বিধবা_বিবাহ পর্ব-৩১ শেষ পর্ব

0
3520

#বিধবা_বিবাহ (অন্তিম তথা দ্বাত্রিংশ পর্ব)
আয়নার নিজের চেহারাটা দেখে চমকে উঠল অতনু। এই কয়দিনেই চোখমুখে অবসাদের ছাপ পড়ে গিয়েছে। ভাসা ভাসা দুই চোখের তলায় পড়েছে রাত্রি জাগরণের চিহ্ন। ভরপেট খেয়ে থাকলেও প্রতিবিম্বে ফুটে ওঠা মানুষটাকে দুর্বল মনে হচ্ছে রীতিমত।
“এই চেহারা নিয়ে বিয়ে করতে যাবো!” থানায় থাকাকালীন ঐশির কথাগুলো মনে পড়লেও চাপা পড়ে গেলো সাফল্যের ইমারতে। একজন পুলিশ অফিসার হিসেবে অরিন্দমকে অপরাধী প্রমাণের কারণে মনটা খুশিতে ভরে উঠতে চাইলেও কোথাও যেন আটকে যাচ্ছিল অতনু। প্রতিবিম্বকে সঙ্গী করে দাঁড়ি কাটার চেষ্টা করলেও বারবার মনটা চলে যাচ্ছিল অরিন্দমের মার্কশিটের দিকে। স্টাডি ব্যাকআপ ছাড়াই কোন মানুষ যে এতটা ভালো ফল করতে পারে, সেটা অজানাই ছিল অতনুর কাছে। ইনবর্ন ট্যালেন্ট বোধহয় এটাকেই বলে।
“কিন্তু ছেলেটা যে ইনবর্ন ক্রিমিনাল নয়!” মনের মধ্যে ঘুরতে থাকা চিন্তাটা পাশে বসে থাকা মায়ের কাছে প্রকাশ করেই ফেলল অতনু। বস্তুত, নিজের ব্যক্তিগত এবং কর্মরত জীবন আলাদা করে রাখার অভ্যাস থাকলেও এত সেনসিটিভ কেস মায়ের কাছে লুকোতে পারেনি সে। অরিন্দমের মনে জেগে থাকা সিবলিং রাইভ্যালরি, অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিজঅর্ডার সবকিছুই খুলে বলেছে মাকে, বুঝিয়ে দিয়েছে খটোমটো
শব্দগুলি। কিন্তু এত জটিল কেস সলভ করেও শান্তি আসছে না যে, কোথায় যেন বিঁধছে ক্রমাগত…

“পরিস্থিতি ছেলেটাকে অপরাধী বানিয়েছে বাবা। পরিস্থিতিই ওকে সবকিছু ফিরিয়ে দেবে।” ছেলের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলে উঠলেন অতনুর মা। তারও খারাপ লাগছিল এত সম্ভাবনাময় একটা ছেলের এরূপ করুণ পরিণতি। পরিবার নামক সংস্থা যে একটা মানুষের উত্তরণ, অবতরণের কান্ডারী হয়ে উঠতে পারে, একজন মা হওয়ার সুবাদে তিনি বুঝতে পারেন। প্রাচুর্যের মধ্যে থাকলেও ভালোবাসা, মনোযোগের অভাবে বেশিরভাগ মানুষই হীনমন্যতার মধ্যে ডুবে পড়ে। ফলস্বরূপ অবসাদ এবং অপরাধ।

“অন্যায় করেছে, শাস্তি তো হবেই। কিন্তু দেখিস বাবা, ছেলেটা যেন সমাজের মূল স্রোতে ফিরে যেতে পারে। থেকেও না থাকা সম্পর্কগুলো যেন সারিয়ে তুলতে পারে ওকে।” মায়ের কথা শুনে ঘাড়টা একদিকে এলিয়ে দিল অতনু। মনে পড়ে যাচ্ছে, থানা থেকে বেরোবার ঠিক আগের মুহূর্তে আসা অরিন্দমের মায়ের ফোনকল। ছেলের জামিনের জন্য প্রাণপণে চেষ্টা করছেন তিনি। অতীতে করা ভুলের মাশুল হয়তো এভাবেই চুকিয়ে ফেলতে চাইছেন তিনি, বিবেকের তাড়নাতে।
“ঐশী অরিন্দমকে বই উপহার দিতে চেয়েছে। কাউন্সেলিং চলার সাথে সাথে রেগুলার স্টাডি হেল্প করবে ওকে। ছেলেটা পড়তে ভালবাসত।” রেজারটা নিজের দিকে টেনে নিতে নিতে বলে উঠলো অতনু।
“বউমা বই উপহার দিতে চেয়েছে! বাহ..” ঐশির এহেন পদক্ষেপে মনটা ভারী হালকা হয়ে গেল তার। বাসন্তীলতা ভাগ্যিস বিয়ের কথাটা পেড়েছিলো। মেয়েটাকে তার প্রথম থেকেই বড্ডো পছন্দ ছিল। ইচ্ছে ছিলো অতনু স্বনির্ভর হওয়ার পর সইকে নিজের মনের কথা জানাবেন। কিন্তু হঠাৎই পরিবারের অমতে গিয়ে ঐশী বিয়ে করে নেওয়ায় সব পরিকল্পনা ভেস্তে গিয়েছিলো। মেয়েটার প্রতি জেগে থাকা ভালোবাসা না কমলেও অন্যান্য সকলের মত তিনিও ধাক্কা খেয়েছিলেন। কিন্তু পরে ঐশী বিধবা হয়ে বাড়ি ফিরে আসার কারণে ভালোবাসার সাথে বাড়তি উপাচার হিসেবে যুক্ত হয়েছিল মায়া..
একজন বিধবাই হয়তো অন্য বিধবার মনের কষ্ট, অনুভূতি বুঝতে পারে। অতনুর মাও তার ব্যতিক্রম ছিলেননা মোটেই। তাই বাসন্তীলতাদেবী প্রস্তাবটা দেওয়ার পর দুমুহূর্ত ভাবেননি তিনি। পুরনো স্মৃতি ভুলে গিয়ে আপন করে নিতে চেয়েছিলেন তাকে। দুর্ঘটনা সবার জীবনেই আসে…কারোর জীবনে,কারোর বা রাস্তাঘাটে।
যদিও তার এরূপ পদক্ষেপে সমালোচনার ঝড় ধেয়ে এসেছিল, তথাকথিত শুভাকাঙ্খীরা বিধবাকে বিয়ে করার কুফল সম্বন্ধে নানারকম ব্যতিক্রমী ঘটনাকে উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরছিল নিজের সাধ্যমতো। কিন্তু অতনুর মা তাদের কথাতে যে কান দেননি, তা বলাই বাহুল্য।

“ঐশী স্কুল-কলেজের সময় থেকে সহপাঠী অরিন্দমকে চেনে। ভালোমত জানে ওকে হ্যান্ডেল করার উপায়গুলো। তাই বই দেওয়ার আইডিয়াটা আমার বেশ লেগেছে।” অমসৃণ গালে ফোম মাখাতে মাখাতে বলে উঠলো অতনু।
“তুই দাড়ি কেটে নে.. আমি গোছগাছ সেরে আসছি।” একজন আত্মীয়ার ইশারায় অতনুর মা উঠে গেলেন। অনেক কাজ পড়ে আছে। রাত পোহালেই বিয়ে। কাল ভোরে উঠতে হবে। অশক্ত শরীরটা নিয়েও তিনি তদারকি করছেন কাজে। একমাত্র ছেলের বিয়ে বলে কথা!
“যাও।” খানিক অন্যমনস্ক হতেই ব্লেডের কারিকুরিতে ফোম মাখা গালটা খানিক কেটে গেলো।
“আহ্!” ব্যথার প্রকাশটা বাইরে বেরিয়ে আসতে চাইলেও চুপচাপ গিলে নিলো অতনু। হঠাৎই
বুকের বাঁদিকে নিঃশব্দে কাটতে থাকা ঘুণপোকাটা অজানা কারণে সক্রিয় হয়ে উঠলো। অবচেতন মনটা বলে উঠলো না জানি কতশত এমন আঘাতে কেটে গিয়েছে অরিন্দমের মন। শরীরের ক্ষত দেখা গেলেও মনের ক্ষত দেখা যায় না যে…কিন্তু দুটোক্ষেত্রেই ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাওয়া মানুষটা জ্বালা যন্ত্রণা সহ্য করে নিশ্চুপে। যারা সহ্য করতে পারেনা, তারাই রয়ে যায় ডায়রির পাতাতে, কেউ বা কারাগারের পিছনে..

চঞ্চল মনটাকে শান্ত করার চেষ্টায় অতনু কানেক্ট করল ঐশীকে। এই মানুষটার সাথে কথা বললেই জমে থাকা অবসাদ দূর হয়ে যায় তার।
“হ্যাঁ বলো..” বার দুই রিং বাজার পর ঐশী রিসিভ করে বলে উঠলো।
“মনটা ভারী অস্থির লাগছিল। তাই ফোন করেছিলাম।” স্বভাবজাত খোলামনে বলে উঠল অতনু,”কি করছো? তোমার সময় থাকলে একটু গল্প করতাম…”
“অস্থির লাগছে কেন?” ওপ্রান্তে বলে ওঠে ঐশী। “এইমাত্র দাদার সাথে এগ্রিমেন্টে সাইন করে নিলাম। টোটাল ত্রিশ লাখ। দাদা জানতে চাইছিল প্রজেক্টটা কবে থেকে শুরু হবে..”
“বিয়েটা হয়ে যাক। সবার সাথে কথা বলিয়ে দেব তোমার দাদাকে।” কেটে যাওয়া গালে ওষুধ লাগাতে লাগাতে বলে উঠল অতনু।”একটা কথা না বলে পারছি না, এগ্রিমেন্টে সাইন করে নিয়ে ভালোই করেছো।”
“আসলে করাতে চাইতাম না। কিন্তু দাদার ওরকম রূপ দেখার পর রিস্ক নিতে চাইনি আর। টাকাটা যে আমারও প্রয়োজন।” অতনুর মুখের কথাটা কেড়ে নিয়ে বলে উঠল ঐশী। তারপর দু মুহূর্ত চুপ থেকে ফের বলে উঠলো,”অস্থির লাগছে কেন বললে না তো?”
“অরিন্দমের কথা ভেবে খারাপ লাগছে মনটা.. এত ব্রিলিয়ান্ট ছেলে।”থেমে থেমে বলে উঠলো অতনু। ইদানিং ঐশীর ছোঁয়া লেগে ওর মনটাও বড্ড বেশি আবেগপ্রবণ হয়ে উঠছে।
“তুমি শুধু অরিন্দমের কথাই ভাবছ অতনু। ওর বিবাহিতা স্ত্রীয়ের কথা তো একবারও বললে না..” কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর ঐশী বলে উঠলো। ওর মনে পড়ে যাচ্ছিল ওবাড়িতে থাকার সময় অরিন্দমের বউ কিভাবে দিনের পর দিন জবুথবু ভাবে দিন কাটাতো। মুখ ফুটে কোনদিন মনের ভুলেও কাউকে বলতে যায়নি দাম্পত্যের ওঠানামাকে। নারীর স্বভাবজাত সহ্যগুনে হজম করে নিয়েছিলো স্বামীর সকল অবহেলা, বিতৃষ্ণাকে।
খাবার টেবিলে কোনদিন স্বামী-স্ত্রীকে কথা বলতে দেখিনি ঐশী। ভেবেছিল নারীর সহজাত লজ্জায় জড়িয়ে থাকা মেয়েটি হয়তো একটু মুখচোরা। কিন্তু মাসের পর মাস কেটে গেলেও দাম্পত্যের স্বাভাবিক ছন্দ চোখে পড়েনি তাদের মধ্যে। কিন্তু প্রাকৃতিক নিয়মে এসে গিয়েছিল সন্তান।
দিনকয়েক আগেই ওবাড়ি থেকে আসবাব আনার সময় চোখ গিয়েছিলো রোগাপাতলা মেয়েটির শরীরের দিকে। মাতৃত্বের আগমনবশত উত্থিত পেটটা সকল প্রশ্নের জবাব দিয়ে দিয়েছিলো ঐশিকে। বুঝে গিয়েছিলো নিজের প্রাক্তন জা গর্ভবতী। যদিও অরিন্দম এহেন সুসংবাদ জেনে যে মোটেই খুশি হয়নি তা বলাই বাহুল্য। হয়তো ঐশীর বাবার মত অরিন্দমও চেয়েছিল দায়িত্ব-কর্তব্যের বেড়াজাল থেকে মুক্তি পেতে। থানায় দেখা করার সময় ঐশীকে ফের নিজের মনের কথা জানানোই এর সুস্পষ্ট প্রমাণ।

“বিয়েটা কোন ছেলেখেলা ব্যাপার নয় অতনু। অরিন্দম আমাকে না পেলেও, যা পেয়েছে সেটা নিয়ে খুশি থাকা উচিত। মুভ অন বলেও একটা শব্দ থাকে ডিকশনারিতে। আই থিঙ্ক সেটা ও ভুলে গিয়েছিল…”কেটে কেটে বলে ওঠে ঐশী।
“তুমি এত হাইপার হচ্ছো কেন।” খানিক অবাক হয়ে বলে উঠল অতনু।”ছেলেটা তো আলটিমেটলি..”
“স্ত্রীকে বাধা দেয়নি, তাই তো?”অতনুর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলে উঠল ঐশী। “বাধা না দিলেও প্রাকৃতিক নিয়মে বাবা হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করতে বসেছে সে। আপত্তি না জানালেও আবেগটুকু জানার চেষ্টা করেনি। হয়তো স্ত্রীর মধ্যে আমাকে কল্পনা করে মিলনে লিপ্ত হয়েছে। কিন্তু বুঝতে পারেনি তার স্ত্রীয়ের উপর এই ঘটনার কি প্রভাব পড়তে পারে। মিলনশেষেও কিন্তু স্ত্রীরা বুঝে যায় কাম এবং অনুরাগের মধ্যে পার্থক্য! এটা তো মেয়েটার প্রতি অবিচার, তাই নয় কি?” একটা মেয়ে হয়ে অন্য মেয়ের কষ্টটা ধরা পড়ে গিয়েছে ঐশির কাছে,”আমি যতদিন ওই বাড়ি ছিলাম.. কোনদিন মুখ ফুটে মেয়েটাকে কিছু চাইতে দেখিনি। সংসারের সব কাজ করে চলত বিনা বাক্যব্যয়ে। মানছি এসব করে ভালোবাসা পাওয়া যায় না। কিন্তু অরিন্দম তো ডিভোর্স দিতে পারতো! এটা তো একপ্রকার ঝুলিয়ে রাখা। ঠিক যেমনটা আমার বাবা নিজের স্ত্রীকে ঝুলিয়ে রেখেছিল। ভাল না বাসলেও সংসারের স্বাভাবিক নিয়মে দুইজন ছেলেমেয়ের জন্ম দিয়েছিল!” কঠোর বাস্তবতা বেরিয়ে এলো ঐশির মুখ থেকে। খানিকক্ষণ থেমে ফের বলে উঠল সে,”মানছি তখনকার দিনে একটা মেয়ের কাছে সংসার স্বামী ম্যাটার করতো। কিন্তু এখন সেইদিন নেই। ডিভোর্স এখন এক্সেপ্টেবল ম্যাটার। ফিলিং লেস ভালোবাসা বয়ে কি লাভ। দুজনেরই কষ্ট!”

ঐশীর কথা শুনে অতনু নিশ্চুপ। বোধহয় মেপে নিতে চাইছিল ঐশীর মানসিক উত্তরণকে। কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে আসা এক পরিণত নারীকে…
“আদতে কি জানো অতনু আমাদের প্রত্যেকের জীবনই একেকটা উপন্যাস। কোথাও ভাঙে, কোথাও গড়ে। সবকিছু মিলিয়ে মিশিয়ে জীবন।” ভাবি স্বামীকে নিশ্চুপ দেখে বলে উঠলো ঐশী,”অরিন্দম শিক্ষিত, তাই ওর কাছ থেকে আমি এরকম চাইল্ডিস বিহেভিয়ার এক্সপেক্ট করিনি। তাই স্পষ্ট ভাষায় বলে দিয়েছি কলেজের ভালোবাসার খাতিরে ফুটফুটে মেয়েটাকে যেন হাতছাড়া না করে। একজনের কাছ থেকে কষ্ট পেলে কী অন্য আরেকজনকে সেই কষ্টটা দিয়ে দিতে হবে?” প্রশ্ন করে ওঠে ঐশী। “এরকম করতে থাকলে অন্যকে কষ্ট দেওয়াটা অভ্যাস হয়ে যাবে যে! লাইক এ চেইন সিস্টেম।”

“কিন্তু তুমি অরিন্দমের সাথে নিজের বাবাকে এক মাপকাঠিতে মেপে নিচ্ছ কেন?” মনমধ্যে ঘুরতে থাকা কথাটা অবশেষে বেরিয়ে আসলো অতনুর মুখ থেকে। “তোমার বাবা সংসারের কোনরকম খরচাপাতি দিতনা, ভরণপোষণ ভুলে অন্য সংসার পেতেছিল সে। কিন্তু অরিন্দম…”
“অরিন্দমের স্ত্রী স্বাবলম্বী, সুন্দরী। স্কুলে পড়ায়। তোমার কি মনে হয় স্বামীর কাছে ভরণপোষণের আশায় মেয়েটা এতদিন ছিল স্বামীর সাথে?” পাল্টা প্রশ্ন করে ওঠে ঐশী। “অরিন্দম জীবনে অনেক ত্যাগ করেছে। কিন্তু যেচে আসা সম্পদকে পায়ে ঠেলে ফেলা ত্যাগের মধ্যে পড়ে না। অরিন্দম এতদিন হাতে হেরিকেন ধরে রেখে আলোর সন্ধানে যাত্রা করেছে। আলেয়ার পিছনে ছুটে মরেছে!”
প্রত্যুত্তরে অতনু চুপ থাকলেও ঐশীর যুক্তির প্রতিটি পংক্তি গেঁথে গিয়েছে তার মস্তিষ্কমধ্যে। ওপ্রান্তে থাকা মেয়েটি বয়সে তার থেকে ছোট হলেও পরিস্থিতি তাকে পরিণত বানিয়ে দিয়েছে। ওকে নিশ্চুপ দেখে ফের বলে উঠল ঐশী,”আমি জানিনা তোমার মনের মধ্যে কি চলছে। কিন্তু এইটুকু রিকোয়েস্ট করব অরিন্দমের স্ত্রীর কথাটা একটু ভেবে দেখো। ভাবতে পারো অনধিকার চর্চা করছি, কিন্তু কখনই চাইনা আমার মায়ের মত পরিণত হোক ওর। যে কিনা স্বামীর ভালোবাসা হারিয়ে জপ ধ্যান, সামাজিক কুসংস্কারগুলোকে আঁকড়ে বাঁচতে চাইবে!”
“বুঝেছি..”অস্ফুটে বলে উঠলো অতনু। “আই থিঙ্ক, এই কথাগুলো অরিন্দম বুঝবে।”
“হোপ সো..রাখি। কাল দেখা হবে.. গুডনাইট।” কলটা ডিসকানেক্ট করে দিলো ঐশী।

“বোন, সব গোছগাছ কমপ্লিট?” ঐশী লাইনটা ডিসকানেক্ট করার সাথে সাথেই কৃষানু ঢুকলো সেই ঘরে। কিছুক্ষণ আগেই লাবনীর সাথে কথা হয়েছে তার। কৃশানুর অপরাগতার কারণে ডিভোর্স লেটার পাঠিয়েছে সে। যদিও মনে মনে প্ৰস্তুত ছিলো কৃশানু। কিন্তু সময়টা যে এত তাড়াতাড়ি কেটে যাবে, তা ভাবতে পারেনি সে। বিয়ে ভাঙ্গার কারণে মনটা ততটাও খারাপ নেই তার, বরঞ্চ ভালো লাগছে দুই ছেলেমেয়ের কাস্টডি পাবে বলে। লাবনী জানিয়েই দিয়েছে নতুন ভাবে জীবন শুরুর কারণে বাড়তি বোঝা টানতে চায়না সে। অতি উচ্চাকাঙ্ক্ষী এই মহিলাটির মনের অলিগলি আজও হদিস পায়না কৃশানু। একজন মা হয়ে লাবনীর এহেন পদক্ষেপে মানুষটা তার কাছে দুর্বোধ্য হয়ে গেল আরো। উচ্চবিত্ত পরিবারের এই মেয়েটি ফের বিয়ের পরিকল্পনা করছে। ইনফ্যাক্ট, পাত্র দেখাও হয়ে গিয়েছে তার। স্ত্রীর প্রোফাইল থেকে সর্বত্র ব্লকড থাকলেও এইসব মুখরোচক খবর ভেসে আসে হাওয়ার গতিতে।
“কোনদিনই লাবনী আমাকে ভালবাসেনি। ব্যবহার করতে চেয়েছে আমার সম্পর্ককে, সম্পদকে।” বাস্তব ভাবনাটা মাথায় আসার পরই কৃষানু ছুটে এসেছে নিজের বোনের কাছে। অবুঝ মনটা চাইছে সময়টাকে পিছিয়ে সেই সময় নিয়ে আসতে, যখন একজন বৌমা বাড়ির মেয়েকে অধিকারনামা বুঝিয়ে দিচ্ছে কড়ায়-গণ্ডায়, জানান দিচ্ছে বিধবা হয়ে ফিরে আসার কারণে বাড়ির চৌকাঠ অনেক উঁচু হয়ে গিয়েছে ঐশির জন্য। সেই মুহূর্তগুলোর কথা মনে করে একজন দাদা বর্তমান সময়ে উপলব্ধি করছে বোনের মনে জেগে থাকা দগদগে ঘাগুলোকে। আদতে, নিজে আঘাত না খেলে অন্যের আঘাত বোঝা যায় না যে!

“বস দাদা।” বিছানার একপাশে সরে গিয়ে ঐশী বসার জায়গা করে দিতেই পিঠোপিঠি বোনের মুখের দিকে নজর পড়লো কৃশানুর। সাথে সাথেই এক অব্যক্ত যন্ত্রণায় বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো ওর। ভাবতেই কষ্ট হচ্ছে মাত্র চব্বিশ ঘণ্টা পরেও মেয়েটা এই বাড়িতে থাকবেনা আর।
“গোটা একটা বছর বোনকে ফিরে পেয়েও হেলায় দূরে সরিয়ে দিয়েছিলাম ওকে। আজ বিদায়ক্ষণে সে মনটা আফসোসে ভরে উঠছে কেন..” নিজেকেই প্রশ্ন করে উঠলো কৃশানু। উত্তর পেলনা সে।
“একি দাদা! তুই কাঁদছিস!” উল্টোদিকে বসে থাকা পূর্ণবয়স্ক মানুষটির দুচোখে জল দেখে প্রশ্ন করে উঠলো ঐশী। আচমকাই মাথাটা তালগোল পাকিয়ে গেল ওর.. বোধহয় বুঝে নিতে চাইছে একজন পুরুষমানুষের চোখ বেয়ে নেমে আসা জলধরার কারণকে।
“তবে কি ডিভোর্সটা হইয়েই যাবে।” দাদার মনখারাপি ভাবনার কারণ হাতড়াতে হাতড়াতে আপনমনেই বলে উঠে ঐশী। তারপর অস্বস্তিটা দূর করতে মনের ভাবনা বলেই ফেলে সে,”টিয়া, তুতুন কবে আসবে? বৌদির সাথে কথা হয়েছে।”
বোনের মুখে ট্যাঁরাব্যাঁকা প্রশ্নটা শুনে খানিকক্ষণ চুপ করে থাকলো কৃষানু। পরিণত মনটা ততক্ষণে বুঝে গিয়েছে নিজের বোন সরাসরি জিজ্ঞেস করার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলেছে। পরিস্থিতি মানুষকে যে কতটা দূরে ঠেলে দিতে পারে, এই ঘটনাই তার সুস্পষ্ট প্রমাণ।
“লাবনী নোটিশ পাঠিয়েছে। মিউচুয়ালি ডিভোর্সটা হয়ে যাওয়ার আগেই ছেলেমেয়েকে এই বাড়ি পাঠিয়ে দেবে বলেছে। নতুন করে বিয়েতে বসার তোড়জোড়ও চলছে জোরকদমে।” হাসিমুখে বলে উঠলো কৃশানু। বস্তুত, লাবনীর প্রতি বিন্দুমাত্র নির্ভরশীলতা অবশিষ্ট নেই আর। পরিণত মনটা বুঝে গিয়েছে মানুষটা কোনদিন তার ছিলই না। কিন্তু আগামীকাল বোনের বিয়ে জেনেও বারবার কেন আটকে রাখতে চাইছে ওকে.. কেন ছেলেবেলা কৃষানুটা ফিরে পেতে চাইছে নিজের শৈশবকে। যখন মায়ের বকাবকি, তিরস্কার বর্ষণে ছোটবোনকে ঢালের মতো রক্ষা করতো কৃষানু।
“ভালো থাকিস বোন। টিয়া, তুতুন তোর অপেক্ষায় থাকবে।” ভাঙা গলায় উপচে পড়া চোখের জলটা সামলিয়ে তড়িঘড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে গেল কৃশানু। সেই অভিব্যক্তি দেখে ঐশী দাদার মনখারাপের কারণটা বুঝে ফেলেছে ততক্ষণে। বড্ড ইচ্ছে করছে সময়গুলো ফিরে পেতে। ইচ্ছে করছে এই বাড়িটা অক্ষত থাকুক। কিন্তু, দুই ছেলে-মেয়ের ভার বহনকারী এক বাবার পক্ষে সম্ভব হবেনা নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ করা। সাথে এজেন্সিটা শুরু করার জন্য প্রভূত অর্থের প্রয়োজন মিটাবে এই বাড়িখানাই।
“হলদে পাতা না ঝরলে কচি পাতা জন্মাবে কি করে…” অস্ফুটে বলে উঠলো ঐশী।

—++—

কারাগারের একপ্রান্তে চুপচাপ বসে আছে অরিন্দম। কিছুক্ষণ আগেই মা, বউ দেখা করে গিয়েছে তার সাথে। দুজনের ফোলা চোখ, লালচে নাক জানান দিচ্ছে পরিবারের সদস্যের এরূপ করুন দশাতে অসমবয়সী দুইজনেই শোকগ্রস্ত। কারাগারে থাকা ছোটসন্তানের কষ্ট দেখে এই প্রথম হয়তো অরিন্দমের মা নিজের চোখের জল ফেলেছিলেন। কুকীর্তিতেও মায়ের চোখের জল আসার কারণ বুঝতে পারেনি অরিন্দম। ভেবেছিলো অন্যান্যবারের মতো মা বোধহয় এবারেও দূরে ঠেলে দেবেন তাকে। কিন্তু এহেন উলোটপুরাণে প্রশ্নচিহ্ন জমা হওয়ার স্বাভাবিক বৈকি। “তবে কি মাকে কেউ বলেছে, নাকি বুঝিয়েছে…”আপনমনে বলে উঠল অরিন্দম। কারাগারে থাকা বদ্ধ প্রাণীটি জানেনা ইনভেস্টিগেটর ইনচার্জ পদে থাকা নিজের রাইভ্যাল, অতনুই অরিন্দমের মাকে সব জানিয়েছে। অপরিণতমনস্কতার কারণে এটাও বুঝতে পারেনি দাদাকে হারিয়ে মায়ের জীবনের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়ে গিয়েছে শুধুমাত্র দুইজন, অরিন্দম আর তার স্ত্রী…
কিন্তু, আশ্চর্যের ব্যাপার আজ মায়ের চোখের জলটা অতটাও মনের গভীরের দাগ কাটেনি অরিন্দমের, যতটা কেটেছে নিজের স্ত্রীয়ের চোখের জল। মনে পড়ে যাচ্ছিল ঐশীর বলে ওঠা কথাগুলো। ভালো থাকার জলজ্যান্ত চাবিকাঠিটা এতদিন অবহেলা করে এসেছি সে…
“প্রত্যেকের জীবনেই ভালোবাসার মানুষ থাকে। দৃষ্টির অভাবে অনেক সময় অবহেলা করে ফেলে মানুষ। আলেয়ার পিছনে ঘুরতে থাকে উদভ্রান্তের মত।”অস্ফুটে বলে ওঠে অরিন্দম,”যার যেটা আছে, সেটা নিয়ে খুশি থাকা উচিত…”
“পোয়াতি থাকা অবস্থাতেও মেয়েটা নিজের অপরাধী স্বামীকে দেখতে এসেছে!” বিস্ময়টা যেন কাটতে চাইছে না এখনো। দিনের পর দিন যাকে অবহেলা ভরে দূরে সরিয়ে দিয়েছে, একবিছানায় রমণের পর সামান্য খোঁজখবরটুকু নেওয়ার চেষ্টা করেনি, সেই মানুষটাই নিজের স্বামীর বিপদ দেখে ছুটে এসেছে।
“এর নামই কি ভালোবাসা..”উত্তরটা হাতড়াতে লাগলো অরিন্দম। মনে পড়ে যাচ্ছে, ঐশির বলে ওঠা কথাগুলো,”তুই আমার জীবনের ইনফ্যাচুয়েশন ছিলিস। বয়সের ওঠানামার কারণে স্রেফ পছন্দ করতাম তোকে, হয়তো তোর দাদাকেও। কিন্তু আমি তোকে ভালোবাসিনা অরিন্দম। আমার চাওয়া-পাওয়ার সাথে তোর স্বভাবের মিল খুজে পাই না আমি, যেটা পাই অতনুর কাছ থেকে।”
উত্তপ্ত, জ্বলন্ত সিসার মতো কথাগুলো ওকে আঘাত দিলেও বিন্দুমাত্র প্রতিবাদের শক্তি জাগেনি সেদিন। বড্ড সস্তা মনে হচ্ছিল নিজের আবেগকে। একতরফা, মূল্যহীন… ঠিক যেমনটা নিজের স্ত্রীয়ের দায়িত্ব কর্তব্যগুলোকে নেহাতই খেলো মনে করত অরিন্দম। ভাবত সুশিক্ষিত হলেও মেয়েটি আদতে অশিক্ষিত।
“নিজের চাওয়া-পাওয়ার সাথে মিল খুঁজে পেয়েছিলাম ওর মধ্যে। তবুও কেন আলেয়ার পিছনে ঘুরে বেরিয়েছিলাম এতদিন। কেন ভালোবাসা কাছে এসে ধরা দিলেও অবহেলায় ঠেলে ফেলে দিতে চেয়েছিলাম আস্তাকুড়ে!” বস্তুত, এই বিষম পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে মনের জটিল সমীকরণগুলি ক্রমশ সরল হয়ে যাচ্ছিল। বড্ড ইচ্ছে করছিল মেয়েটা আবার আসুক। জিজ্ঞেস করুক,”তুমি কেমন আছো? খেয়েছো।” ঠিক যেই কথাগুলো অরিন্দম এককালে আশা রাখত ঐশীর কাছ থেকে।
“অ্যাই শুনছিস! খাবারটা খেয়ে নে। একদম নখরা করবিনা বলে দিলাম!” গরাদের ওপ্রান্ত থেকে ভেসে আসা হুকুমটা শুনে অরিন্দম ফিরে এলো বাস্তবের মাটিতে। প্রত্যেকদিনের মতো আজও পুলিশদের তর্জন গর্জন বন্ধ হয়নি, কিন্তু কোন অজানা কারণে মরতে থাকা খিদেটা চাগাড় দিয়ে উঠলো আজ। মনে পড়ে গেল, বিগত দুইদিন কিচ্ছু খায়নি ও।

“খাচ্ছি…” পড়ে থাকা কম্বলটা মেঝেতে পেতে দিয়ে যুত করে বসলো অরিন্দম। তারপর খাবারের থালাটা টেনে নিল নিজের দিকে…

——+++——-

গলতে থাকা সূর্যের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ঐশী। কিছুক্ষণ আগেই অতনুর সাথে কথা হয়েছে, শহরের অন্যপ্রান্তে থাকা নিজের বাড়ি থেকে বের হওয়ার তোড়জোড় চালাচ্ছে অতনু। গুটিকয়েক বরযাত্রী সমেত চলে আসবে আর কিছুক্ষণের মধ্যেই…নতুন জীবনে প্রবেশের উদ্বেগ, আনন্দ মিলেমিশে গেলেও চাপা পড়ে যাচ্ছে মনখারাপের পরতে। বিয়ের নিয়মানুসারে অন্য বাড়িতে যেতে হলেও শেকড় ছেঁড়ার ব্যথা অনুভব করছেনা ঐশী, মনটা জানে দুটো বাড়িই তার আপন। কিন্তু আজ সকাল থেকে সবিতাদেবী একটাবারের জন্যও মেয়ের সাথে দেখা করতে আসেননি। সূর্য উঠার আগে দধিমঙ্গলের খাদ্যসামগ্রী ঘরে চলে আসলেও সবিতাদেবী নিজ হাতে মেয়ের ঘরে চিড়ে, দই নিয়ে আসেননি। পাত্রটা পাঠিয়ে দিয়েছেন বাড়ীর এক ঝিয়ের হাত ধরে। যজ্ঞ না করায় মাঙ্গলিক, বিধবা মেয়ের পুনর্বিবাহে তার যে কতটা আপত্তি রয়েছে, এই ঘটনাই তার সুস্পষ্ট প্রমাণ।
একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো ঐশির বুক চিরে। সিদ্ধান্তটাও ক্লিশে লাগছে রীতিমতো। মায়ের মতের বিরুদ্ধে গিয়ে করা প্রথম বিয়ের স্মৃতিটা ফের ভিড় করছে মানসপটে।
বছরকয়েক আগে এমনই এক শরতের সকালে জীবনের প্রথম দধিমঙ্গল হয়েছিল তার। মেহেন্দির রঙে সেজে উঠেছিল নরম হাতদুটো। গাঢ় লালচে রাঙ্গা হাত দেখে ছেলেবুড়ো সবাই বলেছিলো স্বামীর ভালবাসা উপচে পড়বে। কিন্তু বাস্তবটা যে পুরোপুরি উল্টো হয়েছিল, তা বলাই বাহুল্য।
গলন্ত সূর্যটা দেখে মনে পড়ে গেলো বছরকয়েক আগে সূর্য, অগ্নিকে সাক্ষী রেখে লাজে রাঙা বধূটি তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছিলো বন্ধুবান্ধবদের মস্করা। ছদ্ম রাগে চোখ পাকিয়ে উঠলেও আত্মীয়, বন্ধুরা অভিজ্ঞতাবশত ঐশীর ভালোলাগা আন্দাজ করে আরো মেতে উঠেছিলো খোশগল্পে। তিনতলা বাড়িটা মুড়ে গিয়েছিলো ব্যস্ততার পরতে। আজ ব্যস্ততা থাকলেও সেই চনমনে ভাব নেই। সবকিছুই যেন বড্ডো যান্ত্রিক, এমনকি নিমন্ত্রিত গুটিকয়েক আত্মীয়-স্বজনরা বাড়ির এদিকে-সেদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকলেও সময় নষ্ট করে কেউই উঁকি দেয়নি বিধবা পাত্রীর ঘরে। নিজের বাড়িতে থেকেও যেন বড্ড বেশি ব্রাত্য হয়ে পড়েছে ঐশী। একাকীত্ব যেন গ্রাস করছে এই শুভদিনেও।
আত্মীয়-স্বজনদের স্বরূপ দেখে ঐশী অভ্যস্ত, কিন্তু নিজের মাও এরূপ আচরণ করলে মনখারাপ হওয়া স্বাভাবিক বৈকি। তাই আনন্দ, উত্তেজনার মাঝেও চোরা বিষাদটা জেগে আছে মনের গোপন কুঠুরিতে।

“মনি, আর দেরি করা ঠিক হবেনা। অতনু বেরিয়ে গিয়েছে।” চিন্তার এলোমেলো জালটা ছেড়ে দিয়ে বলে উঠলেন ঐশীর পিসিমা। সাদা থান পড়া এই ছোটোখাটো মানুষটি ততক্ষণে এগিয়ে এসেছেন ভাইঝির দিকে।
“খুব সুন্দর লাগছে তোকে।” কপালে চুমুর প্রলেপ এঁকে দিয়ে বলে উঠলেন বাসন্তীলতাদেবী।
পিসিকে দেখে খাটের নিচ থেকে পানের ডিবে বার করে ঐশী। এই মানুষটি আর অতনুর মায়ের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। ভীষণ বাস্তববাদী দুজনেই, যুগের সাথে তালে তাল মিলিয়ে চলা দুজন সমবয়সী মানুষ কখনও ঐশির কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিটে দেয়নি। ফাঁকা সিঁথির দিকে হা করেও তাকিয়ে থাকেনি অন্যান্যদের মত। এমনকি আত্মীয় কুটুম্বদের মত করুণা, উপদেশে মুড়ে দেওয়া থেকেও বিরত রেখেছে নিজেকে। উপলব্ধি করিয়েছে, প্রত্যেকের জীবনেই একটা ব্যক্তিগত স্থান থাকে। কিন্তু, নানান ভাবনা গেঁথে মনটা অন্যদিকে ঘোরাতে চাইলেও চোরকাঁটাটা কিছুতেই উপড়াতে পারছেনা ঐশী। সবিতাদেবী যে এখনও মেনে নেননি এই বিবাহকে। চিরাচরিত কুসংস্কারে আবদ্ধ থাকা মানুষটি এখনো বিশ্বাস করে আছেন, অবিনাশের মৃত্যুর জন্য ঐশীর মাঙ্গলিক দোষই দায়ী এবং অতনুকে বিয়ে করলে ফের গ্রহ রুষ্ট হওয়া স্বাভাবিক।

“আমি কোনো ভুল করছি পিসি?” অভ্যস্ত হাতে একটা পান সাজিয়ে দিতে দিতে বলে উঠলো ঐশী। পরিবারের সমর্থন না পেয়ে ফের যুক্তিবোধটা অবলম্বন হারাচ্ছে…
“ধুর পাগলী!” পানের খিলিটা মুখে পুরে দিয়ে ভাইঝিকে কাছে টেনে নেন বাসন্তীলতাদেবী।কুঁচকে যাওয়া হাতটা পরম স্নেহে বুলোতে থাকেন ঐশীর মাথায়। আদর পেয়ে নিজের মুখটা শিশুর মতো পিসির কোলে গুঁজে দেয় ঐশী।
সেদিকে তাকিয়ে বলে ওঠেন তিনি,”নতুন করে শুরু করা কোনো অপরাধ না। নিজেকে ভালো রাখার জন্য কোনোদিন কোনোকিছুর সাথে আপস করবিনা। আমাদের সময় সমাজের চোখ রাঙানি এড়িয়ে বিধবাবিবাহ সম্ভব না হলেও এখন যুগ পাল্টেছে। তুই স্বনির্ভর আর শিক্ষিত, নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নেওয়ার ক্ষমতা আছে তোর। তাছাড়া তুই একটা মানুষ, তোর এতটাও ক্ষমতা নেই যে জলজ্যান্ত আরেকটা মানুষকে নিজের দুষ্ট গ্রহের ক্ষমতা বলে মৃত্যুর দোরগোড়ায় টেনে নিয়ে যেতে পারবি…” সস্নেহে বলে উঠলেন তিনি।
“তবে তুমি কেন জীবনটাকে নতুন করে শুরু করলেনা পিসি?” ঐশীর কথা শেষ হওয়ার আগেই হাওয়াই চপ্পলের চটচট আওয়াজে সচকিত হয়ে ওঠেন বাসন্তীলতাদেবী। সবিতাদেবী এসে গিয়েছেন বোধহয়। গোটা বাড়িতে একমাত্র এই মানুষটিই হাওয়াই চপ্পল ব্যবহার করেন।
“আমি আসি…তুই রেডি হয়ে নে শিগগির।” ভাইঝির কাছ থেকে সরে গিয়ে তাড়াতাড়ি দরজার দিকে এগোতে এগোতে বলে উঠলেন বাসন্তীলতাদেবী। ঐশির মা দেখলে যে ফের চিল্লামিল্লি জুড়বেন, সেটা ভালোমতোই জানান তিনি।

“ঠাকুরঝি সরো দেখি! তোমাকে কতবার বলবো শুভদিনে বারে বারে নিজের মুখ দর্শন করাবে না!”
মুখঝামটা দিয়ে ঐশীর মা কথাগুলো বলে উঠলে ঘরে বসে থাকা ঐশীর কানে কথাগুলো পৌঁছে যায় চট করে। মাছভাত খাওয়ানোর পরেও বাসন্তীলতাদেবীর অবস্থান এই বাড়িতে বিশেষ পরিবর্তন হয়নি। মেয়ের সামনে সরাসরি কিছু বলতে না পারলেও, সবিতাদেবী আজও নিজের সংস্কারবশত ক্ষোভ উগরে দেন ননদের উপর।

“ইচ্ছে করে দাঁড়াইনি। তোদের গোছগাছ হয়ে গেছে?” সংকুচিত ভঙ্গিতে নিজের ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলে উঠলেন ঐশীর পিসিমা। জবাব না দিয়ে মুখটা বেঁকিয়ে মেয়ের ঘরে ঢুকে পড়লেন সবিতাদেবী। সেদিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে পাশের ঘরে চলে গেলেন বাসন্তীলতাদেবী।
রংবিহীন এই ঘরে সিমেন্টের দেওয়ালে নানাবিধ ভাস্কর্য ফুটে উঠেছে। সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে নিজের দুঃসহ অতীত ভেসে উঠলো তার মানসপটে। বিয়ের সপ্তাহ খানেক পরে সাপের কামড়ে স্বামী মারা যায় তার। দুর্ভাগ্যের করাল গ্রাসে পড়ে সর্বস্ব হারানোর পালা শুরু হয় তখন থেকেই। রাতদিন অপমান, অভিযোগ শুনেও তখনকার চিরাচরিত ধ্যান ধারনাকে আঁকড়ে নিয়ে
শ্বশুর বাড়িতে বেশ কিছুদিন মাটি কামড়ে পড়ে ছিলেন। কিন্তু অল্পবুদ্ধি যুবতী মেয়েটি সংসারের সারমর্ম বুঝে যায় কিছুদিনের মধ্যেই। বিয়ের মাসখানেক পরে স্বামীর অকালমৃত্যুতে আপাতচেনা মুখগুলো অচেনা হয়ে যায় রাতারাতি।
দিনভর ঠিকে ঝিয়ের মত সাংসারিক কাজকর্মে শরীরটাকে নিংড়ে দিলেও অপবাদ গালাগালি ছাড়া কিছুই জুটতোনা কপালে।
প্রথম প্রথম “শ্বশুরবাড়ি মেয়েদের স্বর্গ” এই আপ্তবাক্যটি মনে পুষে রেখে মানিয়ে চলার চেষ্টাও করেলেও ফলদায়ক হয়নি কিছুই…
বিধবার আচারনিষ্ঠা অনুশাসন কঠোরভাবে মেনে চলা সত্ত্বেও দুশ্চরিত্র ভাসুরের কর্মকাণ্ডে বাড়িছাড়া হতে হয়েছিল তাকে।
ভাই মারা যাওয়ার পরপরই বাড়ির বড়ো ছেলেটি সদ্যবিধবা বধূর দিকে নজর পড়ে। নানবিধ রোগে আক্রান্ত নিজের স্ত্রী ছিলো ভাসুরের কাছে নিতান্তই বোঝা। সেইমতো সুযোগ বুঝে নানা অছিলায় শরীরটাকে ছোঁয়ার চেষ্টাও করতে থাকে।
নিজের সম্ভ্রম রক্ষার জন্য শ্বশুরবাড়ির গুরুজনদের সাথে এই ব্যাপারে আলোচনা করলে লাভ হয়নি কিছুই। ছেলেকে পূর্ণ সমর্থন করে যৌবনোচ্ছল বিধবা পুত্রবধূকে গালিগালাজ করা হয়। বাপের বাড়ির লোকজনকে ডেকে সালিসি বসানো থেকে শুরু করে একপ্রকার ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেওয়া হয় তাকে।
কথায় বলে মেয়েদের কোন ঘর হয় না ,
এই প্রবাদটি অক্ষরে অক্ষরে মিলে গিয়েছিল বাসন্তীলতাদেবীর জীবনে। বাপের বাড়ি ফিরে আসার পরেও অবিরত মুখঝামটা, অবহেলাকে সঙ্গী করে তার দিনগুলো কাটতো। বাড়ির একমাত্র মেয়ে হলেও কোণের একচিলতে ঘরে তার ঠাই হয়েছিলো তার। বহুপূর্বে ঘটে যাওয়া সেই কারণবশত আজও ঐশীর মা অসম্মান করে তাকে। ঠিক ভুল বিচার না করেই অপরকে দোষী দাগিয়ে দেওয়ার প্রবণতা আছে সবিতাদেবীর। সেটা নিজের মেয়েই হোক, বা ননদ।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রাতের আকাশ আনমনে দেখতে থাকলেন তিনি। চটির আওয়াজ অন্যত্র যেতেই ঐশীর ঘরে যাবেন তিনি। বড্ড মায়া হচ্ছে মেয়েটার জন্য। এক বছরের স্মৃতি ফিরে আসছে মানসপটে।
“ঐশী চলে গেলে এইবাড়িতে আমার নিরাপত্তা থাকবে! নাকি ফের আগের মত এককোণে পড়ে থাকতে হবে সব অন্যায়কে মুখ বুজে!” চিন্তাটা মাথায় আসতেই বুকটা ভয়ে ছ্যাত করে উঠল তার। “কোথায় হবে আমার ঠিকানা!”

“তুমি পিসির সাথে ফের অমনভাবে কথা বললে!” দেওয়ালের আবরণ ভেদ করে চলে আসা ভাইঝির কন্ঠস্বরটা পানি আসতেই ভ্রুদুটো কুঁচকে উঠলো তার।
“আমি বলেছিলাম বিধবা মানুষ, এই শুভদিনে…” আমতা আমতা করে বলে উঠলেন সবিতাদেবী।
“তবে আমি কি মা! আমিও যে বিধবা। তবে কি আমার বিয়েতে তুমি আমারই মুখ দেখবে না!” ভাইঝির কণ্ঠস্বরটা কানে ভেসে আসতেই মুখখানা উজ্জ্বল হয়ে উঠল বাসন্তীলতাদেবীর। মনের ভাবনা অন্য কারোর মুখ থেকে প্রকাশ পাচ্ছে দেখে চুপচাপ শুনতে থাকলেন তিনি।
“আমি জানি, তোমার অমতে গিয়ে যজ্ঞ না করেই বিয়ে করার কারণে তুমি রেগে গিয়েছো। ভাবছো অবিনাশের মত অতনুর একই পরিণতি হবে। কি তাইতো?” যথাসম্ভব শান্তভাবে বলে উঠলো ঐশী। এর ফলশ্রুতি যে কি হতে পারে, সেটা জানে সে…
“সবই যখন জানিস তখন কেন যজ্ঞ না করেই বিয়েটা করছিস!” রাগে হিতাহিত জ্ঞানশুন্য হয়ে প্রায় চিল্লিয়ে উঠলেন সবিতাদেবী। “তুই কি চাস অবিনাশের মত…”
“অবিনাশ আমার কারনে মরেনি মা। নিজের ভাই মেরে ফেলেছে ওকে। নিজের পাপের শাস্তি পেয়ে গিয়েছে অন্য কারোর হাতে। একজন মাঙ্গলিকের এত ক্ষমতা নেই যে জলজ্যান্ত কোনো মানুষকে মেরেই ফেলবে!” মেয়ের কথা শুনে বিছানায় ততক্ষণে ধপ করে বসে পড়েছেন সবিতাদেবী। এতোকাল ধরে সযত্নে লালিত বিশ্বাসটা ভেঙে গেল এক লহমায়। মেয়ের গ্রহ দোষের কারণে সৃষ্ট দুর্ঘটনার তথ্যও মিথ্যে প্রমাণিত হলো আজ।
“হ্যাঁ মা। অবিনাশ আমার কারনে খাদে পড়েনি। ওর পাপকাজ সরিয়ে দিয়েছে ওকে।” বলে এতদিন ধরে জমে রাখা কথাগুলো ঐশী বলে ফেলল একে একে।
সবটুকু শোনার পর সবিতাদেবী নিশ্চুপ। নিখুঁত সাক্ষ্যপ্রমাণের আঘাতে বেঁচে থাকা বিশ্বাসটা ভেঙে যাচ্ছে বালির বাঁধের মতো।

“বর এসেছে বর এসেছে!” এমন সময় সমবেত কোলাহল কানে যেতেই ঝট করে দাঁড়িয়ে পরে ঐশী। অধীর প্রতীক্ষার অবসান ঘটলো অবশেষে
নিজের মুখটা আয়নায় দেখে নিলো একবার। তারপর কোণের টেবিলে রাখা বাধানো ফটোফ্রেমটা হাতের মধ্যে বন্দি করে পা বাড়ালো ঘরের বাইরে।
“একি পিসি কই!” বিয়ের মন্ডপে পিসিকে কোথাও দেখতে না পেলে দাদাকে জিজ্ঞেস করে বসলো সে।
“পিসি ঘরে আছে। কিন্তু কেন?” ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে উঠলো কৃষানু।
উত্তর না দিয়ে উপস্থিত সবাইকে অবাক করে দিয়ে নির্দিষ্ট ঘরের দিকে পা বাড়ালো ঐশী। বরবেশে থাকা অতনুর ঠোঁটের কোণে তখন ফুটে উঠেছে একচিলতে হাসি…

“পিসি চলো।” নির্দিষ্ট ঘরে পৌঁছে একাকী দাঁড়িয়ে থাকা বয়স্ক একপ্রকার টানতে টানতে নিয়ে আসলো মণ্ডপের মাঝখানে। তারপর হাতে ধরা ফটোটা রেখে দিলো যজ্ঞের আগুনের পাশে।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সাদাকালো জলছবিটা ততক্ষনে হোমের আগুনে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।
আত্মীয় কুটুম্বদের সমবেত গুঞ্জনে জায়গাটা মুখরিত হয়ে উঠেছে। এমনকি পুরোহিতমশাইও
মন্ত্র পড়তে পড়তে অবাক হয়ে তাকিয়ে রয়েছেন সেইদিকে।
“খুব অবাক লাগছে তাইনা!” সমবেত জনতাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো ঐশি। পাত্রীর এরূপ আচরণে গোটা ঘরে তখন পিনড্রপ সাইলেন্স। এমনকি দাদা কৃশানুও থমকে দাঁড়িয়ে আছে এককোণে। অতনুর মুখে ফুটে উঠেছে চওড়া হাসি।
দৃষ্টিটা ফটোফ্রেমের দিকে রেখে হতবাক নিমন্ত্রিতদের উদ্দেশ্যে বলে উঠল ঐশী,”এই মানুষটি না থাকলে আমার দ্বিতীয় বার বিয়ের পিড়িতে বসার ইচ্ছেটা স্বপ্নই থাকতো। আর পিসী না থাকলে আমি এই সিদ্ধান্ত কখনোই নিতে পারতাম না। মনের জোর পেয়েছি এই মানুষটির কাছ থেকে।”
“কিন্তু বিধবা হয়ে এই শুভক্ষণে…” অভ্যাগতদের একজন নিজের আপত্তি জানিয়ে উঠলে অতনু বাধা দিয়ে উঠলো। উত্থিত সেই হাত দেখে মুখে কুলুপ আঁটলেন ভদ্রলোক।

“এখানে দাঁড়াও পিসি…”বলে মণ্ডপের সামনের জায়গাটা খালি করে বাসন্তীদেবীকে দাঁড় করিয়ে দিল ঐশী। ভাইঝিরর কর্মকাণ্ডে ততক্ষনে চোখে জল চলে এসেছে বাসন্তীলতাদেবীর। তবে এই কান্না দুঃখের না, সুখের। হারিয়ে ফিরে পাওয়া সম্মানের…
“এই সময়ে কাঁদতে নেই। আমি কিন্তু খুব বকবো।” পিসির চোখের জলটা মুছে দিতে দিতে বলে উঠলো ঐশী। তারপর পিসির উদ্দেশ্যে বলে উঠলো ফের,”নতুন তৈরি হওয়া ফ্ল্যাটবাড়িতে তোমার নামে ঘর রেজিস্টার হয়ে গিয়েছে। কিন্তু তৈরি হতে কয়েকমাস লেগে যাবে। তাই আমি আর অতনু ঠিক করেছি বিয়ের পর তুমি আমাদের সাথেই থাকবে।” সেই কথা শুনে সুখের অশ্রু ঝরাতে ঝরাতে ঐশীকে বুকে টেনে নিলেন বাসন্তীলতাদেবী। এতদিন পর নিজের আশ্রয় খুঁজে পেলেন তিনি। সম্মান, ভালোবাসায় মোড়া যে আশ্রয়ের খোঁজে ঘুরে বেড়িয়েছিলেন জীবনভর।
“তাড়াতাড়ি! লগ্ন বয়ে যাচ্ছে যে…” পুরোহিতের কথা শুনে ভাইঝিকে ছেড়ে দিলেন বাসন্তীলতাদেবী। অসমবয়সী দুই বিধবার এহেন উত্তরণের দৃশ্য প্রাণভরে দেখে চলেছেন সবিতাদেবী। কুসংস্কারকে আঁকড়ে বেঁচে থাকা মানুষটি দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে চোখের জল মুছে চলেছেন ক্রমাগত। পরিস্থিতি জানিয়ে দিয়েছে উত্তর, তার মনের মধ্যে জেগে থাকা প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতে।

আগের পর্ব https://www.facebook.com/114703953643370/posts/192751262505305/

সমাপ্ত

© সম্প্রীতি রায়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here