সংগোপনে’ পর্ব-৩

0
2329

#সংগোপনে
#ধারাবাহিক_পর্ব_৩
#অচিন_পাখি_কলমে_ভাগ্যলক্ষ্মী_দাস

আগের পর্বের পর————-

মূল প্রবেশ দ্বারের সামনে এসে কলিংবেল বাজাল কুহেলি, অল্পক্ষণের মধ্যেই দরজাটা খুলে গেল। যিনি দরজাটা খুলে দিলেন তার চোখে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি, দেখেই বোঝা যাচ্ছে ইনি ভৃত্য স্থানীয়। কুহেলির ঠোঁটে মিষ্টি হাসিটা লেগেই ছিল, ভিতরের ব্যক্তিটির দিকে তাকিয়ে বলল,

আমাকে মিস্টার শর্মা ডেকেছেন, আমি ওনার এম্প্লয়ী।

ভিতরের লোকটিও একগাল হেসে ওকে ভিতরে নিয়ে গেল, বাড়ির বাইরেটা যতটা সুন্দর আর ছিমছাম ভিতরটাও ঠিক ততটাই সাজানো। মানানসই আসবাবপত্র ওয়াল পেইংটিং সবই আছে, কোনোটাই অতিরিক্ত মনে হচ্ছে না, যেন খুব যত্ন করে ভেবেচিন্তে সৌন্দর্যের সারল্যকে বজায় রেখেই সবটা সাজান হয়েছে। লোকটি কুহেলিকে হলরুমে নিয়ে এসে বলল,

ছোটবাবু বলেছিলেন আপনি আসবেন, উনি নিজের ঘরেই আছেন, সিড়ি দিয়ে উঠে দ্বিতীয় ঘরটা ছোটবাবুর, আপনি আসলে পাঠিয়ে দিতে বলেছেন।

কুহেলি হেসে ওনাকে ধন্যবাদ জানিয়ে সিড়ি দিয়ে উঠে দ্বিতীয় ঘরটার সামনে এসে দাড়াল। দরজাটা খোলাই আছে, আলেখ সোফায় বসে ল্যাপটপে খুব মন দিয়ে কিছু একটা দেখছে। কুহেলি দরজায় আলতো করে টোকা দিয়ে বলল,

মে আই কাম ইন স্যার?

আলেখ চোখ তুলে দরজার কাছে দাড়ানো কুহেলিকে দেখেই হেসে উঠে দাড়িয়ে বলল,

ওহ মিস বাসু, ইয়েস ইয়েস কাম ইন।

কুহেলি ভিতরে ঢুকলে আলেখ ওকে সোফায় বসতে বলে নিজে রুমের অন্যদিক থেকে একটা চেয়ার এনে ওর থেকে একটু দূরে বসল। কুহেলি ফাইলটা দিতেই আলেখ হেসে ওটা হাতে নিয়ে বলল,

থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ মিস বাসু। আর আমি সত্যিই দুঃখিত এইভাবে ছুটির দিনে আপনাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য।

এতে কষ্টের কিছুই নেই স্যার, কাজ টা সবার আগে। আর আপনিও তো ছুটির দিনে কাজ করছেন।

কুহেলির কথা শুনে আলেখের মুখে একটা হাসি ফুটে উঠল, জয়েন করার কয়েকদিনের মধ্যেই আলেখের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল কুহেলি। কুহেলি যে যথেষ্ট প্রতিভাবান সেটা তো বুঝতে পেরেছিলই তার সাথে এটাও বুঝেছিল কুহেলি নিজের কাজকে সবকিছুর উপরে রাখে। নিজের কাজের প্রতি এই ডেডিকেশন টাই আলেখের খুব পছন্দ হয়েছিল কোথাও যেন নিজের সাথে একটা মিল খুঁজে পেয়েছিল। আলেখ হেসে বলল,

হুম, বাট আমি তো বাড়িতে বসেই কাজ করছি আর আপনাকে আমার জন্য এই দুপুর বেলা এতটা আসতে হল।

ইটস নট এ বিগ ডীল স্যার।

তারপর রিস্টওয়াচের দিকে তাকিয়ে বলল,

ওকে, স্যার এবার আমি আসি।

আলেখ ব্যস্ত হয়ে বলল,

মিস বাসু আপনি প্রথম বার আমার বাড়িতে এলেন আর এভাবেই চলে যাবেন? আর এখন তো এমনিতেও লাঞ্চ টাইম হয়ে গেছে, যদি আপনার কোনো আপত্তি না থাকে তাহলে লাঞ্চ টা এখানে করলে আমি খুশি হব।

কুহেলি আলেখের ব্যবহারে অবাক হয়ে গেল, এত বড় একটা কোম্পানির ওনার হওয়া সত্ত্বেও মানুষটার মধ্যে কোনো অহংকার নেই, ওর মত একজন সামান্য এম্প্লয়ীকে নিজের সাথে লাঞ্চ করতে বলছেন! কুহেলিকে চুপ করে থাকতে দেখে আলেখ বলল,

মিস বাসু.. ইজ এনিথিং রং?

কুহেলি মাথা নেড়ে বলল,

নো নো স্যার।

তাহলে আমি লাঞ্চ সার্ভ করতে বলি?

না, না, স্যার আপনি ব্যস্ত হবেন না। আর আমার বাড়িতে অলরেডি লাঞ্চ রান্না করা হয়ে গেছে সেগুলো ওয়েস্ট হয়ে যাবে।

ও, তাহলে অন্তত একটু জুস খেয়ে যান।

স্যার ইটস ওকে, আমার কিছু লাগবে না, অ্যাম ফাইন।

তা বললে তো হবেনা, আমার মা বলত কেউ বাড়িতে এলে তাকে কখনও খালি মুখে যেতে দিতে নেই।

বলে আলেখ উঠে রুমের বাইরে গিয়ে একজনকে ডেকে একগ্লাস জুস আনতে বলে আবার ফিরে এসে চেয়ারে বসে বলল,

জাস্ট পাঁচ মিনিট, আপনার বেশি দেরি হবে না।

কুহেলি এবার আর কিছু না বলে শুধু হাসল, ওর মনে অন্য একটা কথা ঘুরছে। আলেখ একটু আগে ওর মায়ের কথা বলতে গিয়ে “বলত” কথাটা ব্যবহার করেছিল। জিজ্ঞেস করবে কিনা সেটা ভাবছিল, কিন্তু আলেখ যতই সহজ ব্যবহার করুক না কেন পরিশেষে সে কুহেলির বস। ওকে অন্যমনস্ক দেখে আলেখ বলল,

মিস বাসু, কিছু ভাবছেন?

কুহেলি আলেখের দিকে তাকিয়ে সাহস করে প্রশ্নটা করেই ফেলল। এই একটা বড় বাজে স্বভাব ওর, একবার একটা কিছু জানার কৌতুহল হলে সেটা না জানা পর্যন্ত ওর শান্তি হয় না।

স্যার একটা কথা জিজ্ঞেস করব?

শিওর।

আপনার মা…..

প্রশ্নটা পুরো শেষ হওয়ার আগেই আলেখের মুখ থেকে হাসিটা হঠাৎ মিলিয়ে গেল, সেটা দেখে কুহেলির মনে হল ওর এই প্রসঙ্গ টা তোলা ঠিক হয়নি। মাথাটা নীচু করে বলল,

অ্যাম সরি স্যার, আমার এভাবে আপনাকে পার্সোনাল কোয়েশ্চেন করাটা উচিৎ হয়নি।

নো মিস বাসু, আপনার সরি বলার কোনও প্রয়োজন নেই।

তারপর কিছুক্ষণ মেঝের দিকে একটা শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে আলেখ বলল,

মাকে আমি খুব ভালোবাসতাম…না, এখনও বাসি। ইউ নো মিস বাসু, আমার তখন মাত্র তেরো বছর বয়স। আমাদের ছোট্ট ফ্যামিলিটায় খুশির কোনও অভাব ছিল না, কিন্তু হঠাৎ করে কোথা থেকে যে কি হয়ে গেল। মায়ের শরীরটা হঠাৎ করেই বিগড়াতে শুরু করল, ডক্টর দেখানো হল, ডক্টর বললেন….

এত অবধি বলে আলেখ থামল, ওর মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে কথাগুলো বলতে ওর খুব কষ্ট হচ্ছে। কুহেলির খুব খারাপ লাগছে, ওর এই অকারণ কৌতূহলের জন্য আলেখ কষ্ট পাচ্ছে। আলেখ নিচের দিকে তাকিয়েই কথাগুলো বলছে, আবার বলা শুরু করল।

ডক্টর বললেন লিভার ক্যান্সার, লাস্ট স্টেজ। ড্যাড ট্রিটমেন্টের কোনও অভাব রাখেনি, কিন্তু কিছু করার ছিল না। দেখতে দেখতে চার মাসের মধ্যে মা….

কথাটা আর শেষ করতে পারল না আলেখ, কুহেলি লক্ষ্য করল আলেখের চোখ দুটো ছলছল করছে। আপনজনকে হারানোর দুঃখটা ঠিক না বুঝলেও আপনজনের অভাবটা ও ঠিকই বোঝে। চৈতালী দেবী আর শৈলজা দেবী কোনোদিনই ওকে অরিন্দম বাবুর অভাব বুঝতে দেননি ঠিকই কিন্তু কোথাও যেন বাবার জায়গাটা শূন্যই থেকে গেছে। বাবার কথা মনে হতেই কুহেলির চোখদুটোও ভিজে এল। আলেখ নিজেকে সামলে নিয়ে কুহেলির দিকে তাকিয়ে দেখল ওর চোখে জল, খুব শান্ত স্বরে আলেখ বলল,

মিস বাসু, ডোন্ট ফিল সরি ফর মি।

কুহেলি চট করে চোখের জলটা মুছে নিল। ওকে যিনি দরজা খুলে দিয়েছিলেন সেই লোকটি একটা ট্রে তে করে একগ্লাস জুস এনে কুহেলির সামনের সেন্টার টেবিলটার উপরে রেখে চলে গেলেন। জুসের রং টা দেখে একটু খটকা লাগল, গ্লাসটা হাতে নিয়ে মুখের কাছে আনতেই বুঝতে পারল এটা পাইনঅ্যাপেল জুস। কুহেলি পড়ল মহা সমস্যায়, পাইনঅ্যাপেলে ওর সাংঘাতিক অ্যালার্জি, কিন্তু এখন এই পরিস্থিতিতে ওর কিছু বলতেও কেমন একটা লাগছে। আলেখের মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে এখনও যথেষ্ট আপসেট। এমনিতেই অকারণে এরকম একটা সংবেদনশীল প্রসঙ্গ টেনে আনার জন্য নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে। কিন্তু এই জুসটা খাওয়া মানে ওর কাছে বিষ খাওয়ার সমান। আলেখ লক্ষ্য করল কুহেলি গ্লাসটা হাতে নিয়ে বসে আছে, খাচ্ছে না।

মিস বাসু?

কুহেলি একমনে ভাবছিল জুস টা নিয়ে কি করা যায়, তাই আলেখের প্রথম ডাকটা শুনতে পায় নি, আলেখ যখন দ্বিতীয়বার আরেকটু জোরে ডাকল তখন চমকে উঠে জবাব দিল,

ইয়েস স্যার।

ইস দেয়ার এনি প্রবলেম?

নো, নো, নাথিং।

তাহলে জুস টা তাড়াতাড়ি খেয়ে নিন, নাহলে ওটা গরম হয়ে যাবে।

কুহেলি আর কিছু না ভেবে চোখ বন্ধ করে জুস টা খেয়ে নিল, এক নিশ্বাসে পুরোটা শেষ করে গ্লাসটা টেবিলে নামিয়ে রেখেই কুহেলি উঠে দাড়াল।

ওকে স্যার, এবার আমি আসি।

বলেই কুহেলি রুম থেকে বেরোনোর জন্য পা বাড়াল, কিন্তু আলেখের ডাকে থেমে যেতে হল।

ওয়েট মিস বাসু।

কুহেলি থেমে পিছন ফিরল, আলেখ ওর গাড়ির চাবিটা বের করতে করতে বলল,

আই উইল ড্রপ ইউ।

কুহেলি ব্যস্ত হয়ে বলল,

না, না, স্যার, তার কোনো দরকার নেই। আমি এমনিই চলে যেতে পারব। আপনাকে শুধু শুধু কষ্ট করতে হবে না।

আপনি আমার এক কথায় অফ ডে তেও এতটা দূর এলেন, আর আমি এইটুকু করব না। আমি আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসছি অ্যান্ড দ্যাটস ফাইনাল।

বলে কুহেলির উত্তরের অপেক্ষা না করেই আলেখ রুম থেকে বেরিয়ে গেল। কুহেলিও আর কথা না বাড়িয়ে আলেখের পিছন পিছন বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল। কুহেলিকে একটু দাড়াতে বলে আলেখ গাড়ি আনতে চলে গেল, একটুপরেই একটা ব্ল্যাক এক্স ইউ ভি এসে ওর সামনে দাড়াল। কুহেলি একটু ইতস্তত করে উঠে পড়ল, আলেখ ওর অ্যাড্রেস টা জেনে নিয়ে গাড়ি স্টার্ট করল। এসি গাড়িতে বসেও কুহেলির কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে শুরু করল, জুস নিজের প্রতিক্রিয়া দিতে শুরু করেছে। শরীরটা খারাপ হতে শুরু করেছে, আলেখের মন ড্রাইভিং এর দিকে তাই পাশে বসা কুহেলির মুখে ফুটে ওঠা অস্বস্তিটা ওর নজরে আসেনি। প্রায় পঁচিশ মিনিট পর যখন গাড়িটা ওর অ্যাপার্টমেন্টের সামনে দাড়াল তখন কুহেলির শরীরটা অনেকটাই খারাপ, কিন্তু ও সেটা আলেখকে বুঝতে না দিয়ে গাড়ি থেকে নেমে দাড়াল। আলেখও গাড়ি থেকে নেমে এসে কুহেলির সামনে দাড়াল, এতক্ষণ ওর দিকে তাকায়নি কিন্তু এবার ওকে দেখে মনে হল ওর কিছু একটা অসুবিধা হচ্ছে। ব্যস্ত হয়ে বলল,

মিস বাসু আর ইউ অলরাইট?

অ্যাম ফাইন স্যার, থ্যাঙ্কস আমাকে পৌঁছে দেওয়ার জন্য। অনেক বেলা হয়ে গেছে, আপনি এবার বাড়ি যান।

কুহেলিকে দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে ওর কোনও একটা সমস্যা হচ্ছে, কিন্তু সেটা ও আলেখকে বলতে চাইছে না, হয়তো সংকোচ বোধ করছে মনে করে আলেখ আবার জিজ্ঞেস করল।

আর ইউ শিওর মিস বাসু? মানে, আপনাকে দেখে….

আলেখের কথার মাঝখানেই কুহেলি বলে উঠল,

ইয়েস স্যার অ্যাম শিওর, কিছু হয়নি আমার।

আলেখ আর কথা বাড়াল না, কুহেলিকে বাই বলে গাড়ি ঘুরিয়ে চলে গেল। কুহেলি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নিজের ফ্ল্যাটে এসে দৌড়ে ওয়াশরুমে গেল, পেটে অলরেডি অসহ্য যন্ত্রণা শুরু হয়ে গেছে। বেসিনের কাছে পৌঁছেই অনেকটা বমি করল, সারা শরীরে ইচিংও শুরু হয়ে গেছে। জামাটা বদল করে ঠান্ডা জলে বেশ কিছুক্ষণ শাওয়ার নিল, তারপর ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এসিটা অন করে শুয়ে পড়ল। একটু পরেই আবার বমি পেল, এবার ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে ওষুধটা খেয়ে নিল। অ্যালার্জির ওষুধ ওর কাছে সবসময় থাকে, ওষুধটা খেয়ে সব রান্না গুলো ফ্রিজে রেখে দিল, এই মুহূর্তে কিছুই খেতে পারবে না। ছোট বেলায় তো এই অ্যালার্জির জন্য ওকে নার্সিংহোমে ভর্তি করাতে হয়েছিল, তারপর থেকে এই আনারস বস্তুটাকে এড়িয়ে চলে। কিন্তু তাও মাঝেমধ্যে দুএকবার অসাবধানতা বশত খেয়ে ফেলেছিল, তাই এখন ওষুধটা ও সবসময় ঘরে রেখে দেয়। ওষুধটা খেয়ে কুহেলি চুপচাপ শুয়ে পড়ল, একটু ঘুমানোর চেষ্টা করল কিন্তু পেটটা বড্ড ব্যথা করছে কিছুতেই ঘুমাতে পারল না। ওষুধে কাজ দিতে একটু সময় তো লাগবেই, কুহেলি কোনরকমে বিছানা আঁকড়ে শুয়ে থাকল। সন্ধ্যের দিকটায় পেট ব্যথাটা অনেকটা কমে এল, ইচিং টাও কম, অল্প অল্প হচ্ছে, কিন্তু একটু পর পর বমিটা হয়েই যাচ্ছে। এবার কুহেলি চিন্তায় পড়ল, এর আগেও এরকম হয়েছে কিন্তু এতবার বমি হয়নি। মোবাইলটা হাতে নিয়ে ওর স্কুলফ্রেন্ড প্রীতিশাকে ফোন করল, প্রীতিশা মেডিকেল পড়ার পর ওর বাবার নার্সিং হোমেই প্র্যাকটিস করছে। প্রথমবার ফুল রিং হয়ে গেলেও ফোনটা রিসিভ হল না, দ্বিতীয় বার দুবার রিং হওয়ার পরেই কলটা রিসিভ হল।

আরে, কুহু কেমন আছিস? আমি তো স্ক্রীনে তোর নাম দেখে চমকে গিয়েছিলাম রে।

ভাল আছি প্রীতি, তুই কেমন আছিস?

এই তো চলছে, বাট তুই এরকম লো সাউন্ড করছিস কেন?

কুহেলি সবটা ওকে খুলে বলল, শুনে প্রীতিশা বলল,

চিন্তা করিস না, তুই যে মেডিসিন টার নাম বললি ওটা বেস্ট মেডিসিন। আর বমির ব্যাপারটা নিয়েও টেনশনের কোনো কারণ নেই, এরকম অনেকসময় হয়, কখনও কখনও রিয়্যাকশন টা স্ট্রং হয়ে যায়। তুই রাতে আরেকবার ওষুধটা খেয়ে নিবি, আর হ্যা, খালি পেটে থাকবি না।

হুম।

তা তুই জানিস যখন তোর অ্যালার্জি আছে তখন খেতে গেলি কেন?

কুহেলি গোটা পরিস্থিতি টা প্রীতিশাকে বুঝিয়ে বলল, সবটা শোনার পর প্রীতিশা বলল,

হুম, রবিবারের দুপুর বেলা বসের বাড়ি, দারুন ইন্টারেস্টিং ব্যাপার তো।

ব্যাস, অমনি শুরু হয়ে গেলি?

আরে বল না, দেখতে কেমন রে?

প্রীতি!!

বল না।

কুহেলি জানে প্রীতিশাকে না বলা অবধি ও ছাড়বে না, তাই বলল,

ভালোই।

বয়স কত?

জানি না, তুই এসব ফালতু কথা বাদ দিবি?

কুহু, এরকম করছিস কেন? বল না।

আমি সত্যিই জানি না, তবে ওই সাতাশ আঠাশ হবে হয়তো।

ব্যাচেলার?

হুম।

ওয়াও, এ তো দারুন ব্যাপার। সত্যি করে বলতো কি চলছে?

শাট আপ প্রীতি। খালি উল্টো পাল্টা কথা, তুই তো জানিস আমি ওসব মোটেই পছন্দ করি না, আর স্যারও নিজের কাজ ছাড়া অন্যদিকে মাথা ঘামান না, ইনফ্যাক্ট এই ছুটির দিনেও বসে কাজ করছিলেন।

জানি জানি, কি যে এত কাজ কাজ করিস কে জানে? তোর কথা শুনে তো মনে হচ্ছে যেমন তুই তেমন তোর বস।

প্রীতি!!

ওকে, ওকে, আর কিছু বলছি না। তুই মনে করে ওষুধ টা খেয়ে নিস।

ওকে, বাই।

বাই।

প্রীতিশার কথা মত রাতে অল্প দুটো ভাত খেয়ে ওষুধ খেয়ে শুয়ে পড়ল। সকালে যখন অ্যালার্মের আওয়াজে ঘুম ভাঙ্গল তখন পেট ব্যাথা বা ইচিং কোনোটাই নেই, রাতে বমিটাও আর হয়নি। কিন্তু খুব দূর্বল লাগছে, এতবার বমি হওয়ায় শরীরটা দুর্বল হয়ে গেছে। কুহেলি বিছানা থেকে নেমে ওয়াশরুমে গিয়ে স্নান সেরে এসে রেডি হয়ে নিল, অফিসের ব্যাগটা গুছিয়ে নিচ্ছিল তখন গীতা এসে বলল,

আক্কা, ফ্রিজে দেখছি সব রান্নাই ধরা রয়েছে, তুমি কালকে খাওনি?

না গো গীতা দি, শরীরটা ভালোলাগছিল না।

কেন গো?

ওই একটু বমি হচ্ছিল।

গীতা ব্যস্ত হয়ে বলল,

সেকি, তুমি ডাক্তার দেখিয়েছ?

ওষুধ খেয়েছি গীতা দি, আর এখন আমি একদম ফাইন।

ঠিক বলছ তো?

একদম ঠিক, তুমি চিন্তা করো না। আমাকে ঝটপট ব্রেকফাস্ট টা দাও, নাহলে আবার দেরী হয়ে যাবে।

আচ্ছা, তুমি পাঁচ মিনিট দাড়াও আমি এক্ষুনি তৈরি করে দিচ্ছি। একটু পরেই গীতা একবাটি কর্নফ্লেক্স এনে ওকে দিল, কুহেলি তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করে অফিসের জন্য বেরিয়ে পড়ল। আজকে থেকে ওর প্রজেক্টের কাজটা শুরু হবে, অনেক কাজ এখন ওর। অফিসে কাজের মধ্যে সারাটা দিন যে কোথা থেকে বেরিয়ে গেল কুহেলি টের পেল না। দেখতে দেখতে অফিস ফাঁকা হয়ে এল, রুহিও একসময় চলে গেল, ওকেও যেতে বলেছিল কিন্তু হাতের কাজটা অসম্পূর্ণ রেখে কুহেলি যায় নি। কাজ শেষ করে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল ছটা বাজে, ব্যাগটা গুছিয়ে চেয়ার থেকে উঠে দাড়াতে গিয়ে মাথাটা কেমন যেন ঘুরে গেল, শরীরটা সত্যিই বড্ড দুর্বল লাগছে। একটুক্ষণ দাড়িয়ে বেরোনোর জন্য পা বাড়াতে গিয়ে দেখল আলেখের কেবিনে আলো জ্বলছে, তার মানে এখনও আলেখ অফিসেই আছে। হঠাৎ কুহেলির মনে হল এখন যদি ছুটির কথাটা বলা যায় তাহলে ভালো হয়, কেবিনের সামনে এসে দরজায় নক করল। ভিতর থেকে আওয়াজ এল,

কাম ইন।

কুহেলি দরজাটা ঠেলে ভিতরে ঢুকতেই আলেখ হেসে বলল,

মিস বাসু আপনি, আসুন। এখনও যাননি?

এই বেরোচ্ছিলাম।

ও, হ্যাভ এ সিট।

কুহেলি একটা চেয়ার টেনে বসল, তারপর একটু ইতস্তত করে বলল,

স্যার, আমার একটা কথা বলার ছিল।

শিওর, বলুন।

আসলে সামনের মাসে আমার কয়েকদিনের ছুটির প্রয়োজন।

হঠাৎ?

অ্যাকচুয়ালি আমার মামার বিয়ে, আর বাড়ি থেকে বারবার বলছে যাওয়ার জন্য। আমি ওদের বোঝানোর চেষ্টা করেছি যে এই মুহূর্তে আমার পক্ষে ছুটি নেওয়াটা পসিবল নয় কিন্তু ওরা শুনতে চাইছে না। বাট স্যার তেমন প্রবলেম হলে আমি ওদের আবার বুঝিয়ে বলব।

আলেখ একটু ভেবে বলল,

না, তার দরকার নেই। আচ্ছা, বিয়েটা কবে?

নেক্সট মন্থের চার তারিখ।

ওকে, ইউ ক্যান গো বাট, ওনলি ফর ফাইভ ডেয়স। তার বেশি আমি অ্যাল্যাও করতে পারব না।

থ্যাঙ্ক ইউ স্যার।

ওয়েলকাম, আপনি একটা লিভ অ্যাপ্লিকেশন কালকে অঙ্কিতের কাছে দিয়ে দেবেন।

ওকে স্যার।

চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়িয়ে কুহেলি আলেখকে আরও একবার থ্যাঙ্কস বলে গুডনাইট জানিয়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে আসছিল। পিছন থেকে আলেখ বলে উঠল,

মিস বাসু, আর ইউ ফাইন নাও?

কুহেলি অবাক হয়ে পিছন ফিরল, ওর অবাক ভাবটা দেখে আলেখ হেসে বলল,

মিস বাসু, এত অবাক হওয়ার কিছু নেই। কালকে আপনাকে দেখে যে কেউ বলতে পারত, আপনার শরীরটা ভাল ছিল না, কিন্তু একটা ব্যাপার বুঝতে পারিনি, আপনি যখন আমার বাড়িতে গেলেন তখন আপনি একদম ফিট ছিলেন তাহলে হঠাৎ করে কি হয়েছিল?

কুহেলি একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল, একটু হেসে বলল,

কিছু না স্যার, এমনিই একটু শরীরটা খারাপ লাগছিল।

দেন, এখন ঠিক আছেন?

ইয়েস স্যার।

ওকে, তাহলে এবার বেরিয়ে পড়ুন, আমিও আর একটু পরেই বেরোব।

ওকে স্যার।

কুহেলি অফিস থেকে বেরিয়ে সোজা বাড়ি চলে এল, ফ্রেশ হয়ে সবার আগে একটা লিভ অ্যাপলিকেশন টাইপ করে অঙ্কিত কে মেল করে দিল। তারপর প্রজেক্টের কিছু কাজ নিয়ে বসল, কাজ করতে করতেই ডিনারের টাইম হয়ে গেল। ল্যাপটপটা বন্ধ করে উঠে ডিনারটা সেরে এসে বাড়িতে একটা ফোন করে ওর ছুটির খবরটা জানিয়ে দিল। চৈতালী দেবী তো শুনে ভীষন খুশি, কিছুক্ষণ গল্প করার পর কুহেলি লাইটটা অফ করে শুয়ে পড়ল। এখনও তেমন রাত হয়নি, এক্ষুনি ঘুম আসবে না তাই শুয়ে শুয়েই একটু ফেসবুকে ঢু মারল। এটা সেটা দেখার পর মেসেঞ্জার টা ওপেন করল, সবার ওপরে দেবার্ঘ্য মিত্র নামটা শো করছে। শেষ ওর সাথেই কথা হয়েছিল, নামের পাশের সবুজ বিন্দুটা জ্বলে রয়েছে, কুহেলি কি মনে করে চ্যাট টা ওপেন করল, আর ঠিক তার সঙ্গে সঙ্গেই একটা মেসেজ ফুটে উঠল স্ক্রীনে।

“কেমন আছ?”

কুহেলি মনে মনে ভাবল,

আমার অন হওয়ার অপেক্ষা করছিল নাকি!

তারপর হালকা হাতে টাইপ করল,

“ভালো আছি, আপনি?”

ওপার থেকে উত্তর আসতে কালমাত্র বিলম্ব হল না।

“ভাল, তুমি ছুটি পেলে?”

“হ্যা, তবে পাঁচদিন।“

“আমিও খুব বেশিদিনের ছুটি পাইনি, এক সপ্তাহ।“

“হুম।“

“কবে যাবে?”

“তিন তারিখ।“

“ও, আমি এক তারিখেই চলে যাচ্ছি।“

“হুম, আপনার তো অনেক কাজ, আপনাকে তো আগে যেতে হবেই।“

“হুম”

বেশ কিছুক্ষণ আর কোনো মেসেজ এল না, কুহেলিরও এবার ঘুম পাচ্ছিল। গুড নাইট টাইপ করে সেন্ড করতে যাবে তার আগেই ওপার থেকে একটা মেসেজ এল।

“আচ্ছা, আজ খুব ঘুম পাচ্ছে। আবার পরে কথা হবে, গুডনাইট।“

কুহেলি ওর টাইপ করা গুডনাইট টা সেন্ড করে ডেটা কানেকশনটা অফ করে পাশে রেখে দিল। ঘুমে চোখের পাতা দুটো ভারী হয়ে এসেছে, চোখটা বন্ধ করার একটু পরেই কুহেলির দুচোখ জুড়ে ঘুম নিজের রাজ্য বিস্তার করে বসল। এরপর দেখতে দেখতে কেটে গেল কুড়িটা দিন, অফিসে কাজের চাপ যথেষ্ট, কুহেলি পাঁচদিন থাকবে না, তাই যতটা পারছে কাজগুলো এগিয়ে রেখেছে, প্রায় রোজই ওভারটাইম কাজ করে ওর কাজ অনেকটাই গুছিয়ে নিয়েছে। আজকে বাকিটুকু গুছিয়ে নিলেই আর অসুবিধা হবে না, পাঁচটা দিন ম্যানেজ হয়ে যাবে। এই কুড়িদিনে মাঝে মধ্যেই দেবার্ঘ্যর সাথেও টুকটাক কথা হয়েছে, এখন ওরা আগের থেকে অনেকটাই সহজ হয়েছে। দেবার্ঘ্য গতকাল শিলিগুড়ি চলে গেছে, চৈতালী দেবী কুহেলিকেও আজকে যেতে বলেছিলেন কারণ বিয়েটা শিলিগুড়িতে হবে আর বাসে করে সেখানে পৌছতে অনেকটা সময় লাগবে, প্রায় বারো তেরো ঘণ্টা। তাই সবাই আজকে রাতেই রওনা হয়ে যাবে। কিন্তু কুহেলি রাজি হয়নি, ওর উপায় নেই, তাই চৈতালী দেবীকে ওর জন্য বিয়েবাড়িতে পরার মত কিছু জামা কাপড় সঙ্গে নিয়ে নিতে বলেছে, আর ও নিজের সঙ্গে কিছু সাধারণ জামা কাপড় নিয়ে নেবে। এখান থেকে সোজা বাগডোগরার ফ্লাইট ধরবে বলে ঠিক করেছে, দেবার্ঘ্য বলেছে ও এয়ারপোর্টে ওকে নিতে আসবে। কুহেলি তাড়াতাড়ি করে কাজগুলো গুছিয়ে নিচ্ছিল, এই কটাদিন আগামীর কাজ গুলো এগিয়ে রাখার জন্য বাড়িতেও অনেক রাত অবধি কাজ করেছে, তাই প্যাকিংটা এখনও করে উঠতে পারেনি। অবশেষে সব কাজ সেরে যখন বেরচ্ছে তখন অলরেডি সাড়ে ছটা, লিফটের কাছে এসে বাটন প্রেস করে ওয়েট করতে লাগল, লিফট আসার আগে আলেখ এসে ওর পাশে দাঁড়াল। ওকে দেখে কুহেলি একটু হাসল।

আপনিও এখনও যাননি?

না। সো মিস বাসু কালকে রওনা হচ্ছেন তো?

ইয়েস স্যার।

হুম, খুব এনজয় করবেন, তবে পাঁচদিন পরে কিন্তু ফিরে আসতে হবে। একদিনও যেন বেশি না হয়।

কুহেলি হেসে বলল,

ডোন্ট ওয়ারি স্যার ছদিনের দিন আপনি আমাকে অফিসে দেখতে পাবেন।

ওদের কথার মধ্যেই লিফট এসে গেল, দুজনে নেমে এল নিচে। আলেখ কুহেলিকে বলল,

মিস বাসু, আসুন আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দিচ্ছি।

না, না, স্যার। আমার ক্যাব এসে গেছে প্রায়।

ওকে দেন, গুডনাইট।

গুডনাইট স্যার।

আলেখ চলে যাওয়ার একটু পরেই কুহেলির ক্যাব এসে গেল। কুহেলি ফ্ল্যাটে ফিরে ফ্রেশ হয়ে আগে ওর প্যাকিং সেরে নিল, তারপর ঘরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা জিনিসপত্র গুলো গুছিয়ে রেখে বাড়িতে ফোন করে কিছুক্ষণ কথা বলল। তারপর একটু আগে আগেই ডিনার টা সেরে শুয়ে পড়ল। গত কয়েকদিন খাটাখাটনি টা একটু বেশিই হয়ে গেছে, আর আজকে তো কথাই নেই। যে পাঁচটা দিন থাকবে না, সে কদিনের সবটুকু কাজ ও সেরে রেখে এসেছে, শরীরের ক্লান্তি ঘুম হয়ে নেমে এল চোখে।

ক্রমশ__________

© স্বত্ব সংরক্ষিত

কেমন লাগছে নতুন ধারাবাহিক সংগোপনে? আমাকে জানাবেন কিন্তু। বিয়েবাড়িতে দেবার্ঘ্যর সাথে প্রথম দেখা হবে কুহেলির। কি মনে হয়, কেমন হবে সেই প্রথম সাক্ষাৎ? কমেন্টে জানাবেন কিন্তু। আবার দেখা হবে আগামী পর্বে। ততদিন পর্যন্ত পড়তে থাকুন ভালো থাকুন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here