সংগোপনে’ পর্ব-৩৮

0
1517

#সংগোপনে
#ধারাবাহিক_পর্ব_৩৮
#অচিন_পাখি_কলমে_ভাগ্যলক্ষ্মী_দাস

আগের পর্বের পর————-

বিজয়া দশমীর সকাল থেকেই কেমন যেন একটা মন খারাপের রেশ ঘিরে ধরে। চারটে দিনের এত আনন্দের মাঝে যেন হঠাৎ ছন্দপতনের সুর শোনা যায়। কুহেলির মনটাও সকাল থেকে ভালো নেই, দেখতে দেখতে কোথা থেকে যে চারটে দিন কেটে গেল, যেন বুঝতেই পারল না। মণ্ডপে সকাল থেকেই শুরু হয়ে গেছে মায়ের বিদায় পর্বের প্রস্তুতি। কুহেলি রোজের মত আজও সব কাজ গুছিয়ে দিচ্ছে, তবে মুখে অন্যদিনের মত হাসিটা নেই। হাসি ঠাট্টা গল্প গুজব সবই চলছে কিন্তু কারোর মধ্যেই সেই উচ্ছ্বাস টা যেন আর নেই। কি করেই বা থাকবে! এই কর্মব্যস্ততার যুগে যেখানে প্রতিনিয়ত ঘড়ির কাটার থেকেও দ্রুত ছুটে চলতে হয় সেখানে এই চারটে দিন যেন পরম প্রাপ্তির। হাজার চিন্তার ভিড় সরিয়ে নির্মল নির্ভেজাল আনন্দের জোয়ারে গা ভাসানোর এই চারটে দিন যেন বড্ড তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে যায়। কতদিন পর সবাই এক সাথে এক জায়গায় হয়ে প্রাণ খোলা আনন্দের উচ্ছ্বাসে মেতে ওঠে। কিন্তু মেয়াদ সেই চারটে দিন, আবার আগামীকাল থেকে সবাই ফিরে যাবে যার যার নিজস্ব পুরনো ছকে বাঁধা জীবন শৈলীতে। সকালে জল খাবার থেকে শুরু করে মধ্যাহ্ন ভোজের আসরেও সবার মুখেই ঘুরে ফিরে আসতে লাগল সেই একই কথা। শৈলজা দেবী বললেন,

কি ভালো কাটল কটা দিন, আবার তো কালকেই তোরা সবাই ফিরে যাবি। আবার যে কার সঙ্গে কবে দেখা হবে কে জানে।

কুহেলি একটু বিষন্ন মনেই বলল,

ঠাম্মু, জানো তো আমার এখন মনে হচ্ছে না আসলেই ভালো হত। তোমাদের সাথে কাটানো এত আনন্দের দিন গুলো এভাবে ফুরিয়ে যাওয়ার কষ্টের থেকে আসতে না পারার কষ্টটা নিশ্চয়ই কমই হত।

পাগলী কোথাকার, না এলে এত আনন্দ উপভোগের সুযোগ টা যে পেতিস না।

দুপুরের আহার পর্বের পর রাত্রি আর কুহেলি রাত্রির ঘরে বসে লাগেজ গুছিয়ে নিচ্ছিল। ওদের কাল দুপুরের ফ্লাইট, আর আজ সন্ধ্যে থেকেই মায়ের বিদায় পালা শুরু হয়ে যাবে তাই লাগেজ টা এই ফাঁকে গুছিয়ে রাখাটাই ভালো। রাত্রিরও খারাপ লাগছে, একঘেয়ে জীবনে হঠাৎ পাওয়া আনন্দ মুখরিত এই চারটে দিন কেন যে এত তাড়াতাড়ি পেরিয়ে গেল। টুকটাক গল্পের ফাঁকে রাত্রিকে ওর লাগেজ গুছানোয় একটু সাহায্য করে কুহেলি নিজের ঘরে ফিরে ওর আর আলেখের লাগেজটাও গুছিয়ে নিল। আলেখ ঘরে নেই, চিরন্তন আর আরও কয়েকজনের সঙ্গে নিচেই বসে গল্প করছে। কুহেলি সব কাজ সেরে গা টা একটু এলিয়ে দিল বিছানায়। গত দুদিন ধরে ঘুমটা ঠিক মত হয়নি, অষ্টমীর রাতে তো একেবারেই নয়। সেদিন ঠাকুর দেখে ফিরতে ফিরতে ওদের প্রায় ভোরের আলো ফুটে গিয়েছিল, সর্বসাকুল্যে হয়তো ঘণ্টা দুয়েক ঘুমিয়েছিল। আর নবমীর দিনেও তেমন একটা পার্থক্য নেই, বাড়ি ফিরে ফ্রেশ হয়ে শুতে শুতে সেই প্রায় ভোর রাত। সুতরাং গত দু রাতেই ঘুমের বেশ অভাব থেকে গেছে। শুয়ে থাকতে থাকতেই কখন যেন চোখ দুটো লেগে এসেছিল কুহেলির, হঠাৎ কারো ডাকে ঘুমটা ভেঙে গেল। প্রথমটায় বুঝতে একটু সময় লাগল এটা দিন না রাত, কারণ দুপুরে ঘুমানোর অভ্যাস টা কুহেলির নেই। একটু ধাতস্থ হতেই কুহেলি দেখল সামনে চৈতালী দেবী দাড়িয়ে আছেন।

এই, কি রে? তোর শরীর খারাপ নাকি?

না তো, কেন?

না, তুই তো দুপুরে ঘুমাস না তেমন। তাই ঘুমাচ্ছিস দেখে ভাবলাম… সে যাক গে, এখন চট পট উঠে পড়। বিকেল হয়ে গেছে, তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নে।

কেন? এখন হঠাৎ রেডি হব কেন?

ওমা, ঠাকুর বরণের সময় হয়ে এলো তো, বরণ করবি না? সন্ধ্যে থেকেই শুরু হয়ে যাবে কিন্তু, আটটা সাড়ে আটটা নাগাদ সবাই ভাসানের উদ্দেশ্যে রওনা হবে।

কুহেলির খেয়ালই ছিল না এবার তো সেও ঠাকুর বরণ করবে। প্রতিবার শুধু পাশে দাড়িয়ে দেখেছে সবাই লাল পেড়ে সাদা শাড়ী পরে বরণ করে মাকে। এবার সেও বরণ করবে, ভাবতেই মনটা ভালো হয়ে গেল। দশমীর দিনের এই একটা জিনিসই ওর ভালোলাগে, সবাই যেন সব কিছু ভুলে এক হয়ে যায় এই সময় টায়। কুহেলি উঠে বলল,

মা, দিদুনের সেই গরদের শাড়িটা আছে না?

হ্যা, আছে তো। মায়ের ঘরের আলমারিতে রাখা আছে, কেন?

আমি আজকে ওটা পরব, একটু এনে দেবে?

চৈতালী দেবী হেসে বললেন,

দাড়া, এক্ষুনি এনে দিচ্ছি।

চৈতালী দেবী চলে গেলেন শাড়ি আনতে আর কুহেলি উঠে ওর নতুন লাল ব্লাউজটা বের করল। সব শাড়ি গুলোর সঙ্গে ম্যাচিং ব্লাউজ কিনতে গিয়ে এই ব্লাউজটা দেখে খুব পছন্দ হয়ে ছিল। কি ভেবে নিয়েই নিয়েছিল, আর বাকি সব ব্লাউজ গুলোর সঙ্গে এটাও নিয়ে এসেছিল। ভাগ্যিস এনেছিল, লাল পেড়ে গরদের শাড়ির সঙ্গে বেশ মানাবে। চৈতালী দেবী কিছুক্ষণ পরেই শাড়ি আর সঙ্গে একটা থালায় বরণের সব উপকরণ সাজিয়ে নিয়ে এলেন।

এই নে, শাড়িটা এখনও কেমন নতুনের মত রয়েছে দেখেছিস?

হুম, শাড়িটা সত্যিই খুব সুন্দর।

আচ্ছা, তুই রেডি হয়ে নে, আর এই যে বরণের থালাটা এখানে রইল। আমি যাই দেখি দেবাঞ্জলি একটু ডাকছিল।

চৈতালী দেবী চলে যাওয়ার পরে কুহেলি একটু ফ্রেশ হয়ে শাড়িটা পরে নিল। কুহেলির অঙ্গে জড়ানো আটপৌড়ে করে পরা গরদের লাল পেড়ে শাড়িটা দেখে মনে হচ্ছে যেন এটা শুধুমাত্র ওর জন্যই তৈরি হয়েছিল। সঙ্গে হালকা স্বর্ণালংকারের আভূষণ যেন একটা অন্য মাত্রা এনে দিয়েছে ওর রূপে। কুহেলি হালকা একটু সেজে নিল, আলতো একটু লালের ছোয়া দিল ঈষৎ গোলাপী ঠোঁট দুটোয়। কপালে ছোট্ট একটা লাল টিপ আর সিঁথিতে রক্তিম সিদুরের ছোয়া। দীর্ঘ ঘন চুলগুলোকে আলগোছে একটা খোঁপার আকার দিয়ে একটা খোঁপার কাটা গেঁথে দিল। নিতান্ত সাধারণ সাজেও নজর কাড়া একটা মোহময়ী রূপের সৃষ্টি হল যেন। আলেখ সেই দুপুর থেকেই সবার সঙ্গে বসে গল্প করছিল, এখন একটু পোষাক পরিবর্তনের উদ্দেশ্যে ঘরে ঢুকতেই থমকে দাড়িয়ে পড়ল। সামনে দাড়ানো কুহেলি তখন নিজের সাজ সম্পূর্ণ করে আয়নায় নিজেকে এক বার ভালো করে দেখে নিচ্ছিল। আলেখ যেন বাকি সব কিছু ভুলে গেল, সম্পূর্ণ নতুন রূপে সজ্জিত কুহেলির দিক থেকে যেন দৃষ্টি ফেরানো এক প্রকার অসম্ভব হয়ে উঠল। কুহেলি এতক্ষণ আলেখকে লক্ষ্য করেনি এখন পিছন ফিরতেই আলেখকে ওভাবে দাড়িয়ে থাকতে দেখে বলল,

কি হল? ওভাবে ওখানে দাড়িয়ে আছ কেন?

কুহেলির কথায় যেন আলেখের ঘোর কাটল। একটু হেসে এগিয়ে এসে বলল,

দাড়িয়ে ছিলাম না, তোমাকে দেখে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম।

তোমার তো খালি….. যাও গিয়ে চেঞ্জ করে নাও আমি নীচে গেলাম।

কুহেলি বরণের থালা টা হাতে নিয়ে দরজার দিকে এগোতে গেলে আলেখ আচমকা পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলল,

সবসময় এত যাই যাই করো কেনো বলতো? কখনও দেখলাম না নিজে থেকে একটু আমার কাছে এসেছ।

কুহেলি একটু হেসে বলল,

তাই নাকি! আজকে তো বরং সারাটা দুপুর আমি ঘরে ছিলাম তোমারই তো পাত্তা ছিল না।

আলেখ মুখটা কুহেলির কানের একদম কাছে নিয়ে গিয়ে বলল,

ইঙ্গিত টা ঠিক কোন দিকে করলে বলতো?

আলেখের কথার অর্থ বুঝতে কুহেলির মোটেই অসুবিধা হল না। বেচারির গাল দুটো আবার রং পরিবর্তন করে ওর সাজসজ্জার সঙ্গে একদম মানানসই হয়ে উঠল।

জানি না, ছাড়ো আমাকে, নীচে সবাই অপেক্ষা করছে।

আলেখ কুহেলিকে না ছেড়েই বলল,

আর আমার কি হবে?

তোমার আবার কি হবে?

এই যে তোমাকে এখন ছাড়ার একটুও ইচ্ছে নেই, তাও ছাড়তে হবে তাহলে আমার কি হবে?

তুমি না সত্যি….. এই ছাড়ো না, নীচে সত্যিই সবাই অপেক্ষা করছে। নীচে যাওয়ার আগে একবার রাত্রির কাছেও যাব।

আলেখ আলতো করে ওর ঠোঁট দুটো কুহেলির লালচে গাল দুটোয় ছুঁইয়ে হাতের বাধন টা আলগা করে দিল। কুহেলি একটু লাজুক হাসির ছোয়া নিয়ে দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। আলেখ সেদিকে তাকিয়ে একটু মুচকি হেসে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ল। কুহেলি ওদিকে ঘর থেকে বেরিয়ে রাত্রির ঘরে এসে দেখল, রাত্রি আর দিঠি দুজনে এক সঙ্গে বসে তৈরি হচ্ছে। দুজনের পরনেই লাল সাদা কম্বিনেশনের চুড়িদার, রাত্রি দিঠিকে বেশ সুন্দর করে চুল বেঁধে দিচ্ছিল। কুহেলি হেসে বলল,

বাবা, বেশ ভালই তো চলছে দুজনের। আমাকে একদম ভুলেই গেছ তো দেখছি।

দিঠি একটা দুষ্টু হাসি ছুড়ে দিয়ে বলল,

তোকে মনে রাখার জন্য তো জিজু আছে, আমাদের তো আর কেউ নেই তাই আমরা একে অপরকে মনে রাখছি তাই না রিতু দি?

ওরে বাবা, সোজা রিতু দি! তলে তলে এতদূর? আমিই কিছু টের পেলাম না।

রাত্রি হাসতে হাসতে বলল,

তোমার বোন এত্ত সুইট না, কখন যেন আমারও বোন হয়ে গেছে। শি ইজ সাচ এ লাভলি গার্ল।

হুম, এটা ঠিক বলেছ।

ওরা তৈরি হওয়ার পরে তিন জনে একসঙ্গেই নীচে চলে গেল। মণ্ডপে আজ শুধু লাল সাদার ভিড়, বাড়ির প্রত্যেকে আজ নিজেকে লাল সাদায় সাজিয়ে তুলেছে। শুধু চৈতালী দেবী আর শৈলজা দেবী বাদে, কুহেলির এই ব্যাপারটা একটুও ভালোলাগে না। এটা সধবাদের রং আর ওটা বিধবাদের রং এই প্রভেদ টা ঠিক কে সৃষ্টি করেছিল কে জানে! কুহেলি অনেক চেষ্টার পরেও শৈলজা দেবীকে কোনদিনও কোনও উজ্জ্বল রঙের শাড়ি পরাতে পারেনি। আগে তো শুধুই সাদা পরতেন, কুহেলির জেদের কাছে হার মেনে শেষে খুব হালকা রঙের কয়েকটা রঙিন শাড়ি পরেন। চৈতালী দেবীকে অবশ্য কুহেলি কোনও রং থেকেই দূরে সরে থাকতে দেয়নি, শুধু এই লাল রং টা বাদে। চৈতালী দেবী কিছুতেই লাল রং টাকে আর আপন করে নিতে পারেননি। সবাই ধীরে ধীরে মণ্ডপে আসতে শুরু করেছে, বিধি অনুসারে দর্পণ বিসর্জন হয়ে গেছে বেশ কিছুক্ষণ আগেই, এবার শুরু হবে মায়ের বরণ পালা। ঐতিহ্যবাহী বাঙালি বধূর সাজে সজ্জিত সকল রমণীদের মনে আজ যেন এক নতুন উচ্ছাসের সঞ্চার হয়েছে। তবে শুধু রমণীদের কথা বললেই বা চলবে কেন, আজ এই বাড়ির প্রত্যেকটি পুরুষ সজ্জিত হয়েছে সাবেকি বাঙালিয়ানার সাজে। প্রত্যেকের পরনে আজ লাল রঙের ধুতি আর সাদা রঙের পাঞ্জাবি। চিরন্তন সবার জন্যেই একই পোশাক অনিয়েছে, এক সাজে সজ্জিত সকলকেই আজ অসম্ভব সুন্দর লাগছে। কুহেলি দেবাঞ্জলি রাত্রি দিঠি আরও অনেকেই একযোগে অপেক্ষা করছে মায়ের বরণ পর্বের সূচনার। রাত্রি আর দিঠি যদিও শুধুই দর্শক তবুও তাদের উৎসাহের কোনও অভাব নেই। আলেখ ধুতি পাঞ্জাবি পরে তৈরি হয়ে মণ্ডপে আসতেই ওর চোখ দুটো আপনা থেকেই যেন কারও অন্বেষণে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। বেশি অপেক্ষা করতে হল না, কিছুটা দূরেই দেখতে পেল কুহেলিকে। আজ কেন যেন আলেখ কিছুতেই চোখ ফেরাতে পারছে না কুহেলির দিক থেকে। আলেখ একটু হেসে এগিয়ে গেল কুহেলির দিকে, রাত্রি আগে দেখতে পেল আলেখকে। চোখ দুটো গোল গোল করে বিস্ময়ের পরম সীমানায় পৌঁছে গিয়ে বলল,

আরে, এটা কাকে দেখছি! আলু…. আই মিন আলেখ এটা সত্যিই তুই?

রাত্রির কথায় কুহেলিও পিছন ফিরে তাকিয়ে একটু অবাক না হয়ে পারল না। ধুতি পাঞ্জাবি পরিহিত সম্পূর্ণ বাঙালি সাজে সজ্জিত আলেখকে সত্যিই খুব ভালো লাগছে। একটা মিষ্টি হাসি যেন এমনিই ফুটে উঠল ঠোঁটে। আলেখ রাত্রির মাথায় একটা আলতো চাটি মেরে বলল,

মুখটা বন্ধ কর, যখনই মুখ খুলিস আজে বাজে বকিস।

যাহ বাবা, আমি আবার কি আছে বাজে বললাম! তোকে সত্যিই চেনা যাচ্ছে না রে। ইউ আর লুকিং রিয়েলি ভেরি ডিফরেন্ট অ্যান্ড মাচ মোর হ্যান্ডসাম অলসো।

আলেখ কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই ঢাকে কাঠি পড়ল। মুহুর্তের মধ্যে গোটা পরিবেশটাই যেন বদলে গেল, দিঠি তো রাত্রিকে টানতে টানতে মণ্ডপের মাঝখানটায় নিয়ে গেল যেখানে ইতিমধ্যে ধুনুচি নাচ শুরু হয়ে গেছে। দিঠি নিজে একটা ধুনুচি নিল আর রাত্রির হাতেও একটা ধরিয়ে দিল। রাত্রি প্রথমটায় বেশ ভয় পাচ্ছিল কিন্তু দিঠির দেখা দেখি কিছুক্ষণের মধ্যেই মেতে উঠল নাচে। কুহেলি সেদিকে তাকিয়ে মৃদু মৃদু হাসছিল, আলেখ কুহেলির কানের কাছে মুখ এনে বলল,

এত হেসো না, আমি এমনিই তোমার রূপে ঘায়েল হয়ে আছি এখন যদি অমন নেশা ধরানো হাসির ঢেউ জাগাও তাহলে আমি কিন্তু আর নিজেকে সামলে রাখতে পারব না। কুহেলি চোখ দুটো নামিয়ে যেন ওর গালের রং পরিবর্তনের প্রচেষ্টাকে বিফল করার আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগল। কতটা সফল হল জানি না তবে আলেখ যে আরও বেশি ঘায়েল হল সেটা বলতে পারি। আজ হঠাৎ করেই কেন যেন ওর সমস্ত অনুভূতিরা একযোগে নিজেদের অস্তিত্ব প্রকাশের খেলায় মেতে উঠতে চাইছে। কুহেলি অল্প হেসে আলেখের দিকে তাকিয়ে একটু থেমে থেমে বলল,

আজ…. তোমাকেও… খুব… ভালো…. লাগছে।

আলেখ কুহেলির আরও কিছুটা কাছে সরে আসতে যাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই দেবাঞ্জলি এসে কুহেলির হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে যেতে বলল,

আরে কুহু, এখনও এখানে দাড়িয়ে কি করছ? চলো চলো, দেখো সবাই বরণ শুরু করে দিয়েছে। কুহেলি যেতে যেতে একবার পিছন ফিরে আলেখের দিকে তাকিয়ে একটা লজ্জা মিশ্রিত হাসি উপহার দিয়ে গেল। আর সেই হাসির দোলায় যেন আলেখের হৃদয়ে জেগে ওঠা অনুভূতি গুলো নতুন করে আন্দোলিত হতে লাগল। কুহেলি দেবাঞ্জলির হাত ধরে উঠে এলো দেবীমঞ্চে। শুরু হয়ে গেছে বরণ পর্ব, সবাই একে একে মায়ের সিঁথি রাঙিয়ে দিচ্ছে, সিঁদুরের ছোয়ায় মায়ের মুখমণ্ডল ধীরে ধীরে রক্তিম হয়ে উঠল। কুহেলি ওর জীবনের প্রথম বরণ পর্ব সম্পন্ন করল, একটা অদ্ভুত অনাবিল আনন্দে ভরে উঠল ওর মন। বরণ শেষে শুরু হল সিঁদুর খেলা, চেনা অচেনা, ধনী দরিদ্র নির্বিশেষে আজ যেন সবাই একাত্ম হয়ে উঠেছে। মায়ের সামনে এসে বোধহয় তার সব সন্তানেরাই এভাবেই এক হয়ে যায়। পরম আনন্দে সবাই রাঙিয়ে দিচ্ছে একে অন্যের সিঁথি, রক্তিম বর্ণের ছটায় ভরিয়ে দিচ্ছে গোটা মুখমণ্ডল। নিজে হাতে সবাই সবাইকে মিষ্টিমুখ করিয়ে দিচ্ছে। কি অপূর্ব এই দৃশ্য, মঞ্চের সামনে চলছে সিদুর খেলা আর আর মণ্ডপের মধ্যস্থানে চলছে ধুনুচি নাচ। আলেখও একবার চিরন্তনের জোরাজুরিতে একটা ধুনুচি হাতে নিয়ে কিছুটা তাল মেলানোর চেষ্টা করেছিল কিন্তু আলেখ বরাবর এইসবে তেমন পারদর্শী নয়। তাই কোনরকমে সেখান থেকে পালিয়ে একটা পাশে এসে দাড়িয়েছে। আলেখ পুরো ব্যাপারটাই ভিষন উপভোগ করছে কিন্তু তার মাঝেও ওর চোখ জোড়া একভাবে অনুসরণ করে চলেছে কুহেলিকে। একসময় ধীরে ধীরে শুরু হল মায়ের বিসর্জনের প্রস্তুতি। বাড়ির সবাই যাবে বিসর্জনে, শুধু স্বরূপ বাবু আর শৈলজা দেবী থাকবেন। এ যেন এক অনন্য সুন্দর শোভাযাত্রা, ঢাকের বাদ্যি আর আলোর রোশনাই তে সজ্জিত হয়ে মা তার সন্তানদের নিয়ে ফিরে চলেছেন তার পতিগৃহে। সমস্ত প্রস্তুতি শেষ হলে চিরায়ত সেই উল্লাস ধ্বনির সঙ্গে শুভারম্ভ হল মায়ের কৈলাশ যাত্রার। একযোগে সমস্বরে সবাই বলে উঠল,

বলো দুগ্গা মাই কি… জয়। আসছে বছর আবার হবে। বলো দুগ্গা মাই কি…. জয়।

কুহেলিও পা মিলিয়ে এগোতে যাচ্ছিল সেই আবার ফিরে আসার যাত্রায়। কিন্তু হঠাৎ একটা আচমকা টানে ভিড় থেকে সরে যেতে হল। একটা বলিষ্ট হাত যেন অতর্কিতে তাকে টেনে নিয়ে যেতে লাগল বাড়ির অন্দর মহলের দিকে, যেখানে এখন… কেউ নেই। কুহেলি প্রথমটায় ঘটনার আকস্মিকতায় একটু ঘাবড়ে গেলেও সেই হাতের স্পর্শ চিনতে তার ভুল হয়নি। আলেখ এক হাতে কুহেলির হাত ধরে টেনে নিয়ে এল বাড়ির পিছন দিকের লম্বা নির্জন বারান্দায়। এদিকে আলোর রোশনাই ততটা নেই, এদিক ওদিক থেকে চুইয়ে আসা আলোর ছোয়ায় যেন একটা মায়াবী পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। আলেখ কুহেলিকে একটা বিরাট থামের সঙ্গে চেপে ধরে ওকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে একমুঠো সিঁদুরে রাঙিয়ে দিল ওর সিঁথিটা। কুহেলির চোখ দুটো আবেশে বুজে এল যেন, আলেখ কুহেলির অনেকটা কাছে এসে নেশা ধরানো সুরে বলল,

তোমার সিঁথির সিঁদুরে নামটা তো আমারই, আর আজকের দিনে আমি তোমাকে নিজের হাতে সিঁদুরের ছোয়া না দিলে কি দিনটা সম্পূর্ণ হত?

কুহেলি বন্ধ চোখের আগল ভেদ করেও যেন আলেখের চোখের গভীরে থাকা ভালোবাসার আহ্বান স্পষ্ট দেখতে পেল। আলেখের তপ্ত নিশ্বাসের ছোয়ায় যেন তির তির করে কেপে উঠতে লাগল ওর সর্বাঙ্গ। কুহেলি ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকাল আলেখের দিকে, ভালোবাসার আকুল আহ্বানের ডাকে সাড়া দিয়ে কুহেলি আঁকড়ে ধরল আলেখকে। মিশে যেতে চাইল ওই প্রশস্ত নিরাপদ আশ্রয়ের ঠিকানায়। আলেখও নিজের দুটো হাতের মাঝে যেন বেঁধে নিতে চাইল কুহেলিকে। আলেখের দ্রুত হয়ে আসা হৃদস্পন্দন যেন কুহেলি শুনতে পাচ্ছে, আর সেই দ্রুত গতির সঙ্গে তাল মেলাতেই যেন কুহেলির হৃদস্পন্দনও ক্রমশই দ্রুত হয়ে এল। আলেখ হঠাৎ করেই কুহেলিকে কোলে তুলে নিল, কুহেলি পরম আবেশে দুহাতে আলেখের গলা জড়িয়ে ধরল। আলেখ কুহেলিকে কোলে নিয়েই উঠে এল নিজেদের ঘরে। কুহেলি কেমন যেন একটা ঘোর লাগা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আলেখের দিকে। যেন কোনও একটা স্বপ্নের দুনিয়ায় ভেসে যাচ্ছে, সুদূরে। আলেখ ধীরে ধীরে কুহেলিকে বিছানার উপরে বসাল, ঘরে জ্বলতে থাকা হালকা আলোর মায়াবী পরিবেশে যেন ওরা দুজনেই ধীরে ধীরে ভেসে যেতে লাগল ভালোবাসার অতল সাগরে। আলেখ কুহেলির পাশে বসে আলতো হাতে কুহেলির গাল স্পর্শ করল। আলেখের উষ্ণ ছোয়ায় যেন কুহেলির সর্বাঙ্গ জুড়ে একটা শিহরণ ছড়িয়ে গেল। আলেখ আলতো হাতে একে একে খুলে দিতে লাগল কুহেলির অঙ্গে সজ্জিত সব স্বর্ণালঙ্কার। আলেখের ছোয়া যেন একটু একটু করে কুহেলির শিরা উপশিরায় এক দুর্দমনীয় দহনের সৃষ্টি করতে লাগল। ঘন হয়ে আসতে লাগল ওর নিশ্বাস, দ্রুত থেকে দ্রুততর হল ওর হৃদযন্ত্রের প্রতিটা স্পন্দন। উত্তেজনায় কাপতে লাগল কুহেলির কোমল ওষ্ঠাধর। ঈষৎ কম্পমান সেই অধর যুগল যেন আলেখের হৃদয়ের সব অনুভূতি গুলোকে তোলপাড় করে দিতে লাগল। আজ আবার সেই অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণ অনুভব করল আলেখ। উত্তাল অদম্য অনুভূতির ডাকে সাড়া দিয়ে আলেখ পরম আবেশে কুহেলিকে মিশিয়ে নিল নিজের বুকের মাঝে। কুহেলির হাত দুটোও যেন আলেখকে আকড়ে ধরে আরও গভীরে মিশিয়ে নিতে চাইল। আলেখ একহাতে কুহেলির খোঁপায় গোজা কাটা টা খুলে দিল, আলগোছে বেঁধে রাখা সুদীর্ঘ ঘন কেশরাশি ছড়িয়ে পড়ল কুহেলির পিঠের উপর। আলেখ মুখ ডুবিয়ে দিল সেই ঘন কালো কুন্তল রাশির ছায়ায়। মাতাল করা সেই ঘ্রাণে আলেখ যেন হারিয়ে যেতে লাগল কোনও এক অজানা স্বপ্নপুরীতে। ধীরে ধীরে আলেখ ডুব দিল কুহেলির কাধে, উষ্ণ ঠোঁটের স্পর্শ ছুয়ে যেতে লাগল কুহেলির উন্মুক্ত কাধ, গলা। কুহেলি যেন সব ভুলে ভেসে চলেছে ভালোবাসার সুখ সাগরে। আলেখ আলতো করে শুইয়ে দিল কুহেলিকে, আবেশে কুহেলির চোখ দুটো আবার বুজে এল। নিজেও কুহেলির পাশে শুয়ে আবার ওকে টেনে নিল নিজের বুকের মাঝে। আলেখের একটা হাত ধীরে ধীরে উঠে এল কুহেলির উন্মুক্ত পিঠে, আলতো ঠোঁটের ছোয়া স্পর্শ করল কুহেলির কানের লতি। কুহেলির গোটা শরীর যেন কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগল, আলেখের প্রশস্ত বুকের আরও গভীরে মিশে যেতে চাইল যেন। আলেখ নিজের বুকে কুহেলির উষ্ণ উদ্ভিন্ন যৌবনের স্পর্শ অনুভব করে যেন আরও রোমাঞ্চিত হয়ে উঠল। আলেখের হাত ধীরে ধীরে স্পর্শ করল কুহেলির ব্লাউজের সূক্ষ্ম রশি, আলতো টানেই তাদের বাঁধন শিথিল হয়ে গেল। কুহেলির সমগ্র সত্তা জুড়ে যেন লজ্জারা নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করতে লাগল। আলেখ ধীরে ধীরে কুহেলিকে একটু আলাদা করল নিজের থেকে, কম্পমান বন্ধ চোখের পাতায় ছুইয়ে দিল ওর উত্তপ্ত তৃষ্ণার্ত অধর যুগল। কুহেলির সর্বাঙ্গ জুড়ে ছড়িয়ে পড়তে লাগল সেই উত্তেজনার কম্পন। আলেখ একে একে ওর ঠোঁট জোড়া ছুঁইয়ে দিতে লাগল কুহেলির কপালে, গালে, ঠোঁটে। কুহেলির একটা হাত কখন যেন উঠে এসেছে আলেখের পিঠে, আর অন্য হাতটা এলোমেলো ভাবে ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছে আলেখের গভীর চুল গুলোর আনাচে কানাচে। প্রগাঢ় এক চুম্বনের পরেও যেন শান্ত হল না দুটো তৃষ্ণার্ত মনের প্রেমাগ্নি। আলেখ কুহেলির ঠোঁট দুটো ছেড়ে মোহাবিষ্টের মত কিছুক্ষণ চেয়ে রইল কুহেলির রক্তিম মুখের দিকে। আজ সিঁদুরের লালের আড়ালে যেন ঢাকা পড়ে গেছে কুহেলির স্বভাবসিদ্ধ লাজুকতার রক্তিম আভা। ধীরে ধীরে আলেখের মুগ্ধ নেশাতুর দৃষ্টি ছুয়ে যেতে লাগল কুহেলির প্রতিটা অঙ্গের আনাচ কানাচ। অবিন্যস্ত শাড়ির বক্ষ সংলগ্ন কিছুটা অংশ স্থানচ্যুত হয়ে এলিয়ে পড়েছিল নরম বিছানার দুধ সাদা চাদরের উপরে। অনাবৃত সেই অংশে প্রকট হয়ে উঠেছে সুগভীর বক্ষ বিভাজিকা। আলেখের মনে হল সেই সুগভীর বিভাজিকা তাকে যেন কোনো অতলান্ত কৃষ্ণগহ্বরের যুগ যুগান্ত ধরে রহস্যে আবৃত এক অচেনা জগতে পাড়ি জমানোর হাতছানি দিয়ে ডাকছে। সেই অমোঘ হাতছানি উপেক্ষা করার মত ইচ্ছে বা সামর্থ্য কোনোটাই তার নেই। আলেখ কালমাত্র বিলম্ব না করে সেই অপ্রতিরোধ্য অমোঘ আকর্ষণে সাড়া দিয়ে ডুব দিল কুহেলির রূপ সাগরে। একাত্ম দুটি মন যেন এক হয়েও অপূর্ণ রয়ে গিয়েছিল, আজ যেন সেই অপূর্ণ পরিণতির পূর্ণতা লাভের রাত। ভালোবাসার অতলস্পর্শী সাগরে ডুব দিয়ে দুটো দৈহিক সত্তারও যেন আজ একাত্মতা লাভের রাত। প্রেম বন্ধনে আবদ্ধ দুটো মন যেন আজ সর্বত রূপে পূর্ণতার শিখরে উন্নীত হল। বাড়তে থাকা রাতের গভীরতার সঙ্গে ধীরে ধীরে ভালোবাসার পরশে শান্ত হতে লাগল ওদের তৃষ্ণার্ত হৃদয়ে জ্বলতে থাকা প্রেমাগ্নির দহন।

ক্রমশ__________

© স্বত্ব সংরক্ষিত

একটি কথাও বলব না আজ। শুধু অপেক্ষার প্রহর গুনবো… আপনাদের সুন্দর সুন্দর কমেন্টের। আজ তবে আসি…. দেখা হবে আগামী পর্বে ততদিন পর্যন্ত পড়তে থাকুন ভালো থাকুন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here