সংগোপনে’ পর্ব-১৬

0
1874

#সংগোপনে
#ধারাবাহিক_পর্ব_১৬
#অচিন_পাখি_কলমে_ভাগ্যলক্ষ্মী_দাস

আগের পর্বের পর————-

সকালে ঘুম থেকে উঠে নিজেকে বেশ ফ্রেশ মনে হল কুহেলির। কালকেই ঠিক করে নিয়েছে অযথা বেশি ভাবনা চিন্তা আর করবে না, একবার যখন একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে তখন পরিস্থিতি যখন যেমন হবে তখন সেই অনুযায়ী পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে ভাবা যাবে। কুহেলি সত্যিই মানসিক ভাবে খুবই স্থির, এত সহজে যেকোনো পরিস্থিতির সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা বোধহয় সবার থাকে না। যথারীতি কুহেলি তৈরি হয়ে ঠিক সময়মত অফিসে পৌঁছে গেল, আসার সময় গীতা কে বলে এসেছে রাতের খাবার রান্না করার দরকার নেই। অফিসে এখন নতুন প্রজেক্ট নিয়ে সবাই ব্যস্ত, নতুন প্রোডাক্টের মার্কেট মনিটর করার জন্য আলাদা একটা টিম তৈরি করা হয়েছে, তাই সেদিকে কুহেলির কোনও দায়িত্ত্ব নেই। এখন ওর পুরো মনোযোগ নতুন প্রজেক্টের দিকে। অফিসে এসেই কুহেলি নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল, আলেখও সময়মত অফিসে এল। ওকে আসতে দেখে সবাই উঠে দাড়িয়ে ওকে গুডমর্নিং উইশ করল, কুহেলিও। আলেখও খুব স্বাভাবিক ভাবেই প্রতিদিনের মত সবাইকে গুডমর্নিং উইশ করে নিজের কেবিনে চলে গেল। ব্যাস, এইটুকুই, সারাদিনে দুজনের কথা তো দূর দেখাও হল না, যে যার কাজে ডুবে রইল। আজ আবার রুহি আসেনি, বিদিশাকে জিজ্ঞেস করে কুহেলি জানতে পারল রুহির মায়ের শরীরটা হঠাৎ করেই খুব খারাপ হয়ে পড়েছে তাই আজ রুহি আসতে পারেনি। মিস্টার শেট্টি কে ফোন করে জানিয়েছে, লাঞ্চ ব্রেকে কুহেলি রুহিকে একবার ফোন করে কথা বলে নিয়েছে। গলার স্বর শুনেই কুহেলির মনে হয়েছিল মেয়েটা বড্ড চিন্তায় রয়েছে, কিছুক্ষণ কথা বলে ওর চিন্তা টা একটু কমানোর চেষ্টা করেছে। লাঞ্চের পর নিজের কাজের সাথে সাথে কুহেলি রুহির কাজও অনেকটা এগিয়ে রাখল। রুহি সুযোগ পেলেই ওর সাধ্যমত কুহেলিকে সাহায্য করে, তাই এইটুকু তো ওর জন্য করাই যায়। সব কাজ সারতে সারতে অফিস আওয়ার পেরিয়ে গেল, কাজের মধ্যে একবার ডুবে গেলে কুহেলির আর কোনও দিকে খেয়াল থাকে না। ধীরে ধীরে অফিস ফাঁকা হয়ে এল, একসময় কুহেলি কি মনে করে একবার ঘড়ির দিকে তাকাল, সময় দেখে একলাফে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়াল। পাচটা পঞ্চাশ! আজ রাতে আটটার সময় ওকে ওঙ্কার ভিলায় যেতে হবে, এখনও অফিসে বসে থাকলে কখন বাড়ি যাবে কখন তৈরি হবে আর কখন যাবে! তড়িঘড়ি নিজের ব্যাগটা গুছিয়ে নিয়ে ক্যাব বুক করতে করতে নিচে নেমে এল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ক্যাব বুক করার আর প্রয়োজন হল না, কারনটা সহজেই অনুমেয়। আলেখ গাড়িতে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে আছে, কুহেলিকে দেখে দরজাটা খুলে দিল, কুহেলিও বিনা বাক্যব্যয়ে গাড়িতে উঠে পড়ল। আলেখ দরজাটা বন্ধ করে নিজে ড্রাইভিং সিটে উঠে গাড়ি স্টার্ট করল। কালো এক্স ইউ ভি টা এগিয়ে চলেছে কুহেলির অ্যাপার্টমেন্টের উদ্দেশ্যে, আলেখ ড্রাইভ করতে করতে বলল,

আজকে তো খুব একটা ওয়ার্কলোড ছিল না, তাহলে এত দেরী হল?

আসলে রুহি আজ আসতে পারেনি, ওর মায়ের শরীরটা ভালো না। তাই ওর কাজ গুলো একটু এগিয়ে রাখছিলাম, তাতেই একটু লেট হয়ে গেল।

আলেখ কিছু বলল না, শুধু একটু হাসল। কুহেলি বুঝতে পারল না, এতে আলেখ ঠিক কি মনে করল। আজকের দিনটা ওদের দুজনের কাছেই খুব গুরুত্বপূর্ণ, আর আজকেই ও দেরী করল। যদিও কাজের জন্যই দেরী হয়েছে, তাও… ওর জন্য কতক্ষন আলেখ অপেক্ষা করেছে। কুহেলি একটু থেমে বলল,

আপনি তো চলে যেতে পারতেন, শুধু শুধু আমার জন্য এতক্ষণ ওয়েট করলেন, কতটা লেট হয়ে গেল।

আলেখ একবার কুহেলির দিকে তাকিয়ে আবার রাস্তার দিকে তাকিয়ে হেসে বলল,

আমার লেট হচ্ছে না, তবে এখন যদি আপনাকে পৌঁছে না দিই তাহলে হয়তো ডিনারের জন্য নির্ঘাৎ লেট হত। আমি তো আরেকটু হলেই আপনাকে কল করতে যাচ্ছিলাম, আপনার কতক্ষন ওভারটাইম করার ইচ্ছে ছিল সেটা তো ঠিক জানা ছিল না তাই নিজেই একটা টাইম ঠিক করে নিয়েছিলাম, সেটা ক্রস করে গেলেই আপনাকে কল করতে বাধ্য হতাম।

আলেখের বলার ভঙ্গী শুনে কুহেলি হেসে ফেলল, মনে মনে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাসও নিয়ে নিল। আলেখ রাগ করেনি, রাগ করলেও কুহেলির কিছু বলার ছিল না। আলেখ কুহেলিকে ওর অ্যাপার্টমেন্টের সামনে নামিয়ে দিয়ে বলল,

আপনার এতদিনের ট্র্যাক রেকর্ড দেখে আর আলাদা করে বলার প্রয়োজন হয় না, কিন্তু তাও বলছি, ড্যাড খুব পাঞ্চুয়াল। আটটার আগে পৌঁছালে কোনও সমস্যা নেই কিন্তু যদি এক মিনিটও লেট হয় তাহলে ড্যাড অসন্তুষ্ট হবে। আমি ঠিক সাড়ে সাতটায় আপনাকে নিতে আসব, আশা করি তার মধ্যে আপনি তৈরী হয়ে নিতে পারবেন।

কুহেলি একটু ইতস্তত করে বলল,

আমি বলছিলাম কি, আপনার আর আমাকে নিতে আসতে হবে না, আমি একাই চলে যেতে পারব। আসলে আপনি এখন এতটা যাবেন, আবার আসবেন, তাই…..

কুহেলিকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে আলেখ বলল,

ওটা নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না, আপনি শুধু সাড়ে সাতটার সময় রেডি থাকবেন।

কুহেলি আর কিছু বলতে পারল না, আলেখ একটু হেসে চলে যেতেই কুহেলি ঝটপট নিজের ফ্ল্যাটে উঠে এল। হাতে খুব বেশি সময় নেই, তাড়াতাড়ি করে স্নান সেরে তৈরি হতে বসল। কিন্তু প্রথমেই পড়ল মহা সমস্যায়, কি পরবে সেটাই ভেবে পাচ্ছে না। এখানে ওর ওয়ার্ডরোব ভর্তি ফরমাল ড্রেস, আর নাহলে একদমই ক্যাজুয়াল। এইরকম একটা ডিনারে এইগুলোর কোনোটাই পরা যায় না, কলকাতার বাড়িতে কত রকমের পোশাক রয়েছে। কিন্তু এখন সেকথা ভেবে কি লাভ! শেষে জামাকাপড় ঘাটতে ঘাটতে একটা লং আনারকলি স্টাইলের সালোয়ার নজরে এল। বেশ কয়েক বছর আগে কেনা, তখন খুব ট্রেন্ডিং ছিল এই স্টাইল টা, এখনও যে পুরনো হয়ে গেছে তা নয়। যেবার পুজোয় বাড়ি যেতে পারেনি, সেইবার চৈতালী দেবী এটা পাঠিয়েছিলেন। ভাগ্যিস পাঠিয়েছিলেন! অন্য কোনও বিকল্প নেই তাই এটাই পরে নিল, প্রথমে তো ভাবছিল কয়েক বছর আগের ড্রেস এখন হবে কিনা। সেই চিন্তাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে সালোয়ার টা পারফেক্ট ফিট হল। এথনিক ওয়ার এমনিই কুহেলির খুব পছন্দের, তারমধ্যে এই ধরনের আনারকলি স্টাইলের সালোয়ার গুলো আরও ভালোলাগে, সময়ের অভাবে পরাই হয় না। সাজতে কুহেলির ভালোই লাগে, তবে উগ্র নয়, আর আজকে খুব বেশি সাজার প্রশ্নই ওঠে না। ড্রেস টা পরে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে হালকা করে একটু লিপস্টিক লাগাল, লাইনার পেন দিয়ে গাঢ় কালো রঙের সরু রেখায় চোখ দুটো একে নিল। কপালে একটা টিপ পরার ইচ্ছে ছিল কিন্তু ওর কাছে টিপের কোনও চিহ্ন মাত্র নেই, আর ওই লাইনার দিয়ে টিপ পরতে ওর ভালোলাগে না। কানে ছোট ছোট দুটো অক্সিডাইসের ঝুমকো পরল, গলায় একটা সরু সিলভার চেনের সঙ্গে ছোট্ট একটা লকেট পরে নিল। সালোয়ার টা ফুল স্লিভ তাই হাতে কিছু পরল না, শুধু বা হাতের কব্জিতে ওর সর্বক্ষণের সঙ্গী ঘড়িটাকে বেঁধে নিল। চুলটা খোলাই রাখল। শেষে একটু সুগন্ধির ছোয়া মেখে যখন সোজা হয়ে উঠে দাড়াল তখন আয়নায় কুহেলির প্রতিবিম্ব যদি কোনও কবি দেখতে পেতেন তাহলে হয়তো নিঃসন্দেহে বাংলা শব্দ ভান্ডারে সৌন্দর্য্যের যত গুলো প্রতিশব্দ আছে সেগুলোকে একত্র করে একটা নতুন কাব্য রচনা করে ফেলতেন। ঘড়িতে সময় বলছে সাতটা পঁচিশ, যে কোনও মুহূর্তে আলেখ চলে আসবে। একটা সাদা রঙের ছোট হ্যান্ডব্যাগে নিজের পার্স আর মোবাইলটা ঢোকানোর সময় কুহেলির হঠাৎ মনে হল, জীবনের এত গুরুত্বপূর্ণ একটা সিদ্ধান্ত বাড়িতে কাউকে না জানিয়েই নিয়ে নিল, এমনকি আজ আলেখের বাবার সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছে সেটাও বাড়িতে না জানিয়ে। মনে একটা সংশয় দেখা দিল, কাজটা ঠিক করছে তো! একবার ভাবল চৈতালী দেবীকে ফোন করে এক্ষুনি সবটা জানিয়ে দেয়, কিন্তু পরক্ষনেই মনে হল, সেটা করা সম্ভব নয়, যেভাবে সবটা করবে ঠিক করেছে সেইভাবেই এগোতে হবে। কুহেলির এই ভাবনার মধ্যেই ওর হাতের ফোনটা বেজে উঠল, আলেখ। চিন্তা গুলো মাথা থেকে সরিয়ে দিয়ে কলটা রিসিভ করল।

হ্যালো, মিস বাসু আর ইউ রেডী?

ইয়েস স্যার, আমি এক্ষুনি আসছি।

ওকে, আমি নিচে ওয়েট করছি।

কুহেলি কথা শেষ করে ফোনটা ব্যাগে রেখে এগিয়ে গেল ওর শ্যু স্ট্যান্ডের দিকে। অনেকদিন পর নিজের প্রিয় সিলভার স্টিলেটো টা পরল। ফ্ল্যাট টা লক করে লিফটের দিকে এগোল কুহেলি, এদিকে আলেখ কুহেলির সঙ্গে কথা বলে গাড়ি থেকে নেমে অপেক্ষা করতে লাগল। ঠিক পাঁচ মিনিট পরেই কুহেলিকে বিল্ডিঙের ভিতর থেকে হেঁটে ওর দিকে এগিয়ে আসতে দেখা গেল। আলেখ কুহেলির দিকে তাকিয়ে যেন স্তব্ধ হয়ে গেল, ওর হৃদযন্ত্র টা যেন একমুহুর্তের জন্য স্পন্দিত হতে ভুলে গেল। ডিপ মেরুন আর সাদা রঙের কম্বিনেশনের লং সালোয়ারে কুহেলিকে অসম্ভব সুন্দরী লাগছে। স্বল্প প্রসাধনের ছোয়ায় কুহেলির রূপে যেন একটা অনন্য স্নিগ্ধতা ফুটে উঠেছে। আলেখ এর আগে কখনও কুহেলিকে এইরূপে দেখেনি, শুধু এই রূপ কেন, অফিসের ফরমাল সাজের বাইরে আলেখ কোনদিনও কুহেলিকে দেখেনি। আলেখ যেন পলক ফেলতেও ভুলে গেল, চলার ছন্দের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সুদীর্ঘ চুল গুলোও যেন ঈষৎ আন্দোলিত হচ্ছে। একদৃষ্টে কুহেলির এগিয়ে আসার দিকে তাকিয়ে ছিল আলেখ, একরাশ মুগ্ধতার রেশ যেন ধীরে ধীরে ওকে ঘিরে ধরছে। কুহেলি আলেখকে দেখে তাড়াতাড়ি হেঁটে এগোতে গিয়ে হঠাৎ একটা ছোট পাথরে হোচট খেল। টাল সামলাতে না পেরে পড়েই যাচ্ছিল কিন্তু আলেখ তার আগেই ওকে একহাত দিয়ে ধরে নিজের কাছে টেনে আনল। হঠাৎ করেই কুহেলি ওর এত কাছে এসে পড়ায় আলেখ কেমন যেন স্থির হয়ে গেল। কুহেলির চুল থেকে একটা মিষ্টি গন্ধ ভেসে আসছে, সেই ঘ্রাণটা কেমন যেন নেশা ধরানো। এদিকে কুহেলি আচমকা পড়ে যাওয়ার ভয়ে চোখ দুটো বন্ধ করে নিয়েছিল, কিন্তু একটু পরেই পড়ে যায়নি বুঝতে পেরে চোখটা খুলে নিজেকে আলেখের এতটা কাছে আবিষ্কার করে অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল। ছিটকে আলেখের কাছ থেকে সরে এল, কুহেলি এইভাবে সরে যাওয়ায় আলেখেরও ঘোরটা কেটে গেল, সে নিজেও বেশ অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল। কুহেলি কোনরকমে বলল,

সরি, আসলে তাড়াতাড়িতে খেয়াল করিনি।

আলেখ নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বলল,

ইটস ওকে, চলুন দেরী যাচ্ছে।

বলে গাড়ির দরজাটা খুলে দিল, কুহেলি এবার সাবধানে এগিয়ে গিয়ে উঠে পড়ল। আলেখ নিজে ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ি স্টার্ট করল, হলদে রঙের বিল্ডিং টাকে পিছনে ফেলে কালো গাড়িটা এগিয়ে চলল ওঙ্কার ভিলার উদ্দেশ্যে। কুহেলি বেশ কিছুক্ষণ আলেখের দিকে তাকালই না, একটু আগের ঘটনাটার জন্য বড্ড অপ্রস্তুত বোধ করছে। আলেখের অবস্থাও কিছুটা একই, এইরকম পরিস্থিতিতে সে আগে কখনও পড়েনি। তবে কুহেলির মত তার চোখ দুটো বাধ্য নয়, থেকে থেকেই তারা লক্ষ্য ভ্রষ্ট হয়ে রাস্তার দিক থেকে কুহেলির দিকে চলে যাচ্ছে। বেশ কিছুক্ষণ এভাবেই কেটে গেল, আলেখের মনে হল এভাবে তো পরিস্থিতি টা আরও অস্বস্তি কর হয়ে যাবে। ও জানে কুহেলি এমনিতেই আজকের ডিনার টা নিয়ে যথেষ্ট নার্ভাস তার মধ্যে এই পরিস্থিতি। আলেখ প্রথমে নিজেকে একটু শান্ত করল, অবাধ্য চোখ দুটোকে শাসনের গণ্ডিতে বেঁধে ওর সেই চির পরিচিত হাসিটা ঠোঁটের কোণে এনে বলল,

ইউ আর ওয়েলকাম।

কুহেলি জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে ছিল, এমনিতেই যত দূরত্ব কমছে ওর নার্ভাসনেস টা ততই বাড়ছে। তার মধ্যে ওই ঘটনাটার জন্য আলেখের দিকে তাকাতে একটা অস্বস্তি বোধ হচ্ছে। তাই অন্য উপায় না পেয়ে বাইরের দিকে তাকিয়েই বসে ছিল। আচমকা আলেখের কথায় চমকে উঠল, বাইরের দিক থেকে আলেখের দিকে তাকিয়ে বলল,

কিছু বললেন?

বললাম, ইউ আর ওয়েলকাম।

কুহেলি এইকথার কোনও অর্থ খুঁজে পেল না, হঠাৎ করে এটা বলার কি কারণ থাকতে পারে সেটা বুঝতে পারল না। একটু অবাক হয়ে বলল,

ফর হোয়াট?

আলেখ রাস্তার দিক থেকে দৃষ্টি না সরিয়েই হেসে বলল,

কাউকে হেল্প করলে একটা থ্যাঙ্কস পাওনা হয়, আর তার উত্তরে তো ওয়েলকাম বলতে হয়। তাই না?

কুহেলির মনে পড়ল তখন আলেখ ওকে নির্ঘাৎ পতনের হাত থেকে বাচিয়েছে, কিন্তু কুহেলি এখনও ধন্যবাদ জানায়নি। কুহেলির নিজের উপরেই রাগ হল, একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলল,

সরি, আসলে তখন হঠাৎ করে….

আলেখ কুহেলির কথার মধ্যেই কথা বলে উঠল।

আমার মনে হয় আপনি থ্যাঙ্কস আর সরি ওয়ার্ড দুটোর মধ্যে কনফিউসড হয়ে পড়েছেন। তখনও থ্যাঙ্কসের বদলে সরি বললেন আর এখন আবার।

কুহেলি এবার হেসে ফেলল, ওকে হাসতে দেখে আলেখের হাসিটাও আরও একটু প্রশস্ত হল। কুহেলি বলল,

থ্যাঙ্ক ইউ। তখন আপনি না থাকলে হয়তো পড়েই যেতাম, আর তার পরের কথা আমি ভাবতেও চাইনা।

ইউ আর মোস্ট ওয়েলকাম। আর যেটা হয়নি সেটা নিয়ে সত্যিই ভাবার কোনও মানে হয় না।

কুহেলি হেসে মাথা নাড়ল। কুহেলিকে সহজ হতে দেখে আলেখ মনে মনে বেশ খুশি হল। কুহেলির সত্যিই এখন নিজেকে অনেকটা হালকা মনে হচ্ছে, একটু আগের সেই অস্বস্তি টা আর নেই, নার্ভাসনেস টাও অনেকটা কম। কুহেলি একবার আড় চোখে আলেখের দিকে তাকাল, সেই চিরপরিচিত হাসি মুখ। কুহেলি অবুঝ নয়, আলেখের হঠাৎ এই কথা গুলো বলার পিছনের উদ্দেশ্য টা বুঝতে ওর কোনও অসুবিধা হল না। কত অনায়াসে পরিস্থিতিটা সহজ করে দিল, সত্যি মানুষটাকে যত বেশি দেখছে তত বেশি জানছে, আর ততটাই ওর প্রতি শ্রদ্ধা বাড়ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ওরা ওঙ্কার ভিলায় পৌঁছে গেল, কুহেলি ওর রিস্ট ওয়াচে সময় দেখল। আটটা বাজতে এখনো পাঁচ মিনিট বাকি আছে, যাক দেরী হয়নি। গাড়ি থেকে নামতেই আবার সেই নার্ভাসনেস টা যেন ফিরে এল, আসলে যতই হোক না কেন, এরকম একটা পরিস্থিতিতে যে কোনও মেয়েরই নার্ভাস বোধ করাটা খুবই স্বাভাবিক। আলেখ বোধহয় কুহেলিকে দেখে ব্যাপারটা বুঝতে পেরে বলল,

রিল্যাক্স মিস বাসু, টেনশনের কিছু নেই, আসুন।

আলেখ কুহেলিকে সঙ্গে নিয়ে বাংলোর মূল দরজার দিকে এগোল। কলিংবেল বাজাতেই একজন ভৃত্য এসে দরজা খুলে দিল, আলেখ কুহেলিকে নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করল। এখানে কুহেলি আগেও একবার এসেছে, কিন্তু সেদিন আর আজকের দিনের মধ্যে আকাশ পাতাল অন্তর। একটু এগিয়েই দেখা গেল সামনে সুবিশাল ড্রইংরুমের সুসজ্জিত সোফায় বসে আছেন ওঙ্কার গ্রুপসের ভূতপূর্ব কর্ণধার শ্রীমান নভতেজ শর্মা। কুহেলি এর আগে দু এক বার কয়েক মুহূর্তের জন্য ওনাকে অফিসে দেখেছে, আসলে আলেখ দায়িত্ত্ব নেওয়ার পর থেকে উনি কোম্পানিতে যান না বললেই চলে। আজকে সামনা সামনি ভালোভাবে দেখে কুহেলি মুগ্ধ না হয়ে পারল না। এই বয়সেও অসম্ভব সুদর্শন, আলেখ যে এনারই সন্তান সেটা আর আলাদা করে বলে দিতে হয় না। চেহারার দিক থেকে আলেখ তার পিতার যোগ্য উত্তরসূরী, বয়সের নিরিখে বিচার করতে গেলে নভতেজ শর্মা আলেখের থেকেও বেশি সুদর্শন। একমনে বসে একটা ম্যাগাজিন পড়ছিলেন, চেহারায় আলাদা একটা ব্যক্তিত্বের ছাপ ফুটে রয়েছে। প্রথম দর্শনেই কোনও কথা বলার আগেই কুহেলির মনে ওনার প্রতি একটা সম্ভ্রমের সৃষ্টি হল। সামনে কারো অস্তিত্বের আভাস পেয়ে ম্যাগাজিন থেকে চোখ তুলে তাকিয়ে আলেখ আর কুহেলিকে দেখে হেসে সোফা ছেড়ে উঠে দাড়ালেন। তারপর আলেখকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে সোজা কুহেলির দিকে তাকিয়ে বললেন,

ওয়েলকাম বেটা, এস। আমি তোমারই অপেক্ষা করছিলাম।

প্রথম আলাপেই এতোটা আন্তরিক সম্বোধন কুহেলি একেবারেই আশা করেনি। একজন অপরিচিতা মেয়ে, যে কিনা তারই কোম্পানিতে একজন সাধারণ এম্প্লয়ী, যাকে হঠাৎ তার একমাত্র ছেলে জীবন সঙ্গী হিসেবে বেছে নিয়েছে তাকে যে উনি এত সহজে এত আন্তরিকতার সাথে অভ্যর্থনা জানাবেন, এটা কুহেলি কল্পনাও করেনি। কুহেলি ঘটনার আকস্মিতায় এতটাই অবাক হয়েছে যে ওনার অভ্যর্থনার প্রতিউত্তর দিতেও ভুলে গেল। মিস্টার নভতেজ শর্মা আবার বললেন,

লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই বেটা, এস। কাম, হ্যাভ এ সিট।

কুহেলি এবার যেন চমক ভেঙে বাস্তবে ফিরল। একবার আলেখের দিকে তাকিয়ে একটু ইতস্তত করে এগিয়ে গিয়ে ওনার পা ছুয়ে প্রণাম করল। প্রথমে প্রণাম করবে কিনা সেটা নিয়ে একটু দ্বিধায় ছিল, এত বড় একজন ব্যক্তিত্ব, হঠাৎ করে ওর প্রণাম নেবেন কিনা সে বিষয়ে সংশয় ছিল। কিন্তু উনি কুহেলিকে প্রথমেই বেটা বলে সম্বোধন করাতে কুহেলি আর দ্বিধা করেনি। কুহেলিকে আরও অবাক করে দিয়ে উনি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে আশীর্বাদ করলেন। কুহেলি প্রণাম করে সোজা হয়ে দাড়ালে নভতেজ শর্মা ওদেরকে বসতে বললেন। কুহেলি সোফার একটা দিকে বসল, আলেখ একটু দূরত্ব বজায় রেখে ঠিক ওর পাশে এসে বসল, আর ওদের ঠিক মুখোমুখি বসলেন মিস্টার নভতেজ শর্মা। উনিই কথা শুরু করলেন,

কুহেলি, তোমার নামটা খুব মিষ্টি।

কুহেলি ছোট্ট করে হেসে ধন্যবাদ জানাল।

আলেখ বলছিল তুমি আমাদের কোম্পানিতে অলমোস্ট ওয়ান অ্যান্ড এ হাফ ইয়ার আগে জয়েন করেছ, অ্যান্ড দিস ইজ ইওর ফার্স্ট জব। আর আমাদের লেটেস্ট প্রজেক্টটা তুমিই লিড করেছ। ভেরি ইমপ্রেসিভ, এত কম সময়ে এত ভালো পারফরমেন্স সত্যিই খুব একটা দেখা যায় না। প্রথমে যখন আলেখ এবার বিয়ের জন্য রাজি হয়ে গেল আমি তো বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না। কিন্তু তোমার কথা জানার পর আর অবাক হইনি, আলেখ এক্কেবারে কাজ পাগল ছেলে আর তোমার মত একজনকে লাইফ পার্টনার হিসেবে পেলে তো ওর সুবিধাই হবে। সংসারের সঙ্গে সঙ্গে কাজের দিকটাতেও তুমি হেল্প করতে পারবে, আর আলেখ নিজেই স্বীকার করেছে এটাই ওর মেইন রিজন। দেখো রিজন যাই হোক না কেন, আমার একমাত্র ছেলে যে অবশেষে বিয়ে করতে রাজি হয়েছে আমি এতেই খুশি।

কুহেলির হঠাৎ খুব খারাপ লাগতে লাগল, এইরকম একটা মানুষকে মিথ্যে কথা বলা টা কি ঠিক হচ্ছে? উনি নিজের একমাত্র ছেলের ভবিষ্যৎ সংসারের কথা ভেবে কতটা খুশি হচ্ছেন, কিন্তু উনি জানেন না যেটা তৈরি হতে চলেছে সেটা আদৌ সংসার নয়। এখানে দুটো মানুষ নতুন জীবন শুরু করার জন্য এই সম্পর্কে আবদ্ধ হচ্ছে না, এখানে দুটো নিরুপায় মানুষ তাদের নিজস্ব সমস্যার সমাধান হিসেবে এই নতুন সম্পর্কটাকে বেছে নিয়েছে। নভতেজ শর্মা আরও অনেক কথা বললেন, ওনার সঙ্গে কথা বলতে বলতে কুহেলির মনে হতে লাগল যেন কতদিনের পরিচয় এনার সঙ্গে। কত সহজে ওকে আপন করে নিলেন, আর ঠিক এই কারণেই কুহেলির খারাপলাগাটা আরও তীব্র হয়ে উঠল, কিন্তু এখন আর এটা নিয়ে ভেবে লাভ নেই তাই ও চিন্তা টা একপ্রকার জোর করেই মাথা থেকে সরিয়ে দিল। উনি বোধহয় আরও অনেকক্ষণ কথা চালিয়ে যেতেন কিন্তু মাঝখানে একজন ভৃত্য এসে বলে গেল ডিনার রেডি। ওরা সবাই উঠে ডাইনিং রুমের দিকে এগোল, এইদিকটায় কুহেলি সেদিন আসেনি, প্রয়োজন পড়েনি। বেশ বড় আকৃতির একটা কাঠের টেবিল, আজকাল তো কাঠের ডাইনিং টেবিল প্রায় দেখাই যায় না। এটা যে বেশ পুরনো সেটা দেখেই বোঝা যায়, কিন্তু পুরনো হলেও তার জৌলুস এতটুকু কমেনি। ডিনারের আয়োজন দেখে কুহেলি প্রায় ভিরমি খাচ্ছিল, একেবারে এলাহী আয়োজন। পদের সংখ্যা গুনে শেষ করা যাবে কিনা সন্দেহ, কুহেলি তো ভেবেই পেল না এত ও খাবে কীকরে! সব কটা পদ যদি এক চামচ করেও খায় তাতেও ওর বেশি হয়ে যাবে। খেতে বসে নভতেজ শর্মা আবার গল্প শুরু করলেন, ওর পরিবারের কথা, পড়াশুনোর কথা, সব একে একে শুনলেন। আলেখের সম্বন্ধেও অনেক কথা বললেন, ওর ছোট বেলার অনেক গল্প করলেন, কিন্তু কুহেলি লক্ষ্য করে দেখল উনি একবারও আলেখের মায়ের প্রসঙ্গে তুললেন না, কারনটা কিছুটা আন্দাজ করতে পারল সে, এর আগে দুবার নিজে দেখেছে মায়ের প্রসঙ্গ উঠলেই আলেখ ভিষন দুর্বল হয়ে পড়ে। আরো অনেক রকম কথা চলতে লাগল, ওদের তিনজনকে একসাথে দেখে এখনই একটা পরিবার মনে হচ্ছিল, কুহেলির বেশ ভালোলাগছিল। সবকিছু বেশ ভালই চলছিল, হঠাৎ নভতেজ শর্মা কুহেলিকে প্রশ্ন করলেন,

আচ্ছা বেটা একটা কথা বলত, আলেখের জন্য তো তুমি একদম পারফেক্ট, ও তোমাকে নিজের লাইফ পার্টনার হিসেবে পছন্দ করে খুব বুদ্ধিমানের কাজ করেছে কিন্তু তুমি ওকে পছন্দ করলে কেন? তোমার মত এরকম এত মিষ্টি আর ট্যালেন্টেড মেয়ে তো অন্য যে কাউকে বিয়ে করতে পারতে। হঠাৎ আলেখকে পছন্দ করলে কেন?

কুহেলি প্রমাদ গুনল, এটা তো ভাবেনি। ওকে প্রশ্ন করলে কি উত্তর দেবে সেটা ঠিক করা হয়নি, নিজের বাড়িতে কি উত্তর দেবে সেটা ভেবে রাখলেও এখন কি বলবে খুঁজে পেল না। আসল কারণ টা তো বলা সম্ভব নয়, আসলে উনি যে কুহেলিকে এরকম একটা প্রশ্ন করবেন এটা ওরা আশা করেনি। কুহেলি আলেখের দিকে তাকিয়ে দেখল ওর মুখটাও কালো হয়ে গেছে। একটু ভেবে কুহেলি বলল,

আসলে আমার বাড়ি থেকেও কিছুদিন হল আমার বিয়ের কথা ভাবছে, আমি যদিও ঠিক এক্ষুনি বিয়ে করতে চাইছিলাম না, কেরিয়ারের দিকেই ফোকাস করতে চাইছিলাম কিন্তু বাড়িতে আর ওয়েট করতে চাইছে না। আর ঠিক এই সময়েই উনি….. সত্যি বলতে আমাকে বিয়ে করতে হলে অ্যারেঞ্জ ম্যারেজই করতে হত, সেখানে ওনার মত একজনকে জীবন সঙ্গী হিসেবে পেলে যে কেউই নিজেকে ভাগ্যবতী মনে করবে, তাই আমিও…..

কুহেলি কথাটা শেষ করল না। কথাগুলো বলতে ওর কেমন যেন একটা অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছিল, আলেখের দিকে তাকিয়ে দেখল ওর মুখে হাসিটা আবার ফিরে এসেছে। নভতেজ শর্মা ওর উত্তর শুনে হেসে বললেন,

বেশ, খুব ভালো কথা। আমি আগেও বলেছি কারণ তোমাদের যাই হোক না কেন তাতে আমার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। ফাইনালি আলেখ বিয়ে করছে আর তোমার মত একজন কে বিয়ে করছে আমার কাছে এটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

ডিনারের পর্ব সেরে ওরা আবার ড্রয়িং রুমে ফিরে এল। আলেখ এতক্ষণ একটাও কথা বলেনি, আসলে কথা বলার মত সুযোগই পায়নি। আসার পর থেকে নভতেজ শর্মা শুধু কুহেলির সঙ্গেই কথা বলেছেন, মাঝে মাঝে তো মনে হচ্ছিল শুধু ওনারা দুজনই আছেন, আলেখের কোনও অস্তিত্বই নেই। এবার আলেখ মুখ খুলল,

ড্যাড, অনেকটা রাত হয়েছে, এবার বেরোতে হবে, নাহলে লেট হয়ে যাবে।

আরে দাড়া, এত তাড়া কিসের! তুই তো নিজেই যাবি পৌঁছতে, তাহলে আর চিন্তা কিসের? আমার কুহেলির সঙ্গে কিছু কথা আছে।

ড্যাড, এতক্ষণ তো কথা বললে, আর কি বলবে?

সেটা কি তোকে বলব নাকি? তুই এখানেই বস, আমি কুহেলিকে একটু আমার স্টাডি রুম টা দেখিয়ে আনছি।

তোমার স্টাডি রুমে দেখার কি আছে?

সেটা তুই কোনোদিন সেখানে গেলেই বুঝতে পারবি। কোনোদিন তো ভুলেও ওদিকে যাস না, এখন বেশি কথা বলিস না তো। চুপচাপ এখানে বস, আমরা আসছি, এস তো বেটা।

বলে কুহেলিকে সঙ্গে নিয়ে উনি দোতলার সিড়ির দিকে এগোলেন, কুহেলি একবার আলেখের দিকে তাকিয়ে এগিয়ে গেল। দোতলায় উঠে একদম শেষ প্রান্তের ঘরটার সামনে এসে নভতেজ শর্মা বললেন,

এসো, এটা আমার সবথেকে প্রিয় ঘর, দিনের অধিকাংশ সময় টা আমি এখানেই কাটাই।

ওনার পিছন পিছন ঘরটায় ঢুকে কুহেলি অবাক হয়ে গেল, ছোট খাটো একটা লাইব্রেরী বলা চলে। ঘরের চারটে দেওয়াল জুড়ে শুধু বুকশেলফ, আর তাদের সবকটাই নানারকম বইয়ে ঠাসা। কুহেলি বইয়ের পোকা না হলেও বই পড়তে ভালোবাসে, এখন তো আর তেমন সময় হয়ে ওঠে না কিন্তু আগে সুযোগ পেলেই দু চারটে বই পড়ত। কুহেলি অবাক হয়ে সবটা দেখছিল, এরমধ্যে নভতেজ শর্মা বললেন,

তোমাকে কটা কথা বলার ছিল কুহেলি। যেটা আলেখের সামনে বলতে পারতাম না, তাই তোমাকে এখানে নিয়ে এলাম।

হঠাৎ করেই ওনার মুখ থেকে হাসিটা মিলিয়ে গেল, তার জায়গায় একটা গাম্ভীর্যের আবির্ভাব হল। কুহেলি একটু চিন্তায় পড়ল, কি এমন বলতে চান উনি! এখন তো আলেখও নেই। একটু থেমে নভতেজ শর্মা একটা আলমারির দিকে এগিয়ে গিয়ে একটা বই বের করলেন, দুর থেকে ওটাকে বই মনে হলেও সেটা কাছ থেকে দেখে বুঝতে পারল ওটা একটা অ্যালবাম। উনি অ্যালবামটা কুহেলির হাতে দিয়ে বললেন,

এটা খুলে দেখ।

কুহেলি খুলে দেখল এটা একটা ফ্যামিলি অ্যালবাম। একজন সুদর্শন পুরুষ তার সঙ্গে একজন অসামান্য সুন্দরী মহিলা এবং তাদের দুজনের সাথে একটা ছোট্ট ছেলে। কুহেলির বুঝতে অসুবিধা হল না এটা এই পরিবারের অ্যালবাম। নভতেজ শর্মার চেহারা চিনতে একটুও কষ্ট হল না, খুব একটা পরিবর্তন আসেনি, কাজেই সঙ্গের মহিলাটি যে আলেখের মা, সেটা বলাই বাহুল্য। এরকম অনেক ছবিতে অ্যালবাম টা পরিপূর্ণ, কুহেলি একের পর এক সব ছবি গুলো দেখল। নভতেজ শর্মা বলতে শুরু করলেন,

আলেখের কাছে হয়তো ওর মায়ের কথা শুনেছ, ছেলেটা ওর মাকে খুব ভালোবাসত, না.. ভুল বললাম, ভালোবাসত না, ভালোবাসে। ওর মা যখন আমাদের ছেড়ে চলে যায় তখন ছেলেটা একেবারে ভেঙে পড়েছিল, অনেক কষ্টে ওকে সামলেছিলাম। ওকে আগলে রাখতে গিয়ে নিজের দুঃখটা ভুলে গিয়েছিলাম। সব সময় চেষ্টা করতাম ওর মায়ের অভাবটা পূরণ করার কিন্তু পারিনি, কেউ কারো অভাব পূরণ করতে পারে না। আলেখ আজও ওর মাকে খুব মিস করে, না পারতে নিজের মায়ের প্রসঙ্গে কথা বলে না। আমিও বলিনা, জানি ওর মায়ের কথা উঠলে নিজেকে আর সামলাতে পারে না, দুর্বল হয়ে পড়ে। নীচে একটু আগেই বললাম শুনলে তো, এই ঘরটায় আলেখ কখনও আসে না। তখন হালকা ভাবে এখানে আসতে বলেছি বটে কিন্তু এমনিতে আমিও ওকে জোর করি না। আলেখ এই ঘরটায় একেবারেই আসে না, ওর মায়ের স্মৃতি যে ছড়িয়ে আছে এখানে। এই ঘরটা নন্দিনীর বড্ড প্রিয় ছিল, সুযোগ পেলেই এই ঘরেই সময় কাটাতো। তুমিও তো তোমার বাবাকে হারিয়েছ, অনেক ছোট বয়সে। তুমি আলেখের কষ্টটা আমার থেকেও ভাল বুঝতে পারবে, আর সেই জন্যই তোমাকে এই কথাগুলো বলছি।

কথাগুলো বলতে বলতে ওনার গলাটা ধরে এসেছে, কুহেলিরও মনটা ভারী হয়ে উঠেছে। আলেখের এই কষ্টটা সেদিন রাতেই অনুভব করতে পেরেছিল কিন্তু আজ ওর বাবার মুখ থেকে আবার সবটা শুনে মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে উনি আবার বলতে শুরু করলেন,

কারো অভাব কেউ পূরণ করতে পারে না ঠিকই কিন্তু চেষ্টা তো করাই যায়। আমি এতদিন সেই চেষ্টাই করেছি, তোমার মা আর তোমার গ্রান্ডমাও নিশ্চয়ই সেই চেষ্টার কোনও অভাব রাখেননি। কিন্তু আমি নিশ্চিত তাও তোমার মনে একটা শূন্যস্থান রয়েই গেছে। তোমরা দুজনেই পারো একে অন্যের পরিপূরক হতে, নিজের ভালোবাসা দিয়ে সেই শূন্যস্থান টা পূরণ করতে। তোমার কাছে আমি কোনও কথা চাইব না, শুধু এটুকু বলব, আমার ছেলেটাকে আপন করে নিও। ওর কষ্টগুলোকে দূরে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করো। বাবা হিসেবে আমার শুধু এইটুকুই চাওয়ার তোমার কাছে, মেয়ের কাছে এইটুকু তো চাইতেই পারি, কি পারি না?

কুহেলির দুচোখ বেয়ে জলের ধারা নামল, সামনে দাড়ানো মানুষটার মধ্যে যেন নিজের বাবার প্রতিচ্ছবি দেখতে পেল। কোনদিনও নিজের বাবার স্নেহ ভালোবাসা পাওয়ার সৌভাগ্য হয়নি ওর, এমনকি ছবি না থাকলে হয়তো মানুষটার মুখটাও মনে পড়ত না। আজ হঠাৎ করেই আলেখের বাবার মধ্যে সেই না পাওয়া মানুষটাকে খুঁজে পেল, হৃদয়ের সমস্ত আবেগ চোখের জলের ধারা হয়ে ঝরে পড়তে লাগল। কুহেলিকে কাদতে দেখে নভতেজ শর্মা ব্যস্ত হয়ে বললেন,

তুমি কাদছ কেন কুহেলি? আমি কি ভুল কিছু বলে ফেলেছি?

কুহেলি চোখের জল মুছে বলল,

না, আপনি ভুল কিছু বলেননি। আসলে আমি কোনদিনও আমার বাবাকে কাছে পাইনি, আমার স্মৃতির ভান্ডারে ওনার এতটুকু ছায়াও নেই। আজ আপনি আমায় মেয়ে বললেন তাই….

নভতেজ শর্মা এগিয়ে এসে পরম স্নেহে কুহেলির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,

এতে কান্নার কি আছে বোকা মেয়ে, এখন থেকে আমি আলেখের মত তোমারও বাবা। আর আমি কিন্তু নিজের মেয়ের চোখে জল দেখতে পছন্দ করি না। আজকের পর আর যেন কখনও চোখে জল না দেখি, মনে থাকবে?

কথাগুলোর মধ্যে একটা পিতৃ সুলভ স্নেহ মিশ্রিত শাসন ছিল, একটা প্রচ্ছন্ন অধিকার বোধ ছিল, যেটা কুহেলির ভাগ্যে কোনদিনও জোটেনি। কুহেলি হেসে নিজের চোখের জল মুছে সম্মতি সূচক মাথা নাড়ল। নভতেজ শর্মা আরও একবার কুহেলির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,

চল, এবার নিচে যাই। রাতও হচ্ছে, এবার তোমার ফেরা উচিৎ।

ওরা দুজন নিচে নেমে এল, আলেখ সোফায় বসে উসখুস করছিল। ওরও ভিতরে ভিতরে একটা চাপা টেনশন হচ্ছিল, না জানি উপরে কি চলছে। ওদেরকে নামতে দেখে সোফা ছেড়ে উঠে দাড়িয়ে বলল,

হল তোমার কথা?

হ্যা, হল। এবার তুই কুহেলিকে পৌঁছে দিয়ে আয়।

তারপর কুহেলির দিকে ফিরে বললেন,

সাবধানে যেও বেটা।

কুহেলি আবার ওনাকে একটা প্রণাম করল, উনি কুহেলির মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,

তাড়াতাড়ি তোমার বাড়িতে কথা বল, তারপর আমি নিজে গিয়ে বাকি কথা বলব। আমার এই মেয়েটাকে পাকাপাকি নিজের কাছে না নিয়ে আসা পর্যন্ত আমার শান্তি হবে না।

কুহেলি কিছু বলল না, শুধু একটু হাসল। ওর মনটা অদ্ভুত একটা ভালোলাগায় ভরে আছে, এখানে আসার সময় কল্পনাও করেনি যাওয়ার সময় ওর মনটা এত ভালো হয়ে যাবে। আলেখও বেশ অবাক হয়েছে, কুহেলিকে যে ওর বাবার পছন্দ হবে সেটা ও আন্দাজ করেছিল কিন্তু এতটা ও নিজেও আশা করেনি। তবে মনে মনে বেশ খুশিই হল, সব একদম ঠিকঠাক হচ্ছে, এবার কুহেলির বাড়িতেও সবটা ঠিকমত হয়ে গেলেই হয়। নভতেজ শর্মার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ওরা বেরিয়ে এল। গাড়িতে উঠে থেকেই কুহেলির মুখের হাসিটা নজরে এসেছিল আলেখের, একটু হেসে বলল,

সো, মিস বাসু আপনাকে বেশ খুশি খুশি মনে হচ্ছে।

কুহেলি আলেখের দিকে তাকিয়ে বলল,

ঠিকই বলেছেন, আমি সত্যিই খুব খুশি।

খুব ভালো কথা, কিন্তু খুশির কারনটা জানতে পারি কি? যদি না বলতে চান দেন ইটস ফাইন।

খুশির কারণ কেউ গোপন করে নাকি! আমার খুশির কারণ আপনার বাবা।

ড্যাড?

হ্যা।

কীকরে?

সেটা নাহয় আমাদের মধ্যেই থাক, এখন ওটা আপনার না জানলেও চলবে।

আলেখ অবাক হয়ে গেল, কিছুক্ষণ কোনও কথাই বলতে পারল না, তারপর একটু হেসে বলল,

বাবা, এখন থেকেই দুজনে টিম তৈরি করে নিলেন? আমার কপালে তো মনে হচ্ছে অশেষ দুর্ভোগ আছে।

কুহেলি এটা শুনে হেসে ফেলল, আলেখ নিজেও হেসে উঠল। এই কয়েকদিনে ওরা দুজন দুজনের কাছে আগের থেকে অনেক বেশি সহজ হয়ে উঠেছে, কিন্তু সেটা বোধহয় ওরা নিজেরাও জানে না। থাক এখন জানার প্রয়োজনও নেই, যেমন চলছে চলুক না, ক্ষতি কি! আলেখ কুহেলিকে ওর অ্যাপার্টমেন্টের সামনে নামিয়ে দিয়ে বলল,

আজ আর আলোচনা করে কাজ নেই, কালকে আপনার বাড়ি যাওয়ার ব্যাপারটা নিয়ে কথা বলতে হবে।

ঠিক আছে।

ওকে, রাত হয়েছে, এবার আপনিও গিয়ে রেস্ট নিন আর আমিও আসি। গুড নাইট।

গুডনাইট।

আলেখ চলে যাওয়ার পর কুহেলি নিজের ফ্ল্যাটে উঠে এল। আজকের দিনটা সত্যিই ভিষন অপ্রত্যাশিত ছিল। পোশাক পাল্টে ফ্রেশ হয়ে ভালোলাগার রেশটুকু গায়ে মেখে শুয়ে পড়ল। আজ খুব ভালো ঘুম হবে।

ক্রমশ____________

© স্বত্ব সংরক্ষিত

কেমন লাগল আজকের পর্ব টা? জানাবেন কিন্তু। আশা করি আপনাদের ভালো লাগছে গল্পটা। নভতেজ শর্মাকে কেমন লাগল আপনাদের? আলেখের বাড়ির পর্ব তো হল এবার পালা কুহেলির বাড়ির, কি মনে হয়, সবাই মেনে নেবে তো? কুহেলির কথা অনুযায়ী বাকিদের নিয়ে কোনও চিন্তা নেই শুধু শৈলজা দেবীকে নিয়েই যা একটু চিন্তা। শৈলজা দেবী আপত্তি করবেন না তো? যদি আপত্তি করেন তাহলে কি করবে কুহেলি? আপনাদের মতামত জানাবেন। অপেক্ষা করব কিন্তু। দেখা হবে আগামী পর্বে ততদিন পর্যন্ত পড়তে থাকুন ভালো থাকুন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here