ভালোবাসি আমি যে তোমায় ২*পর্ব:২৩

0
1702

#ভালোবাসি_আমি_যে_তোমায়_২
#Sohani_Simu

১৯.

সারা দেশের মধ্যে রাজশাহীতে সর্বাধিক তাপমাত্রা রেকর্ড করা হচ্ছে।গত পাঁচ বছর নাকি রাজশাহীতে এমন গরম হয়নি।প্রখর রোদ আর ভ্যাপসা গরমে যখন সবাই নেতিয়ে পরেছে তখন অন্ত আর রিংকু ভর দুপুরে ছাদে বসে এক্সপেরিমেন্ট করতে ব্যস্ত।তাদের এক্সপেরিমেন্টের বিষয় হল রোদের তাপে ডিম ভাজা যায় কিনা, যদি যায় তাহলে কত ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রায় কত সময় নিয়ে ডিম ভাজা যাবে।তাদের কাছে যন্ত্রপাতি হিসেবে আছে তাপমাত্রা আর সময় দেখার জন্য অন্তর ফোন,ডিম ভাজার জন্য একটা ফ্রাই প্যান,প্যানে ডিম উল্টে পাল্টে দেওয়ার জন্য একটা স্প্যাচু্লা,দুটো ডিম,ডিম ভাজি রাখার জন্য দুটো হাফ প্লেট,দুটো কাটা চামস,তেল আর লবণ।অন্ত আর রিংকু একটা কালো ছাতার নিচে পাশাপাশি বসে সবার আগে ফ্রাই প্যান রোদে দিল তারপর ইউটিউবে দেখে নিল কিভাবে ডিম পোস করতে হয়।ভিডিও দেখা শেষে ফ্রাই প্যানে তেল দিয়ে দশমিনিট পর তেল সামান্য গরম হতেই অন্ত একটা ডিম ফাটিয়ে প্যানে ছেড়ে দিল।ডিম ফাটাতে গিয়ে ডিমের কুসুম গলে ডিমটা দেখতে বিশ্রী হয়ে গেল সাথে কিছু খোসাও ডিমের সাথে লেগে থাকলো।অন্ত ঠোঁট উল্টে রিংকুর দিকে তাকাতেই রিংকু উৎফুল্ল ভঙ্গিতে বলল,

‘ইয়ে কি মজা!একটু পরে ডিম খাবো।’

ডিম দেখতে কেমন হল সেটা বড় কথা নয় রিংকু ডিম খাবে সেটায় বড় কথা।রিংকুকে খুশি দেখে অন্ত মুচকি হেসে লবনের কৌটা থেকে একচামচ লবণ নিয়ে ডিমের উপর ছড়িয়ে দিতে লাগলো।অন্ত এমন ভাবে লবণ ছড়াচ্ছে যেন সেটা লবণ নয় মাখন আর ডিমটাও ডিম নয় পাউরুটি।পাউরুটিতে যেভাবে মাখন লাগায় অন্ত ডিমে সেভাবে লবণ লাগাচ্ছে।লবণ লাগানো শেষে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দুজন ডিমের দিকে তাকিয়ে বসে থাকলো যেন তারা চোখ থেকে আগুন বের করে ডিমটাকে ভেজে ভাজা ভাজা করে ফেলবে।গরমে অন্তর ফর্সা মুখ লাল হয়ে গেছে।রিংকু একহাতে ছাতা ধরে আছে আর আরেক হাতে একটা প্লাস্টিকের পাখা দিয়ে একবার অন্তকে বাতাস দিচ্ছে তো আরেকবার নিজেকে বাতাস দিচ্ছে।প্রায় একঘন্টা দুমিনিট পর ডিমের সাদা অংশ একটু বেশি সাদা হয়ে গিয়েছে আর নরম ডিমটা শক্তও হয়েছে।অন্ত খুশি হয়ে ডিমটা একটা প্লেটে ঢেলে রিংকুকে খেতে দিয়ে বলল,

‘দেখতো ডিমটা সেদ্ধ হয়েছে কিনা।’

তখনই অন্তর পাশে একটা লম্বা ছায়া এসে দাঁড়ালো।অন্ত প্লেট হাতে নিয়েই মাথা তুলে উপরে তাকিয়ে নির্ভীককে দেখেই রাগী কন্ঠে বলল,

‘আপনি আবার আমাদের বাসায় এসেছেন?’

নির্ভীক অন্তর খোঁজ নিতে ইচ্ছেমতিকে ফোন করেছিল।ইচ্ছেমতি বলেছে অন্ত আর রিংকু ছাদে বসে রোদের তাপে ডিম রান্না করছে তাই নির্ভীক সেজেগুজে অন্তর হাতের রান্না খেতে চলে এসেছে।নির্ভীক মুচকি হেসে অন্তর পাশে বসে আস্ত ডিমটা রিংকুর মাথায় ফাঁটিয়ে দিয়ে বলল,

‘আমার বউ এর হাতের রান্না আমিই এখনও খেলাম না আর তুই খেতে বসে আছিস!!যা ভাগ এখান থেকে।’

রিংকু মাথায় হাত দিয়ে হতভম্ব হয়ে নির্ভীকের দিকে তাকিয়ে আছে।অন্ত নাক ছিটকিয়ে একটু সরে বসে রিংকুর দিকে তাকিয়ে বলল,

‘ইয়াক ছিঃ!!কি বিশ্রী দেখতে।’

অন্তর কথা শুনে রিংকু চট করে উঠে দাঁড়িয়ে নির্ভীকের দিকে তাকিয়ে কান্নার স্বরে বলল,

‘চাঁদ ভাইয়া,এটা কি করলে?আমি এখনই যেয়ে তোমার আম্মুকে বলে দিব।’

ডিমের জায়গায় যদি নির্ভীক রিংকুর মাথায় লবণ বা তেল ঢেলে দিত রিংকু কিছু মনে না করে বসে থাকতো কিন্তু ডিমের আঁশটে গন্ধে গা গুলিয়ে আসছে তাই এভাবে বসে থাকা সম্ভব নয়।রিংকু কোন দিকে না তাকিয়ে ছাতা ফেলে দিয়ে ধপধপ করে হেঁটে চলে গেল।অন্ত এতক্ষণ একবার রিংকুর দিকে তাকাচ্ছিল আরেকবার নির্ভীকের দিকে।রিংকু যেতে না যেতেই নির্ভীক অন্তর গা ঘেষে বসে অন্তকে একপাশ থেকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ডিমের দিকে তাকিয়ে বলল,

‘ওয়াও এটা তুমি রান্না করেছো?দেখি কেমন হয়েছে খেতে,একটু টেস্ট করি।’

অন্ত নির্ভীকের থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্য ছটফট করছে কিন্তু কিছুতেই নির্ভীকের থেকে নিজেকে ছাড়াতে পারছেনা তাই রেগে গিয়ে বলল,

‘ছেড়ে দিন নাহলে কিন্তু আবার ভাইয়াকে বলে দিব।’

‘কি বলবা?সকালে তো বললা একটা কিস করেছি এখন দুটো করি?’

অন্ত বড় বড় চোখে নির্ভীকের দিকে তাকালো।নির্ভীক মুচকি হেসে একটা কাঁটা চামচ নিয়ে এক টুকরো ডিম মুখে দিতেই চোখমুখ কুচকে ফেললো।এত নোনতা খাবার সে জীবনেও কোনদিন খায়নি।শুধুমাত্র অন্ত বানিয়েছে জন্য হাসিমুখে একটু খেয়ে দুই হাতে অন্তকে নিজের কাছে টেনে নিয়ে অন্তর কাঁধে থুতনি রেখে বলল,

‘ফার্স্ট টাইম তোমার হাতের রান্না খেলাম তাও যে সে রান্না নয় একদম ইউনিক রান্না।এখন বল কি নিবা?’

অন্ত রেগে নির্ভীকের বুকে কনুই দিয়ে গুতো মেরে বলল,

‘উফ্ ছাড়ুন তো,আপনি এত খারাপ কেন!রাযীন ভাইয়া কত ভালো আর আপনি একটা অসভ্য লোক,ছাড়ুুুুনননননন!!’

নির্ভীক এক হাতে অন্তর দুইহাত চেপে ধরে প্যান্টের পকেট থেকে একটা লাভ শেইপ লকেট লাগানো সোনার চেইন বের করে অন্তর মাথার উপর দিয়ে পরিয়ে দিয়ে ফট করে অন্তর গালে আর কপালে চুমু দিয়ে বলল,

‘আই লাভ ইউ পিচ্চি।’

অন্ত অবাক হয়ে নির্ভীকের দিকে তাকিয়ে আছে।বার বার মনে হচ্ছে এই কথা গুলো তার চেনা এই কন্ঠস্বর তার সবচেয়ে প্রিয়।এই ছেলের সবকিছু তার মুখস্থ,সে যুগ যুগ ধরে চেনে এই ছেলেকে।হঠাৎই অন্তর মাথাব্যথা করতে লাগলো।এত চিন্তা নিতে পারছেনা তার উপর এত রোদ আর গরমে অনেকক্ষণ ধরে বসে থেকে ক্লান্ত হয়ে গেছে।অন্ত চোখ বন্ধ করে নিজের হাঁটুতে মাথা রাখার চেষ্টা করে দুর্বল কন্ঠে বলল,

‘হাত ছেড়ে দিন,মাথাব্যথা করছে।’

নির্ভীক ঠিক হয়ে বসে অন্তর গালে হাত দিয়ে চিন্তিত হয়ে বলল,

‘বেশি ব্যাথা করছে?এখানে কেন এসেছো বলো তো?কত গরম এখানে!চলো নিচে যাব।’

অন্ত গাল থেকে নির্ভীকের হাত সরিয়ে দিয়ে ভ্রু কুচকে নিজের ফোন হাতে নিয়ে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াতেই চোখমুখ অন্ধকার হয়ে মাথা ঘুরে উঠলো।নির্ভীকের উপর ঢলে পরেই চোখবন্ধ করে কান্না করতে লাগলো।নির্ভীক ভয় পেয়ে দ্রুত অন্তকে নিয়ে নিচে এসে বিছানায় শুয়ে দিল।ইচ্ছেমতি মেঝেতে বসে বই খাতা মেলে দিয়ে নোট তৈরী করছিল অন্তকে এমন অবস্থায় দেখেই ঘাবড়ে গিয়ে বলল,

‘ভাইয়া,কি হয়েছে ওর?’

নির্ভীক ব্যস্ত কন্ঠে বলল,
‘যাও তো একটা টাওয়েল ভিজিয়ে নিয়ে আসো।’

ইচ্ছেমতি দ্রুত বেলকুনিতে টাওয়েল নিতে গেল।নির্ভীক অন্তর মেডিসিন হাতে নিয়ে অন্তকে ধরে তুলে মেডিসিন খাইয়ে দিল।অন্ত একবার চোখ খুলে তখনই খিচে বন্ধ করে একপাশ হয়ে শুয়ে হেঁচকি তুলতে তুলতে বলল,

‘আপনি উল্টো হয়ে বসে আছেন কেন!!’

নির্ভীক কিছু না বলে ভেজা টাওয়েল দিয়ে অন্তর মুখ হাত মুছতে লাগলো।ইচ্ছেমতি চিন্তিত হয়ে অন্তর অন্যপাশে বসে থাকলো।মেডিসিন খাওয়ার জন্য কিছুক্ষণের মধ্যেই অন্ত ঘুমিয়ে পরলো।


প্রায় সাড়ে পাঁচ ঘন্টা ঘুমিয়ে চোখ মুখ ফুলে তুলে অন্ত ড্রইং রুমের সোফায় গিয়ে বসলো।দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা বাজে।কিচেন থেকে হাসাহাসির শব্দ পেয়ে কিচেনের দরজায় দাঁড়াতেই নির্ভীকের মাকে দেখে অবাক হয়ে বলল,

‘অ্যান্টি তুমি এখানে!’

নির্ভীকের মা হাসতে হাসতে অন্তর কাছে এসে দাঁড়িয়ে বললেন,

‘কুহেলী আজ আমাদের ডিনারের জন্য ইনভাইট করেছে।শুধু আমি নয় সবাই এসেছে।আকাশ খারাপ দেখে আমরা আগে ভাগেই চলে এসেছি।’

আকাশ খারাপের কথা শুনেই অন্ত ভয় পেয়ে মনে মনে বলল তারমানে আজকে আবার প্রকৃতি ডিপ্রেসড্ হয়েছে।ডিপ্রেশন একটা ভয়ঙ্কর ব্যাধি।একটা মানুষ যখন ডিপ্রেশনে ভুগে তখন সে নিজেকে সবার থেকে দূরে সরিয়ে দেয়,নিজেকে বিষাক্ত মনে করে,নিজেই নিজের শত্রু হয়ে যায়।অনেকে সেই শত্রুর সাথে লড়তে লড়তে তাকে বধ করে রোগ সারিয়ে ফেলে আবার অনেকে পরাজয় স্বীকার করে মৃত্যুকে বরণ করে নেয়।তেমনই প্রকৃতির যখন ডিপ্রেশন হয় প্রকৃতিও নিজেই নিজের শত্রু হয়ে যায়।নিজেই নিজেকে আঘাত করে।নিজের বিষাক্ত সত্তাকে নিশ্চিহ্ন করতে প্রবল ঝড় সৃষ্টি করে।আকাশ ফেটে বের হয় তার মন খারাপের আর্তনাদ।এক সময় শেষ হয় আত্মযুদ্ধ,জয় লাভ করে শত্রু পক্ষ।ক্ষত-বিক্ষত প্রকৃতি নিজেকে স্বাভাবিক করে আবার শেষ থেকে শুরু করে কারন মানুষের মৃত্যু হলেও প্রকৃতির মৃত্যু নেই।মানুষ মিথ্যে,মানুষের এই ক্ষণস্থায়ী জীবন মিথ্যে আর প্রকৃতি সত্য,চিরন্তন সত্য ইংরেজীতে যাকে বলে হেবিচুয়াল ফ্যাক্ট।

দশমিনিট ঝড় হয়ে এখন দমকা হাওয়ার সাথে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি শুরু হয়েছে।চোখে মুখে পানির ছিটা দিয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হতেই অন্ত চোখ বড় বড় করে দেয়ালের সাথে লেগে দাঁড়ালো কারন নির্ভীক চোখমুখ শক্ত করে তার দিকে তেড়ে আসছে।অন্ত ভয়ে কাঁপাকাঁপি শুরু করে দিয়েছে।নির্ভীক এসে অন্তর সামনে দাঁড়িয়ে একহাতে অন্তর কোমড় জড়িয়ে ধরে নিজের কাছে টেনে নিল।অন্তর দিকে ঝুকে অন্তর ভেজা গালে গাল ঠেকিয়ে রেখে নরম কন্ঠে বলল,

‘সামনের উইকে ভাইয়া আর তোমার আপুর বিয়ে।আমরাও বিয়ে করব চলো তারপর সবসময় একসাথে থাকবো।প্রত্যেকটা দিন প্রত্যেকটা ঘন্টা মিনিট সেকেন্ড মিলি সেকেন্ড তোমার সাথে থাকতে চাই।যদি বল ভালোবাসিনা,নো প্রবলেম আমি বাসি।ভালোবাসার চেয়েও অনেক বেশি ভালোবাসি।যদি বল লাগবেনা ভালোবাসা দূরে যাও,অনেক দূরে।বহুদূরে চলে যাব কিন্তু তোমাকে নিয়ে।যদি বল যাব না,চুরি করে নিয়ে যাব।যদি বল কেন কারন ভালোবাসি আমি যে তোমায়।’

শেষের কথাটা ফিসফিস করে বলে নির্ভীক অন্তর কানে ঠোঁট ছোঁয়ালো। মুচকি হেসে অন্তর দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুচকে ফেললো।অন্ত নিশ্বাস আটকে দাঁড়িয়ে আছে।নির্ভীক এক হাতে অন্তর গাল ধরে মুখের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল,

‘এই জারিফ ভাইয়ার ছোটপাখি উইল ইউ ম্যারি মি?’

অন্ত ভ্রু কুচকে নির্ভীকের দিকে তাকালো।এই প্রশ্নের উত্তর তার মুখস্থ কিন্তু এই মুহূর্তে কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারছেনা,কি বলবে বুঝতে পারছেনা।নির্ভীক মুচকি হেসে অন্তকে জড়িয়ে ধরলো তখনই ইচ্ছেমতি ঘরে ঢুকে দরজার আড়ালে লুকিয়ে দুই হাতে মুখ ঢেকে বলল,

‘আমি কিছু দেখিনি।’

ইচ্ছেমতির কথা শুনে নির্ভীক মুচকি হেসে চোখবন্ধ করে অন্তকে আর একটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো কিন্তু রিংকুর কন্ঠ পেয়েই নির্ভীক অন্তকে ছেড়ে দিয়ে তড়িৎ গতিতে একটু দূরে গিয়ে দাঁড়ালো।রিংকু অন্তকে হাত ছুড়তে দেখে ভেবে দুজন মারামারি করছে তাই সে অবাক হয়ে বলল,

‘চাঁদ ভাইয়া,তুমি এখানে কি করছো?অন্তকে মারছিলে?আমি সবাইকে বলে দিব।’

নির্ভীক রিংকুর দিকে যেতে যেতে রাগী কন্ঠে বলল,

‘ওই দাঁড়া মুখ থেকে যদি একটাও আওয়াজ বের করিস তোকে মেরে গুম করে দিব কিন্তু।’

রিংকু ভয়ে এক দৌড়।এদিকে অন্তও রেগে বিছানা থেকে বালিশ নিয়ে নির্ভীকের পিঠে ছুড়ে মেরেছে।নির্ভীক অন্তর দিকে তাকাতেই অন্ত একলাফে বিছানার উপর উঠে ভীত কন্ঠে বলল,

‘আমি কিছু করিনি।’

ইচ্ছেমতি দরজার আড়াল থেকে বের হয়ে বলল,

‘জানু আমি কিন্তু দেখেছি তুই করেছিস।’

অন্ত ঠোঁট উল্টে নির্ভীকের দিকে তাকালো।নির্ভীককে হাসতে দেখে রেগে আরেকটা বালিশ নিয়ে নির্ভীকের মুখে ছুড়ে বলল,

‘খারাপ ছেলে!’

নির্ভীক গম্ভীর মুখ করে অন্তর দিকে তাকিয়ে বলল,

‘তোমার ক্লাস একটু পরে নিচ্ছি আগে মটুটাকে একটা লেসন দিয়ে আসি।’

নির্ভীক চলে যেতেই ইচ্ছেমতি অন্তর কাছে গিয়ে বলল,

‘কিরে কি চলছিল?’

অন্ত চিন্তিত হয়ে ইচ্ছেমতিকে নিয়ে মুখোমুখি বসে সব বলে দিল।অন্তর কথা শুনে ইচ্ছেমতি বরাবরের মতো কিছুই বলল না।ফোন নিয়ে সব রাগ অভিমান ভুলে আবার প্রান্তকে কল দিল।অন্তকে বলা নির্ভীকের কথাগুলো অন্ত বুঝতে না পারলেও ইচ্ছেমতি ঠিকই বুঝতে পেরেছে।ইচ্ছেমতিও মনে মনে প্রান্তকে উদ্দেশ্য করে বলল ভালোবাসেন না তো?না বাসুন আমি বাসি আমি বাসবো।

সাড়ে নটা বাজতেই সবাই ডিনার সেরে গল্পের পসরা নিয়ে বসলো।বড়রা বড়দের সাথে আর ছোটরা ছোটদের সাথে।ছোটদের মধ্যে যারা একটু বেশি ছোট তারা বাদ যেমন অন্ত আর রিংকু।বড়দের গল্প এদের পছন্দ হচ্ছেনা তাই এরা দুজন আলাদা বসে ভূতের গল্প করছে।রিংকু এমন ভাবে অন্তকে ভূতের গল্প শোনাচ্ছে যেন এসব সেরা সত্য ঘটনা।কয়েকটা ভূতের গল্প অন্তর মনে খুব বাজে ভাবে গেঁথে গেল।অন্ত আশেপাশে তাকিয়েই উঠে গিয়ে জারিফের কাছে বসলো।বাহিরে বৃষ্টি হচ্ছে খোলা জানালা দিয়ে ঠান্ডা হাওয়া এসে পর্দা গুলো দুলছে।অন্তর গা ছম ছম করছে।জানালার দিকে তাকিয়েই বলল,

‘ভাইয়া জানালাটা বন্ধ করে দাও।’

জারিফ রাযীনের সাথে কথা বলছে,অন্তর কথায় গুরুত্ব দেয়নি কিন্তু নির্ভীক রাযীনের পাশে বসে ফোন টিপতে টিপতে ঠিকই খেয়াল করছে অন্ত কখন কোথায় কি করছে।নির্ভীক রিংকুকে জানালা লাগাতে বলল।রিংকু জানালা লাগাতেই অন্ত হাই তুলতে তুলতে জারিফের হাত ঝাকিয়ে বলল,

‘ভাইয়া ঘুম পাচ্ছে।’

জারিফ একবার অন্তর দিকে তাকিয়েই বলল,

‘যা ঘুৃমা তাহলে।’

‘তুৃমিও চলো।’

জারিফ ভ্রু কুচকে অন্তর দিকে তাকালো।অন্ত ভয় পাচ্ছে বুঝতে পেরে ইচ্ছেমতিকে অন্তর সাথে পাঠিয়ে দিল।ঘরে এসে অন্ত ইচ্ছেমতিকে দিয়ে সব জানালা দরজা বন্ধ করে নিল।ঘরের প্রতিটি কোনা আর খাটের তলায় ভাল করে দেখে নিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিল।ইচ্ছেমতি কোমড়ে হাত দিয়ে ভ্রু কুচকে বলল,

‘এভাবে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে কি দেখলি?’

অন্ত একপাশ হয়ে শুয়ে বলল,

‘রুমের মধ্যে কোনী ভূত আর স্কন্ধকাটা ভূত আছে কিনা দেখে নিলাম।রিংকুও প্রতিদিন ঘুমানোর আগে দেখে ঘুমায়।’

ইচ্ছেমতি হাসতে হাসতে কাত কিন্তু তার ফোন আসায় ফোন নিয়ে বেলকুনিতে গেল।প্রান্ত যে তাকে ফোন দিবে সেটা ইচ্ছেমতি স্বপ্নেও ভাবেনি।ফোন রিসিভ করেই ইচ্ছেমতি বলল,

‘কি ব্যাপার তখন বললেন কাজ আছে এত তাড়াতাড়ি কাজ শেষ হয়ে গেল?’

‘এই মেয়ে কে তুমি?’

কর্কশ মেয়েলি কন্ঠ শুনে ইচ্ছেমতি অপ্রস্তুত হয়ে গেল।ফোন মুখের সামনে নিয়ে দেখলো এটা প্রান্তরই নাম্বার তাহলে কে এই মেয়ে।ইচ্ছেমতি ভ্রু কুচকে বলল,

‘আপনি কে?’

‘আগে বল তুমি কে?আমার ছেলের সাথে এত কিসের ফোনালাপ তোমার?’

ইচ্ছেমতি বুঝলো এটা প্রান্তর মা।একটা শুকনো ঢোক গিলে বলল,

‘আস-সালামুআলাইকুম অ্যান্টি,ভাল আছেন?’

‘ওয়ালাইকুম আগে বল তুমি কে?’

মহিলা ইচ্ছেমতি কে জানার জন্য একদম মরিয়া হয়ে উঠেছেন।সালামের জবাব পর্যন্ত ঠিক করে দিলেন না।ইচ্ছেমতি মনে মনে বাঁকা হেসে বলল প্রান্ত ভাইয়া আপনি শুধু দেখুন আজকে আমি কি করে সব শোধ তুলি।তারপর ইচ্ছেমতি মুচকি হেসে বলল,

‘দুঃখের কথা কি আর বলবো অ্যান্টি।আপনার ছেলে আমাকে লুকিয়ে বিয়ে করেছে।বিয়ের কয়েকমাস পরে এখন বলছে সে আর এই বিয়ে মানে না।এখন আমি পরে গেছি অতল সাগরে সেজন্যই তো আপনার ছেলেকে বার বার ফোন দিচ্ছি কিন্তু সে বলছে তার নাকি আরেকটা গার্লফ্রেন্ড আছে।এসব শুনলে কোনো স্ত্রীর মাথা ঠিক থাকে বলুন?আমার তো মরে যেতে ইচ্ছে করছে কিন্তু ভেতরে আরেকটা ছোট প্রাণ আছে তাই শান্তি মতো মরতেও পারছিনা।চিন্তা করবেন না একবছর পর আপনার নাতিকে অনাথ আশ্রমে দিয়ে আমি মরে যাব।’

অনেক কষ্টে হাসি চেপে ইচ্ছেমতি কথা গুলো বলল।প্রান্তর মা এসব শুনে হতবাক।উনি ধারণাও করতে পারেননি এত দেখেশুনে রাখার পরেও উনার ছেলে এমন একটা ভুল করে বসবে।প্রান্তর বাবাও একই ভুল করেছিলেন সেজন্যই তো প্রান্তর দাদি রেগে প্রান্তর বাবাকে বলেছিলেন একদিন আসবে যেদিন তাদের ছেলেও লুকিয়ে বিয়ে করবে।তখন তারাও বুঝতে পারবে কষ্টটা কোথায় লাগে।প্রান্তর দাদিকে দেওয়া সেই কষ্টের ভয় সবসময় প্রান্তর মাকে ভাবায়।ভয়ে উনি ছেলেকে সব সময় চোখে চোখে রাখেন।অ্যান্ড্রয়েড ফোন চালাতে পারতেন না শিখে নিয়েছেন শুধুমাত্র ছেলে ফোনে কি করে না করে সেসব দেখার জন্য।মায়ের কাছে প্রান্তর কোনো প্রাইভেসি নেই।প্রান্তর মা জানেন ইচ্ছেমতি কে, উনি জানেন ইচ্ছেমতির সাথে প্রান্তর কোন সম্পর্ক নেই কিন্তু উনি জানেন না সোনার কন্যা কে।ইচ্ছেমতির নাম্বার প্রান্ত সোনার কন্যা দিয়ে সেভ করে রেখেছে।প্রান্তর মা খুব বিচক্ষণ মহিলা ঠান্ডা মাথায় সবকিছু ভেবে কড়া গলায় বললেন,

‘শোনো মেয়ে,আমার ছেলেকে আমি চিনি সে এসব কাজ করতে পারেনা।আমি তোমার সাথে দেখা করতে চাই।’

ইচ্ছেমতি কি বলবে বুঝতে পারছেনা।কিছু একটা ভেবে বলল,

‘দেখা করার আর কোনো উপায় নেই অ্যান্টি।আমি অনেক দূরে চলে এসেছি।আর কখনও আপনার ছেলেকে বিরক্ত করবোনা।আজই শেষ কথা বলার জন্য ফোন করেছিলাম।এই এলাকায় ইলেক্ট্রিসিটি নেই তাই ফোনের চার্জ শেষ হয়ে গেলে আর কখনও কথা হবেনা,কোনো ডাকঘরও নেই যে চিঠি পাঠাবো।যাইহোক আমি একটা সুখবর দিতে আপনার ছেলেকে ফোন দিয়েছিলাম।তিনদিন আগে শহরে গিয়ে চেক আপ করে ডক্টর বলেছে ছেলে হবে।আপনার অনাগত নাতির জন্য দোয়া করবেন অ্যান্টি।’

বলেই ইচ্ছেমতি কল কেটে ফোন অফ করে জোরে জোরে শ্বাস নিল।এত বড় বড় মিথ্যে কথা সে এর আগে কোনদিন বলেনি।মিথ্যে বলে তার অনেক খারাপ লাগছে কিন্তু প্রান্তর পানিশমেন্ট হবে ভেবে ফুর ফুরে মেজাজ নিয়ে ঘরে ঢুকলো।অন্তকে থমমেরে বিছানায় বসে থাকতে দেখে ভ্রু কুচকে বলল,

‘কিরে ঘুমাসনি এখনও?এভাবে মুখ ফুলিয়ে বসে আছিস কেন?’

অন্ত অসহায় মুখ করে বলল,

‘নির্ভীক ভাইয়া মেসেজে আই লাভ ইউ বলেছিলেন আমিও কেমন করে যেন আই লাভ ইউ টু লিখে পাঠিয়ে দিয়েছে।কিভাবে করলাম বুঝতে পারছিনা।উনাকে বলছি ভুল করে গিয়েছে উনি বলছেন বাহিরে গেলে আমার ঠোঁট নাকি খেয়ে ফেলবেন।এখন কি হবে?’

ইচ্ছেমতি ধপ করে বিছানায় শুয়ে অন্তর কোলে মাথা রেখে বলল,

‘তুই একটা কাজ কর।নির্ভীক ভাইয়ার সাথে চুটিয়ে প্রেম কর।’

‘কিভাবে?’

‘ও তুই তো আবার প্রেম করতে জানিস না,ডোন্ট ওরি আমি শিখিয়ে দিব।আমি যা বলবো তুই কিন্তু তাই করবি তাহলে দেখবি ওই খারাপ ছেলেটা কিভাবে শায়েস্তা হয়।’

অন্ত খুশি হয়ে বলল,
‘সত্যি শায়েস্তা হবে?’

‘হুম হান্ড্রেড পার্সেন্ট সত্যি।তুই নির্ভীক ভাইয়াকে শায়েস্তা করবি আমি প্রান্ত ভাইয়াকে।এই দুটো ছেলে একদম বদের হাড্ডি,এরা সব মেয়েকে তাদের পেছনে চরকির মতো ঘুড়াই কিন্তু কাউকে পাত্তা দেয়না।নির্ভীক ভাইয়া তাও একটু ভাল আছেন কিন্তু প্রান্ত ভাইয়া এক নাম্বারের মিচকা শয়তান।দেখতে তো দুজন যমজ ভাইয়ের মতো কিন্তু রাজশাহীরর আগুন এরা।সব মেয়েদের মনে আগুন লাগিয়ে দেয়।কালকে সকাল থেকে উনাদের পেছনে লাগবো ওকে?না কাল নয় আজকে থেকেই।আমি আমার চাল চেলেছি এবার তোর পালা।নির্ভীক ভাইয়াকে বল,না তোকে বলতে হবে না ফোন দে আমি বলি।’

ইচ্ছেমতি অন্তর হাত থেকে খপ করে ফোন নিয়ে মেসেজে লিখলো,

‘নির্ভীক ভাইয়া জানেন?ভার্সিটিতে শৈবাল ভাইয়া আমাকে একটা আইসক্রিম কিনে দিয়ে আই লাভ ইউ বলেছিল।আপনার মতো লুকিয়ে,কেউ দেখতে পায়নি আর বলেছে কাল ভার্সিটিতে গেলে অনেক গিফট দিবে।’

ইচ্ছেমতি মেসেজ সেন্ড করে বাঁকা হেসে বলল,

‘শালা শৈবাল কুত্তা তুই এবার শেষ।খুব শখ না অন্তর সাথে প্রেম করার।অন্তর ফোন নাম্বার দিইনি জন্য আমাকে থ্রেট দিয়েছিলি না?এবার দেখ থ্রেট কাকে বলে,কত প্রকার আর কি কি।’

অন্ত কিছু বুঝতে পারছেনা।শৈবালকে তো সে চিনেই না।এদিকে অন্তর মেসেজ দেখে নির্ভীকের মাথা গরম হয়ে গেছে।সে বুঝতে পারছেনা শৈবাল অন্তকে একা পেল কখন সেদিন পুরোটা সময় তো সে অন্তকে চোখে চোখে রেখেছিল।শুধু কিছু সময়ের জন্য পানিতে ঘুমের ঔষধ মেশানোর জন্য অন্তকে রেখে ভার্সিটির মেডিসিন সেন্টারে গিয়েছিল।শৈবাল কি তাহলে তখনই…. আর কিছু না ভেবেই নির্ভীক সোফার সামনের সেন্টার টেবিলে লাথি মেরে উঠে দাঁড়িয়ে রাগী কন্ঠে সবাইকে বলল,

‘বাসায় যাব।’

কারও উত্তরের অপেক্ষা না করেই নির্ভীক বড় বড় পা ফেলে বৃষ্টির মধ্যেই বাসা থেকে বেড়িয়ে গেল।এদিকে টেবিলের উপর কাচের জগ আর আটটা চায়ের কাপ ছিল সব গুলো নিচে পরে টুকরো টুকরো হয়ে গেল।

চলবে………..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here