যে শ্রাবণে এলে তুমি পর্ব:৩৫

0
680

#যে_শ্রাবণে_এলে_তুমি💕💕
#পর্ব_35
#লেখনিতে_মৌসুমী

আলমারী খোলার শব্দে ফারদিন নড়েচড়ে উঠলো ঘুমের মধ্যেই।নিরা ফারদিনের নড়াচড়ায় একটু চুপ করে দাঁড়ালো যখন দেখলো ফারদিন ঘুমাচ্ছে,জেগে উঠেনি তখন আবার তার কাজে লেগে পড়লো।ডায়েরিটা যেখানে যেমনভাবে ছিলো এখুনো ঠিক তেমনভাবেই সেখানে আছে।ডায়েরিটার উপর হাত রেখে নিরার মনে হলো ,অন্যের ব্যক্তিগত ডায়েরি পড়াটাকি ঠিক হবে?যদি বুঝে ফেলে আমি পড়েছি তাহলেতো খুব রাগ করবে।কিন্তু মনটাও আনচান করছে পড়ার জন্য,কি যে করি,থাক না হয় পড়বোনা।ডায়েরির উপর থেকে হাতটা সড়িয়ে ফেললো নিরা।তারপর মনে মনে আবার যুদ্ধ করে ডায়েরিটাই হাত দিলো সে।ঝট করে ডায়েরিটা নিজের হাতে তুলে আলমারিটা কোনরকম লাগিয়েই ফারদিনের দিকে এক নজর দেখে বারান্দায় চলে আসলো নিরা।বারান্দার দরজাটা লাগিয়ে দিয়েছে তারপর আলো জ্বালিয়ে ইজি চেয়ারে বসে পড়লো নিরা।

ডায়েরিটার পাতাগুলো একটার পর একটা উল্টাচ্ছে নিরা।কিছুই নেই লেখা।এভাবে দশ-পনেরো পৃষ্টা উল্টানোর পর দেখতে পেলো ফারদিনের একটি হাসিমাখা মুখের ছবি।অনেকদিন আগের তোলা ছবিটা সেটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে।পরের পৃষ্ঠায় লিখা আছে পরিস্কার ভাবে যে,আমি ফারদিন আহমেদ,এই ডায়েরিটা খুব পছন্দের একটি ডায়েরি আমার।শখের বসেই কিনেছিলাম তবে ডায়েরি লিখার অভ্যাস না থাকার কারণে লিখার মত কিছুই পাইনা।আজ হঠাৎ লিখতে ইচ্ছে হলো তাই ভাবলাম কিছু লিখে রাখি।ফারদিনের হাতের লেখা দেখে নিরা মুগ্ধ।কে বলেছে ডাক্তারদের হাতের লেখা ভালো না,এইতো কত সুন্দর ঝরঝরে হাতের লেখা।আর মানুষে বলে ডাক্তারদের হাতের লেখা ভালো না,তাহলে এসব কি ?কত চমৎকার হাতের লেখা।
পরের পৃষ্ঠা আবার ফাঁকা।তার পরের পৃষ্ঠায় আবার দেখতে পেলো লেখা।

এতদিন ভাবতাম ডায়েরিটাই লিখবোটা কি?তবে এখন মনে হচ্ছে আমি আমার মনের গোপন কথাগুলোয় তো এখানে লিখে রাখতে পারি।যা কাউকে বলতে পারছিনা তা তো এখানেই প্রকাশ করা যাই।তাহলে মনটাও একটু হালকা হয়।

এইচ এস সি পরিক্ষা দিয়েই ঢাকায় চলে এসেছিলাম। মাঝে মাঝে আসতাম রাজশাহী। তেমন আসা হতো না পড়াশোনার চাপে। তারপর একদিন বাড়িতে যাওয়ার জন্য মনটা খুব খারাপ করছিলো তাই বাড়ি চলে গিয়েছিলাম।রাতের ট্রেনে উঠে সকাল বেলায় রাজশাহী এসে পৌঁছেই সোজা বাড়ি গিয়েই দিয়েছিলাম টানা ঘুম।সেদিন দুপুরে নামাজ পড়ে যখন খেতে বসলাম তখন ই আমার সেলফোনটা বেজে উঠলো,দেখি আমার বন্ধু তন্ময় ফোন দিয়েছে আমাকে।তন্ময় জানতোনা আমি রাজশাহী আছি।যখন জানলো আমি রাজশাহীতে তখন বললো,বিকেলে যেনো বিজিবিতে ওদের সাথে আড্ডা দিতে যাই।বিজিবিতে প্রতিদিনি আমার কয়েকজন বন্ধু আড্ডা দেয় বিকেলের দিকে,আগে আমিও যেতাম।যাইহোক ,বিকেলে আছরের নামাজ জিরো পয়েন্টের ওখানে যে বড় মসজিদ আছে ওখানেই পড়ে রওনা দিয়েছিলাম বিজিবিতে।সাথে বাইক থাকায় যেতে দেরি হয়নি।কিছুক্ষণ আড্ডা দিতেই দেখলাম আকাশে মেঘ।সন্ধ্যে হতেও দেরি নেই।তাই আর দেরি না করেই বাইক নিয়ে ছুট দিলাম।পথেই শুরু হয়ে গেলো বৃষ্টি ।বড় বড় ফোঁটায়।বাইকে থাকার কারণে মুহূর্তেই ভিজে গেলাম।বাইক নিয়ে আসতে আসতেই সোনাদিঘির মোড়ে এসে দেখি জ্যাম বেঁধে আছে।আমি মাস্টারপাড়ার এপাশ দিয়েই আসছিলাম ,মনে মনে বললাম,যাহ শালা ,এই রাস্তায় দিয়ে আসলাম ক্যান বোকার মত,এখন ফেঁসে গেলাম,বৃষ্টিতে ভিজা নিয়ে আমার সমস্যা নাই কিন্তু সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছিলো ,আজান দিবে আর নামাজটা কাজা করতে চাচ্ছিলাম না।কিন্তু জ্যামের জন্য আটকা পড়লাম।রাজশাহীতে অবশ্য ঢাকার মত ভয়ংকর জ্যাম বাঁধেনা।নানা কথা মাথায় ঘুরতে ঘুরতে একসময় আমার চোখ পড়লো রাস্তার অপজিটের একটা রিকশায়।রিকশাটা এপাশেই আসতে আসতে আটকা পড়েছে।রিকশাটায় দুইটা মেয়ে আছে তার মধ্যে কালো রঙের বোরখা পড়া একটা মেয়ে রিকশার ওপর দাঁড়িয়ে এতো এতো মানুষের সামনে দু হাত মেলে বৃষ্টিতে ভিজছে।আমি মেয়েটার দিকে তাকিয়ে কোনভাবেই চোখটা ফেরাতে পারছিলামনা অন্যদিকে।মনে হচ্ছিলো আমার চোখটা আটকে গেছিলো মেয়েটার ওপরে।অনেক মেয়ে দেখেছি এ জিবনে,অনেক বান্ধবীও ছিলো কিন্তু কারো দিকে আমার দৃষ্টিটা এভাবে আটকেনি কখনো।বুকের ভিতরের হৃদপৃন্ডটা অনবরত ধাপধুপ করে লাফাচ্ছিলো যা আমি হাত দিয়ে চেপে ধরেও থামাতে পারিনি।চারিদিকে আজান হচ্ছে,জ্যাম ছুটে গেছে আমার সেদিকে খেয়াল নেই,আমার খেয়াল রিকশার ওই কালো বোরখা পড়া বৃষ্টিবিলাসির দিকে।তার চোখ,তার ঠোঁট,ঠোঁটের হাসি সবটাই আমাকে আকর্ষণ করছিলো।আমি মেয়েটিকে দেখে এতোটাই দূর্বল হয়ে গেছিলাম যে মেয়েটার রিকশা কখন সেই স্থান ত্যাগ করেছিলো তা বুঝতেই পেরেছিলাম না।পেছনের মানুষের কথায় আমার যখন হুস ফিরলো তখন দেখি রিকশাও নাই আর সেই মেয়েটাও নাই।আমি কি স্বপ্ন দেখছিলাম এতক্ষণ এমন মনে হচ্ছিলো মেয়েটাকে পরে দেখতে না পেয়ে।সেদিন মেয়েটার ভাবনা নিয়েই বাড়ি ফিরেছিলাম,তারপর ভেজা কাপড় তাড়াহুড়া করে চেন্জ করেই মাগরিবের নামাজ পড়েছিলাম।নামাজের মোনাজাতেও বলেছিলাম আল্লাহকে যে, আল্লাহ আমি মেয়েটাকে কি বাস্তবেই দেখেছিলাম নাকি তখন আমি জেগে জেগে স্বপ্ন দেখছিলাম।যদি স্বপ্ন না হয়ে থাকে তাহলে তুমি আবার মেয়েটাকে আমার সাথে দেখা করিয়ে দিও।আল্লাহ আমার কথা শুনেছিলো,পরেরদিন ই আমি আবার মেয়েটাকে দেখি।আর দেখার পর স্বপ্ন না বাস্তব সেটা দেখার জন্য নিজের হাতে চিমটিও কেটেছিলাম খুব জোরে।আমার বন্ধু আসিফ আমার চিমটি কাঁটা দেখে বলেছিলো,
-কিরে চিমটি কাটছিস কেনো একা একা নিজের হাতে?আমি বললাম,
-দোস্ত দেখতো সামনে যেই মেয়েটাকে ওই ছাদের ওপরে দেখছিস সে কি আসলেই ওখানে আছে?ওই যে হালকা গোলাপি রঙের ওড়না মাথায় যে মেয়েটা তার কথা বলছি।আসিফ তখন বললো,
-হ্যাঁ দেখছিতো কি হয়েছে তাতে?তারপর হঠাৎ উত্তেজিতো হয়ে আসিফ বলেছিলো,কি ব্যাপাররে ফারদিন,তুই হঠাৎ মেয়ে মানুষ দেখছিস।তুই তো এমন না,কি হয়েছে?
আমি বললাম,
-দোস্ত আমি ওই মেয়েকে কাল দেখেছি তারপর থেকে আমি পাগল হয়ে গেছি,কাল সারারাত আমি ঘুমাতেও পারিনি জানিস,আসিফ আমার কথা শুনে অবাক হয়ে গেছে,সে বললো,
-কি বলিস তুই এসব।একদিন দেখেই কেউ এমন করে। তুই তো দেখছি সত্যিই পাগল হয়ে গেছিস।
-হ্যাঁ আসিফ আমার এমন আগে কখনোই হয়নি,দেখ আমার বুকের বাঁ পাশে হাত দিয়ে কেমন লাফাচ্ছে বলেই আসিফের হাতটা আমার বুকের বাঁ পাশে নিয়ে দেখিয়েছিলাম।
তারপর আসিফকে বলেছিলাম তুই চিনিস মেয়েটাকে?আসিফ বললো,
-চিনবোনা কেনো?ছোটবেলা থেকেই দেখছি ওকে।ওটা ওদের বাড়ি।বিকেলে ছাদে উঠলেই দেখতে পাই।আমি বললাম,
-এর আগেও তো তোদের ছাদে এসেছি কৈ আগে তো দেখিনি,আজ যেমন দেখতে পাচ্ছি।
-সেদিন হয়তো সে ছাদে আসছিলোনা তাই দেখিসনি।তারপর আসিফ ই আমাকে মেয়েটার নাম বললো,কোন ক্লাসে পড়ে ,কয় ভাইবোন সব ই।শ্রাবণ মাস ছিলো তখন সেজন্য বৃষ্টি লেগেই থাকতো,সেদিন ছাদে দাঁড়িয়ে মেয়েটাকে দেখতে দেখতেই আবার বৃষ্টি এসে গেছিলো,মেয়েটা সেদিন আর ভিজেছিলোনা বৃষ্টিতে,বৃষ্টি শুরু হতেই সে বাসার ভিতর ঢুকে গেছিলো তাই আমি আর আসিফ ও নেমে গেছিলাম।আমাকে ঢাকায় ফিরতে হতো বলে আসিফকে বলেছিলাম সে যদি ফোন নাম্বারটা জোগার করে দিতো তাহলে ঢাকা থেকেই আমি মেয়েটার সাথে যোগাযোগ করতে পারতাম।তবে মনে মনে ভাবছিলাম,নাইনে পড়া মেয়ের কাছে ফোন নাও থাকতে পারে কিন্তু ছিলো,মেয়েটার ফোন ছিলো আর আসিফ সেই নাম্বার আমাকে যোগার করেও দিয়েছিলো।
ঢাকা গিয়ে সেদিনি আমি মেয়েটাকে ফোন করি,এরপর আস্তে আস্তে আমার কথা হতে থাকলো ,সম্পর্কটাও গভির হতে থাকলো।ডাক্তারী লাইনে পড়ার কারণে বেশি কথা অবশ্য আমরা বলতাম না তবে প্রায় প্রতিদিন ই আমাদের কথা হতো।ভালোবাসার এক সুপ্ত মায়ায় গভীরভাবে জড়িয়ে গেছিলাম।তবে আমি মেয়েটার সব কিছু জানলেও মেয়েটা আমার নামটা পর্যন্ত জানতোনা।আমি ভেবেছিলাম একটা নির্দিষ্ঠ দিনে আমি সরাসরি তার সামনে আমার সম্পর্কে সব কিছুই বলবো।সে শুধু এটাই জানতো আমি মেডিকেল স্টুডেন্ট,এর বেশি আর কিছুই জানতোনা।কখনো জোর ও করতোনা অবশ্য।
এরপর একদিন।

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here