বিষাক্ত প্রেমের অনুভূতি উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর) পর্ব :৩৪

বিষাক্ত প্রেমের অনুভূতি

উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর)

পর্ব :৩৪

‘জেলাসি ‘ ‘ঈর্ষা ‘ পৃথিবীর সবচেয়ে বিষাক্ত যন্ত্রণাদায়ক অনুভূতির নাম।প্রত্যেকটা মানুষ এই অনুভূতির সাথে পরিচিত।আমার তখনি এই অনুভূতিটাকে অনুভব করি যখন ,আমরা কারো জন্য ব্যাকুল থাকি আর সেই প্রিয় মানুষটা অন্যকারো দিকে অগ্রসর হয়।অন্যকারো চোখে সেই মানুষটার জন্য অস্পষ্ট অনুভূতি ভেসে উঠে।জেলাসি ভীষণ বাজে অনুভূতি ,যা মানুষের বিবেককে ভুলিয়ে আবেগে বিমোহ করে।সেহের ধীরেধীরে এই মোহের তাড়নায় জড়িয়ে যাচ্ছিল।আরহাম মিহির কাছাকাছি থাকাটা তাকে ভীষণ পীড়া দিতো।মুখে প্রকাশ না করলেও সেহের ভিতরে ভিতরে প্রতি মুহূর্ত পুড়ত।অনিশ্চয়তা ধীরে ধীরে আরহামকে হারানোর ভয়ে পরিনত হচ্ছিলো।
দুনিয়া জুড়ে কনকনে শীতের প্রভাব ।শীতের এই কঠিন প্রবণতায় শহর জুড়ে নির্বাচনের গরম হাওয়া বইছে। পুরো শহর জুড়ে হৈ চৈ।বেশ খারাপ পরিস্থিতি।এবার অপজিট পার্টি বেশ শক্তিশালী ।আরহামদের বিরুদ্ধে বড়সড় ষড়যন্ত্র পাকিয়েছে । যা ঠেকাতে আরহাম সহ পার্টির বাকি সব সদস্য সামাল দিতে ব্যস্ত! সেই প্রস্তুতিতে দিন রাত কঠোর পরিশ্রম করছে।বেশ দেরী করে বাড়ি ফিরছে।সেহেরের জন্য সামান্যতম সময় বের করতে পারছেনা।যা সেহের বুঝেও বুঝতে চাইছে না।একবার মন মানলেও আরেকবার মবে শখানেক প্রশ্ন জাগছে । ইদানীং আরহাম বাড়ি ফিরে রিফ্রেশমেন্টের জন্য মিহির রুমে যায়।ঘন্টা দুএক আড্ডা দিয়ে রুমে ফিরে।সেহের ততক্ষণে ঘরের বাতি নিভিয়ে ঘুমের ভান করে শুয়ে থাকে।আরহামের এই নীরব প্রহার গুলো সেহেরকে ভীষণ কষ্ট দিচ্ছে।এখন রিফ্রেশমেন্টের জন্য মিহিকেই তার কেন চাই? সেহেরের ভেতর কমতি কিসের? না মুখ ফুটে কিছু বলতে পারছে না নিজের মনকে মানাতে পারছে । শুধু বালিশে মুখ গুঁজে কান্না করে দিন পাড়ি দিচ্ছে!
নির্বাচনের পূর্বে এক বিকালে সেহের মিহি মুখোমুখি । সারাদিনের ক্লান্তি চাপাতে বাগানে বসে চা খাচ্ছে ।টুকটাক গল্প করছে।হ্ঠাৎ গল্পের ফাঁকে সেহের মিহিকে প্রশ্ন করল,”তোমাদের বন্ধুত্ব কত বছরের? ”
জবাবে মিহি মিষ্টি হেসে বলল,”সেই ছোট থেকে।জানোতো কানাডায় আমরা প্রতিবেশী ছিলাম। আঙ্কল আন্টি যখন জীবিত ছিলো আমার বেশিরভাগ সময়ই আন্টির সাথে কাটত।ভীষণ ভালো মানুষ ছিলেন তিনি । আন্টি একজন থাই গার্ল ছিলো।স্টাডির জন্য কানাড়ায় এসেছিল আর সেখানেই আঙ্কের সাথে পরিচয় তারপর প্রণয় ।হ্ঠাৎ এক এক্সিডেন্টে দুজন মারা যায়।আরহাম ভাগ্যের জোরে বেঁচে গেলেও নিজের অনেকটা স্মৃতি হারিয়ে ফেলে। তার বাল্যকাল খুব একটা সুখকর ছিলো না।এক্সিডেন্টের পর মেন্টাল ট্রমার কারণে তাকে বিভিন্ন পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হয়েছে।বাবা সাইকিয়াট্রিস্ট হওয়ায় আরহামের সুস্থতার ভার নিজের উপর নেয় ,তখন থেকে আরহাম তার বাবা মায়ের আবছা আবছা স্মৃতি নিয়ে আমাদের সাথে থাকতে শুরু করে ।ওর আমি ছাড়া খুব একটা বন্ধু ছিলো না।ছোট থেকে একা থাকতে পছন্দ করত।স্কুলের অনেক মেয়ে তার প্রেমে হাবুডুবু খেলেও আরহাম কারো দিকে চোখ তুলে তাকাত না! ”
এতটুকু বলে থামতেই সেহের ধীর স্বরে প্রশ্ন করল,”আর তুমি? তুমি পছন্দ করতে না? ”
সেহেরের এমন প্রশ্নে মিহি অনেকটাই অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে।কিছু বলতে গিয়েও থেম্র যায়।ঠোঁটে জোরপূর্বক হাসির টেনে বলল,”সেহের তুমিও না,কি যে বলো।উই আর জাস্ট গুড ফ্রেন্ড! বাই দ্যা ওয়ে অনেকটা সময় হয়েছে আমার এখন উঠতে হবে। এক কাজে বের হবো! ”
সেহের প্রত্যুত্তরে মুচকি হাসল।মিহি চেয়ার ছেড়ে উঠল।সেহের মিহির যাওয়ার দিকে এক পলকে তাকিয়ে রইল।মিহির চোখে আরহামের জন্য স্পষ্ট ভালোবাসার অনুভূতি ছিলো।মিহি এড়িয়ে গেলেও সেহেরের চোখ থেকে তা আড়াল হয়নি ।সেহের ভাবল, মিহি আরহামকে কতটা জানে।সেই ছোট থেকে আরহামকে কতটা সাপোর্ট করে আসছে।তবে কি আরহামের জীবনের সেই মেয়েটা কি মিহি- ই? ঘটনাক্রমে আরহাম সেহেরের বিয়েটা যদি না হতো তবে আজ হয়তো আরহামের জীবনে মিহি- ই থাকত।কিন্তু সেহের ভেতরের বউ সত্তাটা এর কঠিন বিরোধ করল।ঘোর বিরোধিতায় ভেতর থেকে জোরগলায় আওয়াজ এলো,”আরহামের সাথে তার বিয়ে হয়েছে ,সে আরহামের লিগ্যালি ওয়াইফ ।অতীত যাই হোক এখন আরহাম শুধু মাত্র তার ,শুধুই তার! ”
এরপর থেকে সেহের দিনরাত ভাবতে লাগল ,কি করে আবার আরহামের মনে আগের মত জায়গা করবে।মিহির মত হবে কি? মিহির মত হেয়ার কালার করবে? এক্সারসাইজ করবে? ওয়েস্টার্ন ড্রেস পরা শুরু করবে কি? কথায় কথায় ইংলিশ ঝাড়বে!
সেহেরের ভেতরের ভয় তাকে ব্যাকুল করে দিয়েছে । প্রতিমুহূর্ত আরহামকে হারানোর ভয় তাকে তিলেতিলে ক্ষতবিক্ষত করছে।বাবা মা থেকে শুরু করে জীবনের প্রত্যেকটা সম্পর্ক থেকে সে অর্ধভালোবাসা পেয়েছে । পূর্ণ ভালোবাসা পাবার সৌভাগ্য তার হয়নি! ।আরহাম সেহেরের জীবনের প্রথম প্রেম ।আরহামকে হারানোর মত সাহস তার নেই ।না আরহামকে অন্য কারো সাথে ভাগাভাগি করতে পারবে!
পরদিন সেহের ভার্সিটিতে যায়না । সকাল থেকে কিচেনে। আরহাম কোন এক জরুরী তলবে বেশ ভোরে বেরিয়েছে।সেহের বেশ খুশি মনে আরহামের জন্য পাক শুরু করল।মিহির মত অতশত গুন না থাকলেও ,সেহেরের অবশ্য একটা গুন আছে।যা মিহির নেই ।আর তা হলো “পাককলা “। রান্নাবান্নায় সেহের বেশ পটু।ছোট থেকে দাদী সাথে থাকায় দাদীর থেকে এই গুনটা অর্জন করেছে নিয়েছে ।রান্নার হাত বেশ পরিপক্ক।সেহের আরহামকে ইম্প্রেস করার জন্য সকাল থেকে পাকঘরে।আরহামের পছন্দের খাবার রান্না করতে ব্যস্ত! দাদীমা থেকে কায়দা করে অনেক আগেই আরহামের পছন্দের খাবারের তালিকা জেনে নিয়েছিল।তাও ব্যস সেই তালিকা অনুযায়ী রান্না করতে লেগে গেছে।দুপুরে ফিটফাট রেডি হয়ে আরহামে অপেক্ষা করতে লাগল ।কিন্তু আরহাম ফিরে না। সবাই এক সাথে লাঞ্চ করলেও সেহের করল না।আরহামের ফেরার অপেক্ষা করল। সবাই রান্নার বেশ প্রশংসা করল।সেহের উত্তরে শুধু মুচকি হাসল।মন আরেক দফা ভাঙল ,যার জন্য এতো আয়োজন সেই নেই।
সারাদিন আরহামের অপেক্ষা করল।বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা আরহাম এখনো বাড়ি ফিরেনি।সেহের কয়েকবার ফোন করে খোঁজ নিতে চেষ্টা করেছে।কিন্তু প্রত্যেকবারই ফোন বন্ধ বলছে।অফিসে ফোন দিয়ে জানতে পারে আজ আরহাম অফিসে যায়নি ।সেহেরের চিন্তা আরো বাড়ল।সারাদিনের ক্লান্তি চিন্তা মাথা ধপধপ বাড়ি মারছে।অসহ্য যন্ত্রণায় সেহের মাথা তুলতে পারছে না। তার উপর অস্থির মন সব মিলিয়ে নাজেহাল । রাত বারটা।সেহের ড্রইং রুমে বসে ঝিমাচ্ছে।হঠাৎ গাড়ির শব্দে সেহেরের ঘুম কাটল।আরহাম এসেছে ভেবে খুশিখুশি মুখ নিয়ে সদর দরজার দিকে ছুটে গেলো।এই খুশি বেশিক্ষণ রইল না।আরহামের সাথে মিহি।মিহি ড্রাইভিং সিটে আরহাম বেহুশ অবস্থায় পাশের সিটে হেলে। সেহের দরজা ধরে স্থির হয়ে দাড়িয়ে রইল।মিহি আর দারোয়ান কোনরকম গাড়ি থেকে টেনে বের করল।আরহাম মিহির কাঁধে মাথা হেলিয়ে আছে।সদর দরজায় সেহেরকে দেখে মিহি বলল,”বেশি ড্রিংক করে অসুস্থ হয়ে পড়েছে! ”
সেহের প্রত্যুত্তর করল না।ঠাই দাড়িয়ে রইল।মিহি দারোয়ান আরহামকে রুম অবধি পোঁছে দিলো।সেহের রুমে পোঁছাতে দেখল মিহি সেখানেই আরহামের হাতের কব্জি ধরে কিছু একটা করছে।সেহেরকে দেখতেই সরে দাড়ায়।সেহের কাঠ কাঠ চোখে মিহির দিকে তাকিয়ে।চোখ মুখ লাল হয়ে আছে।মিহি সেহেরকে দেখে অপ্রস্তুত স্বরে বলল,”অনেক রাত হয়েছে,আমি এখন যাই! গুড নাইট । ”
সেহের কোন উত্তর দিলো না। মিহি দরজা অবধি যেতেই পেছন থেকে সেহের ডাকল।মিহি ঘাড় ঘুরিয়ে চাইল।সেহের গম্ভীর স্বরে বলল,”তোমাদের মধ্যে অ্যাফায়ার চলছে তা বললেই পারো। ফ্রেন্ডশীপের নাম করে এই লুকোচুরি কেন? ট্রাস্ট মি আরহাম একবার বললেই তোমাদের মাঝে থেকে সরে যাবো ”
হঠাৎ সেহেরের এমন কথায় মিহি হতভম্ব হয়ে রইল।কিছু বলতে চাইল।কিন্তু কিছু একটা ভেবে আবারো চুপ হয়ে গেল।কোন প্রকার প্রত্যুত্তর না করে নিজের রুমে চলে গেল।সেহের ধপ করে জানালার পাশে ডিভানটায় বসে পড়ল।আরহামের দিকে অগ্নিমূর্তি হয়ে চেয়ে থাকল। চোখ থেকে গলিত শিশার মত তপ্ত জল গাল বেয়ে পড়ল।আরহামের কাছে পা বাড়াল না। সারারাত ডিভানে বসে পাড় করল।মনে মনে এক কঠিন সিদ্ধান্ত নিলো।

চলবে…❣️

ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন । প্লিজ সবাই সবার মতামত জানাবেন😊😊😊।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here