কাজল নদীর জলে’পর্ব-৪

0
1153

কাজল নদীর জলে
আফিয়া আপ্পিতা

৪.
বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে বাসায় ফিরছে চয়ন। গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে গেট পেরিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে। নিতুরাও চয়নের পেছনে আসছে। চয়ন সামনে থাকায় তা খেয়াল হয় না। নিতুরা পেছনে থাকায় চয়নকে চোখে পড়ে। নিতু ‘চয়ন ভাইয়া’ বলে ডাক দেয়। ডাক শুনে সিড়ির কাছে গিয়ে থামে চয়ন। পেছন ফিরে। সিড়িরুমের লাইটের আলোয় সুরলা আর নিতুকে চোখে পড়ে। ভ্রু কুঁচকায় সে। যার অর্থ, এই ভর সন্ধ্যায় এখানে কী করছে ওরা। নিতু এগিয়ে গিয়ে বলে,
“আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া।”

“ওয়ালাইকুমুস সালাম। তুমি এখানে!” সন্দিহান চোখে তাকিয়ে বলে চয়ন। নিতু ধীর গলায় বলে,
“চিবার কাছে আমার একটা নোট আছে, ওটার জন্যই আসা।”
“ওহ, আচ্ছা। তা কেমন আছো? পড়াশোনা কেমন চলছে?”
“ভালো।”
“আর ঝগড়াঝাটি? আজকাল তো ভালোই ঝগড়া করো দেখছি।”
নিতু লজ্জা পায়। আমতা আমতা করে বলে,
“আসলে ভাইয়া সুর….

আসার আগে নিতু চিবাকে ফোন করে জানায় যে সে নোট নিতে আসছে। শুনে চিবা তখনি নোট গুছিয়ে দোতলার সিড়ির কাছে এসে দাঁড়ায়। নিচতলায় নিতুর আওয়াজ পেয়ে হাক ছাড়ে।
” নিতু, কথা শুনা যাচ্ছে তোর, কোথায় তুই? তাড়াতাড়ি আয়।”

নিতুর আর ঝগড়ার বিবরণ দেয়া হয় না চয়নকে। সুরলাকে রেখেই চলে যায় উপরে। যাবার আগে চয়নকে বলে,
“চিবা ডাকছে, আমি যাচ্ছি। আপনি আমার বোনকে নিয়ে আসেন।” বলে সুরলাকে ইশারা করে। চলে যায় সে।

সুরলা তখন থেকে হাত মোচড়ামুচড়ি করছে। তার লজ্জা, ভয় সব একসাথেই লাগছে। ইচ্ছে করছে দুটো কথা বলবে চয়নের সাথে, কিন্তু দ্বিধা হচ্ছে। কোন কথা দিয়ে শুধু করবে ভেবে পাচ্ছে না। বলা হয়ে থাকে, কাঙ্ক্ষিত বস্তু সামনে পেলে মানুষ সব ভুলে যায়। সুরলা ও সব ভুলে গেছে।

চিন্তাভাবনা করে আমতা আমতা করে বলে,
“আসসালামু আলাইকুম। ” নিতুর দেয়া সালামই মনে পড়েছে তার। চয়ন তখন ফোনে কিছু একটা দেখছিল সিড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে । সুরলার সালাম শুনে ফোন থেকে চোখ তুলে। সামনে থাকা হলুদ টি-শার্টের সাথে ডেনিম জাম্প সুট পরা মেয়েটার দিকে এক পলক তাকায়। কাল বিকেলের ঝগড়ার দৃশ্য চোখে ভাসে। আপনাআপনি হাত চলে যায় মাথায়। এই মেয়েটা কী এখন তার চুল ধরে টানবে? আল্লাহ! রক্ষা করো! নানান ভাবনা মাথায় নিয়ে পা বাড়ায় সামনে। এক হাত তখনো মাথায়, আরেক হাতে ফোন। সিড়িতে পা রেখে সালামের উত্তর না দিয়ে সুরলার উদ্দেশ্যে প্রথম বাক্য ছুড়ে,
” এখন কী আমার মাথার চুল ছেঁড়া হবে?”

ভাববাচ্যের আশ্রয় নেয় চয়ন। দেখতে অনেক ছোটো মনে হচ্ছে সুরলাকে। সম্ভবত এইট নাইনে পড়ে। সে হিসেবে ‘তুমি’বলা উচিত। আবার প্রথম কথায় তুমি সম্বোধন করা অভদ্রতা। ‘আপনি’ বলে সম্বোধন করা মানানসই। তবে, ছোটোদের আপনি সম্বোধন করলে অনেকে ক্ষেপে যায়। ভাবে তাদের মুরুব্বি লাগছে দেখতে। মাস খানেক আগে কলিগ তিথির বিয়েতে তার নাইন পড়ুয়া ছোটো বোন তিহিকে ‘আপনি’ সম্বোধন করার পর রেগে গেছে। তাকে নাকি বয়স্ক লাগছে তাই চয়ন কটু করে বলছে, এমন অপবাদ দিয়েছে। এখন কাউকে কোন সম্বোধন করার আগে স্থান কাল পাত্র ভেবে সম্বোধন করে। এখন ‘আপনি’ সম্বোধন করলে যদি সুরলা রেগে যায় আর চুল টানা শুরু করে! এই ভয়েই ভাববাচ্য ব্যবহার করে সে।

চয়নের কথায় শুনে লজ্জায় মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে করে সুরলার। নিজের বোকামিতে নিজেকে দোষারোপ করে, কেন কাল ঝগড়া করতে গিয়েছিল! ঝগড়া করলে ঘরে ও করা যেত, চয়নের সামনেই কেন ঝগড়া করতে হল! এখন চয়ন লজ্জা দিচ্ছে। তাকে অনেক খারাপ ভেবেছে। সে আত্মপক্ষ সমর্থন দিয়ে বলে,
“আসোলে কাল অনেক রেগে ছিলাম নিতুর উপর, তাই চুলে হাত দিয়েছি । অন্যথায়, আমি ভালো।

‘ অন্যথায়, আমি ভালো’ কথাটা শুনে হাসি পায় চয়নের। ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েরা আজকাল ভয়ংকর সব কান্ড বাধিয়ে নিজেকে ভালো বলে! আজব! মৃদুহাসে চয়ন। মাথা থেকে হাত নামিয়ে বলে,
” পিচ্ছিদের এত রাগ থাকতে নেই। ভালো দেখায় না। ”

ছোটোবেলা থেকে ‘পিচ্ছি’ শব্দটা ভীষণ অপছন্দ সুরলার। কেউ তাকে পিচ্ছি বললে সে রেগে যেত। বড়ো হওয়ার পর শব্দটা ঘৃণার তালিকায় গিয়ে ঠেকেছে। সে যখন কাউকে বড়ো মুখ করে বলতে যায় যে, সে আইইউবিতে পড়ে। তখনই সেই মানুষ এসে তাকে পিচ্ছি বলে যায়। প্রথম দেখায় সবাই কেন তাকে পিচ্ছি ভাবে! বড়ো ভাবতে পারে না কেন!
তার রাগ, কষ্ট দুটোই হয়। তবে ‘পিচ্ছি’ শব্দটা ইতিপূর্বে যতবার শুনেছে তার কোনবার সম্ভবত এত কষ্ট পায় নি। যতটা না এখন স্বপ্নপুরুষের মুখে থেকে বের হওয়া শব্দ তাকে কষ্ট দিয়েছে। শেষ অবধি এই মানুষটাও তাকে পিচ্ছি ভাবল! কোথায় ভেবেছে, ভাব জমাবে সম্পর্ক আগাবে! কিন্তু ‘পিচ্ছি’ শব্দটা উচ্চারণ করে সব শেষ করে দিয়েছে। সুরলার রাগ কষ্ট দুটোই হয়। নাক, চোখ লাল হয়। কষ্ট চেপে রাগটাকে প্রশ্রয় দেয়। লাফিয়ে এক সিড়ি উপরে গিয়ে তেড়ে আসে চয়নের দিকে। আঙুল উঁচিয়ে চোখ রাঙিয়ে বলে,
“একদম পিচ্ছি বলবেন না আমায়। আমি যথেষ্ট বড়।”

আকস্মিক ঘটনায় চয়ন চমকায়। ভ্রু কুঁচকে তাকায় সুরলার দিকে। এটুকুনি মেয়ে তাকে ধমকায়! বলে কি-না সে পিচ্ছি না! হাসি পায় চয়নের। ইচ্ছে করে শব্দ করে হাসতে। কিন্তু চুল তার প্রিয়, তাই পারে না। পিচ্ছিদের রাগালে মাসুল দিতে হয়। শেষে না তাকে টাক হতে হয়! অযথা এই মেয়েকে রাগিয়ে ঘূর্ণিঝড় আনার অর্থ হয় না। হাসি চেপে মিথ্যে ভয়ের ভান করে সে। ফোন পকেটে রেখে ছিটকে এক সিড়ি উপরে উঠে মাথায় হাত দিয়ে বলে,
” তুমি অনেক অনেক বড়, এত বড় যে কোন ইঞ্চি টেপ দিয়ে মাপা যাবে না। স্বীকৃতি করেছি। দয়া করে, আমার চুল ধরে টেনো না!”

সুরলার মনে হয়ে, চয়ন তাকে তিরস্কার করছে। সে দিগুন রেগে যায়। আবারও তেড়ে যায় চয়নের দিকে।
” আপনি আমাকে তিরস্কার করছেন! ভালো হবে না কিন্তু। আপনি ছলেবলে কৌশলে আমাকে পিচ্ছি বলতে পারেন না! কখনো না। ভালো হবে না। আমি রেগে গেলে আপনার চুল একটাও মাথায় থাকবে না।”

সুরলার ক্ষেপে যাওয়ার ব্যাপারটায় মজা পায় চয়ন। চিবাকে যখন সে ক্ষেপায় তখন চিবাও এমন রেগে যায়। তখন আরো বেশি ক্ষেপায় সে। এটা তার অভ্যাস। তার মনে হয়, ছোটদের রাগিয়ে যে মজা পাওয়া যায় তা আর কোন কাজে পাওয়া যায় না। হোক সে নিজের বোন কিংবা আগন্তুক। চয়ন হেসে বলে,
” আমার কাছে, আঠারোর নিচে সবাই পিচ্ছি। আর পিচ্ছিদের ‘পিচ্ছি’ বলে সম্বোধন করা বড়দের জাতিগত অধিকার। এই অধকার থেকে কেউ বড়দের মানে আমাদের বঞ্চিত করতে পারবে না। তোমার মত চার ফুটের পিচ্ছিরা তো নয়ই। বুঝেছো পিচ্ছি!”

সুরলা আবারো তেড়ে যায়। চোখ রাঙিয়ে বলে,
” আর একবার পিচ্ছি বললে আমি আপনার সব চুল ছিঁড়ে ফেলবো। ”

চয়ন ততক্ষণে সিড়ির মিডলে পৌঁছে গেছে। সেখানে দাঁড়িয়ে পেছন ফিরে বলে,
“চুল ছিড়তে হলে তোমাকে আমার চুল অবধি পৌঁছাতে হবে, যা তুমি পারবে না। আমার চুল ছিড়তে হলে তোমাকে লিফট চড়ে আমার মাথা অবধি পৌঁছে তারপর চুল ছিড়তে হবে। বুঝেছো পিচ্ছি?”

” আমি আপনার নামে মামলা করব। আমাকে পিচ্ছি বলার অপরাধে আপনার জেল হবে।” রাগটা মাথাচাড়া হয়ে যায় সুরলার। সুরলার হাস্যকর হুমকিতে হো হো করে হেসে দেয় চয়ন। বলে,
“অপ্রাপ্তবয়স্ক মানুষের দায়ের করা মামলা নিবে না পুলিশ। আগে প্রাপ্ত বয়স্ক হও, তারপর মামলার কথা বলো। ”

“আপনি জানেন, আমার বয়স কত?” চোখ ছোট ছোট করে বলে সুরলা। চয়ন সময় না নিয়েই জবাব দেয়,
“কতই বা হবে? বড়োজোর পনেরো? দেখতে তেমনই লাগছে। আমি নিশ্চিত, তুমি আমার ছোটবোন থেকে ও ছোটো হবে। ”

সুরলা হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারে না। এই লোকের চোখ কী আছে নাকি চলে গেছে! তার বয়স বলে কিনা পনেরো! তার বয়স বাইশ চলে। সেটা কিভাবে বুঝাবে সে! এই লোকের বিহেভ দেখে মনে হয় না। সত্যটা বললে বিশ্বাস করবে। তাই কথা বাড়াতে চায় না সে। এই লোককে যতটা ভদ্র ভেবেছিল ততটা ভদ্র নয়, বদের হাড্ডি। প্রথম কথোপকথনে কেমন করে তাকে পঁচাচ্ছে! না জানি পরে কী হবে! নিশ্চয়ই সারাদিন ‘পিচ্ছি’ ডেকে ক্ষেপাবে!

সুরলার চুপ থাকাটা পছন্দ হয় না চয়নের। সে বলে,
” শুনো পিচ্ছি, এখান থেকে যাবার সময় নিতুকে নিয়ে গলির মোড়ের দোকানটায় যাবে। দোকান থেকে হরলিক্স, বর্নভিটা, চেমন, কমপ্ল্যান, গ্লুকোজ কিনে নিয়ে যাবে। একটা ঘামলা নিয়ে সব একসাথে গুলে শরবত বানিয়ে খেয়ে একটা লম্বা ঘুম দিবে। সকালে উঠে দেখবে, তুমি রাতারাতি বড়ো হয়ে গেছ। তখন কেউ তোমার আর ‘পিচ্ছি’ বলে ডাকবে না। ট্রিকস টা ভালো না পিচ্ছি?”

সুরলা পিচ্ছি নয় তার হাইট পিচ্ছি। তাই তাকে পিচ্ছি লাগে। এটা চয়নকে কিভাবে বুঝাবে ভেবে পায় না সুরলা। রাগে তার কান দিয়ে ধোঁয়া বেরুচ্ছে। চয়ন আর কিছুক্ষণ থাকলে সে নিশ্চয় তার রাগটা কন্ট্রোলহারা হবে। তখন চয়নের অবস্থা, কাল বিকেলের নিতুর মত হবে। যা চাচ্ছে না সুরলা। তাই কটমট করে বলে,
“এই মুহুর্তে আপনি আমার সামনে থেকে বিদায় হন। না হলে আমি অঘটন ঘটিয়ে ফেলব। ”

“হাহ! আজকাল ভালো কথার দাম নেই। ” বলে ফুস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে সামনে আগায় চয়ন। চেয়েছিল এই মেয়েকে আরো কিছুক্ষণ ক্ষেপাবে। কিন্তু সরলার হাবভাব ভালো ঠেকছেনা বিধায় চলে যাচ্ছে। ক্ষেপানোর জন্য হাতে পর্যাপ্ত পরিমাণে সময় আছে, আজ এই পর্যন্তই থাক।
দোতলায় নিজেদের বাসা যায় সে। ড্রয়িংরুমে নিতুর সাথে দেখা হয়। নিতু নোট নিয়ে ফিরে আসছে। চয়নকে একা দেখে ভ্রু কুঁচকায়। বলে,
“আপনি একা! আমার বোন কোথায়? ”

চয়ন পিছন ফিরে সিড়ির দিকে তাকায়। সুরলাকে দেখা যাচ্ছে না। রেগে চলে গিয়েছে সম্ভবত। সে সরল গলায় বলে,
“কিছু বুঝলাম না জানো? তোমার বোনকে পিচ্ছি বললাম। তাতেই রেগে আগুন। তুমিই বলো, পিচ্ছিদের পিচ্ছি না বলে কী বলব?”

“আপনি ওকে পিচ্ছি বলেছেন!” বিস্মিত গলায় বলে নিতু। চয়ন মাথা নাড়ায়। নিতু সন্দেহী চোখে চয়নের মাথার দিকে তাকিয়ে বলে,
“আপনার চুল কয়টা ছিঁড়েছে?”
“ছিঁড়ার আগেই কেটে এসেছি। প্রচুর বিপজ্জনক তোমার বোন। ”
“ওর থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে চলবেন। আপনাকে রাতারাতি গায়েব করে দিবে। আমি যাই, দেখি কোথায় গেল।”

বলে বাসা থেকে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে যায় নিতু। সিড়ির কাছে গিয়ে দেখে সুরলা সিড়ির মিডলে মাথা চেপে বসে আছে। নিতু এগিয়ে যায় সেদিকে। সুরলার কাধে হাত রেখে বলে,
” চিবাদের বাসায় না গিয়ে এখানে বসে আছো কেন?”

নিতুর কথায় মাথা থেকে হাত নামিয়ে বলে,
“তোর ওই বান্ধবীর ভাইকে আমি দেখে নিব। কত বড় সাহস, বলে কিনা আমি পিচ্ছি! ”

নিতু অন্যদিকে তাকিয়ে মুখ চেপে হাসে। বিড়বিড় করে বলে,” আমার চুল ছিঁড়েছো বদ দোয়া লেগেছে। বেশ হয়েছে। আরো আমার চুল টানো।”

নিতুর হাসিটা চোখে পড়ে সুরলা। রাগত স্বরে বলে,
“তুই হাসছিস!”
তড়িৎ ফিরে নিতু। মাথা নাড়িয়ে বলে,
“কই না তো! আমি হাসছিনা। ভাইয়া কাজটা ঠিক করল না। আমার বোনটা কত বড়ো সেটা ভাইয়ার চোখে পড়া উচিত ছিল। ”

সুরলা ফুস করে নিঃশ্বাস ছাড়ে। ‘প্রেম ভালোবাসার অধ্যায় পরে। আগে ‘পিচ্ছি’ বলার ব্যাপারটা রফাদফা করব। কাল জগিং করতে গেলে ব্যাটাকে সায়েস্তা করব। আমাকে পিচ্ছি বলা না? দেখাচ্ছি মজা!’ ভেবে নেয় সুরলা।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here