সুপ্ত_প্রেমাসুখ পর্ব-২

0
1806

#সুপ্ত_প্রেমাসুখ
#ইলোরা_জাহান_ঊর্মি
#পর্বঃ২

কনকনে শীতের রাতে ঘন কুয়াশার চাদর গায়ে মেখে, ফোনের ফ্ল্যাশ লাইটের আবছা আলোয় সামনে এগিয়ে যাচ্ছে এক জোড়া যুবক-যুবতী। একে তো ঘন কুয়াশা তার উপর আবার উত্তুরে হাওয়া। গায়ের পশম কাঁটা দেয়ার মতো অবস্থা। এরেন রীতিমতো ঠকঠক করে কাঁপছে। গায়ে জ্যাকেট থাকা সত্ত্বেও ব্যাগে করে সে ভারী শাল নিয়ে এসেছে। সেই শাল দিয়ে ওড়নার মতো করে মাথা ঢেকে গায়ে জড়িয়ে রেখেছে। এক হাত জ্যাকেটের পকেটে গুটিয়ে রেখে আরেক হাত চাদরের নিচ দিয়ে সামান্য বের করে ফোনের ফ্ল্যাশ লাইটের আলো ফেলে পথ চলছে। ওর এমন কান্ড দেখে ইলোরা যেন বেমালুম ভুলে গেছে যে তারা কত বড়ো বিপদের মুখে পড়েছে। সে এমন কনকনে শীতের মধ্যে ড্রেসের উপর একটা ডেনিম জ্যাকেট পড়ে আছে আর এই ছেলে জ্যাকেটের উপর চাদর পেঁচিয়ে প্যাকেট হওয়ার পরও ঠকঠক করে কাঁপছে। ইলোরার পেটফাটা হাসি আসছে। কিন্তু এমন পরিস্থিতিতে সে হাসতেও পারছে না। তবে ঠোঁট টিপে ঠিকই হাসছে। বাস থেকে নামার পর কন্ডাক্টরের ফেরার অপেক্ষায় কয়েক মিনিট দাঁড়িয়ে ছিল তারা। অধৈর্য হয়ে এরেন ইলোরাকে নিয়ে সামনের দিকে হাঁটা শুরু করেছে অন্য কোনো গাড়ি পাওয়ার আশায়। ইলোরা কোনো উপায়ান্তর না পেয়ে বাধ্য মেয়ের মতো এরেনের পিছু পিছু হেঁটে চলেছে। হাঁটতে হাঁটতে প্রায় অনেক দূর চলে এসেছে। এখনও অবধি একটা গাড়িও চোখে পড়ছে না তাদের। চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার ছাড়া কিছুই চোখে পড়ছে না। ইলোরা ভয়ে ভয়ে এরেনের দিকে তাকিয়ে বলল,“মনে হচ্ছে আজ আর কোনো গাড়ি পাওয়া যাবে না।”

ইলোরার কথায় এরেন ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। তারপর ছোটো একটা নিঃশ্বাস ফেলে সেও বলল,“আমারও তাই মনে হচ্ছে। এখানকার মানুষ বোধ হয় শীতের প্রকোপ বেশি হওয়ায় তাড়াতাড়ি দোকানপাট আটকে যার যার বাড়ি ফিরে গেছে। গাড়িওয়ালারা হয়তো একই কাজ করেছে। দেখছো না রাস্তা পুরো ফাঁকা!”

“তাহলে এখন কী হবে?”

এরেন কোনো উত্তর দিলো না। সে নিজের মনে ঠকঠক করে কাঁপছে আর সামনের দিকে পা বাড়িয়ে চলেছে। ইলোরা মুখ গোমড়া করে তাকে অনুসরণ করছে। তার পা দুটো ঠান্ডায় আর ক্লান্তিতে অবশ হয়ে গেছে। কিছুতেই যেন আর সামনে এগোতে পারছে না। এত দূর হাঁটার অভ্যাসও নেই তার। সে আর না পেরে হঠাৎ থেমে গেল। রাস্তার পাশে একটা গাছের গুঁড়ি দেখে তার উপর বসে পড়ল। তাকে থামতে দেখে এরেনও থেমে গেল। ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল,“বসে পড়লে কেন?”

“হাঁটতে পারছি না আর।”

আবছা আলোয় ইলোরার ক্লান্ত মুখটার দিকে তাকিয়ে এরেনের খুব মায়া লাগছে। এটুকু হেঁটেই মেয়েটা কেমন ক্লান্ত হয়ে পড়েছে! এরেনের ভাবনার মাঝেই হঠাৎ ইলোরা লাফিয়ে উঠে এরেনের পাশে এসে দাঁড়াল। ভীতু চোখে এদিক-ওদিক দৃষ্টি বিচরণ করতে লাগল। তার এহেন কাজে এরেন হকচকিয়ে গেল। সে কিছু বুঝতে না পেরে সতর্ক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে প্রশ্ন করল,“এনি প্রবলেম?”

এরেনের প্রশ্নে ইলোরা ভীতু চোখে তাকিয়ে মুখ গোমড়া করে উত্তর দিল,“এখানে যদি ভূত থাকে?”

“কিহ্!”

ইলোরা একটা শুকনো ঢোক গিলে একই ভাবে বলল,“ভূতরা এমন অন্ধকারের মধ্যেই লুকিয়ে থাকে।”

এরেনের যেন আক্কেলগুড়ুম হলো। রাত-বিরেতে যে মেয়ে একা একা কিশোরগঞ্জ রওনা দিয়েছে সে মেয়ে কি না অবাস্তব ভূতে ভয় পায়! তাছাড়া দুদিন পর না-কি এই মেয়ে ভার্সিটিতে ভর্তি হবে। অথচ বাচ্চাদের মতো কেমন ভূতে বিশ্বাস করে! এরেন সরু চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,“এসব কে বলল তোমাকে?”

ইলোরা এরেনের দিকে কিছুটা সরে দাঁড়িয়ে ঠোঁট উল্টে বলল,“আমি জানি। এজন্যই অন্ধকারে আমার ভয় লাগে।”

“তাহলে এতক্ষণ যে এই ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যে আবছা আলোয় হাঁটছিলে, ভয় করেনি?”

“করেছে তো। এখন যদি ভূত এসে আমাদের দুজনের ঘাড় মটকে দিয়ে চলে যায়?”

এরেন হাসবে না কাঁদবে কিছুই যেন বুঝতে পারছে না। সে বোকা বোকা চোখে তাকিয়ে বলল,“শোনো, এসব ভূত-টুত কিছুই সত্যি না। এসবকিছু মিথ্যা বানোয়াট গল্প। এখন তুমি কি হাঁটতে পারবে?”

ইলোরা অসহায় মুখ করে ডানে বায়ে মাথা নাড়ল। যার অর্থ সে আর এক পা-ও সামনে এগোতে পারবে না। এরেন বুক ফুলিয়ে বড় একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,“ওখানে বসে বিশ্রাম নাও, যাও।”

ইলোরা ভীতু চোখে একবার এরেনের দিকে তাকিয়ে আবার এদিক-ওদিক দৃষ্টি বিচরণ শুরু করল। এরেন বুঝতে পেরে গাছের গুঁড়িটির দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল,“আমি এখানেই দাঁড়ালাম। এবার বসো।”

এবার ইলোরা মনে কিছুটা সাহস পেল। ধীর পায়ে হেঁটে গিয়ে আবার গুঁড়িটির উপর বসে দুহাতে মুখ ঢেকে জোরে নিঃশ্বাস নিল। ক্লান্ত শরীরটা এখন বিছানা চাইছে। অতিরিক্ত পাকামো করে বাড়ি থেকে একা বের হওয়ার ফল এবার হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে সে। মনে মনে নিজেকে নিজে বকতে শুরু করল। হঠাৎ তার ফোনটা স্বশব্দে বেজে উঠল। ইলোরা হালকা চমকালো। ফোনটা ব্যাগ থেকে বের করে তার মুখটা চুপসে গেল। কিছুক্ষণ ফোনের দিকে তাকিয়ে থেকে তারপর রিসিভ করে কানে ধরে বলল,“হ্যালো ভাই।”

“হ্যাঁ বোন। পৌঁছে গেছিস?”

সাকিবের প্রশ্ন শুনে ইলোরা অসহায় দৃষ্টিতে একবার এরেনের দিকে তাকাল। তারপর আমতা-আমতা করে বলল,“না। তবে কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে যাব।”

সাকিব অবাক হয়ে বলল,“মানে? এতক্ষণে তো পৌঁছে যাওয়ার কথা।”

“আসলে মাঝপথে হঠাৎ বাসের টায়ার পাংচার হয়ে গিয়েছিল। তাই একটু দেরি হয়েছে। যাইহোক, তুমি চিন্তা কোরো না। আমি কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে যাব। কাল সকালে কথা হবে তোমার সাথে। এখন রাখছি।”

“আরে শোন, এরে………..।”

সাকিবকে কথা শেষ করতে না দিয়েই ইলোরা তাড়াতাড়ি ফোন কেটে দিলো। তারপর বড়ো একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ফোনটা সুইচ অফ করে রাখল। এরেন ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করল,“মিথ্যা কথা বললে কেন?”

“সত্য কথা বললে সারারাত জেগে দুশ্চিন্তা করবে। আবার এই রাত-দুপুরে ছুটে চলেও আসতে পারে আমাকে খুঁজতে। একে দিয়ে বিশ্বাস নেই।”

এরেন হাসিমুখে বলল,“তোমার ভাই কিন্তু তোমাকে একটু বেশিই ভালোবাসে।”

ইলোরা এরেনের কথায় মুচকি হেসে ফোনটা পুনরায় ব্যাগে রেখে দিলো। এরেন নিজের ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে দেখল রাত এগারোটা দশ বাজে। সব ঠিকঠাক থাকলে এতোক্ষণে সে কিশোরগঞ্জ পৌঁছে যেত। মেয়েটা সাথে না থাকলে এখন সে দ্রুত পায়ে হেঁটে অনেক দূর পর্যন্ত চলে যেতে পারত। কিন্তু সাকিব যখন বোনের খেয়াল রাখার দায়িত্ব দিয়েছে তখন সেটা এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব না। তার থেকে বড়ো কথা একা একটা মেয়ের যেকোনো বিপদ হয়ে যেতে পারে। সে জেনেশুনে একটা মেয়েকে কোনো বিপদের মুখে ঠেলে দিয়ে চলে যেতে পারে না। এমন ভয়ানক পরিস্থিতিতে সে কোনোদিনও পড়েনি। একদিকে অস্বস্তি হচ্ছে আরেক দিকে চিন্তা ও হচ্ছে। মেয়েটা যদি এখন বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ে তাহলে সে কী করবে একে নিয়ে? এরেনের ভাবনার মাঝে হঠাৎ তার চোখেমুখে তীব্র আলোক ছটা এসে পড়ল। আকস্মিক ঘটনায় এরেনের চোখ দুটো আপনা-আপনি কুঁচকে গেল। সে নিজের বাঁ হাতটা চোখের সামনে ধরে পিটপিট করে চোখ খোলার চেষ্টা করল। আলোটা ইলোরার মুখেও কিছুটা পড়ায় সেও সামনে তাকাল। আলোটা চোখ থেকে নেমে যেতেই এরেন স্পষ্ট দৃষ্টিতে সামনে তাকাল। ইলোরা ও ভ্রু কুঁচকে তাকাল। সামনে চারজন বখাটের মতো যুবক ছেলেকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ইলোরা ভয় পেয়ে দ্রুত উঠে এরেনের পেছনে গিয়ে দাঁড়াল‌। ছেলেগুলোর মধ্যে একজন উচ্চ স্বরে প্রশ্ন করল,“কারা আপনারা?”

এরেন সোজাসুজি জবাব দিল,“আমরা ঢাকা থেকে এসেছি। কিশোরগঞ্জ যাচ্ছি।”

আরেকজন ছেলে বলল,“তো এখানে কী করছেন?”

“আসলে আমরা যে বাসে করে যাচ্ছিলাম তার দুটো টায়ার পাংচার হয়ে গেছে। সেখানে আশেপাশে কোথাও গ্যারেজ নেই তাই কন্ডাক্টর গিয়েছে গ্যারেজ খুঁজতে। আমরা অনেকক্ষণ যাবত অপেক্ষা করে তারপর ভাবলাম সামনে হয়তো কোনো গাড়ি পেয়ে যাব। এটা ভেবে হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূর পর্যন্ত চলে এলাম অথচ একটা গাড়িও চোখে পড়ল না এখন পর্যন্ত। আপনারা কি বলতে পারবেন এখানে কোথাও গাড়ি পাব কি না?”

কথাগুলো বলে এরেন উৎসুক দৃষ্টিতে ছেলেগুলোর দিকে তাকিয়ে রইল। একটা ছেলে বলল,“এই সময় তো কোনো গাড়ি পাবেন না। শীতের রাত তো।”

আরেকটা ছেলে এরেনের পেছন দিকে উঁকি-ঝুঁকি মেরে জিজ্ঞেস করল,“আপনার সাথে কে? বউ না-কি?”

এরেন খুব অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে পড়ে গেল। তবু সে নিজেকে স্বাভাবিক রেখে জবাব দিলো,“ও আমার বন্ধুর বোন। আমরা দুজন এক বাসেই কিশোরগঞ্জ যাচ্ছিলাম। এতোক্ষণ হেঁটে ও অনেক ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। তাই এখানে বসে বিশ্রাম নিচ্ছিল।”

ছেলেগুলো সবাই একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। তাদের মুখ দেখে মনে হচ্ছে তারা কেউ এরেনের সোজাসাপ্টা কথাটা বিশ্বাস করে উঠতে পারেনি। এরেন ঘাড় ঘুরিয়ে পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখল ইলোরা ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে চোখের ইশারায় ইলোরাকে শান্ত থাকতে বলল। একটা ছেলে বলে উঠল,“মেয়েটা যেহেতু এত ক্লান্ত হয়ে পড়েছে তাহলে তো মনে হচ্ছে আর হাঁটতে পারবে না। আর এত শীতের মধ্যে এভাবে রাস্তায় বসে রাত কাটালে দুজনই অসুস্থ হয়ে পড়তে পারেন। তো এখন কী করবেন?”

এরেন চিন্তিত মুখে ছেলেগুলোর দিকে তাকাল। ছেলেগুলো ফিসফিস করে নিজেদের মধ্যে কিছুক্ষণ কথা বলল। এরেন তাতে ভ্রুক্ষেপ করল না। তার পেছন থেকে ইলোরা উঁকি-ঝুঁকি মেরে উৎসুক দৃষ্টিতে ছেলেগুলোকে দেখছে। নিজেদের মধ্যে কথা শেষ করে একটা ছেলে বলল,“বিপদে পড়ে যখন আমাদের এলাকায় এসে পড়েছেন তখন এই এলাকার মানুষ হিসেবে আপনাদের সাহায্য করা আমাদের দায়িত্ব। আমার বাড়ির সামনে একটা পুরনো কাচারি ঘর আছে। আপনারা চাইলে সেখানে রাতটা পার করতে পারেন। আসলে এতো রাতে বাড়ির ভেতরে নিয়ে গেলে হয়তো সবাই বিরক্ত হবে। তাই যদি কষ্ট করে কাচারি ঘরটাতেই থাকতেন। আমাদের সত্যিই খুব খারাপ লাগছে আপনাদের জন্য। এখান থেকে মাত্র পাঁচ মিনিটের পথ আমার বাড়ি যেতে। আপনারা কি যাবেন?”

এরেন ইলোরার ক্লান্ত মুখটার দিকে তাকিয়ে দেখল মেয়েটা ঘুমে ঢুলছে। শীতে তার ঠোঁট কাঁপছে। তাছাড়া সে নিজেই শীতকাতুরে। রাত যত বাড়ছে শীতের প্রকোপ ততোই বেড়ে চলেছে। এভাবে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা আর সম্ভব হচ্ছে না। অনিচ্ছা সত্ত্বেও এরেন বাধ্য হয়ে মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। ছেলেগুলো এরেনের মুখের দিকে আগ্রহী দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। এরেনের সম্মতি পেয়ে তাদের মুখে হাসি ফুটল। পূর্বের ছেলেটা হাসিমুখে বলল,“আসুন আমার সাথে।”

এরেন ইলোরাকে উদ্দেশ্য করে ছোটো করে বলল,“চলো।”

এরেন ছেলেটার পেছন পেছন হাঁটতে শুরু করল। ইলোরা ও বাধ্য হয়ে ঘুমঘুম চোখে তাদেরকে অনুসরণ করে চলল। বাকি তিনজন ছেলে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল। কিছুদূর যেতেই সামনে একটা ছোটখাটো টিনের ঘর দেখতে পেল তারা। অচেনা ছেলেটা এগিয়ে গিয়ে ঘরের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল,“ভেতরে আসুন।”

এরেন ইলোরাকে নিয়ে ঘরের ভেতরে প্রবেশ করল। ছেলেটা একপাশে গিয়ে সুইচ টিপতেই ঘরের মাঝখানে ছোট একটা লাল বাল্ব জ্বলে উঠল। তবে বাল্বটার আলো কিছুটা আবছা। ছেলেটা কিছুটা ইতস্তত করে পাশের একটা পাটি দেখিয়ে বলল,“এটা বিছিয়ে শুয়ে পড়ুন। কিছু মনে করবেন না। একটু কষ্ট করে মানিয়ে নিন।”

এরেন মুখে হাসি টানার চেষ্টা করে বলল,“না ভাই। আপনি আমাদের অনেক বড়ো উপকার করেছেন। কৃতজ্ঞ থাকব আপনার কাছে।”

ছেলেটা ইলোরার দিকে একনজর তাকিয়ে হেসে বলল,“উনি খুব বেশি ক্লান্ত। আপনারা বিশ্রাম করুন। আর আপনাদের কি সকালে জাগিয়ে দিতে হবে?”

“না না, আমরা নিজেরাই উঠে পড়ব। আপনাকে কষ্ট করতে হবে না।”

“ঠিক আছে। আমি তাহলে আসছি। ভেতর থেকে দরজাটা লাগিয়ে দিন।”

এরেন মাথা নাড়ল। ছেলেটা মুচকি হেসে ঘর থেকে বেরিয়ে চলে গেল। এরেন দরজার খিল লাগিয়ে ফিরে তাকাতেই দেখল ইলোরা পাটি বিছিয়ে নিয়েছে। ব্যাগ থেকে একটা চাদর বের করে মাথার নিচে ব্যাগটা দিয়ে গায়ে চাদর টেনে গুটিসুটি মেরে শুয়ে পড়েছে। এরেন কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ভাবল পাটিটা মোটামুটি অনেক বড়ো। ইলোরা যেহেতু এক কোণে শুয়েছে সে নির্দিধায় আরেকপাশে বসতে পারবে। এটা ভেবেই সে এগিয়ে গিয়ে কাঁধ থেকে ব্যাগটা নামিয়ে রেখে পাটির এক কোণে পদ্ম আসনের মতো করে বসল। সঙ্গে সঙ্গে ইলোরা লাফ দিয়ে বসে পড়ল। এরেন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে ইলোরার দিকে প্রশ্নভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,“হোয়াট হ্যাপেন?”

ইলোরা ভ্রুকুটি করে প্রশ্ন করল,“আপনি এখানে বসেছেন কেন?”

“তাহলে কোথায় বসব? এখানে আর কোনো বসার জায়গা নেই।”

ইলোরা ঘরের চারদিকে তাকিয়ে ঠোঁট উল্টে বলল,“তাই তো! কিন্তু আমার তো অস্বস্তি হচ্ছে।”

“কিছু করার নেই। একটা রাত কষ্ট করে মানিয়ে নিতে হবে। আমি লাইট অফ করে দিচ্ছি‌। আশা করি তাহলে তোমার অস্বস্তিটা একটু কম হবে।”

ইলোরা সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে বলে উঠল,“এই না না। আমি অন্ধকারে ভয় পাই।”

এরেন এবার কিছুটা বিরক্তি নিয়ে বলল,“ঠিক আছে, তাহলে তুমি ঘুমাও। আমি এখানেই বসে আছি।”

ইলোরা আবার শুয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ পর হঠাৎ সে এরেনকে প্রশ্ন করল,“আপনি কিশোরগঞ্জ কার বাসায় যাচ্ছেন?”

“আমার ছোট খালার বাসায়।”

“বেড়াতে?”

“না।”

“তাহলে?”

“আমার ছোট খালার আর্থিক অবস্থা ভালো না। তার সংসার চলে আমার বাবার সহায়তায়। এরমধ্যে আবার শুনলাম তারা যেটুকু জায়গায় বাড়ি করে থাকছে তার উপর এলাকার কোন পয়সাওয়ালার নজর পড়েছে। সেজন্যই যাচ্ছি।”

ইলোরা ভ্রু কুঁচকে বলল,“কিন্তু আপনি গিয়ে কি আটকাতে পারবেন? তাদের সাথে ঝামেলায় জড়ালে তো তারা আপনারই কোনো ক্ষতি করে ফেলতে পারে। তখন?”

ইলোরার কথাটা এরেনের কাছে যুক্তিযুক্ত মনে হলো। সত্যিই তো! তার যদি কোনো ক্ষতি করে বসে? এটা সে ভেবেই দেখে নি। খালার মুখে শোনার পর বাবা-মাকে কারণ না বলেই কিশোরগঞ্জ রওনা দিয়েছে। এরেনের মুখে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। ইলোরা কিছুক্ষণ চুপ থেকে কিছু একটা ভেবে হঠাৎ বলল,“আমার মামা কিন্তু এলাকার মানুষদের এসব সম্পত্তি বিষয়ক সমস্যা সমাধান করে দেয়। আপনি চাইলে আমার মামার সাথে এ ব্যাপারে কথা বলতে পারেন। আমি নিশ্চিত মামা আপনাকে হেল্প করবে।”

ইলোরার কথায় এরেন একটা আশার আলো দেখতে পেয়ে খুব খুশি হলো। সে উত্তেজিত হয়ে প্রশ্ন করল,“তাহলে তো খুব উপকার হয়। তোমার মামার সাথে যোগাযোগ করব কিভাবে?”

ইলোরা স্বাভাবিকভাবেই উত্তর দিলো,“কাল সকালে না হয় আপনি আমার সাথে আমার মামার বাড়ি চলুন। তাহলেই তো মামার সাথে দেখাও হয়ে যাবে আর কথাও হয়ে যাবে।”

এরেন ইতস্তত করে বলল,“কিন্তু তোমার সাথে আমাকে দেখে তোমার মামা যদি অসন্তুষ্ট হন?”

ইলোরা মুচকি হেসে গদগদ কন্ঠে বলল,“আমার মামা একদম অন্যরকম। আমাকে অনেক বেশি ভালোবাসে সে। আপনি গেলেই দেখতে পারবেন।”

এরেন কিছুটা চিন্তামুক্ত হয়ে ছোটো একটা শব্দ করল,“আচ্ছা।”

ইলোরা আর কথা বাড়াল না। পাশ ফিরে চুপচাপ গুটিসুটি মেরে চোখ বন্ধ করল। এত ক্লান্তির ফলে চোখ বন্ধ করার কয়েক মিনিটের মধ্যেই সে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে গেল। এরেন রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে কিছুক্ষণ বসে বসে ঝিমালো। তারপর আর না পেরে সেও ইলোরার মতো মাথার নিচে ব্যাগ রেখে গায়ে চাদর টেনে শুয়ে পড়ল। বরাবরই সে বেশি রাত জাগতে পারে না। তার উপর আবার বসে বসে ঘুমানো তো অসম্ভব। সে চোখ বন্ধ অবস্থায় আপন মনে বিড়বিড় করল,“এমন রাত যেন জীবনে আর কোনোদিনও না আসে আল্লাহ্।”

চলবে…………………..🌸

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here