#যে শ্রাবণে এলে তুমি💕💕
#পর্ব:29
#লেখনিতে:মৌসুমী।
নিরাকে অনেকক্ষণ বুকে নিয়ে শুয়ে থাকার পর হঠাৎ ঝটকা দিয়ে সরিয়ে দিলো ফারদিন।নিরা এতক্ষণ ধরে ব্যাথায় কেঁদেই যাচ্ছিলো।ফারদিন হঠাৎ ফেলে দেওয়াতে কাঁন্নাগুলো থেমে গেলো।সে অবাক হয়ে ফারদিনের দিকে তাকিয়ে আছে।ফারদিন আগুন চোখে নিরার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললো,
-তোমাকে সেদিন বিয়ে করাটাই আমার ভূল হয়েছে।একটা অনুভূতিহীন মেয়ে।আজ পর্যন্ত আমার কষ্টটাই বুঝলোনা।তুমি এতটাও ছোট নও যে তোমাকে সব খুলে বলতে হবে।অনার্স ফাইনাল ইয়ারে পড়ো তুমি।কিন্তু এখুনো তোমার চালচলন ,ব্যবহার বাচ্চাদের মত।
কি শয়তানে যে আমাকে সেদিন ধরলো,ধুর।ফারদিন রাগে তরতর করে কাঁপছে।নিরার কাঁন্নাগুলো এখন আবার বাঁধ ভেঙে নামতে শুরু করলো।মুখে সে কিছুই বলছেনা।
ফারদিন বিছানা থেকে নেমে সিগারেটের প্যাকেট থেকে সিগারেট নিয়ে তাতে আগুন ধরালো।একবার টান দিয়ে সেই ধোঁয়াটা নিরার মুখের কাছে মুখ নিয়ে ছেড়ে দিলো।নিরা এবার কাঁন্না রেখে কাশতে শুরু করলো।ফারদিন একটার পর একটা সুখটান দিচ্ছে সিগারেটে আর নিরার মুখের ওপর ধোঁয়াগুলো ছাড়ছে।কাশতে কাশতে নিরার অবস্থা কাহিল।ফারদিন সিগারেট খাওয়া শেষ করে বিছানায় সটান হয়ে শুয়ে চোখ বন্ধ করলো ।নিরা বিছানা থেকে নেমে আসতে আসতে হেঁটে আসলো দরজার কাছে।দরজা খুলে গেস্টরুমে গিয়ে সেখানেই এলোমেলো হয়ে শুয়ে পড়লো।
”
”
সকালের সোনালী রোদে পদ্মার পানিগুলো চিকচিক করছে।বর্ষার পানিতে পদ্মা এখন গমগমে।স্রোতের সাথে পাল্লা দিয়ে ছুটে চলছে এক একটা নৌকা।যতদূর চোখ যাচ্ছে পানি আর পানি।বাতাসে ফারদিনের মাথার চুলগুলো উড়ে এসে কপালে পড়ে ফারদিনের মুখটাকে আরো আকর্ষনীয় করে তুলছে। ঘাসের ওপর বসে একমনে নদীর ঢেউগুলোর খেলা দেখছে সে।পাশেই কপোত-কপোতিরা বসে থেকে তাদের ব্যক্তিগত কথায় ডুবে আছে ।ফজরের নামাজ পড়েই এখানে চলে এসেছে সে হাঁটতে হাঁটতে।মনটা খুব খারাপ বলে ক্ষিদেটাও সেভাবে জাপটে ধরেনি তাকে এখুনো।ঢেউএর খেলা দেখতে দেখতে একটু দূরে বসে থাকা অল্প বয়সী ছেলেমেয়েদের দিকে চোখ চলে গেলো ফারদিনের।ওদের দেখে বুকের ভিতরের কষ্টগুলো আরো যেনো জেগে উঠলো সাথে সাথে।মনের মাঝে কত শত স্বপ্ন একেঁ রেখেছিলো সে নিরার জন্য কিন্তু নিরার চোখে সে কখনো পড়লোই না।নিরা নামের মেয়েটাকে যেদিন প্রথম দেখেছিলো সেদিন ই বুকের ভিতর ছ্যাত করে উঠেছিলো যা আগে কখনো কোন মেয়েকে দেখেই হয়নি।বুকের বাঁ পাশের ছোট্ট হৃদপৃন্ডটা সেদিন অনবরত লাফিয়েই চলেছিলো যা হাত দিয়ে থামাতে পেরেছিলোনা ফারদিন।ফারদিনের ভাবনার মাঝেই ছোট একটা ছেলে এসে ফারদিনের পাশে দাঁড়িয়ে বললো,
-ভাইজান বাদাম লিবেন?
ছেলেটার কথায় ভাবনাগুলোকে বুকের গোপন পকেটে তালা দিয়ে ছেলেটার উদ্দেশ্যে বললো,
-বাদাম,,,
-জ্বি ভাইজান,লেন,ভালো বাদাম,দেখেন কত বড় বড় বাদামগুলা।
-অনিচ্ছা সত্বেও ছেলেটার কাছ থেকে বাদাম নিলো ফারদিন।খালি পেটে বসে বসে বাদাম চিবোলেও যদি নিরা নামের ওই ঝড়টাকে কিছুক্ষণ ভূলে থাকা যাই সেটা মন্দ হয়না কিন্তু মনটা বড় বেয়ারা,কথা শুনেনা।
সারাদিন বাড়ি ফিরেনি ফারদিন।শেষ বিকেলের দিকে শুকনো মুখে বাড়ি ফিরে দেখে নিরার বাবা-মা আর উৎস এসেছে।ফারদিনকে দেখেই নেওয়াজ সাহেব বললেন,
-এইতো ফারদিন বাবা এসেছে।নেওয়াজ সাহেবের কথায় সবাই দরজার দিকে তাকালো।ফারদিন এসে সবাইকে সালাম দিয়ে তার মা ফজিলা বেগমের পাশে বসলো।ফয়েজ বসে আছে জামান সাহেবের পাশে।জামান সাহেব বললেন ,
-ফয়েজ তো রাজি এবার ফারদিনকে বলেন বেয়াই,সে অনুমতি দিলে আমাদের কোন আপত্তি নেই।আর নিহাও তো অনেকদিন আপনাদের ওখানে গিয়ে থাকেনি ।
-কোন বিষয়ে অনুমতি দিবো?কপাল ভাজ করে বললো ফারদিন।
ফজিলা বেগম বললেন,
-নিহা আর নিরাকে নিয়ে যেতে চাচ্ছে বেয়াই আর বেয়ান।সাথে তোরা দুই ভাইও।
ফারদিন নিরার দিকে এক পলক তাকালো,সে নিহার পাশে জড়োসড়ো হয়ে ওড়না দিয়ে মাথা ঢেকে বসে আছে।গলা ,হাত সব ওড়না দিয়ে মুড়িয়ে রেখেছে।এভাবে নিরাতো থাকেনা।বড়জোর মাথায় ওড়না থাকে তবে হাতগুলো ওড়নার মধ্যে এভাবে গুটিয়ে রাখেনা।হঠাৎ ফারদিনের কাল রাতের কথা মনে পড়লো,কাল সেই নিরাকে ইচ্ছামত কামড়িয়েছে তাই সেগুলোর ক্ষত ঢাকতেই হয়তো নিরা এভাবে ওড়না জড়িয়ে রেখেছে।
কিরে কি বলছিস বল?যাওয়ার বিষয়ে তোর কি মত?
জামান সাহেবের কথায় সেদিকে এবার তাকালো ফারদিন।ফারদিনের বিয়ের দিন থেকে ফারদিনের সাথে কথা বলতোনা জামান সাহেব।আজ অনেকদিন পর তিনি তার ছেলের সাথে কথা বললেন।আনন্দে ফারদিনের বুকটা ভোরে গেলো,তার আব্বা তার সাথে কথা বলেছে এর থেকে আনন্দের আর কি হতে পারে।ফারদিন জামান সাহেবকে বললো,
-আপনিতো অনুমতি দিয়েছেন ওদের যাওয়ার জন্য এখানে আমি কি বলবো।তবে ভাইয়া যাক আমি যাবোনা।
মাহফুজা বেগম ধরমড়িয়ে বললেন,
-কেনো ফারদিন,তুমি যাবানা কেনো?তুমি আমার বাড়ির নতুন জামাই,তুমি না গেলে চলে।আর তাছাড়া আমাদের আত্মীয়-স্বজনদের তোমাদের বিয়ের কথা বলেছি।তারা যদি দেখে বিয়ের পর মেয়ে এসেছে বাপের বাড়ি কিন্তু জামাই আসেনি তখন তারা অন্য কিছু ভাববে।তুমিও চলো আমাদের সাথে।ওখান থেকেই না হয় হসপিটালে যাতায়াত করবে।আর বেয়ান আর বিয়াইএর জন্য ভাবতে হবেনা,আমি খাবার পাঠিয়ে দিবো তিনবেলা।বক্কর গিয়ে নিয়ে আসবে।
-আন্টি আমি বাড়ি ছাড়া তেমন কোথাও থাকিনা।এটাতো আপনি জানেন।
ফারদিনের আন্টি বলা শুনে ফজিলা বেগম ফারদিনের ওপর ধমকে উঠলেন,
-আন্টি কাকে বলছিস তুই,কে তোর আন্টি?শ্বাশুড়ীকে কেউ আন্টি বলে।মায়ের কথায় ফারদিন থতমত খেয়ে হ্যাবলার মত সবার দিকে তাকাচ্ছে।মাহফুজা বেগম হাসি আটকানোর চেষ্টা করতে করতে ফজিলা বেগমকে বললেন,
-বেয়ান থাক এরকম ভাবে বলিয়েন না,আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে।
-না না বেয়ান তা হবে না,ও এখন থেকে আপনাকে মা বলে ডাকবে,ফয়েজ যেমন ডাকে।আর বেয়াইকে আব্বা।
পাশ থেকে ফারদিন মিন মিন করে বললো,
-আমি চেষ্টা করবো।কিন্তু কথা হলো আমি দুদিনের বেশি থাকতে পারবোনা।
ফয়েজ এবার কথা বললো,এতক্ষণ সে চুপচাপ বসে ছিলো।
-আমি এখন গিয়ে থাকতে পারবোনা মা,আপনি আপনার মেয়েকে নিয়ে যান, আমি সময় পেলে যাবো।এখন আমার খুব কাজের চাপ।
নেওয়াজ সাহেব বললেন,
-রাতে তো আর কাজ নাই,সকালে চলে যেও আমাদের ঐখান থেকেই কাজে।
জামান সাহেব বললেন,
-যাবিনা কেনো ,যা।তারপর নিহা আর নিরাকে বললেন,
-শোনো মায়েরা যাচ্ছো যাও বাপের বাড়ি কিন্তু এক সপ্তাহের বেশি একদিন ও থাকবানা বুঝেছো।আমরা বুড়ো -বুড়ি না হলে পাগল হয়ে যাবো একা এতবড় বাড়িতে থাকতে থাকতে।
সবাই কথাবার্তা বলে সন্ধ্যার পড় রওনা হলো ।নিরা যাওয়ার সময় শুধু কথা বলেছে সকলের সাথে।তার আগে বা এখন অব্দি তেমন কোন কথায় বলছেনা।একদম চুপচাপ আছে।ব্যাথায় তার শরীর টনটন করছে।শরীরটাও জ্বর জ্বর করছে।যাওয়ার আগে আলমারি থেকে কাপড় চোপড় বের করে গলার চেইন বের করার সময় নিরা একটা ডায়েরি পায় আলমারীতে।এতদিন এটা নজরে পড়েছিলোনা তার ,আজ ই পড়েছে।বেশ মোটা একটা ডায়েরি।ডায়েরির প্রথম পাতার পরের পাতা উল্টিয়ে দেখেছে কার এটা।সেখানে লিখা আছে,পড়ার জন্য কাউকে অনুরোধ করিনি,তাই কেউ আর একটা পাতাও উল্টাবেননা।ডায়েরিতে এরকম করেও এই কথা কেউ লিখে রাখে তা নিরার জানা ছিলোনা।এই লেখা দেখে নিরার কৌতুহলি মন আরো জেগে উঠলো।সে জানে যে ডায়েরিতে মানুষ তার জিবনে সব কথাগুলো লিখে রাখে।সেটা অন্যকারো পড়া ঠিক না বিনা অনুতমিতে তারপরো নিরার ইচ্ছে জাগলো যে এর ভিতর কি লিখা আছে সেটা পড়ার।দেখেই বোঝা যাচ্ছে এটা ফারদিনের।আর সে এটা অনেকদিন থেকেই হাত দেয় নি।কারণ এটা একটা গোপন স্থানে রাখা।নিরা তার গলার চেইন ওই স্থানে রেখেছিলো বলেই দেখতে পেয়েছে ।কিন্তু রাখার সময় সে খেয়াল করেছিলোনা।
”
”
মাহফুজা বেগম বাড়ি এসেই রান্নাবান্নার আয়োজন শুরু করেছে।নিহাও হাতে হাতে সাহায্য করছে।টুনি সব কেটেকুটে দিচ্ছে।দুই জামাই যাতে রাতে একটু তৃপ্তি নিয়ে খেতে পারে সেজন্য মাহফুজা বেগম কোমড় বেঁধেই কাজে লেগেছে।ফয়েজ আর উৎস টিভিতে খবর শুনছে।নেওয়াজ সাহেব ঘরে বসে বই পড়ছেন।ফারদিন এসেই আবার গেছে বাইরে চা খেতে।এখানকার কোন দোকানের চা নাকি খুব ভালো তাই ফারদিন সময় পেলেই সে দোকানে গিয়ে চা খায়।
নিরা গুটিসুটি মেরে কাঁথা গাঁয়ে দিয়ে শুয়ে আছে তার ঘরে।এতোদিন পর নিজের ঘরে এসে তার খুব ভালো লাগছে।শুয়ে শুয়েই ঘরের প্রতিটি কোনা চোখ বুলিয়ে দেখছে সে।বারান্দার গাছগুলো রুমে ঢুকেই দেখে এসেছে।গাছগুলোতে উৎস হয়তো পানি দেয় বলে গাছগুলো ভালোই হয়ে আছে।গোলাপ গাছটাতে ফুল এসেছে।ফোন থাকলে ছবি তুলে সেটা তিশাকে দেখাতো।তিশা আর ও একসাথে গিয়ে দুজন দুইটা গাছ নওঁদাপাড়া আমচত্বরের কাছে নার্সারী আছে সেখান থেকে কিনে এনেছিলো গ্রামে যাওয়ার আগে।তিশার সাথেও কথা হয়নি অনেকদিন হলো।কলেজে যাবে ভাবছে কাল না হয় পরশু তারপর তিশাকে কারো ফোন থেকে কল করে ডাকবে।
চলবে….
দুঃখিত দেরি করে দেওয়ার জন্য গল্পটা।আপনারা নিশ্চয় অপেক্ষা করে ছিলেন।