একটুখানি পর্ব : ৪২

0
630

একটুখানি
— লামইয়া চৌধুরী
পর্বঃ৪২
কূজন কুহুদের বাসার সোফায় বসে আছে। কুহুর বাবা
– মা ও বসে আছেন। এমনকি কূজনের মুখোমুখি
হয়ে সামনের সোফাটায় বসে আছেন ওরা।
কূজনের মন অস্বস্তিতে ভরে আছে। কূজনকে
উশখুশ করতে দেখে কুহুর মা কূজনকে ইশারায়
আশ্বস্ত করলেন। কূজন কুহুর মায়ের ইশারায়
তর্জনী দিয়ে কপালের ঘাম মুছলো। ভারমুক্ত
লাগছে এখন তাকে। কূজন ঠোঁটে হালকা হাসি মিশিয়ে
তাকালো পাশে বসে থাকা কলরবের দিকে।
চোখে মুখে খুশির ঝিলিক বয়ে যাচ্ছে
কলরবের। যে চোখে কূজন শুধু বুদ্ধির দীপ্তশিখা
দেখতো আজ কলরবের সে চোখেই
ভালোবাসার দীপ জ্বলতে দেখছে সে। কিন্তু
তাঁর বুকের ভিতর যে চিতা জ্বলছে তা কি কেউ
দেখছে?? বুকের মধ্যে দাউ দাউ করে আগুন
জ্বলছে তার। চোখে মুখে ফুটে উঠবে সে
ভয়ে কৃত্রিম চওড়া এক হাসি ঠোঁটে এঁকে
রেখেছে। এই হাসি দিয়ে নিজের বসন্ত
প্রেমের প্রথম কুহু ডাক না পাওয়া নামক হিমালয়ে
বিলীন করে দিতে চাচ্ছে কূজন। কিন্তু সেই কুহু
ডাক বুকের পাঁজর নামক হিমালয়ে গিয়ে কঠিন ধাক্কা
দিচ্ছে আর ধ্বনি প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে আসছে
বেদনা হয়ে। আসলেই কি কেউ বুঝেনি তার কষ্ট
নাকি সবাই বুঝেও না বোঝার ভাণ করে যাচ্ছে?
কেউ বুঝেনি কে বলেছে?? বাবা তো বুঝেছিল।
বাবা তো যেকোনো মূল্যে কুহুকে তার করেই
দিত কিন্তু ঐ যে বুকের পাঁজরে কুহু ডাক শুনলেও
পরিবারের মাঝে আর কোনো বিদ্রোহ ক্লেশ
দেখতে চায় না সে তাই তো মাকে দিয়ে কুহুর মা –
বাবার কাছে ফোন দিয়ে জানিয়ে দিয়েছে যেন
সবার কাছে বিষয়টা গোপন থাকে। জাহরা কবরীর
কাছে ক্ষমাও চেয়েছেন। বলেছেন আসলে
কলরবও যে বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছে তা অজানা
ছিল। জানা থাকলে এই ভুলটা করতেন না। কূজন মায়ের
কাছেও কথা শুনেছে। কেনো সেদিন রাতেই
বাবাকে কুহুদের বাসায় যেতে না করেনি?? না
করলেই তো কূজনের বাবা কুহুদের বাসায় যেত না।
কূজন মাকে কীভাবে বোঝাবে সে তো
নিজের মধ্যেই ছিল না, নিজেকেই সামলাতে
পারছিলো না। বাবা যে কাল সকালেই কুহুদের বাসায়
যাবে মাথা থেকেই আউট হয়ে গিয়েছিল। কূজন
ভাবছে ভালোয় ভালোয় সব মিটে গেলে হয়।
বাবাকে তো বলে কয়ে দমিয়ে রেখেছে
সে। কি জানি আসলেই দমে গেছে নাকি ঝড়ের
পূর্বাভাস? কূজন খুব ভালো করেই জানে ওর বাবার
পাওয়ার কেমন। বাবার একটুখানি ইশারায় সব উলটপালট
হয়ে যেতে পারে। ওর বাবা চাইলে কলরবকে
যেকোনো ধরনের কাজে ফাঁসিয়ে জেলেও
পাঠাতে পারে এমনকি মেরে ফেলে লাশ গুম করার
মতো ক্ষমতাও আছে। চাকরিটাও খেয়ে ফেলতে
পারে। যেকোনো ধরনের স্ক্যান্ডেল লাগিয়ে
দিতে পারে কলরবের মাথায়। এসব কথা ভাবতেই
কূজনের গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো। ওর বাবা নিতান্তই
ভালো মানুষ কিন্তু ছেলের জন্য সব করবেন উনি।
বড় বড় আমলা থেকে শুরু করে পুলিশ ডিসি, এসপি,
সন্ত্রাস সবাই বাবার টাকার কাছে হার মানবে। কিন্তু কূজন
তো এগুলো চায় না। সে চায় শান্তি! সবাই শান্তিতে
থাকুক এটাই। কূজনের ভাবনায় ছেদ পড়লো
কলরবের ডাকে।
– কিরে উঠ আমার সাথে চল।
– কোথায়?
ইরিন আনন্দে গদগদ হয়ে বললো,
– আমরা ভাবির সাথে দেখা করতে যাচ্ছি। কূজন ভাইয়া
তাড়াতাড়ি চলো।
কূজন অবাক হয়ে বললো,
– কোন ভাবি??
– কোন ভাবি আবার কুহু ভাবি। আমাদের একমাত্র ভাবি নাহ্
তোমার একমাত্র ভাবি তবে আমার বড় ভাবি হবে কুহু
ভাবি আর ছোট ভাবি হবে তোমার বউ। ওয়াও দুই
ভাবিকে দিয়ে কাজ করাবো আমি। জংলি ননদিনী
হবো আমি।
কূজন বিড়বিড় করে বললো,
– কুহু ভাবি!
তারপর উঠে দাঁড়ালো। তবে হাত পা ছেড়ে দিতে
চাইছে মন। সারা শরীর জুড়ে অস্ফুট ব্যাথা জেঁকে
বসেছে। পা চলছে না, মনও চলছে না তবুও কূজন
কলরব আর ইরিনের সাথে চললো। সাহরাও আছেন
সাথে। পিহু ওদের কুহুর রুমে নিয়ে যাচ্ছে। যাওয়ার
পথে কলরব ইরিনকে ফিসফিস করে বললো,
– ইরিন তুই জংলি না তুই হবি জঙ্গী ননদিনী। হাহাহহা
ইরিন ভাইকে চিমটি কাটলো তারপর কূজনের হাত ধরে
বললো,
– এই জন্যেই কূজন ভাইয়াকে আমার ভালো লাগে।
তোমার মতো খালি আমাকে ক্ষেপায় না। হুহ্হহ্ একবার
বিয়েটা করো তারপর দেখো আমি আর কুহু ভাবি
মিলে কেমন নাকানিচুবানি দেই তোমাকে।
কলরব ইরিনের কথায় হেসে ফেললো।
..
কুহুর মা কুহুকে নীল রঙের একটা শাড়ি পরিয়েছেন।
কুহু পরতে চায়নি তারপরো জোর করে
পরিয়েছেন। হাত ভর্তি নীল কাঁচের চুরি পরিয়ে হহাত
খোঁপা করে ঘোমটা টেনে দিয়েছেন
মেয়ের। তারপর বলেছেন একটু সেজে নিতে।
কিন্তু কুহু সাজেনি। কবরী বিরক্ত হয়ে বলেছিলেন,
” এত ঢং করিস কেনো তুই?
এমনিতে তো কতোই সাজিস, শুধু শুধু বাসায় বসে
বসে সেজে এ ঘর ও ঘর ঘুরে বেড়াস কিন্তু
যেই মানুষজনের সামনে যাবি পেত্নীর মতো
চলে যাস। ”
কুহু বিরক্ত হয়ে বলেছিল,
– আম্মু শাড়িও কিন্তু পড়বো না তাহলে।
– আচ্ছা মা আর বলবো না। তুই যে আমাকে কি পরিমাণ
জ্বালাস আল্লাহ খালি বুঝতে পারবে। ভালোয়
ভালোয় তোকে বিদায় করলে বাঁচি।
কুহু মায়ের কথা শোনে হেসে বলেছিল,
– দেখা যাবে! পরে কান্নাকাটি করলেও আমি তোমার
বাড়ি আসবো না।
কবরীও তখন মেয়ের সাথে হেসেছেন কিন্তু
চোখের কোণে পানি চিকচিক করছিল।
ইরিনকে ভিতরে আসতে দেখেই কুহু জমে
গেল। কুহু বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসেছিল। পা গুলো
ফ্লোর ছুঁয়ে রেখেছে। কলরবকে ভিতরে
আসতে দেখে পা দিয়ে ফ্লোর আঁকড়ে
ধরলো। নীচের দিকে চোখ নামিয়ে বসে
আছে সে। হঠাৎ চোখ গেল কূজনের স্নিকারস
এর দিকে। মূহুর্তেই কূজনের জন্য খারাপ লাগা শুরু
করলো তার। কূজনের নিশ্চয় কষ্ট হচ্ছে। এভাবে
ওকে ভাইয়ের বউ হিসেবে দেখলে কূজনের
কষ্ট হওয়াটাই স্বাভাবিক। কুহু তো চায়নি কাউকে কষ্ট
দিতে আর কূজনকে তো সে তেমন কোনো
কথাও দেয়নি এমনকি ইশারাও করেনি তাহলে নিশ্চয়
কূজন মনে কষ্ট পেলে কুহুর তাতে কোন
দোষ নেই। সাহরা কুহুর চিবুকে হাত রেখে কুহুর মুখ
তুলে ধরলেন। কুহু সাথে সাথে সালাম দিল সাহরাকে
তারপর পা ছুঁয়ে সালাম করতে নিলেই সাহরা বললেন,
– পা ছুঁয়ে সালাম করতে হয় না।
কুহুও চায়নি করতে। কুহুর মা জোর দিয়ে বলে
দিয়েছেন যেন অবশ্যই পা ছুঁয়ে সালাম করে তাই
করতে চেয়েছিল। কুহু মনে মনে খুশি হলো
এরকম আজেবাজে কুসংস্কার মানেন না সাহরা।
ইরিন কুহুকে জড়িয়ে ধরে বললো,
– শুনো ভাবি আজ থেকে তুমি করে বলবো
তোমাকে। আর আমাকে একদম বকা দিবে না কিন্তু।
পড়া না পারলে ভাইয়ার মতো সুন্দর করে বুঝিয়ে
দিবে। ভাইয়া আমাকে যেভাবে ফিজিক্স বুঝিয়ে
দেয় ঠিক সেভাবে ওকে??
কুহুর খুব হাসি পাচ্ছে কিন্তু হাসতেও কেমন জড়তা কাজ
করছে তাই চুপ করে মাথা নেড়ে ইরিনের কথায় সায়
দিল সে।
সাহরা আদর মেশানো হাতে কুহুর মাথার ঘোমটা
একটুখানি সরিয়ে নিতেই কুহু আতঙ্কিত হয়ে পিছিয়ে
গেল।
সাহরা হেসে বললেন,
– পুরো ঘোমটা সরাচ্ছি না তো মা। আমার আবার ড্রামা
বেশি, সিরিয়াল টাইপের। তাই বহুদিনের শখ ছেলের
বউকে টিকলি দিব। সাধারণ মানুষের মতো আংটি ফাংটি
দিয়ে কথা পাকা করবো না। সিনেমা টাইপ টিকলি দিব।
সিনেমাও না। সিনেমাতে তো হাতের বালা দেয় আমি
আরো একধাপ এগিয়ে টিকলি পরিয়ে দিব তোমাকে।
কথা শেষ করে সাহরা কুহুর দিকে এগিয়ে গিয়ে টিকলি
পরিয়ে দিলেন কুহুকে। তারপর কুহুর কপালে চুমু
খেয়ে বললেন,
– অনেক মিষ্টি লাগছে তোকে।
– দোয়া করবেন।
– অবশ্যই।
সাহরা ইরিন আর কূজনকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
– ইরিন! কূজন! এখন চল তো আমরা যাই। ওরা একটুখানি
কথা বলুক।
কুহু চুপসে গেল ভয়ে। কলরব যদি এখন ওকে
গতকালকের জন্য ধমক দেয়?? কলরব একটুখানি সিরিয়াস
হয়ে কথা বললেই কেমন যেন গম্ভীর গম্ভীর
লাগে তাকে, ভয় করে কুহুর। সেদিন স্কেল দিয়ে
টেবিলে মেরেছে আর কুহুর মনে হয়েছিল এই
বুঝি তাকে মারবে। মনে মনে কথাগুলো ভেবে
কুহু ঢোক গিললো। ইরিন আর কূজন এতক্ষণে ঘর
ছেড়ে চলেও গেছে। সাহরা দরজার কাছে
যেয়ে পিহুকেও ডেকে বললো চলে আসতে
উনার সাথে। পিহু রুমের ভিতরেই ছিল। পিহু চলে
যেতে নিতেই কুহু সঙ্কিত গলায় বললো,
– না পিহু তুই থাক।
পিহু বোনের কথা শোনে সাহরার দিকে তাকালো।
কলরবের মা পিহুর হাত ধরে টেনে পিহুকে নিজের
সাথে নিয়ে চলে গেলেন। ওরা চলে যেতেই
কুহু কলরবের দিকে চোখ তুলে তাকালো। কলরব
ফরমাল সাজে এসেছে আজ। সাদা ফর্মাল শার্ট
পরেছে সে। কুহু পরমুহূর্তেই চোখ নামিয়ে নিল।
কলরব যেখানে দাঁড়িয়েছিল সেখানেই দাঁড়িয়েই
বললো,
– কেমন আছেন আপনি??
কুহু কিছু বললো না। কলরবের মুখে আপনি শুনে
সে আরো জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়ালো। মানে
সত্যি সত্যি কলরব রেগে আছে। এখন নিশ্চয় ধমক
দিবে কুহুকে।
কলরব কুহুর কাছে উত্তর না পেয়ে রুমটা ঘুরেঘুরে
দেখতে লাগলো। কুহু অস্বস্তিতে কুৃঁকড়ে
যাচ্ছে। কলরব হঠাৎ জিজ্ঞাসা করলো,
– আচ্ছা ফুলটুশী আমি কি তোমাকে না মানে সরি
আপনাকে একটুখানি ছোঁয়ে দেখতে পারি??
কুহু খাট ঘেঁষে দাঁড়িয়েছিল।কলরবের কথা শুনে
আতঙ্কে পিছিয়ে গেল আর বিছানায় ধপ করে
পড়ে গেল। কলরব কুহুর দিকে তাকিয়ে দেখলো
কুহু বিছানায় বসে আছে। চোখে মুখে স্পষ্ট
আতঙ্কের ছাপ। কলরব কুহুর এই অবস্হা দেখে
হেসে ফেললো তারপর আঙুল দিয়ে ইশারায় কুহুর
ছবির ফ্রেম দেখিয়ে কুহুকে বললো,
– এখানে ছোঁয়ার কথা বলছি। ছু্ঁতে পারি???
কুহু কলরবের কথা শোনে অবাক হয়ে কলরবের
দিকে তাকিয়ে রইলো। কুহু একবার নিজের ছবিটার
দিকে তাকাচ্ছে, আরেকবার কলরবের দিকে। সে
সম্মোহিত হয়ে কলরবের কথা গুলো মনে মনে
আওড়াচ্ছে। কলরব কুহুর দিকে একনজরে তাকিয়ে
আছে। ঘোর লাগা দৃষ্টি নিয়ে কুহুর চোখে ডুবে
যাচ্ছে সে। কুহুর চোখে বিস্ময় দেখতে পাচ্ছে
সে।
চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here