মনের কিনারে তুই
লেখিকা: Tarin Niti
পর্ব : ২৩
একটু আগে ফজরের আযান দিয়েছে। ইশার ঘুম ভেঙ্গে গেছে কিন্তু ইশা এখনও শুয়ে আছে।সোজা হয়ে একদৃষ্টিতে উপরের দিকে তাকিয়ে আছে।ওর চোখের কার্নিশ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে।সারারাত একটুও ঘুমাতে পারেনি!শুধু আরিয়ান এর কথা মনে হয়েছে! আরিয়ানের ওর সাথে এমন করলো কেনো???
আগে রাতজেগে আরিয়ানের সাথে কথা বলতো, আরিয়ান কত স্বপ্ন দেখাতো!আজ সব শেষ.. ইশা সারারাত কান্না করেছে। ওর বারবার মনে হচ্ছে সামান্য একটা চড়ের কারণে আরিয়ানের ওর থেকে এত বড় প্রতিশোধ নিলো!ওর মনটা ভেঙ্গে গিয়েছে। ইশা আরিয়ানের কথা ভেবে তাচ্ছিল্যের হাসে তারপর উঠে বসে চোখ-মুখ মুছে নিজেকে শক্ত করে বলে,
“ইশা সারারাত কান্না করেছিস এবার তোকে স্ট্রং হতে হবে। আজ থেকে তোর নতুন লড়াই শুরু
তোকে দেখিয়ে দিতে হবে তুই ভেঙ্গে পড়িস নি”
ইশা চোখ মুছে উঠে ড্রেসিং টেবিলের সামনে যায়।আয়নায় নিজের চেহারা দেখে ইশা নিজেই অবাক হয়। না ঘুমানোর কারণে চোখের নিচে কালো হয়ে আছে, চেহারা টা মলিন চুল গুলো উস্কখুস্ক।ইশা জোরপূর্বক হেসে ওয়াশরুমে চলে যায়।
ইশা ফ্রেশ হয়ে ওযু করে এসে নামাজ পরে, নামাজ পড়ে এসে ব্যালকুনিতে যায়।আজকে ছাদে যেতে ইচ্ছা করছে না।
অনেকক্ষণ পর ইশার মা ইশার রুমে আসে ইশাকে রুমে দেখতে না পেয়ে ভ্রু কুঁচকে তাকায়। তারপর ব্যালকনিতে গিয়ে দেখি ইশা একদৃষ্টিতে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। ইশার মা বলে,
“আজকে ভার্সিটি যাবিনা? ”
ইশা পেছন ফিরে মাকে দেখে বলে, ” হ্যাঁ আম্মু যাবো তোমাকে দেওয়া কথা রাখতে হবে তো”
ইশার মা মুচকি হেসে বলে,
“আমার সাথে কিচেনে হেল্প করবি চল”
“হ্যাঁ হ্যাঁ চলো”
ইশার মা চাইছে ইশা একটু ব্যস্ত থাকুক। একলা থাকলে আরিয়ানের কথা মনে পড়লে মন খারাপ হবে!কিচেনে দুই মা-মেয়ে কথা বলতে বলতে নাস্তা বানাচ্ছে।
ইশার বাবা নাস্তার টেবিলে এসে দেখে ইশা দাঁড়িয়ে আছে।ইশার চোখ কেমন মলিন হয়ে আছে,চোখের নিচে কালো দাগ!ইশা বাবা ইশাকে বলে,
“কালকে রাত্রে ঘুমাসনি? ”
ইশা ওরাও আব্বুর দিকে অবাক চোখে তাকায়। তারপর আমতা আমতা করে বলে,
“ন না ঘুমিয়েছি তো”
তখনই ইশার মা সেখানে আসে উনি ও বুঝতে পারে ইশা কালকে রাত্রে ঘুমায়নি। ইশার মা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,
“তুই যদি ওই ছেলেটার কথা বারবার ভাবিস তাহলে তো নিজেকে শক্ত করতে পারবি না। তুই না বলেছিলে আমাদের সাপোর্ট থাকলে তুই সব করতে পারবি, তাহলে এখন কেন ছেলেটার কথা ভাবছিস?”
ইশা মাথা নীচু করে বলে,
“সরি আর কখনো ওর কথা মনে করবো না”
“আমি জানি তুই এখন না বললেও ঠিকই তুই ওর কথা ভাববি, আরিয়ানকে ভালবাসিস?”
ইশা ছলছল চোখে ওর আম্মুর দিকে তাকায়। ইশার তাকানো দেখে ওর মা বুঝতে পেরে প্রসঙ্গ পাল্টাতে বলে,
“আচ্ছা নাস্তা কর ভার্সিটি যেতে হবে”
ইশা আর কিছু না বলে চেয়ার টেনে বসে পড়ে।ইশার বাবা একবার মেয়ের দিকে তাকিয়ে নাস্তা শুরু করে।
.
ভার্সিটি গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে ইশা। ওর আজকে আবার সেই প্রথম দিনের মতো অনুভূতি হচ্ছে।মনে হচ্ছে যেন নতুন এসেছে ভার্সিটিতে,অনেক কিছু সম্মুখীন হতে হবে।সত্যিই তো! আজকে অনেক কিছুর সম্মুখীন হতে হবে, অনেক অপমান সহ্য করতে হবে।ইশা বুকে হাত দিয়ে নিজেকে শান্ত করে ভার্সিটির ভিতরে যায়।
একটা বটগাছের নিচে আরিয়ানরা বসে আছে। আরিয়ান আর জারা খুব কাছাকাছি, রিহান ওখানে নেই। ইশার ক্লাসে যেতে হলে বট গাছের কাছে দিয়ে যেতে হয়।ইশা আরিয়ানদের সামনে দিয়ে তাড়াতাড়ি হেঁটে চলে যেতে নে তখন জারা এসে ইশার পথ আটকায়। ইশা কে ভালো করে উপরনিচ দেখে বলে,
“কালকে আরিয়ান এতো বড় একটা ছ্যাকা দিল আর আজকে তুমি ভার্সিটিতে চলে এসেছো?সাহসী মেয়ে তো!”
ইশা কিছু না বলে চলে যেতে নে তখন জারা আবার বলে,
“আমি বলেছিলাম আরিয়ান তোমার মতো মেয়েকে কখনো ভালোবাসবেনা তুমি তো বিশ্বাসই করনি। কোথায় গেল তোমার সে বড় বড় কথা আর তোমার বান্ধবী কোথায়, যে আমার সাথে তর্ক করেছিল? ”
ইশা হাত মুঠ করে নিজেকে শান্ত করে। এদের সাথে কথা বলতে চায় না।
তখন আরিয়ান উঠেছে জারার কাঁধে হাত রেখে বলে,
“বেবস, ওর সাথে কি কথা বলছো?”
জারা হেলেদুলে আরিয়ানের কোমরে হাত রেখে বলে,
“কিছু না,ওকে বুঝাচ্ছিলাম যে আমি রাইট আর ও রং! তুমি নাকি ওকে ভালোবাসো খুব বড় মুখ করে বলেছিলো”
এটা বলে জারা জোরে হেসে দে। আরিয়ানও জারার সাথে হাসতে থাকে।ইশা একবার আরিয়ানের দিকে তাকায়।আরিয়ানের হাসিমুখটা আজকে অসহ্য লাগছে! ইশার চোখ ছল ছল করে ওঠে, কিন্তু ও নিজেকে সামলে ক্লাসে যাওয়ার জন্য এগোতে আরিয়ান বলে,
“কালকে বাসায় কয়টা খেয়েছো?”
ইশা পেছন ফিরে আরিয়ানের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়।আরিয়ান বলে,
” চড়ের কথা বলছি!! প্রিন্সিপালের রুমে তো একটা খেলে,বাসায় কয়টা খেয়েছো?দেখলে তুমি আমাকে একটা চড় মেরেছো আমি তোমাকে তার দশগুণ ফিরিয়ে দিয়েছি”
ইশা এক দৃষ্টিতে আরিয়ানের দিকে তাকিয়ে আছে। এটা কি সেই আরিয়ান যাকে ইশা ভালোবাসতো!ইশার কিছু না বলে দৌড়ে ক্লাসে চলে যায়, পেছনে আরিয়ানের হাসির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে!
ইশা এক দৌড়ে সোজা ক্লাসের সামনে চলে আসে। তারপর নিজেকে শান্ত করে ক্লাসে প্রবেশ করে।ক্লাসে গিয়ে দেখে রাইমা বসে আছে, ইশা যেয়ে রাইমার পাশে বসে।রাইমা ইশাকে দেখে মিষ্টি হেসে বলে,
“কেমন আছিস? কালকে তুই কই ছিলি,আমিতো রিহানের সাথে দেখা করে এসে তোকে আর দেখলাম না!বাসায় চলে গিয়েছিলে নাকি?”
রাইমা এখনো কিছু জানে না। গতকাল রাইমা রিহানের সাথে দেখা করে এসে ইশাকে খোঁজে কিন্তু পায় না।রাইমা ইশাকে লাইব্রেরীতেও খোঁজে,ওখানে না পেয়ে রাইমা ভাবে ইশা হয়তো বাসায় চলে গিয়েছে। তাই রাইমাও বাসায় চলে যায়, গতকালকের বিষয়ে কিছুই জানে না রাইমা।
“এখন বল কালকে আমাকে না বলে চলে গেলি কেন?”
গতকালকের কথা ভেবেই ইশার চোখ ছল ছল করে ওঠে।রাইমা ইশা কে দেখে অবাক হয়ে যায়
তাড়াতাড়ি ইশাকে ধরে বলে,
“কিরে তুই ঠিক আছিস?”
ইশা কোনরকমে নিজেকে সামনে বলে, ” হ্যাঁ ঠিক আছি”
রাইমা সন্দিহান চোখের ইশার দিকে তাকিয়ে বলে,
” কি হয়েছে বলতো?”
ইশা হঠাৎ রাইমাকে জড়িয়ে ধরে। রাইমা হকচকিয়ে যায় তারপর ইশার পিঠে হাত রেখে বলে,
“ইশু কি হয়েছে বল..”
“রাইমা রারাইমা… আরিয়ান আমাকে ভালোবাসে না”
ইশা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে।রাইমা অবাক হয়ে বলে,
“কি বলছিস তুই?”
“হুমমম..!”
ইশা আবার কেঁদে দেয়। রাইমা ইশাকে ওর বুক থেকে তুলে ইশার কাঁধে হাত রেখে বলে,
“কি বলছিস তুই এসব! আমাকে সব খুলে বল”
ইশারায় রাইমাকে সব খুলে বলে।কালকে আরিয়ানকে লাইব্রেরীতে ডাকা,আরিয়ানকে জড়িয়ে ধরা,স্যার দেখে ফেলা আর প্রিন্সিপাল রুমে আরিয়ানের অস্বীকার ইশা সব বলে।সব শুনে রাইমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে ও চোখ বড় বড় করে ইশার দিকে তাকিয়ে আছে।আর ইশা নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। রাইমার বিশ্বাসই হচ্ছে না আরিয়ান ইশার সাথে এরকম করছে!রাইমা ইশার কাঁধে হাত রেখে বলে,
“এসব সত্যি?”
ইশা মাথা নীচু করে মাথা নাড়ায় মুখে কিছু বলে না। তারপর আজকে আসার সময় আরিয়ান আর জারার কথাগুলো বলে। রাইমা অবাক হয়ে বলে,
“আরিয়ান ভাইয়া এরকম করবে আমি তো ভাবতেই পারছি না! উনি তোকে কত ভালোবাসতো”
ইশা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলে,
“ভালোবাসা? ওটা ভালোবাসা ছিল না ওটা ছিল নাটক। চড়ের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য।”
রাইমা হঠাৎ ভয় পেয়ে বলে, ” আন্টি কি বলেছে?”
“আম্মু কালকে প্রিন্সিপাল রুমে আমাকে চড় মেরেছিল আর আরিয়ান আজকে আসার সময় জিজ্ঞেস করেছে বাসায় কয়টা মেরেছে!”
আরিয়ান ইশার সাথে এরকম করবে রাইমার ভাবনারও বাইরে ছিল।রাইমা নিজেকে সামলে বলে,
“কিন্তু আঙ্কেল-আন্টি তোকে ভুল বুঝলো!”
ইশা একটু হাসি দিয়ে বলে, “না বাবা মা আমার পাশে না থাকলে আমি আজকে এত স্ট্রং থাকতে পারতাম না। হয়তো এখন বাসায় বসে কান্না করতাম”
“মানে?”
তারপর ইশা রাইমাকে ওর বাসার কথা বলে।ইশার বাবা ওকে সাপোর্ট করেছে পরে মা ও সব বিশ্বাস করেছে।রাইমা মিষ্টি হেসে বলে,
“তুই খুব লাকি যে এরকম দুজন মা-বাবা পেয়েছিস”
ইশা রাইমার দিকে তাকিয়ে আসতে করে বলে,”হুমম”
হঠাৎ কিছু মনে পড়ে যায় এমন ভঙ্গিতে রাইমা বলে,
“কিন্তু রিহান তো আমাকে কিছু বললো না?”
“রিহান ভাইয়া তো কালকে তোর সাথে ছিল হয়তো উনিও কিছু জানেনা”
“আরিয়ান ভাইয়া তোর সাথে এরকম করেছে তার মানে রিহানও কি আমার সাথে নাটক করছে?”
“না রাইমা রিহান ভাইয়া খুব ভালো।আরিয়ান এরকম করছে বলে কি রিহান ভাইয়াওএরকম করবে নাকি?”
“আরিয়ান ভাইয়াকেও তো ভালো ভাবতাম!আর রিহান কিভাবে ভালো হবে?বন্ধুই তো দুজন..”
“তুই যেটাই ভাবিস আমার মনে হয় না রিহান ভাইয়া সাথে নাটক করছে”
” আমারও তো মনে হয়নি আরিয়ান ভাই তোর সাথে নাটক করছে? এত ভালোবাসা দেখিয়েছে,এতো কেয়ারিং সব নাটক ছিল?”
ইশা মন খারাপ করে আর নিচু স্বরে বলে,
” বিশ্বাস” শব্দটার মানে এত কঠিন কেন..!
চলবে…