মুহূর্তে পর্ব-১৪

0
847
  1. #মুহূর্তে
    পর্ব-১৪
    নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

    শেষ দুপুরের সোনালী রোদ্দুর এসে পড়ছিলো তাহিরার উপর। ছাদের এককোণে দাঁড়ানো সে। আকাশের দলবাঁধা কবুতরের উড়াল দেখতে ভালোই লাগছিলো তার। তার পিছন থেকে হাসির শব্দ, চিৎকার চেঁচামেচি। কবিতা সহ তার সকল কাজিনরা কানামাছি খেলছে। তাহিরাকেও জোর করেছিলো কিন্তু তার মন নেই এইসবে। তার মন তো পড়ে আছে তার কাছে যার থেকে সে খুব করে পালাতে চাইছে। কিন্তু সে জানে অবশেষে তার দুয়ারেই যেতে হবে তাহিরার। প্রচন্ড ভালোবাসে যে তার পাশের ঘরের উচ্ছন্ন ছেলেটাকে। সে জানে নিজেকে যতই দূর রাখুক তবুও ধ্রুবর বুকেতেই তার ঠাই। অতিরিক্ত ভালোবাসে সে ধ্রুবকে। সম্ভবত নিজের থেকেও বেশি। এই কারণে মাঝেমধ্যে ঘৃণাও হয় নিজের উপর। এমন একটা মানুষকেই তার কেন ভালোবাসতে হলো? কিন্তু এইবার সে নিজের সর্বোচ্চ ক্ষমতা দিয়ে চেষ্টা করবে ধ্রুবকে ভুলানোর। এইবারের আঘাতটাও যে গাঢ়!

    হঠাৎ করে খালামণির কন্ঠ শুনে সে, “কবিতা…. এই কবিতা কতক্ষণ ধরে তোর ফোন বাজছে। কানে শুনিস না না’কি?”
    কবিতা বিরক্তি নিয়ে বলে, “মা তুমিও না, আর সময় পাও না। এই একজন হাতে এসেছিলো। তোমার এখনই কথা বলতে হলো।”
    কবিতা আগের থেকে অনেকটা স্বাভাবিক। এইখানে এসে তাকে ফুরফুরে লাগছে। সারাক্ষণ হাসি-খুশি, বাচ্চাদের মতো লাফা-লাফিতেই আর খেলাতেই তার দিন কাটে। কেউ বলতেই পারবে না চারদিন আগে মেয়েটার ভয়ে কাঁদতে কাঁদতে নিশ্বাস আটকে এসেছিলো।

    কবিতা বিরক্তি নিয়ে তার চোখের ওড়না খুলে নিচে যায়। তার ফোনে পনেরোটা মিসকল ভেসে আছে। সে অবাক। এতগুলো কল কে দিবে তাকে! কবিতা ফোনটা হাতে নিতেই ফোন আবারও বেজে উঠে। এইবার কবিতা ফোন ধরে বলে, “হ্যালো, কে?”
    “কবিতা তুমি…ঠিক তুমি বলছ?”
    বুকের ভেতর ধক করে উঠে। ফোনের ওপাশে তীর্থের কন্ঠ। কতদিন পর কন্ঠ শুনলো তার। হঠাৎ এক ভালোলাগার অনুভূতি এসে তাকে কাবু করে। পরের মুহূর্তে তার মনে পরে সে ভয়ানক সন্ধ্যাটা। রক্তিম আকাশের নিচে এক কুৎসিত দিক দেখেছিলো সে তীর্থের। সে শঙ্কিত হয়ে যায়। কাঁপা-কাঁপা কন্ঠে বলে, “আপনি আমার নাম্বার কোথায় পেলেন? দেখুন আমি বাড়িতে এসেছি। কেউ আপনার সাথে কথা বলতে শুনলে আমার সমস্যা হবে। রাখলাম।”
    কবিতা তার কানের কাছ থেকে ফোন দূরে নিতেই তীর্থের কথা শুনে থমকে যায়, “কবিতা আমার কথা শুনো, শিল্পা আন্টি আর নেই।”
    “কী! কী বলছেন এইসব?”
    “দুইদিন আগে এক্সিডেন্টে সে মৃত্যুবরণ করেন। ধ্রুবর অবস্থা অনেক খারাপ। সে খাবার খাচ্ছে না, কিছু বলছে না, কাঁদছেও না। আমাদের ভীষণ চিন্তা হচ্ছে কবিতা। আমার ওকে নিয়ে খুব ভয় কবিতা। তুমি যত দ্রুত সম্ভব তাহিরাকে নিয়ে আসো। ও ছাড়া কারও ধ্রুবকে সামলানোর ক্ষমতা নেই।”
    “আমরা আসছি। আজই আসছি।”

    কবিতা ছুটে গেল তাহিরার কাছে। তার নিশ্বাস ঘন। তাকে অস্বস্তিতে দেখাচ্ছে। তাহিরা কবিতার এমন এলোমেলো অবস্থা দেখে হেসে দেয়, “তোর এ’কি অবস্থা!”
    “তোমার ফোন কোথায় আপু?”
    তাহিরা চুপ করে রইলো। ধ্রুবর সাথে যেন যোগাযোগ না হয় এ-কারণে সে ফোন বন্ধ করে রেখেছিলো।
    কবিতার চোখে পানি ভেসে আসে। তাহিরা এইবার হড়বড়িয়ে যায় কবিতাকে দেখে। অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করে, “কী হলো তোর?”
    “আপু শিল্পা আন্টি আর নেই।”
    তাহিরার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে। সে আর্তনাদ করে উঠে, “ফাজলামোর একটা সীমা থাকে কবিতা।”
    “আই উইশ এইটা ফাজলামো হতো। তীর্থ কল করেছিলো। ধ্রুব ভাইয়ার অবস্থা ভীষণ খারাপ।”
    তাহিরার হঠাৎ মাথা ঘুরিয়ে উঠলো। সে পড়ে যেতে নিলেই কবিতা ধরে নেয় তাকে। তাহিরা মেঝেতে বসে অঝোরে কাঁদতে শুরু করে। অনেকটা সময় কাটে। সে চুপ। এতক্ষণে বাড়িতে উপস্থিত সবাই এসে সেখানে একজোট হলো। খালা তাকে ধরে পানি খাইয়ে সে। তাহিরা বহু কষ্টে বলে, “খালামণি আমার এখনই ঢাকায় পৌঁছাতে হবে।”
    “এখন না মা, আবির আগে আসুক। কাজে শহরের বাহিরে গেছে। কাল বিকেলে আসবে। ওর সাথে গেলেই হবে।”
    “কী বলছেন এইসব? আমার মা মারার যাবার পর উনিই আমাকে মা’য়ের আদর দিয়েছিল। এতদিনে মনে হয় উনার কবরও দেওয়া হয়ে গেছে। উনাকে শেষবারের মতো দেখার ভাগ্যটাও আমার হলো না। কিন্তু উনাকে করা শেষ ওয়াদা রক্ষার জন্য আমার যেতে হবে। আমার এখনই বের হতে হবে।”
    কবিতা ছটফট করে উঠে দাঁড়ায়, “আমি ব্যাগ নিয়ে আসছি।”

    দুইজনে সাথে সাথে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। সারাটা রাস্তায় এক মুহূর্তের জন্যও তাহিরার কান্না থামে নি। বাসস্ট্যান্ডে তাদের নিতে আসে লিমন ও পলাশ। বাসায় পৌঁছে দেখে বাড়িতে থমথমে অবস্থা। কিছু প্রতিবেশি ও ধ্রুবর বন্ধু ছাড়া কেউ-ই নেই। ধ্রুবর কোনো আত্নীয় আসে নি। লিমন থেকে জানতে পারে এক্সিডেন্ট হয়েছিলো রাস্তা পাড় হবার সময়। তাহিরার নাম্বার বন্ধ থাকায় তাদের সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয় নি। কেবল ধ্রুবর ফোনে কবিতা ও তার দাদীর নাম্বার ছিলো। ফোনটাও পাওয়া যাচ্ছে না। তার সাথে যোগাযোগ করার কোনো উপায় পাওয়া গেল না। বহুকষ্টে তীর্থ কবিতার নাম্বার যোগাড় করেছে। শিল্পার মৃত্যুর খবর শুনে ধ্রুবর কোনো আত্নীয় কবর জেয়ারতের জন্যও আসে নি। একটিবার ধ্রুবর খবরও নেয় নি ফোন করে। এর উপর ধ্রুবর অবস্থা খুব খারাপ। তাহিরা ও কবিতা বাড়িতে পা রাখতে না রাখতেই তীর্থের সামনে পড়ে তারা। তীর্থ এক দুই না ভেবে তাহিরাকে উঁচু স্বরে বলে, “তোমার মাথায় কী জ্ঞান বুদ্ধি বলতে কিছু আছে? ফোন বন্ধ রাখতে হলে ফোন ব্যাবহার করে লাভ কী? এইদিকে ধ্রুবর অবস্থা খারাপ আর ওদিকে তুমি ঘুরে বেড়াচ্ছ?”
    কবিতা তাহিরার সামনে এসে দাঁড়ায়। সে শীতল গলায় বলে, “না বুঝে শুনে কথা বলবেন না। আপনার থেকে ধ্রুব ভাইয়ার জন্য আপুর চিন্তা শতগুণ বেশি সাথে শিল্পা আন্টি না থাকার বেদনাও। আপুর কাছে উনি মা’য়ের মতো ছিলেন।”
    তীর্থ কবিতার কথার পিঠে কিছু বলতে পারে না। সে চুপ করে যায়।
    “ধ্রুব… ও কোথায়?” কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করে তাহিরা।
    “ওর রুমে। কিছু খাচ্ছে না, কোনো কথা বলছে, ঘুমাচ্ছে না, এমকি কাঁদছেও না। ওকে এতবার বললাম কেঁদে নিজের মন হাল্কা করতে কিছু এক ফোঁটা জলও বের করে নি চোখ দিয়ে। কেমন নিথর হয়ে বসে আছে।”
    তাহিরা দৌড়ে যায় ধ্রুবর রুমে।

    চারদিকে অন্ধকার। দরজা খোলায় বাহির থেকে একটুখানি রশ্মি ভেতরে এলো। বিছানার এককোণে বসা ধ্রুব। তার হাতে একটি ছবির ফ্রেম। ছবিতে তার দুইপাশে তার মা ও তাহিরা দাঁড়ানো। সে ফ্রেমটাই বুকের কাছে রেখে এই দুইদিন কাটিয়েছে ধ্রুব। হঠাৎ একটি ছায়ামূর্তির দর্শন পায় ধ্রুব। সে বিরক্তি নিয়ে বলে, “আমার কারও সাথে কথা বলার ইচ্ছা নেই।”
    ছায়ামূর্তিটি তবুও এগোল। এগিয়ে এলো তার কাছে। তার রুমের বাতি জ্বলে। তার সামনে তাহিরা। অন্তরটা কেঁপে উঠে ধ্রুবর। তাহিরা এসে তার গালে হাত রাখে। তার সম্পূর্ণ মুখটায় কেমন বেদনার ভাব ছড়ানো। তাহিরার হাতের স্পর্শতেই ধ্রুবর শুষ্ক চোখটা ভিজে গেল।

    তীর্থ বাতি জ্বালিয়ে একপলক তাকায় ধ্রুবর দিকে। তারপর সে রুম থেকে বেরিয়ে আসে। কবিতা অভিযোগের সুরে বলে, “আপনি দরজা বন্ধ করছেন কেন? আমি দেখা করব তো ধ্রুব ভাইয়ার সাথে।”
    ” এখন না। একটু একা সময় প্রয়োজন ওর। তাহিরা সাথে ওকে একা কিছুক্ষণ থাকতে দেও।”
    কবিতা কথা এগোল না। ঘরটাতে চোখ বুলাতেই তার কান্না পেল। শিল্পা আন্টির সাথে তার খুব কম মুহূর্ত আছে কিন্তু কেন যেন তার খুব কষ্ট হচ্ছে। মনে পড়ছে শিল্পা আন্টির কথা।

    তীর্থের কেমন যেন অশান্তি লাগছিলো কবিতার চোখের জল দেখে। বুকের ভেতর চিনচিন ব্যাথা করতে শুরু করল। কারও চোখের জল দেখলে বুক ব্যাথা করতে পারে এই ব্যাপারটা তার জানা ছিল না। তীর্থ হাত বাড়িয়ে কবিতার গালের জল আলতো করে মুছে দিল।

    তীর্থের হাতের স্পর্শ পেতেই কবিতা চমকে তাকায় তার দিকে। হঠাৎ করে এক পা পিছিয়ে যায়। তার মনে পড়ে সেই রক্তিম সন্ধ্যার কথা। সে দেখতে পায় তীর্থের মুখের মলিনতা তবুও তার চোখের সামনে ভাসছিলো এই হাত দিয়েই কাউকে অমানুষের মতো মারার দৃশ্যটা। যে হাত দিয়ে আদর করে এখন তার চোখের জল মুছে দিচ্ছে সে হাত দিয়েই সেদিন কাউকে খুব মেরেছিলো তার সামনে দাঁড়ানো লোকটা। ভাবতেই শিউরে ওঠে সে। তার চোখ পড়ে তীর্থের মাথার ব্যান্ডেজের উপর। তাকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা করছে তার আঘাত এখন কেমন? ব্যথা করে কি? কিন্তু সে পারলো না। ভয়ে তার বুক কাঁপছে। সে সেখান থেকে চলে গেল।

    লিমন তীর্থের কাঁধে হাত রেখে জিজ্ঞেস করে, “ভাই আপনি কি ঠিক আছেন?”
    “হুম। ওদিন ও ভয় পেয়েছে। ভয় পাওয়াটাও স্বাভাবিক। ওর দূরে ছুটে যাওয়া স্বাভাবিক। আমার কষ্টের নগরীতে ওকে মানায় না’রে। আমার পৃথিবী ওর জন্য না। আমি এই ব্যাপারটা জানি। এইজন্য ওর থেকে দূরে সরতে চাই, কিন্তু পারি না। প্রতি মুহূর্ত আমি ওর প্রতি আরও দুর্বল হয়ে পড়ছি।”
    “সব ঠিক হইয়া যাইব ভাই।”
    তীর্থ দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সেখানে আর দাঁড়ায় না, চলে যায় ড্রইংরুমে। এক দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়ায়। তার থেকে দূরে এক সোফায় বসে কাঁদছে কবিতা। তীর্থ যতবার কবিতাকে দেখেছে ততবারই তার স্বাধীন মনোভাব, দুষ্টুমি আর সাহস দেখেছে। তার নরম দিকটা দেখা যায় খুব কম। অথচ এ দিকটা তার সবচেয়ে বেশি পছন্দের।

    কলিংবেল বাজে। দরজা খুলে লিমন। সে রুমে ঢুকতে ঢুকতে বলে, “ভাই আন্টির ছাত্র কয়জন আসছে। খাবার নিয়া আসছে।”
    তার পিছনে একজন বলল, “ঘরে চুলা জ্বালানো যেহেতু মানা তাই খাবার নিয়ে এলাম। গত দুইদিন আমাদের বন্ধুরা এনেছিলো। তাই আজ আমরা নিয়ে এলাম।”
    তীর্থ মাথা নাড়ায় কেবল। কে কোনদিন খাবার এনেছে এতে তার কিছুই আসে যায় না। এ বিষয় নিয়ে বলার কি আছে সে বুঝতে পারল না। তারা আসুক বা না আসুক এতে তার কিছু আসে যায়ও না। কিন্তু ইতিমধ্যে একজনের প্রতি তার মনোযোগ গেল। সবার শেষে একটি লোক এলো এবং তার ধ্যান গেল কবিতার উপর। সে এক প্রকার ছুটে যায় কবিতার কাছে। চমকাল তীর্থ। লোকটা শিল্পা আন্টির মৃত্যুর দিনও উপস্থিত ছিলো। তাকে আগে দেখেছে মনে হলো কিন্তু চিনতে পারলো না। আজ কবিতার কাছে যাওয়ার পর তার মনে হলো এই লোকটা ভার্সিটিতে একদিন দেখা করতে এসেছিলো কবিতার সাথে। সম্ভবত এই লোকের সাথেই তার বিয়ে ঠিক হয়েছে। নামটা বলেছিলো কবিতা।
    কথন!

    কক্ষে প্রবেশ করবার কিছু মুহূর্তেই কবিতার দর্শন পায় সে। তাকে দেখে অবাক হয় নি। ডক্টর শিল্পার সাথে সে পরিচিত। কিন্তু তাকে কান্না করতে দেখে তার খারাপ লাগে। মেয়েটাকে কাঁদলে একটুও মানায় না। সে দ্রুত এগিয়ে যেয়ে বসে কবিতার পাশে। তার মনে হলো কবিতাকে সান্ত্বনা দিলে তার কান্না আরও বাড়বে তাই সে স্বাভাবিক গলায় বলল, “এভাবে কাঁদছ কেন? একদম পেঁচার মতো দেখাচ্ছে।”
    হতদম্ব হয়ে কবিতা তাকায় কথনের দিকে। বিস্ময়ে সে কান্নাও ভুলে যায়, “আপনি এই সময় ফাজলামি করছেন আমার সাথে?”
    “ফাজলামি কোথায় করলাম? সত্যি বলছি। একতো গোল মুখ তোমার। এর উপর কান্নার সময় যেভাবে চোখ মুখ কুঁচকে নিলে একদম পেঁচার মতো দেখাচ্ছিলো।”
    কবিতা মুখ ফুলিয়ে তাকায় কথনের দিকে। তার চোখে মুখে রাগের ছাপ। সে ক্রোধে মেঝেতে লাথি মেরে বলল, “আপনাকে তো … আপনাকে একবারে ওই… ধ্যুর কিছু মাথায়ও আসে না।”
    রাগে কবিতা হনহনিয়ে বেরিয়ে যেতেই কথন বলে, “খাবার এনেছিলাম কিন্তু। আম্মুর হাতের যে গরুর মাংস ওদিন তোমার অনেক পছন্দ হয়েছিলো তাও আছে।”
    কবিতা যত দ্রুত গিয়েছিলো তার থেকে দ্বিগুণ গতিতে ফিরে এলো। কথনের হাতের থেকে ব্যাগ নিয়ে বলল, “দুপুর থেকে কিছু খাই নি। আমার পেটে ইঁদুররা কাবাডি খেলছে।” বলেই সে কুড়কুড় করে খাবার নিয়ে গেল। যাবার পূর্বে লিমনকে আদেশের সুরে বলে, “লিমন ভাইয়া অন্যান্য প্যাকেটও নিয়ে আসেন।”
    কথন হেসে দিলো কবিতার এমন কান্ডে। তার হাসিতে গড়াগড়ি খেতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু এমন শোকের বাড়িতে তা মানানসই নয়। কথনের এক বন্ধু এসে তাকে জিজ্ঞেস করে, “মেয়েটা তোর চেনা।”
    “হ্যাঁ।”
    “দেখতে সুন্দর আছে, মেয়েটার সাথে পরিচয় করিয়ে দিবি?”
    কথনের হাসিটা হঠাৎ করে উধাও হয়ে যায়। সে চোখ ঘুরিয়ে তাকায় তার বন্ধুর দিকে। শীতল কন্ঠে বলে, “ওর সাথে আমার বিয়ের কথা চলছে।”
    তার বন্ধু কেমন জোরপূর্বক হাসলো। আমতা-আমতা করে বলল, “আরে তাহলে তো ভাবির মতো আমার। ভাবির মতো সুন্দর আরকি।” তারপর এক গভীর নিশ্বাস ফেলল।

    কথন তার কথায় বিশেষ পাত্তা দিলো না। সে রুমে চোখ বুলিয়ে পায় তীর্থকে। এক কোণে দাঁড়িয়ে ছিল সে। তার সামনে যেয়ে স্বাভাবিক গলায় জিজ্ঞেস করে, “ধ্রুবকে দেখছি না। ওর কী খবর?”
    সে অবাক হলো। তীর্থ তার দিকে কেমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সে দৃষ্টিতে অসহায়, আহত এবং রাগান্বিত ভাব। কথন পরের মুহূর্তে ভাবলো এটা তার কল্পনা। যে মানুষকে সে চিনেও না সে মানুষ কেন তার উপর এমন অনুভূতি রাখবে?
    তীর্থ কঠিন গলায় তাকে উওর দিলো, “ধ্রুব ভেতরে আছে। তাকে ডিস্টার্ব করা যাবে না।”
    .
    .
    দরজা বন্ধ হবার শব্দ শুনে তাহিরা একপলক তাকায় দরজার দিকে। সাথে সাথে অনুভব করে ধ্রুবর হাতজোড়া তাকে শক্ত করে ধরে নিয়েছে। সে ধ্রুবর দিকে তাকিয়ে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে শুরু করে। তার সকল অভিমান, রাগ, কষ্ট একপাশে রাখে। এই সময় ধ্রুবর তাকে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।
    ধ্রুবর মুখ সে দেখতে পারছিলো না। তার কেবল কাঁপানো গলার স্বর শুনতে পায় তাহিরা, “সে…দিন সকালে উঠে তোকে পাই নি। তোর ফোনও বন্ধ। দাদীও যেতে চাইল বনানী। তাকে নামিয়ে তোর খালার বাসার ঠিকানা নিয়েছিলাম। বিকেলেই উঠলাম তোর কাছে…যাবার জন্য। মাঝরাস্তায় ফোন আসে, মা’য়ের এক্সিডেন্ট হয়েছে। আমি তখনই ফিরে যাবার জন্য রওনা দিলাম। হাস্পাতালে পৌঁছে দেখি। উনি বেডে শুয়ে ছিলেন। সে রাতে তার সাথে দেখা করতে দেয় নি আমাকে বেয়াদব ডাক্তারগুলো। তার চিকিৎসার বাহানায়। ভোরে ফজরের আযানের পরপরই ডাক্তার বলে সে আর নেই। তাহু জানিস আমি অনেক ডাকলাম মা’কে। মা সবসময় আমার এক ডাকে আমার কাছে চলে আসতো। কিন্তু সে সাড়াই দিলো না। তাহি সে উঠে নি আর। আমি এত করে ডাকলাম। তার ছেলের একটা কথা সে শুনে নি। তুই আমার সাথে রাগ করে কেন গেলি? মা তোর সব কথা শুনতো। তুই একবার বলতি যেন আমাকে ছেড়ে না যায়। সে… সে ছাড়া যে আমি একা হয়ে যাব। বাবাও ছোট বেলায় আমাকে ছেড়ে চলে গেল। সে আমাকে বলেছিলো সে কখনো আমাকে ছেড়ে যাবে না। তাহলে কেন নিজের কথা রাখে নি সে? আমার কথা একবারও ভাবে নি।” তাহিরা অনুভব করতে পারছিলো তার পেটের কাছের পোশাকটা ভিজে গেছে ধ্রুবর চোখের জলে। ধ্রুব তাহিরাকে ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। এই প্রথম তার চেহেরা পরিষ্কার দেখতে পায় সে। কী বাজে অবস্থা হয়েছে তার! চোখের নিচে কালিতে ভরে গেছে। মুখটা নিষ্প্রাণ দেখাচ্ছে। খোচাখোচা দাঁড়ি উঠেছে গালে। তার চোখেমুখে পানিতে ভিজে গেছে। সে আজ পর্যন্ত এত বাজে অবস্থায় দেখে নি ধ্রুবকে।

    ধ্রুব তাহিরার দুইগালে হাত রেখে অস্থির হয়ে বলে, “তাহু তুই আমাকে ছেড়ে যাবি না তো? তুইও মা’য়ের মতো আমাকে ছেড়ে যাস না প্লিজ। আমি মরে যাব। একদম মরে যাব। তুই আমাকে ছেড়ে গেলে আমি কার জন্য বাঁচব?” ধ্রুব একবার নিজের দুই হাতের দিকে তাকিয়ে দ্রুত তা সরিয়ে নেয় তাহিরার গাল থেকে, “আমি তোকে বিয়ের আগে ছুঁবও না, আই প্রমিজ। তবুও তুই আমাকে ছেড়ে যাস না।”
    তাহিরা নিজেই ব্যাকুল হয়ে যাচ্ছিল ধ্রুবর এই অবস্থা দেখে। কেমন উন্মাদের মতো ব্যবহার করছিলো ধ্রুব। কী করবে সে? কীভাবে সামলাবে সে ধ্রুবকে?

    ধ্রুব হাঁটু গেড়ে মেঝেতে বসে পড়ে। অসহায় কন্ঠে বলে, “তাহু তুইও কী আমাকে একা ফেলে চলে যাবি? মা, বাবা, সবাই আমাকে ফেলে চলে গেছে। আমি অনেক খারাপ যে তাই। তুই প্লিজ আমাকে ছেড়ে যাস না। তুই যেভাবে বলবি আমি সেভাবে চলবো। তাও তুই আমাকে ছেড়ে যাস না। তুই ছাড়া এই পৃথিবীতে আমার আর কেউ নেই।”
    তাহিরা সাথে সাথে ধ্রুবর সামনে বসে তার দুইগালে হাত রেখে নরমসুরে বলল, “আমি কোথায় যাব তোকে ছেড়ে?”
    তাহিরা ধ্রুবর কপালে একটা চুমু খেল। তারপর জড়িয়ে ধরে ধ্রুবকে। সে জানে না এমন সময় কি বলতে হয়। মা হারানোর কষ্ট কোনো সান্ত্বনা দিয়ে কমে না। কিছুতেই কমে না। সে শূণ্যস্থানটা এই জীবনে কেউ পূরণ করতে পারে না। তার মনে আছে যখন তার মা-বাবা মারা গিয়েছিলো, সবাই তাকে অনেক সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করেছে। লাভ হয় নি। বরং তার কষ্ট বেড়েছে।

    ধ্রুবর বুকে মাথা রাখতেই সে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে তাহিরাকে। যেন একটু ছাড় দিলেই সেও উড়াল দিয়ে হারিয়ে যাবে তার দৃষ্টির কাছ থেকে। কেমন কাঁপানো গলায় বলল, “তুই আমাকে ছেড়ে গেলে আমি সত্যি মরে যাব।”
    তাহিরা শক্ত করে তার চোখ চেপে ধরল। ধ্রুবর শার্ট আঁকড়ে ধরলো। তার বুকে প্রচন্ড পীড়ন হচ্ছে। তার দুঃখ থেকে বেশি ধ্রুবর জন্য। তার মনে পড়ে শিল্পা আন্টি কাছে তার ওয়াদাটির কথা। সে একসময় ওয়াদা করেছিলো, সে কোনোমতেই ধ্রুবকে একা ছাড়বে না। সারাজীবন তার কাছে থাকবে। শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত।

    চলবে….

    [বিঃদ্রঃ ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। গল্পটা কেমন লাগছে জানাবেন। ধন্যবাদ।]

    সকল পর্ব

    https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=381227816949915&id=100051880996086

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here