হুংকার পর্ব_১

0
1878

সন্তান যখন সময়ের মতো বাসায় না ফেরে, তখন বাবা মায়ের উপর দিয়ে কি যায় এটা একমাত্র উপর ওয়ালা এবং সেই বাবা মা-ই বুঝতে পারেন। ঘড়ির কাটা নিজ গতিতে আগাচ্ছে। সময়কে ধরে রাখা অসম্ভব। রাত ১১ টা বাজতে চলল কিন্তু রাবেয়া এখনো বাসায় ফেরে নি। রমজান সাহেব কপালে হাত দিয়ে সোফায় বসে আছেন মাথা নিচু করে। উনার মেয়ে কখনো এমন করে না। বেশ লক্ষী তো উনার মেয়ে। রমজান সাহেব মাথা তুলে উনার স্ত্রী আসফিয়া বেগমের দিকে তাকালেন। স্বামীর চাহনি দেখে উনি মোবাইল নিয়ে আবার রাবেয়ার নাম্বারে কল করলেন। না, নাম্বার এখনো বন্ধ। হলরুমে এগিয়ে আসলেন রমজান সাহেবের পাড়ার প্রতিবেশী সুলতান সাহেব। চিন্তিত কন্ঠে বললেন,
“মেয়ের খবর পেয়েছো রমজান?”
রমজান সাহেব মাথা নিচু রেখেই “না” উত্তর দিলেন। ধীরপায়ে এগিয়ে আসলেন সুলতান সাহেবের মেয়ে উর্মি।
“রাবেয়ার সব বান্ধবীদের কল করে জিজ্ঞেস করলাম। সে কারোর বাসায় নেই।”
আসফিয়া বেগম ধপ করে সোফায় বসলেন। উনার রূহ বেরিয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। উনার একমাত্র মেয়ে হঠাৎ করে এভাবে উধাও হয়ে গেল কেন? উর্মি এগিয়ে এসে উনার সাথে বসে বলল,
“আন্টি, ভাইয়ারা আসুক। দেখে নিয়েন তারা ঠিক রাবেয়াকে খুঁজে নিয়ে আসবে।”
সুলতান সাহেব ঝাঁজালো কন্ঠে বললেন,
“কোথায় ওই দুই হাঁদারাম। তারাও এখনো বাসায় ফেরে নি।”
“আব্বু, ইয়ামিন ভাইয়ার আজ খুব জরুরি মিটিং আছে। উনি বলেছেন আমাকে আজ ফিরতে খুব রাত হবে। আর ইলিয়াস হয়তো বন্ধুদের সাথে বাহিরে।”
সুলতান সাহেব রাগে গজগজ করতে লাগলেন। বাড়ির মেয়ে উধাও আর উনার ছেলেরা নিজেদের কাজে ব্যস্ত।

বেশ কিছুক্ষণ পর কলিংবেল বাজার শব্দ আসলো। সবার বুক ধুকপুক করে উঠল। হয়তো রাবেয়া এসেছে। উর্মি দৌড়ে গেল। দরজা খুলে দেখে ইলিয়াস দাঁড়িয়ে আছে। বাহিরে ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি পরছে। ইলিয়াস রাগী কন্ঠে বলল,
“তোরা এই বাসায় আর আমি বাসায় গিয়ে কলিংবেল বাজিয়ে চলেছি কেও খুলছেই না।”
সাধারণ দিন হলে উর্মি ইলিয়াসের ১২ টা বাজিয়ে দিতো। কিন্তু এখন চিন্তিত বলে কিছু বলল না৷ চুপচাপ সরে দাঁড়াল। ইলিয়াস কিছুটা অবাক হলো। উর্মি তো তাকে ছেড়ে দেয়ার মতো পাবলিক না। ধীরপায়ে সে ভেতরে প্রবেশ করে দেখে সবার চিন্তিত মুখ। উর্মির দিকে তাকিয়ে ইশারায় জিজ্ঞেস করে কি হয়েছে। উর্মি মন খারাপ করে বলল,
“রাবেয়া এখনো বাসায় ফেরে নি।”
ইলিয়াস চোখ বড়ো বড়ো করে ফেলল। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল,
“এখনো না? কোচিং তো ৫ টায় শেষ হয়। আর এখন রাত ১১ টা বাজে।”
“সেটাই তো। যা না ভাইয়া খুঁজে নিয়ে আয় মেয়েটাকে।”
“হ্যাঁ যাচ্ছি, ইয়ামিন ভাইয়া কোথায়?”
“ভাইয়ার তো আজ খুব জরুরি মিটিং আছে।”
“ভাইয়া নিজেকে কাজের সাগরে ডুবিয়েই মা*রবে।”
বলেই ইলিয়াস আবার বেরিয়ে গেল।

রাত সাড়ে ১২ টা। উর্মি দরজার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। রাবেয়ার পরিবার তাদের প্রতিবেশী। ছোটোবেলা থেকে তারা পাশাপাশি বাসাতে থাকে। খুব ভালো সম্পর্ক দুই পরিবারের মাঝে। উর্মির মা ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মা*রা গিয়েছেন প্রায় ৭ বছর আগে। স্ত্রী ম*রে যাওয়ার পর সুলতান সাহেব বেশ ভেঙ্গে পরেছিলেন। তখন রমজান সাহেব আর উনার স্ত্রী-ই ব্যবসা, সংসার সামলাতো। উনাদের একমাত্র মেয়ে রাবেয়া। আর সুলতান সাহেবের তিন ছেলে মেয়ে। বড়ো ছেলে ইয়ামিন আর ছোটো জমজ ছেলে মেয়ে ইলিয়াস আর উর্মি। আসফিয়া বেগমের সন্তান হচ্ছিল না। উনি সুলতান সাহেবের ছেলে মেয়েকে নিজের সন্তানের মতো দেখেন। উর্মি ও ইলিয়াসের জন্মের ৪ মাস পর উনি জানতে পারেন উনি মা হতে চলেছেন। উর্মি আর রাবেয়া দেড় বছরের ছোটো বড়ো। উর্মি রাবেয়াকে নিজের ছোটো বোনের মতো ভালোবাসে।

হঠাৎ উর্মির মোবাইল বেজে উঠল। স্ক্রিনে চোখ বুলিয়ে দেখে প্রিয় মানুষটার নাম ভাসছে। রিসিভ করে কানে ধরলো,
“হুম”
“রাবেয়ার খবর পেয়েছো?”
“না, তুমি কোথায় এখন?”
“বাসায় যাচ্ছি”
“আসতে পারবে?”
“এই সময়? আব্বু কিছু বলবে না?”
“উঁহু, উনি জানেন আমার সবচেয়ে বড়ো মেন্টাল সাপোর্ট তুমি। মোস্তফা আমি নিজেকে সামলাতে পারছি না।”
“উর্মি রিলাক্স। আমি আসছি, এখনই আসছি।”
“আমি রাবেয়াদের বাসায় আছি।”
“ওকে আমি আসছি”
উর্মি কল কেটে দাঁড়িয়ে রইল।

বেশ কিছুক্ষণ পর মেইন দরজা দিয়ে গাড়ি প্রবেশ করতেই উর্মি সোজা হয়ে দাঁড়াল। বৃষ্টি খুব জোরে নেমেছে। মোস্তফা গাড়ি থেকে বেরিয়ে দৌড়ে আসলো উর্মির সামনে। উর্মি কিছুক্ষণ মোস্তফার দিকে তাকিয়ে থেকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে মোস্তফার বুকে মাথা রাখলো। মোস্তফা উর্মির মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
“চিন্তা করো না রাবেয়া ঠিক ফিরে আসবে।”
উর্মি মাথা তুলে মোস্তফার দিকে তাকিয়ে কান্না জড়িত কন্ঠে বলল,
“ও কখনো এত দেরি করে না।”
“হ্যাঁ জানি। রাবেয়া খুব ভালো মেয়ে। আচ্ছা তুমি কি কিছু জানো তার সম্পর্কে। যেমন কাওকে পছন্দ করে এমন কিছু।”
উর্মি মাথা তুলে মোস্তফার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলল,
“তুমি কি বলতে চাচ্ছো? কারো সাথে পালিয়ে গিয়েছে সে?”
“আমি এটা কখন বললাম উর্মি?”
উর্মি মুখ ঘুরিয়ে ফেলল। চিন্তার কারণে উল্টাপাল্টা কথা বলছে সে। মোস্তফা উর্মির হাত ধরে হলরুমে নিয়ে গেল। বড়োদের সালাম দিয়ে উর্মিকে সোফায় বসিয়ে বলল,
“আমার একটা পুলিশ ফ্রেন্ড আছে। আমি তাকে সব বলেছি এবং রাবেয়ার ছবিও পাঠিয়ে দিয়েছি। ইন শাহ আল্লাহ আমরা রাবেয়াকে ঠিক খুঁজে পাবো।”
চিন্তার মাঝেও সকলের মন কিছুটা শান্ত হলো। হয়তো এখন রাবেয়াকে খুঁজে পাবে তারা।

রাত ১ টা, দরজা দিয়ে প্রবেশ করলো ইয়ামিন। ভেজা কাক হয়ে এসেছে সে। তার রাগী চেহারা দেখে ঢোক গিলল উর্মি। বড়ো ভাইকে ভীষণ ভয় পায় সে। এগিয়ে গিয়ে ইয়ামিনের সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
“ভাইয়া কোথায় ছিলেন আপনি? অনেকক্ষণ ধরে কল করছিলাম আপনাকে।”
“বলেছিলাম না তোমায় আমার মিটিং আছে?”
উর্মি মাথা নিচু করে ফেলল। ইয়ামিন বিরক্ত নিয়ে এক নজর সবাইকে দেখে উর্মিকে বলল,
“তোরা এই বাসায় কি করছিস?”
“ভাইয়া, রাবেয়া কোচিং যাওয়ার পর আর বাসায় ফেরে নি।”
ইয়ামিন সোফায় বসে শান্ত কন্ঠে বলল,
“পালিয়ে গিয়েছে হয়তো কারো সাথে?”
আসফিয়া বেগম হাতমুঠো শক্ত করে ফেললেন। ইলিয়াস আর উর্মিকে উনি ভীষণ ভালোবাসেন। কিন্তু ইয়ামিনকে সহ্য করতে পারেন না। ছেলেটা ছোটো বেলা থেকেই এমন। সবসময় এমন এমন কথা বলে উনার রাগ হয়। সুলতান সাহেব ঝাড়ি মে*রে বললেন,
“চড় মে*রে তোমার দাঁত ফেলে দেবো। আমাদের রাবেয়া কি এমন মেয়ে?”
ইয়ামিন লম্বা নিশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়াল। সবার উদ্দেশ্যে বলল,
“নিজেদের বাসায় চলুন। এবং গিয়ে ঘুমান। সকালের মধ্যে ঠিক ফিরে আসবে।”
রমজান সাহেব বললেন,
“আর যদি না ফেরে?”
“ফিরবে, জীবিত না হলেও মৃত হয়েই ফিরবে।”
বলেই ইয়ামিন উর্মিকে বলল চাবি নিয়ে বাসায় আসতে। ইয়ামিনের কথায় পরিবেশটা বেশ ভয়াবহ হয়ে গেল। মৃত হয়ে ফিরবে? আসফিয়া বেগম মাথা নিচু করে চোখের জল ফেলতে লাগলেন। ইয়ামিন বাসায় চলে গেল। সুলতান সাহেব কি বলবেন ভেবে পাচ্ছেন না। উনার ছেলে প্রায়ই এমন কান্ড করে। আর উনাকে লজ্জিত হতে হয়। মোস্তফা উর্মিকে বলল ইয়ামিনকে বাসার চাবি দিয়ে আসতে নাহলে আবার রাগারাগি করবে সে।

ফজরের আযান ভাসছে চারপাশে। সারারাত ধরে সবাই রাবেয়ার অপেক্ষায়। কারো চোখে ঘুম নেই। উর্মির এই অবস্থা দেখে মোস্তফা নিজের বাসায় যায় নি। কিভাবে যাবে? উর্মির কষ্ট তার সহ্য হয় না। মোস্তফা কিছুক্ষণ পর পর তার বন্ধুকে কল দিয়ে রাবেয়ার কথা জিজ্ঞেস করছে। কিন্তু কোনো খবর পাচ্ছে না। উর্মি মোস্তফার দিকে এগিয়ে গেল। তাদের জন্য মোস্তফারও কষ্ট হচ্ছে। উর্মি বলল,
“তুমি বাসায় যাও। মা বাবা চিন্তা করছে তোমার জন্য।”
“আব্বুকে আমি বলেছি আজ বাসায় ফিরবো না। হ্যাঁ উনারা চিন্তিত। কিন্তু আমার জন্য না, রাবেয়ার জন্য।”
“প্লিজ যাও তুমি। কাজ থেকে ফিরে বিশ্রাম টুকু করো নি।”
“আমার বোনকে খুঁজে পাচ্ছি না আর তুমি বলছো আমাকে বিশ্রাম করতে?”
“এত ভালো কেন তুমি মোস্তফা?”
“আমাকে ভালো ভেবো না। তোমার সাথে জড়িত প্রত্যেকটা মানুষকে আমি ভালোবাসি।”
উর্মি তাকিয়ে রইল মোস্তফার দিকে। এই মানুষটা তার জীবনে না থাকলে তার কি হতো? মোস্তফা পকেট থেকে টুপি বের করে বলল,
“আমি নামাজ পড়ে আসি। তুমিও গিয়ে নামাজ পড়ে নাও। আল্লাহ সব ঠিক করে দেবেন।”
“ইন শাহ আল্লাহ”
মোস্তফা মুচকি হেসে বাসা থেকে বের হলো। সুলতান সাহেব আর রমজান সাহেবও উঠে দাঁড়ালেন মসজিদে যাওয়ার জন্য। উর্মি আসফিয়া বেগমকে নিয়ে ঘরে গেল নামাজ আদায় করার জন্য।

অন্ধকার সরে আকাশে আলো ছেয়েছে। ইয়ামিন জানালার সামনে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছে। তার দৃষ্টি বার বার ঘড়ির দিকে যাচ্ছে। এখন সাড়ে ৬ টা বাজে। ১২ ঘন্টা কেটে গিয়েছে রাবেয়া উধাও। তাকে পেলে তো এতক্ষণে খবর পেয়ে যেত। সিগারেট শেষ করে ইজি চেয়ারে বসলো। চোখ বন্ধ করে হেলান দিয়ে বসে রইল। হঠাৎ শব্দ আসলো দরজা খোলার। ইয়ামিন চোখ খুলে ঘাড় ঘুরিয়ে দরজার দিকে তাকাল। উর্মি দাঁড়িয়ে আছে। চোখে মুখে তার ভয়ের ছাপ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। ইয়ামিন শান্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“কি হয়েছে?”
“ভাইয়া, রাবেয়া…”
“ফিরেছে বাসায়? কার সাথে গিয়েছিল?”
“ভাইয়া রাবেয়া হসপিটালে।”
ইয়ামিন সোজা হয়ে বসে বলল,
“এক্সিডেন্ট হয়েছে?”
উর্মি কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল,
“রশিদ ভাইয়া কল দিয়েছে। বলল রাবেয়াকে কয়েকজন মিলে হসপিটাল নিয়ে গিয়েছে। তার ধর..ধ*র্ষণ হয়েছে।”
ইয়ামিন তবু শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। ধীরে ধীরে দাঁড়িয়ে বলল,
“আমি গাড়ি বেশ করছি। তুমি শান্ত হও।”

রশিদ, মোস্তফা আর ইয়ামিন একই কলেজে পড়াশোনা করতো। রশিদ ডাক্তার হতে চেয়েছিল বলে মেডিকেল কলেজে চলে যায়। ইয়ামিন আর রশিদ বন্ধু হলেও মোস্তফা আর ইয়ামিনের মধ্যে কোনো কালেই বন্ধুত্ব ছিল না। উর্মিকে কয়েকবার মোস্তফা ইয়ামিনের সাথে দেখেছিল। মেয়েটাকে পছন্দ হওয়ায় বিয়ের প্রস্তাব পাঠায়। মোস্তফা ছেলে হিসেবে বেশ ভালো বলে কারো আপত্তি ছিল না। দুজনের এনগেজমেন্ট হয়ে গিয়েছে। উর্মির অনার্স কমপ্লিট হলে তাদের বিয়ে হবে।

রশিদ তাকিয়ে আছে রাবেয়ার দিকে। শরীরের বিভিন্ন জায়গায় আঁচড়, খামচির দাগ। শুধু তাই না বেল্ট দিয়ে পে*টানোর দাগও দেখা যাচ্ছে। বেশ অত্যাচার হয়েছে মেয়েটার উপর। রাবেয়াকে বেশ কয়েকবার দেখেছে সে। কিন্তু আজ যেন চিনতেই পারছে না। বাঁচাতে পারবে তো মেয়েটাকে? ব্লিডিং থামার নাম নিচ্ছে না। রশিদ বাকি ডাক্তারদের চিকিৎসা করতে বলে বের হলো।সবাই চিন্তিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আসফিয়া বেগম কাঁদতে কাঁদতে অজ্ঞান হওয়ার মতো অবস্থা। রমজান সাহেব চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছেন। এমন সর্বনাশের সম্মুখীন হবেন উনি কখনো ভাবেন নি। মোস্তফা আর উর্মি এগিয়ে আসলো রশিদের দিকে।
“ভাইয়া, রাবেয়া কেমন আছে?”
“আমরা চেষ্টা করছি ব্লিডিং থামানোর। মিথ্যে বলবো না, ওর অবস্থা আসলেই খুব খারাপ। সব উপর ওয়ালার হাতে।”
আসফিয়া বেগমের কান্নার গতি আরো বেড়ে গেল। রশিদ আর কি বলবে ভেবে পেল না। পাশ কাটিয়ে চলে গেল। উর্মির মাথা শূন্য হয়ে গেল রশিদের কথা শুনে। চারপাশে শুধু কান্নার শব্দ। ইয়ামিন বিরক্ত হয়ে বলল,
“থামবেন আপনারা? কিছু হয়নি আপনাদের মেয়ের।”
রমজান সাহেব ইয়ামিনের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তোমাকে এখানে কেও থাকতে বলেনি। যাও তুমি এখান থেকে। আমাদের মেয়ে আমরাই বুঝে নেবো।”
“তো বুঝে নেন। না বলেছি আমি?”
সুলতান সাহেব ইয়ামিনের কলার ধরে টেনে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“আমি বুঝতে পারছি না তুমি কার মতো হয়েছো। হসপিটাল বলে তামাশা করতে চাচ্ছি না। চুপচাপ চলে যাও নাহলে আমার থেকে খারাপ কেও হবে না।”
ইয়ামিন নিজের কলার ছাড়িয়ে বিরক্ত চেহারা বানিয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

মোস্তফার বন্ধু আসলো কিছুক্ষণ পর। এসে জানতে পারলো রাবেয়ার অবস্থা ভালো না। যদি তার জ্ঞান ফিরে তাহলেই স্টেটমেন্ট দিতে পারবে। আসফিয়া বেগমের প্রেশার লো হয়ে গিয়েছে। উনাকে ঘুমের ঔষধ দিয়ে অন্য কেবিনে রাখা হয়েছে। রাতে বেরিয়েছে ইলিয়াস রাবেয়াকে খোঁজার জন্য। এখনো হয়তো খুঁজে বেড়াচ্ছে। উর্মি ইলিয়াসকে কল দিয়ে হসপিটাল আসতে বলল। মোস্তফা পুলিশের সাথে কথা বলছে৷
“মোস্তফা, ডাক্তার রশিদের সাথে আমি কথা বলেছি। উনি টেস্ট করতে দিয়েছেন। উনার সন্দেহ রাবেয়ার গণধ*র্ষণ হয়েছে৷ এখন রিপোর্ট আসার অপেক্ষা।”
“আলী, আমি অনুরোধ করছি তোকে। যারা এই পাপ করেছে তারা যাতে জঘন্য শা*স্তি পায়।”
“পাবে, আমি ওয়াদা করছি তোকে তাদের যেভাবেই হোক খুঁজে বের করবো। একবার শুধু রাবেয়া স্টেটমেন্ট দেয়ার মতো অবস্থায় আসুক।”
তাদের থেকে কিছুটা দূর ইয়ামিন দাঁড়িয়ে আছে। আলী ও মোস্তফার কথা শুনে সে ওটি’র দরজার দিকে তাকিয়ে হাতমুঠো শক্ত করে ফেলল।

ব্লিডিং বন্ধ হয়েছে। কিন্তু রাবেয়ার অবস্থা তবুও ভালো না। তার জ্ঞান ফেরার কোনো চান্স পাচ্ছে না। মাথায় আঘাতের চিহ্ন পেয়েছে রশিদ। ভারী কিছু দিয়ে আঘাত করে তাকে অজ্ঞান করা হয়েছে। রশিদ ওটি থেকে বের হয়ে সবার উদ্দেশ্যে বলল,
“রাবেয়াকে আইসিইউ তে শিফট করা হবে। দোয়া করুন যাতে তার জ্ঞান ফিরে আসে। আগামী ২৪ ঘন্টা বেশ ক্রিটিকাল। তার জ্ঞান ফিরলে বাঁচার চান্স বেড়ে যাবে।”
ইয়ামিন হঠাৎ বলল,
“যদি জ্ঞান না ফেরে?”
সবার দৃষ্টি ইয়ামিনের দিকে গেল। ইয়ামিন রশিদের দিকেই তাকিয়ে আছে। রশিদ লম্বা নিশ্বাস ফেলে বলল,
“মাথায় আঘাত লেগেছে তার। মেমোরি লস বা কোমায় যেতে পাবে। এমনও হতে পায় ব্রেইন স্ট্রোক হবে তার।”
“হুম বেঁচে ফেরার চান্স খুব কম।”
রমজান সাহেব উঠে দাঁড়িয়ে গর্জে উঠলেন,
“ইয়ামিন তুমি যাও এখান থেকে। তুমি সুলতান ভাইয়ের ছেলে বলে আমি এতক্ষণ সহ্য করেছি।”
ইয়ামিন ভ্রু কুঁচকে বলল,
“আমার সাথে রাগারাগি করে কি লাভ? ডাক্তার কি বলল শুনেন নি?”
“তুমি কি চাও আমার মেয়েটা ম*রে যাক?”
ইয়ামিন উত্তর দিলো না। মুখ ঘুরিয়ে ফেলল সাথে সাথে। সুলতান সাহেব এগিয়ে এসে রমজান সাহেবের কাঁধে হাত রেখে বললেন,
“হয়তো সারাজীবন আমাকে মাফ চেয়ে যেতে হবে তোমার কাছ থেকে। আমি মনে করতাম আমার বড়ো ছেলে আমার মানসম্মান রক্ষা করবে। কিন্তু ভুল ভাবতাম। ইয়ামিনের প্রতিটা কান্ড আমাকে লজ্জিত করে।”
ইয়ামিন বিরক্ত হয়ে বিড়বিড় করতে লাগলো। উর্মি চুপচাপ দাঁড়িয়ে সব দেখছে। তার ভাই খারাপ মানুষ না। কিন্তু ইদানীং এমন ব্যবহার কেন করছে সে বুঝতে পারছে না।

খুশির আমেজ ছড়িয়ে পরলো চারপাশে। রাবেয়ার জ্ঞান ফিরেছে। আইসিইউ’তে বলে কাওকে ভেতরে যাওয়ার পারমিশন দেয়নি রশিদ। শুধু ইন্সপেক্টর আলী যেতে পারবে ভেতরে স্টেটমেন্ট নেয়ার জন্য। ইয়ামিন এই কথা শুনে রশিদের কাছে দ্রুত গেল।
“তুই শুধু একজনকে ভেতরে যাওয়ার পারমিশন কেন দিলি?”
“রাবেয়া এখন এত মানুষের সম্মুখীন হতে পারবে না।”
“আমি এত কিছু বুঝি না। রাবেয়ার স্টেটমেন্ট আমি শুনতে চাই।”
“আরে ভাই তুই রিলাক্স হো।”
“রশিদ ভেতরে যেতে দে আমায়।”
“তোর কি হয়েছে ইয়ামিন? চেহারার রং উড়ে আছে কেন তোর?”
ইয়ামিন আমতা আমতা করে বলল,
“ক..কই না তো।”
“চিন্তিত তুই ওর জন্য তাই না?”
ইয়ামিন রশিদের দিকে তাকিয়ে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়াল। রশিদ বলল,
“আচ্ছা, তুই দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দূর থেকে রাবেয়াকে দেখতে পারবি।”
“ওকে দেখার ইচ্ছে আমার নেই। আমি তো শুধু ওর স্টেটমেন্ট শুনতে চাই।”
ইয়ামিন বিড়বিড় করে কথাটা বলল বলে রশিদ শুনতে পায়নি। দুজন এগিয়ে গেল আইসিইউ’র দিকে।

নার্সের হাত জাপ্টে ধরে কাঁপছে রাবেয়া। আলী বেশ দূরে দাঁড়িয়ে আছে। রাবেয়া তাকে দেখেই চিৎকার চেচামেচি করছে। তাকে সামলানো যাচ্ছে না। উর্মি তার চিৎকার শুনে নিজেকে সামলাতে পারলো না। দৌড়ে গেল ভেতরে। উর্মি থমকে গেল রাবেয়াকে দেখে। পুরো চেহারায় জখমের দাগ। রাবেয়া ঠোঁট উল্টিয়ে কেঁদে উঠল উর্মিকে দেখে। উর্মি ধীরপায়ে হেটে গেল। রাবেয়া উঠতে চাচ্ছে কিন্তু পারছে না। পুরো শরীরে ক্ষত বলে শক্তি পাচ্ছে না। উর্মি রাবেয়ার পাশে বসলো। কি বলবে সে? রাবেয়ার অবস্থা দেখে তার মন চাচ্ছে না কিছু জিজ্ঞেস করতে। কিন্তু স্টেটমেন্টটা তো খুব জরুরি। আলী এগিয়ে আসলো। রাবেয়া চিৎকার করে বলল,
“সামনে আসবে না। খবরদার ছুঁবে না আমায়। উর্মি আপু..আপু ওকে যেতে বলো।”
উর্মি রাবেয়ার হাত মুঠোয় নিয়ে বলল,
“উনি পুলিশ৷ উনি তোমার কোনো ক্ষতি করবে না রাবেয়া। আলী ভাইয়া অনেক ভালো।”
“না..না আপু না.. ভালো বলতে কেও নেই এই দুনিয়ায়। যাকে ভাইয়া বলে ডাকতাম সেই আমার এত বড়ো ক্ষতি করলো।”
সবাই থমকে গেল রাবেয়ার কথা শুনে। উর্মি অবাক হয়ে আলীর দিকে তাকাল। আলী দ্রুত এসে রাবেয়াকে বলল,
“মিস রাবেয়া। কার কথা বলছেন আপনি? নাম বলুন তার।”
আলী সামনে আসতেই রাবেয়া আবার চেচামেচি শুরু করলো। উর্মি রাবেয়াকে তুলে জড়িয়ে ধরে রাখলো। শান্ত করার চেষ্টা করছে তাকে৷ রাবেয়া ঘনঘন নিশ্বাস ফেলছে। উর্মি রাবেয়ার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
“রাবেয়া তুমি যদি আমাদের তার নাম না বলো আমরা কিভাবে তাকে শা*স্তি দেবো? একবার তার নাম বলে দাও আমরা ওয়াদা করছি তাকে কঠিন থেকে কঠিন শা*স্তি দেবো।”
রাবেয়া ঘেমে একাকার। উর্মির চেহারার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ফুপিয়ে কেঁদে উঠল। উর্মি রাবেয়ার গালে হাত দিয়ে বলল,
“আমি আছি তো তোমার সাথে। ভয় পেও না।”
রাবেয়া কিছু বলার আগেই তার চোখ গেল দরজার দিকে। চোখ বড়ো বড়ো করে বলল,
“ওইযে ও ওখানে..ওইযে আপু দেখো দাঁড়িয়ে আছে।”
উর্মি আর আলী দরজার দিকে তাকাল। উর্মি থমকে গেল মানুষটাকে দেখে। দরজার পাশে মোস্তফা দাঁড়িয়ে আছে।

চলবে……..

#হুংকার
#শোভা_আক্তার(লাভলী)
#পর্ব_১

[আসসালামু আলাইকুম, নিয়ে আসলাম নতুন গল্প। আশা করছি আপনাদের ভালো লাগবে। ভুল ত্রুটি ধরিয়ে দিয়েন❤️❤️]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here