সংগোপনে’ পর্ব-৪২

0
1328

#সংগোপনে
#ধারাবাহিক_পর্ব_৪২
#অচিন_পাখি_কলমে_ভাগ্যলক্ষ্মী_দাস

আগের পর্বের পর————

কুহেলি ভোর বেলা ঘুম থেকে উঠেই ওঙ্কার ভিলায় চলে এল, রাত্রি যদিও ওকে ব্রেকফাস্ট করে আসার জন্য অনেকবার বলেছিল কিন্তু কুহেলি শোনেনি। আসলে যে কারণে কুহেলি রাত্রির সাথে ছিল সেই উদ্দেশ্য শতকরা একশত ভাগ সফল। একটু নাটকীয় ভাবে যদি বলতে হয় তাহলে, মিশন সাকসেফুল। তাই কুহেলি ঘুম থেকে উঠেই সোজা ওঙ্কার ভিলায় ফিরে এসেছে। আসতে তো হতই, একটা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে যে। কুহেলি ওদের ঘরে ঢুকে দেখল আলেখ এখনও ঘুমাচ্ছে, অবশ্য ঘুমানোরই কথা, এখনও ওর ওঠার সময় হয়নি। কুহেলি একটু হেসে আলেখের পাশে বসে আলতো করে ওর ঠোঁট জোড়া ছুঁইয়ে দিল ঘুমন্ত আলেখের ঠোঁট দুটোয়। হ্যা, এটাই এখন ওর রোজ সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। সেদিনের পর থেকে একদিনও এর অন্যথা হয়নি, তাই তো চোখ খোলার সঙ্গে সঙ্গেই কালমাত্র বিলম্ব না করে ছুটে এসেছে। শুধু কাল রাতের গুডনাইট কিস টা বাদ পড়ে গেছে, কথা টা মনে হতেই কুহেলির ঠোঁট জুড়ে আবার একটা মিষ্টি হাসি খেলে গেল। সেদিন সকালেও আলেখ বাকি থাকা গুডনাইট কিসের জন্য কি ছেলেমানুষী টাই না করছিল। কুহেলি আলেখের নাকে নিজের নাক টা স্পর্শ করে খুব ধীর কণ্ঠে বলল,

তোমার এই ছোট ছোট পাগলামি গুলোই যে বড্ড বেশি ভালোলাগে আমার।

কুহেলির নরম ঠোঁট জোড়া আরও একবার স্পর্শ করল আলেখের ঠোঁট দুটো। কুহেলি একটু হেসে আলেখের গালে একটা হাত আলতো করে ছুঁইয়ে উঠে যাচ্ছিল কিন্তু হঠাৎ একটা হ্যাঁচকা টানে টাল সামলাতে না পেরে একেবারে আলেখের বুকের উপর এসে পড়ল। প্রথমটায় কুহেলি নিজের হতভম্ব ভাবটা কাটিয়ে উঠতেই কিছুটা সময় নিয়ে ফেলল। পরে একটু ধাতস্থ হতেই দেখল সে আলেখের দুই বাহুর মধ্যে বন্দী দশায় আলেখের বুকের উপরে অবস্থান করছে। আর আলেখ তার দিকে তাকিয়ে মিটি মিটি হাসছে, কুহেলি একটু অবাক হয়ে বলল,

তু…তুমি জেগে ছিলে!

আলেখ কুহেলির এলোমেলো চুল গুলো সরিয়ে দিতে দিতে বলল,

হুম, ভাগ্যিস জেগে ছিলাম তাই তো আমার মিষ্টি বউটার এমন রোম্যান্টিক দিক টা দেখতে পেলাম।

কুহেলি একটু লজ্জা পেয়ে আলেখের বুকে একটা মৃদু চাপড় মেরে বলল,

শয়তান একটা।

বা রে, এতে শয়তান বলার কি হল? তবে তুমি যদি একান্তই আমার শয়তানি দেখতে চাও আই ডোন্ট মাইন্ড।

কথা টা বলেই আলেখ এক ঝটকায় কুহেলিকে বিছানার সঙ্গে চেপে ধরে ওর দিকে ঝুঁকে এল। কুহেলি লজ্জা মেশানো সুরেই একটু গাম্ভীর্য আনার চেষ্টা করে বলল,

এই একদম না, সকাল সকাল একদম দুষ্টুমি করবে না কিন্তু।

আলেখ ইতিমধ্যেই কুহেলির অনেকটা কাছে এগিয়ে এসেছে, ওর উষ্ণ নিশ্বাসের ছোয়ায় যেন কুহেলির হৃদস্পন্দন বেড়ে উঠছে। আলেখ ওর মুখটা কুহেলির একদম কাছে নিয়ে গিয়ে মৃদু সুরে বলল,

আচ্ছা আমি করলেই দুষ্টুমি আর তুমি যখন করছিলে! ওটা দুষ্টুমি ছিল না বুঝি?

কুহেলির নিশ্বাস ঘন হয়ে এসেছে, কথা গুলোও যেন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।

আ… আমি তো.. আমি তো তোম.. তোমার…

কুহেলির কথা অসম্পূর্ণই থেকে গেল, কারণ আলেখের তপ্ত ওষ্ঠাধর তখন কুহেলির কান ছুয়ে নামতে শুরু করেছে গলায়। কুহেলি যেন নিজেকে ধরে রাখতে পারছে না, কোনক্রমে অস্ফুটে একটি মাত্র শব্দ উচ্চারণ করতে পারল,

আ.. আলেখ।

আলেখ তখন ডুব দিয়েছে কুহেলির ঘাড়ে, নেশা জড়ানো কম্পিত আহ্বান শুনে আলেখ কুহেলির দিকে তাকিয়ে বলল,

একটা রাত তোমাকে ছাড়া কিভাবে কাটিয়েছি সেটা তুমি জানো না কুহু, তোমাকে বুকের মাঝে না পেলে যে আমার ঘুম আসে না।

আলেখের মুখে কুহু শুনে কুহেলির সারা শরীরে যেন একটা অন্যরকম শিহরণ বয়ে গেল। আজ প্রথম আলেখ তাকে কুহু বলে সম্বোধন করেছে, কুহেলি আলেখের চোখের দিকে তাকিয়ে দেখল সেখানে কিসের যেন একটা আকুলতা ফুটে উঠেছে। আলেখ ধীরে ধীরে ওর ঠোঁট টা নামিয়ে আনতে লাগল কুহেলির পেলব অধরদ্বয়ের দিকে, দুজনের হৃদস্পন্দন যেন পাল্লা দিচ্ছে একে অপরের সঙ্গে। একসময় সব দূরত্ব মিলিয়ে এল, মিলেমিশে একাকার হয়ে যেতে লাগল দুটো তৃষ্ণার্ত ঠোঁট। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গভীর থেকে গভীর হতে লাগল ওদের দু জোড়া অধর যুগলের আলাপ পর্ব। কিছুক্ষণ পর যখন অনিচ্ছা সত্ত্বেও তারা বিচ্ছিন্ন হল তখন দুজনেরই শ্বাস প্রশ্বাসের গতি স্বাভাবিকের থেকে বেশ দ্রুত। আলেখ কিছুক্ষণ কুহেলির কপালের সঙ্গে নিজের কপাল টা স্পর্শ করে রাখল, দুজনেরই চোখের পাতা কখন যেন বুজে এসেছে। দুজনেরই হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া কিছুটা স্বাভাবিক হলে আলেখ কুহেলির দিকে তাকিয়ে বলল,

আই মিসড ইউ কুহু, আই মিসড ইউ সো মাচ।

কুহেলি ধীরে ধীরে ওর বন্ধ চোখের আগল খুলে তাকাল আলেখের দিকে। একটু হেসে বলল,

এতোটা মিস করেছ আমাকে?

হুম।

কুহেলি অল্প হেসে আলেখের নাকটা একটু আদর করার ভঙ্গিমায় নাড়িয়ে দিয়ে বলল,

পাগল একটা, মাত্র একটা রাতেই যদি এই অবস্থা করে ফেল তাহলে যদি কোনও দিন আমি আর না থাকি তখন কি করবে?

কুহেলি কথাটা নিতান্তই মজার ছলে বললেও আলেখের হৃদয়ে যেন কথাটা বিষাক্ত তীরের মত বিদ্ধ হল। মুহূর্তের মধ্যে ওর উজ্জ্বল মুখটায় যেন আধার ঘনিয়ে এল, প্রচন্ড উত্তেজিত গলায় বলে উঠল,

কুহু, তুমি এরকম কথা কি করে বলতে পারলে? আর থাকবে না মানে? কোথায় যাবে তুমি আমাকে ছেড়ে?

এক নিশ্বাসে কথা গুলো বলেই আলেখ ছিটকে উঠে এল কুহেলির কাছ থেকে। কুহেলি সত্যিই খুব হালকা ভাবেই এমনিই বলেছিল কথাটা, আলেখের যে এতটা খারাপ লাগবে সেটা একেবারেই বুঝতে পারেনি। কুহেলি ব্যস্ত হয়ে উঠে আলেখের পাশে বসে বলল,

আলেখ আমি ওভাবে বলতে চাইনি, আমি তো জাস্ট একটু মজা করছিলাম, এমনিই কথার ছলেই বলে ফেলেছি…..

কুহেলির অসম্পূর্ণ কথার মাঝেই আলেখ সেই একই রকম উত্তেজিত কন্ঠে বলে উঠল,

মজা! এটা মজা করার বিষয়? তুমি মজার ছলেও এরকম একটা কথা কীকরে বলতে পারলে?

কুহেলি বুঝল ওর নিতান্ত হালকা চালে বলা কথাটা আলেখের অন্তরে আঘাত করেছে। অভিমানে, কষ্টে, দুঃখে ওর ফর্সা মুখটা যেন লাল হয়ে এসেছে, ওকে এভাবে কষ্ট পেতে দেখে কুহেলির অন্তরটাও যেন দুমড়ে মুচড়ে যেতে লাগল। হঠাৎ খেয়াল বশে বলা ওর একটা কথা যে আলেখের মনে এভাবে আঘাত হানবে এটা কুহেলি সত্যিই বুঝতে পারেনি। চোখের কোনায় কখন যেন নোনা জল গুলো জমতে শুরু করেছে, কুহেলি ব্যস্ত হয়ে দুহাতে আলেখের মুখটা ধরে বলল,

আই অ্যাম সরি আলেখ, আমি বুঝতে পারিনি তোমার এতোটা খারাপ লাগবে তুমি এতোটা কষ্ট পাবে। আমি এত কিছু ভেবে বলিনি বিশ্বাস করো, আমি সত্যিই মজার ছলেই বলে ফেলেছি কথাটা। প্লিজ আলেখ ক্ষমা করে দাও, আমি অজান্তেই তোমাকে এতোটা কষ্ট দিয়ে ফেলেছি।

কুহেলির চোখে জল দেখে আলেখের কষ্টটা যেন দ্বিগুণ হয়ে গেল, ব্যস্ত হয়ে উষ্ণ জলের কণা গুলো মুছিয়ে দিতে দিতে বলল,

তোমাকে বলেছি না, তোমার চোখের জল আমি সহ্য করতে পারি না। আজ কি আমাকে কষ্ট দেবে বলেই ঠিক করেছ?

কুহেলি কান্নাভেজা গলায় বলল,

তোমাকে কষ্ট দেওয়ার কথা আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারি না।

আলেখ কুহেলিকে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে নিয়ে বলল,

তুমি ছাড়া আমার জীবন শূন্য কুহু, তোমাকে ছাড়া আমি অসম্পূর্ণ। তোমাকে ছাড়া আমার জীবন টা আমি কল্পনাই করতে পারি না, এক মুহূর্তের জন্যও না।

আলেখের বুকে মুখ গুজে কুহেলি যেন অন্তর দিয়ে কথা গুলো অনুভব করছে, আলেখের প্রতিটা হৃদ স্পন্দনে যেন শুনতে পাচ্ছে নিজের নাম। দুহাতে আকড়ে ধরল আলেখকে, মিশে যেতে চাইল আরও গভীরে, আলেখ ওর হাতের বাঁধন টা আরও একটু দৃঢ় করে বলল,

আর কোনদিনও এমন কথা মুখেও আনবে না, কক্ষনো না।

হুম।

বেশ কিছুক্ষণ সময়ের হিসেব পেরিয়ে এভাবেই দুটো দেহ মন একাত্ম হয়ে রইল। একসময় কুহেলি ধীরে ধীরে আলেখের বাহু ডোর থেকে নিজেকে মুক্ত করে বলল,

তুমি রাগ করোনি তো?

আলেখ একটু হেসে বলল,

তোমার উপরে রাগ করার মত সামর্থ্য কি আমার আছে?

কুহেলির ঠোঁটেও এক চিলতে হাসি দেখা দিল, আলেখের বুকের বাঁদিকে একটা হাত আলতো করে স্পর্শ করে বলল,

না বুঝেই তোমাকে কষ্ট দিয়ে ফেললাম, কথা দিলাম আর ভুলেও কক্ষনো তোমায় কষ্ট দেব না।

আলেখের ঠোঁটে একটা দুষ্টু হাসি ফুটে উঠল, নিজের বুকের উপর থাকা কুহেলির হাতের উপর নিজের একটা হাত রেখে একটু ঝুঁকে এসে বলল,

সে তো, না হয় ফিউচারে আর কোনদিনও এমন করবে না বুঝলাম কিন্তু আজকে যে আমাকে এতোটা কষ্ট দিলে তার কি হবে?

কুহেলি একটু করুন সুরে বলল,

তুমিই বলো।

ভুল যখন একটা করেই ফেলেছ তখন শাস্তি তো পেতেই হবে।

শাস্তি!

হুম শাস্তি।

বেশ, তুমি যা শাস্তি দেবে আমি তাই মাথা পেতে নেব, বলো।

আলেখ একটু মুচকি হেসে ওর বা হাতের তর্জনী টা নিজের ঠোঁটে ছুঁইয়ে বলল,

বেশি কিছু না, শুধু এটা হলেই হবে।

কুহেলি চোখ দুটো নামিয়ে একটু লজ্জা জড়ানো হাসি ফুটিয়ে বলল,

তুমি না… সত্যি… দিন দিন একদম যা তা হয়ে যাচ্ছ। সবসময় খালি দুষ্টুমি…

কুহেলি এক ঝটকায় নিজের হাত টা ছাড়িয়ে নিয়ে উঠে দাড়িয়ে বলল,

কোথায় তুমি প্রথমেই জিজ্ঞেস করবে রাত্রি কেমন আছে তা না করে তুমি….

আলেখ একটা হাই তুলে বলল,

রিতু ঠিক আছে আমি জানি।

তাই? কীকরে জানলে?

কমন সেন্স মাই লাভ, রিতু ঠিক না থাকলে তুমি কি ভোর বেলায় এসেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করে ঘুমন্ত হাসবেন্ড কে আদর করতে?

তোমার মুখে কি কিছুই আটকায় না! আর তুমি মোটেও ঘুমিয়েছিলে না, তাই সুযোগের সদ্ব্যবহার কে করেছে সেটা বলার মনে হয় না খুব একটা প্রয়োজন আছে। আর তাছাড়াও আমি মোটেও সুযোগের সদ্ব্যবহার করছিলাম না, আমি শুধু তোমার দৈনন্দিন দাবী পূরণ করছিলাম। নিজে তো ঘুমের ভান করে চুপচাপ শুয়ে ছিলে, ভিষন বদমাশ হয়ে গেছ তুমি।

আলেখ আবার বেশ বড়সর একটা হাই তুলে বলল,

বেশ করেছি, যা করেছি আমার নিজের ওয়াইফের সাথে করেছি তাতে তোমার এত সমস্যা হচ্ছে কেন?

আহা, কি কথা! তোমার ওয়াইফ আর আমি আলাদা বুঝি? আর এই সাত সকালে এত হাই তুলছ কেন? রাতে ঠিক মত ঘুমাওনি নাকি?

ঘুম এলে তবে তো ঘুমাব।

কুহেলির মুখটা আবার ম্লান হয়ে এল, আবার আলেখের পাশে বসে বলল,

তুমি কাল রাতে সত্যিই ঘুমাওনি।

হুম।

কুহেলি একটা হাত দিয়ে আলেখের এলোমেলো চুলে আঙুল চালাতে চালাতে বলল,

তুমি এমন কেন বলতো! পাগল একটা।

আলেখ একটু হেসে বলল,

কারণটা তুমি জানো না? ঠিকই বলেছ আমি সত্যিই পাগল…. তোমার প্রেমে।

বলেই তড়িৎ গতিতে কুহেলির ঠোঁটে নিজের ঠোঁট দুটো ছুঁইয়ে দিয়ে সোজা উঠে কাবার্ডের দিকে এগিয়ে গিয়ে এক সেট জগিং স্যুট বের করতে লাগল। এমন আচমকা ঘটে যাওয়া ঘটনার রেশ কাটিয়ে উঠতে কুহেলির একটু সময় লাগল, একটু পরে অবাক চোখে আলেখের দিকে তাকিয়ে বলল,

এটা কি হল?

আলেখ জগিং স্যুট বের করে ওয়াশরুমের দিকে যেতে যেতে একটা দুষ্টুমি পূর্ণ মুচকি হাসি ঠোঁটে এনে বলে গেল,

শাস্তি।

কুহেলি কিছুক্ষণ বন্ধ দরজাটার দিকে তাকিয়ে থেকে আপনমনেই একটু হেসে বলল,

তুমি সত্যিই পাগল।

আলেখ জগিং থেকে ফিরে স্নান সেরে অফিসে যাওয়ার জন্য প্রায় তৈরি হয়ে বসে আছে অথচ কুহেলির কোনও পাত্তা নেই। তখন থেকে বেচারা হন্যে হয়ে কি যেন একটা খুঁজেই চলেছে কিন্তু পাচ্ছে না, আর কুহেলিরও খোজ নেই যে ওকে জিজ্ঞেস করবে, অগত্যা নিজেই অনুসন্ধান চালিয়ে যাচ্ছে। কুহেলি একটু পরেই ঘরে এসে এই দৃশ্য দেখে বলল,

কি হল? কি খুঁজছ?

কুহেলিকে দেখে আলেখ যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল।

থ্যাঙ্ক গুড তুমি ফাইনালি এসেছ, কোথায় ছিলে?

আমি তো একটু কিচেনে ছিলাম।

কিচেনে তোমার কি কাজ? বৃন্দা দি আসেনি?

এসেছে, কিন্তু…

তাহলে তুমি কি করছিলে কিচেনে?

আরে বাবা বলতে দিলে তো বলব, আগে বলতে দাও আমাকে।

বেশ বলো।

ড্যাড কালকে বলছিল অনেক দিন থেকে মেথির পরোটা খেতে ইচ্ছে করছে। তাই সেটাই বৃন্দা দিকে বলতে গিয়েছিলাম, আর….

এই একটা কথা বলতে এতক্ষণ লাগল?

উফ্, আবার সেই পুরো কথা না শুনেই কথা বলছ? আগে কথা টা শুনে নাও তারপর বলো।

ওকে ওকে, সরি বলো।

আমি কালকে মেথি ভিজিয়ে রেখেছিলাম, সেটাও দেখিয়ে দিয়ে এলাম টুকটাক কিছু কাজও গুছিয়ে দিয়ে এলাম তাই একটু সময় লাগল। এবার বলো তুমি এত ব্যস্ত হয়ে কি খুঁজছ?

আমার ব্লু টাই টা খুজে পাচ্ছি না, সব জায়গায় খুঁজলাম কিন্তু পেলাম না। একটু খুঁজে দাও না কুহেলি।

যেখানে খোজার দরকার সেখানে বাদ দিয়ে নিশ্চয়ই সব জায়গায় খুঁজেছ, সর দেখি।

কুহেলি গিয়ে দু সেকেন্ডের মধ্যে ব্লু টাই টা নিয়ে এল। আলেখ একটু অবাক হয়ে বলল,

এটা কি করে সম্ভব! আমি এত খুঁজলাম কিছুই পেলাম না আর তুমি বলতে গেলে চোখ বন্ধ করে নিয়ে এলে?

কুহেলি এগিয়ে এসে টাইটা বেঁধে দিতে দিতে বলল,

শুধু খুঁজলেই হয়! আগে তো জানতে হবে জিনিসটা কোথায় আছে।

হুম, তবে আমার অত জেনে কাজ নেই।

কেন?

কেন আবার? তুমি আছ তো, যখনই কিছু খুঁজে পাব না কুহেলি বলে জাস্ট একটা ডাক দেব আর তুমি এসে ম্যাজিকের মত খুঁজে দেবে।

কুহেলি টাইটা বেঁধে ঠিক ঠাক করে দিতে দিতে একটু যেন লাজুক সুরে বলল,

আচ্ছা, একটা কথা জিজ্ঞেস করব?

অফকোর্স, এতে পারমিশন নেওয়ার কি আছে?

কুহেলি একটু ইতস্তত করে বলল,

তুমি… তুমি তখন আমাকে কুহু বলে ডাকলে তাহলে এখন আবার কুহেলি বলে ডাকছ কেন?

কুহেলির হাজার টা অনন্য সুন্দর রূপের মধ্যে এই লজ্জাবতী রূপটাই আলেখের সব থেকে বেশি ভালোলাগে। একটু হেসে ওর কানের কাছে মুখটা নামিয়ে এনে বলল,

ওটা শুধু আমাদের স্পেশ্যাল মোমেন্টের জন্য, বুঝলে?… কুহু।

আলেখ আলতো করে ওর ঠোঁট দুটো কুহেলির লাজে রাঙা গালে স্পর্শ করে বলল,

উই আর গেটিং লেট, আমি নীচে যাচ্ছি তুমিও তাড়াতাড়ি নীচে চলে এস। বেশিক্ষণ এখানে থাকলে হয়তো আবার একটা স্পেশ্যাল মোমেন্ট তৈরি হয়ে যেতে পারে, আর তাহলে আজ আর অফিস যাওয়া হবে না।

আলেখ কথা গুলো বলেই একটু হেসে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। কুহেলি কিছুক্ষণ সময় নিল নিজের রক্তিম গাল দুটোকে আবার তার পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনতে। যাই হোক একটু সময় নিয়ে সম্পূর্ণ তৈরি হয়ে ব্রেকফাস্ট সেরে ওরা তো বেরিয়ে পড়ল অফিসের উদ্দেশ্যে। রাত্রিও সেই ভোর বেলাতেই উঠেছে কুহেলি চলে যাওয়ার পর নিজের রুটিন মাফিক সব কাজ সেরে এই সবেমাত্র ব্রেকফাস্টের পর্ব মিটিয়ে একটু নিজের ঘর সংলগ্ন বারান্দায় এসে বসেছে। ওয়েদার টা বেশ ভালই, হালকা শীতের আমেজ যেন শরীরের সঙ্গে সঙ্গে মনটাও ছুয়ে যাচ্ছে। রাত্রি ওর দোলনায় বসে হাতে ফোনটা নিয়ে নিজের মনের সাথে একটা অদ্ভুত দ্বন্দ্ব লড়ছে। নিশীথ কে একবার ফোন করতে ইচ্ছে করছে আবার ভাবছে ফোন করাটা ঠিক হবে কিনা? যদি কিছু মনে করে! কিন্তু মনে করার মত তো কিছু নেই, কালকে ওকে অত বড় একটা সাহায্য করল সেখানে ফোন করে একটা ধন্যবাদ তো দেওয়াই যায়। শেষ পর্যন্ত রাত্রি ফোনটা করেই ফেলল, ফোনের রিং শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই যেন রাত্রির হৃদ স্পন্দনও যেন দ্রুত হতে শুরু করল। পুরো রিং হয়ে লাইনটা একসময় কেটে গেল, রাত্রির মনটা একটু যেন খারাপ হয়ে গেল। কিন্তু খারাপ লাগাটা বেশিক্ষণ স্থায়ী হল না, কারণ একটু পরেই যান্ত্রিক শব্দের সঙ্গে স্ক্রীনের ওপর নিশীথের নামটা ফুটে উঠল। রাত্রির মুখটা যেন অকারনেই একটু উজ্জ্বল হয়ে উঠল, সত্যিই অকারণে কি? রাত্রি কলটা রিসিভ করার সঙ্গে সঙ্গেই ওপাশ থেকে নিশীথের আওয়াজ ভেসে এল,

গুড মর্নিং মিস রাত্রি, আসলে একটু বিজি ছিলাম তাই কলটা রিসিভ করতে পারিনি, বলুন।

এই প্রথম বোধহয় নিশীথ ওর সাথে এত ভালো ভাবে কথা বলছে, উহু একটু ভুল হল। আজ প্রথম নয় গতকালও নিশীথের ব্যবহার রাত্রির প্রতি ঠিক কেমন ছিল সেটা তো আপনারা সবাই জানেন। কিন্তু তাছাড়া যদি বলতে হয় তাহলে সত্যিই আজ প্রথমবার নিশীথ রাত্রির সাথে এতোটা ভালোভাবে কথা বলছে। রাত্রিও প্রত্যুত্তরে মিষ্টি করে একটা গুডমর্নিং উইশ করল, কিন্তু তার সঙ্গেই রাত্রির কিছু যেন একটা খুব অদ্ভুত মনে হল। যেন কিছু একটা অন্যরকম লাগছে, সেটা যে কি ঠিক বুঝতে পারল না। ফোনের ওপ্রান্ত থেকে আবার নিশীথের কণ্ঠস্বর শোনা গেল,

আপনি ঠিক আছেন তো? মানে…

নিশীথের কথার মাঝখানেই রাত্রি বলল,

ডোন্ট ওয়ারি মিস্টার আগরওয়াল, আমি এতটাও উইক নই। হ্যা, ভেঙে পড়েছিলাম, খুব দুর্বল হয়ে পড়েছিলাম কিন্তু আপনি….. মানে আপনারা যেভাবে আমার পাশে ছিলেন তারপরেও কি আমি দুর্বল হতে পারি?

দ্যাটস গুড, একটা অ্যাক্সিডেন্টের জন্য কারোর লাইফ থেমে যেতে পারে না।

রাত্রির ঠোঁটে একটা হাসি আপনা থেকেই যেন খেলে গেল, হঠাৎ করেই মনটা এত কেন ভালো লাগছে সে নিজেও বুঝে উঠতে পারছে না। কিন্তু এই ভালোলাগার মাঝেও একটা কিছু যেন খুব অদ্ভুত লাগছে, যেন কিছু একটা বেমানান আছে এইসব কিছুর মাঝে। নিশীথ আবার বলল,

মিস রাত্রি, আপনার যদি অসুবিধা না থাকে তাহলে কালকে কি আমরা রিশ্যুট টা অ্যারেঞ্জ করতে পারি? অ্যাকচুয়ালি এরপর আমারও আর বেশ কিছুদিন সময় হবে না আর তাছাড়াও লোকেশন টাও এরপর বেশ কিছুদিনের জন্য আর পাওয়া যাবে না। আই নো আমার এইভাবে ফোনে এটা বলা ঠিক হচ্ছে না কিন্তূ…..

আপনি কালকেই সব অ্যারেঞ্জ করুন আমার কোনও অসুবিধা নেই।

আর ইউ শিওর?

ইয়েস।

ওকে দেন, সব ফাইনাল হলে আপনার কাছে মেল চলে যাবে।

ওকে।

ওকে দেন, বাই অ্যান্ড টেক কেয়ার।

হুম, বাই।

ফোনটা রাখার পরেও যেন একটা ভালোলাগার রেশ রাত্রির শরীর মন জুড়ে লেগে রইল, কিন্তু নিজের উপর একটু রাগও হতে লাগল। এত কিছুর মধ্যে আসল কথাটাই তো বলা হল না, একটু ভালো করে ধন্যবাদই তো বলার ছিল কিন্তু সেটাই বলা হল না। আর অত অদ্ভুত লাগছিল কেন বারবার! কি এমন বেমানান ছিল? সবই তো ঠিকই ছিল তাহলে…. হঠাৎ রাত্রির মনে হল,

ইয়েস, তাই তো, আমার যতদূর মনে পড়ছে কালকে উনি আমাকে তুমি বলছিলেন আর আজ আবার আগের মতোই আপনি বললেন। তাই আমার ওরকম অদ্ভুত মনে হচ্ছিল, কিন্তু এতে অদ্ভুত লাগারই বা কি আছে? উনি তো আমাকে আগেও আপনি বলতেন, আমিও তো ওনাকে আপনিই বলি। সবই তো নরম্যাল আছে কিন্তু তাহলে… আচ্ছা উনিই বা আমাকে কালকে তুমি কেন বলছিলেন? উফ্, আমি এই আপনি তুমি নিয়ে এত কেন ভাবছি? হোয়াটস রং উইথ মি? কালকে ওরকম একটা সিচুয়েশনে হয়তো উনিও তুমি বলে ফেলেছেন এতে এত ভাবাভাবির কি আছে? আচ্ছা, বাই এনি চান্স আমি কি ওনার কাছ থেকে তুমি শুনতে চাইছিলাম?

কথা টা মনে হতেই রাত্রির ঠোঁটে ওর অজান্তেই একটা হাসির রেখা ফুটে উঠেই আবার পরক্ষনেই মিলিয়ে গেল।

হোয়াট দ্য… আমি এসব কি উল্টোপাল্টা কথা ভাবছি? আমার মাথা টা কি খারাপ হয়ে গেল নাকি! রাত্রি হোয়াটস রং উইথ ইউ? এইসব উল্টোপাল্টা কথা ভাবা বন্ধ কর, স্টপ দিস রাইট নাও।

বেশ একটু ধমক দিয়ে নিজের সুপ্ত চিন্তা গুলো কে আপাতত দুর করে দিল বটে কিন্তু এই চিন্তা গুলো কি সত্যিই দুর সরিয়ে রাখতে পারবে রাত্রি? দেখা যাক কি হয়, ততক্ষণে একটু নিশীথের মনের ভিতরে কি চলছে সেটা জানার চেষ্টা করলে কেমন হয়? নিশীথের মনটা কাল রাতে সত্যিই খুব অশান্ত লাগছিল, কুহেলির কাছ থেকে পাওয়া ছোট্ট একটা মেসেজ মুহূর্তের মধ্যে ওর অশান্ত মনটা কে শান্ত করে দিয়েছিল। রাত্রির জন্য হঠাৎ এত চিন্তা কেন হচ্ছিল সেটা নিয়ে একটু দ্বিধারও সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু সে নিশীথ আগরওয়াল বলে কথা…. ঠিক নিজেকে বুঝিয়ে নিয়েছিল, আর সেটাই বুঝিয়েছে যেটা সে বুঝতে চায়। তবে আগে রাত্রিকে দেখলেই যে বিরক্তির ভাবটা জেগে উঠত সেটা যেন হঠাৎ করেই চিরতরে বিদায় নিয়েছে। রাত্রির মিসডকল দেখে একটু অবাকই হয়েছিল, খুশি হয়েছিল কি? সেটা অজানা, নিশীথের মনের খবর নিশীথ ব্যতীত অন্য কারোর পক্ষে জানা সম্ভব নয়। নিশীথ আগরওয়াল এমন একটা মানুষ যাকে বুঝে ওঠা সত্যিই বড়ই দুরূহ। এই যেমন এখন, দিব্যি কাজের সমুদ্রে ডুবে রয়েছে, দেখলে কে বলবে যে এই নিশীথই কালকে রাত্রির জন্য এতটা ভাবছিল। এমনকি এই একটু আগেও যখন রাত্রির সঙ্গে কথা বলল, তখনও ওর খোজ নিলেও, ভালো ভাবে কথা বললেও অধিকাংশ কথাই কিন্তু কর্মসংক্রান্তই বলেছে। কি জানি! নিশীথের মনে কি চলছে সেটা বোঝার সাধ্য মনে হয় না কারোর আছে, তাই অযথা চেষ্টা না করে ওকে ওর মত ছেড়ে দেওয়াই ভাল। সময় হলে তো জানাই যাবে, যেমন চলছে তেমনই চলুক না, দেখাই যাক কি হয়। মাঝখানের দিনটাও বেশ ভালোভাবেই কেটে গেল, আলেখ কুহেলি আর রাত্রি মিলে একসাথে গোটা একটা সন্ধ্যে কাটিয়েছে। আইডিয়া টা অবশ্যই কুহেলির, কিন্তু ব্যাপারটা সফল করেছে করেছে ওরা সবাই মিলেই। ওদের সাথে নভতেজ বাবুও কিন্তু সমানতালে যোগ দিয়েছেন। যাই হোক মোট কথা হল রাত্রি আবার একদম পুরোদমে নিজের ছন্দে ফিরে গেছে। কাজ যদিও শেষ হয়নি কিন্তু তাও আজ আর রাত্রি ডায়েট প্ল্যানের বিধি নিষেধ মানল না, মনের সুখে তৃপ্তি করে খেল। এইসবের মাঝে কুহেলির একটা জিনিষ নজরে এল নভতেজ বাবু যেন বড্ড কম খাচ্ছেন, কিন্তু এতকিছুর মধ্যে আর কিছু বলা হল না। আসলে সত্যি বলতে তেমন একটা গুরুত্বও দেয়নি, হতেই তো পারে অস্বাভাবিক তো কিছু নয়, সবারই মাঝে মধ্যে এমন হয়েই থাকে। যাই হোক সবমিলিয়ে বেশ ভালই কেটেছে সন্ধ্যেটা, আর রাত্রি… তার মনেও আর কোনরকম অস্বস্তি বা ভীতি কোনোকিছুই নেই। ওর নিজেরও একটু অবাক লাগছে, এত তাড়াতাড়ি যে নিজেকে সামলে নিতে পারবে নিজেও হয়তো আশা করেনি। আজ সকাল থেকেই রাত্রির মনটা খুব ভালো, আজ সেদিনের শ্যুট টা রিশ্যুট করা হবে। সকালে ঘুম থেকে উঠেই নিয়মমাফিক ওয়ার্কআউট সেরে তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়ল লোকেশনের উদ্দেশ্যে। একটা হালকা হাসি যেন লেগেই আছে ঠোঁট দুটোয়, এত আনন্দের কারণ টা কি রাত্রি নিজেও জানে? অ্যামি আগেই পৌঁছে গিয়েছিল সেটে, রাত্রিকে দেখে হেসে এগিয়ে এসে বলল,

গুড মর্নিং ম্যাম।

রাত্রি পাল্টা একটা মিষ্টি হাসি ফিরিয়ে দিয়ে বলল,

গুড মর্নিং অ্যামি।

অ্যামি যেন একটু অবাকই হল, এত তাড়াতাড়ি রাত্রিকে এতোটা স্বাভাবিক দেখতে পাবে হয়তো আশা করেনি। আর তাছাড়াও শুধু স্বাভাবিক নয়, রাত্রি যে কোনও কারণে খুব খুশি সেটাও বেশ বুঝতে পারছে। রাত্রি ঠিক সময়মত তৈরি হয়ে শ্যুট শুরু করল, যেন আগের থেকেও অনেক বেশি প্রানবন্ত। ফটোগ্রাফার ডিরেক্টর সবাই ওর কাজে খুব সন্তুষ্ট হলেন, কিন্তু থেকে থেকেই রাত্রির চোখ দুটো যাকে খুঁজে চলেছে সে কোথায়? এসে থেকেই দেখছে নিশীথ কোথাও নেই, একবার একটু সাহস করে একজন স্টাফকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারল সে এখনও আসেনি তবে আসার কথা আছে। রাত্রিও তো তেমনটাই জানে, আজ শেষদিন নিশীথ তো আসবে বলেছিল তবে এখনও এলো না কেন? মাঝে মধ্যেই রাত্রি নিজেকে ধমক দিচ্ছে, এভাবে নিশীথের জন্য অপেক্ষা করার কি আছে? কিন্তু মন বলে কথা, সে কি কারো শাসন মানে! তাই রাত্রির অবাধ্য চোখদুটোও থেকে থেকেই চলে যাচ্ছিল দরজার দিকে। অবশেষে লাঞ্চ ব্রেকের পর রাত্রির প্রতীক্ষার অবসান ঘটল, নিশীথ সেটে ঢুকছে, সেই পুরনো চালে। গাঢ় ছাই রঙের স্যুট, চোখে একটা মানানসই গ্লেয়ার, বাঁহাতের কব্জিতে বাধা একটা দামী ব্র্যান্ডেড ঘড়ি আর ডানহাতে একটা সুদৃশ্য ব্রেসলেট। যেকোনো মেয়ের হৃদস্পন্দন স্তব্ধ করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট, ফোনে কারোর সঙ্গে কথা বলতে বলতেই ঠিক ডিরেক্টরের পাশে গিয়ে বসল। রাত্রি যেন কিছুক্ষণের জন্য হারিয়ে গিয়েছিল, ফটোগ্রাফারের ডাকে যেন একটা ঘোরের মধ্যে থেকে জেগে উঠে আবার কাজে মন দিল। নিশীথ বসে সবটাই দেখল, একদম শেষ পর্যন্ত, যখন অবশেষে সবটা সুষ্ঠ ভাবে সম্পন্ন হল তখন সবাই একে অপরকে অভিনন্দিত করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। আসলে আগেরদিন অনভিপ্রেত ঘটনাটার জন্য সবারই মনটা একটু খারাপ ছিল তাই আজকে সবটা নির্বিঘ্নে মিটে যাওয়ায় সবাই খুব খুশি। রাত্রি অপেক্ষা করছিল কখন নিশীথ ওকে অভিবাদন জানাতে আসবে কিন্তু না, নিশীথ এলো না শুধু একবার চোখাচুখি হতে আলতো করে একটু হাসল। রাত্রির একটু খারাপ লাগল, কেন সেটা তার জানা নেই কিন্তু খারাপ লাগল। রাত্রি উঠে গিয়ে ড্রেসটা চেঞ্জ করে ফ্রেশ হয়ে বাইরে এসে দেখল নিশীথ তখনও বসে ফটোগ্রাফারের সাথে কথা বলছে। ওর অকারণ খারাপ লাগাটা একপ্রকার জোর করেই মন থেকে সরিয়ে দিল, মনে মনে ঠিক করল আজ নিশীথ কে ধন্যবাদ জানাতেই হবে। কারণ এরপর আবার কবে দেখা হবে না আদৌ দেখা হবে কিনা…. কথাটা কেন যেন পুরো ভাবতে পারল না রাত্রি। নিশীথের সঙ্গে আর দেখা হবে না এটা ভাবতেই মনটা কেমন খারাপ হয়ে গেল। রাত্রির নিজেকে ভিষন বিভ্রান্ত মনে হল, যেন নিজের মনের অবস্থাটা নিজেই ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। রাত্রি আবারও সব এলোমেলো চিন্তা গুলোকে একপাশে সরিয়ে এগিয়ে গেল নিশীথের দিকে, ততক্ষণে নিশীথও কথা শেষ করে উঠে দাঁড়িয়েছে। রাত্রিকে দেখে একটু হেসে বলল,

গ্রেট জব মিস রাত্রি অ্যান্ড থ্যাঙ্কস ফর ইওর হার্ড ওয়ার্ক।

থ্যাঙ্ক ইউ।

রাত্রি একটু ভেবে বলল,

মিস্টার আগরওয়াল আমার আপনাকে কয়েকটা কথা বলার ছিল।

ইয়া শিওর, বলুন।

না মানে…

ওহ, ওকে আসুন আমার সঙ্গে।

নিশীথ রাত্রিকে নিয়ে এখানে ওর আলাদা ঘরটায় নিয়ে এল, রাত্রির মনে হচ্ছে ওর বুকের মধ্যে কেউ যেন হাতুড়ি পিটচ্ছে, অযথা এমন হওয়ার কারনটা রাত্রি ঠিক বুঝতে পারল না। নিশীথ ওকে বসতে বলে নিজেও বসল, রাত্রি সোফায় বসে একটু ইতস্তত করতে লাগল। নিশীথ সেটা লক্ষ্য করে বলল,

প্লিজ ডোন্ট হেজিটেড, আপনি যা বলতে চান বলুন।

রাত্রি যেন নিজেকে একটু গুছিয়ে নিয়ে বলতে শুরু করল,

আসলে সেদিন আপনি আমার জন্য যা করেছেন তার জন্য আমি আপনাকে ঠিকমত ধন্যবাদ টুকুও দিতে পারিনি। অবশ্য আপনি যা করেছেন তার জন্য ধন্যবাদ শব্দটা যথেষ্ট নয়। আমি হয়তো আমার গোটা লাইফেও আপনার এই ঋণ শোধ করতে পারব না। কিন্তু অ্যাটলিস্ট আপনাকে ধন্যবাদ টুকু তো দিতেই পারি, সেদিন যদি আপনি না থাকতেন….

রাত্রি কথাটা শেষ করতে পারল না, নিশীথ তার আগেই বলে উঠল,

ওসব কথা থাক, দেখুন মিস রাত্রি আমি মনে করি যেটা মনে করলে কষ্ট ছাড়া অন্য কিছু পাওয়ার কোনও আশা নেই সেটা ভুলে যাওয়াই বেটার। আপনাকেও তাই বলছি ভুলে যান, আই নো ভুলে যান বললেই ভুলে যাওয়া যায় না কিন্তু তাও ট্রাই টু ফরগেট। আর প্লিজ আমাকে থ্যাঙ্কস জানাবেন না, এমন কিছুই করিনি আমি। বরং আমার আপনাকে সরি বলা উচিৎ, যতই হোক না কেন কিছুটা দায় আমার থেকেই যায়।

নো মিস্টার আগরওয়াল, এটা আপনি ভুল বললেন। আমি সেদিনও আপনাকে বলেছিলাম অ্যান্ড আই গেস কুহেলিও আপনাকে এই একই কথা বলেছে। দুর্ঘটনায় কারো হাত থাকে না, সো প্লিজ নিজেকে শুধু শুধু দোষ দেবেন না।

কুহেলির নাম শুনে নিশীথের অভিব্যক্তি যেন সামান্য পরিবর্তিত হল কিন্তু সেটা রাত্রির দৃষ্টি গোচর হল না। নিশীথ সামান্য একটু হেসে বলল,

আই নো, বাট স্টিল আমি এখনও এটাই বিলিভ করি দ্যাট কিছুটা হলেও আমার দায় আছে। কারণ এটাই ফ্যাক্ট, আর নিজের দায় এড়ানোর মত মানুষ আমি নই।

রাত্রির কেন যেন কথাটা খুব খারাপ লাগল। দায়! তবে কি নিশীথ সত্যিই শুধুই দায় পালন করার জন্যই এতসব করেছে? সব কিছু কেমন যেন তাল গোল পাকিয়ে যাচ্ছে। নিশীথ এবার উঠে দাড়িয়ে বলল,

সরি মিস রাত্রি, আমার একটা ইম্পর্ট্যান্ট মিটিং আছে এখন না বেরোলে লেট হয়ে যাবে।

রাত্রিও উঠে দাড়িয়ে একটু যেন জোর করেই হাসল। নিশীথ হাসি মুখে ওর দিকে একটা হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল,

আপনার সঙ্গে কাজ করে খুব ভালোলাগল, আই হোপ ভবিষ্যতেও সুযোগ হলে আবার আমরা এক সাথে কাজ করতে পারব।

রাত্রি নিশীথের বাড়িয়ে দেওয়া হাতটা ধরে বলল,

অফকোর্স।

গুডবাই মিস রাত্রি, ভালো থাকবেন।

নিশীথ আর কিছু না বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল, রাত্রির মনটা আবারও একটা অজানা খারাপ লাগায় ভরে উঠল। রাত্রিও ধীর পায়ে এসে নিজের গাড়িতে উঠে বসল, অ্যামি ওকে দেখেই বুঝল কিছু একটা হয়েছে। কিন্তু কিছু বলল না, জানে বলে লাভ নেই রাত্রি এখন কিছুই বলবে না। গাড়িটা ছুটে চলেছে আর সঙ্গে রাত্রির ভাবনা গুলোও, নিশীথের সেদিনের ব্যবহারের সঙ্গে আজকের ব্যবহারে যেন কোনো মিল নেই। কিন্তু এটাই তো স্বাভাবিক তাই না! নিশীথের কাছ থেকে তো এটাই প্রত্যাশিত ছিল। সেদিনের পরিস্থিতি অন্য ছিল, তার সঙ্গে গুলিয়ে ফেললে হবে কেন? কিন্তু রাত্রির এত খারাপ লাগছে কেন? চোখের কোন দুটো এমন ভাবে ভিজে উঠছে কেন? উত্তর রাত্রি জানে না আর জানতেও চায় না।

ক্রমশ________

© স্বত্ব সংরক্ষিত

ব্যস্ততার কারণে সবসময় কমেন্টের রিপ্লাই দিতে পারি না, সেই কারণে আমি দুঃখিত। তবে আমি সুযোগ পেলেই সব কমেন্ট করি। কেমন লাগল আজকের পর্ব টা? অবশ্যই অবশ্যই অবশ্যই জানাবেন কিন্তু। অপেক্ষা করব। দেখা হবে আগামী পর্বে ততদিন পর্যন্ত পড়তে থাকুন ভালো থাকুন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here