বিষাক্ত প্রেমের অনুভূতি উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর) পর্ব :২৩

বিষাক্ত প্রেমের অনুভূতি

উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর)

পর্ব :২৩

(জানি লেট হয়েছে কমেন্টে রাগ ঝারতে পাড়েন।আমি সত্যি খুব ব্যস্ত 😓)

গিটারের টুংটাং আওয়াজে পুরো বাগান মেতে। বাচ্চারা আরহামকে ঘিরে। মধ্যমণি আরহাম গিটার হাতে গান গাইছে।

কন্যা রে

কন্যা রে, কন্যা রে
বাঁকা চুলে-তে খোঁপা আর বাইন্ধো নারে
কন্যা রে, কন্যা রে
বাঁকা চুলে-তে খোঁপা আর বাইন্ধো নারে
বাঁকা চুলে-তে খোঁপা আর বাইন্ধো নারে

ঐ চুলে-তে জাদু আছে রে
আমার ঘুম আসেনা রাতে
একলা ঘরে রে

কন্যা রে, কন্যা রে
বাঁকা চুলে-তে খোঁপা আর বাইন্ধো নারে
কন্যা রে, কন্যা রে
বাঁকা চুলে-তে খোঁপা আর বাইন্ধো নারে

অন্তর কাড়িলা বন্ধু, ঘুম কাড়িলা
বৃথা প্রেমের রঙিন আশা কেনো দেখাইলা?
মন দিয়েছি বন্ধু-আমার প্রান দিয়েছি
আজ থেকে সব-ই আমার উজাড় করেছি
কন্যা রে, কন্যা রে, আমার, কন্যা রে

কন্যা রে, কন্যা রে
বাঁকা চুলেতে খোঁপা আর বাইন্ধো নারে
ঐ চুলে-তে জাদু আছে রে
আমার ঘুম আসেনা রাতে
একলা ঘরে রে

সেহের লাজুক হেসে আড়চোখে পুকুরপাড় থেকে আরহামকে দেখছে।যেন গানটা তাকে সমর্পন করা।দূর থেকে আরহামকে বাচ্চাদের সাথে এই ভাবে মিশতে দেখে সেহেরের ভীষণ ভালো লাগছে।আরহামের চেহারায় এক ভিন্ন রকম চমক । ভিন্নরকম এক আমেজ । মুহূর্তে মনে হলো সেহেরের সামনে থাকা মানুষটা আরহাম না যেন অন্যকেউ। কোন ফেরেশতা । আজ যদি আরহামের সাথে এখানে না আসত তবে হয়তো কোনদিন আরহামের এই রূপের সাথে পরিচিত হবার সুযোগ মিলত না।
বৃষ্টি স্নাত পুকুরপাড় ।খানিক পূর্বে ঝপঝপ বৃষ্টি নেমে থেমেছে । আকাশ একদম পরিষ্কার।নীল সাদা রঙের ছড়াছড়ি।পুকুর পাড়ের বাঁশের সাঁকোটা বৃষ্টির পানিতে ভিজে।পাড়ের বড় কদম গাছটা্র কদম ফুল গুলো ঝিরঝির বৃষ্টির স্পর্শে ভিজে।সেহের সাঁকোতে বসে পুকুরের হিম শীতল পানিতে পা ভেজাচ্ছে।পায়ের রুপালি নুপুর গুলো রিনিকিঝিনি আওয়াজ তুলছে।অনেকদিন পর আজ খোলা আকাশের নিচে বসেছে।যেন অশান্ত ক্লান্ত মনটার মুহূর্তে সতেজ শান্ত নীড়ের সন্দান মিলল ।সেহের গুন গুন করে গান গাইছে।হ্ঠাৎ পাশে কাউকে অনুভব করল। ঘাড় ফিরিয়ে চাইল।আরহাম পানিতে পা ডুবিয়ে সেহেরের পাশে বসে । সেহের কোন প্রকার শব্দ করল না। আবার সামনে জলরাশির দিকে চোখ ফিরাল।ঠোঁটের কোণায় মিষ্টি হাসি লেগে।আরহাম নীরবতা ভেঙে বলল,

“ডিস্টার্ব করলাম? ”
“উহু ,বরং অনেককাল পর পথহারা পথিকে শান্তির নীড়ে ফিরিয়ে এনেছেন !”
ততক্ষণে সেহের আরহামের দিকে তাকিয়ে ।আরহাম সেহেরের চোখে চোখ রেখে বলল,
“তা কি করে? ”
“এই যে এখানে নিয়ে এসে। এতোদিনের অশান্ত ক্লান্ত মনটা আজ যেন এক চিলতে সুখ পেয়েছে ।আমি ভেবেছিলাম ….”
সেহেরের কথা কেটে আরহাম বলল,”কি ভেবেছিলে? ”
“আপনার তোড়জোড় দেখে ভেবেছিলাম আপনি হয়তো বড় কোন পার্টি এটেন্ড করতে যাচ্ছেন।”
“এখানে এসে তুমি খুশি নও? ”
“অবশ্যই ,অনেক অনেক খুশি।আজ এখানে না আসলে এই বাচ্চাদের না দেখলে হয়তো কোনদিন জীবনের এই কঠিন বাস্তবতা সম্পর্কে জানা হতো না।জীবন কতটা মূল্যবান তা জানা যেত না।আচ্ছা একট কথা জিগ্যেস করবো? ”
“হুম ”
“বাবা মাকে কখনো মিস করেন না? ”
“উহু ”
আরহামের উত্তরে সেহেরের ভ্রু কুঁচকে এলো ।আরহাম আগের মত সামনের দিকে চোখ রেখে বলল,”মিস করার মত কোন স্মৃতি নেই।সব কিছু মনের কোন এক অন্ধকার ঘরে ধুলো জমে আছে।যখনি বাবা মায়ের কথা ভাবতে যাই একরাশ অসহ্য যন্ত্রণা মাথা চেপে ধরে।অস্পষ্ট আবছা কিছু ছবি চোখে ভেসে উঠে”
এতোটুকু বলে আরহাম আবার নীরবতায় ডুবে যায়।সেহের তখনো আরহামের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ।আচমকা সেহের আরহামের কাছে চলে যায়। গাল ছুঁতে- ই আরহামের ঘোর কাটে।পলকহীন ভাবে সেহেরের দিকে তাকিয়ে থাকে।সেহের আরহামের গাল থেকে জড়া পাপড়ি তুলে আরহামের শক্ত মুষ্টিবদ্ধ হাতের উপরে রেখে বলে,
“মনে মনে একটু উইশ করে ফুঁ দিয়ে হাওয়ায় উড়িয়ে দিন ”
সেহেরের এমন ছেলেমানুষি কথায় আরহামে হেসে উঠে ।সেহের বোকাসোকা মুখ করে আরহামের দিকে তাকিয়ে । আরহাম কোনরকম নিজের হাসি থামিয়ে বলল,”এতে কি হবে? ”
“আপনার ইচ্ছা পূর্ণ হবে”
“এমন হয় নাকি? ”
“হুম ,শুনেছি হয়”
“ওকে ফাইন, তোমার যেহেতু এতোটা বিশ্বাস চেষ্টা করাই যায়।”
আরহাম সেহের চোখ বুঝে উইশ করল।তারপর ফুঁ দিয়ে হাওয়ায় ভাসিয়ে দিলো ।আরহাম সেহেরকে জিগ্যেস করল ,”কি চাইলে? ”
সেহের খোলা আকাশের পানে তাকিয়ে বলল ,”মুক্তি ,আপনি? ”
আরহাম বেশ কিছুক্ষণ সেহেরের দিকে শব্দহীন অপলক চোখে তাকিয়ে রইলো ।ভারী স্বরে বলল,”তোমাকে ”
সেহের তড়াক করে ঘাঁড় ফিরিয়ে আরহামের দিকে চাইল । আরহামের চোখে প্রেমের গভীর আকুতি।অজস্র ভালোবাসা। যা সেহেরের বুকের ভেতর বদ্ধ জানালার ওপারের আবদ্ধ ভালোবাসার লোহার বেড়াজাল গুলো ঝনঝন করে ভাঙছে ।সেই ঝনঝনানির গভীর হুংকার সেহেরের চোখে ভাসছে যে তা কি আরহাম বুঝছে?

সন্ধ্যা নামার পূর্বে আরহাম সেহের বাড়ীর উদ্দেশ্যে রওনা হয়। আসার সময় আরহাম বাচ্চাদের উপহার দেয়।সেহের দূর থেকে আরহামকে দেখছিল ।আরহামের চোখে পরিতুষ্টির ঝলক ফুটে ছিল। কঠিন মানুষ ভেতর এমন কমল হৃদয় থাকতে পারে তা সেহেরের জানা ছিল না।সেহের তৃপ্তির দৃষ্টিতে আরহামের পানে চেয়ে থাকে।

আকাশ থেকে কালো আঁধারের রথ নামচ্ছে।চারদিক নিরিবিলি ।গ্রামের পথ মাড়িয়ে গাড়ি শহরের দিকে উঠছে । দুদিকে ঘন জঙ্গল।মাঝবরাবর পিচ রাস্তা । খানিক বাদে বাদে দুএকটা গাড়ির দেখা মিলচ্ছে।সেহের গাড়ির সিটে হেলান দিয়ে দূর আকাশের পানে তাকিয়ে । বৃষ্টি স্নাত শীতল হাওয়া গোছানো চুল গুলো অগোছালো হয়ে যাচ্ছে। চোখে বারবার লেগে আসছে। তন্দ্রা তন্দ্রা ভাব।গাড়িতে মৃদু আলো ছড়িয়ে। আরহাম ড্রাইভ করছে।সেহেরকে ধীরে ধীরে নিদ্রায় তলিয়ে যেতে দেখে আরহাম গাড়ির আলো নিভিয়ে দেয়।গাড়ি ছুটে চলছে তার নিজ গতিতে।বেশ কিছুক্ষণ পর অকস্মাৎ ঝাঁকুনিতে সেহেরের নিদ্রা ভাব কাটে।নিদ্রালস ঘুম ঘুম চোখে উঠে বসে।গাড়ি শহরের ভেতর ঢুকেছে । বাহিরে গাড়ির উচ্চ আওয়াজে ভেঁপুর ডাক।সেহের বিরক্তি চোখে আরহামের দিকে তাকিয়ে জিগ্যেস করে,”বাড়ী পৌঁছাতে কতটুকু পথ ”
“জ্যাম ছাড়লে বিশ মিনিট ”
সেহের বিরক্তির ভঙ্গিতে গাড়ির জানালা খুলে বাহিরে তাকায়।হঠাৎ চোখ আটকায় রাস্তার অপর পাড়ে বার্ড শপে এক জোড়া পায়রার দিকে।সোনালি পিঞ্জিরাবদ্ধ ধবধবে সাদা পায়রা । হাত ছানি দিয়ে সেহেরকে ডাকছে।সেহের ফ্যালফ্যাল চোখে পায়রার দিকে তাকিয়ে ।যা আরহামের দৃষ্টি এড়ায় নি।জ্যাম ছাড়তে আরহাম গাড়িটা এক সাইডে পার্ক করে।সেহের বিস্মিত স্বরে বলে ,”জ্যাম ছেড়েছে ,থামলেন যে? ”
আরহাম কোন উত্তর দিল না বাঁকা হাসল।আরহামকে দোকানের দিকে অগ্রসর হতে দেখে সেহেরের বুঝতে বাকি রইল না।সেহের আন্দাজ করে গাড়ি থেকে আওয়াজ করে বলল ,”দেখতে সুন্দর ! এমনিতেই দেখছিলাম ,নেওয়ার প্রয়োজন নেই ”
আরহাম শুনল না।জোর আওয়াজে বলল,”যে জিনিসের উপর তোমার চোখ পড়বে তা একান্ত- ই তোমার। পছন্দের জিনিস হাত ছাড়া করতে নেই! ”
আরহামের কথায় সেহের ড্যাবড্যাব চেয়ে থাকল।গাড়িত ভেতর ভ্যাঁপসা গরম। আরহামের ফিরতে দেরী হওয়ায় সেহের গাড়ি থেকে নেমে দাড়ায়।পাশেই চায়ের দোকান।কাপ চামচের সংঘর্ষে টুংটাং শব্দ হচ্ছে।সেহের গাড়িতে হেলান দিয়ে দোকানের দিকে তাকিয়ে।এমন সময় চায়ের দোকান থেকে দুজন ছেলের হাসি আওয়াজ কানে ভেসে আসে।প্রথমে ধ্যান না দিলেও পরবর্তীতে লক্ষ করে।জ্বলন্ত সিগারেট হাতে ছেলে দুটো সেহেরকে নিয়েই কথা বলছে।সেহের শরীরে শাড়ির আঁচল জড়িয়ে নেয়।ছেলে গুলো সেহেরের পাশে এসে দাড়িয়ে সেহেরকে উদ্দেশ্য করে বলে,”কি সুন্দরী খরিদ্দার খুঁজছ বুঝি?আমাদের সাথে চলো টাকায় মুড়িয়ে দিবো ”
কথা গুলো সেহেরের গায়ে ভীষণরকম বাজে।রাগে গজগজ করতে করতে বলে,”জুতার বাড়ি চিনিস? বাড়িতে মা বোন নাই? তোরা নষ্ট বলে পুরো দুনিয়া তোদের মত নষ্ট? ঐ যে আমার স্বামী প্রাণে বাঁচতে চাইলে এখনি পালা ”
সেহের আঙুল উঠিয়ে আরহামকে দেখাতে ছেলে গুলো ভয় পেয়ে যায়।তড়িঘড়ি করে পালাতে নিলে সেহেরের সাথে একজনের ধাক্কা লাগে।হাতের জ্বলন্ত সিগারেট সেহেরের হাতের তালুতে লাগে।সাথে সাথে হাতে ফোসকা পড়ে যায়।সেহের হাত চেপে গাড়িতে হেলান দিয়ে দাড়ায়। আরহাম রোড পাড় হয়ে আসতে আসতে ছেলে দুজন মোটর সাইকেলে চড়ে পালায়।আরহাম মোটর সাইকেলের দিকে হিংস্র চোখে তাকায়।ততক্ষণে ব্রেনে মোটর সাইকেলের নাম্বার নোট করা হয়ে গেছে।

বাড়ি ফিরে আরহাম কোন কাজে মন দিতে পারছে না।সেহেরেরো একই হাল।বাড়িতে উৎসব ।আরহামের জন্মদিনের সেলিব্রেশন করা হচ্ছে। ভর্তি মানুষের কোলাহল । সবার মাঝে আরহাম সেহের শান্ত।সবার মাঝে থেকেও যেন নেই।সেহেত দূর থেকে দেখছে আরহাম রাগে হাত কচলাচ্ছে।চোখে মুখে ক্রুদ্ধভাব।সেহের সাহস করে আর কিছু বলল না।চুপ করে রইল।

গভীর রাত পুরো বাড়ি ঘুমে তলিয়ে। ঘড়িতে ঠিকঠিক দুটো।নিদ্রারত আরহামের চোখ ধপ করে খুলে।যন্ত্রের মত উঠে বসে।সেহেরের দিকে চোখ ঘুরিয়ে তাকায়, গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।আরহামের ঠোঁটের কোণে হিংস্র হাসি ফুটে উঠে।বিছানা ছেড়ে কাবার্ডের দিকে পা বাড়ায়।কালো লং কোর্ট আর গ্লাভস গুলো পরে নেয়।আলতো পায়ে ছাইরঙা বাড়ির দিকে পা বাড়ায়।বাহিরে টিপটিপ বৃষ্টি । বারান্দার পিঞ্জিরাবদ্ধ পায়রা গুলো অশান্ত ভাবে ছুটাছুটি করছে।কথিত আছে মৃত্যু সংবাদ পশুপাখি সর্ব প্রথম আঁচ করতে পারে।হয়তো কারো জীবনের অন্তিম সময় ঘনিয়ে এসেছে তা আঁচ করে পায়রা গুলো এতো অশান্ত!

চলবে ….❣️

ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন ।প্লিজ সবাই সবার মতামত জানাবেন😊😊😊

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here