#জীবন_সাথী💜
লেখিকা-জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা
৭.
~
রিহানের জন্য খাবার নিয়ে হসপিটালে আসে অনু আর তিহা।রিহানের কেবিনে ঢুকতেই দেখে রিহান বেডের সাথে হেলান দিয়ে শুয়ে পা নাচাচ্ছে আর মোবাইলে টিপছে।একে দেখলে কেউ বলবে যে এর শরীরের এই অবস্থা;দিব্বি সে এখানে আরামে দিন কাটাচ্ছে।কথাগুলো ভেবে ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে টেবিলের উপর টিফিন বক্সটা রেখে রিহানের পাশে এসে বসে অনু।অনুকে একবার আড় চোখে দেখে আবার মোবাইল টিপাই মনোযোগ দেয় রিহান।রিহানের এমন না দেখা ভাবে তার দিকে ব্রু কুঁচকে তাকায় অনু তারপর টিফিন বক্স থেকে খাবারটা বের করে রিহানের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,
”নে তোর জন্য নিজের হাতে রান্না করে এনেছি।খেয়ে নে;”
অনুর কথা শুনে রিহান মোবাইলটা পাশে রেখে একবার খাবারের দিকে তাকাচ্ছে তো একবার অনুর দিকে তাকাচ্ছে।রিহানের এমন কর্মকান্ডে অনু বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করে,
”কি হলো এমন ভাবে কি দেখছিস?খাবি না?”
রিহান তার দুহাত মাথার নিচে রেখে আরাম করে শুয়ে বলে ,
”তুই আমার জন্য রান্না করে এনেছিস!এতো কেয়ার!”
অনু বিরক্ত ভরা চোখে রিহানের দিকে তাকায়;তারপর তিহার দিকে ঘুরে বলে,
”এই জন্যই না তিহা কারো জন্য কিছু করতে নেয়;বিশেষ করে এই রিহানের মতো স্ক্রু ঢিলাদের জন্য।এদের জন্য যায় করো না কেন এরা তাতেই খুত ধরবে।”
কথাটা বলে রিহানের দিকে রাগি দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে ,
”তুই খাবি না?”
অনুর এমন চাহনি দেখে রিহান দাঁতকেলিয়ে হেসে বলে ,
”কে বলেছে খাবো না দে এক্ষনি খাচ্ছি।”
অনুও মুচকি হেসে তার দিকে বক্সটা এগিয়ে দিলো।রিহান খুশি মনে খাবারটা খেয়ে চলছে।অনু বানিয়েছে বলে কথা।খাবার খাওয়ার মাঝখানেই অনু রিহানকে প্রশ্ন করে,
”এই রিহান পুলিশ আসবে কবে রে তোর স্টেটমেন্ট নিতে?”
রিহান মুখে একটা লোকমা নিতে নিতে বলে ,
”আমি খাওয়ার মাঝখানে কথা বলি না।”
রিহানের কথায় অনু আর কোনো প্রশ্ন না করে রিহানকে খাবারটা খেয়ে নিতে বলে।খাওয়া শেষ হলে অনু টিফিন বক্সটা গুছাতে গুছাতে বলে ,
”এবার বল পুলিশ কখন আসবে?”
রিহান একটা টাওয়াল দিয়ে হাত মুখ মুছে বলে ,
”পুলিশের আর হসপিটালে আসার প্রয়োজন নেয়।ওনারা অপরাধীকে ধরে ফেলেছেন।”
.
রিহানের কথায় অনু টিফিন বক্স রেখে অবাক হয়ে তার দিকে তাকায়।তারপর ওর পাশে এসে বসে কৌতুহলী দৃষ্টিতে রিহানের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে,
”পুলিশ অপরাধীকে ধরে ফেলেছে!কিন্তু কিভাবে আর কারা ওরা?কেন এমন করেছে?কিছু বলেছে?”
রিহান পা মেলে সোজা হয়ে শুয়ে চোখ বন্ধ করে বলে ,
”একটা একটা করে প্রশ্ন কর সব উত্তর দিবো।”
রিহানের এমন দায়সারা ভাব দেখে অনুর ভীষণ রাগ হচ্ছে।এই মুহূর্তে তার রিহানের চুল গুলো ছিড়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে।এই ছেলেটা কোনো কিছুকেই সিরিয়াসলি নেয় না অলওয়েজ এমন একটা ভাব যেন কিছুতেই ওর কিছু যায় আসে না।অনু চোখ মুখ কুঁচকে রিহানকে বলে,
”এই তুই তাকা আমার দিকে।এমন মরার মতো শুয়ে পড়েছিস কেন?অদ্ভুত ছেলে তো তুই তোকে যারা এভাবে মারলো তুই তাদের ব্যাপারে একটুও সিরিয়াস না!ওরা কেন এসব করেছে;কার কোথায় করেছে এসব কিছু জানিস?”
রিহান চোখ বন্ধ করা অবস্থায় ডানে বামে মাথা নাড়লো।তার মানে সে কিছু জানে না।অনুর এবার রাগে শরীর রি রি করছে।পারলে এক্ষনি এই রিহান নামের আপতটাকে মাথায় তুলে একটা আছাড় দিতো সে।অনু কোনোরকমে নিজেকে শান্ত করে রিহানকে বলে ,
”রুহান ভাইয়া কই?”
”থানায়”(রিহান)
অনু পার্স থেকে তার ফোনটা বের করে রিহানকে বলে,
”ভাইয়া ফোন নাম্বারটা বল ;”
রিহান এবার চোখ খুলে ব্রু কুঁচকে তাকায় ।তারপর কিছু একটা ভেবে অনুকে রুহানের নাম্বারটা দেয়।নাম্বার পেয়েই অনু রুহানের কাছে কল লাগায়।দুটো রিং বাজতেই রুহান কলটা রিসিভ করে,
”হ্যালো কে?”(রুহান)
অনু সোফায় তিহার পাশে বসতে বসতে বলে,
”ভাইয়া আমি অনু”
”হুম অনু বলো।”(রুহান)
”ভাইয়া রিহানের অপরাধীদের নাকি পুলিশ ধরে ফেলেছে?”
”হুম।আমিও এখন থানায় আছি;ওদের সামনেই।ওদের প্রত্যেকের নামে একটা একটা করে মামলা দিচ্ছি।”(রুহান)
”ওহ।আচ্ছা ওরা এখনো কিছু বলেনি?না মানে কেন ওরা রিহানকে মারল?কার কথায় এসব করেছে এই ব্যাপারে কিছু বলেছে?”(অনু)
”না পুলিশ এখনো জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেনি।জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করার পর সব কিছু জানা যাবে।”(রুহান)
রুহানের কথায় অনু ভাবে সে কি বলবে কালকের কথাটা।আরাফ স্যারই যে সব কিছু করেছে সেটা তো আর কেউ না জানলেও সে জানে।কিন্তু পুলিশ আরাফ স্যারের লোকগুলোকে ধরলো কি করে?আরাফ স্যার তো বলেছিলো ওদের বাঁচাবে!তাহলে?উনারা আবার ভুল কাউকে ধরে ফেলেননি তো?
,
কথাগুলো ভাবতেই অনুর চোখে মুখে চিন্তার ছাপ পরে;সে চিন্তিত হয়ে রূহানকে জিজ্ঞেস করে ,
”আচ্ছা ভাইয়া পুলিশ বুঝলো কিভাবে যে তারায় আসল অপরাধী?”
”আরে ওরা তো সবাই নিজে থেকে এসেই আজ সকালে সারেন্ডার করেছে।পরে পুলিশ ওদের নিয়ে হসপিটালে রিহানের কাছে আসে যাতে রিহান ওদের আইডেন্টিফাই করতে পারে।তখন রিহানও বলে এরাই নাকি রিহানকে মেরেছিলো।রিহানের জবানবন্ধি পেয়েই তো সবাই সিউর হলাম।”
.
রুহানের কথা শুনে অনুর কাছে সবটা ক্লিয়ার হয়েছে।অনু বুঝছে যে সবটাই আরাফের প্লেন।আরাফ তার লোকদের বাঁচানোর জন্য আগে থেকে তাদের সারেন্ডার করতে বলেছে পরে নিশ্চয় তিনিই আবার ওদেরকে থানা থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসবেন।এমন ভাবে কাজটা করেছে যেন সাপও মরে আর লাঠিও না ভাঙ্গে।তবে অনুও মনে মনে ঠিক করে নেয় ঠিক সময় সেও মুখ খুলবে।
কথাগুলো ভেবে একটা তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে ফোনটা কেটে দেয় অনু।
.
অনুদের বাসার সামনে এসে আরাফের গাড়িটা থেমে যায়।গাড়ি থেকে পারভেজ সাহেব নেমে এসে তাদের বাসাটা একবার উপর থেকে নিচ পর্যন্ত দেখে আরাফকে বলে ,
”চল আরাফ তুইও আমার সাথে ভেতরে চল !”
আরাফ ঠোঁট দুটো প্রসারিত করে হাসলো ।তার এমন হাসিতে যেন তার অপরাধবোধটা আরো প্রগাঢ় হচ্ছে।সে পারভেজ সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললো ,
”আজ না পি.এ অন্য কোনোদিন।”
‘
আরাফের কথায় পারভেজ সাহেব বুঝতে পারলো আরাফ কেন ভেতরে যেতে চাইছে না।আরাফের মধ্যে ভীষণ অপরাধবোধ কাজ করছে;সে এখন পারভেজ সাহেবের বাড়ির লোকদের সাথে চোখে চোখ মিলিয়ে কথা বলতে পারবে না।তার জন্য এত গুলো মানুষ কষ্ট পেয়েছে;তাই আরাফ মনে মনে ঠিক করে নিয়েছে আগে এই সব কিছুর পেছনে আসল অপরাধীকে সে খুঁজে বের করবে তারপর সে পারভেজ সাহেবের পরিবারের সাথে দেখা করবে।
.
পারভেজ সাহেব আরাফের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে ,
”যা করবি ঠান্ডা মাথায় করবি।মনে রাখবি রাগের মাথায় যায়ই করিস না কেন তা তোর নিজেরই ক্ষতি বয়ে আনবে।তাই সব কিছু করার আগে ভেবে চিনতে করবি।”
‘
পারভেজ সাহেবের কথায় আরাফ মুচকি হাসলো।এই হাসিতেই প্রকাশ পাচ্ছে যে সে এই মুহূর্তে কতটা ক্ষুব্ধ;আজ তার চোখে মুখে এক অন্যরকম রাগ ছড়িয়ে আছে;যে রাগে সে রীতিমতো কাঁপছে কিন্তু সেটা প্রকাশ করছে না।নিজের রাগকে কন্ট্রোল করার জন্য সে স্টিয়ারিংকে শক্ত করে চেপে ধরলো;তারপর পারভেজ সাহেবের দিকে তাকিয়ে একটা জোরপূর্বক হাসি দিয়ে বললো,
”আজ তাহলে আসি পি.এ;তবে যাওয়ার আগে তোমাকে প্রমিস করে যাচ্ছি যার কারণে তুমি এতো কষ্ট পেয়েছো;যার কারণে আমি আমার পি.এ কে এতো কষ্ট দিয়েছি তাকে আমি ছাড়বো না।”
‘
কথাটা বলে আরাফ গাড়ি স্টার্ট করে সেখান থেকে বেরিয়ে যায়।আর পারভেজ সাহেব আরাফের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলে ,
”আল্লাহ তুমি ছেলেটার সহায় হও।”
‘
কথাটা বলে সে তার বাড়ির দিকে পা বাড়ায়।দরজার কলিং বেলটা কাঁপাকাঁপা হাতে চাপেন তিনি;মনে হাজারো প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে।এতদিন পর উনাকে দেখে তার স্ত্রী আর মেয়ের কি রিয়েকশন হবে সেটাই ভাবছেন তিনি।ভাবতে ভাবতে খেয়াল করলেন এখনো কেউ এসে দরজা খুলছে না।কপাল কুঞ্চিত করলেন পারভেজ সাহেব সাথে চোখে মুখে দেখা গেলো চিন্তার ছাপ।পারভেজ সাহেব আবারো কলিং বেল চাপলেন।এবারও কেউ দরজা খুলছে না।তার দুশ্চিন্তা আরো প্রগাঢ় হলো ।বেশ কয়েকবার কলিং বেল চাপার পর দরজাটা কেউ খুললো।দরজার সামনে মানুষটি দেখে থমকে গেলো পারভেজ সাহেব।তার প্রিয়তমার একি হাল!উস্ক খুস্কো চুল;বিষন্ন চোখ মুখ;গাল গুলোও ভেঙে গিয়েছে;দেখেই বুঝা যাচ্ছে রাহেলা বেগম যে অসুস্থ!তার প্রিয় মানুষটির এই করুন অবস্থা দেখে পারভেজ সাহেবের চোখে পানি চলে এলো;তিনি শক্ত করে রাহেলা বেগমকে জড়িয়ে ধরে তার মাথায় চুমু দিলেন।সঙ্গে সঙ্গে কর্কশ গলায় রাহেলা বেগম বলে উঠলো ,
”এই কি করছো ?বুড়ো বয়সে কি ভীমরতি ধরেছে?দু দিন পর নাতি নাতনির মুখ দেখবে আর এখন এই বয়সে কি শুরু করলে বলোতো?দেখি ছাড় আমায়।”
‘
রাহেলা বেগমের এমন ব্যবহারে পারভেজ সাহেব অবাক হয়ে তার দিকে তাকালে রাহেলা বেগম ব্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে,
”কি এভাবে কি দেখছো?”
তারপর পারভেজ সাহেবের হাতের দিকে তাকিয়ে বলে ,
”তুমি না বাজার করতে গিয়েছিলে!হাত দেখি ফাঁকা।বাজার কই?”
রাহেলা বেগমের প্রতিটা কথায় পারভেজ সাহেবের কাছে খুব বিস্ময়কর লাগছে।রাহেলা বেগম কোমরে হাত দিয়ে বলে ,
”ও বুঝেছি নিশ্চয় বাজারে গিয়ে রহমান ভাইয়ের সাথে আড্ডা জুড়ে দিয়েছিলে তাই তুমি বাজার করতেই ভুলে গিয়েছো তাই না?”
কথাটা বলে তিনি কোমর থেকে হাত নামিয়ে মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে বলে ,
”আচ্ছা আচ্ছা ভয় পেতে হবে না;আমি আজ তোমায় কিচ্ছু বলবো না।এখন চলো ভেতরে চলো।”
‘
কথাটা বলে রাহেলা বেগম পারভেজ সাহেবের হাত ধরে তাকে ভেতরে নিয়ে গিয়ে একটা চেয়ারে বসালেন তারপর তিনি বললেন ,
”তুমি বস;আমি তোমার জন্য পানি নিয়ে আসছি ।”
কথাটা বলে রাহেলা বেগম রান্না ঘরের দিকে গেলেন।পারভেজ সাহেব নিজের পরিচিত রুমটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছেন।কতদিন পর আবার নিজের বাড়িতে আসলেন;অন্য রকম এক ভালো লাগা কাজ করছে তার মনে;পুরো রুমে চোখ বুলাতে গিয়ে তিনি দেখলেন তার চেয়ারের পাশে একটা খবরের কাগজ।তিনি সেটাকে তুলে দেখলেন আজকের ডেট দেওয়া।উনি মুচকি হেসে ভাবলেন অনু এখনো ঠিক মনে করে খবরের কাগজটা তার চেয়ারের পাশে রেখে যায়।এটা অনুর অভ্যাস ছিল প্রতি সকালে তার বাবার খবরের কাগজটা তার চেয়ারের পাশে রেখে দেয়া।এই ১ বছর উনি ছিলেননা ঠিকি কিন্তু তার মেয়ে রোজ মনে করে এই কাজটা করেছে।কথাগুলো ভাবতেই তার অনুর কথা মনে পড়ে তার।আসার পর থেকেই অনুকে দেখছেন না তিনি।অনু কি তাহলে বাসায় নেয়?কথা গুলো ভাবতেই হঠাৎ পারভেজ সাহেবের চোখ যায় তাদের বেডের পাশে রাখা টেবিলটার দিকে।সেখানে কিছু ওষুধ পত্র আর কিছু ফাইল রাখা।উনি চেয়ার থেকে উঠে গিয়ে সেগুলো দেখতে লাগেন।ফাইলের উপর রাহেলা বেগমের নামটা দেখে তিনি তাড়াতাড়ি খুলেন সেটা।পুরো ফাইলটা ভালোভাবে দেখার পর তার চোখ থেকে পানি পড়ে যায়।তিনি এখন বুঝতে পারছে রাহেলার এই অদ্ভুত ব্যবহারের পেছনের কারণটা।
চলবে..
(আল্লাহকে ভয় কর.পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়)
{গঠনমূলক কমেন্ট প্লিজ☺}