Story – আমার ভিনদেশি তারা
Writer – Nirjara Neera
পর্ব নং – ১৮
————————————————
বেশ কয়েকদিন চাকরির জন্য হন্য হয়ে ঘুরলাম উইনিপেগে। কিন্তু কানাডিয়ান ভাষা টা না জানায় বার বার রিজেক্ট হচ্ছিলাম। কয়েক জায়গায় তো ফরেনার বলে রিজেক্ট হলাম। অবশ্য ২/১ জায়গায় সুযোগ থাকলেও চেষ্টা করলাম না। কারন পরিবেশ টা ভালোই লাগলো না। হতাশ হয়ে যাচ্ছিলাম বার বার। রিচা আর লিও কয়েক বার জিজ্ঞেস করেছিল কিন্তু তাদের জবাব দিতে পারিনি। বুকের গভীরের দীর্ঘশ্বাস গুলো চক্রাকারে কমলা রঙের ম্যাপল পাতার ভিড়ে মিশে যাচ্ছিলো।
.
কাল রাতে প্রচন্ড বৃষ্টি হয়েছে। বৃষ্টি টা ভোরের দিকেই থেমেছে। তবুও দমকা দমকা বাতাস শিহরন জাগিয়ে তুলছে। বাইরে সবে মাত্র অন্ধকারের ঘন চাদর টা পাতলা হতে শুরু করেছে। এমন সময় ঘুম টা খুব আরামের হয়। পাশের বেডে ইভিলিন প্রচুন্ড জোরে জোরে নাক ডাকছে। স্কাই বেড ছেড়ে ফ্লোরে ঘুমাচ্ছে। হয়ত পড়ে গিয়েছে। এক ঘন্টা পর পর হোস্টেলের বড় দেয়াল ঘড়িটার ঢং ঢং ঘন্টা ধ্বনি শোনা যাচ্ছে। আমি কম্বল টা গায়ে ভালোভাবে জড়িয়ে জানালার দিকে ফিরতেই স্রষ্টার সৃষ্টির অদ্ভুদ সুন্দর একটা রূপ চোখে পড়লো। জানালার টা কাচের শার্সি টা নামানো ছিল। তাতে পর্দা ঝোলানো। পর্দা গুলোর হালকা নড়াচড়া তে বাইরের ধুসর মেঘ মিশ্রিত আকাশের আবছা আলোর ছিটকে আসছিল। সেই আবছা আলোতে দেখলাম অপার্থিব ফুলের রুপ! গ্রীন ক্যাকটাসের উপর ছোট শ্বেত শুভ্র ফুল! শিব লিঙ্গের মত দেখতে কাটাওয়ালা ক্যাকটাস যেটা জ্যাক আর জিল দিয়েছিল। সেই ক্যাকটাস টিতে একটা ফুল ফুটেছে। সদ্য প্রস্ফুটিত বুনো টগরের ন্যায় নরম সাদা ফুল। হালকা কাপুনি দিয়ে পাপড়ি গুলো নড়ে উঠছে। আহা! কি নেশা জাগানিয়া রুপ! মোহিত হয়ে তাকিয়ে ছিলাম কিছুক্ষন। হয়ত ক্যাকটাস টি মুনসুনের অপেক্ষায় ছিল এমন একটি লোভনীয় ফুল উপহার দেওয়ার জন্য।
ঘুমালাম না আর। সকালটা পার করে দিলাম ফুলটা দেখতে দেখতে। জ্যাক আর জিল কে বলতে হবে। তাদের দেয়া ক্যাকটাসে ফুল এসেছে। খুশি হবে তারা অনেক।
আজ সরকারি ছুটি কোন একটা দিবস উপলক্ষে। সকালের নাস্তা করে বাইরে বের হওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিলাম। উদ্দেশ্য জ্যাক আর জিলের কাছে যাওয়া। সী ব্লু রংয়ের টপস সাথে হোয়াইট স্কার্ফ পড়েছিলাম। ব্ল্যাক এক জোড়া সু আছে। যেটা বাংলাদেশ থেকে এনেছিলাম। তৈরি হয়ে বাইরে বেরুতে যাব এমন সময় খবর এল কয়েকজন নাকি আমার সাথে দেখা করতে এসেছে। কে হবে ভাবতে ভাবতে করিডোরে আসতেই ৭/৮ জন ছেলে মেয়ে আমাকে ঘিরে ধরলো। আমি চমকে গেলাম। এডালিন, রিচা, কার্ল, রাঘব, লিনা, এমিলি আরো কয়েক জন। সবাই দারুন চমৎকার সব পোশাক পড়া। যেন কোথাও বেড়াতে যাচ্ছে। কেন এসেছে এরা?
আমার হা করা বিস্মিত মুখ দেখে ওরা কতক্ষণ হাসাহাসি করলো। পরে জানতে পারলাম লিওর বার্থ ডে আজকে। সবাই ওদের বাড়িতে যাচ্ছে। আমি তো বেমালুম ভুলেই গিয়েছিলাম।
হৈ হৈ রৈ রৈ করে বেরুতে গিয়ে আমার গিফটের কথা মনে পড়লো। সবাই এত সুন্দর সুন্দর গিফট নিয়ে যাচ্ছে। আমি কি দিব? আমার কাছে তেমন ডলারও নেই। যে ভালো করে একটা গিফট দিব। যা আছে তা দিয়ে যদি টেনেটুনে দিয়ে দিই তাহলে আমি কিভাবে চলবো?
সবাই গিয়ে ততক্ষণ গাড়িতে উঠে গিয়েছে। আমি আবার রুমে চলে এসেছি। কি দিব কি দিব? তন্ন তন্ন করে নিজের সব কিছু ছড়িয়ে ফেলছি। দেওয়ার মত আমার কাছে কিছু আছে কিনা? নাহ! সব মেয়েলি সামগ্রী। লিও কে দেয়ার মত কিছুই নেই। ধপ করে বেডে বসে গেলাম। আমার দেরি দেখে রিচা উপরে উঠে এলো। সে এসেই আমাকে এক ডাক দিয়েই নিশ্চুপ হয়ে গেল। আমি মাথা নিচু করে ছিলাম। কিন্তু ওর সাড়া শব্দ হঠাৎ করে থেমে যাওয়ায় কৌতুহলী হয়ে মাথা তুললাম। দেখলাম রিচা আমার ক্যাকটাস টা হাতে নিয়ে হা করে ফুল টা দেখছে। চোখে মুখে তার বিস্ময় ঠিকরে পড়ছে।
“রিচা!”
“ওয়াও! আই এ্যাম স্পীচলেস টামিনা”
আমি একটু করে গলায় খাকড়ি দিলাম।
রিচা টব টা ধীরে ধীরে রেখে দিল। বিস্ময়ের ঘোর এখনো সে কেটে উঠতে পারেনি। কিন্তু আমার মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। রিচা কে উল্লেখ করে বললাম
“আচ্ছা রিচা এটা যদি লিও কে বার্থ ডে গিফট হিসেবে দিই, তাহলে কেমন হবে?”
“দারুন হবে টামিনা!”
খুশি হয়ে গেলাম। টব টা হাতে নিয়ে সবার সাথে বেড়িয়ে পড়লাম।
লিওর বাড়ি টা বেশ দূরেই। অভিজাত এলাকায়। বেশ খানিকটা সময় লাগল। লিওর বাড়িটা ভ্যানকুভার শহরের কাছাকাছি। তবে সেটা মূল শহরের মধ্যে পড়ে না। পথিমধ্যে বিশাল টিউলিপ বাগানের সাথে পরিচয় হয়েছিল। কানাডা টিউলিপের জন্য এমনিতেই বিখ্যাত। হরেক রকমের টিউলিপ দেখে আমাদের মাথা ঘুরানোর মতো অবস্থা।
দেখতে দেখতে বিশাল গেইটের কাছাকাছি এসে পৌছলাম। সবাই গাড়ি থেকে নেমে হুড়োহুড়ি করেই ভিতরে দৌড় মারলো। আমি আমার ক্যাকটাস টব টা হাতে নিয়ে সবার সাথে দৌড় দিব এমন সময় আমার স্কার্ফের কোনা গাড়ির আংটার সাথে আটকে গেল। বেশ কিছুক্ষন যুদ্ধের পর স্কার্ফ ছাড়াতে পারলাম। কিন্তু ততক্ষণ সবাই আমাকে ফেলে চলে গেছে। গেইটের ভিতর প্রবেশ করতেই আমার চোখ ছানাবড়া। আমি নিজেও অনেক বিলাসীতায় বড় হয়েছে। আমার নিজের বাড়িও অনেক বড়। অনেক ডুপ্লেক্স বাড়িও আমি দেখেছি। কিন্তু এ বাড়িটা অন্যরকম। বিশাল বড় ইয়ার্ড। সেখানে সবুজ ছাটা ঘাসের গালিচা পাতানো। ইয়ার্ডের এক কোনে সাড়ি সাড়ি ঝাউ গাছ। অপর পাশে রেইন ট্রি এর সমারোহ। সব কিছু একদম পারফেক্ট। যেন গাছ জন্মালেও সেটা অনুমতি নিয়ে আসছে। আমি হা করে তাকিয়ে ছিলাম। নিঃশ্বাস নেওয়ার কথাও ভুলে গিয়েছিলাম। এত সুন্দর সাজানো শৈল্পিক বাড়ি প্রথম বার দেখছিলাম। লিও রা এতটা ধনী হবে ভাবতেই পারি নি।
চোখ বড় বড় করে সব দেখতে দেখতে হেটে যাচ্ছিলাম। এত টাই মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম যে কেউ যে আমাকে ডাকছিল সেটা শুনতে পাই নি। হঠাৎ করে কেমন গর-গররররর শব্দ পেলাম। যেন কেউ রেগে ফোস ফোস করছে। আমি শব্দ বরাবর তাকাতেই আমার গলা শুকিয়ে এলো। বেঙ্গল টাইগারের মত দেখতে গলায় স্টিলের বেল্ট লাগানো একটা কুকুর আমার মাত্র কয়েক মিটার দুরত্বে দাড়িয়ে আছে। কুচকুচে কালো লোমশ কুকুরটি সামনের দু পা ফাক করে কান দুটো খাড়া করে গর গর শব্দে যেন আমাকে বলছে
“তোর তো সাহস কম নয়, আমার এরিয়া তে ঢুকেছিস! দাড়া তোর হাড্ডি আর মাংস যদি আমি আলাদা না করি তাহলে আমি নাইজেরিয়ান কুত্তা না!”
আমি ঢোক গিলে এক পা পিছু হটলাম। ছোট বেলায় এক বার পাগলা কুকুরের কামড় খেয়ে ১৪ টা ইনজেকশন মারতে হয়েছিল। সেই থেকে কুকুর প্রাণী টাকে আমি বাঘের মত ভয় পাই। আর এত বড় কুকুর তো আমি জীবনেও দেখি নি। কেমন শয়তানের মত বড় বড় আগুন ঝরা চোখে তাকিয়ে আছে যেন আমাকে এখনি ছিড়ে ফেলবে।
কুকুর টার ভাব গতি মোটেও ভালো লাগছেনা। কেমন গো গো শব্দ করছে। কুকুর ভয় পেতাম বলে আমার দাদী একটা মন্ত্র শিখিয়ে ছিল। মন্ত্র টা ছিল ঠিক এ রকম
আমাল জামাল কুত্তার দাত সামাল
ইল বিল কুত্তার দাত খিল
.
মনে মনে মন্ত্র টা জপ করছি। কিন্তু কোনো লাভ হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না। তাই কোনো কিছু চিন্তা ভাবনা না করে একটা ভৌ দৌড় দিলাম। দৌড়াতে দৌড়াতে পিছনে খেয়াল করলাম। দেখলাম কুকুরটা অলিম্পিক গতিতে আমার পিছু দৌড়াচ্ছে। ইয়া আল্লাহ!!
জোরে শোরে মন্ত্র জপছি
“আমাল জামালা কুত্তার দাঁত সামাল”
“ইল বিল কুত্তার দাঁত খিল”
জপছি আর উর্দ্ধশ্বাসে দৌড়াচ্ছি। চিৎকার করতে করতে কোন দিকে দৌড়াচ্ছি জানি না। এক সময় পিছু তাকাতে তাকাতে কারো সাথে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যেতে লাগলাম। আমার হাতে ক্যাকটাস থাকায় ঝাপটিয়ে ধরার সুযোগ টা পেলাম না। কিন্তু মানুষ টি আমাকে ধরে ফেলল। আতঙ্কিত অবস্থায় আমি সেই মানু্ষ টার বুকে চেপে গেলাম। এবং তাকে বলতে শুনলাম
“হেই শাকিরা… স্টপ! শী ইজ আওয়ার গেস্ট। ইয়ু হ্যাভ টু এপোলোজাইস! কাম অন গার্ল!”
আমি জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে আরো সেটে গেলাম সেই মানু্ষ টার সাথে। এবং সেও এক হাতে শক্ত করে চেপে ধরলো।
.
(চলবে)
.
Today I am so happy ♥ Can you guess what for 😉