সংগোপনে’ পর্ব-৫১

0
1207

#সংগোপনে
#ধারাবাহিক_পর্ব_৫১
#অচিন_পাখি_কলমে_ভাগ্যলক্ষ্মী_দাস

আগের পর্বের পর————-

কুহেলি চুপচাপ শুয়ে ছিল, হালকা তন্দ্রার ভাবও যেন এসেছিল কিন্তু হঠাৎ কারোর কথায় আসন্ন নিদ্রার রেশ টা কেটে গেল। একরকম চমকেই উঠল কুহেলি, সদ্য বোজা চোখ দুটো মেলে দেখল আলেখ ঘরে ঢুকেছে আর হাতে একটা ট্রে। হাসি মুখে কি যেন সব বলছে, কুহেলির ভারী অদ্ভুত লাগল, এই তো কিছুক্ষণ আগেও ওই চোখ দুটোয় সে নিজে অনুশোচনার ছায়া দেখেছিল। কুহেলি কথা না বলায় কতটা কষ্ট হচ্ছিল সেটা তো সে নিজে অনুভব করেছে, তাহলে হঠাৎ এখন এইরকম হাসি মুখে! আর তার থেকেও অদ্ভুত লাগছে কথা গুলো, কি বলছে এগুলো আর কাকেই বা বলছে?

আই অ্যাম হিয়ার মাই প্রিন্সেস, তাড়াতাড়ি উঠে পড় ডার্লিং, ইটস লাঞ্চ টাইম অলরেডি অনেকটা লেট হয়ে গেছে। কাম অন সুইট হার্ট গেট আপ, খাবার টা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে তো, হারি আপ।

কুহেলি হা করে তাকিয়ে আছে আলেখের দিকে, এইসব কি বলছে আলেখ? এখানে তো শুধুমাত্র সেই আছে, তাহলে আলেখ এই প্রিন্সেস সুইটহার্ট ডার্লিং এইসব ওকে বলছে! না মানে, না বলার কিছু নেই কিন্তু আলেখ এইভাবে কোনদিনও ওকে ডাকেনি। কুহেলি বুঝল আলেখ ওর মান ভাঙ্গানোর জন্য এখন এই নতুন পন্থা অবলম্বন করেছে। আলেখ ইতিমধ্যেই কুহেলির পাশে এসে বসেছে, ট্রে টা পাশের সাইড টেবিলের উপর রেখে বলল,

কি হল প্রিন্সেস এখনও ওঠনি?

কুহেলি উঠে বসল, একটু গম্ভীর সুরে বলল,

এগুলো কি শুরু করেছ?

আলেখ খুব স্বাভাবিক ভাবে উত্তর দিল,

কোনগুলো?

ডোন্ট ট্রাই টু অ্যাক্ট ওভারস্মার্ট আলেখ। এই প্রিন্সেস সুইটহার্ট এইসব বলে তুমি আমার রাগ কমাতে পারবে না।

আলেখ আগের মতই হাসি মুখে বলল,

জানি তো, তোমায় এই নাম গুলো স্যুটও করে না, শুধু শুধু তোমায় ঐসব নামে ডাকতে যাব কেন?

কুহেলি দারুন অবাক হয়ে বলল,

মানে! তাহলে কাকে বলছিলে ঐসব?

আলেখ ওর ডান হাত টা আলতো করে কুহেলির পেটে স্পর্শ করে বলল,

আমি তো আমার বেবি ডল কে বলছিলাম।

এত রাগের মাঝেও আলেখের এই ছেলেমানুষী দেখে কুহেলির হাসি পেয়ে গেল। একটা আলতো হাসির রেখা ওর ঠোঁটের কোণে ক্ষণিকের জন্য ঝিলিক দিয়েই মিলিয়ে গেল। আলেখের সেটা নজর এড়াল না, মনে মনে ভাবল,

তুমি আমার ওপর কতক্ষন রাগ করে থাকতে পার আমিও দেখব কুহেলি।

তবে কুহেলি হাসিটা ফুটে উঠতে না দিয়ে আগের মতই গম্ভীর সুরে বলল,

কি ছেলেমানুষী হচ্ছে এগুলো? আর তোমাকে বলেছিলাম না আমি একটু একা থাকতে চাই।

কুহেলি যতই মুখে বলুক সে একা থাকতে চায় কিন্তু মনে মনে সেও ভিষন ভাবে আলেখের সঙ্গ চাইছিল। কুহেলির কথায় আলেখ একটু কষ্ট পেল কিন্তু বুঝতে দিল না, এইটুকু তো সহ্য করতেই হবে, না হলে কুহেলির মান ভাঙাবে কীকরে? হাসি মুখে বলল,

আমি তোমার কাছে আসিনি তো।

মানে?

মানে, আমি তো আমার বেবির কাছে এসেছি। তুমি একা থাকতে চাইলেও আমার বেবিটা একা থাকতে চায় না, তাই না প্রিন্সেস?

শেষের কথাটা কুহেলির পেটের উপরে হাত টা আলতো করে বুলিয়ে বলল। কুহেলির খুব ভালোলাগছে, ইচ্ছে করছে এক্ষুনি আলেখকে জড়িয়ে ধরতে। কিন্তু না, আলেখকে আরও একটু কষ্ট পেতে দেওয়া উচিৎ, এইটুকু শাস্তি তো তার প্রাপ্য। কুহেলি মুখে কিছু না বলে শুধু আলেখের হাত টা সরিয়ে দিল, আলেখ বুঝতে পারল কুহেলি ভিতরে কিছুটা নরম হলেও বাইরে এত সহজে ধরা দেবে না। আলেখ একটা স্যুপের বোল নিয়ে চামচে করে কিছুটা স্যুপ কুহেলির মুখের সামনে ধরল। কুহেলি মুখটা ফিরিয়ে নিল, এবার আলেখ একটু আহত সুরে বলল,

আচ্ছা কুহেলি, তুমি তো আমার উপরে রাগ করে আছ কিন্তু যে আসছে তার কি দোষ? তুমি না খেলে আমাদের বেবিও তো না খেয়েই থাকবে। তুমি আমার সাথে কথা বলো না, ফাইন, আমি কিচ্ছু বলব না। বাট প্লিজ একটু খেয়ে নাও, এখন কিন্তু তোমার টাইম টু টাইম খাওয়া উচিৎ।

কুহেলি আর আপত্তি করল না, কিন্তু নিজে হাতে খেতে চাইলে আলেখ বলল,

প্লিজ কুহেলি, আমি আমার সুইটহার্ট কে নিজে হাতে খাওয়াতে চাই, এইটুকুও কি করতে দেবে না?

কুহেলি পারল না আপত্তি করতে, আলেখ খুব যত্ন করে কুহেলিকে খাইয়ে দিল। কুহেলি বিনা বাক্যব্যয়ে সবটা খেয়ে নিল, আলেখ ওকে খাইয়ে দেওয়ার পর কুহেলি আবার চুপচাপ শুয়ে পড়ল। একটাও কথা বলল না আলেখের সঙ্গে, আলেখও আর কথা বলার চেষ্টা করল না। জানে এত তাড়াহুড়ো করে কোনো লাভ হবে না, একটু ধৈর্য্য তাকে ধরতেই হবে। তাছাড়া কুহেলির এখন একটু বিশ্রামের প্রয়োজন তাই ওকে আর বিরক্ত না করে আলেখ ওর ফোনটা নিয়ে উঠে গেল পাশের ঘরে। কুহেলি আড়চোখে সবটাই লক্ষ্য করছিল, আর ভারী রাগও হচ্ছিল। আলেখ হঠাৎ এইভাবে ওর উপেক্ষা টা মেনে নিচ্ছে কেন? কেন জোর করে নিজের বুকে মিশিয়ে নিচ্ছে না? কেন নিজের ভালোবাসার উষ্ণ স্রোতে ওর মনের শীতল অভিমানের পাহাড়টাকে বিগলিত করে দিচ্ছে না? আসলে সত্যিই নারী হৃদয় বড় জটিল, কি যে চায় এরা নিজেরাই জানে না। এই কথাটা যিনিই প্রথম উপলব্ধি করে থাকুন না কেন, খুব ভুল কিছু বলেননি। এই যেমন, কুহেলি আলেখের সঙ্গে কথাই বলছে না মুখে বলছে একা থাকতে চাই ওদিকে আবার আলেখ ওকে একা রেখে গেলেই মেয়ের অভিমান আরও বেড়ে যাচ্ছে। এদিকে আলেখ পাশের ঘরে গিয়ে আগে শহরের অন্যতম সেরা গাইনোকলোজিস্ট ডক্টর শিবনন্দন রাওয়ের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট ঠিক করল। ওনার ডেট যদিও এইরকম বললেই পাওয়া যায় না কিন্তু এই শহরে আলেখ শর্মারও একটা আলাদা প্রতিপত্তি আছে। তবে আলেখ নিজের প্রতিপত্তির অপব্যবহার করা একেবারেই পছন্দ করে না, নিজের ব্যক্তিগত কাজের জন্য তো একেবারেই নয়। আজকের অ্যাপয়েন্টমেন্টটাও কোনও অন্য অপেক্ষমান রোগীদের প্রতীক্ষার মাঝে অনধিকার প্রবেশ নয়। ডক্টর রাও আসলে একটা সময়ে দশ জনের বেশি পেশেন্ট ভিজিট করেন না, আর আজকের সন্ধ্যেবেলার পূর্ব নির্ধারিত তালিকায় ইতিমধ্যেই দশ জনের নাম নথিভুক্ত হয়ে গেছে। আলেখ শুধু এই সংখ্যা টা আজকের জন্য দশ থেকে এগারো করে নিয়েছে। কুহেলি এদিকে বুকে অভিমানের পাহাড় নিয়েই কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছে, আর আলেখ…. সে তো ডক্টরের সাথে অ্যাপয়েন্টমেন্ট ঠিক করে তারপর বেশ কয়েকবার নভতেজ বাবুকে ফোন করার ব্যর্থ চেষ্টা করে অবশেষে প্রায় বেলাশেষে গিয়ে দুপুরের খাওয়া সম্পন্ন করে আবার ফিরে এসেছে ওদের ঘরে। ঘুমন্ত কুহেলির পাশে বসে কপালে একটা আলতো ভালোবাসার পরশ একে দিয়ে বলল,

খুব কষ্ট দিয়েছি বলো? ওই নরম মন টায় কত অভিমান নিয়ে বসে আছ বলতো? তবে যত রাগ করো না কেন খুব বেশিক্ষণ তুমি আমাকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারবে না। কারণ তুমি আমাকে নিজের থেকেও বেশি ভালোবাস, চিন্তা করো না তোমার এই অভিমান আমি আজকেই দুর করে দেব। আমিও দেখি তুমি কতক্ষন নিজেকে আমার থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পার।

মনে মনে কথা গুলো ভাবার সঙ্গে সঙ্গেই আলেখের ঠোঁট জুড়ে একটা হাসি খেলে গেল। কুহেলির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে মৃদু স্বরে বলল,

নাহ, যেভাবেই হোক আজকের মধ্যেই তোমার মান আমি ভাঙাবই। তোমার কাছে থেকেও এত দুরত্ব যে আর সহ্য হচ্ছে না। বিশেষ করে এখন, যখন আমাদের লিটিল প্রিন্সেস আসতে চলেছে।

কুহেলি সেই যে দুপুরে খাওয়ার পরে ঘুমিয়েছে, এখনও ঘুমাচ্ছে। এখন প্রায় বিকেল শেষের মুখে, সন্ধ্যে হল বলে, কুহেলি এত ঘুমায় না, কিন্তু আজ ঘুমাচ্ছে। আলেখের ওকে ডাকতে ইচ্ছে করছিল না, কিন্তু না ডাকলে হবে না। সন্ধ্যে সাড়ে সাতটায় ডক্টর রাওয়ের নার্সিংহোমে যেতে হবে। আলেখ আলতো করে কুহেলির কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে ডাকল,

কুহেলি, ওঠো এবার।

কুহেলি ঘুমের মধ্যেই ভ্রূ দুটো একটু কুচকে বিরক্তির সুরে বলল,

উনহ, ঘুমোতে দাও।

আলেখ একটু হেসে বলল,

কুহেলি, আবার পরে ঘুমিও চলো ওঠ এখন দেরী হয়ে যাচ্ছে তো, উঠে রেডি হও।

কুহেলি এবার কিছুটা বিরক্তি নিয়ে চোখ দুটো খুলল, সামনে আলেখের হাসি মুখটা দেখে বলল,

কি হল? ডাকছ কেন? আর তুমি আজকে আমার আগে উঠেছ?

আলেখ বুঝল কুহেলি এখনও ঘুমের ঘোরেই রয়েছে, বোধহয় সকাল মনে করছে। আলেখ হেসে বলল,

ওঠো, এটা সকাল নয়।

কুহেলি একটা হাই তুলে উঠে বসল, অবাক চোখে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল পৌনে ছটা বাজে। নিজের মনেই বলে উঠল,

পৌনে ছটা! এটা কি সন্ধ্যে নাকি?

আজ্ঞে।

কুহেলি আলেখের দিকে তাকাল, একটু বিস্ময়ের সুরে প্রশ্ন করল,

আমি দুপুরে ঘুমিয়েছিলাম?

হ্যা।

এতক্ষণ?

হ্যা।

কুহেলি যেন ঘুমের ঘোরে সব ভুলেই গিয়েছিল, হঠাৎ সব মনে পড়ল। ওর জীবনের সেরা সুখবর আর তার সাথেই আলেখের ওই অহেতুক ব্যবহার। আবার অভিমানটা ফিরে এলো, আলেখের দিকে একটা অভিমানী ক্রুদ্ধ দৃষ্টি ছুড়ে দিয়ে নেমে পড়ল খাট থেকে। আলেখ সবই বুঝল, কুহেলির একটা হাত ধরে বলল,

কোথায় যাচ্ছ?

হাত টা ছাড়ো।

আলেখ হাত টা ছাড়লো তো নাই বরং উঠে কুহেলির সামনে এসে বলল,

রাগ টা পরে করো, এখন বলো কোথায় যাচ্ছ?

কুহেলি অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,

তোমার উপর রাগ করতে আমার বয়েই গেছে, আমার অত ফালতু সময় নেই। নিজেকে এতোটা গুরুত্ব দিও না, আমার আরও অনেক কাজ আছে তোমাকে নিয়ে রাগ করার মত সময় আমার নেই। আর কোথায় যাচ্ছি সেটাও কি এখন তোমাকে বলে যেতে হবে নাকি?

আলেখ হেসে কুহেলির হাত টা আরও একটু শক্ত করে নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল,

তাই? রাগ করোনি?

আলেখের হাসি দেখে রাগে কুহেলির সর্বাঙ্গ যেন জ্বলে গেল, মনে মনে বলল,

আমাকে এত কষ্ট দিয়ে এখন হাসছে? বাজে লোক একটা, আমার বলে কিছু ভালোলাগছে না আর উনি হাসছেন!

কিন্তু মনের কথা মনেই রইল, প্রকাশ্যে আর এলো না মানে কুহেলি তাদের প্রকাশ করল না। উল্টে বলল,

না করিনি।

আচ্ছা! তাহলে এগুলো কি?

কোনগুলো?

এই যে, সকাল থেকে কথা বলছ না, ঠিক করে তাকাচ্ছও না আমার দিকে। এগুলো কেন করছ তাহলে?

কথা বলতে বলতে আলেখ কুহেলির অনেকটাই কাছে চলে এসেছে, আলেখের তপ্ত নিশ্বাসের ছোয়ায় কুহেলির মনের শীতল অভিমানের পাহাড় ধীরে ধীরে গলতে শুরু করেছে। কিন্তু সেটা কিছুতেই কুহেলি আলেখকে বুঝতে দিতে চায় না, তাই কিছু না বলে মুখটা অন্য দিকে ফিরিয়ে নিল। আলেখ বুঝল কুহেলি ভিতরে অনেকটাই নরম হয়েছে, কিন্তু যা জেদী মেয়ে এত সহজে সেটা স্বীকার করবে না। আলেখ কুহেলির এই নতুন অভিমানী রুপটাও বেশ উপভোগ করছে। খুব ইচ্ছে করছে কুহেলিকে বুকে মিশিয়ে নিয়ে একটু মন ভরে আদর করতে, কিন্তু এই মুহূর্তে সেটা করা যাবে না। তাই কি আর করে বেচারা, কুহেলির হাত টা ছেড়ে দিয়ে বলল,

কি হল, বললে না তো?

কুহেলি এবারও কিছু বলল না, আলেখকে পাশ কাটিয়ে যেতে গেলেই আলেখ বলল,

আরে কোথায় যাচ্ছ অন্তত সেটা তো বলো।

কুহেলি তাও কোনও উত্তর না দিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ল। আলেখ সেদিকে তাকিয়ে একটু হেসে বলল,

হুম, যতই চেষ্টা কর, কতক্ষন আর নিজেকে ধরে রাখবে?

কুহেলি ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে দেখল আলেখ তৈরি হচ্ছে, এই সময়ে তৈরি হয়ে আবার কোথায় যাবে? কুহেলির ইচ্ছে করছে জিজ্ঞেস করতে কিন্তু না, অভিমানের জমাট বাধা বরফ কিছুটা বিগলিত হলেও সেটা এখনও আছে আর বেশ ভালো মতই আছে। তাই মনের প্রশ্নটা মনেই থেকে গেল, কিন্তু উত্তর টা সে প্রশ্ন ছাড়াই পেয়ে গেল।

রেডি হয়ে নাও কুহেলি।

কেন?

ডক্টরের কাছে যেতে হবে।

কুহেলি আর কোনও কথা না বলে চুপচাপ তৈরি হতে লাগল। আলেখ আগেই তৈরি হয়ে নীচে নেমে গিয়েছিল, বাইরে নিজের গাড়িতে হেলান দিয়ে কুহেলির জন্য অপেক্ষা করছিল। কুহেলি কিছুক্ষণ পরেই বেরিয়ে এল, পরনে একদম সাদামাটা একটা চুড়িদার। প্রসাধনী নেই বললেই চলে কিন্তু তাও কি সুন্দর লাগছে। আলেখ একটু হেসে দরজাটা খুলে দিল, কুহেলি কোনও কথা না বলে চুপচাপ উঠে পড়ল। আলেখও ড্রাইভিং সিটে বসে নিজের সিটবেলট লাগিয়ে দেখল কুহেলি এখনও সিটবেল্ট লাগায়নি।

সিটবেলট টা লাগাও।

কুহেলির সত্যি মনেই ছিল না, সিটবেলটের কথা, থাকবে কীকরে! মনের মধ্যে তো একরাশ অভিমান নিয়ে বসে আছে। আর সব থেকে অদ্ভুত ব্যাপার হলো, আলেখের সকালে বলা কথা গুলোর জন্যই এত কষ্ট পেয়েছিল আর সেই থেকেই এত অভিমান। কিন্তু এখন অভিমানের কারণের ফর্দতে আরও একটা কারণ যুক্ত হয়েছে। আর সেটা হল, আলেখ কেন জোর করে ওর মান ভাঙাচ্ছে না! কি মুশকিল, নিজেই বলছে দূরে থাকতে কথা না বলতে আবার নিজেই রাগ করছে আলেখ কেন জোর করে কথা বলছে না! যাক গে, কুহেলি সিট বেল্ট লাগানোর পরে আলেখ ড্রাইভ করা শুরু করল। খুব বেশি দূরে নয় ডক্টর রাওয়ের নার্সিংহোম, বড়ো জোর সাত আট মিনিটের পথ। কিন্তু এই সামান্য সময়টুকুও যেন কুহেলি আর আলেখ দুজনের কাছেই কয়েক ঘন্টার মত মনে হল। কারণ দুজনের একজনও একটাও কথা বলেনি, কুহেলি বার কয়েক আড়চোখে আলেখের দিকে তাকিয়ে দেখেছে, কিন্তু আলেখ একবারও তাকায়নি। তাকায়নি যে তার দুটো কারণ আছে, এক তো এইসময়ে রাস্তায় ভালই ভিড় থাকে আর দ্বিতীয়ত, কুহেলির দিকে তাকালেই কথা বলতে ইচ্ছে করবে কিন্তু ম্যাডাম তো বারন করেছেন। আর এখন কোনও কারণেই কুহেলির মুড টা খারাপ করতে চায় না আলেখ। কিন্তু ব্যাপারটা যে ঠিক উল্টো হচ্ছে সে খবর তো আর আলেখ জানে না, কুহেলি তো মনে মনে রেগে বোম হয়ে আছে। মনে মনে বলেই চলেছে,

আচ্ছা মানুষ তো! আমি বললাম বলেই দেখ কেমন কথা বন্ধ করে বসে আছে। যেন আমার কথা ছাড়া চলেনই বাবু, যত্তসব ঢং। একে তো পুরো দোষটা নিজের, তখন যা নয় তাই বলে আমাকে কষ্ট দিল। আমি তো রাগ করবই, এত কষ্ট দিলে আমি রাগ করব না? কোথায় আমার মান ভাঙ্গানোর চেষ্টা করবে তা না করে দিব্যি কথা বন্ধ করে বসে আছে। আরে আমি তো রেগে আছি, আমি তো বলবই চলে যেতে, কথা না বলতে, তাই বলে কি সেটা বেদবাক্য নাকি! যে একেবারে অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে হবে! অসহ্য।

কুহেলি নিজের মনে আলেখের মুন্ডুপাত করেই চলেছে আর আলেখ…. সে বেচারা এসব কিছুই বুঝতে পারল না। ডক্টর রাওয়ের নার্সিংহোম টা বেশ সুপরিচিত, সেরা বললেও ভুল বলা হবে না। নিউ লাইফের নাম জানে না এমন মনে হয় না এই তল্লাটে কেউ আছে। ওদের অ্যাপয়েন্টমেন্ট টা ঠিক সাড়ে সাতটায়, ওরা সময়ের কিছুটা আগেই এসেছে। রিসেপশনে বলতেই ওদের ডক্টর রাওয়ের কেবিনের রাস্তা দেখিয়ে দিল, ওরা কেবিনের সামনে এসে দেখল এখনও একজন পেশেন্ট অপেক্ষা করছেন। কুহেলি আর আলেখ দুজনেই একটা সোফায় পাশাপাশি বসল। কুহেলির কেমন একটা মিশ্র অনুভুতি হচ্ছে, একটা অদ্ভুত খুশি আর তার সঙ্গে একটা নতুন অনুভূতি হচ্ছে যেটা ঠিক বলে বোঝানো সম্ভব না, আর কিছুটা নার্ভাসও লাগছে। আলেখ কুহেলির দিকে তাকিয়ে ওর মনের নার্ভাসনেস টা বুঝেই কোনও কথা না বলে শুধু একটা হাতের উপরে হাত রাখল। কুহেলি কিন্তু এবার আর আলেখের হাতটা সরিয়ে দিল না, বা মুখে কোনরকম বিরক্তির ছাপও দেখা গেল না। এই নিঃশব্দ স্পর্শ টুকুর এখন খুব প্রয়োজন ছিল কুহেলির। নির্দিষ্ট সময়ে ওদের পালা এল, ডক্টর রাও একজন মধ্যবয়ষ্ক ব্যক্তি, সবসময় হাসি মুখে থাকেন। কুহেলিকে দেখেই একগাল হেসে বললেন,

কাম সিট ইয়াং লেডি।

কুহেলি আর আলেখ বসার পর ডক্টর রাও ওনার কাজ শুরু করলেন। চেকআপ শেষে কিছু টেস্ট করতে দিয়ে বললেন,

হুম, আপনার এখনও ভমিটিং হয়নি এটা ভালো তবে এখন হয়নি বলে যে পরবর্তীতেও হবে না তার কোনও কারণ নেই। খাওয়া দাওয়া এখন থেকে একদম টাইম টু টাইম করতে হবে আর উল্টো পাল্টা কিছু খাওয়া চলবে না। আই মিন নো জাঙ্ক ফুড অ্যাট অল, ওনলি হেলদি ফুড তাও পিওর হোম মেড।

আরও কিছু নির্দেশ দেওয়ার পর ডক্টর রাও কুহেলিকে টেস্ট গুলো করানোর জন্য পাঠিয়ে দিলেন। টেস্ট গুলো এখানেই হয়ে গেল, ব্যবস্থা খুবই ভালো। সব কাজ মিটে গেলে আলেখ আর কুহেলি আবার ফিরে এলো ওঙ্কার ভিলায়। কুহেলি ফ্রেশ হয়ে একটু নীচে যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়েছিল কিন্তু আলেখ বাধ সাধল।

আবার কোথায় যাচ্ছ?

কুহেলির রাগটা আবার ফিরে এলো, কিছু না বলেই আবার এগোতে গেলে আলেখ এবার কুহেলির হাত টা ধরে বলল,

কি হল? কোথায় যাচ্ছ? কিছু লাগলে বলো আমি এনে দিচ্ছি।

কুহেলির মাথাটা এবার গরম হয়ে গেল, কখন থেকে চাইছে আলেখ একটু ওর মান ভাঙ্গানোর চেষ্টা করুক কিন্তু তা না করে শুধু খেয়ালই রেখে যাচ্ছে। আরে বাবা এত খেয়াল না রেখে আগে মান টা তো ভাঙাবে নাকি? সঙ্গে সঙ্গে আবার আলেখের সকালের বলা কথা গুলোও মনে পড়ে গেল। আর পারল না, হাত টা এক ঝটকায় ছাড়িয়ে নিয়ে রেগে মেগে বলে উঠল,

তুমি প্লিজ এইগুলো বন্ধ কর, আমার এত খেয়াল তোমার রাখতে হবে না। কেন করছ? তুমি থাকো তোমার জেলাসি নিয়ে, আমার প্রতি এত কনসার্ন না দেখালেও চলবে। যখন আবার আমাকে কষ্ট দিতে ইচ্ছে করবে তখন না হয় এসো।

কথা গুলো আলেখের মর্মে গিয়ে বিদ্ধ হলো, একটা ভুল না হয় করেই ফেলেছে। তাই বলে সে ইচ্ছে করে কুহেলিকে কষ্ট দেবে! একথা যে সে স্বপ্নেও ভাবতে পারে না। আর সহ্য করতে পারল না আলেখ, এক টানে কুহেলিকে নিজের কাছে নিয়ে এলো। কুহেলি নিজেকে সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করল কিন্তু আলেখের একটা হাত কুহেলির কোমর টা শক্ত করে আকড়ে রেখেছে আর অন্য হাত টা কুহেলির পিঠে। কুহেলি অনেক চেষ্টা করেও নিজেকে ছাড়াতে পারল না, কিন্তু প্রয়াস বন্ধ করল না।

ছাড় আমাকে, ছাড় বলছি। আমি চাই না তোমার কাছে থাকতে, ছাড় আমাকে। আম…..

কুহেলি আর কিছু বলতে পারল না, কারণ আলেখের উষ্ণ অধর ততক্ষণে রুদ্ধ করে দিয়েছে কুহেলির ওষ্ঠাধর। কুহেলি এই অতর্কিত আক্রমণ টা আশা করেনি, কিছুক্ষণ যেন নড়াচড়া করতেও ভুলে গেল। আলেখ পরম আবেশে কুহেলির ঠোঁটের ভাজে নিজের ঠোঁট দুটো মিশিয়ে দিচ্ছে, শুষে নিতে চাইছে কুহেলির মনের সব অভিমান সব কষ্ট। কুহেলিও আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না, দুহাতে আলেখকে জড়িয়ে ধরে অনুভব করতে লাগল আলেখের প্রতিটা স্পর্শ। মনের মাঝে জমে থাকা হিম গিরিটা আলেখের ভালোবাসার উষ্ণতায় বিগলিত হতে লাগল। চোখের কোল বেয়ে ঝরে পড়ছে সব অভিমান, রাগ, দুঃখ, কষ্ট। আলেখ একসময় ধীরে ধীরে নিজের ঠোঁটের বন্ধন থেকে মুক্ত করল কুহেলির ঠোঁট জোড়া, বেশ কিছুক্ষণ কুহেলির কপালে নিজের কপাল ঠেকিয়ে রাখার পর ওকে মিশিয়ে নিল নিজের বুকে। আলেখের চোখের কোণায়ও চিকচিক করছে নোনা জলের বিন্দু গুলো, আবেগী সুরে বলল,

তুমি এভাবে বলতে পারলে কুহু? আমি কি তোমাকে ইচ্ছে করে কখনও কষ্ট দিতে পারি? তুমি আমার প্রাণ কুহু, আমার সবটা জুড়ে তো শুধুই তুমি। তোমার এতটুকু কষ্টও যে আমি সহ্য করতে পারিনা, সেখানে তুমি কীকরে বললে আমি ইচ্ছে করে তোমাকে কষ্ট দেব?

কুহেলি কান্না ভেজা গলায় বলল,

দিয়েছ তো, তুমি আমাকে কষ্ট দিয়েছ। তুমি জানো তোমার ঐ কথা গুলো আমাকে কতটা কষ্ট দিয়েছে? আমি কোনদিনও ভাবিনি তুমি এভাবে আমাকে বলবে।

আলেখ দুহাতে কুহেলির মুখটা তুলে ধরে বলল,

সরি কুহু, আমি জানি না আমি কীকরে তখন ঐকথা গুলো বলে ফেললাম? বাট ট্রাস্ট মি কুহু, আমি ইচ্ছে করে বলিনি। আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাইনি, তখন কেন যে অত রাগ হয়ে গেল বুঝতে পারিনি। শুধু মনে হচ্ছিল আমার কুহু কে অন্য কেউ কীকরে এত ভালোবাসতে পারে? তুমি তো শুধুই আমার।

আমি তো তোমারই ছিলাম, আছি আর থাকবও। অন্য কেউ আমাকে কতটা ভালবাসল তাতে কি এসে যায় আলেখ? তুমি আমাকে ভালোবাস আমি তোমাকে ভালোবাসি এটাই তো শেষ কথা।

আমাকে ক্ষমা করে দাও কুহু, প্লিজ। আমি না বুঝে অবুঝের মত কাজ করেছি। কিন্তু আমার থেকে দূরে সরে যেও না, তুমি আমার সঙ্গে কথা না বললে আমার ভালোলাগে না।

কুহেলি অভিমানে ঠোঁট ফুলিয়ে বলল,

কে বলেছে দূরে থাকতে, কথা না বলতে? কেন চলে গেলে আমার সঙ্গে কথা না বলে?

আলেখ একটু অবাক হয়ে বলল,

মানে! তুমিই তো বললে তুমি একা থাকতে চাও আমার সাথে কথা বলতে চাও না।

আমি বললাম বলেই তুমি বাধ্য ছেলের মত চলে গেলে?

আলেখ হা করে তাকিয়ে আছে, কুহেলি কি বলছে এক বর্ণও বুঝতে পারছে না। একটু আমতা আমতা করে বলল,

না.. মানে.. আমি তো চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু তুমিই তো….

হ্যা, আমি বললাম বলেই তুমি ওই একবার দুবার চেষ্টা করেই চলে গেলে? কেন গেলে? কেন আমাকে নিজের বুকের মাঝে নিয়ে তখন এই কথা গুলো বলোনি?

আলেখ চরম বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে কুহেলির দিকে, এগুলো কি বলছে কুহেলি! সে চাইছিল আলেখ ওর মান ভাঙ্গানোর চেষ্টা করুক, শুধু মুখেই বলেছিল চলে যেতে কথা না বলতে! আসলে সেটা চায়নি! সত্যিই, নারী মন বোঝা মনে হয় না এজনমে আর হবে। আলেখ একটু হেসে কুহেলির অভিমানে ফুলে থাকা ঠোঁট দুটোয় আবার নিজের ঠোঁট জোড়া ছুঁইয়ে দিয়ে বলল,

আচ্ছা! তুমি যে রাগ করলেও এমন রোম্যান্টিক হয়ে যাও সেটা তো জানা ছিল না।

কুহেলি একটু লজ্জা পেল, কারণ এতক্ষণ আবেগের বশে কি বলে ফেলেছে সেটা এখন খেয়াল হয়েছে। আলেখের দিকে একবার তাকিয়েই আবার চোখ দুটো নামিয়ে নিয়ে বলল,

কোথায়? আমি শুধু রাগই করছিলাম, আর কিছু না।

আচ্ছা?

হ্যা।

কুহেলি নিজেকে ছড়ানোর চেষ্টা করতে লাগল কিন্তু আলেখ এত সহজে ছাড়লে তবে তো। ওর ঠোঁটে এখন খেলে বেড়াচ্ছে দুষ্টু হাসি, কারণ কুহেলির মনে যে অভিমানের আর কনা মাত্রও অবশিষ্ট নেই সেটা বুঝতে তার আর বাকি নেই।

শুধু রাগ করলে তাহলে কেন চাইছিলে আমি তোমার মান ভাঙাই? তাও আবার এমন করে বুকের মাঝে নিয়ে!

কুহেলি এবার আর পালানোর পথ পেল না, নিজের কথায় নিজেই ফেঁসে গেছে। তাও একটা মেকি ভাব এনে বলল,

ওটা.. ওটা তো এমনিই বলেছি।

তাই নাকি?

বলেই হঠাৎ আলেখ কুহেলির সামনে হাটু গেড়ে বসে পড়ল। কুহেলি তো কান্ড দেখে অবাক, কি করতে চাইছে আলেখ! কিন্তু বেশি অপেক্ষা করতে হল না। আলেখ হাঁটু গেড়ে বসে কুহেলির কোমর টা জড়িয়ে ধরে ওর পেটের দিকে তাকিয়ে বলল,

দেখেছ প্রিন্সেস, তোমার মাম্মা কিন্তু এখন মিথ্যে কথা বলছে। তুমি তো সত্যি টা জানো তাই না? তুমি একটু তোমার মাম্মা কে বলে দাও তো, যে মুখে না বললেও তোমার পাপা জানে তোমার মাম্মা তোমার পাপা কে কতটা ভালোবাসে।

কুহেলি আলেখের কথা শুনে লজ্জায় চোখ দুটো বন্ধ করে ফেলল, আর চোখের কোল বেয়ে নেমে এলো নোনা জলের ধারা। না, এই অশ্রু কষ্টের বা অভিমানের নয়, আনন্দের। নিজের জীবন টা সম্পূর্ণ মনে হওয়ার আনন্দ। কুহেলিও হঠাৎ হাঁটু মুড়ে বসে পড়ল, দুহাতে জড়িয়ে ধরল আলেখকে, মুখ থেকে আপনা থেকেই বেরিয়ে এলো একটি মাত্র শব্দ….. ‘ভালোবাসি’।

ক্রমশ____________

© স্বত্ব সংরক্ষিত

যাক, মান ভাঙলো তাহলে? এখন আগামী দিনগুলোর অপেক্ষা, কি হবে, কেমন হবে সেটাই দেখার অপেক্ষা। কেমন লাগল আজকের পর্বটা জানাতে ভুলবেন না কিন্তু, আমি অপেক্ষায় থাকব। আজ তবে আসি দেখা হবে আগামী পর্বে ততদিন পর্যন্ত পড়তে থাকুন ভালো থাকুন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here