রয়ার খুলে সেখান থেকে স্কচটেপ নিয়ে মিহুর মুখে লাগিয়ে দিল। মিহু বাম হাত দিয়ে মুখের স্কচটেপ খুলতে গেলে মেঘ সেই হাত ধরে চেয়ারের সাথে রুমাল দিয়ে বেঁধে দিল। ডান হাত আপাতত জখম থাকায় সেটা নাড়াতে কষ্ট হচ্ছে বলে চুপ করে বসে রাগী চোখে মেঘের দিকে তাকিয়ে রইলো মিহু। মেঘ বাঁকা হেসে উঠে যেয়ে কেবিনের দরজা লক করে এলো। ফার্স্ট এইড বক্স নিয়ে টেবিলের উপর নামিয়ে রেখে মিহুর চোখের দিকে তাকালো। মিহু বুঝতে পারছে এখন কি হতে চলেছে তা-ও বেশ অস্বস্তি লাগছে ওর। ও এদিক-ওদিক তাকিয়ে নিজেকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছে।
মিহুর দিকে ঝুঁকতেই মিহু চেপে চোখ দুটো বন্ধ করে নিলো। মেঘ এক এক করে ওর শার্টের বোতাম খুলে অর্ধেক শার্ট খুলে ফেললো। শার্টের ভেতরে হাতা কাটা কালো গেঞ্জি দেখে কিছুটা স্বস্তি পেলো মেঘ। এতক্ষণে ওর দম বন্ধ হয়ে ছিল। আস্তে করে মিহুর হাতের পুরোনো ব্যান্ডেজটা খুলে রক্ত পরিষ্কার করে ওষুধ লাগিয়ে নতুন ব্যান্ডেজ করে দিল। শার্ট ঠিক করে পড়িয়ে দিয়ে বোতামগুলো লাগিয়ে দিল মেঘ। মিহু জোরে জোরে কয়েকটা শ্বাস নিয়ে চোখ খুলতেই সামনে পানির গ্লাস দেখতে পেলো।
-“পানিটা খেয়ে নাও ভালো লাগবে। আর পেইন কিলার যেহেতু খেয়ে এসেছো তাই এখন খাওয়ার দরকার নেই।”
-“উমম…”
-“কি হলো ধরো!”
-“উমম…”
মিহু রাগী চোখে তাকালো মেঘের দিকে। মেঘ কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থেকে বুঝতে পেরে তাড়াতাড়ি করে মিহুর হাতের বাঁধন খুলে দিল। তারপর ধীরেসুস্থে মুখের উপর থেকে স্কচটেপ খুলে দিল। মিহু কিছু না বলে মেঘের হাত থেকে পানির গ্লাসটা নিয়ে ঢকঢক করে পানি খেয়ে নিলো। এই মুহূর্তে এই পানিটা ওর খুবই প্রয়োজন ছিল। হৃদস্পন্দন গুলো যে বেগে চলছে মনে হচ্ছে এখনি বেড়িয়ে আসবে। “এই ছেলেটা কেন এত কাছে আমার! না করলেও শুনতে চায় না। চূড়ান্ত পর্যায়ের ঘাড়ত্যাড়া ছেলে একটা। পঁচা ছেলে, লুচু ছেলে, বদমায়েশ ছেলে।” বিরবির করে কথাগুলো বলে আড়চোখে মেঘের দিকে তাকিয়ে দেখে মেঘ এখনো ওর দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
-“কি হয়েছে! আমাকে দেখোনি আগে কখনো? এভাবে কেন তাকিয়ে আছো?”
-“শাঁকচুন্নিদের রূপ ক্ষণে ক্ষণে বদলায় তো তাই দেখছি এখন কোন রূপে আছো।”
-“ইডিয়ট! বের হও আমার কেবিন থেকে। নাহলে কিন্তু আমি তোমার নামে স্যারের কাছে কমপ্লেইন করবো। আর তোমাকে এরপরের সকল কেস থেকে সাসপেন্ড করে দিব।”
-“এই না না না। তুমি তো ভালো মেয়ে, লক্ষ্মী মেয়ে। তোমার মতো কিউট আর মিষ্টি মেয়ে এই দুনিয়াতে আর একটাও নেই। এবার প্লিজ আমাকে সাসপেন্ড করো না। আমি এখনুনি চলে যাচ্ছি তোমার কেবিন থেকে।”
মেঘ দুটো ঢোক গিলে এক দৌড়ে বেরিয়ে গেল মিহুর কেবিন থেকে। এদিকে মেঘ বের হতেই মিহু হেসে ফেললো। মেঘের কিছু কিছু স্বভাব ওর ভীষণ ভালো লাগে। এই যে মেঘ যখন ওর দিকে ভীত চোখে তাকায় বা ওর কথায় ভয় পেয়ে পালিয়ে যায় তখন মিহুর খুব ভালো লাগে মেঘকে দেখতে। নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো মিহু। কেবিনের ভেতরের কাঁচের দেয়ালের বাইরে তাকিয়ে মেঘকে দেখে চেয়ারে মাথা হেলিয়ে দিয়ে ওকে দেখতে লাগলো।
চলবে….