সেলাই মেশিন – (৭)

সেলাই মেশিন

(৭)
————-
এতদিন নিজের মধ্যে লালন করা স্বপ্ন ভেঙে যাওয়ার যন্ত্রনায় পুরোপুরি ভেঙে পড়েছিল। দুইদিন নিজের ঘর থেকেই বের হলো না। চুপচাপ নিজের খাটের ওপর বসে ছিল, শুকনো খাবার খেয়ে চালিয়ে নিয়েছে ওই দুদিন। কাঁদেনি, শুধু শুন্যতায় নিজেকে ভাসিয়ে দিয়েছিলো। তৃতীয়দিন হোস্টেলের সুপারভাইজার খালা এসে দরজায় ভীষণ শব্দ করে ডাকাডাকি করতে লাগলো, “এই মাইয়া, দুইদিন ধইরা ঘরের ভিতরে কী করো? জলদি বাইর হও নাইলে কিন্তু দরজা ভাইঙা ফেলবো। নিচে তোমার সাথে দেখা করতে কে জানি আসছে। এখনই বাইর হও।”

মৌরি চমকে উঠে দরজা খুলে বের হলো। ওর সাথে দেখা করতে কে আসতে পারে? কৌতূহলী হয়ে নিচে বসার ঘরে গিয়ে দেখে বাবা বসে আছে! মৌরির মনে হলো অসীম অন্ধকার শুন্যতায় একটা ক্ষুদ্র আলোর রেখা দেখতে পেয়েছে। ছুটে গিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরে দুইদিন পর ব্যর্থতার অশ্রু চোখ বেয়ে নেমে এলো। বাবা প্রথম খানিকক্ষণ কিচ্ছু বললেন না। মৌরি একটু শান্ত হওয়ার পরে বললেন, “এইটুক মানুষ তুই, একা একা এতদূর চইলা আইলি? আমারে কিছুই জানাইলি না?”
মৌরি চোখ মুছে নিচু গলায় বললো, “জানাইলে কী হইতো? তুমি আমার জন্য কী করতা?”
“এইটা কী বললি মা? আমি তোর জন্য তেমন কিছুই করতে পারি নাই, নানান সমস্যা ছিল, ছোট একটা চাকরি করি, চাইলেও অনেক কিছু করতে পারি না। কিন্তু তাই বইলা একা একা এইখানে ক্যামনে চইলা আইলি? এখন কানতেছস ক্যান? কী হইছে?”
“মেডিক্যালে পড়ার কত ইচ্ছা নিয়ে আসছিলাম, দাদারে কত আশা দিছি কিন্তু চান্স পাই নাই বাবা।”
“এখন কাইন্দা লাভ আছে? ঢাকায় চান্স হয় নাই তো কী হইছে? আমার এইখানে চইলা আয়। গতমাসে আমার প্রমোশন হইছে, বেতন বাড়ছে। রুনুর শরীর এখন আগের চেয়ে ভালো। এখন বাসায় থাকলে তোর কষ্ট হইবো না।”
“না বাবা, আমি ওই বাসায় আর যামু না। একদিন অনেক আশা নিয়ে গেছিলাম, সেদিন আমারে রাখতে পারো নাই। এখন নিজের ব্যবস্থা আমি নিজেই করমু।”
“পাগল মাইয়া! তখন অনেক ঝামেলা ছিল রে মা। তখন আমার বাড়িতে থাকলে তোর কষ্ট হইতো।”
“আমার কষ্টের চেয়ে বেশি কষ্ট তোমার হইতো বাবা। তাই আমি আর কথা বাড়াই নাই, সোজা গ্রামে ফেরা গেছি। আর ওইখানে যামু না বাবা। সামনে ঢাকা ইউনিভার্সিটির পরীক্ষা। একটা না একটা সাবজেক্টে তো চান্স পামুই। তারপর আর সমস্যা হইবো না। ”
“তোর কী মনে হয় ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে চান্স পাওয়া এতোই সোজা? সারা বাংলাদেশে সবচেয়ে ভালো ছাত্র ছাত্রী এই পরীক্ষা দেয়ার জন্য প্রিপারেশন নিতেছে। তোর মতো হাজার ছাত্র ছাত্রী আশা কইরা বইসা আছে, সে চান্স পাবে। এর মধ্যে তুই যদি চান্স না পাস?
“তাইলে সোজা আবার দাদির কাছে চইলা যাবো। আমাদের কলেজে বিএ করা যায়, ওইটাই করবো। তারপর যা হয় দেখা যাইবো।”
বাবা চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে বললেন, “এত বড় শহরে একা ক্যামনে থাকবি? শহরে কত কিছু ঘটে, কত খরচ!”
“দাদা প্রতি মাসে কিছু টাকা পাঠাইবো বলছে, আর আমি দেখি কোনো ছোটমোট কাজ জোগাড় করতে পারি কিনা। এইখানে মেয়েরা টিউশনিও করে।”
“থাক, যদি এইখানেই পড়োস তাইলে আর অন্য কিছু কইরা সময় নষ্ট করিস না। আমিও তোরে কিছু টাকা পাঠায় দিমুনে। আগে দেখ কই ভর্তি হইতে পারোস।”
“টাকা লাগবো না বাবা।” অভিমান ভরা কণ্ঠে বললো মৌরি। “খালি আমার জন্য দোয়া করো, ভালো একটা জায়গায় যেন পড়তে পারি।”

মৌরির অভিমান বাবা ঠিকই টের পেলেন। “এত জিদ করিস না রে মা। আমার জায়গায় হইলি বুঝতি। যাই হোক, তোর জন্য একটা জিনিস আনছি।”
বাবা পকেট থেকে একটা মোবাইল ফোন বের করে মৌরির হাতে দিলেন। “একটু পুরান ফোন। আমার কলিগ ফরহাদ সাহেবের ছেলে কাতার চইলা গেলো, যাওয়ার আগে পুরান ফোন রাইখা নতুন ফোন কিনছে। ফরহাদ সাহেব অল্প দামে ছেলের পুরান ফোনটা বিক্রি করলো। নতুন ফোন তো মা কিনতে পারতেছি না, আপাতত এই ফোনটা রাখ। আমার ফোন নাম্বার সেভ করা আছে। কোনো সমস্যা হইলেই আমারে ফোন দিস।”

মৌরি ফোন নিয়ে খুব একটা উচ্ছাস দেখালো না। কাকে ফোন করবে? বাবাকে ফোন করে কোন সমস্যার কথা জানালে কি বাবা আদৌ কিছু করতে পারবে?

বাবা সেদিন মৌরিকে নিয়ে সারাদিন ঘুরলেন। জাদুঘর দেখলেন, নিউমার্কেট থেকে মৌরিকে নতুন সালোয়ার কামিজ কিনে দিলেন, কিছু খাবার দাবার কিনে দিলেন- বিস্কিট, চাপাতা, চিনি, মুড়ি। বাবার সাথে ঘুরতে ঘুরতে মৌরির মনে হলো এমন আনন্দের দিন বহুদিন পরে ফিরে এলো। ছোট বেলায় বাবা ছুটির দিনে মৌরিকে নিয়ে ঘুরতে বের হতেন। শাহেদার সাথে বিয়ের কিছুদিন পরে সেটা বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো।

সন্ধ্যায় বাবা বিদায় নিলেন। নিজের ঘরে ফিরে মৌরি সমস্ত হতাশা ঝেড়ে ফেললো। ব্যর্থতার সাথে বন্ধুত্ব করার গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা পেয়েছিলো মৌরি। অসহায় হয়ে পড়ে থাকলে কেউ ঘুরেও দেখবে না, সবার দয়ার পাত্র হয়ে জীবন পার করতে হবে। অতএব দুঃখবিলাস করার সময় নেই ওর। এক সপ্তাহ পরেই ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি পরীক্ষা। মৌরি ভালো পরীক্ষা দিলো আর রেজাল্ট হওয়ার পরে দেখা গেলো ইকোনোমিক্সে পড়ার সুযোগ পেয়েছে। এই বিষয়ে পড়ার কোন পরিকল্পনায় ওর নেই, এমনকি এই বিষয়ে কিছু জানেও না। কিন্তু দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা এমন যে সবসময় ইচ্ছেমতো বিষয়ে পড়ার সুযোগ পাওয়া যায় না। মৌরি আর দ্বিতীয়বার ভাবলো না , ইকোনোমিক্সে ভর্তি হয়ে গেলো।

ভর্তি হওয়ার কিছুদিন পরে ইউনিভার্সিটির হলে জায়গা পেলো তবে নিচতলার কমন রুমে। কত জায়গার কত রকম মেয়েদের সাথে পরিচয় হলো! জগৎ অনেক বড় মনে হতে লাগলো মৌরির। কত রকম সমস্যা মানুষের, কত রকম কষ্ট, বাধা পেরিয়ে এসেছে মেয়েরা! জীবনটাকে ধীরে ধীরে অন্যভাবে দেখতে শুরু করে। ভাবনার জগৎ প্রসস্থ হয়। ক্লাসে মনযোগ দেয় মৌরি, সম্পূর্ণ অচেনা বিষয়ে জানার আগ্রহ তৈরী করে নিজের মাঝে। একসময় বিষয়টাকে উপভোগ করতে শুরু করে। অংকে ও আগে থেকেই ভালো, মাইক্রোইকোনোমিক্স আর স্ট্যাটিসটিকস বুঝতে ওর বেশি বেগ পেতে হলো না। তাছাড়া সময় পেলেই লাইব্রেরিতে নানা রকম বই ঘাটাঘাটি করতে ওর ভালো লাগতো।

তবে অর্থ কষ্ট ওকে দারুন ভাবে পীড়া দিতো। প্রতিটা পয়সা খরচ করতে হতো হিসাব করে।ক্লাসের অনেক মেয়ে সুন্দর কাপড় পরে সাজগোজ করে পরিপাটি হয়ে ক্লাসে আসতো কিন্তু মৌরির হাতে গোনা তিন চারটা কাপড় ছাড়া পরার মতো কিছু ছিল না। এর মাঝে হুটহাট কিছু খরচ চলে আসতো। যেমন একজন শিক্ষক অবসরে যাচ্ছেন, তার ফেয়ারওয়েল করতে সবাই চাঁদা দিচ্ছে, মৌরি পড়তো ভীষণ বিপাকে। বন্ধুরা মিলে সিনেমা দেখতে যাবে, মৌরি মানা করে দিতো। আশেপাশের মেয়েরা ধীরে ধীরে বুঝতে পারলো মৌরি আসলে অনেক কিছুতেই নিজেকে যুক্ত করতে পারে না টাকার অভাবে। ধীরে ধীর মৌরী দলছুট হয়ে যাচ্ছিলো। একসময় মনে হতে থাকে জীবনটা পুরোপুরি উপভোগ করতে আসলে টাকার বিকল্প নেই।

একদিন রুমমেট বন্ধু সিমলা খুব অস্থির হয়ে রুমে এলো। তার হাতে একটা শপিং ব্যাগ। কি হয়েছে জানতে চাইলে বললো সন্ধ্যায় শিল্পকলায় একটা অনুষ্ঠানে ও উপস্থাপনা করবে। শাড়ি পড়ার কথা কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে দর্জি ব্লাউজটা ভুল সেলাই করে দিয়েছে, গায়ে ঢোকে না এমন টাইট। একটু আগেই দর্জির কাছে ছুটে গিয়েছিলো, গিয়ে দেখে দর্জির দোকান বন্ধ। এখন কিভাবে শাড়ি পরবে সেই চিন্তায় তার মুখ অন্ধকার। মৌরি বললো, সুই সুতা দিলে ও ব্লাউজ ঠিক করে দেবে।

সিমলা ছুটে দিয়ে কোথা থেকে যেন সুই সুতা নিয়ে এলো। সিমলাকে অবাক করে দিয়ে মৌরি ঝটপট ব্লাউজের সেলাই খুলে সাইজে ঠিকঠাক করে আবার সেলাই করে দিলো। ব্লাউজ পরে সিমলা হতভম্ব! এত সুন্দর ফিটিং করে দিয়েছে মৌরি!
“এইসব ব্লাউজ সেলাই আমার জন্য কোনো ব্যাপারই না। ব্লাউজ, কামিজ সেলওয়ার পেটিকোট সব সেলাই জানি।”
“বলো কী?” উত্তেজিত শিমলা চিৎকার করে বললো।
“হুম, একটা সেলাই মেশিন থাকলে সব সেলাই এইখানেই করতে পারতাম।”
পরদিন থেকে পুরো হলে প্রচার পেয়ে গেলো মৌরি সেলাই করতে জানে। অনেকেই টুকটাক সেলাই কাজের জন্য মৌরির কাছে অনুরোধ নিয়ে আসে আর সময় পেলে মৌরীও কাজ করে দেয়।খুলে যাওয়া সেলাই ঠিক করে দেয়া, সামান্য ছেড়া কাপড়ে রিফু করে দেয়া, ঢোলা জামা ফিটিং করে দেয়ার কাজগুলো নিখুঁত পারতো মৌরি। এভাবে দলছুট হতে হতে মৌরি আবার সবার প্রিয়জন হয়ে দাঁড়ায়। মৌরি সেলাই জানে বলে মেয়েদের মাঝে ভীষণ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

পুজোর ছুটিতে দাদির কাছে গেলো মৌরি। দাদার শরীর বেশ খারাপ করেছে। মৌরিকে দেখেই বলতে লাগলেন, “কত আশা দিয়া গেলো ডাক্তার হবি, সেইটার কী হইলো?”
মৌরি বিচলিত না হয়ে বললো, “এখন যা পড়তেছি, এইটাও খারাপ না দাদা। অনেক বড় চাকরি করবো, অনেক টাকা হইবো।”
দাদা ম্লান হেসে বললেন, “এত টাকা দিয়া কি করবি? টাকার পিছে ঘুরিস না, পাগল হইয়া যাবি।”
“তাইলে কিসের পিছে ঘুরবো দাদা?” হাসতে হাসতে বললো মৌরি।
“কিসের পিছে ঘুরবি, জানি না। তয় দোয়া করি তুই যেন অনেক সুখী মানুষ হইতে পারোস। মা চইলা যাওয়ার দুঃখ যেন তোর না থাকে। কত কষ্ট কইরা ঢাকায় থাকস, ওইসব কষ্ট যেন ভুইলা যাস। ”
“এত কষ্ট কইরা পড়তেছি তো টাকা কামাই করার জন্য, তাই না?”
“না না, এতো টাকা টাকা করা ভালো না। শান্তি থাকে না। তোর পড়া শেষ হইলেই একটা ভালো পোলা দেইখা বিয়া করায় দিমু। তোর সংসার দেখমু। সুখে থাকতে গেলে এত টাকা লাগে নারে।”
“তাইলে কী লাগে?”
দাদা কিছুক্ষন কী যেন ভাবলেন। তারপর বললেন, “আচ্ছা, এখন মাথায় আইতেছে না। পরে মনে হইলে বলবো।”

দাদা অবশ্য মৌরির সুখের সংসার দেখে যেতে পারেননি। পুজোর ছুটির পর হলে ফিরে আসার কিছুদিন পরেই দাদা মারা গেলেন। তার সুখী হবার মন্ত্র আর জানা হলো না।

(ক্রমশ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here