কাজল নদীর জলে
আফিয়া আপ্পিতা
২০.
” আমার মনে হয়, ভাইয়া সুরলাকে পছন্দ করে। ভালো টালো ও বাসতে পারে।” মায়ের অবাক চাহনির উত্তরে বলে চরণ। যা ভিত্তিহীন। সে জানে তার ভাই ভালোবাসায় বিশ্বাসী না। একবার ধোকা খেয়ে ভালোবাসা থেকে বিশ্বাস উঠে গেছে।প্রেম, ভালোবাসা থেকে দূরে থাকে। তাও সে মাকে মিথ্যা বলে। যাতে মা চয়নের জন্য পাত্রী হিসেবে সুরলাকে বাছাই করে। জোবায়েদা ভ্রু কুঁচকে বলেন,
“তুই কিভাবে বুঝলি?”
চরণ পরনে থাকা ট্রাউজার থেকে ফোন বের করে একটা ছবি দেখায় মাকে। চিবার বার্থডে পার্টিতে চয়ন-সুরলা যখন এক মুহূর্তের জন্য পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ছিল। সেই মুহুর্তের ছবি তুলেছে ফটোগ্রাফার। তা চরণের হাতে পড়েছে। সে এই ছবিটা সবার কাছে প্রকাশ করতে না দিয়ে নিজের কাছে রেখে দিয়েছে। ছবিটা দেখিয়ে বলে,
“ভাইয়াকে এর আগে কোন মেয়ের ব্যাপারে এতটা ইন্টারেস্ট দেখাতে দেখিনি। সুরলার সাথে ভাইয়ার ভীষণ ভাব। চিবার জন্মদিনের পরদিন ব্রেকফাস্ট করতে বসে চিবা যখন সুরলার কথা বলল তখন দেখলে না কেমন ইস্টারেস্ট দেখাল? ভাইয়া তো ওকে ভালোবেসে কিট্টি ডাকে। ভাব ভালোবাসা না থাকলে ভাইয়ার মত মানুষ কাউকে নাম দেয়? কারো ব্যাপারে জানতে এতটা উৎসুক হয়? তুমিই বলো?”
জোবায়েদা খানিক ভাবেন। তারপর ছেলের কথার উত্তর দেন,
“হ্যাঁ, এর আগে ও কয়েকবার ওই মেয়ের কথা বলেছিল চয়ন। ও ভেবেছিল সুরলা নিতুর ছোটবোন, এটা নিয়ে সে কি তর্ক চিবার সাথে। মেয়েটা নিয়মিত জগিং করে, চিবাকে ওর থেকে কিছু শিখতে ও বলেছে। চয়ন যখন মেয়েটার ব্যাপারে কথা বলছিল আমার ও খটকা লেগেছে। সেদিন আমার সামনেই তো ‘কিট্টি’ বলে সম্বোধন করছিল।”
চরণ মাথা নাড়ে। বলে,
“ভাই যেহেতু কাউকে পছন্দ করে, তাই তোমরা অন্যত্রে পাত্রী না খুঁজে, পাত্রী হিসেবে ওকেই সিলেক্ট করো।”
জোবায়েদার চোখে মুখে হাসির আভা খেলে যায়। এবার ছেলেটাকে বিয়ের জন্য রাজি করাতে পারবেন তবে! অবশেষে ছেলেটা বিয়ে করবে! ভাবতেই খুশি লাগছে তার। খুশিতে গদগদ হয়ে বলেন,
“সত্যিই তবে চয়ন তার পাত্রী খুঁজে নিয়েছে! যাক ভালো হয়েছে। মেয়ে যেমনই হোক আমার আপত্তি নেই। আমার ছেলের খুশিই আমার খুশি। ছেলেটা যে বিয়ের জন্য রাজি হবে এটাই আমার জন্য বড় কিছু। এবার ইদের ছুটিতে বাড়ি এলে বিয়ের কথা পাকা করে রাখব।”
চরণ হাফ ছাড়ে। যাক কাজ হচ্ছে তবে! এবার ভাইকে রাজি করাতে পারলেই হয়। মাকে তো বলে দিয়েছে ভাই মেয়েটাকে পছন্দ করে, ভালোবাসে। যদি তা সত্যি হতো! অতীত ভুলে যদি সুরলাকে যদি একটা সুযোগ দেয় তবে ভাইয়া ঠকবে না, বরং জিতবে।
কথা বলতে বলতে বেগুনি বানানো শেষ করেছেন জোবায়েদা। বেসনের গোলা যুক্ত বাটি সিঙ্কে রেখে হাত ধুলেন। সিঙ্কের পাশে হেঙ্গারে ঝুলানো টাওয়ালে হাত মুছে ছেলের মুখোমুখি দাঁড়ান। চিন্তিত ভঙ্গিতে বলেন,
“চয়নের ব্যাপার তো বুঝলাম। কিন্তু মেয়ের মতামত ও জানা প্রয়োজন। সুরলা যদি চয়নকে পছন্দ না করে থাকে তবে কি বিয়ের জন্য রাজি হবে? যদি ওর পরিবার না মানে?”
কথা প্রসঙ্গে চরণ শপিংমলে সুরলার সাথে দেখা হওয়ার কথা জানায়। ভাইয়ের বিয়ের কথা বলার পর সুরলার চেহারার রঙ বর্ণনা করতে ও ভুলে না। তারপর সে বলে,
“ভাইয়াকে যদি সুরলা পছন্দ না করে তবে বিয়ের কথায় মন খারাপ করবে কেন!”
“তাহলে তো বিয়েতে কারো আপত্তি থাকার কথা নয়। ”
“তবে আর দেরি কেন? চয়নের বিয়ের মিশন শুরু করা যাক?” হেসে বলে চরণ। প্রতিত্তোরে জোবায়েদা বলেন,
“ইদ আসুক, চয়ন ও বাসায় ফিরুক তারপর এটা নিয়ে আগাব। এর আগে আমি তোর বাবার সাথে কথা বলে নিই। তার মতামতের ও দরকার আছে।”
রাতে জোবায়েদা স্বামীর সাথে কথা বলেন এ ব্যাপারে। সব শুনে বখতিয়ার আরেফিন জানান, ভালো হলে আগাতে বলেন। জোবায়েদা ভাবেন, রেহানার সাথে কথা বলবেন এ ব্যাপারে। দেখা যাক তারা কী বলে? তারা রাজি হলে টুকটাক কথা সেরে নিবেন। চয়ন যেহেতু সুরলাকে পছন্দ করে তাই আপত্তি করবে না। তাও ইদে বাড়ি এলে ওর মতামত নিবেন। ইদের আগে একবার রেহানার বাসায় গিয়ে কথা প্রসঙ্গে প্রাথমিকভাবে বিয়ের কথা বলবেন। মনে মনে নানা চক আঁকেন জোবায়েদা। দুদিন পর রাতে সবাইকে চমকে দিতে বখতিয়ার আরেফিন পরিবারের কাছে ফিরে আসেন। তার ফেরার কথা আরো মাস কয়েক পর। একটা ট্রিপ ক্যান্সেল হওয়ায় নির্ধারিত সময়ের আগেই ছুটি পেয়ে যান। ছুটি পেয়ে কালবিলম্ব না করেই ছুটেন পরিবারের কাছে। চমকে দেবার আশায় পরিবারকেও জানান নি। অনেক দিন পর বখতিয়ার আরেফিন বাসায় ফেরায় যেন বাসার প্রাণ ফিরে আসে। ছেলে মেয়ে আর স্ত্রীর উপচে পড়া খুশি চোখ এড়ায় না তার। প্রশান্তি চেয়ে যায় মনে। বখতিয়ার আরেফিন আসার পর বিয়ের ব্যাপার আরো গম্ভীর হয়। পরদিন সকালেই তিনি স্ত্রী আর চরণকে নিয়ে বৈঠক বসেন। চরণ মাকে ইতিপূর্বে যা বলেছে বাবাকেও তাই বলে। ছবিও দেখায়। জোবায়েদা সুরলার সম্পর্কে নানান গল্প করেন। চিবা তখনো কিছু জানে না। সে কাজিনদের সাথে গ্রুপ কলে ইদ কিভাবে কাটাবে সেই পরিকল্পনা করতে ব্যস্ত। এসবে ধ্যান যায় না তার।
সুরলার ছবি দেখে বখতিয়ার আরেফিন অবাক হন। বিস্মিত চোখে চেয়ে থাকেন ছবির দিকে। চরণ বলে,
“বাবা তুমি চিনো ওকে?”
বখতিয়ার আরেফিন ইতিবাচক ইশারা করলে চরণ কারণ জানতে চায়। বখতিয়ার সাহেব স্ত্রীর উদ্দেশ্যে বলেন, ” তোমার মনে আছে? গতবছর বাংলাদেশে আসার পর পাসপোর্ট সংক্রান্ত সমস্যা সমাধানের জন্য দৌড়াদৌড়ি করতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে বাসায় ফিরছিলাম?”
জোবায়েদা মনে করার চেষ্টা করেন। মনে পড়ে তার। সায় জানিয়ে বলেন,
“হ্যাঁ মনে আছে, সুগার ফল হওয়ায় তুমি ভরা রাস্তায় জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যাওয়া ধরেছিলে। তখন দুই তিনজন ছেলেমেয়ে এসে তোমাকে ধরেছিল। তুমি মিষ্টি জাতীয় কিছু চাওয়ার পর একটা মেয়ে ব্যাগ থেকে চকলেট বের করে খাইয়েছিল তোমায়। তারপর খানিক জিরিয়ে তুমি স্বাভাবিক হওয়ার পরে তোমাকে বাসার উদ্দেশ্যে গাড়ি ঠিক করে গাড়িতে তুলে দিয়েছিল। এমনটা বাসায় এসে বলেছিলে তুমি।”
বখতিয়ার আরেফিন কৃতজ্ঞ স্বরে বলেন,
“ছেলে মেয়েদের মাঝে এই মেয়েটিও ছিল। আর চকলেট দিয়েছে ও। যাওয়ার আগে সি এন জি চালকের নাম্বার নিয়েছে। সি এন জি চালককে বারবার বলছিল, যেন ঠিকঠাক ভাবে নিয়ে আসে আমায়। পথে ও দুই একবার কল দিয়েছে। একটা ধন্যবাদ দেয়ার জন্য পরে অনেক খুঁজেছি কিন্তু পাইনি। মেয়েটা ভীষণ মিষ্টি। এ যদি হয় আমার ছেলের পছন্দ তবে আমার কোন আপত্তি নেই, বরং খুশি। ”
জোবায়েদা আর চরণ সেদিনের ঘটনার জন্য সুরলাদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। জোবায়েদা বলে,
“দেখতে গেলে ধন্যবাদ দিয়ে এসো। ”
বখতিয়ার নির্দ্বিধায় বলেন,
” মেয়েকে ইতিপূর্বে আমরা দেখিছি তাই আর দেখাদেখি পর্বের প্রয়োজন নেই। তা ছাড়া ছেলে মেয়ে ও একে অপরের পরিচিত, পছন্দের। সুতারাং এত ফর্মালিটির দরকার নেই। তুমি আজই বরং মেয়ের খালার সাথে কথা বলে দেখো। ওনারা রাজি হলে ইদের ছুটিতে চয়ন এলে আমরা আনুষ্ঠানিক ভাবে প্রস্তাব নিয়ে যাব, সব ঠিকঠাক হলে এনগেজমেন্ট করিয়ে আসব। ব্যাস।”
পরিকল্পনা মাফিক ইফতারের পর যাওয়ার জন্য তৈরি হন। একা যাবেন না সাথে মেয়েকে নিবেন বলে ঠিক করেন। চিবা তখনো কিছু জানে না। জোবায়েদা তৈরি হয়ে মেয়ের রুমে যান। চিবা ইফতার করে বিশ্রাম করছিল। জোবায়েদা এসে বলেন,
“তৈরি হয়ে নে, আমরা নিতুদের বাসায় যাব।”
চিবা ওঠে বসে বলে,
“কেন!”
“নিতুর মায়ের সাথে একটা জুরুরি কথা বলার আছে।”
“কী জুরুরি কথা?”
“এখন সময় নেই। যেতে যেতে বলব। এশার আযার দিবে একটু পর। এসে তারাবির নামায পড়তে হবে। চল তাড়াতাড়ি।”
চিবা টি-শার্ট প্লাজো ছেড়ে থ্রি-পিস পরে তৈরি হয়ে নেয়। বাসা থেকে বেরিয়ে সিড়ি বেয়ে নামতে নামতে বলে,
“এবার বল কী জুরুরি কথা বলতে যাচ্ছো তুমি?”
জোবায়েদা বলেন,
“চয়নের জন্য সুরলার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যাচ্ছি।”
চিবা যেন বিশ্বাস করতে পারে না। মা তাকে সব কথা খুলে বলে। খুশিতে লাফিয়ে উঠে সে সুরলাকে ভীষণ পছন্দ তার। সে ভাইয়ের বউ হবে ভেবেই খুশি লাগছে তার! জোবায়েদা নিতুদের বাসায় গিয়ে রেহানাকে একান্তে ডেকে কথা প্রসঙ্গে বলেন সুরলা আর চয়নের বিয়ের কথা। চয়নকে রেহানার আগে থেকেই পছন্দ। চয়নকে জামাই বানানোর শখ জেগে ওঠে আবার। তড়িৎ ইতিবাচক উত্তর দেন। তারপক্ষ থেকে উত্তর হ্যাঁ, বাকি সুরলার মা বাবা। তাদের সাথে কথা বলে জানাবেন রেহানা। সুরলার মায়ের নাম্বার নিয়ে চলে যান জোবায়েদা। রেহানা নিতিকাকে ডেকে জোবায়েদার আনা প্রস্তাবের কথা জানান। নিতিকা চেহারায় উৎফুল্লতা দেখা দেয়। সে ভেবেছিল, বিয়ের ব্যাপারে প্রথমে তাকেই কোন পদক্ষেপ নিতে হবে, এখন সব ছেলে পক্ষ থেকে হলে তাকে আর চাপ নেয়া লাগবে না। রেহানা উৎফুল্লতার সাথে বলে,
“আমার সরুটার ভাগ্য খুলেছে। সোনার টুকরো বর জুটবে কপালে। চয়নের মতো বর পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। শুনে তো প্রথমে আমি বিশ্বাসই করতে পারছিলাম। এতটা খুশি লাগছিলো। চয়নের কাছে আমার মেয়েটা সুখে থাকবে। আমার ইচ্ছে পূরণ হলো অবশেষে।”
“খালামুনিকে জানিয়েছো?”
“না, জানাব এখন। হ্যাঁ, রে সুরলা রাজি হবে তো!”
নিতিকা মনে মনে হাসে। বলে,
“শুধু রাজি! তোমার মেয়েকে বলো গিয়ে দেখবে খুশিতে নাচতে শুরু করবে। পারলে সে এখনি বিয়ে করে নেয়। ” মনের কথা মনে চেপে বলে,
“খালামুনিকে জানাও, খালামুনি ওর মতামত নিক। ইতিবাচক হলে আগাবে, নেতিবাচক নিষেধ করবে। তবে আমার মনে হয় না, তোমার মেয়ের পক্ষ থেকে নেতিবাচক উত্তর আসবে।” মায়ের কাছে বোনের পছন্দের কথা বলে না নিতিকা। চেপে যায়। রেহানা খুশিতে গদগদ হয়ে বোনকে কল দেয়। রিসিভ হলে ভালোমন্দ বলে বিয়ের ব্যাপারটা জানায়। সাথে চয়নের প্রশংসার ঝুলি খুলে বসে।
চলবে…..