সংগোপনে’ পর্ব-৩৭

0
1507

#সংগোপনে
#ধারাবাহিক_পর্ব_৩৭
#অচিন_পাখি_কলমে_ভাগ্যলক্ষ্মী_দাস

আগের পর্বের পর————-

কি হল? ওঠো, দেরী হয়ে যাচ্ছে তো। আরে ওঠো, আমি কিন্তু আর ডাকব না বলে দিচ্ছি। কি অদ্ভুত, বাড়িতে তো ডাকতেই হয় না, অ্যালার্মও লাগে না এমনিই উঠে পড়। আর এখন দেখ, ডেকেই যাচ্ছি তাও ওঠার নাম নেই, কি হল টা কি! তুমি উঠবে না নাকি?

কুহেলি প্রায় মিনিট পনের ধরে আলেখকে ওঠানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে কিন্তু তার ওঠার কোনও আগ্রহই নেই। শেষে আরও কয়েকবার ডাকাডাকির পর আলেখ বেশ আয়েশ করে একটা আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসে বলল,

কি হল, এত কেন ডাকছ? তাও এই ভোর বেলায়?

এটা ভোর মনে হচ্ছে তোমার? সাতটা বেজে গেছে, শিগগিরি উঠে স্নানে যাও। আর এত কেন ডাকতে হলো বলো তো? বাড়িতে তো রোজ ভোর বেলাতেই ওঠো।

আলেখ একটা অলস হাই তুলে বলল,

আরে শ্বশুরবাড়িতে এসেও যদি একটু আরাম না করলাম, তাহলে আর কি লাভ বলো তো!

অনেক আরাম হয়েছে, এখন যাও তাড়াতাড়ি স্নান সেরে এস, আমি একটু রাত্রির কাছে যাচ্ছি।

আলেখ এতক্ষণে ঘুমের রেশটা কাটিয়ে ভালো করে কুহেলির দিকে তাকাল। আজ একটা লাল টুকটুকে ঢাকাই জামদানী পরেছে, সঙ্গে সাদা রঙের একটা ব্লাউজ। ব্লাউজের পিঠের অংশে খুব সুন্দর সূক্ষ্ম সুতোর কাজে মা দুর্গার মুখ ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। ব্লাউজের হাতের আর পিঠের বর্ডার লাইন গুলোতে লাল কুচি দেওয়া। ভারী সুন্দর লাগছে দেখতে, লাল টিপ, লাল সিদুর, লাল শাড়ি সব মিলিয়ে যেন মনে হচ্ছে ফুটফুটে একটা লাল গোলাপ ফুটে রয়েছে। আলেখ উঠে এসে কুহেলির পিছনে দাঁড়িয়ে সবে ভাবছে প্রাণ ভরে এই সদ্য ফোঁটা গোলাপ কুড়ির সুবাসে ডুব দেবে তখনই কুহেলি দুটো প্যাকেট ওর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,

এই নাও, এই লাল প্যাকেট টা তোমার আর এই সাদা প্যাকেট টা মিস্টার আগরওয়ালের।

ব্যাস, সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে এত সুন্দর মুডটার পুরো বারোটা বেজে গেল বেচারার। একটু তেতো মুখেই বলল,

এতে কি আছে?

পাঞ্জাবি, অষ্টমীর অঞ্জলি তে মেয়েরা শাড়ি আর ছেলেরা পাঞ্জাবি পরে।

মিস্টার আগরওয়ালের জন্যও কিনেছিলে?

না, এটা আমি কিনিনি, কালকে উনি আসবেন বলার পর হঠাৎ মনে হল তাই মামা কে বলেছিলাম। মামাই কাউকে দিয়ে আনিয়েছে বোধহয়।

আর আমার টা?

তোমারটা তো আমি আগেই কিনে রেখেছিলাম।

এতক্ষণে মুখে একটু হাসি ফুটল বাবুর, ওর পাঞ্জাবিটা কুহেলির নিজের পছন্দ করা আর নিশীথের টা নয় এটাই যেন বিরাট খুশির বিষয়। এবার হাসি মুখেই বলল,

বেশ, তবে ওনারটা আমাকে দিচ্ছ কেন?

তুমি একটু ওনাকে দিয়ে এসো, আমি যাচ্ছি রাত্রির কাছে। তুমি স্নান সেরে রেডি হয়ে এটা ওনাকে দিয়ে দিও বুঝলে।

আলেখকে আর উত্তর দেওয়ার সময় দিল না কুহেলি। একটা বেশ বড়সড় প্যাকেট নিয়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। আলেখ আর কি করে, প্যাকেট দুটো খাটের উপর রেখে ওয়াশরুমে চলে গেল ফ্রেশ হতে। কুহেলি এদিকে সোজা রাত্রির ঘরে এসে নক করল, রাত্রিও ঘুম থেকে উঠে পড়েছিল তাই দরজা খুলতে বেশি দেরী হল না। কুহেলি হাসি মুখে ঘরে ঢুকে বলল,

গুড মর্নিং, রাত্রি।

গুড মর্নিং কুহেলি, তুমি তো একদম রেডি দেখছি।

হুম, অনেক কাজ আছে তো। নীচে তো অলরেডি কাজ শুরুও হয়ে গেছে।

ওহ, আমি তো এই জাস্ট ফ্রেশ হলাম। আমার একটু টাইম লাগবে, তোমার তো কাজ আছে তুমি তাহলে চলে যাও আমি আসছি একটু পরেই, না হলে তোমার আবার দেরী হয়ে যাবে।

কাজ আছে ঠিকই, তবে নীচে যাওয়ার আগেও কিছু কাজ আছে।

বলে কুহেলি ওর হাতের প্যাকেটটা রাত্রির হাতে দিয়ে বলল,

নাও, আজকে এটা পরবে তুমি।

রাত্রি একটু অবাক হয়ে বলল,

কি এটা?

কুহেলি হেসে বলল,

খুলেই দেখো।

রাত্রি হলুদ রঙের প্যাকেটটা খুলে অবাক হয়ে গেল। একটা হালকা গোলাপী রঙের জামদানী শাড়ি, সঙ্গে ম্যাচিং জুয়েলারী। রাত্রি চোখদুটো গোলগোল করে বলল,

একি! শাড়ি! কে পরবে?

যাকে দিলাম সে পরবে।

রাত্রি প্যাকেট টা কুহেলির হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,

অসম্ভব, পাগল নাকি! আমি আর শাড়ি? ইমপসিবল, জাস্ট অসম্ভব।

কুহেলি শাড়িটা বিছানার ওপর রেখে বলল,

কেন শুনি?

কেন আবার? এইসব ক্যারি করা আমার কাজ নয়। শ্যুটের সময় ওই ভারী লেহেঙ্গা সামলাতে গিয়েই হিমশিম খাচ্ছিলাম আর সেখানে এই শাড়ি! না না, আমার কোনও অঘটন ঘটানোর ইচ্ছে নেই।

আরে কিচ্ছু হবে না, তুমি শুধু শুধু ভয় পাচ্ছ। সবাই সব কাজ লাইফে প্রথম তো একবার করেই, এটাও আজ তুমি প্রথম ট্রাই করবে। আমি বলছি তো কিছু হবে না।

কিন্তু কুহেলি…..

তুমি আজকে এই শাড়িটা না পরলে কিন্তু আমি খুব কষ্ট পাব। এবার ভেবে দেখো কি করবে।

উফ্, এই ইমোশনাল ব্ল্যাকমেল…. সত্যিই তুমি না…. বেশ, পরব। কিন্তু আমি পরতে পারি না, তোমাকেই পরিয়ে দিতে হবে।

সে আমি জানি।

কুহেলি খুশি মনে রাত্রিকে নিজে সাজিয়ে দিল, সবটাই হয়ে গেছে শুধু আঁচল টা পিন করা বাকি এমন সময় দিঠি একরকম লাফাতে লাফাতে ঘরে এসে বলল,

আরে দি তুই এখানে! আমি সারা বাড়ি খুঁজে মরছি।

কেন? তুই আমার ঘরে যাসনি?

হ্যা, আগে তো ওখানেই গিয়েছিলাম।

তাহলে? আলেখ তো জানে আমি এখানে আছি তোকে বলেনি?

থাকলে তো বলবে, সে তো নিজেই ঘরে নেই।

ও, আচ্ছা বল খুঁজছিলি কেন?

আরে নিচে মা মাসি সবাই তোকে ডাকছে, অনেকক্ষণ হল।

আচ্ছা আসছি একটু পরেই হয়ে গেছে।

না না, এক্ষুনি চল।

আরে! আমার হয়ে এসেছে প্রায় দুমিনিট।

দু মিনিট কেন, দু সেকেন্ডও না। সবাই অনেকক্ষণ থেকে খুঁজছে তোকে, তুই চল। না হলে এবার সবাই আমাকে বকবে।

বলে দিঠি মোটামুটি কুহেলির হাত ধরে টানতে লাগল, কুহেলি উপায় না পেয়ে রাত্রিকে বলল,

সরি রাত্রি, তুমি প্লিজ পিন টা একটু করে নাও, আমি যাই দেখি কেন ডাকছে।

দিঠিও কুহেলিকে নিয়ে যেতে যেতে রাত্রিকে সরি বলে গেল। নাহ, শাড়ি টা পরা হয়েই গেছে এখন শুধু পিন টা করলেই হয়। তবে এই পিন করা টুকুও রাত্রির কাছে বেশ দুরূহ ব্যাপার মনে হচ্ছে। রাত্রি খুব সাবধানে সাজানো প্লিট গুলো ধরে রেখে অনেক কষ্টে শেষে পিন করেই ফেলল। সামান্য পিন করেই রাত্রির মনে হল যেন বিশ্বজয় করে ফেলেছে, ঘুরে ফিরে একবার ভালো করে নিজেকে আয়নায় দেখল। নাহ, বেশ ভালই লাগছে ওকে এই নতুন সাজে, একটা স্নিগ্ধ সৌন্দর্য্যের ছোয়া লেগেছে যেন। রাত্রি বেশ খুশি মনে জুয়েলারী গুলো পরতে লাগল। এদিকে কুহেলি চলে যাওয়ার পরই আলেখ স্নান সেরে তৈরি হয়ে নিয়েছে। আকাশ নীল পাঞ্জাবি টায় ভারী সুন্দর মানিয়েছে ওকে। যাই হোক, নিজে তৈরি হয়ে নিশীথের জন্য আনা প্যাকেট টা নিয়ে আলেখ কিছুটা অনিচ্ছা সত্ত্বেও নিশীথের ঘরের দরজাটার সামনে এসে নক করল। নিশীথ এদিকে দরজা খুলেই সামনে দাড়ানো আলেখকে দেখে একটু অবাকই হল। নিশীথ বিচক্ষণ ব্যক্তি, আলেখ যে তাকে তেমন পছন্দ করে না সেটা আলাদা করে বলে দেওয়ার প্রয়োজন হয় না। তাই আলেখ যে এই সকাল বেলায় তার সঙ্গে কুশল বিনিময় করতে আসেনি এটা খুব সহজেই অনুমেয়। অল্প হেসে নিশীথ বলল,

গুড মর্নিং মিস্টার শর্মা।

আলেখও ওর স্বভাবসিদ্ধ হাসিটা বজায় রেখেই বলল,

গুডমর্নিং, রাতে কোনও অসুবিধা হয়নি তো?

একদম না, আসুন না ভিতরে এসে কথা বলি।

আলেখ অল্প হেসে ভিতরে প্রবেশ করল, নিশীথ সরাসরি বলল,

বলুন, হঠাৎ সকাল বেলায়?

আলেখ মাঝে মধ্যে অবাক হয়ে যায়, কেউ এতোটা সরাসরি কীকরে কথা বলতে পারে! আলেখ যে প্রয়োজন ছাড়া এখানে আসবে না সেটা অনুমান করা মোটেও কঠিন কাজ নয় কিন্তু তাই বলে এমন সরাসরি কেউ কীকরে বলতে পারে! যাক, বলেই যখন ফেলেছে তখন আর অযথা কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। আলেখ প্যাকেট টা নিশীথের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে হাসিমুখেই বলল,

এটা দিতে এসেছিলাম।

কি এটা?

কুহে…. আমার আর কুহেলির পক্ষ থেকে একটা ছোট্ট গিফট।

শুধু কুহেলির নাম টা নিতে গিয়েও থেমে গেল আলেখ। সত্যি কিসের যে এই অদ্ভুত একটা রাগ না অভিমান না অন্যকিছু কে জানে! আর তার জন্য কি কি না করে বেড়াচ্ছে, দ্য আলেখ শর্মা। নিশীথ একটু অবাক হয়ে প্যাকেট টা নিয়ে খুলে দেখল একটা হলুদ রঙের পাঞ্জাবি।

ওয়াও, দারুন। থ্যাঙ্কস মিস্টার শর্মা, আমি শুনেছিলাম এখানে অষ্টমীর অঞ্জলিতে বেশিরভাগ সবাই শাড়ি আর পাঞ্জাবি পরে। আমার ইচ্ছে ছিল একটা পাঞ্জাবি নেওয়ার বাট এনি হাউ সেটা আর হয়ে ওঠেনি। যাক, ইচ্ছেটা আপনারা ফুলফিল করে দিলেন, থ্যাঙ্কস এগেইন।

ইউ আর মোস্ট ওয়েলকাম, এটা পরে রেডি হয়ে নীচে চলে আসুন। আমিও নিচেই আছি।

ওকে।

আলেখ চলে যাওয়ার পর নিশীথ পাঞ্জাবিটা পরে তৈরি হয়ে নিল। অমন সুপুরুষ সুদর্শন যুবকের অঙ্গে যাই উঠুক না কেন, তার শোভা বাড়াবেই। নিশীথের ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম হল না, বেশ একটা অন্যরকম লাগছে আজকে। তৈরি হয়ে সবে নীচে যাওয়ার জন্য ঘর থেকে বেরিয়েছে অমনি কিসের একটা সঙ্গে জোর ধাক্কা লেগে গেল। সামনে তাকাতেই মেজাজটা এক্কেবারে বিগড়ে গেল, ধাক্কাটা কোনও বস্তুর সঙ্গে নয় লেগেছে রাত্রির সঙ্গে। আর এবারেও দোষটা সেই রাত্রিরই, সে শাড়ি সামলাতে গিয়ে আর এদিকে ওদিকে তাকানোর সুযোগ পায়নি। ব্যাস, আর কি, কথায় আছে না, যেখানে বাঘের ভয় সেখানে সন্ধ্যা হয়। এখানেও ব্যাপারটা কিছুটা তাই, বেছে বেছে একেবারে একই সময়ে দুজনকে ঘর থেকে বেরোতে হল আর, একদম সঠিক সময়েই রাত্রির মনটা শাড়ির দিকে থাকতে হল। রাত্রি কোনরকমে নিজেকে শাড়ি সমেত ভূপতিত হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করলেও এই অনাকাঙ্ক্ষিত সংঘাতের ফলে পাশের দেওয়ালে হাতটা বেশ জোরেই লাগল। বেচারি নিজের হাত টা ডলতে ডলতে বেশ কড়া করে দু চার কথা নিশীথ কে শোনানোর তোড়জোড় করছিল কিন্তু তার আগেই নিশীথ আক্রমণ করে বসল।

চোখ দুটো মাঝে মধ্যে একটু ব্যবহার করবেন, না হলে যেটুকু কার্যক্ষমতা অবশিষ্ট আছে সেটুকুও আর থাকবে না।

রাত্রির ভারী রাগ হল, সে বলে জীবনে প্রথম বার শাড়ি পড়েছে, আর সেটা সামলাতেই প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে পড়ছে। আর তার উপরে এমন গা জ্বালানো কথা শুনলে কার না রাগ হয়! তবে সে পাল্টা কিছু বলার সুযোগ পেল না, নিশীথ তার আগেই গটগট করে ওর সামনে দিয়েই সিড়ি বেয়ে নীচে নেমে গেল। আর রাত্রি বেচারি তার শাড়ি সামলাতে সামলাতে অতি কষ্টে শেষ পর্যন্ত মণ্ডপে এসে পৌঁছাতে সক্ষম হল। কুহেলি পুজোর কাজে ভীষন ব্যস্ত, আলেখ দু একবার কথা বলার চেষ্টা করেও বিশেষ সুবিধা করতে পারেনি। ফলে সে এখন বাড়ির অন্য পুরুষ সদস্যদের সাথে বসে গল্পের আসরে যোগ দিয়েছে। কিছুক্ষণ পর নিশীথও ওদের দলেই এসে যোগ দিল আর রাত্রি এসে কুহেলিকে খুঁজে নিয়ে ওর কাছে গিয়ে ভারী করুন মুখ করে বলল,

কুহেলি, আমি একদম ক্যারি করতে পারছি না। যদি কিছু হয়ে যায়! না মানে, যদি ধরো এদিকে ওদিকে কোথাও…..

কুহেলি হেসে ওকে মাঝপথেই থামিয়ে দিয়ে বলল,

এত চিন্তা করো না তো, এক কাজ করো তুমি এটা ভুলেই যাও যে তুমি শাড়ি পরেছ। বেশি মনোযোগ দিও না ওদিকে, তাহলেই দেখবে আর কোনো সমস্যা হবে না।

উপায় টা বেশ মনে ধরল রাত্রির, সত্যিই তো, শাড়ির দিকে মন না দিলেই হল। রাত্রি খুশি হয়ে বলল,

ঠিক বলেছ, আচ্ছা বলো আমি কি হেল্প করব।

তোমার কিচ্ছু করতে হবে না, তুমি বসে শুধু এনজয় করো।

রাত্রি তাও কিছু করতে চাইছিল কিন্তু কুহেলি রাত্রিকে কিছুই করতে দিল না। বরং দিঠিকে ডেকে ওর সঙ্গে রাত্রিকে পাঠিয়ে দিলেন সবার সঙ্গে বসে গল্প করার জন্য। ভালই লাগছিল রাত্রির, সবার সঙ্গে এভাবে প্রাণ খুলে আড্ডা দিতে ওর বরাবরই ভালোলাগে, আর এখানে তো ওর প্রিয় বন্ধু আলুও আছে। সবাই একযোগে বসে আড্ডা দিচ্ছে, রাত্রি বেশ বুঝতে পারছে আশেপাশের বেশ কয়েক জোড়া চোখ বারবার ঘুরে ফিরে ওর দিকেই নিবদ্ধ হচ্ছে। আর হবে নাই বা কেন! অমন অসামান্যা সুন্দরী যদি একটা প্রস্ফুটিত পদ্মের মত সবার মধ্যমনি হয়ে বসে থাকে তাহলে তো এমনটা হওয়াই স্বাভাবিক। রাত্রি অবশ্য এসবে অভ্যস্ত, এমন হাজার জোড়া চোখের দৃষ্টিকেও সে হেলায় উপেক্ষা করে। পুষ্পাঞ্জলির সময় হয়ে এলে কুহেলি এসে সবাইকে ডেকে নিয়ে গেল, এমন সুন্দর সুযোগ আলেখ হাতছাড়া করল না। ঠিক সুযোগটা কাজে লাগিয়ে কুহেলির পাশেই দাড়িয়ে গেল পুষ্পাঞ্জলি দিতে। কুহেলি আলেখের দিকে তাকিয়ে মৃদু স্বরে বলল,

ভালো লাগছে।

আলেখও খুব নীচু স্বরে প্রায় কুহেলির কানের কাছে মুখ এনে বলল,

তোমার মত নয়।

ব্যাস, আর কি! এই ছোট্ট একটা কথায় কুহেলির গাল দুটো আবার নিজেদের রং পরিবর্তন করল। ওর পরনের শাড়ি আর ওর লাজুকতার ছোয়া লাগা গাল দুটোর মধ্যে কোনটা যে বেশি রক্তিম তার পার্থক্য করাটা বড়ই কঠিন মনে হচ্ছে। এদিকে দিঠি রাত্রিকে সঙ্গে নিয়ে অঞ্জলি দেওয়ার ভিড়ে সামিল হয়েছে, আর ঘটনাচক্রে নিশীথ আরও কয়েকজনের সঙ্গে ঠিক ওদের পিছনেই দাড়িয়েছে। অঞ্জলি শুরু হবে এমন সময়ে দিঠিকে ওর মা মানে চৈতী দেবী কোনও একটা কারণে ডাকতে সে আসছে বলে চলে গেল। রাত্রি সেখানেই দাড়িয়ে রইল, এক সময় অঞ্জলি শুরুও হয়ে গেল কিন্তু দিঠি তখনও এলো না। রাত্রি কিছুই জানে না, তাও সবার দেখাদেখি ফুল আর বেলপত্র হাতে নিয়ে ভক্তি ভরে করজোড়ে পুনরাবৃত্তি করতে লাগল অঞ্জলি মন্ত্রের। খুব ভালোলাগছে ওর, কিন্তু সব ভালোলাগার মধ্যেই একটু বিঘ্ন না এলেই যেন নয়। আমাদের আশেপাশে এমন মানুষের অভাব নেই যারা তুচ্ছ থেকে তুচ্ছতম কারণ নিয়েও, আবার অনেক সময় তো বিনা কারণেই অন্যকে অপমান করতে দুবার ভাবেন না। যেন এটাই তাদের স্বর্গীয় আনন্দ লাভের একমাত্র পথ, অন্যের সামান্য তম ত্রুটিও জনসমক্ষে বিরাট করে তুলে ধরতে পারলেই যেন এদের মোক্ষ লাভ হয়। আগেই বলেছিলাম কিছু বিশেষ কৌতূহলী প্রতিবেশী বৃন্দের আধুনিকা প্রাণোচ্ছল রাত্রিকে তেমন পছন্দ হয়নি। তাদের সভ্যতা ভদ্রতার মানদণ্ডে রাত্রির অবস্থান অনেকটাই নিম্নের দিকে। যদিও এই বিশেষ মানদণ্ডের পরিমাপ টা যে ওনাদের ঠিক কে বলে দিয়েছিল সেটা জানা নেই। যাই হোক, রাত্রির কাছে সবটাই নতুন, এইসব আচার অনুষ্ঠান নিয়ম নীতি কোনোটাই তার পরিচিত নয়। পুষ্পাঞ্জলির সময় রাত্রি নিজের জুতো টা খুলে রাখতে ভুলে গিয়েছিল, আসলে ঠিক ভুলে যায়নি, খেয়াল করেনি। আর এটাই হল আগামী একটা অত্যন্ত অপ্রীতিকর পরিস্থিতির উৎস। অঞ্জলি দেওয়া হয়ে গেলে যখন সবাইকে চরণামৃত দেওয়া হচ্ছিল তখন রাত্রির পাশে দাড়ানো কয়েকজন তথাকথিত ভদ্রমহিলা রাত্রিকে লক্ষ্য করে শুরু করলেন তাদের তির্যক মন্তব্যের তীর। আর কি অদ্ভুত! যাকে উদ্দেশ্য করে কটূক্তি গুলো করা হচ্ছে সে যাতে তার অপমান টুকু সর্বান্তকরণে অনুভব করতে পারে তার জন্য এই অতি উৎসাহী মহিলাবৃন্দ ভাষার ব্যবধান টুকুও ঘুচিয়ে দিলেন। প্রথমটায় রাত্রি অতটা বুঝতে পারেনি, আসলে তেমন খেয়াল করেনি। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই বুঝতে পারল কথা গুলো তাকে উদ্দেশ্য করেই বলা হচ্ছে।

বুঝলি অনু, শুধু রূপের বাহার থাকলেই হয় না, একটু শিক্ষা দীক্ষাও থাকতে হয়।

তা যা বলেছ দিদি, আরে এদের যত রোশনাই সব বাইরেই, ভিতরে কিছু আছে নাকি? সবই তো ঝুঁটো।

একদম ঠিক বলেছিস, শুধু লোক দেখানো সাজলেই হয় না, মনে ভক্তিও থাকতে হয়।

ছি ছি, মায়ের অঞ্জলিতে কিনা জুতো পায়ে দিয়ে দাড়িয়ে আছে! অত্যাধুনিক যত্তসব ঢং।

তাছাড়া আবার কি! আরে এদের কি সংস্কার বলতে কিছু আছে নাকি! বিদেশের হাল হকিকত তো আর আমাদের অজানা নয়। শুধু শুধু…..

আরও অনেক কথাই ভেসে আসছিল, কিন্তু রাত্রির কান পর্যন্ত আর পৌঁছাল না সেগুলো। এত অপমানিত বোধহয় এর আগে সে কখনও হয়নি, সত্যিই তো পায়ের জুতোটা খোলার কথা মনেই হয়নি। কিন্তু যে এসবে অভ্যস্ত নয়, যার কাছে সবটাই নতুন, একটু ভুল তো তার হতেই পারে। রাত্রির ভাসা ভাসা চোখ দুটো জলে ভরে এল, ভিষন কষ্ট হচ্ছে, ইচ্ছে করছে এক্ষুনি এক ছুটে এখান থেকে চলে যায়। হয়তো তাই যেত কিন্তু হঠাৎ একটা পরিচিত গলার আওয়াজে আর যাওয়া হল না তার। রাত্রির ঠিক পিছনে দাড়ানো নিশীথ এতক্ষণ সবটাই চুপচাপ লক্ষ্য করছিল, এমন পবিত্র একটা উৎসবে শুধু শুধু কোনও অবাঞ্ছিত দৃশ্য তৈরি করতে চাইছিল না। কিন্তু সব কিছু সহ্য করার একটা সীমা আছে, নিশীথ আর ধরে রাখতে পারল না নিজেকে। ওর সেই অতি পরিচিত স্বভাবসিদ্ধ হাসিটা ঠোঁটে ফুটিয়ে তুলে বলল,

বলছিলাম আপনাদের ডিগ্রিটা একটু দেখতে পারি?

হঠাৎ এমন একটা অত্যন্ত অপ্রত্যাশিত এবং অপ্রাসঙ্গিক একটা প্রশ্নে সবাই যেন একটু চমকে উঠল। ওই বিজ্ঞ মহিলা বৃন্দের মধ্যে একজন বেশ অবাক হয়ে বললেন,

ডিগ্রী! কিসের ডিগ্রী?

নিশীথ অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বলল,

হ্যা, ডিগ্রী। এই যে আপনারা এত দক্ষতার সঙ্গে সমান তালে একজন মেয়েকে অপমান করে যাচ্ছেন, এটা তো সবার পক্ষে করা সম্ভব নয়। তাই ভাবলাম নিশ্চয়ই কোনও স্পেশাল কোর্স করেছেন। আসলে আমারও মাঝে মধ্যেই কাউকে কাউকে অপমান করতে খুব ইচ্ছে করে কিন্তু ঠিক পারি না। ভাবছি আমিও কোর্সটা করব, তাই একটু ডিগ্রিটা দেখতে চাইলাম, মানে কোথায় কোন ইউনিভার্সিটিতে কোর্সটা করানো হয় সেটা জানার একটা ইচ্ছে হচ্ছে।

নিশীথ যে এমন কিছু বলবে সেটা বোধহয় উপস্থিত কেউই আশা করেনি, বিশেষ করে রাত্রি তো নয়ই। নিশীথের কথায় সেই মহিলা এবার বেশ রেগে গিয়েই বললেন,

কি বলছেন টা কি আপনি? আমরা কাকে অপমান করেছি? উল্টে আপনি আমাদের অপমান করছেন। আপনার এত বড় সাহস হয় কীকরে?

নিশীথ তেমনই হাসি মুখে বলল,

বাহ্, আমি কোথায় আপনাদের অপমান করলাম! আমি বরং আপনাদের কাছ থেকে এই কৌশল টা শিখতে চাইছি।

দেখুন আপনি কিন্তু সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছেন।

নিশীথ এতক্ষণ ধীর কণ্ঠে কথা বলছিল তাই আশেপাশের কেউ অতটা খেয়াল করেনি কিন্তু এখন ওই মহিলা গণের উত্তেজিত কণ্ঠ সকলের দৃষ্টি সেইদিকে আকর্ষিত করল। আলেখ আর কুহেলিও এগিয়ে এল, ব্যাপারটা ঠিক কি হয়েছে বুঝে ওঠার আগেই নিশীথ আবার বলতে শুরু করল, কিন্তু এবার আর হাসির আড়ালে নয়। যথেষ্ট পরিমাণ রাগের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েই বলল,

আমি এখনও আমার সীমা অতিক্রম করিনি। যদি করতাম তাহলে আর এখানে দাড়িয়ে কথা বলতে পারতেন না।

আপনি…..

আমার কথা এখনও শেষ হয়নি।

নিশীথের গম্ভীর গলার সুরে এমন কিছু ছিল যা সবাইকে স্তব্ধ হতে বাধ্য করল। নিশীথ বলে চলল,

অনেকক্ষন থেকেই শুনছি আপনাদের কথা, কত সহজে একটা মেয়েকে যা নয় তাই বলে অপমান করছেন। আর কারণটা তো আরও অসাধারণ, সামান্য জুতো পরে অঞ্জলি দিয়েছে বলে আপনারা ডাইরেক্ট একটা মেয়ের ক্যারেকটার সার্টিফিকেট বানিয়ে ফেললেন! সবাই সব কিছু জানে না, জানা সম্ভব নয়। রাত্রিও জানত না, হয়তোবা খেয়াল করেনি, অজান্তে একটা ভুল করে ফেলেছে। কিন্তু আপনারা তো লক্ষ্য করেছিলেন, আপনারা ইচ্ছে করলেই কিন্তু ভুলটা শুধরে দিতে পারতেন। কিন্তু না, আপনারা সেটা না করে উল্টে তার সমালোচনায় মুখর হয়ে উঠলেন। আর কি বলছিলেন যেন ভক্তির কথা! লোক দেখানো সজলেই হয় না, মনে ভক্তিও থাকতে হয় তাই তো? আপনারা কীকরে বুঝলেন রাত্রির মনে ভক্তি আছে কি নেই? পায়ে জুতো দেখে? এই অসাধারণ পদ্ধতি গুলো কোথা থেকে শিখেছেন বলুন তো?

নিশীথের বাক্যবাণে বিদ্ধ হয়ে তাদের কারোরই আর উত্তর দেওয়ার মত অবস্থা নেই। কুহেলি আর আলেখ সহ উপস্থিত বাকিরাও এতক্ষণে গোটা ব্যাপারটা বুঝে গেছে। কুহেলির অসম্ভব রাগ হল, কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু আলেখ বাধা দিয়ে বলল,

এখন কিছু বোলো না কুহেলি, মিস্টার আগরওয়াল উপযুক্ত জবাব দিয়েছেন। তোমার আর কিছু বলার প্রয়োজন নেই।

নিশীথের তীক্ষ্ম সত্যের আঘাতে তখন তাদের বাকশক্তি প্রায় সম্পূর্ণ রূপে লুপ্ত হয়েছে, দৃষ্টিও অবনত। নিশীথ এবার ওনাদের দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে রাত্রির দিকে তাকিয়ে বেশ রাগত সুরেই বলল,

আর আপনি, অন্য সময়ে তো কথার অভাব হয় না। এখন কি হয়েছিল? কথা বলতে ভুলে গিয়েছিলেন? নাকি আপনার কথার স্রোত শুধু অসময়ে আর অকারনেই নির্গত হয়?

এতক্ষণ ধরে বেঁধে রাখা নোনা জল গুলো টুপ টাপ করে ঝরে পড়ল। একটাও কথা না বলে রাত্রি ছুটে চলে গেল ওখান থেকে। ওর কান্না ভেজা চোখ দুটো দেখে নিশীথের কেন যেন বড্ড খারাপ লাগল। এই প্রথম ওর মনে হল, হয়তো এমন করে বলাটা উচিৎ হয়নি। কিন্তু কি করত? অসম্ভব রাগ হচ্ছিল, নিজের অপমানের যোগ্য জবাব টুকু কেন দেবে না? এই প্রথম নিশীথ নিজেও জানে না ওর কেন এত রাগ হল? কুহেলি রাত্রির পিছন পিছন চলে গেল বাড়ির ভিতরে, আর আলেখ এগিয়ে এল নিশীথের দিকে। পরিবেশ এখন অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে এসেছে, সেই তথাকথিত ভদ্রমহিলা গণ কখন যেন প্রস্থান করেছেন। নিশীথ নিজেকে একটু শান্ত করে বলল,

সরি মিস্টার শর্মা, আমি জানি আমার এভাবে রিয়্যাক্ট করাটা উচিৎ হয়নি কিন্তু…..

নিশীথের কথা শেষ হওয়ার আগেই আলেখ বলল,

অনুচিত কিছু না করে সরি বলাটা বোধহয় উচিৎ নয়। আপনি যা করেছেন ঠিক করেছেন, তার জন্য আপনি সরি কেন বলছেন?

তবুও একটা এরকম উৎসবে….

ওনারা যদি এরকম একটা উৎসবে এসে এতোটা নিম্ন মানসিকতার পরিচয় দিতে পারেন তাহলে আপনিই বলুন, আপনি যেটা করেছেন সেটা কি ভুল?

না।

তাহলে? দেখুন মিস্টার আগরওয়াল, আমি জানি আপনার আর রাত্রির সম্পর্ক টা তেমন ভালো নয়। আপনারা দুজনেই একে অপরকে পছন্দ করেন না, সেটা নিয়ে আমার কিছু বলারও নেই। ওটা সম্পূর্ণ আপনাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার, কিন্তু তা সত্বেও আপনি যেভাবে রাত্রির হয়ে কথা বললেন…. আই অ্যাম রিয়েলি ভেরি থ্যাঙ্কফুল টু ইউ।

মিস্টার শর্মা, এখানে মিস রাত্রির জায়গায় অন্য কেউ থাকলেও আমি একই কাজ করতাম।

আই নো দ্যাট, বাট রিতু আমার বেস্ট ফ্রেন্ড তাই ওর হয়ে আপনাকে একটা ধন্যবাদ তো দিতেই পারি।

এই একটা ঘটনা যেন আলেখের মনে নিশীথের প্রতি জমে থাকা সেই অজানা সব ক্ষোভ বা রাগ বা… যাই হোক না কেন সব দুর করে দিল। এদিকে রাত্রি সোজা নিজের ঘরে এসে বিছানায় বসে অনবরত কেদেই চলেছে, কুহেলি ওর পাশে বসে বলল,

রাত্রি প্লিজ ডোন্ট ক্রাই। আমারই ভুল হয়েছে, তোমাকে একা ছাড়া টাই উচিৎ হয়নি। এভাবে তোমাকে ইনভাইট করে এনে…. আমার জন্য আজ তোমাকে এতোটা অপমানিত হতে হল। সরি রাত্রি।

রাত্রি কান্না জড়ানো গলায় বলল,

স্টপ ইট কুহেলি, তুমি কেন নিজেকে দোষ দিচ্ছ? তোমার কোনও দোষ নেই এখানে। আর ওনাদের সব কথা গুলো তো ভুল নয়, আমি তো সত্যিই ভুলে গিয়েছিলাম জুতো টা খুলতে।

রাত্রি! ভুল হতেই পারে, আর তুমি নিজেকে কেন দোষ দিচ্ছ? তোমার কি দোষ এখানে? সম্পূর্ণ দোষটা ওনাদের, ওনাদের নিম্ন মানসিকতার। মিস্টার আগরওয়াল ওনাদের যে জবাব টা দিয়েছেন সেটা কিন্তু তোমার দেওয়া উচিত ছিল রাত্রি। কারোর সামনে নিজের ভুল না থাকলে কক্ষনো এভাবে দুর্বল হয়ে পড়বে না।

নিশীথের নামটা শুনেই রাত্রি যেন একটু থমকে গেল। দু চোখের পাতায় অবিরাম বারিপতনেও যেন আপনা থেকেই বিরাম পড়ল। নিশীথের এই রূপ রাত্রি আগে কখনও দেখেনি, দেখা তো অনেক পরের কথা সে কল্পনাও করতে পারে না। তার পরিচিত নিশীথ আগরওয়ালের সঙ্গে যেন এই নিশীথের কোনও মিল নেই। নিজের অজান্তেই মনের কোনও একটা কোনায় নিশীথের প্রতি একটা সম্ভ্রম জন্ম নিল। রাত্রি একটু শান্ত হয়েছে দেখে কুহেলি পরিবেশটা আরও একটু স্বাভাবিক করার জন্য বলল,

আচ্ছা রাত্রি এই যে তুমি এত কান্না কাটি করলে, চোখ টা একেবারে ফুলে লাল হয়ে গেছে। এভাবে তো সন্ধ্যায় আর ঘুরতে বেরোনো যাবে না তাই না? না মানে.. এইভাবে তো আর….

কথা আর শেষ হল না, রাত্রি লাফ দিয়ে উঠে বলল,

কেন যাবে না? নিশ্চয়ই যাবে। আমি এতদূর থেকে এসেছি আর কলকাতার পুজো ঘুরে দেখব না?

কুহেলি হেসে বলল,

হুম, দেখবে তো, আমি তো সেটাই চাই কিন্তু এভাবে কেদে কেটে নিজের চেহারার বারোটা বাজালে কিন্তু আমি তোমাকে নিয়ে যাব না।

রাত্রি অল্প হেসে বলল,

ডোন্ট ওয়ারি, আমি আর কাদছি না। আসলে কি বলতো, এমন কিছু আগে কখনও ফেস করিনি তো, তাই একটু বেশিই খারাপ লেগেছিল। বাট নাও আই অ্যাম পারফেক্টলি ফাইন, সন্ধ্যের প্ল্যান যেন আমাকে বাদ দিয়ে না হয়।

কুহেলি হেসে বলল,

তোমাকে বাদ দিয়ে কোনও প্ল্যান হতে পারে!

রাত্রির নিজেকে আবার স্বাভাবিক করে নিতে খুব বেশি সময় লাগল না। কুহেলি ওকে একটু বিশ্রাম করতে দিয়ে নিচে নামতেই চৈতালী দেবী বললেন,

হ্যা রে, মেয়েটা ঠিক আছে তো? ইশ এভাবে নিমন্ত্রিত হয়ে এসে অপমানিত হতে হল।

চিন্তা করো না মা, রাত্রি ইজ এ স্ট্রং গার্ল। একদম ঠিক আছে।

যাক।

শৈলজা দেবী বললেন,

বুঝলি কুহু, তোর ওই বন্ধু কি নাম যেন… হ্যা, নিশীথ। ছেলেটা কিন্তু আচ্ছা রকম ঝামা ঘষে দিয়েছে ওই হতচ্ছাড়ি গুলোর মুখে।

ঠিক বলেছ ঠাম্মু।

দুপুরের আহারে আবার সেই পুরনো মেজাজ ফিরে এল সবার মধ্যে। গল্প আর আড্ডার মধ্যে দিয়েই বেশ কেটে গেল দুপুর টা। এবার ধীরে ধীরে তৈরি হওয়ার পালা, দুর্গা পুজোয় ঠাকুর দেখতে বেরোনো হবে বলে কথা, না সাজলে হয় নাকি? সবাই একে একে যার যার ঘরে চলে গেলে নিশীথ কুহেলিকে বলল,

কুহেলি, আমি কিন্তু আপনাদের সঙ্গে যেতে পারব না।

কেন? না মানে, জানি আপনার অভ্যাস নেই বাট ডোন্ট ওয়ারি উই হ্যাভ স্পেশ্যাল পাসেস। আমাদের কোথাও লাইনে দাড়াতে হবে না, যদিও ওটাও ঠাকুর দেখার একটা মজা বাট জানি আপনাদের পক্ষে সেটা পসিবল নয়।

ওটা কোনও ব্যাপার নয়, আমি সেই জন্য যাব না বলিনি কিন্তু।

তাহলে?

আমি বিকালের ফ্লাইটেই ব্যাঙ্গালোর যাচ্ছি।

হঠাৎ? না মানে আপনার তো আজকের দিনটা থাকার কথা ছিল।

হুম, বাট একটা আর্জেন্ট মিটিং পড়ে গেছে। একটু আগেই উমেশ জানাল, আই হ্যাভ টু গো।

ওহ, তাহলে তো আর আমার কিছু বলারই রইল না। তবে আপনি থাকলে ভাললাগত।

মে বি নেক্সট টাইম।

আলেখ আর রাত্রি একটু মণ্ডপের দিকে গিয়েছিল, শুধু নিশীথের শেষ কথাটাই শুনতে পেয়েছে। আলেখ এগিয়ে এসে হাসিমুখে জিজ্ঞেস করল,

আবার কোনটা নেক্সট টাইমের জন্য তুলে রাখছেন?

উত্তরটা কুহেলি দিল,

আজকের সন্ধ্যের প্ল্যান টা।

আলেখ একটু অবাক হয়ে বলল,

মানে?

মানে উনি আজ চলে যাচ্ছেন।

সেকি! কেন?

নিশীথ আবার আলেখকে পুরোটা বলল। কুহেলি বা আলেখ দুজনেই বরাবর কাজকে সবার আগেই রেখে এসেছে তাই কেউই আর নিশীথ কে বাধা দিল না। কিন্তু রাত্রির মুখটায় কেন যেন একটু আঁধারের ছায়া ঘনাল। ওরা সবাই নিজের ঘরে চলে গেল, কিছুক্ষণ বিশ্রামের পরে তৈরি হবে। নিশীথ ব্যাঙ্গালোর যাওয়ার উদ্দেশ্যে আর বাকিরা কলকাতার পুজো ভ্রমণের উদ্দেশ্যে। রাত্রি চুপচাপ শুয়ে ছিল, বারবার কেন যে নিশীথের মুখটাই ঘুরে ফিরে চোখের সামনে ভেসে উঠছে সেটাই বোঝার চেষ্টা করছে। একসময় উঠে দাড়িয়ে নিজের মনেই বলল,

হোয়াটস রং উইথ মি? উনি জাস্ট আমাকে হেল্প করেছেন, নট এ বিগ ডীল। একবার হেল্প করেছেন বলে তো আর উনি মানুষটা বদলে যাচ্ছেন না। ডোন্ট ফরগেট রাত্রি হি ইজ নিশীথ আগরওয়াল, সেই খিটখিটে বদমেজাজি নিশীথ আগরওয়াল।

কিন্তু পরক্ষণেই আবার ভাবল,

বাট স্টিল, উনি আমাকে হেল্প করেছেন। তখন যদি উনি ওভাবে কথা বলা শুরু না করতেন তাহলে ঐ মহিলারা হয়তো আরও কত কিছু বলতো। আমার একবার ওনাকে ধন্যবাদ জানানো উচিৎ।

বেশ কিছুক্ষণ নিজের মনের সাথে দ্বন্দ্ব করে শেষমেষ ধন্যবাদ জানাবে বলে মনস্থির করল। রাত্রি আর কিছু না ভেবে সোজা নিশীথের দরজায় গিয়ে নক করল। নিশীথ দরজা খুলে রাত্রিকে দেখে একটু অবাক হল, তবে বেশ অদ্ভুত ভাবে বিরক্ত হল না। রাত্রি কোনরকম ভনিতা না করে বলল,

একটা কথা বলার ছিল।

বলুন।

এখানে বাইরে দাড়িয়েই বলব।

নিশীথ একটু সরে দাঁড়িয়ে রাত্রিকে ভিতরে আসতে বলল। রাত্রি ভিতরে আসার পর নিশীথ বলল,

বলুন, কি বলবেন।

রাত্রি একটু থেমে বলল,

থ্যাঙ্ক ইউ।

রাত্রি কেন ধন্যবাদ জানাচ্ছে সেটা বুঝতে নিশীথের কোনও অসুবিধা হল না। বরাবরের মত আজকেও নিশীথ কোনরকম অযথা বিনয়ের পরিচয় না দিয়ে সোজাসুজি বলল,

থ্যাঙ্কস জানানোর মত কিছু করিনি আমি। চোখের সামনে অনুচিৎ কিছু দেখলে প্রতিবাদ করাটা নিজের কর্তব্য বলে মনে করি। আপনার কাছ থেকেও আমি সেটাই আশা করেছিলাম। কিন্তু ঠিক প্রয়োজনের সময় প্রতিবাদ করাটা বোধহয় সবার দ্বারা সম্ভব নয়।

কথাটা শুনে রাত্রির একটু রাগ হল কি? কি জানি! রাত্রি নিজেই জানে না! যাই হোক বিশেষ কথা না বাড়িয়ে রাত্রি নিজের ঘরে চলে এল। ধন্যবাদ বলাটা উচিৎ ছিল, বলে দিয়েছে ব্যাস। আর বেশি ভেবে লাভ নেই, নিশীথ আগরওয়ালের মত মানুষ হয়তো কোনোদিনই বদলায় না, রাত্রির মতে তাকে এড়িয়ে চলাটাই ভাল। কুহেলিরা বেরোনোর আগেই নিশীথ সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল। তারপর সন্ধ্যে থেকে শুরু হল সবার ঠাকুর দেখার পর্ব, সেজে গুজে সে এক এলাহী ব্যাপার। দেশপ্রিয় পার্ক, বাগবাজার, কলেজ স্কোয়ার, যোধপুর পার্ক কিছুই বাদ গেল না। সঙ্গে বাইরে জমিয়ে পেট পুজো, উফফ এর কোনো তুলনা হয় নাকি! আলেখ বেশ জমিয়ে উপভোগ করছিল সবটা, সঙ্গে রাত্রিও। সন্ধ্যে থেকে শুরু করে প্রায় সারা রাত ধরে ঠাকুর দেখার অভিজ্ঞতা তাদের দুজনেরই প্রথম। অষ্টমীর রাতে যতটুকু বাকি রয়ে গেল নবমীর রাতে সেটুকু পুরোদমে উশুল করে নিল সবাই। দুটো দিনে ওরা এত ঠাকুর দেখেছে যে রাত্রি হিসেব টাও গুলিয়ে ফেলেছে। শুরুতে রাত্রি হিসেব রাখছিল কটা ঠাকুর দেখছে কিন্তু পরে সেই সংখ্যাটা কোথায় যে তালগোল পাকিয়ে হারিয়ে গেছে বুঝতে পারেনি। অবশ্য বোঝার বিশেষ চেষ্টাও করেনি, প্রাণ ভরে শুধু আনন্দ করেছে, উপভোগ করেছে কল্লোলিনী তিলোত্তমার শারদোৎসবের অপরূপ রূপ। নবমীর রাতে যখন ওরা অবশেষে পুজো পরিক্রমা শেষ করে বাড়ি ফিরল তখন ইতিমধ্যে ঘড়ির কাটা তিনটের ঘর ছুয়ে ফেলেছে। সবাই নিজেদের ক্লান্ত দেহটাকে একটু বিশ্রাম দেওয়ার জন্য ফ্রেশ হয়েই এলিয়ে পড়ল নরম বিছানার কোলে। ঘুমের আবেশ জড়ানো চোখেও কুহেলির মনে হল, দেখতে দেখতে পেরিয়ে গেল নবমী। কালকে বিজয়া দশমী, মায়ের আবার কৈলাশ গমনের পালা, আবার সেই মন খারাপের পালা, আবার একটা বছরের প্রতীক্ষা। ভাবতে ভাবতেই কখন যেন কুহেলির দুচোখ জুড়ে নেমে এসেছে ঘুম। তবে বিজয়া দশমী কি শুধুই বিদায়ের সুর নিয়ে আসে? নাকি বিদায়ের সঙ্গে আবারও ফিরে আসার আনন্দের সুর বেজে ওঠে নেপথ্যে? এই বিজয়া দশমীতে বাজবে কোন সুর? বিদায় বেলার বিষাদের সুর নাকি নব সূচনার নব আনন্দের সুর?

ক্রমশ___________

© স্বত্ব সংরক্ষিত

আজকের পর্বটা কেমন লাগল অবশ্যই জানাবেন কিন্তু। দেখা হবে আগামী পর্বে ততদিন পর্যন্ত পড়তে থাকুন ভালো থাকুন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here