হুংকার পর্ব-২

0
1067

#হুংকার
#শোভা_আক্তার(লাভলী)
#পর্ব_২

দরজার পাশে মোস্তফা দাঁড়িয়ে আছে। মোস্তফা রাবেয়ার কথা শুনে অবাক হয়ে বলল,
“আমি?”
রাবেয়ার নিশ্বাস আটকে গেল। লম্বা লম্বা নিশ্বাস নিচ্ছে। রশিদ দ্রুত দৌড়ে এসে বলল,
“আপনারা বাহিরে যান রাবেয়ার প্যানিক অ্যাটাক হচ্ছে।”
উর্মি উঠে দাঁড়াল। রাবেয়াকে অক্সিজেন মাস্ক পড়িয়ে ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে দিলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই রাবেয়া ঘুমিয়ে পরলো। রশিদ সবাইকে আইসিইউ থেকে বের করে দিলো।

মোস্তফা এমন মানুষ না। সবাই তাকে ভীষণ বিশ্বাস করে। কিন্তু রাবেয়া তাকে কেন ইশারা করলো? উর্মি এলোমেলো হয়ে আছে। চুপচাপ চেয়ারে বসে কপালে হাত দিয়ে রেখেছে। মোস্তফা উর্মির সামনে হাঁটু গেড়ে বসে তার হাত ধরে বলল,
“উর্মি বিশ্বাস করো৷ রাবেয়ার কোথাও ভুল হচ্ছে।”
ইয়ামিন রাগী কন্ঠে বলল,
“তোমাকে আমার আগে থেকেই অপছন্দ। দেখলেন আব্বু, বলেছিলাম না এই ছেলের সাথে উর্মির বিয়ে দিয়েন না?”
মোস্তফা বলল,
“ইয়ামিন বিশ্বাস করো আমি রাবেয়ার ক্ষতি করি নি।”
“রাবেয়া মিথ্যে বলেছে?”
“রাবেয়ার ভুল হচ্ছে। ও এখন ট্রমার মাঝে আছে। তো ভুল হওয়া কি স্বাভাবিক না?”
“ধ*র্ষিতা তার ধ*র্ষককে চিনতে কখনোই ভুল করবে না।”
উর্মি ধমকের স্বরে বলল,
“চুপ থাকবে তোমরা? প্লিজ আল্লাহর ওয়াস্তে চুপ থাকো। মেয়েটার অবস্থা দেখে কি মায়া হচ্ছে না তোমাদের? আমাদের সাথে বেড়ে ওঠা মেয়েটার উপর দিয়ে আজ কেয়ামত যাচ্ছে। প্লিজ চুপ থাকো তোমরা।”
বলেই উর্মি কেঁদে উঠল। রশিদ আইসিইউ থেকে বের হয়ে বলল,
“এটা হসপিটাল, আপনারা প্লিজ চুপ থাকুন। আর আইসিইউ’র বাহিরে এত মানুষের ভীর আমরা এলাও করি না। আপনারা প্লিজ এখন চলে যান।”
রমজান সাহেব কান্নাজড়িত কন্ঠে বললেন,
“আমার মেয়েকে এই অবস্থায় রেখে কিভাবে যাব?”
“আন্টিকে যে কেবিনে রাখা হয়েছে সেখানে চলে যান। উনি হঠাৎ ঘুম থেকে উঠে পারলে চিন্তিত হবেন। আপনারা উনাকে সামলাতে পারবেন।”
তখনই ইলিয়াস দৌড়ে আসলো। সে যখন এসেছিল একটা নার্স তাকে ঔষধ নিয়ে আসতে বলেছিল। ঔষধের প্যাকেট রশিদের দিকে এগিয়ে দিয়ে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল,
“সব ঔষধ নিয়ে এসেছি। রাবেয়া কেমন আছে ভাইয়া?”
রশিদ উত্তর দিলো না। প্যাকেট হাতে নিয়ে আইসিইউ’র ভেতরে চলে গেল। ইলিয়াস সবার দিকে চোখ বুলিয়ে বলল,
“কি হলো? কি বলেছে রাবেয়া?”
ইয়ামিন আড়চোখে মোস্তফাকে দেখে বলল,
“রাবেয়া বলেছে মোস্তফা তার রে*পিস্ট।”
ইলিয়াস অবাক হওয়ার শেষ পর্যায়ে চলে গেল। উর্মি দাড়িয়ে রাগী কন্ঠে বলল,
“অনেক হয়েছে। মোস্তফা নির্দোষ।”
“তার মানে রাবেয়া বানিয়ে বলছে।”
“রাবেয়া মোস্তফার নাম নেয় নি। আর ভুলে যেয়েন না ভাইয়া আপনিও দরজার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন।”
ইয়ামিন কপাল কুঁচকে ফেলল। সুলতান সাহেব ধমকের স্বরে বলল,
“কুকুর বিড়ালের মতো ঝগড়া করতে ভালো লাগে তোমাদের? রাবেয়া কারো নাম নেয় নি। তাই একে অপরকে দোষারোপ করা বন্ধ করো।”
উর্মি বলল,
“এটা আপনার ছেলেকে বুঝান। মোস্তফার নামে আর একটা অপবাদ শুনলে আমার থেকে খারাপ আর কেও হবে না।”
বলেই উর্মি হনহন করে চলে গেল। তার পিছু মোস্তফা গেল। রমজান সাহেব ফুঁপিয়ে কাঁদছেন। সুলতান সাহেব উনার পাশে বসে বললেন,
“তুমি চিন্তা করো না রমজান। আমরা সবাই আছি রাবেয়ার পাশে। ও তো তোমার একা মেয়ে না। আমিও তাকে নিজের মেয়ে ভাবি। কেও তার সম্মান নিয়ে একটা প্রশ্ন করার দুঃসাহস পর্যন্ত করতে পারবে না।”
“ভাইজান, আমি আমার মেয়ের সম্মান নিয়ে চিন্তা করছি না। আমার মেয়ের কিছু হয়ে গেলে আমরা দুই বুড়ো বুড়ি ম*রে যাব।”
বলেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন রমজান সাহেব। ইলিয়াস চোখের পানি মুছে বলল,
“আংকেল আমি ওয়াদা করছি। রাবেয়ার ধ*র্ষককে আইন ছেড়ে দিলেও আমি ছাড়বো না।”
ইয়ামিন এক ভ্রু উঁচু করে বলল,
“কি করবি শুনি?”
ইলিয়াস ইয়ামিনের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তখনই দেখে নিও।”

————

আলী হাত আড়াআড়ি ভাবে ভাজ করে দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মাথা কাজ করছে না তার। চোখ বন্ধ করে ভাবতে লাগলো দরজার পাশে কে কে দাঁড়িয়ে ছিল তখন। মোস্তফা দরজার পাশে ছিল ঠিক। কিন্তু মোস্তফা এই কাজ করতে পারে না। উর্মির জন্য মোস্তফা পানি নিয়ে এসে পাশে বসলো। মাথা তুলে আলীকে দেখে বলল,
“কি ভাবছিস তুই?”
আলীর ঘোর ভাঙলো। মোস্তফার দিকে তাকিয়ে বলল,
“তোর সাথে কি কেও দাঁড়িয়ে ছিল?”
“না, কিন্তু ইয়ামিন আমার পেছনে দাঁড়িয়ে ছিল।”
উর্মি পানি পান করছিল। মোস্তফার কথা শুনে অবাক হয়ে বলল,
“আমার ভাইয়ের উপর সন্দেহ করো না। হ্যাঁ উনি বদমেজাজি। সবসময় উল্টাপাল্টা কথা বলে। কাওকে সম্মান করতে জানে না। তাই বলে এই না যে উনি এত নিচে নেমে যাবে।”
আলী বলল,
“রাবেয়া নাম নেয়নি কারো। আচ্ছা আরো কিছুদিন অপেক্ষা করা যাক। রিপোর্টও আসা বাকি। রাবেয়া যত পর্যন্ত নাম না বলবে আমি কাওকে এরেস্ট করতে পারবো না।”

জীবনে যখন পরীক্ষার সময় আসে। তখন ধৈর্যের অধ্যায় পড়তে হয়। রাবেয়াকে ঘুমের ইনজেকশন দেয়ার পর আর ঘুম থেকে উঠেনি। রিপোর্ট এসে পড়েছে। রশিদ রিপোর্ট দেখে হতাশ। যেমনটা ভেবেছিল, রাবেয়ার গণধ*র্ষণ হয়েছে। রশিদ রিপোর্ট নিয়ে কেবিনে গেল। সবাই সেখানে বসে আছে। রাবেয়ার আম্মুকে উর্মি সামলাচ্ছে। রশিদকে দেখে সবাই আগ্রহী হয়ে তাকাল। রশিদ মাথা নিচু করে ধীরপায়ে এগিয়ে আসলো। মোস্তফা ভীতু গলায় বলল,
“কি হলো রশিদ? রাবেয়া ঠিক আছে তো?”
রশিদ মাথা তুলে বলল,
“রাবেয়ার গণধ*র্ষণ হয়েছে”
এমন পরিস্থিতিতে কি বলবে কি করবে কেও বুঝতে পারছে না। রাবেয়ার মা থমকে বসে আছেন। বাবাও তব্দা খেয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। আলী বলল,
“রাবেয়ার জ্ঞান ফিরতে কতক্ষণ লাগতে পারে?”
“এটা আমি বলতে পারবো না৷ তার অবস্থা তত পর্যন্ত ভালো যত পর্যন্ত সে ঘুম। কারণ ঘুম থেকে উঠলেই বিভিন্ন কথা ভাবতেই তার অ্যাটাক হয়।”
“কিন্তু ডক্টর রশিদ আমার তার স্টেটমেন্ট নেয়া খুব প্রয়োজন।”
“আমি জানি। কিন্তু তার প্রাণ বাঁচাতে হলে আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। তার জ্ঞান ফিরলে আপনারা তার সাথে হাসিখুশি থাকার চেষ্টা করবেন।”
আসফিয়া বেগম চোখের পানি মুছে বললেন,
“জি জি রশিদ তুমি ঠিক বললে। আ..আমার মেয়ে যদি আমাদের কাঁদতে দেখে আরো কষ্ট পাবে।”
রশিদ হতাশা নিয়ে চলে গেল। সাথে আলীও গেল কেসের সম্পর্কে কিছু কথা বলার জন্য। সবাই নিজেদের মতো আবার অপেক্ষা করতে লাগলো রাবেয়া ঘুম থেকে উঠার।

করিডরের চেয়ারে বসে আছে উর্মি। সে ইয়ামিনের কথা ভাবছে। রাবেয়া ইয়ামিনকে দেখলে কেন পাগলামি করলো তখন? ইয়ামিন কি এমন কাজ করতে পারে? মোস্তফা ইলিয়াসের সাথে কথা বলতে বলতে এগিয়ে আসলো। উর্মিকে চিন্তিত দেখে ইলিয়াস উর্মির পাশে বসলো। উর্মির হাত ধরতেই উর্মি চমকে ইলিয়াসের দিকে তাকাল।
“চিন্তা করিস না। রাবেয়া ঠিক হয়ে যাবে।”
উর্মি নড়েচড়ে বসে বলল,
“ইন শাহ আল্লাহ, ভাই সবাই না খেয়ে আছে। গিয়ে সবার জন্য খাবার নিয়ে আয়।”
“ইয়ামিন ভাইয়া অলরেডি সবার জন্য খাবার নিতে গিয়েছে।”
“ওহ”
মোস্তফা বলল,
“তোমরা একটা বিষয় নোট করেছো?”
তারা দুজন মোস্তফার দিকে তাকাল।
“রাবেয়া ইয়ামিনকে না। পুরুষ মানুষ দেখলেই পাগলামো করে।”
ইলিয়াস বলল,
“কিন্তু আইসিইউ’র ভেতরে তখন রশিদ ভাইয়াও ছিল তাই না? তো ভাইয়াকে দেখে তো রাবেয়া পাগলামো করেনি।”
উর্মি লম্বা নিশ্বাস ফেলে বলল,
“আমি কিছু বুঝতে পারছি না। ইলিয়াস, ভাইয়া এমন কাজ করতে পারে?”
“ভাইয়া ছোটোবেলা থেকে রাবেয়াকে দু চোখে সহ্য করতে পারে না। তাই বলে ভাইয়া এই কাজ করবে? না রে, ভাইয়ার উপর আমার ভরসা আছে।”
দূর থেকে হঠাৎ ইয়ামিনের কন্ঠ ভেসে আসলো,
“মনে হচ্ছে রাবেয়া নাটক করছে।”
তারা সবাই ইয়ামিনের দিকে তাকাল। ইয়ামিন পকেটে হাত দিয়ে তাদের দিকে হেটে এসে আবার বলল,
“আর তোমরা হয়তো ভুলে যাচ্ছো রাবেয়া আমাকে না মোস্তফাকে দেখে পাগলামো করেছে।”
উর্মি বিরক্ত হয়ে বলল,
“ভাইয়া আমি আপনাকে রিকুয়েস্ট করছি চলে যান এখান থেকে।”
“ভাই থেকেও বেশি এখন এই পরপুরুষ?”
“পরপুরুষ ছিল। এখন সে আমার হবু স্বামী। তার সম্পর্কে একটা বাজে কথা আমি সহ্য করবো না।”
ইয়ামিন মোস্তফার দিকে তাকিয়ে তালিচ্ছ্যের হাসি দিয়ে বলল,
“কি যাদু করেছো আমার বোনের উপর। তুমি রে*পিস্ট হলেও তোমার উপর অন্ধের মতো বিশ্বাস করবে।”
উর্মি দাঁড়িয়ে ইয়ামিনের চোখে চোখ রেখে বলল,
“হ্যাঁ আমি তাকে অন্ধের মতো বিশ্বাস করি। সে মানুষটাই এমন। আপনাকে চিনতে আমার ভুল হয়েছে ভাইয়া। আপনি ভাই বলে আমি ভাবতে পারছি না আপনি রাবেয়ার রে*পিস্ট। কিন্তু, যদি রাবেয়া…”
উর্মি পুরো কথা শেষ করার আগেই ইয়ামিন দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“ইয়ামিন হোসেনের এতোও বাজে দিন আসে নি ওই মেয়েকে ছুঁয়ে দেখবে। ওর প্রতি আমার কোনো কালেই ইন্টারেস্ট ছিল না। তো এমন আজেবাজে অপবাদ দেয়া বন্ধ করো।”
ইলিয়াস দাঁড়িয়ে উঁচু স্বরে বলল,
“থামো তোমরা। এখন আমাদের সম্পর্কের মাঝেও কি ফাটল তৈরি করবো আমরা? আমরাই যদি এভাবে একে অপরের সাথে ঝগড়া করতে থাকি তাহলে রাবেয়া ধ*র্ষক তো পাড় পেয়ে যাবে।”
“তোমার বোনকে বোঝাও। আর একবার যদি আমার উপর সন্দেহের আঙুল তুলে, ভুলে যাব ও আমার আপন বোন।”
বলেই ইয়ামিন হনহন করে চলে গেল। মোস্তফা হাতমুঠো শক্ত করে ইয়ামিনের যাওয়ার পথে তাকিয়ে আছে। উর্মি লম্বা নিশ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত করলো।

মোস্তফা উর্মিকে নিয়ে বাহিরে বের হয়েছে। উর্মির মানসিক যন্ত্রণা হচ্ছে বেশি ভাবতে ভাবতে। সময়টা এখন বিকাল। রোদ নেই আকাশে। হালকা হালকা ঠান্ডা বাতাস বইছে চারপাশে। উর্মি হাত আড়াআড়িভাবে ভাজ করে মোস্তফার পাশাপাশি হাঁটছে। দুজনই চুপ। কিন্তু এই নিরবতা খারাপ লাগছে না তাদের। আবার প্রিয় মানুষটা পাশে থাকার পরও চুপ থাকাটা কি ভালো দেখায়? মোস্তফা নিরবতা ভাঙলো।
“চলো রেস্টুরেন্ট গিয়ে কিছু খাওয়া যাক। তুমি রাত থেকে না খেয়ে আছো।”
“আমার গলা দিয়ে খাবার নামবে না মোস্তফা।”
“এভাবে তো তুমিও অসুস্থ হয়ে পরবে। তুমি অসুস্থ হয়ে পরলে তো আমার কষ্ট হবে জানো না?”
উর্মি দাঁড়িয়ে ভ্রু কুঁচকে মোস্তফার দিকে তাকাল। মোস্তফাও দাঁড়িয়ে উর্মির চাহনি দেখে বলল,
“আমি ভুল কিছু বললাম?”
“হুম, তুমি থাকতে আমি অসুস্থ হতে পারি?”
মোস্তফা শব্দ করে হাসলো। উর্মি মুচকি হাসলো তার হাসি দেখে। হাত বাড়িয়ে মোস্তফার বাম হাত জড়িয়ে ধরে কাঁধে মাথা রেখে লম্বা নিশ্বাস ফেলল। বেশ শান্তি অনুভব হয় মানুষটা পাশে থাকলে। মোস্তফা উর্মির কপালে থাকা চুলগুলো সরিয়ে বলল,
“আমাকে বিশ্বাস করার জন্য ধন্যবাদ।”
“যে সম্পর্কে অবিশ্বাস সৃষ্টি হয় সেই সম্পর্কের কোনো মূল্য থাকে না। আমি জানি তুমি কেমন। আর আমি এটাও জানি তুমি গতকাল তোমার কাজে ব্যস্ত ছিলে। তুমি রাবেয়াকে বোনের মতো দেখো। তো তোমার উপর সন্দেহ কিভাবে করি?”
মোস্তফা উর্মির কপালে চুমু দিয়ে বলল,
“ভালোবসি উর্মি।”
উর্মি মাথা তুলে মোস্তফার দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমারো জবাব দিতে হবে?”
মোস্তফা মুচকি হেসে না সূচক মাথা নাড়াল।

রাবেয়ার অবস্থা কিছুটা ভালো হয়েছে। ২২ ঘন্টার পর তার ঘুম ভেঙেছে। রশিদ ইচ্ছে করেই তাকে হাই পাওয়ারের ঘুমের ইনজেকশন দিয়েছিল। কারণ সে খুব ভয় পায় জেগে থাকলে। মাথায় আঘাত লেগেছে। বেশি চিন্তা করলে ব্রেইন স্ট্রোক হতে পারে। আলী পারছে না তার স্টেটমেন্ট নিতে। রশিদ কোনো পুরুষ মানুষ ভেতরে যেতে দেয়নি। রাবেয়ার মা-ও শুধু একবার মেয়ের সাথে দেখা করেছে। তাকে সেই ঘটনা নিয়ে কোনো প্রশ্ন করা হয়নি এখনো। প্রশ্ন করলে যদি প্যানিক অ্যাটাক হয়? রাত ২ টা বাজে এখন।মোস্তফা বাসায় চলে গিয়েছিল। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আবার হসপিটাল এসেছে। সুলতান সাহেবকে জোর করে ইলিয়াস বাসায় দিয়ে এসেছে। রমজান সাহেব আর আসফিয়া বেগমকেও বলেছিল৷ কিন্তু উনারা কোনো মতেই মেয়েকে একা রেখে যাবেন না। রাবেয়া তো উনাদেরই কলিজার টুকরা তাই কেও জোর করেনি।

রাবেয়া ধীরে ধীরে চোখ খুলে তাকাল। এদিক সেদিক চোখ বুলিয়ে দেখে পাশে একজন নার্স বসে বই পড়ছে। রাবেয়া নিচু স্বরে বলল,
“আপু, আমাকে একটু পানি দেয়া যাবে?”
নার্স বই রেখে রাবেয়ার দিকে তাকাল। বেশ মায়া হলো উনার রাবেয়ার অবস্থা দেখে। দ্রুত গ্লাসে পানি ঢেলে বেড উঁচু করে নিলো। রাবেয়া ঠিক মতো হা করতে পারছে না। ঠোঁটের চারপাশে ক্ষত। নার্স একটা চামচ নিয়ে রাবেয়াকে একটু একটু করে পানি পান করাচ্ছে। পানি পান করে রাবেয়া বলল,
“আমার আম্মু কোথায়?”
“আপনার পুরো পরিবার বাহিরে।”
“আমার আম্মুকে ডেকে দেবেন। উনাকে দেখতে ইচ্ছে করছে।”
“জি আমি ডাকছি।”
“আমার আব্বুকে আসতে না বলবেন প্লিজ।”
“আপনার আব্বু ছটফট করছে আপনাকে দেখার জন্য।”
রাবেয়া কান্নাজড়িত কন্ঠে বলল,
“আমি পারবো না আমার আব্বুকে মুখ দেখাতে। উনার মানসম্মান রক্ষা করতে পারি নি আমি।”
রাবেয়ার চোখ বেয়ে পানি পরলো। নার্স আর কিছু বলল না। উনি বুঝতে পরলো রাবেয়ার অনুভূতি। উনি বাহিরে গিয়ে রাবেয়ার আম্মুকে ডাকলেন। আসফিয়া বেগম দ্রুত আইসিইউ’র ভেতরে গেলেন। রাবেয়াকে মাকে দেখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। আসফিয়া বেগম মুখে হাসি ফুটালো। মেয়ের সামনে কান্না করা যাবে না। উনি হেটে এসে রাবেয়ার পাশে বসলেন। রাবেয়া যখন জন্ম হয়েছিল সবাই বলতো এটা মানুষ না। এটা তো একটা ছোট্ট পরী। বেশ সুন্দর দেখতে৷ চেহারায় এখনো সেই ছোটোবেলার নূর ছেয়ে আছে। চেহারার বিভিন্ন জায়গার ক্ষতের দাগ। সেই পিশাচদের কি একটুও মায়া হয়নি উনার মেয়ের উপর? আসফিয়া বেগম আলতো করে মেয়ের গালে হাত রাখলেন। রাবেয়া বলল,
“আব্বু কি আমার উপর রেগে আছে আম্মু?”
“না তো, তোমার আব্বু তো অপেক্ষায় আছে। তুমি সুস্থ হলে আমরা সবাই বাসায় যাব।”
“আমি বাসায় যাব না।”
“আমরা তো তোমার সাথে আছি।”
“আম্মু..আম্মু ও আবার আমাকে বোকা বানিয়ে নিয়ে যাবে।”
“কে? কে নিয়ে যাবে তোমায়?”
রাবেয়ার গলা ধরে আসলো। বলবে নাম? যদি নাম বললে মে*রে ফেলে? সে তো বলেছিল তার সম্পর্কে কাওকে বলবেই তার বাবা মা সবাইকে মে*রে ফেলবে।

মোস্তফা আর উর্মি হসপিটাল ফিরে আসলো। এসে শুনে রাবেয়ার জ্ঞান ফিরেছে। উর্মি রশিদের কাছ থেকে পারমিশন নিতে গেল ভেতরে যাওয়ার জন্য। ইয়ামিন জানতো না রাবেয়ার জ্ঞান ফিরেছে। জানার পর সে এক মুহূর্ত দাঁড়াল না। দৌড়ে গেল আইসিইউ’র দিকে। কপাল বেয়ে ঘাম ঝরছে তার। ইয়ামিনকে যেতে দেখে মোস্তফা আর ইলিয়াসও তার পেছনে গেল তাকে থামাতে। রশিদ পুরুষদের যেতে না বলেছে তবুও ইয়ামিন যাচ্ছে। তারা ইয়ামিনকে পেছন থেকে অনেকবার ডেকেছে কিন্তু ইয়ামিন থামেনি। মোস্তফা অবাক হলো। ইয়ামিন রাবেয়ার জ্ঞান ফেরা নিয়ে এত চিন্তিত কেন। ইয়ামিন দ্রুত আইসিইউ’র ভেতরে গেল। রাবেয়া ফুঁপিয়ে কাঁদছে আসফিয়ারের হাত ধরে। ইলিয়াস আর মোস্তফা দৌড়ে আসলো। মোস্তফা ইয়ামিনের হাত ধরে বলল,
“কি করছো? তুমি শোনো নি রশিদ কি বলেছে?”
কথা বলার শব্দ শুনে রাবেয়া দরজার দিকে তাকাল। তাকাতেই ভয় পেয়ে গেল। আসফিয়া বেগমের হাত খামচে ধরে বলল,
“আম্মু ও এসেছে। ও আবার এসেছে।”
আসফিয়া বেগম তাদের দিকে তাকাল। ইলিয়াস বলল,
“কে রাবেয়া? নাম বলো তার।”
“আমার কাছে আসবে না বলে দিলাম।”
রাবেয়ার চিৎকার চেচামেচি শুনে রশিদ আর উর্মি দৌড়ে আসলো। রাবেয়া হাতের স্যালাইন টেনে খুলে ফেলল। উঠে বসে বিছানায় থাকা বালিশ নিয়ে ছুঁড়ে মারলো। বালিশ লাগলো ইয়ামিনের বুকে। ইয়ামিন শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রাবেয়ার দিকে। আসফিয়া বেগম পারছে না মেয়েকে সামলাতে। উর্মি দৌড়ে গেল। রাবেয়া বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে শান্ত করার চেষ্টা করছে। রশিদ নার্সকে বলল রাবেয়াকে আবার ঘুমের ইনজেকশন দিতে। কিন্তু লো পাওয়ারেরটা। ইয়ামিন ঝুঁকে বালিশ নিয়ে এগিয়ে আসলো। রাবেয়া উর্মিকে আরো শক্ত করে বলল,
“আপু ওকে যেতে বলো।”
উর্মি পেছনে ঘুরে দেখে ইয়ামিন দাঁড়িয়ে আছে। উর্মির চোখ বেয়ে পানি পরলো ভাইকে দেখে। নার্স রাবেয়াকে ঘুমের ইনজেকশন দিলো। রাবেয়া চিৎকার করে কাঁদছে। কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পরলো। উর্মি রাবেয়াকে শুইয়ে দিয়ে শরীরে চাদর টেনে দিলো। ইয়ামিন কাছে এসে উর্মির দিকে বালিশ এগিয়ে দিয়ে বলল,
“ওর মাথার নিচে বালিশ দাও।”
উর্মি খোপ করে ইয়ামিনের হাত থেকে বালিশ নিয়ে বলল,
“বের হোন আপনি এখান থেকে। আপনার চেহারা পর্যন্ত দেখতে চাই না আমি।”
ইয়ামিনের দৃষ্টি রাবেয়ার দিকে। আসফিয়া বেগম ইয়ামিনকে সজোরে ধাক্কা দিয়ে বলল,
“দূর থাকো আমার মেয়ের থেকে।”
ইয়ামিন দু কদম পিছিয়ে গেল। কিন্তু তার দৃষ্টি রাবেয়ার উপর থেকে সরছে না। ইলিয়াস এসে ইয়ামিনকে টেনে বাহিরে নিয়ে গেল।
“ভাইয়া, আপনি কি সত্যি রাবেয়াকে…?”
ইলিয়াস পুরো প্রশ্ন করতে পারলো না। ইয়ামিন ধীরপায়ে এগিয়ে গেল। ইলিয়াস আবার বলল,
“কোথায় যাচ্ছেন ভাইয়া?”
“তাহাজ্জুদ পড়তে।”
ইয়ামিন এলোমেলো পায়ে হেটে হসপিটাল থেকে বেরিয়ে গেল। ইলিয়াস থমকে দাঁড়িয়ে আছে। মোস্তফা আর উর্মি বের হলো আইসিইউ থেকে। উর্মি রাগে গজগজ করছে। মোস্তফার দিকে তাকিয়ে বলল,
“তোমার বন্ধু আলী কোথায়?”
“থানা গিয়েছে।”
“আসতে বলো”
“কেন?”
উর্মি সামনে তাকিয়ে বলল,
“তাকে বলো এসে ইয়ামিন হোসেনকে এরেস্ট করে নিয়ে যেতে।”

চলবে…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here