মনের কিনারে তুই পর্ব : ২২

0
2407

মনের কিনারে তুই
লেখিকা: Tarin Niti
পর্ব :২২

ইশা একপা একপা করে আরিয়ানের দিকে এগিয়ে যায়।আরিয়ানের কাছে গিয়ে আরিয়ানের চোখের দিকে তাকিয়ে বলে,

“তুমি আমাকে চেনো না?আমি তোমাকে জোর করে জড়িয়ে ধরেছিলাম?কেনো মিথ্যা বলছো??”

আরিয়ান ইশার থেকে একটু দূরে গিয়ে বলে,
“আমি মিথ্যা কেনো বলবো?তোমার মতো নির্লজ্জ মেয়ে আমি খুব কমই দেখেছি।চেনা নেই, জানা নেই হুট করে একটা ছেলেকে জড়িয়ে ধরতে যাও!”

ইশা অসহায় চোখে আরিয়ানের দিকে তাকিয়ে আছে। তারপর হঠাৎ ও গর্জে ওঠে আরিয়ানের কলার ধরে বলে,

“তুই আমাকে চিনিস না? আমার সাথে এতদিন প্রেম করে এখন আমাকে চিনোস না?কি ক্ষতি করেছিলাম আমি তোর যে এখন আমার সাথে এরকম করছিস..বললল!! ”

হঠাৎ ইশার মা চেয়ার থেকে উঠে এসে ইশাকে আরিয়ানের থেকে ছাড়িয়ে, নিজের দিকে ঘুরিয়ে জোরে একটা চড় মারে!ইশা গালে হাত দিয়ে স্তব্ধ হয়ে ওর মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে।
বড় হওয়ার পর এই প্রথম মা ওর গায়ে হাত তুললো!ছোটো বেলায় দুষ্টুমির কারণে পড়াশোনার কারণে মাঝে মাঝে মার খেতে, কিন্তু বড় হবার পর ওর মা ওর সাথে একদম বন্ধুর মতো আচরণ করেছে। ইশা কিছু নিয়ে জেদ করলে ইশাকে বুঝিয়ে দিয়েছে কিন্তু কখনো গায়ে হাত তুলে নি।আর আজকে সবার সামনে ওকে চড় মারল!ইশার মা ইশাকে বলে,

“তোর লজ্জা করে না একটা ছেলে বলছে তোকে চেনে না আর তুই বলছিস ছেলেটাকে ভালবাসিস!তুই আমার মেয়ে ভাবতে আমার লজ্জা লাগছে”

চড় খাওয়ার পর ইশা স্তব্ধ হয়ে যায়।মুখ দিয়ে কোন কথা বের হচ্ছে না। তখন প্রিন্সিপাল স্যার বলে,

“আমরা চাইলেই ইশাকে এখনই টিসি দিয়ে বের করে দিতে পারি কিন্তু আপনি একজন টিচার,সম্মানিত ব্যক্তি।আর একজন টিচার হয়ে আমি আপনাকে খুব সম্মান করি,আপনার মেয়ের কথা আপনাকে জানিয়েছি আপনি শাসন করেছেন।আশা করি ভবিষ্যতে ওরকম কিছু করবে না”

ইশা তখন প্রিন্সিপালের দিকে তাকিয়ে বলে, ” স্যার বিশ্বাস করেন আরিয়ান মিথ্যে বলছে”

তখন স্যার বলে, “আরিয়ান মিথ্যে বলছি কি বলছে না,সেটা তো তখন তোমাদের দেখে বুঝে গিয়েছি। তুমি তো জোর করে আরিয়ানকে জড়িয়ে ধরেছিলে! আমি নিজের চোখে দেখেছি,এখন কি আমিও মিথ্যা বলছি”

ইশা স্যারের কথা শুনে মাথা নীচু করে ফেলে।ও বুঝতে পারে এখানে কেউ ওর কথা বিশ্বাস করবে না কিন্তু ইশা অবাক হচ্ছে আরিয়ানের অস্বীকার করা দেখে! আরিয়ান এরকম করছে কেনো?আরিয়ান ওকে ভালোবাসে না..??
প্রিন্সিপাল ইশাকে বলে,
“ইশা আশা করি তুমি আর কখনো এরকম কাজ করবে না, এবার আসতে পারো”

ইশা কিছু না বলে নিচের দিকে তাকিয়ে চুপচাপ বাইরে চলে যায়।ইশার পিছুপিছু আরিয়ান ও রুম থেকে বেরিয়ে যায়।ইশার পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার আরিয়ান ইশার কানে কানে বলে,

“আমি আরিয়ান চৌধুরি। আমাকে কেউ চড় মারবে আর আমি সেটা ভুলে যাবো ইটস নট পসিবল! আজকে আমাকে চড় মারার প্রতিশোধ নিয়েছি।নাও আই এম হ্যাপি।”

ইশা অবাক চোখে আরিয়ানের দিকে তাকায়। এই আরিয়ানকে ও চিনতে পারছে না।
তার মানে সেই প্রথম দিনের চড় মারার কারনে আরিয়ান ওর সাথে এতোদিন নাটক করেছে?ইশার কিছুতেই এটা বিশ্বাস হচ্ছে না। এত ভালোবাসা এত কেয়ারিং এগুলো সব নাটক ছিল!!

ইশা কাঁপাকাঁপা কন্ঠে আরিয়ানকে বলে,
“আপনি আমাকে ভালোবাসেন না?”

এটা শুনে আরিয়ান জোরে হেসে দে তারপর বলে,
“ভালোবাসা?আর তোমাকে? ওহ কাম অন ইশা, আমি এতদিন সব তোমার সাথে নাটক করছি। তুমি যেদিন আমাকে চড় মেরেছিল ওইদিনই আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম আমি এর প্রতিশোধ নেবোই, আজকে নিয়ে নিলাম”

বলেই এই আরিয়ান একটা বাঁকা হাসি দে।ইশা অবাক হয়ে বলে,
“এত দিনের ভালবাসা সব নাটক ছিল?”

ইশার চোখ ছল ছল করছে। ও এটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না।একটা চড়ের কারণে আরিয়ান ওর থেকে এত বড় বদলা নিলো? আরিয়ার হাতগুলো উপরে তুলে আড়মোড়া ভেঙ্গে বলে,

“এতক্ষণে বুঝলে?হ্যাঁ এত স্বপ্ন,ভালবাসা সব নাটক ছিল!বাই দ্যা ওয়ে,,জারা কিন্তু তোমাকে বলেছিল যে আমি তোমাকে ভালোবাসতে পারি না তবুও তুমি বিশ্বাস করোনি।সো স্যাড..”

তারপর আরিয়ান নিজের মুখে ইশার মুখের কাছে এগিয়ে নে,ইশা সেভাবেই দাঁড়িয়ে থাকে,ও স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে।
আরিয়ান একটা বাঁকা হাসি দিয়ে ইশার সামনের চুলগুলো ফু দিয়ে সরিয়ে বলে, “গুডবাই..!! ”

তারপর আরিয়ান হেলতে-দুলতে পকেটে হাত দিয়ে চলে যায়।ইশা একদৃষ্টিতে আরিয়ানের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে।

ইশার মা প্রিন্সিপালের সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে বাইরে আসে।উনি প্রিন্সিপালের কাছে ইশার হয়ে ক্ষমা চায়।প্রিন্সিপাল স্যার খুব ভালো,ওনাকে যথেষ্ট সম্মান দিয়েছে।
তারপর প্রিন্সিপাল থেকে বিদায় নিয়ে বাইরে এসে দেখে ইশা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে কাঁদছে।ইশার মা ইশার কাছে গিয়ে বলে,

“এখানে দাঁড়িয়ে নাটক করছ কেনো?বাসায় চলো ”

ইশা অবাক হয়ে মায়ের দিকে তাকায়।মা কখনো ওকে তুমি করে বলে, না সব সময় তুই করে বলে। আজকে তুমি করে বলছে! ইশার চিৎকার করে কান্না করতে ইচ্ছা করছে।

.
বাসায় এসে ইশা দৌড়ে ওর বাবার রুমে চলে যায়। ইশার বাবা হুইল চেয়ারে বসে বই পড়ছিল,ইশা দৌড়ে গিয়ে ফ্লোরে বসে ওর বাবার কোলে মাথা রেখেই ডুকরে কেঁদে দেয়।ইশার বাবা কয়েক মিনিট হতবাক হয়ে ইশার দিকে তাকিয়ে তারপর ইশার মাথায় হাত রেখে বলে,
“কিরে কাঁদছিস কেনো?”

ইশা কিছু বলে না, আরো জোরে কান্না করতে থাকে। কান্না করতে করতে ইশা জড়ানো গলায় বলে,

“আব্বু.. আব্বু ও মিথ্যে বলছে,আব্বু সত্যিই আমি এসব করিনি”

ইশার বাবা কিছু বুঝতে পারছেনা অবাক হয়ে মেয়েকে দেখছে! তখন ইশার মা রুমে ঢুকে।ইশার বাবা ইশার মাকে বলে,

“ওর কি হয়েছে কাঁদছে কেনো? আর কি করেনি ও?কি বলছে এসব??”

ইশার মা তাকিয়ে দেখে ইশা ওর বাবার কোলে মাথা রেখে কান্না করছে,ওনি সেদিকে তাকিয়ে বলে,
“ভার্সিটিতে রঙ্গ করে এখন এখানে নাটক করে কান্না করা হচ্ছে?”

ইশার বাবা ধমক দিয়ে বলে, “কি বলছো এসব? কি হয়েছে?”

ইশার মা ভার্সিটি সব কথা বলে!ইশা জোর করে একটা ছেলেকে জড়িয়ে ধরেছিল,প্রিন্সিপাল রুমে ছেলেটাকে ভালোবেসে বলেছিল, কিন্তু ছেলেটা অস্বীকার করেছেন। সব শুনেই ইশার বাবা অবাক হয়েছে ইশার দিকে তাকিয়ে থাকে। ইশার মা বলে,

“এই দিনটা দেখার জন্য ওকে পেটে ধরেছি? আমি চেয়েছি ওকে পড়াশুনা করাবো,নিজের পায়ে দাঁড়াবে আর ও ভার্সিটিতে গিয়ে এসব করে!
কত বাবা-মা এস.এস.সি র পর মেয়ে বিয়ে দিয়ে দে। কিন্তু আমি ওকে পড়াতে চাই।এইচএসসির পর অনেকেই আমাকে বলছে, মেয়ে কে এতো পড়িয়ে লাভ কি?কিন্তু আমি চাই ও ভালো করে পড়াশুনা করুক,বড় কিছু একটা হোক, তাই ওকে ভার্সিটিতে ভর্তি করেছি আর ও ভার্সিটিতে এসব করে!”

ইশার মা হঠাৎ কেঁদে দেয়। মায়ের কান্না দেখে ইশার বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে। আজকে ওর জন্য ওর মা কান্না করছে।ইশা হঠাৎ মায়ের পা জড়িয়ে ধরে বলে,

“আ..আম্মু বিশ্বাস করো আমি এরকম কিছু করিনি, প্লিজ আমাকে বোঝো”

ইশার বাবা হুইলচেয়ারের চাকা ঘুরিয়ে ইশার কাছে আসে। তারপর ইশাকে মায়ের পায়ের কাছ থেকে উঠিয়ে উনার পাশে বসিয়ে ইশা মা কে বলে,

“চুপ করো কান্না করছো কেনো? বাইরে একটা ছেলের কথাগুলো শুনে নিজের মেয়েকে ভুল বুঝছো? ওর কথাটা আগে শুনো”

তারপর ইশার বাবা ইশার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
“কি হয়েছে,সব টা আমাকে বল”

বাবার কথা শুনে ইশা ডুকরে কেঁদে উঠে তারপর বলে,
“আমি তোমাদের কাছে ক্ষমা চাইছি, আমি তোমাদেরকে কিছু জানায়নি। তাই হতো আজকে এত বড় শাস্তি পাচ্ছি। কিন্তু বিশ্বাস করো আরিয়ান ভুল বলছে, উনি আমাকে বলেছে ওনি আমাকে ভালোবাসে। আমি প্রথমে রাজি হইনি, কিন্তু উনার পাগলামিতে আমি রাজি হয়ে যাই। আমাদের প্রায় এক মাস রিলেশন ছিল।আর লাইব্রেরী ওনি আমার কাছে আসে।
আমি তোমাদের সাথে সবকিছু শেয়ার করি কিন্তু আমার সবচেয়ে বড় ভুল ছিল তোমাদের এটা না বলা,তাই এতো বড় শাস্তি পাচ্ছি। প্লীজ আমায় ভুল বুঝে দূরে সরিয়ে দিও না”

ইশা নিচের দিকে তাকিয়ে কান্না করছে।ইশার বাবা বলে,
“ছেলেটার নাম আরিয়ান?”

ইশা নিচের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ায়।ইশার বাবা বলে,
“ওই কি সেই ছেলেটা যাকে তুই চড় মেরেছিলি?”

ইশা ওর বাবা দিকে তাকিয়ে বলে,
“হুমম..এই কারণেই ও প্রতিশোধ নিয়েছে।কিন্তু আমি তো ওকে শুধু শুধু চড় মারি নি, আমাকে সিগারেট খাওয়ার জন্যে জোর করেছিলি তাই চড় মেরেছি,এটা জন্য ও আমার সাথে এরকম ভালোবাসা নাটক করে সবার সামনে আমাকে ছোট করেছে”

ইশা মা এতক্ষণ চুপচাপ বাবা মেয়ের কথা শুনছিল।উনি প্রিন্সিপাল রুমে ইশার কথা বিশ্বাস করেনি কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ইশা সত্যি বলছে। প্রিন্সিপাল রুমে এসব বললেও স্যার ইশাকে বিশ্বাস করত না।একে তো ওই স্যারটা ইশা আরিয়ানকে জড়িয়ে ধরা অবস্থায় দেখেছে আবার আরিয়ানের বাবার টাকা আছে,আরিয়ান কে কিছু বলা মানে ভার্সিটির লস!

ইশার মা ইশার কাছে এসে বলে,
“ছেলেটার কথা আমাদের জানাস নি কেন?”

ইশা ওর মায়ের হাত ধরে ডুকরে কেঁদে ওঠে তারপর বলে,
“আমি ভেবেছিলাম নতুন ভার্সিটিতে উঠে রিলেশন তোমরা হয়তো মেনে নেবে না।আমার সবচেয়ে বড় ভুল ছিল তোমাদেরকে না জানানো। আমাকে ক্ষমা করে দাও প্লিজ..”

ইশার মা ইশাকে জড়িয়ে ধরে। ইশার বাবা রেগে বলে,
“ছেলেটার আমার মেয়ের সাথে এরকম করলো আর স্যাররা উল্টো আমার মেয়েকে অপমান করেছে? আমি কালকে ভার্সিটিতে যাবো”

ইশার মা উঠে এসেছে বলে,
“কোনো লাভ নেই বড়লোকের ছেলে!ইশা চড় মারাতে মেনে নিতে পারেনি তাই প্রতিশোধ নিয়েছে। এখন ওকে কিছু বলাও যাবে না”

ইশার বাবা রেগে বলে, “তাই বলে কি আমার মেয়ের সাথে এরকম করবে আর আমি চুপ করে থাকব?”

“কে বলেছে চুপ করে থাকবো? ইশাও এর মুখ্য জবাব দেবে”

ইশা অবাক হয়ে মায়ের দিকে তাকায়।ইশার মা ইশার কাঁধে হাত রেখে বলে,
“তুই কালকে ভার্সিটিতে যাবি! স্বাভাবিকভাবে থাকবি, এমন ভাব করবি যেন কিছুই হয়নি আর মন দিয়ে পড়াশোনা করবি।ওকে দেখিয়ে দিতে হবে এই ধাক্কায় তুই একটুও ভেঙ্গে পড়িস নি।
কিরে পারবি না?তুই না আমার মেয়ে পারবি না বল..”

ইশা ওর মাকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে দেয়,
“পারবো আম্মু, খুব পারবো।তুমি আর আব্বু আমার পাশে থাকলে আমি সব পারবো।শুধু তোমরা আমায় ভুল বুঝনা”

ইশার মা একটা তৃপ্তির হাসি দিয়ে ইশাকে জড়িয়ে ধরে।ইশার বাবা এক্সিডেন্টের পর ওনাকে অনেক লড়াই করতে হয়েছে।পঙ্গু স্বামী, ছোট একটা মেয়েকে নিয়ে বাস্তবতার সাথে লড়াই করে ওনি আজ এ পর্যন্ত, সেখানে ওনার মেয়ে হয়ে ইশা এইটুকুতেই ভেঙ্গে পড়বে?তা কি করে হয়!

ইশা আর ওর মা দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে আছে।কান্না থেমেছে তবুও ইশা একটু পর পর কেঁপে উঠছে। কিন্তু এখন ইশার আর কোনো চিন্তা নেই কারন ও এখন ওর মায়ের বুকে আছে।
ইশার বাবা চোখ ভরে দুই মা মেয়েকে দেখছে..

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here