সংগোপনে’ পর্ব-৩৯

0
1516

#সংগোপনে
#ধারাবাহিক_পর্ব_৩৯
#অচিন_পাখি_কলমে_ভাগ্যলক্ষ্মী_দাস

আগের পর্বের পর————

কুহেলি একভাবে তাকিয়ে আছে আলেখের দিকে, কিছুক্ষণ হল ঘুম টা ভেঙেছে। রোজের মতই আজও আলেখের বক্ষলগ্না হয়েই নিদ্রার অবসান ঘটেছে কিন্তু অন্যদিনের থেকে আজকের অনুভূতি গুলো অনেকটাই আলাদা। ভালোবাসার স্পর্শে সম্পূর্ণা হয়ে ওঠার অনুভূতি টা বোধহয় সব মেয়ের কাছেই অনন্য হয়। কুহেলি অপলক নেত্রে চেয়ে আছে আলেখের দিকে, মনের মধ্যে একটা সুপ্ত ইচ্ছে জেগে উঠে যেন বলতে চাইছে, থেমে যাক এই মুহূর্ত গুলো স্তব্ধ হয়ে যাক আবহমান সময় স্রোত। কতক্ষন যে একইভাবে আলেখের ঘুমন্ত মুখটার দিকে তাকিয়ে ছিল বোধহয় নিজেও জানে না। আলেখ একটু নড়ে উঠতেই যেন কুহেলি ওর জাগ্রত নয়নের দিবানিদ্রা থেকে জেগে উঠল। এতক্ষণ যেন বাহ্যিক কোনও জ্ঞানই ছিল না, এখন যেন হুশ ফিরল। নিজের আলুথালু বেশের দিকে নজর যেতেই লজ্জায় যেন কুকড়ে গেল। গরদের শাড়িটা এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে নীচে, সঙ্গে আলেখের পাঞ্জাবিটাও। কুহেলির সর্বাঙ্গ যেন লজ্জায় লাল হয়ে এল, আলেখের ঘুমন্ত মুখটার দিকেও যেন তাকাতে পারছে না, তবুও একটু তাকাতেই ওর লজ্জা টা আরও শতগুণ বৃদ্ধি পেল। আলেখের মুখে, গলায়, উন্মুক্ত বুকে সর্বত্র সিদুরের রক্তিম পরশ লেগে আছে। খুব সন্তর্পনে নিজেকে আলেখের বাহুপাশ থেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করল। এই দুরূহ কাজটা কুহেলি ভালো ভাবেই রপ্ত করে ফেলেছিল কিন্তু আজ আর পারল না। কুহেলির নিজেকে মুক্ত করার প্রচেষ্টার ফল স্বরূপ আলেখের ঘুমটা ভেঙে গেল। আর সেটা দেখে যেন কুহেলির সর্বাঙ্গে আধিপত্য বিস্তার কারী লজ্জাগুলো আরও বেশি করে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিতে শুরু করল। আলেখ ঘুম জড়ানো চোখেই কুহেলিকে আরও একটু কাছে টেনে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,

এত সকাল সকাল উঠে পড়েছ কেন? আরেকটু ঘুমাও।

কুহেলি এইমুহুর্তে আলেখের এতটাই কাছে রয়েছে যে ওর প্রতিটা হৃদস্পন্দন যেন অনুভব করতে পারছে। কুহেলির হৃদযন্ত্র টাও হঠাৎ করেই যেন নিজের স্বাভাবিক গতি হারিয়ে ফেলল। কোনরকমে নিজেকে একটু মুক্ত করার চেষ্টা করে মৃদু স্বরে বলল,

ছাড়ো আমাকে, ওয়াশরুমে যাব।

আলেখ তেমনই আগের মতই উত্তর দিল,

একটু পরে যেও।

কুহেলি এবার নিজেকে ছাড়ানোর জন্য একটু বেশিই প্রচেষ্টা করতে লাগল।

ছাড়ো না, তুমি তো জানো আমার ঘুম ভেংগে গেলেই ওয়াশরুমে যেতে হয়।

আলেখ এবার কুহেলির দিকে তাকিয়ে একটু হেসে ওর হাতের বাধন টা একটু শিথিল করতেই কুহেলি কিছুটা সরে গেল। বিছানা ছেড়ে উঠতে গিয়েও কুহেলি থেমে গিয়ে আলেখের দিকে না তাকিয়েই বলল,

তুমি… তুমি একটু চোখটা বন্ধ কর।

আলেখের ঘুমের ঘোর তখনও পুরোপুরি ভাবে কাটেনি কিন্তু হঠাৎ এমন একটা কথা শুনে ঘুমের বাকি রেশ টুকু ঝেড়ে ফেলে কুহেলির দিকে তাকাল। কুহেলি গায়ের চাদরটা দু হাতে শক্ত করে চেপে ধরে উল্টো দিকে তাকিয়ে আছে। আলেখ কিছুটা অবাক হয়ে বলল,

হঠাৎ চোখ বন্ধ করব কেন?

কুহেলি তেমনই উল্টো দিকে ফিরেই উত্তর দিল,

দরকার আছে, করো না।

আলেখ এতক্ষণ বুঝতে না পারলেও এবার আর বুঝতে অসুবিধা হল না। একটু হেসে কুহেলির কাছে সরে এসে মৃদু সুরে বলল,

কেন? লজ্জা করছে বুঝি?

ইতিমধ্যে লাল হয়ে আসা কুহেলির গাল দুটো আরও কিছুটা রক্তিমের স্পর্শে রঞ্জিত হল। কুহেলি এবার আর কোনো কথা না বলে গায়ের চাদর টাকেই অঙ্গ আচ্ছাদনের সম্বল করে ওঠার চেষ্টা করল। বলা ভালো, পালানোর চেষ্টা করল কিন্তু সেই চেষ্টা সফল হল না। আলেখ ক্ষিপ্র গতিতে কুহেলির একটা হাত ধরে এক টানে ওকে নিজের বুকের ওপর ফেলেই পাশ ফিরে কুহেলিকে শুইয়ে দিয়ে নিজে ওর উপরে ঝুকে এল। কুহেলি এমন অতর্কিত আক্রমণের জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিল না। গভীর কালো চোখ দুটোয় ভালোবাসার ছোয়া মাখা একরাশ লজ্জা আর কিছুটা বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইল আলেখের দিকে। আলেখ একটা দুষ্টু হাসির রেখা ওর ঠোঁটের কোণে এনে বলল,

পালাচ্ছ কোথায়! এখনও এত লজ্জা!

কুহেলির চোখ দুটো লজ্জার ভারে বুজে এল, আলেখ ওর কানের কাছে মুখটা নামিয়ে এনে নেশা ভরা কণ্ঠে বলল,

এই লজ্জাবতী রূপে তোমায় আরও বেশি আকর্ষণীয় দেখায়।

কুহেলি নিজেকে যেন আবার হারিয়ে ফেলছে, চাদর টা আকড়ে রাখা ওর হাতের মুঠো দুটো আরও দৃঢ় হয়ে এল। আলেখ আলতো করে ওর উষ্ণ অধর যুগল ছুঁইয়ে দিল কুহেলির রক্তিমের ছোয়া লাগা কানের লতিতে। একটু যেন কেঁপে উঠল কুহেলি, আলেখ ধীরে ধীরে নিমজ্জিত হল কুহেলির কোমল পেলব অধর সুধা পানে। প্রেম সুধার সেই তৃষ্ণা শান্ত হলে আলেখ কুহেলির কপালে একটা গভীর ভালবাসার পরশ ছুঁইয়ে দিয়ে বলল,

তোমার কাছে আমার একটা দাবী আছে।

কুহেলি ওর চোখ দুটো বন্ধ করেই রেখেছিল, আলেখের কথা শুনে চোখে একটা জিজ্ঞাসু দৃষ্টি নিয়ে তাকাল। আলেখ একটু দুষ্টুমি পূর্ণ হাসি হেসে কুহেলির অবিন্যস্ত চুল গুলো সরিয়ে দিতে দিতে বলল,

এখন থেকে আমার রোজ সকালে একটা গুডমর্নিং কিস আর রাতে একটা গুডনাইট কিস চাই। অবশ্য, রাতে গুডনাইট কিসের বদলে আরেকটু বেশি কিছু হলেও আপত্তি নেই।

কুহেলি আবার চোখ দুটো নামিয়ে নিল, এত লজ্জা সে কোথায় রাখবে! একটা মৃদু ধাক্কা দিয়ে আলেখকে সরিয়ে দিয়ে উঠে আসতে গেলেই এবারও আলেখ ওর প্রচেষ্টাকে বিফল করে দিল। পিছন থেকে কুহেলিকে দুহাতের মাঝে বেঁধে নিয়ে ওর ঘাড়ে মুখ গুজে দিয়ে বলল,

আবার পালাচ্ছ! এত সহজে পালাতে পারবে না মিসেস কুহেলি আলেখ শর্মা।

কুহেলি নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতেই বলল,

প্লিজ আলেখ, ছাড়ো না।

আলেখ ওর হাতের বাধন টা আরও একটু শক্ত করে বলল,

উহু, আগে তুমি বল আমার দাবী টা মানবে কিনা!

কি হচ্ছে কি আলেখ, প্লিজ ছাড়ো না আমাকে।

উত্তর টা দিয়ে দাও ছেড়ে দেব।

আলেখ প্লিজ।

উহু, কোনও কথা শুনব না। আমার দাবী না মানলে আজ তুমি ছাড়া পাবে না।

আলেখ প্লিজ একটু বোঝার চেষ্টা করো।

নো, আগে তুমি বল তুমি রাজি কিনা?

কুহেলি আর কোনো উপায়ন্তর না দেখে ছোট্ট করে মাথা নেড়ে হুম বলল। আলেখ একটু হেসে কুহেলির কাধে আলতো করে ঠোট জোড়া ছুঁইয়ে হাতের বাধন টা আলগা করে দিল। কিন্তু কুহেলি তাও উঠছে না দেখে আলেখ বলল,

কি হল? যাচ্ছ না যে! যেতে ইচ্ছে করছে না বুঝি?

কুহেলি একটু লজ্জা মেশানো গলায় বলল,

তুমি না… চোখটা একটু বন্ধ করো না।

এখনও চোখ বন্ধ করতে হবে?

প্লিজ।

কুহেলির এমন আকুল অনুনয় উপেক্ষা করার সামর্থ্য আলেখের নেই। একটু হেসে চোখ দুটো বন্ধ করে বলল,

বেশ, তবে বেশিক্ষণ আমি চোখ বন্ধ করে থাকতে পারব না। বুঝতেই পারছ, তাই তাড়াতাড়ি।

কুহেলি ঝটপট চাদরটাকেই অঙ্গে জড়িয়ে কোনরকমে একটা ড্রেস নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ল। আলেখ দরজা বন্ধ করার আওয়াজ শুনে চোখ খুলে ওয়াশরুমের বন্ধ দরজাটার দিকে তাকিয়ে হেসে বলল,

আই লাভ ইউ মাই সুইট অ্যান্ড শাই ওয়াইফ।

কুহেলি স্নান সেরে বেরিয়ে দেখল আলেখ আবার শুয়ে পড়েছে। অল্প হেসে ভিজে চুল গুলো মুছতে মুছতে বলল,

আবার শুয়ে পড়লে কেন? যাও ফ্রেশ হয়ে এস।

আলেখ উঠে একটু হেসে ওয়াশরুমে চলে গেল, কুহেলি ভিজে চুলগুলো মুছে চিরুনির ছোয়ায় তাদের পরিপাটি করে নিল। সিঁদুরের কৌটোটা হাতে নিয়ে সিঁথিটা রাঙাতে গিয়েও থেমে গেল। কাল রাতের সেই মুহূর্তটা আবার যেন জীবন্ত হয়ে ভেসে উঠল ওর চোখের সামনে। আলো আঁধারির সেই মায়াবী পরিবেশে হঠাৎ আলেখের ওর সিঁথি রাঙিয়ে দেওয়া আর তারপর….. ভাবতে গিয়েও যেন কুহেলির কান দুটো গরম হয়ে এল। একটা লাজুক হাসি ঠোঁট জুড়ে খেলে গেল ওর অজান্তেই। সিঁদুর টা পরে কুহেলি উঠে আগে সব অবিন্যস্ত এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কাপড় গুলো তুলে গুছিয়ে রাখল। বিছানার দিকে চোখ পড়তেই আরেক দফা লজ্জা এসে ঘিরে ধরল ওকে, ইশ কি অবস্থা হয়েছে বিছানা টার। দুধ সাদা চাদরটা সিঁদুরে একেবারে ভরে গেছে। কুহেলি ভাবল কেউ দেখার আগেই এটা ধুয়ে ফেলতে হবে নাহলে লজ্জার আর শেষ থাকবে না। যেমন ভাবা তেমন কাজ, কুহেলি চটপট চাদরটা পাল্টে ফেলে একটা অন্য চাদর বিছিয়ে দিল, বালিশের কভার গুলোও বাদ যায়নি ওগুলোকেও পাল্টে ফেলল। আলেখ ইতিমধ্যেই ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এসেছে, কুহেলিকে এইসব করতে দেখে একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,

কি করছ এগুলো?

চেঞ্জ করছি।

সে তো দেখতেই পাচ্ছি, কিন্তু কেন?

কুহেলি একটু লজ্জা পেয়ে বলল,

চাদরটায় সিঁদুর লেগে গিয়েছিল, সঙ্গে সঙ্গে ধুয়ে না দিলে দাগ উঠবে না।

আলেখ ব্যাপারটা বুঝতে পেরে একটু হেসে দুহাতে কুহেলির কোমর জড়িয়ে ধরে কাছে টেনে বলল,

স্মার্ট গার্ল হুম।

কুহেলি অল্প একটু হেসে বলল,

ছাড়ো তো, অনেক কাজ আছে।

কিন্তু আমার যে ছাড়তে ইচ্ছে করছে না।

এখনও মন ভরল না?

আলেখ কুহেলির বেশ কিছুটা কাছে এসে বলল,

এত তাড়াতাড়ি মন ভরবে কি গো! সবে তো শুরু, নেশা যত পুরনো হবে ততই গভীর হবে। আর প্রেমের চেয়ে বড় নেশা আর কি আছে বলো!

কুহেলি একটু লজ্জা মেশানো হাসি ফুটিয়ে তুলে একটা মৃদু ধাক্কা মেরে আলেখকে সরিয়ে দিয়ে সব জামা কাপড় গুলো নিয়ে ঘর থেকে দৌড়ে পালিয়ে গেল। আলেখ সেদিকে তাকিয়ে তোয়ালে টা দিয়ে ভিজে চুল গুলো মুছতে মুছতে একটু হাসল। কুহেলি তো এদিকে এক ছুটে নীচে এসেই আগে বড় ওয়াশরুম টায় ঢুকল। এটা শুধু কাপড় চোপড় ধোয়ার জন্যই ব্যাবহার করা হয়, কুহেলি ঝটপট কেউ দেখার আগেই কাপড় গুলো আর চাদর টা ওয়াশিং মেশিনে দিয়ে যেন একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। যাক, কেউ দেখেনি না হলে হাজার টা কথার উত্তর দিতে হত। এখন এটা হতে তো একটু সময় লাগবে, শুধু শুধু এখানে দাড়িয়ে থেকে লাভ নেই। কুহেলি ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে রান্নাঘরের দিকে এগোল, ওদিক থেকে টুকরো টুকরো কথা শোনা যাচ্ছে। এগিয়ে গিয়ে দেখল চৈতালী দেবী, চৈতী দেবী আর দেবাঞ্জলি সকালের জল খাবারের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। কুহেলি হেসে সবাইকে গুড মর্নিং উইশ করল। টুকটাক কথার মধ্যে দিয়ে কুহেলিও কাজে হাত লাগাল, হঠাৎ দেবাঞ্জলি বলল,

আচ্ছা কুহু, কালকে তুমি আর আলেখ বিসর্জনে যাওনি তাই না?

কুহেলি একটু ঘাবড়ে গেল, আমতা আমতা করে বলল,

হ্যা, মানে… না যাইনি।

চৈতালী দেবী বললেন,

ওমা, তোরা ছিলি না! আমি তো খেয়াল করিনি। কেন যাসনি রে তোরা? বেরোনোর আগেও তো দেখলাম তোদের।

না মা.. আসলে.. আসলে… মানে..

কুহেলি ঠিক কি বলবে খুঁজে পাচ্ছে না। চৈতী দেবী গরম তেলে লুচি ছাড়তে ছাড়তে বললেন,

এত ইতস্তত করছিস কেন? যাসনি কেন সেটা বল না।

কুহেলি কি বলবে বুঝতে না পেরে শেষে বলল,

আমার… আমার খুব মাথা যন্ত্রণা করছিল। তাই যাইনি….আর আমি একা থাকব তাই আলেখও যায়নি।

চৈতালী দেবী একটু ব্যস্ত হয়ে বললেন,

সেকি! হঠাৎ মাথা যন্ত্রণা হলো কেন? ওষুধ খেয়েছিস?

কুহেলি কিছু না বলে শুধু সম্মতি সূচক মাথা নাড়ল। চৈতী দেবী বললেন,

আরে ও কিছুনা, কুহুর তো প্রথম বরণ ছিল এটা। অত সিঁদুর হয়তো সহ্য হয়নি, আজকাল কার সিঁদুরে তো শুধু ভেজাল আর ভেজাল। তাছাড়া কুহুর তো অভ্যেস নেই, তাই মনে হয় মাথা ধরে ছিল।

চৈতালী দেবীর যুক্তিটা মনে ধরলেও দেবাঞ্জলির কোথাও যেন একটু খটকা লাগল, অবশ্যই সুমিষ্ট খটকা। কেমন যেন একটা মিষ্টি প্রেম প্রেম গন্ধ পাচ্ছে দেবাঞ্জলি। কুহেলি কিছু না বলে চুপচাপ আলু কাটছিল, হঠাৎ মনে হল এতক্ষণে নিশ্চয়ই কাচা হয়ে গেছে। কুহেলি চৈতালী দেবীকে বলল,

মা, আমি একটু আসছি।

কুহেলি বেরিয়ে সোজা ওয়াশরুমের দিকে এগোল, আর এদিকে দেবাঞ্জলির খটকা টা ক্রমেই বাড়ছে, কুহেলির পিছন পিছন সেও বেরিয়ে এল। কুহেলি ওয়াশরুমে ঢুকে কাচা জামা কাপড় গুলো একটা বাকেটে নিয়ে পিছন ঘুরতেই চমকে উঠল। দেবাঞ্জলি বুকের কাছে দুটো হাত ভাঁজ করে রেখে ওর দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে। কুহেলি একটু থতমত খেয়ে বলল,

মা.. মামী.. তুমি.. তুমি এখানে?

হুম, একটু দরকার ছিল তাই এলাম।

ওহ, আচ্ছা আমি যাই তাহলে, এগুলো মেলে দিতে হবে তো।

কুহেলি পাশ কাটিয়ে বেরোতে গেলে দেবাঞ্জলি ওর সামনে দাড়িয়ে বলল,

আরে দাড়াও দাড়াও, অত ব্যস্ত হওয়ার কিছু নেই। তোমাকে আর কষ্ট করে মেলতে যেতে হবে না, আমি রেখা দিকে বলছি মেলে দিতে।

কুহেলি বাধা দেওয়ার আগেই দেবাঞ্জলি রেখাকে ডেকে ওগুলো মেলে দিতে বলল। রেখা কথা মত ওগুলো নিয়ে চলে গেলে দেবাঞ্জলি কুহেলির দিকে তাকিয়ে বলল,

হুম, এবার তুমি একটু আমার সঙ্গে এসো তো।

দেবাঞ্জলি কুহেলির একটা হাত ধরে বাইরের বারান্দায় নিয়ে এলো। কুহেলি তো মনে মনে প্রমাদ গুনল, এত কিছু করেও বোধহয় শেষ রক্ষা হল না। দেবাঞ্জলি ওর হাতটা ছেড়ে দুষ্টুমি ভরা হাসি ফুটিয়ে বলল,

হুম, এবার বলো তো, তোমার কালকে সত্যিই মাথা যন্ত্রণা করছিল? নাকি অন্য কোনো ব্যাপার আছে হুম?

কুহেলি একটু অবাক হওয়ার ভাব করে দেবাঞ্জলির দিকে তাকিয়ে বলল,

মানে! তুমি কি বলছ আমি বুঝতে পারছি না।

ওহ হো, বুঝতে পারছ না! আচ্ছা বেশ বাদ দাও ওসব। বলো তো এই সাত সকালে উঠে তুমি বেড শিট কাচতে গেলে কেন? না মানে, শাড়ি বা পাঞ্জাবি কাচলে ঠিক আছে, ওগুলো কালকে ময়লা হওয়াই স্বাভাবিক কিন্তু বেডশিট কেন?

কুহেলি বুঝল ওর আর পালানোর পথ নেই, অত্যন্ত বাজে ভাবে ফেঁসে গেছে। তবুও একটা শেষ চেষ্টা করে বলল,

আসলে, ওই… আসলে সিঁদুর মাখা শাড়িটা ভুল করে বিছানার ওপর রেখে দিয়েছিলাম। তাতেই চাদরেও সিঁদুর লেগে গিয়েছিল, আর সাদা চাদর তো তাই আর দেরি না করে কেচেই ফেললাম। না হলে দাগ উঠত না তো, চাদরটা খারাপ হয়ে যেত।

একনাগাড়ে এত গুলো মিথ্যে বলার পর কুহেলি একটু দেবাঞ্জলির দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করল যে সে আদৌ বিশ্বাস করেছে কিনা। দেবাঞ্জলি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে হঠাৎ হেসে বলল,

কুহু, তুমি সত্যিই একদম মিথ্যে কথা বলতে পারো না।

ব্যাস, আর কিছু শোনার জন্য কুহেলি ওখানে দাড়ালই না। একছুটে সোজা রান্নাঘরে, দেবাঞ্জলিও একটু পরেই এসে পড়ল। কুহু না পারতে ওর দিকে তাকাচ্ছেই না, ভিষন লজ্জা করছে ওর। যাই হোক রান্না শেষ হয়ে গেলে এবার সবাইকে ডাকতে পাঠানো হল, আসলে কালকে সবাই ভাসান সেরে প্রায় ভোর রাতে ফিরেছে তাই এখনও অনেকেই ঘুমের তলায় রয়েছে। ডাকাডাকির পর্ব সেরে যখন সবাই এক সাথে খেতে বসা হল তখন আবার ঘুরে ফিরে উঠে এল আলেখ আর কুহেলির কথা, আর এবার প্রসঙ্গ টা তুলল রাত্রি।

আচ্ছা কুহেলি তুমি আর আলেখ কালকে বিসর্জনে যাওনি না?

কুহেলি সবে এক টুকরো লুচি মুখে দিয়েছিল, রাত্রির কথায় বিষম টিষম খেয়ে একসা করে ফেলল। কোনরকমে একটু জল খেয়ে শান্ত হয়ে আগে আলেখের দিকে তাকাল, দেখল তার মুখেও একটু অপ্রস্তুত ভাব ফুটে উঠেছে। আসলে যতই হোক সবার সামনে একটু অস্বস্তি তো হয়ই, তাও আবার শ্বশুর বাড়ির লোক। তবে এবার আর কষ্ট করে কুহেলিকে উত্তর দিতে হল না, দেবাঞ্জলি একটু হেসে বলল,

না গো রাত্রি ওরা যায়নি কালকে, আসলে কুহুর একটু মাথা ধরেছিল আর আলেখও ওকে একা রেখে যেতে পারেনি। কি আলেখ, ঠিক বললাম তো?

আলেখ একবার কুহেলির দিকে তাকিয়ে দেখল সে মাথা নিচু করে খাওয়ায় মন দিয়েছে, বা বলা ভাল নজর এড়ানোর চেষ্টা করছে। আলেখের বুঝতে খুব একটা অসুবিধা হলো না যে এই অজুহাত টা কুহেলিরই মস্তিষ্ক প্রসূত। নিজেকে স্বাভাবিক রেখেই হাসি মুখে আলেখ বলল,

হ্যা, হঠাৎ ও বলল ওর মাথা যন্ত্রণা করছে তাই আমিই বারন করলাম। অত আওয়াজ আর ভিড়ের মধ্যে গেলে আরও শরীর খারাপ করত, তাই আমিই যেতে দিইনি।

দেবাঞ্জলি বাদে সবাই নির্দ্বিধায় বিশ্বাস করে নিল, এমন কি কুহেলির মাথা যন্ত্রণা এখন কেমন আছে তার জন্যও সবাই উদ্বেগ প্রকাশ করল। দেবাঞ্জলি কুহেলির পাশেই বসেছিল, আস্তে করে কুহেলির কানে কানে বলল,

বুঝলে কুহু, তোমার কর্তা টি ভিষন স্মার্ট, দেখেছ কিভাবে স্মার্টলি হ্যান্ডেল করল সবটা।

কুহেলির ইচ্ছে করছিল এই ইট বালি সিমেন্ট সব ভেদ করে মাটিতে মিশে যেতে। এমন বিচ্ছিরি বিব্রতকর পরিস্থিতিতে যে না পড়েছে সে বুঝবে না। যাই হোক জলখাবারের পর্ব শেষ হলে এবার আলেখ কুহেলি আর রাত্রি নিজেদের ঘরে গিয়ে রওনা হওয়ার প্রস্তুতি নিতে লাগল। দুপুর বারোটা দশে ফ্লাইট, এখনই রেডি হয়ে না বেরোতে পারলে দেরী হয়ে যেতে পারে। কারণ একাদশীর দিনেও কলকাতার রাস্তা ঘাটে ভিড়ের পরিমাণ নেহাৎ মন্দ নয়। ওরা তিনজনে তৈরি হয়ে লাগেজ নিয়ে নিচে নেমে আসতেই সবার আগে দিঠি এসে বলল,

দি তোরা আজকের দিনটা থেকে যা না রে। আমরাও তো কালকেই চলে যাচ্ছি, তোরাও কালকে যাস।

কুহেলি হেসে বলল,

এত বড় হয়ে গেলি এখনও ছেলেমানুষী গেল না, ছোট বেলাতেও এই একই কাজ করতিস। পাগলী একটা, আমাদের টিকিট অলরেডি বুকড দিঠি।

দিঠি একটু মন মরা হয়ে গেল দেখে আলেখ বলল,

ডোন্ট বি আপসেট দিঠি, তুমি এক কাজ করো নেক্সট যখনই সুযোগ পাবে ব্যাঙ্গালোরে চলে এস।

দিঠি একটু হেসে বলল,

ওকে ডান।

তার পর রাত্রির কাছে গিয়ে বলল,

আই উইল মিস ইউ রিতু দি।

রাত্রি ওকে জড়িয়ে ধরে বলল,

আই উইল মিস ইউ টু দিঠি, ইনফ্যাক্ট আমি সবাইকে খুব মিস করব। সত্যি এত আনন্দ আমি কোনদিনও করিনি, এই কটা দিন আমার সারা জীবন মনে থাকবে।

ওরা তিনজনই একে একে সবার কাছ থেকে বিদায় নিল। শৈলজা দেবী কুহেলি আর আলেখকে বললেন,

তোরা এই যে এলি আর কবে আসবি তার তো কোনও ঠিক নেই। খুব ভালো কাটল রে এই কটা দিন, সুযোগ পেলে সময় হলে আবার এমন করে চলে আসিস কিন্তু।

কুহেলি বলল,

নিশ্চয়ই ঠাম্মু, আবার যখনই সময় পাব ঠিক তোমার কাছে চলে আসব।

আলেখ ওনাকে প্রণাম করে বললেন,

ঠাম্মু আমরা তো সময় পেলেই আসব কিন্তু এবার তোমাকে আর মাকেও কিন্তু গিয়ে কিছুদিন আমাদের কাছে থাকতে হবে।

শৈলজা দেবী হেসে বললেন,

আমার আর এই শরীর নিয়ে এত জার্নি পোষায় না বাবা, তোমরাই না হয় একটু সময় করে এই বুড়িটার কাছে ঘুরে গেলে।

চৈতালী দেবী শৈলজা দেবীর কথায় সায় দিয়ে বললেন,

মায়ের পক্ষে জার্নি করা টা সত্যিই খুব কষ্টকর, তাও আমি তেমন সুযোগ সুবিধা পেলে নিশ্চয়ই নিয়ে যাব।

কুহেলি আলেখ আর রাত্রি অবশেষে সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে পড়ল ব্যাঙ্গালোরের উদ্দেশ্যে। কুহেলির মনটা একটু খারাপ, সেটাই স্বাভাবিক অবশ্য। এতদিনের আপনজনদের সাথে আনন্দ হৈ হুল্লোড় সব ছেড়ে যেতে গেলে মন খারাপ তো হবেই। রাত্রিরও মন খারাপ, এত আনন্দের মাঝে এই কটা দিন থেকে যেন ওর একঘেয়েমি সেই জীবনে আর ফিরতে ইচ্ছে করছে না। আর আলেখ… খারাপ ওরও লাগছে, এত ভালো কেটেছে দিনগুলো কিন্তু তার মধ্যেও একটা অন্য ভালোলাগার রেশ সে সঙ্গে করে নিয়ে যাচ্ছে। নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে একান্ত আপন করে পাওয়ার আনন্দ, ভালোবাসার পরিপূর্ণতার আনন্দ। ফ্লাইট কিছুটা লেট থাকায় ওদের বাড়ি পৌঁছাতে প্রায় চারটে বেজে গেল, কুহেলি অনেকবার রাত্রিকে ওদের সঙ্গে লাঞ্চ করতে বলল কিন্তু সে কিছুতেই রাজি হল না। তার বাড়িতেও এবার নাকি আগে থেকেই সে একজন লোক ঠিক করে রেখেছে, তাকে বলে রেখেছিল ওর লাঞ্চ তৈরি আছে। তাই রাত্রি সোজা ওর বাংলোতেই চলে গেলে কুহেলি আর আলেখও ওঙ্কার ভিলায় চলে এলো। কুহেলিও আগে থেকেই বৃন্দা কে বলে রেখেছিল, তাই ফ্রেশ হয়েই আগে লাঞ্চ টা সেরে নিল। খিদেটাও জব্বর পেয়েছিল, কিন্তু অবেলায় খুব বেশি খেতে পারল না। যাই হোক, খাওয়া শেষে কুহেলি বসল ওদের লাগেজ নিয়ে। সব জামা কাপড় গুলো এখন আলাদা করে রাখতে হবে, তাছাড়াও এখন আরও অনেক কাজ আছে। কুহেলি একভাবে এটা সেটা করেই যাচ্ছে আর আলেখ চুপচাপ বসে দেখে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে দু একবার একটু কুহেলির কাছে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল কিন্তু লাভ হয়নি। কুহেলি গোটা সন্ধ্যেটা টুক টাক কাজের মধ্যে দিয়েই কাটিয়ে দিল, বেচারা আলেখ আর কি করে শেষে আর কোনও উপায় না পেয়ে ল্যাপটপ খুলেই বসে পড়ল। ডিনারের পর আরও কিছু টুকটাক কাজ সেরে কুহেলি যখন রুমে ফিরল তখন রাত প্রায় সাড়ে দশটা। ওর কাছে এটা এমন কিছু রাত নয় কিন্তু আজ জার্নিও হয়েছে আর তাছাড়া টুকটাক হলেও একটু একটু করে বেশ ভালই কাজ করে ফেলেছে। বেশ ভালই ঘুম পাচ্ছে, কুহেলি ওর ড্রেস টা বদলে একটা হালকা নাইট স্যুট পরে এসে সটান শুয়ে পড়ল। আলেখ তখন ওদের ঘর সংলগ্ন বারান্দায় দাড়িয়ে অঙ্কিতের সাথে কথা বলছিল, তাই কখন কুহেলি ঘরে এসেছে টেরই পায়নি। কথা শেষ করে ঘরে এসে দেখল কুহেলি শুয়ে ঘুমিয়েও পড়েছে। আলেখ ওর পাশে শুয়ে ঘুমন্ত নিষ্পাপ মুখ খানার দিকে তাকিয়ে একটু হাসল। তারপর খুব সাবধানে কুহেলির ঘুম না ভাঙিয়ে ওকে বুকের মাঝে টেনে নিল। এটা যেন একটা মিষ্টি অভ্যেসে দাড়িয়ে গেছে, কুহেলিকে এইভাবে বুকের মাঝখানে না পেলে আলেখের ঘুমই আসে না। আলেখ আলতো করে কুহেলির কপালে ওর ঠোঁট জোড়া স্পর্শ করে বলল,

গুড নাইট মাই লাভ।

ক্রমশ___________

© স্বত্ব সংরক্ষিত

কেমন লাগল জানাতে ভুলবেন না যেন।আজ তবে এই টুকুই। দেখা হবে আগামী পর্বে ততদিন পর্যন্ত পড়তে থাকুন ভালো থাকুন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here