সেলাই মেশিন
(৫)
মৌরি চেয়ারটা সামনে পেছন দিকে ঠেলে অনেকটা দোলনার মতো দোলাচ্ছিলো । হঠাৎ ভারসাম্য হারিয়ে চেয়ারটা পড়ে গেলো, তাতে মৌরি রুনুকে নিয়ে পেছনে পড়লো। বুকের ওপর ছোট্ট রুনুকে চেপে ধরে রাখলো মৌরি, যাতে রুনুর গায়ে ব্যাথা না লাগে। রুনুর কিছু হলো না, ও পিঠে প্রচন্ড ব্যাথা পেলো, কিন্তু রুনু ভয়ে কেঁদে উঠলো। কান্না শুনে চিলের মতো উড়ে এলো শাহেদা। মৌরির বুকের ওপর রুনুকে ওভাবে মেঝেতে পড়ে থাকতে দেখে সব বুঝে ফেললো । ছুটে এসে রুনুকে এক ঝটকায় কোলে নিয়ে মৌরির গালে ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দিলো। সেই প্রথম মৌরির গায়ে আঘাত করেছিল শাহেদা। মৌরির কাঁদছিলো, কিন্তু শাহেদা চিৎকার করে বলে চলেছিল, “তোমাকে না করছিলাম না, বাবুকে নিবা না? তাইলে কেন কোলে নিছো? ব্যথা দেয়ার জন্য ?”
দাদি সব বুঝতে পেরেছিলেন। মৌরি বাবার কাছে এসেও সারাদিন মনমরা হয়ে ঘুরে বেড়ায়। বাবা তার নতুন সন্তানকে নিয়ে বেশি ব্যস্ত, মৌরিকে দেখার সময় নেই। ওই ঘটনার পরে দাদি খুব বুঝতে পারছিলেন, এই বাড়িতে মৌরি কাংখিত নয়। কথা ছিল দাদি দাদা আর মৌরি দুই সপ্তাহ থাকবে, কিন্তু চারদিন পরেই মৌরিকে নিয়ে দাদি গ্রামে ফিরে এলেন। ফেরার পথে বাসে আদর করে কত কিছু বোঝালেন, “মৌরি পাখি, শোন। দুনিয়ায় কত বাচ্চা আছে যাদের দেখার কেউ নাই। ওই যে দেখ, এরা রাস্তায় ঘুমায়। আর তোরে দেখার জন্য তো আমি আছি, আছি না? তোর নতুন মা যত রাগ করবো , আমি তোরে ততই মায়া দিমু। এরপরেও তুই মুখটা এমন পাতিলের তলার মতো কালা কইরা রাখবি?”
“আমি তো কালা-ই দাদি।দেখছো না, নতুন বাবু কত সুন্দর।”
“এহ, কইলেই হইলো? তুই আমার চাঁদের মতো সুন্দর নাতনি। যে তোরে বলবো কালা, তারে আমি দিমু ডলা।”
দাদি ছন্দে ছন্দে কথা বলে মৌরির মন ভালো করার চেষ্টা করতেন। মৌরি প্রতিবার দাদির ছড়া শুনে হাসে, এবারও হেসে ফেললো। দাদি কত রং ঢং করে কথা বলে ওর মন ভালো করে দিতে পারে! মৌরি মন ভার করে থাকতেই পারে না।
গ্রামে ফিরে পড়ালেখা আর সেলাই শিক্ষা নিয়ে মৌরি ব্যস্ত হয়ে পড়লো। আসলে দাদিই তাকে নানান কাজে ব্যস্ত রেখে পুরোনো স্মৃতি ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করছিলো। স্কুলের পড়ার ফাঁকে সেলাইয়ের খুঁটিনাটি শেখায় নেশা ধরেছিলো মৌরিকে। পৃথিবীর এমন কোনো সেলাইয়ের কৌশল নেই যা ও শেখেনি। ওর করা নানা রকম সূচিকর্ম শোভা পেতে লাগলো জানালার পর্দায়, বালিশের কভারে কিংবা কাঁথার ভাঁজে। সেলাই মেশিনে দাদির অসংখ্য ব্লাউজ পেটিকোট আর দাদার পাঞ্জাবি সেলাই করে দিয়েছে মৌরি। দাদির কাছে কাপড় কাটা, মেশিনে সেলাই করা আর সূচিকর্ম খুব ভালো ভাবে রপ্ত করেছিল ও। তখন থেকেই দাদির সেলাই মেশিনের প্রতি প্রবল আগ্রহ।
মৌরি স্কুল থেকে আসার পরে কবির চাচার সাথে টুকটাক গল্প করার চেষ্টা করে। স্বভাবতই লোকটা কোন জবাব দেয় না, চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে। একদিন মৌরি স্কুল থেকে ফেরার পথে মসজিদের পেছনে পুকুর পাড়ে বসলো। ওখানে মাঝে মাঝে বসে মৌরি। খুব শান্ত স্নিগ্ধ পরিবেশ, পুকুরের চার পাশের ঝোপঝাড় পরিষ্কার করে রাখা। দুই পাশে আম গাছের নিচে বাঁধানো বেঞ্চ। মৌরি গাছের ছায়ায় ওখানে খানিকক্ষণ বসে, ঘুঘুর ডাক শোনে। একটু দূরে কবির তাকে পাহারা দেয়। তার চোখে মুখে এক ধরণের অস্থিরতা দেখা যায়, সময় মতো না ফিরলে খালাম্মা, মানে মৌরির দাদি রাগ করবে। মৌরি ওসব পাত্তা না দিয়ে কিছুক্ষন ওই জায়গাটায় বসে থাকে, মায়ের মুখটা মনে করার চেষ্টা করে। এলোমেলো ভাবনায় কিছুক্ষন মন ভাসিয়ে দেয়। ওর ভবিষ্যৎ কেমন হতে পারে, তা নিয়েও কিছুটা কল্পনা করে।
বসে থাকতে থাকতে ও কবিরের সাথে গল্প জুড়ে বসে।
“কবির চাচা, আপনি কি সত্যি আমার কথা শুনতে পান না?”
কবির কপাল কুঁচকে তাকিয়ে থাকে।
“আমার কিন্তু মনে হয় আপনে আমার কথা বুঝেন, কিন্তু ভাব ধইরা থাকেন যে বুঝেন না। আচ্ছা, আমি যা বললাম তা যদি আপনি বুইঝা থাকেন তাইলে একবার চোখের পলক ফেলেন।”
কবির কিছুই করলো না, একই ভাবে বিরক্ত মুখে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলো।
মৌরির মাথায় দুষ্টুমি ভর করলো। ও বললো, “কবির চাচা আমি এইবার পুকুরে নামবো, আপনি দাদিকে কিছু বলবেন না, ঠিক আছে?”
কবির তখনও একই ভাবে তাকিয়ে থাকলো।
মৌরি পুকুরের সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে লাগলো। কবির এবার একটু শংকিত ভঙ্গিতে এগিয়ে এলো। মৌরি সাঁতার জানে না। একেবারে শেষ ধাপে পৌঁছাতেই কবির হাউহাউ শব্দ করে ছুটে এলো। তার চোখে মুখে চরম আতংক। মৌরি হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়লো। কবির তার হাত ধরে টেনে নিয়ে বাড়ির পথ ধরলো। মুখে তখন অদ্ভুত “আও আও” শব্দ করছিলো। এই প্রথম কবির চাচার কণ্ঠ থেকে কোনো শব্দ নিঃসৃত হতে শুনলো মৌরি।
এরপর থেকে ওর আরেক নেশা তৈরী হলো। কবির চাচাকে কথা শেখানোর। প্রতিদিন স্কুলের পরে পুকুর পাড়ে বসে মৌরি বিভিন্ন শব্দ উচ্চারণ করে কবিরকে শেখানোর চেষ্টা করে। কবির সেই “আও আও” ছাড়া কিছুই বলতে পারে না।
সময় দ্রুত পেরিয়ে যায়। মৌরি মেট্রিক পরীক্ষা দিয়ে খুব ভালো ভাবে পাশ করলো। ওর পরীক্ষার ফল শুনে দাদা দাদির সে কী আনন্দ! কবির চাচা সারা গ্রামে ছুটোছুটি শুরু করলেন, যাকে দেখেন আও আও করে মৌরির পরিক্ষার ফলের কথা জানানোর চেষ্টা করেন। কেউ কিছুই বোঝে না, তাতে কবির চাচার উৎসাহে ভাঁটা পড়ে না। এই গ্রামে এত ভালো ফল কয়জন করে? বাড়িতে মিষ্টি নিয়ে এলেন দাদা, আসে পাশের কয়েক বাড়িতে বাটিতে করে মিষ্টি পাঠানো হলো। মৌরি সেদিন বাবার জন্য অপেক্ষা করলো। বাবাকে তো ফলাফল জানানো হয়েছে, বাবা নিশ্চয়ই আসবে। মৌরি গভীর রাত পর্যন্ত উঠানে বসে রইলো। বার বার মনে হচ্ছিলো বাবা এক বাক্স মিষ্টি নিয়ে হাজির হবে, এসে বলবে, দেখ তো মা, কেমন সারপ্রাইজ দিলাম। কিন্তু বাবা এলো না, রুনুর নাকি খুব অসুখ।
মৌরি নিজেও জানে না কখন ওর চোখ বেয়ে অশ্রু নেমে আসছে। কবির চাচা আচমকা কোথা থেকে উদয় হতেই লজ্জায় চোখ মুছলো মৌরি। চাচা নিচু গলায় বিড়বিড় করলো।
মৌরির সামনে মাটিতে উবু হয়ে বসে ওর দিকে গভীর মনোযোগে দেখতে লাগলো।
“কি চাচা? কিছু বলবেন?”
কবির চাচা একবার চোখ বন্ধ করে খুললেন। তার মানে হ্যা। এতদিনে মৌরির সাহায্যে ইশারা ইঙ্গিতে কথা বলার কৌশল ভালোভাবে রপ্ত করেছে কবির। ইশারা করে বললো সে আজকে অনেক খুশি।
মৌরি হেসে ফেললো। কবির চাচা ইশারা করে বললো মৌরি যেন আরো অনেক পড়ে, পড়ে ডাক্তার হয়। তখন কবিরের গলার অপারেশন করে যেন ভালো করে তোলে।
“ডাক্তার! কী যে বলেন চাচা। ডাক্তার হওয়া কি মুখের কথা? আমি গ্রামের স্কুলে পড়লাম, হয়তো গঞ্জের কলেজেই পড়তে হইবো। ডাক্তার হইতে গেলে শহরে যাইতে হইবো। অনেক টাকা লাগবো। কেমনে হইবো এত কিছু?”
কবির মুখ শক্ত করে গোৎ জাতীয় শব্দ করে আবার ইশারায় বললো, মানুষ চাইলে সব পারে। না চাইলে কিছুই পারে না। মৌরি যেন উচ্চাশা না ছাড়ে। কবির তার উপর অনেক আশা করে। তার বিশ্বাস, মৌরি অনেক নামকরা ডাক্তার হবে।
মৌরির কেমন বুক ফেটে কান্না আসছিলো। তার বাবা এই কথাগুলো আজকে বলতে পারতো না? গ্রামের এই মূর্খ লোকটা কত সুন্দর করে ইশারায় কত কিছু বলে দিলো! স্নেহের সম্পর্কের এই বন্ধন অস্বীকার করার কোন উপায় নেই।
মৌরি ম্লান হেসে বললো, “ঠিক আছে চাচা, আমি খুব চেষ্টা করবো ডাক্তার হইতে। যদি না পারি তাইলে কিন্তু আপনি মন খারাপ করবেন না। মনে করবেন যতোটুকু পড়ছি, নিজের সব শক্তি দিয়েই পড়ছি, চেষ্টার ত্রুটি করি নাই। ঠিক আছে?”
কবির দুই হাত তুলে ইঙ্গিত করে বোঝালো, সে খুশি। তারপর লুঙ্গির গিট থেকে একটা পুঁতির মালা বের করে মৌরির হাতে দিলো, ভালো ফলাফলের জন্য পুরস্কার।
মালা হাতে নিয়ে মৌরি হুহু করে কেঁদে ফেললো। ওই মালাটা এখনো মৌরি যত্ন করে নিজের কাছে রেখে দিয়েছে।
(ক্রমশ)