#সুপ্ত_প্রেমাসুখ
#ইলোরা_জাহান_ঊর্মি
#পর্বঃ৯
“ভাইয়া, আসবো?”
এরেনের গভীর মনোযোগ ছিল বইয়ের পাতায়। বোনের ডাকে ফিরে তাকাল। দেখল জারিন দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। এরেন ভ্রু বাঁকিয়ে বলল,“আয়। অনুমতি নেয়া শুরু করলি কবে থেকে?”
জারিন ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল,“তুই পড়ছিলি তাই ভাবলাম যদি ডিস্টার্ব হস।”
এরেন বইটা বন্ধ করে চেয়ারে আরাম করে বসে বলল,“সে তো তুই সারাক্ষণই ডিস্টার্ব করিস।”
জারিন অবাক হয়ে প্রশ্ন করল,“আমি তোকে সারাক্ষণ ডিস্টার্ব করি?”
এরেন ছোটো করে জবাব দিলো,“হুঁ।”
জারিন গাল ফুলিয়ে দরজার দিকে পা বাড়াতে বাড়াতে বলল,“ওকে, আর করব না।”
বোন রেগে গেছে বুঝে এরেন দ্রুত চেয়ার ছেড়ে উঠে দৌড়ে গিয়ে জারিনের হাত ধরে টেনে বিছানার একপাশে বসিয়ে সেও মুখোমুখি বসল। জারিনের গাল ফুলানো দেখে এরেন হাসতে হাসতে গাল টেনে দিয়ে বলল,“আরে আমি তো মজা করছিলাম। বুঝতে পারিসনি তুই? এইটুকু কথায় রেগে গেলি কেন বুড়ি?”
হঠাৎ করেই জারিনের খেয়াল হলো সে আজ অল্পতেই রেগে যাচ্ছে। একটু আগে তার আম্মীর সাথে কথা বলতে গিয়েও এমন হয়েছে। আম্মী কোনো এক বিষয় নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই কথা বলছিল। অথচ সে হুট করেই রেগে গিয়েছিল। এবারও ঠিক সেটাই হলো। ভাইয়া যে তার সাথে মজা করেছে তা তো সে বুঝতেই পেরেছে। তবু রেগে গেল। অবশ্য হঠাৎ করে এমন হওয়ার কারণটাও কিছুটা আঁচ করতে পারছে সে। কিন্তু সেটা কিছুতেই কাউকে বুঝতে দেওয়া যাবে না। জারিন দ্রুত নিজেকে সামলে মুচকি হেসে বলল,“সরি। এখন বল ভাবির কী খবর?”
এরেন কিছুটা বিব্রত বোধ করে বলল,“কী সবসময় ভাবি ভাবি করিস বল তো? কতবার বলেছি সবসময় এসব বলবি না।”
“কেন? তোর ভালো লাগে না?”
“সবসময় ভাবি ভাবি করলে অন্য কেউ মানে আম্মী বা বাবাও তো শুনে ফেলতে পারে। তখন কী হবে ভাবতে পারছিস?”
জারিন ত্যাড়াভাবে বলল,“তোর শুনতে ভালো লাগে কি না বল।”
এরেন শান্ত স্বরে বলল,“ভালো লাগার মতো তেমন সম্পর্ক নেই আমাদের।”
“হতে কতক্ষণ?”
জারিনের সহজভাবে বলা কথাটায় এরেন মুচকি হাসল। তাচ্ছিল্যের স্বরে বলল,“হবে না বুড়ি। কারণ আমরা কেউই আমাদের মধ্যকার সম্পর্কটা মানি না। আমি এখন ওর কথা যেটুকু ভাবি ও আমার কথা সেটুকু ভাবে না-কি জানিও না। দেখা হলেই যেভাবে পালিয়ে বেড়ায় তাতে তো মনে হয় ও আমাদের সম্পর্কটা নিয়ে ভাবতে চায় না।”
জারিন মাথাটা হালকা দুলিয়ে বলল,“আমার কিন্তু এমনটা মনে হচ্ছে না।”
“কেন?”
জারিন বালিশ টেনে কোলে নিয়ে আরাম করে বসে অভিজ্ঞের মতো বলল,“শোন, কেউ না মানলেও তোরা সেই হাসবেন্ড-ওয়াইফই থাকবি। সম্পর্কটা তো আর চেঞ্জ হবে না। অন্য কাউকে বিয়ে করার কথা ভাবলেও তোদের দুজনের মাথায় একই চিন্তা আসবে যে এক্সিডেন্টলি হলেও বিয়েটা হয়েছে। আর হাসবেন্ড থাকতে অন্য কাউকে গ্রহণ করা হারাম। তবে তার আগে যদি ছাড়াছাড়ির কথা ভাবিস তাহলে ভিন্ন কথা। সেক্ষেত্রে আমি বলব মানুষের জীবনে প্রথম সম্পর্কটা কিছুটা স্পেশাল হয়। ছেড়ে দেয়ার পরে সম্পর্কটা হয়তো ঢাকা পড়ে যাবে কিন্তু সারাজীবন তোদের দুজনের মনে একটা আঁচড়ের দাগ থেকে যাবে। অন্য কাউকে বিয়ে করলে সেটা হবে তোদের দ্বিতীয় বিয়ে। আর প্রথম বিয়ের কথা লুকিয়ে দ্বিতীয় বিয়ে করলে দ্বিতীয় হাসবেন্ড বা ওয়াইফকে ঠকানো হবে। সেক্ষেত্রে দুজনেই হয়তো ভাববি কোনোভাবে যদি এই সম্পর্কটাকে বাঁচিয়ে রাখা যায় তাহলে আর কাউকেই দ্বিতীয় বিয়ে করতে হবে না।”
জারিন কথা থামিয়ে ভাইয়ের মুখের দিকে তাকল। এরেন মনোযোগ দিয়ে বোনের কথা শুনে মাথা দুলিয়ে কপালে হালকা ভাঁজ ফেলে বলল,“সবই বুঝলাম। কিন্তু ওর তো অন্য কোনো পছন্দও থাকতে পারে।”
জারিনের মুখেও এবার চিন্তার ছাপ দেখা গেল। পরক্ষণেই বলল,“তোর ভাষ্যমতে মেয়েটা তোকে দেখলে লজ্জায় আর অস্বস্তিতে জড়োসড়ো হয়ে পড়ে। এর মানে হলো তোকে দেখলে ওর মাথায় এটাই ঘোরে যে এক্সিডেন্টলি হলেও তুই ওর হাসবেন্ড। ওর সাথে প্রতিদিন দেখা হওয়ায় এখন তুই ওকে নিয়ে প্রতিদিনই ভাবিস। মানে ভার্সিটি থেকে এসে তোর মাথায় ওই মেয়েটাই ঘুরঘুর করে। হয়তো তোর মতো ওর-ও একই অবস্থা হয়। আর আমার মনে হয় এতদিনে ওর জন্য তোর মনে একটা সফট কর্নার তৈরি হয়েছে।”
জারিনের কথা শুনে এরেন তার মাথায় গাঁট্টা মেরে বলল,“ওই বুড়ি, এসব কখন বললাম আমি?”
জারিন ডান হাতের তালুতে মাথা ঘষতে ঘষতে মুখ গোমড়া করে বলল,“বলা লাগে না, আমি এমনিতেই বুঝে গেছি তোর হাবভাব দেখে। তাতে তো ভালোই হয়েছে। এখন থেকে তুই ওর সাথে সহজ হওয়ার চেষ্টা করবি। তোকে দেখলে ও পাশ কাটিয়ে চলে গেলেও তুই যাবি না। বরং ওর সাথে ফ্রেন্ডলি কথা বলার চেষ্টা করবি। তুই ইচ্ছে করে কথা বললে দেখবি আস্তে আস্তে ওর মাঝের আড়ষ্টতা কমে আসবে। তোর সাথে কথা বলার পর ও হয়তো তোকে নিয়ে আরো বেশি ভাববে। ভাবতে ভাবতে একদিন তোর জন্যও ওর একটা সফট কর্নার তৈরি হবে।”
“তুই যতটা সহজ ভাবছিস ব্যাপারটা ততটা সহজ হবে না রে বুড়ি। অস্বস্তি, ভয়, লজ্জা সবকিছুতে ওকে আরও বেশি করে ঘিরে ধরবে। সবচেয়ে বড়ো কথা সাকিব। সাকিব তো ভার্সিটিতেই থাকে। ওর সামনে তো আর ওর বোনের সাথে আমি ভাব জমানোর চেষ্টা করতে পারব না।”
জারিন দাঁত বের করে হেসে বলল,“সাকিব ভাইয়ার বোন কিন্তু তোর বউ। তোর বউয়ের সাথে তুই ভাব জমাবি তাতে কার কী?”
“সেটা তো আর আমরা ছাড়া অন্য কেউ জানে না।”
“জানি ভাইয়া। কিন্তু চেষ্টা করতে দোষ কী? আমি জানি তুই চেষ্টা করলে সব সম্ভব হবে।”
“হয়তো।”
“হয়তো না ভাইয়া। তুই একবার চেষ্টা করে দেখ প্লিজ। হাজার হোক হাসবেন্ড বলে কথা। তোর প্রতি ওর কিছুটা দুর্বলতা আসবেই, দেখিস। দরকার পড়লে এই এক্সিডেন্টলি বিয়ের কথাটা লুকিয়ে নতুন করে সম্পর্ক শুরু করবি। তবু আমি চাই তোর জীবনে প্রথম যে এসেছে সে-ই থাকুক। হয়তো আকস্মিকভাবে এসেছে। কিন্তু আল্লাহ্ যখন তাকে তোর জীবনে পাঠিয়েছে, নিশ্চয়ই কোনো কারণেই পাঠিয়েছে। প্লিজ একবার চেষ্টা করে দেখ।”
এরেন মেঝেতে দৃষ্টি স্থির রেখে মাথা দুলিয়ে বলল,“ঠিক আছে। আমি চেষ্টা করব। কিন্তু তাতে কোনো লাভ হবে কি না কে জানে? সেটা ওর সাথে কথা বললেই বুঝা যাবে আশা করি। চেষ্টা করে দেখি হঠাৎ জুড়ে যাওয়া সম্পর্কটাকে একটা সুযোগ দিয়ে তাকে বাঁচানো যায় কি না। দেখি কপালে কী আছে?”
জারিনের মুখে হাসি ফুটলো। এরেন বলল,“এখন যা, আমি পড়তে বসব। নইলে এক্সামে লাড্ডু পাব।”
জারিন হেসে বিছানা থেকে নেমে দরজার দিকে পা বাড়াতে বাড়াতে বলল,“সেই লাড্ডু না হয় ভাবিকে খাইয়ে মিষ্টি মুখ করাব।”
এরেন মুচকি হেসে উঠে টেবিলের দিকে এগিয়ে গেল। জারিন হঠাৎ দরজার কাছে দাঁড়িয়ে পড়ল। ঘুরে দাঁড়িয়ে নরম কন্ঠে ডাকল,“ভাইয়া।”
এরেন ফিরে তাকিয়ে ছোটো একটা শব্দ করল,“হুঁ।”
জারিন একহাত দিয়ে আরেকহাত কচলাতে কচলাতে আমতা-আমতা করে প্রশ্ন করল,“রনি ভাইয়া আসে না কেন এখন আর?”
এরেন হেসে উত্তর দিলো,“মাত্র এক সপ্তাহ পর এক্সাম। এখন কি ঘুরঘুর করার সময়? ও তো এমনিতেই এক্সামের আগে পড়ে না। আর এক্সাম এলে দিনরাত এক করে পড়ে। এক্সাম শেষ হলে আসবে।”
জারিনের মুখটা চুপসে গেল। এরেন তাকে সূক্ষ্ম চোখে নিরীক্ষণ করে প্রশ্ন করল,“কেন?”
জারিন সৌজন্যমূলক হাসি মুখে টেনে বলল,“এমনি। আগে তো সবসময় আসতো। অনেকদিন ধরে আসে না তাই জিজ্ঞেস করলাম।”
“সে তো সাকিবও আসে না। ওর কথা তো জিজ্ঞেস করলি না।”
“একজন এলেই তো আরেকজন আসে। তাই একজনের কথাই জিজ্ঞেস করেছি। সব কথা মেয়েদের মতো এত পেঁচাস কেন? ধুর!”
কথাটা বলে জারিন পায়ে শব্দ তুলে দ্রুত দরজার সামনে থেকে সরে গেল। এরেন কপাল ভাঁজ করে কিছুক্ষণ বোনের চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর টেবিলে বসে মাথা ঝাড়া দিয়ে ছোট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আপন মনে বিড়বিড় করল,“বাদ দে এরেন। এই মেয়ের মন বোঝা সত্যিই দুষ্কর। ওকে নিয়ে আকাশ-পাতাল ভেবে যেচে পাগল হওয়ার কোনো মানেই হয় না।”
•
বিছানায় পা ভাঁজ করে বসে হাতে ধরে রাখা বইয়ের পাতায় চোখ বুলিয়ে চলেছে ইলোরা। অদূরেই ডালিয়া পড়ার টেবিলে বসে মনোযোগ দিয়ে পড়ছে। তার পাশে মিথিলা হাতের আঙুলের ফাঁকে কলম নিয়ে খাতার দিকে একধ্যানে তাকিয়ে আছে। কিছু একটা লিখতে গিয়ে সে বেমালুম ভুলে বসে আছে। তাই লেখা বন্ধ করে খুব ঠান্ডা মাথায় পড়াটুকু মনে করার চেষ্টা করছে। হঠাৎ মিথিলার নজর চলে গেল পাশে পড়ে থাকা ডালিয়ার ফোনের উপর। দেখল ফোনটা নিঃশব্দে বেজে চলেছে। সাইলেন্ট মুডে থাকায় ডালিয়া শুনতে পাচ্ছে না। মিথিলা মাথাটা হালকা উঁচু করে ভালোভাবে তাকাতেই স্ক্রিনে ভেসে ওঠা নামটা দেখে ভ্রু কুঁচকে ফেলল। ডালিয়াকে ডেকে বলল,“আপ্পি তোমার ফোন বাজছে।”
ডালিয়া পড়া থামিয়ে ফোনের দিকে তাকাল। স্বাভাবিকভাবেই হাত বাড়িয়ে কলটা কেটে দিয়ে আবার পড়ায় মনোযোগ দিলো। পরক্ষণেই আবার ফোনটা বেজে উঠল। ডালিয়া তার দিকে তাকালই না। মিথিলা সন্দিহান কন্ঠে বলল,“প্রতিদিন এই একই ব্যাপার দেখতে দেখতে এখন তো আমার মনে প্রশ্ন জাগছে।”
মিথিলার কথায় ডালিয়া আর ইলোরা একসাথে তার দিকে তাকাল। ইলোরা প্রশ্ন করল,“কী ব্যাপার মিথি?”
মিথিলা টেবিল থেকে ডালিয়ার ফোনটা হাতে নিয়ে উঁচু করে ধরল। ইলোরা স্পষ্ট দৃষ্টিতে ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে ভ্রু বাঁকিয়ে ডালিয়ার মুখপানে তাকাল। ডালিয়া তৎক্ষণাৎ মিথিলার হাত থেকে ছোঁ মেরে ফোনটা কেড়ে নিল। সুইচ অফ করে ফোনটা তাড়াতাড়ি বইয়ের মধ্যে রেখে দিলো। ইলোরা প্রশ্নভরা দৃষ্টিতে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। মিথিলা ইলোরাকে লক্ষ্য করে ভ্রু উঁচিয়ে বলল,“কী আপ্পি? কিছু বুঝতে পারলে না তো?”
ইলোরা ডানে বামে মাথা দোলালো। মিথিলা চেয়ার ছেড়ে উঠে ইলোরার পাশে গিয়ে বসল। ইলোরা প্রশ্নভরা দৃষ্টিতে বোনের দিকে তাকাল। মিথিলা বলল,“গত কয়েকদিন ধরে প্রতিদিন সন্ধ্যায় ডালিয়া আপ্পির ফোনে একজন কল করে। কিন্তু আপ্পি একদিনও রিসিভ করে না। সেজন্য প্রতিদিন পড়তে বসলে ফোন সাইলেন্ট করে রাখে।”
ইলোরা অবাক হয়ে প্রশ্ন করল,“কে?”
মিথিলা বিছানা ছেড়ে আবার নিজের চেয়ারে বসে বলল,“তাহসিন ভাইয়া।”
নামটা শুনে ইলোরা সন্দিহান দৃষ্টিতে ডালিয়ার দিকে তাকাল। বিস্ময় নিয়ে বলল,“সত্যি না-কি ডালিয়া?”
ডালিয়া ইলোরার দিকে তাকিয়ে মুখ গোমড়া করে উপর নিচে মাথা দোলালো। ইলোরা বলে উঠল,“ওহ্ মাই গড! তার মানে আমাদের এতদিনের সন্দেহ সত্যি হয়েছে।”
ডালিয়া চোখ ছোটো ছোটো করে প্রশ্ন করল,“কী?”
“তাহসিন সত্যিই তোর প্রেমে পড়ে গেছে।”
ইলোরার কথায় ডালিয়া চোখ বড়ো বড়ো করে তাকাল। তারপর মাথা চুলকে গলা ঝেড়ে বলল,“ধুর, বাজে কথা কম বল।”
•
ক্যাম্পাসের একপাশে বন্ধুরা সবাই হাসি আড্ডায় মেতে উঠেছে। ঠিক সেই মুহূর্তে সেখান দিয়ে ইংরেজি স্যারকে যেতে দেখে সবাই হুড়মুড় করে উঠে দাঁড়িয়ে ভদ্রভাবে সালাম জানাল। স্যার সালামের জবাব দিয়ে হাসিমুখে বলল,“জমিয়ে আড্ডা বসেছে মনে হচ্ছে?”
জবাবে সবাই মুচকি হাসল। শুধু মুনার মুখটা চুপসে গেল। স্যার বললেন,“তোমাদের মতো আমিও এমন জমিয়ে আড্ডা দিতাম ফ্রেন্ডদের সাথে। এমনকি এখনও দেই। ফ্রেন্ডদের সাথে আড্ডা দেয়ার মজাই আলাদা। তোমাদের এই টিমটা কিন্তু আমার বেশ ভালো লাগে। অসাধারণ বন্ডিং তোমাদের সবার মাঝে। আশা করি সবসময় এমনই থাকবে।”
তাহসিন উৎসুক কন্ঠে বলল,“স্যার, আপনি না একদম অন্যরকম। মানে সবসময় কী সুন্দর ফ্রেন্ডলি কথা বলেন সবার সাথে! এটা সত্যিই খুব ভালো লাগে।”
স্যার মুচকি হেসে বললেন,“সবার সাথে কোথায়? সবাইকে তো চিনিই না। নতুন টিচার বিধায় আমাকেও সবাই চেনে না। তবে আমি যাদের চিনি তাদের সাথে একটু আধটু কথা হয়। স্যার বলে যে সবসময় মুখ গম্ভীর করে বসে থাকব, এসব কী ভালো লাগে? আমার তো ইচ্ছে করে সবার সাথে পরিচিত হতে। তোমাদের টিমটা আমার ভালো লাগে তাই দেখা হলেই গল্প করতে ইচ্ছে করে। কিন্তু গল্প করার মতো অত সময় হাতে থাকে না।”
নাদিয়া হাসিমুখে বলল,“স্যার, ক্লাসে আপনার লেকচার গুলো কিন্তু অসাধারণ হয়। কত সহজভাবে সবকিছু বুঝিয়ে দেন আপনি।”
“তাই না-কি? তবে কিছু কিছু স্টুডেন্ট কিন্তু মনে করে এসব স্যারদের মাথায় গন্ডগোল আছে। ক্লাসে ঢুকেই একাধারে বকবক শুরু করে দেয়, কিছুই মাথায় ঢোকে না।”
স্যারসহ সবাই হেসে উঠল। হঠাৎ স্যার ভ্রু উঁচিয়ে বলে উঠলেন,“সদা হাস্যোজ্জ্বল রমণীর মুখে আজ হাসির রেখা নেই কেন?”
স্যারের কথায় সবাই আড়চোখে মুনার দিকে তাকাল। মুনা থতমত খেয়ে গেল। রাগ চেপে জোরপূর্বক হেসে আমতা-আমতা করে বলল,“কই? না তো। এমনি চুপ করে আছি স্যার।”
স্যার অবাক হয়ে বললেন,“ওহ মাই গড! তুমি চুপ থাকতে পারো না-কি? ক্লাসে যে পরিমাণ ফিসফাস করো তাতে তো মনে হয় চুপ থাকাটা তোমার কর্ম নয়। সে যাই হোক, বাইরে যেমনই থাকো ক্লাসে ফিসফাস আর হাসাহাসি করাটা কমানোর চেষ্টা করো। ওকে? সারাজীবন তো ছোটো থাকবে না।”
ইলোরা বলে বসল,“স্যার, এতদিন আপনার নামটা জিজ্ঞেস করব করব করেও করা হয়নি। প্রথম দিন ক্লাসে বলেছিলেন কিন্তু মনে নেই।”
স্যার মুচকি হাসিটা দীর্ঘ করে বললেন,“আমার নাম আফসার চৌধুরী।”
টুম্পা হেসে বলল,“এবার মনে থাকবে।”
স্যার প্রশ্ন করলেন,“তোমাদের ক্লাস নেই এখন?”
অন্তর উত্তর দিলো,“না স্যার।”
স্যার হাসিমুখে বললেন,“আচ্ছা তাহলে তোমরা আড্ডা দাও। মাঝখানে এসে বিরক্ত করলাম।”
অরিশা বলল,“মাঝে মাঝে ইচ্ছে করেই এমন বিরক্ত করবেন স্যার। আমরা কিন্তু বিরক্ত হব না। বরং খুশি হব।”
স্যার এবার শব্দ করে হাসলেন। তারপর বললেন,“ওকে। আসছি এবার আমি।”
পরক্ষণেই মুনার গোমড়া মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন,“লাফিং কুইন মুখ গোমড়া করে থাকলে ভালো দেখায় না।”
কথাটা বলে স্যার আর এক মুহূর্তও দাঁড়ালেন না। ধীর পায়ে প্রস্থান করলেন। স্যার চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মুনা ফুঁসে উঠল,“শয়তান, বান্দর, পাজি স্যার একটা। মন চায় ছক্কা মাইরা ভার্সিটি থেকে বের করে দেই। ওহ্, তা তো সম্ভব না। গাছের সাথে মাথা ঠুকে স্মৃতিশক্তির চৌদ্দটা বাজাইতে মন চায়। যাতে আর কোনোদিনও আমার হাসি নিয়া খোঁটা না দিতে পারে।”
মুনার কথায় হো হো করে হেসে উঠল সবাই। মুনা চোখ পাকিয়ে সবার দিকে তাকাল। অন্তর হাসতে হাসতে বলল,“আররে মুলা, হুদাই এত রাগতাছোস ক্যান? আফু ষাঁড় তোর হাসির কত্ত খেয়াল রাখে দেখস না?”
অন্তরের কথায় সবাই হেসে উঠলেও কিছুটা অবাক হয়ে তাকাল। ডালিয়া চোখ পিটপিট করে প্রশ্ন করল,“আফু ষাঁড় মানে কী?”
অন্তর দাঁত কেলিয়ে হেসে বলল,“আফু ষাঁড়? দেটস মিন আফসার স্যার।”
অন্তরের কথা শুনে সবার চোয়াল ঝুলে পড়ার মতো অবস্থা হলো। কিছুক্ষণ সবাই চোখ বড়ো বড়ো করে অন্তরের দিকে তাকিয়ে থেকে পরক্ষণেই হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ল। ইলোরা বলল,“ওরে ভাই। আর কিছু খুঁইজা পাইলি না তুই? শেষ পর্যন্ত এমন ব্রিলিয়ান্ট একজন স্যাররে ষাঁড় বানিয়ে ফেললি।”
মুনা খুশিতে গদগদ হয়ে বেশ গাঢ় গলায় বলল,“আরে এই পাজি স্যারের জন্য এই নামই পারফেক্ট। অন্তু রেএএএএ, তোরে তো নোবেল দেওয়া উচিত।”
অন্তর সুযোগ পেয়ে বলল,“তো এইবার ট্রিট দে।”
মুনা অন্তরের বাহুতে জোরে এক থাপ্পড় মেরে বলল,“ওরে সুবিধাবাদী। নোবেল, ট্রিট কোনোটাই তুই পাবি না।”
অন্তর বাহু ঘষতে ঘষতে বিরক্ত হয়ে বলল,“হাত সামলা দজ্জাল মাইয়া। নইলে ওই আফু ষাঁড়ের গলায় ঝুলাইয়া দিমু।”
টুম্পা বলল,“ধুর! স্যররে নিয়া এমন মজা করা ঠিক হইতাছে না।”
তাহসিন টুম্পার মাথায় টোকা দিয়ে বলল,“ওরে আমাদের নম্র, ভদ্র টুম্পি রেএএএ।”
টুম্পা ভাব নিয়ে বলল,“আফসার স্যারের মতো।”
মুনা ভেংচি কেটে রাগত স্বরে বলল,“ওই পাজি স্যারকে ভদ্র বললে পৃথিবীতে আর সত্যিকারের ভদ্র মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না, বুঝলি? নইলে ভাব একটা মানুষ কতটা বিরক্তিকর হলে এক বিষয় নিয়ে বারবার খোঁচা মেরে কথা বলে। সেই যে একদিন ক্লাসে জোরে হেসে ফেলেছিলাম। সেজন্য যতদিন সামনে পড়ি ততদিন ঐ একটা কথা বলেই খোঁচা মারে। আস্ত শয়তান একটা।”
টুম্পা বিদ্রুপ করে বলল,“স্যারের আর কী দোষ মুনা? তুই তো প্রতিদিনই ক্লাসের মধ্যে হাসাহাসি করতেই থাকিস। স্যারের চোখে পড়ে তাই বলে।”
অরিশা ভ্রু নাচিয়ে বলল,“এই টুম্পা, তুই হঠাৎ স্যারের এত পক্ষ নিচ্ছিস যে? কাহিনি কী বেপি? বাতাসে কেমন যেন প্রেম প্রেম গন্ধ পাচ্ছি।”
টুম্পা বিরক্তি নিয়ে বলল,“ধুর, তা আর হলো কই? ধর্ম তো আলাদা। তবে এক ধর্মের হলে নিশ্চিত প্রেমে পড়ে যেতাম।”
টুম্পার হতাশ ভাব দেখে সবাই আরেকদফা অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। তবে সবার দমফাটা হাসির মাঝেই একজন টুম্পার হাস্যোজ্জ্বল মুখের দিকে তাকিয়ে শুধু একটু মলিন হাসল। না চাইতেও বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। তবে সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে সামলে সবার সাথে আড্ডায় মনোযোগ দিলো।
চলবে……………………🌸
(ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। ভুল চোখে পড়লে ধরিয়ে দিবেন প্লিজ।)