বিষাক্ত প্রেমের অনুভূতি উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর) পর্ব :২৪

বিষাক্ত প্রেমের অনুভূতি

উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর)

পর্ব :২৪

সেহের ভার্সিটি যাওয়ার পথে নিউজ পেপারে চোখ বুলাচ্ছে।আরহাম পাশের সিটে ড্রাইভ করছে। পিছনের সিটে লিয়া বসে।নিউজ পেপারের হেড লাইনে সেহেরের চোখ আটকায়। বড় বড় অক্ষরে লিখা “রেলপথে মোটর সাইকেল সহ দুই আগন্তুকের লাশ।” হেড লাইন দেখে সেহের বিস্তারিত ঘটনা পড়ে । জানতে পারে গত রাত থেকে ছেলে দুজন নিখোঁজ।আজ সকালে রেলপথে ক্ষতবিক্ষত লাশ মিলেছে ।লাশ দেখে মনে হচ্ছে খুনি ভীষণ হিংস্রতার সাথে হত্যা করেছে।আশ্চর্যজনক বিষয় হলো ছেলে দুটোর লাশে সাথে চোখ আর হাত মিলেনি।লাশের উপর বিষাক্ত কেমিকেল ছিটানো যেন লাশে দ্রুত পচন ধরে।খুনি কোনো প্রকার প্রমাণ ছাড়েননি।খুনিকে আসতে যেতে কেউই দেখেনি । এমন একই ঘটনা এর পূর্বে আরো কয়েকটা কেসে দেখা গেছে।পুলিশ এবার ঘোর তদন্ত চালাচ্ছেন।ছেলে দুটোর ছবি দেখে সেহের ছিটকে উঠে গত রাতের ছেলে গুলো।এদের এতো ভয়ংকর মৃত্যু কে দিতে পারে? এর পেছনে কি সেই বাদামি চোখের অধিকারী সেই মানুষটার হাত! ভাবতেই সেহেরের গা কাঁটা নিয়ে উঠে।পেপার বন্ধ করে জড়সড় ভাবে বসে থাকে।চোখ মুখ আতংকে মাখা।যা আরহামের চোখ এড়ায় না।আরহাম ড্রাইভ করতে করতে আলতো স্বরে বলে,”ইজ এভরিথিং ওকে? ”
সেহের ভীতু চোখে আরহামের দিকে এক পলক তাকায়।সাথে সাথে চোখ ফিরিয়ে।”হ্যাঁ “সূচক মাথা নাড়ায়।এতে আরহামের সন্দিহান বাড়ে।গাড়িতে লিয়া থাকায় কিছু বলতে যেয়েও আর কথা বাড়ায় না।সেহের লিয়াকে ভার্সিটিতে ড্রপ করে।পার্টি অফিসের উদ্দেশ্যে রওনা হয়।

বিকালের শেষ প্রহর।আকাশ মেঘলা থাকায় ঠিক ধরা যাচ্ছেনা।মনে হচ্ছে এই বুঝি সন্ধ্যা নামল।হিম শীতল পরিবেশ।থেমে থেমে অগোছালো হাওয়া বইছে।মালিহা খানম সেহের গল্পে মেতে।অল্প সময়ে দুজনের মাঝে বেশ ভালো সখ্যতা হয়ে গেছে।অনেক সময় রক্তের সম্পর্ক থেকে হৃদয়ের সম্পর্ক গুলো বেশি জোরদার হয়।আর পরিস্থিতি সৃষ্টি করা সম্পর্কগুলোয় অন্যরকম এক জোর মজবুত শক্তি থাকে।যা রক্তের সম্পর্ক থেকে কয়েক গুন ঊর্ধ্বে।
সামনে ধোঁয়া উঠা চায়ের কাপ।মালিহা খানম সেহের হাসি ঠাট্টায় মজে।কথার মাঝে মালিহা খানম বলে,”তোমাদের সম্পর্ক ঠিক আছে তো? মানে… তোমাদের স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক! …আমি যা বলতে চাইছি তুমি হয়তো বুঝছ। ”
আচমকা মালিহা খানমের এমন কথায় সেহের বিষম খায়।ড্যাবড্যাব চোখে তাকিয়ে থাকে।সেহেরের চাহনি বুঝতে পেরে মালিহা খানম আবার বলল,”জানি আমার এমন প্রশ্নে তুমি অস্বচ্ছন্দ বোধ করছ।আমি লুকোচুরি করে কথা বলতে পারিনা।যা বলি যা করি সরাসরি বলতে করতেই পছন্দ করি।তোমাদের ভালোর জন্য গার্ডিয়ান হিসাবে আমার জানাটা জরুরি তোমরা আদৌ ভালো আছ তো? ”
সেহের লজ্জায় নিজেকে গুটিয়ে নেয়।মাথা নত করে চায়ের কাপে চামচ ঘোরাচ্ছে।মালিহা খানম আবার বলল,”বিয়েটা তোমার ইচ্ছে হয়নি তা আমার অজ্ঞাত নয়।শুনো প্রেম ভালোবাসা বিয়ে জীবনে একবার- ই হয়।বিয়ে এক পবিত্র বন্ধন । তোমার ভাগ্যের লিখনে আরহামের নাম ছিল।তুমি মানো আর না মানো আরহাম তোমার স্বামী।তাই যত দ্রুত সম্ভব এই সত্যিটা মেনে নেও।এতে তোমার ভালো।অগোছালো মন আর মস্তিষ্কে শান্তি মিলবে ।মন থেকে একবার সম্পর্কটাকে মেনে নিতে চেষ্টা করো ,দেখবে সব জটিলতা কেটে পানির মত সহজ সচ্ছ হয়ে যাবে।হাসবেন্ড হিসাবে আরহাম কিন্তু ততটাও মন্দ নয়,ভীষণ কেয়ারিং আর লাভিং একজন ! ”
মালিহা খানমের কথা গুলো সেহেরের মনে গাঢ় ছাপ ফেলল।সত্যি তো ,সেহের কেন নিজের জীবনকে এতোটা জটিল করছে।সম্পর্কটা না হয় জোর পূর্বক হয়েছে।বিয়ে নামক শব্দের জালে তো সে ঠিক আটকে।সেই ছোট থেকে মুক্তির সন্ধান করছে কই আজো কি তা ধরা দিয়েছে? মুক্তির সন্ধান করলে- ই তো আর মুক্তির খোঁজ মিলে না।বরং ধীরেধীরে সব কিছু আরো অগোছালো হচ্ছে। এই অগোছালো সম্পর্কটাকে একটা সুযোগ দিতে ক্ষতি কি? এতে যদি মনের অস্থিরতা কাটে তবে তাই হোক।সেহের মাথা ঝাঁকিয়ে নত স্বরে বলে,”জি দাদীমা ,আমি সম্পর্কটাকে একটা সুযোগ দিতে চাই ….কিন্তুইইই…কিন্তু…আমার কিছুটা সময় দরকার।”
সেহেরের উত্তরে মালিহা খানম এক চিলতে হাসল।আরহাম সেহেরের ভালো থাকার জন্য।সেহেরের মনে আরহামের জন্য ভালোবাসা জন্মানোর প্রয়োজন।

প্রতি বৃহস্পতিবারের মত আজ সন্ধ্যায় সেহের আনান আফনানের রুমে।ড্রইং- এ হেল্প করছে।তিনজন ছবি আঁকতে ব্যস্ত।রুম জুড়ে খিল খিল হাসির গুঞ্জন।দিশা বাড়ি ফিরে ফ্রেশ হয়ে আনান আফনানের রুমের দিকে পা বাড়ায়।দরজার সামনে আসতে থেমে যায়।ছেলেমেয়েদের এক সাথে দেখে বুক ভরে শান্তির নিশ্বাস টানে।সেই ঘটনার পর এতো দিন কাটল এখন অবধি সেহের দিশার সাথে কথা বলেনি।ভেতরে ভেতরে দিশা অশান্তিতে ছটফট করছে। কয়েকবার মেয়ের সাথে কথা বলতে চেয়েছে কিন্তু প্রত্যেকবার সেহের এড়িয়ে গেছে।মেয়ের এমন অগ্নিমূর্তির রূপ দিশাকে ভীষণ পীড়া দেয়।একটা সময় ছিল যখন দিশা নিজে সেহেরের থেকে দূরে পালাত।নিজ ইচ্ছে সেহেরকে নিজের থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু আজ! আজ সেহেরের এই খোপ দিশাকে তিলেতিলে মারছে। জীবনের সব অন্যায়ের শাস্তি এখন পাচ্ছে।ক্ষমা চাওয়ার মত মুখ নেই।এসব ভাবতে ভাবতে চোখ মুছে রুমের ভেতর পা বাড়ায়।আওয়াজ করে হাসি উজ্জ্বল মুখে বলে,”তোমরা কি নিয়ে এতোটা ব্যস্ত? শুনি? ”
মাকে দেখে সেহের ভ্রু কুঁচকে নেয়।মুখের হাসিটা বুজে যায়।আনান আফনান মাকে ড্রইং বুক বের করে দেখাচ্ছে। দিশা ছেলেদের প্রশংসা করছে। সেহের সব কিছু দেখেও নিজ কাজে ব্যস্ত।কোনরকম প্রতিক্রিয়া করছে না।ভীষণ শান্ত ভাবে বসে। আনান আফনান দূরে যেতে দিশা সেহেরের উদ্দেশ্যে বলে,”তুমি আনান আফনানকে এতোটা সময় দিচ্ছ দেখে ভালো লাগলো”
সেহের ড্রইং বুকে রঙ পেন্সিল ঘষতে ঘষতে বলল,”সম্পর্কটা আপনার সাথে শেষ হয়েছে ,সবার সাথে না! ”
“আমাকে কি একটা সুযোগ দেওয়া যায় না? তুমি কেন বুঝতে চাইছ না আমি যা করেছি তোমার ভালোর জন্য করেছি। ”
সেহের ধপ করে পেন্সিল রেখে। ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকায়।খানিক চুপ থেকে তাচ্ছিল্য স্বরে বলে,”আপনি আমার কতটা ভালো চান তা জানা আছে।যে মহিলা নিজের দুধের শিশুকে ফেলে নতুন সংসার সাজাতে পারে তার কাছে অন্তত মায়া মমতা আশা করিনা।ছোট থেকে এ পর্যন্ত আপনাকে সুযোগ দিয়ে এসেছি।আমি কোন কিছু বলিনি।আমার এখনো মনে পড়ে ফোনে আমার গলার ভাঁজ পেয়ে কি করে রেখে দিতেন । কিছু ভুলিনি।একটা কথা বলুন তো আমার জায়গায় লিয়া থাকলেও কি আপনি এমনটা করতেন? ”
দিশা চুপ করে থাকে।সেহের আবার বলল,”জানতাম আপনার কাছে জবাব থাকবে না।লিয়া বা আনান আফনানের সাথে আপনি কখনোই এমনটা করতে পারতেন না।কারণ তারা আপনার ভালোবাসার চিহ্ন আর আমি ভুলের! ”
কথা গুলো বলে সেহের বড় বড় পা ফেলে রুম থেকে বেরিয়ে যায়।দিশা আহত চোখে সেহেরের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। সেহেরের শব্দের প্রহার দিশার বুকে ভীষণ চোট ফেলেছে।

সামনে ইলেকশন।দাদাজানের সাথে আলাপ আলোচনা শেষ করে আরহাম স্টাডি রুম ছেড়ে রুমের দিকে পা বাড়িয়েছে।রুমের সামনে আসতে ভ্রু যুগল কুঁচকে আসে।অন্ধকার রুমটা এক ফালি চাঁদের আলোয় মাখা।সেহের রুমে নেই।বারান্দা থেকে পায়রা গুলো পাখার আওয়াজ ভেসে আসছে।আরহামের বুঝতে বাকি রইল না সেহের বারান্দায়।বারান্দার দিকে অগ্রসর হয়।বারান্দায় চোখ পড়তে আরহাম কেঁপে উঠে।কুঞ্চিত ভ্রু যুগল সটান হয়। সামনে মায়া রাজ্যের শাহজাদী শুভ্র শাড়ীতে চন্দ্র বিলাসে মগ্ন।আকাশে ইয়া বড় থালার মত চাঁদ।যার এক ফালি জ্যোত্স্নায় পুরো দুনিয়া মায়াবী আলোয় জড়িয়ে।আরহাম বারান্দার দরজায় হেলান দিয়ে দাড়িয়ে।নেশাপ্রবণ চোখ জোড়া সামনের চন্দ্রবিলাসিতে বুঁদ ।এলোমেলো ধমকা হাওয়া তার গোছানো শাড়ির ভাঁজ গুলো বারে বারে অগোছালো করে দিচ্ছে ।কোমর অবধি লতানো কেশ ঘাড়ের এক পাশে এনে রেখেছে। উন্মুক্ত ফর্সা পিঠ যেন আরহামকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে।প্রণয় নেশা মত্ত আরহাম ধীর পায়ে সামনের দিকে পা বাড়ায়।কারো উপস্থিতি টের পেয়ে সেহের ঘাড় ফিরিয়ে চাইল।আরহামে দেখে মিষ্টি করে হেসে বলল,”ফিরেছেন! আপনার অপেক্ষা – ই করছিলাম। ”
আরহাম কিছু বলল না।সেহেরের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল।আরহামের এই চাহনিতে সেহের লজ্জায় মাথা নত করে নেয়।আমতা আমতা স্বরে বলে,” ইয়ে …মানে…ভাবলাম সারাদিনের ক্লান্তি দূর করতে রিফ্রেশমেন্টের জন্য একান্ত ্কিছু সময় কাটানো যাক! ”
“একান্ত? ”
আরহামের ঠোঁটের কোণায় দুষ্টু হাসি ঝুলে ।যা সেহেরকে আরো লজ্জায় ফেলে।সেহের গলা ঝেড়ে আমতা স্বরে বলে,”মা…মানে কফি খেতে খেতে গল্প করা”
সেহেরের বোকাসোকা মুখ দেখে আরহাম ফিক করে হাসল।সেহের বেশ বুঝতে পারল আরহাম পিঞ্চ করছিল। বেতের চেয়ার দুজন মুখোমুখি বসে।দুজনের হাতে ধোঁয়া উড়া কফির মগ।দুজনের মাঝে পিনপতন নীরবতা ।এলোমেলো ধমকা হাওয়া কানেকানে ফিসফিস করে কিছু একটা বলতে চাইছে । সেহের ঘাসের উপর নক ঘষছে।চেহারা দেখে মনে হচ্ছে কিছু বলতে চাইছে।কিন্তু নার্ভাসনেসের জন্য বলতে পারছে না।আরহাম তা ধরতে পেড়ে জিগ্যেস করল,”কিছু বলতে চাইছ ? ”
সেহের ফ্যালফ্যাল চোখে আরহামের দিকে চেয়ে “হ্যাঁ” সূচক মাথা নাড়াল।আরহাম আবার বলল,”দ্বিধাহীন বলতে পারো ”
সেহের মাথা তুলে আরেকবার আরহামের দিকে চাইল।মুখোমুখি বসে কথা গুলো বলা অসম্ভব।সেহের অন্তত তা পারবেনা।তাই চেয়ার ছেড়ে কফির মগ হাতে করে রেলিং ধরে দাড়ায়।চুল গুলো উন্মুক্ত পিঠে ছড়িয়ে নিশ্বাস নিয়ে বলে,”আমাদের বিয়েটা আর পাঁচটা বিয়ের মত হয়নি।জানি আমি আপনার মন মত নয়।এটাও জানি বিয়েটা শুধুমাত্র একটা ডিল।এতোদিন সম্পর্কটা ভাঙতে চেয়েছি কিন্তু এখন আমি চাই….আমি চাই আমাদের সম্পর্কটাকে একটা সুযোগ দিতে।বিয়েটা আর পাঁচটা বিয়ের মত স্বাভাবিক ভাবে নিতে।সবটা গুছিয়ে নিতে আমার কিছুটা সময়ের প্রয়োজন! ”
সেহের এক নিশ্বাসে কথা গুলো বলল। আরহামের ঠোঁটের কোণে উল্লাসের হাসি।সেহেরে এলোমেলো কথা গুলো আরহামকে ঠিক কতটা অগোছালো করে দিয়েছে তা হয়তো সেহেরের জানা নেই।আরহাম চট করে সেহেরকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে।শাড়ির ভাঁজে হাত বুলিয়ে কোমর চেপে ধরে।খোলা কেশে অনবরত ঠোঁট ছুঁয়িয়ে নাক ডুবিয়ে মাতাল ভারী স্বরে বলে,” টেক ইউর টাইম ,খানিকের জন্য নয় চিরকালের জন্য তোমাকে চাই। তুমি আমাদের সম্পর্কটা নিয়ে ভাবছ তা আমার জন্য যথেষ্ট! আমি অনন্তকাল তোমার অপেক্ষায় থাকবো। ”
আরহামের গাঢ় স্বরে সেহের বরাবরের মত কেঁপে উঠছে।আরহামের বুকে শরীরের ভার হেলে দেয়।আরহাম সেহেরের চুলের মিষ্টি মাদকাসক্ত ঘ্রাণ নিতে ব্যস্ত। অবুঝ সেহের কি আদৌ বুঝছে, সে আরহামকে কতটা অগোছালো করে দিচ্ছে?

চলবে…❣️

ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।প্লিজ সবাই সবার মতামত জানাবেন😊😊😊।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here