তৃষ্ণা
পর্ব ১০
মিশু মনি
.
অংশী ঘরে শুয়ে আছে। মাহিবের গলা শুনে চমকে উঠলো। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে বারবার অংশীর নাম ধরে ডেকে চলেছে মাহিব। ঘর থেকে বেরিয়ে এলো অংশী। মাহিবের সাথে সিনেমার নায়ক দাঁড়িয়ে আছে। সুদর্শন ছেলেটাকে দেখেই অংশী বুঝে গেছে ইনিই সিনেমার হিরো। ও পলক না ফেলে তাকিয়ে রইলো।
মাহিব বললো, ‘দুটো চেয়ার নিয়ে আসতে পারবে অংশী? আমরা এখানে কিছুক্ষণ বসবো।’
অংশী এদিক ওদিক তাকালো। ওদের ঘরে তো চেয়ার নেই। কি করবে এখন বুঝতে পারছে না। মাহিব ব্যাপারটা বুঝতে পেরে বললো, ‘ আমাদের ঘরে যাও, প্রীতমকে বলো নিয়ে আসতে।’
অংশী মাহিবের ছাউনি ঘরে চলে এলো। প্রীতম ল্যাপটপের সামনে বসে আছে। অংশী কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই ও ভূত দেখার মত চমকে উঠলো। অংশী বললো, ‘চেয়ার নিতে আইছি। আপনারে নিয়া যাইতে কইছিলো সাহেব।’
– ‘ভাইয়া?’
– ‘হু।’
– ‘তার আগে বলো তো তুমি ঘর থেকে বের হও না কেন? ভয় পাও আমাকে?’
– ‘ভয় পামু ক্যান?’
– ‘তোমার চেহারা তো তাই বলছে। আমাকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আমি বাঘ ভাল্লুক নই। মাহিবের সাথে তো ঠিকই গল্প গুজব করা হয়। আমাকে কি চোখে দেখো না নাকি?’
অংশী প্রীতমের চোখের দিকে একবার তাকিয়েই চোখ নামিয়ে নিলো। ওর কেমন যেন সংকোচ লাগছে। হাত দুটো সমানতালে দলা পাকাচ্ছিলো। প্রীতম বললো, ‘যাও আমি নিয়ে আসছি।’
চেয়ার নিয়ে এসে মাহিবের সামনে রেখে প্রীতম অংশীর পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। মাহিব ও সিনেমার নায়ক অন্তিম বসে পড়লো চেয়ারে। মাহিব প্রীতমকে বললো, ‘আরো দুটো টুল নিয়ে আয় না। তোরা কি দাঁড়িয়ে থাকবি?’
প্রীতম ছুটে গেলো টুল আনার জন্য। এসে দেখলো অংশী নেই। ও বারবার ঘরের দিকে উঁকি মারছিলো। ব্যাপারটা খেয়াল করে মাহিব বললো, ‘কি রে তোর সমস্যা কি?’
প্রীতম মাথা চুলকে বললো, ‘না ভাইয়া কিছু না।’
– ‘দাঁড়িয়ে আছিস কেন? বস।’
প্রীতম চেয়ারে বসার পরও বারবার দরজার দিকে উঁকি মারছিলো। অংশী একটা বাটিতে ঝালমুড়ি বানিয়ে নিয়ে এসে ওর টুলের উপর রেখে বললো, ‘খান।’
অন্তিম মাহিবের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। অন্তিম জীবনেও কখনো মুড়ি খায় নি। মেয়েটার ঘরে হয়তো মুড়িই ছিলো তাই পিঁয়াজ মরিচ ও তেল দিয়ে মাখিয়ে এনেছে। এদের আতিথেয়তা বেশ ভালো বলতে হবে।
মাহিব এক মুঠো ঝালমুড়ি মুখে দিয়ে বললো, ‘ইয়াম্মি তো। প্রীতম খেয়ে দ্যাখ, জীবনেও খাস নি এমন।’
প্রীতম অংশীর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসতে হাসতে ঝালমুড়ি মুখে দিলো। তারপর বাটিটা নিজের হাতে নিয়ে অংশীকে ওর পাশের টুলে বসতে বললো। সংকোচ করতে করতে বসে পড়লো অংশী।
এমন সময় কাশি উঠলো মাহিবের। ওকে কাশতে দেখে এক ছুটে অংশী ঘরে গিয়ে এক গ্লাস পানি এনে মাহিবের সামনে ধরলো। তারপর হাত দিয়ে মাহিবের মাথায় চড় দিতে দিতে বললো, ‘ঠিক হইবো, ঠিক হইবো।’
অংশীর হাতটা ধরে ওর মুখের দিকে তাকালো মাহিব। এত মায়া কোথায় রাখে মেয়েটা! ওর চোখে কি যেন আছে। অংশী ওর চাহনিতেই মরে যায় যায় অবস্থা। প্রীতম ওদের চাওয়াচাওয়ি দেখে মাথা নামিয়ে ভাবনায় ডুবে গেলো।
মাহিব বললো, ‘খাওয়া শেষ করে আমাদেরকে সেই জায়গাটায় নিয়ে যেও তো অংশী।’
– ‘আইচ্ছা।’
খেতে খেতে এখানকার সংস্কৃতি নিয়ে আলোচনা চলছিলো। অংশী শুধু নিরবে শুনে যাচ্ছিলো। খাওয়া শেষ করার পর ওরা উঠে দাঁড়ালো অংশীর প্রিয় জায়গাটায় যাওয়ার জন্য। ছুটে গিয়ে নৌকার বৈঠা নিয়ে এলো অংশী।
মাহিব, অন্তিম ও প্রীতম কে নিয়ে অংশী নৌকা চালিয়ে চললো ওর প্রিয় জায়গাটায়। নৌকা থেকে নামার সময় মাহিব হাত ধরে ওকে নামালো। নদীর ঘাট থেকে ওপরে ওঠার সময় আঁকাবাঁকা রাস্তায় পড়ে যাচ্ছিলো অংশী। মাহিব ওকে প্রায় জাপটে ধরে নিজের বুকের কাছে নিয়ে হাসতে হাসতে বললো, ‘আরে আসো।’
প্রীতমের চোখ এড়ায়নি ব্যাপারটা। তবে কি মাহিবও অংশীর প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে? ব্যাপারটা ভাবতেই ওর মন থেকে অংশীর জন্য জেগে ওঠা ভালোবাসা টুকু ধীরধীরে দূরে সরে যেতে লাগলো। অংশীর চোখে মুখেও মাহিবের জন্য প্রেম স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। কিন্তু মাহিবের মত একজন অংশীকে আদৌ ভালোবাসে তো? নাকি শুধুই মোহ? অবশ্য মোহ নাও হতে পারে। কারণ প্রীতম নিজেই যখন অংশীর প্রেমে পড়ে গেছে সেখানে মাহিবের পড়তে অসুবিধা কোথায়?
জংগলে হাঁটার সময় মাহিব ও অংশী পাশাপাশি হাঁটছিলো। ওরা কথা বলছিলো বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আর উচ্চস্বরে হাসছিলো মাহিব। অংশীও মাহিবের সাথে যোগ দিয়ে খিলখিল করে হাসছিলো। অন্তিম নিশ্চুপ হয়ে শুধু ওদের হাসির সাক্ষী হয়ে রইলো। প্রীতম আর একবারও ফিরে তাকায়নি অংশীর দিকে। দুজনে ইতিমধ্যেই খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে গেছে। অংশীকে নিয়ে আর না ভাবাটাই শ্রেয়। কষ্ট পেতে চায় না প্রীতম।
জায়গাটায় কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে ফেরার পথে গান ধরলো মাহিব। অংশী হাত তালি দিচ্ছিলো মাহিবের গানের সাথে। নদীর ঘাটে এসে মাহিব একহাতে অংশীকে অনেক খানি উপরে তুলে নৌকায় তুলে নিলো। নৌকা দুলে উঠলে দুজনে হেসে উঠলো হো হো করে। প্রীতম দৃশ্যটা দেখে শুধু মনেমনে ভাবছে, মেয়েটার ভাগ্যে যেন দুঃখ না থাকে। শেষ পরিণতি কি যে হবে!
১১
দুদিন কেটে গেলো
সিনেমার শুটিং আরম্ভ হয়েছে। নদীর ধারে শ্যুট হচ্ছে। এলাকাবাসীরা ঘিরে ধরে দেখছে ওদের কাজ। নায়িকার অভিনয়ে বারবার ভুল হচ্ছে। যতবার ভুল হয়, খিলখিল করে হেসে ওঠে অংশী। তখন সেটের সবাই অংশীর দিকে তাকায়। মাহিব মুচকি হাসে।
পুরো সময়টা মাহিবের কাছাকাছি থেকে শুটিং করা দেখলো অংশী। কাজের সময় মাহিব অন্য মাহিব হয়ে যায়। চেনাই যায় না ওকে। অংশী মাহিবের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হারিয়ে যায় অন্য কোনো জগতে। যে জগতে ওরা দুজন ছাড়া আর কেউ নেই। মাহিবকে দেখতে ভালো লাগে অংশীর। ভালো লাগে মাহিবকে নিয়ে ভাবতেও। এ এক অন্যরকম ভালো লাগা। যতক্ষণ মাহিবের কথা ভাবতে থাকে, মনে সুখ সুখ শিহরণ হতে থাকে। অংশী লজ্জা পেয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলে। এভাবেই চলছে অংশীর দিন।
রাত্রিবেলা মাহিব টংয়ের উপর বসে সিগারেট টানছিলো। অংশী এসে পিছন থেকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করলো মাহিবকে। মাহিব বললো, ‘ও! তুমি। বসো।’
– ‘আপনে সিগ্রেট খান ক্যান?’
– ‘না খেলে থাকতে পারি না। নেশা হয়ে গেছে।’
– ‘আপনারে একটা কথা জিগাই?’
– ‘হুম বলো।’
– ‘আপনের বউ আছে?’
মাহিবের দিকে তাকিয়ে এমনভাবে কথাটা বললো অংশী যে কেমন যেন লাগলো মাহিবের। ও সিগারেটে টান দিয়ে বললো, ‘না নেই। হঠাৎ এই প্রশ্ন?’
– ‘না। এমনে জানতে মন চাইলো।’
– ‘হু। বিয়ে করবে নাকি আমাকে?’
বুকের ভিতরটা ধক করে উঠলো অংশীর। এ কেমন প্রশ্ন! উথাল পাথাল ঢেউ বইতে লাগলো মনে। অংশী লজ্জায় যেন মাটিতে মুখ লুকায়। মাথা নিচু করে অন্যদিকে তাকিয়ে রইলো ও। মাহিব আবারও সিগারেটে টান দিয়ে বললো, ‘কি হলো? চুপ করে আছো যে? বিয়ে করতে চাও নাকি?’
অংশীর গলা দিয়ে কোনো শব্দ আসছে না। ও নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে। এদিকে হৃদস্পন্দন বেড়ে যাচ্ছে ক্রমশই।
মাহিব বললো, ‘তোমাদের এখানে আকাশ খুব সুন্দর। চারিদিক এত বেশি নিস্তব্ধ যে সবসময় থেকে যেতে ইচ্ছে করে।’
একমনে কথাগুলো বলে গেলো মাহিব। অংশী মাহিবের দিকে তাকালো। একটু আগে বলা কথাটা কি সহজেই বলে ফেললো লোকটা। বলার পর আবার ভুলেও গেলো। তারমানে শুধু মজা করে বলা!
মাহিব অংশীর দিকে চেয়ে বললো, ‘কি ভাবছো? বিয়ের করবে কিনা সেটা?’
অংশী কথা বলতে পারলো না। মাহিব হেসে ফেললো। সিগারেটের শেষ টানটা দিয়ে বললো, ‘আহ অমৃত। সিগারেটের শেষ টানটা প্রেমিকার চুম্বনের চেয়েও অধিক মধুর হয়।’
লজ্জা পেয়ে মাথা নামিয়ে নিলো অংশী। মাহিব বললো, ‘কখনো কাউকে চুমু খেয়েছো?’
কি অদ্ভুত প্রশ্ন! বুকের ভেতর যে হৃদপিন্ডটা আছে সেটা এবার বোধহয় ফেটেই যাবে। এত জোরে ঢিপঢিপ করছে। গা কাঁপছে অংশীর। ও চোখ মেলে থাকতেও পারছে না, বন্ধ করতেও পারছে না।
মাহিব বললো, ‘রাত হয়েছে অনেক। যাও শুয়ে পড়ো।’
কথাটা বলে উঠে দাঁড়ালো মাহিব। অংশীর খুব বলতে ইচ্ছে করছিলো আর কিছুক্ষণ পাশে বসে থাকুন। কিন্তু বলতে পারলো না। হঠাৎ ই খুব কান্না এসে গেলো ওর। মাহিব গিয়ে ওর ঘরের ভেতর ঢুকলো। অংশীর অস্থিরতা ক্রমশ বেড়েই চলেছে। ছটফট করতে করতে ছুটে ঘরে গিয়ে বালিশ চেপে ধরে কাঁদতে লাগলো অংশী।
চলবে..