মনের কিনারে তুই
লেখিকা: Tarin Niti
পর্ব: ৩৭
ইশার বাবা আর আরিয়ানের বাবা বসার ঘরে বসে আছে। ইশা দরজার আড়াল থেকে ওদের দেখছে।ওর এখন ওদের কথার মধ্যে যাওয়া ঠিক হবে না। তাই দূর থেকেই সব কথা শুনছে।
আরিয়ানের বাবা ভাইয়ের হাত ধরে বলে,
“ভাই তুই কেমন আছিস? আর তুই এভাবে হুইলচেয়ারে কেনো?কি হয়েছিল?”
“এসব আপনার না জানলেও চলবে। কেন এসেছেন সেটা বলেন”
আরিয়ানের বাবা মলিন চোখে ভাইয়ের দিকে তাকায়।ওনি জানে তার ভাইটা খুব জেদি!আরিয়ানের বাবা এবার ইশার মার দিকে তাকিয়ে বলে,
“হাসি তুমি অন্তত বলো ওর কি হয়েছে?”
ইশার মা বলতে না চেয়েও বলে ফেলে, “ইশা ছোট থাকতে ওর একটা এক্সিডেন্ট হয়।তখন থেকে হুইলচেয়ারে বন্দি”
আরিয়ানের বাবা ইশার বাবার কাছে বসলে ইশার বাবা বিরক্ত নিয়ে বলে,
“আপনি কেনো এসেছেন সেটা কি জানতে পারি?আপনি যদি আপনার ছেলে আর আমার মেয়ের বিয়ের ব্যাপারে কিছু বলতে আসেন তাহলে বলবো আমি রাজি না।এবার আসতে পারেন”
“বাড়িতে চল ভাই..”
“কার বাড়ি? আমার কোনো বাড়ি নেই”
“আচ্ছা ঠিক আছে তোর যত রাগ অভিমান সব আমার উপর কর কিন্তু প্লিজ বাড়িতে চল।তোকে ছাড়া আমি ভালো নেই।মা চলে যাওয়ার পর থেকে তো আরো একা হয়ে গিয়েছি।আজকে এতোদিন পর তোর দেখা পেলাম! প্লিজ বাড়ি চল।ওই বাড়িতে ত তোরও অধিকার আছে”
“যেই বাড়িতে আমার স্ত্রীকে অপমান করা হয় আমি সে বাড়িতে যাবো না”
“আমি মানছি সেদিন যা হয়েছিলো সব ভুল। আরিয়ানের মা তো সবার কাছে ক্ষমা চেয়েছে। বড় ভাবিকে ক্ষমা করে দে।হাসি তুমি কিছু বলো..”
ইশার মা বলে, “আমি কি বলবো? উনি যা বলবে সেটাই।উনি যদি ওই বাড়িতে যেতে না চায় তাহলে আমিও যাব না”
“ভাই তোকে আমি এই অবস্থায় দেখতে পারছিনা।আমি তোকে বিদেশে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করাবো।প্লিজ ফিরে চল..”
ইশার বাবা একটু রেগে বলে, “আমার আপনার টাকার কোনো প্রয়োজন নেই। আমি এইভাবে ঠিক আছি।আবার বউ, মেয়ে আমাকে কোনো অবহেলা করছে না। আমি যথেষ্ট ভালো আছি। আপনি এবার আসতে পারেন”
ইশার বাবা আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করে ভেতরে চলে যায়। ইশার বাবার পিছুপিছু ইশার মাও চলে যায়।এবার ইশা আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে। এতক্ষণ ওদের সব কথাই শুনেছে।ইশার কেনো জানি খুব কষ্ট হচ্ছে।
আরিয়ানের বাবা একবার ভেতরের দিকে তাকিয়ে বেরিয়ে যায়। সবাই চলে গিয়েছে। ইশা বসার ঘরে এখন একা! ইশা ঘড়ি দেখে আজকে একটু লেট হয়ে গিয়েছে তাই তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যায়।
ইশা নিচে আসলে আরিয়ানের বাবা ইশাকে দেখে হেসে বলে,
“ভার্সিটি যাচ্ছো? চলো আমি তোমাকে পৌঁছে দি”
ইশা একটু হেসে বলে, “তার কোনো দরকার নেই আঙ্কেল।আমি একা যেতে পারবো”
” তুমিও আমার উপর রাগ করে আছো?”
ইশা তাড়াতাড়ি করে বলে, ” না না আঙ্কেল আমি কেনো রাগ করবো? আপনাদের মধ্যে যা হওয়ার হয়েছে এতে আমার কোনো রাগ নেই।আমি তো তখন ছিলামও না!”
“তাহলে চলো আমার সাথে”
ইশা একবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ভাবে আজকে একটু দেরি হয়ে গিয়েছে।রিক্সা পেতে যদি আরও দেরি হয়!তাই ইশা রাজি হয়ে যায়।
আরিয়ানের বাবা আর ইশা গাড়ির পেছনের সিটে বসে।আরিয়ানের বাবা ড্রাইভারকে বলে,
“রতন, এই হচ্ছে আমার ভাইজি ইশা চৌধুরী!”
ইশা একটু অবাক হয়ে আরিয়ানের বাবার দিকে তাকায়।ড্রাইভার একটু হেসে বলে, “স্যার,এতোদিনে আপনি আপনার ভাইকে খুঁজে পেলেন?”
” হুম পেয়েছি। আমি যে কত খুশি তোকে বলে বুঝাতে পারবো না”
এর মধ্যে গাড়ি চলতে শুরু করে। আরিয়ানের বাবা ইশার মাথায় হাত রেখে বলে,
“আমার কোনো মেয়ে নেই।শুধু একটা ছেলে আরিয়ান। একটা মেয়ের খুব ইচ্ছে ছিলো।আজকে আমি মেয়ে পেলাম। তুই আমাকে আর আঙ্কেল বলবি না।আজ থেকে বড়আব্বু বলে ডাকবি, ঠিক আছে?”
ইশা আরিয়ানের বাবার দিকে তাকায়।আরিয়ানের বাবা খুব ভালো। ইশা ভাবছে এতো ভালো বাবার এরকম অসভ্যতা ছেলে হলো কিভাবে!ইশার ভাবনার মাঝে আরিয়ানের বাবা আবার বলে,
“কিরে বলবি না?”
” বড় আব্বু…”
আরিয়ানের বাবার চোখে পানি এসে পড়ে।ওনি হাত দিয়ে চোখের পানি মুছে বলে,
“তোর মুখে বড়আব্বু ডাকটা শুনে খুব ভালো লাগছে।তোর বাবা যে কবে আমাদের ক্ষমা করবে!”
“চিন্তা করো না বড়আব্বু। সব ঠিক হয়ে যাবে”
“তাই যেন হয়! জানিস কালকে আরিয়ানের মা বাসায় গিয়ে অনেক কান্নাকাটি করেছে।দোষটা তো ওরই ছিলো”
ইশা বলে, “কিন্তু আন্টি তো ক্ষমা চেয়েছে।দেখবেন আব্বু বেশিদিন আপনাদের উপর রাগ করে থাকতে পারবে না”
আরিয়ানের বাবা আনমনল বলে, “তোর কথাই যেন ঠিক হয়”
ওরা আরও কিছুক্ষণ কথা বলতে বলতে ভার্সিটিতে সামনে চলে আসে।
ইশা মিষ্টি হাসে বলে, “আসছি বড়আব্বু”
তারপর দরজা খুলে বেড়িয়ে যায়।
ইশাকে বাবার গাড়ি থেকে নামতে দেখে আরিয়ান একটু বেশিই অবাক হয়। এগিয়ে এসে বলে,
” তুমি ড্যাডের গাড়িতে?”
আরিয়ানের বাবা ওপাশের দরজা খুলে বেরিয়ে বলে,
“এই শুন,আমার মেয়েকে একদম জ্বালাবি না। ঠিক আছে?”
” ও তোমার মেয়ে হলো কবে থেকে?”
“আজ থেকেই।ওকে ভার্সিটিতে একদম জ্বালাবি না।সবসময় খেয়াল রাখবি”
ইশা আরিয়ানের বাবাকে বলে, “আমার খেয়াল কাউকে রাখতে হবে না।আমি নিজে নিজের খেয়াল রাখতে পারি”
আরিয়ানের বাবা হেসে বলে, “আমার মেয়ে তো দেখি এখনও ছেলেটার উপর রেগে আছে”
আরিয়ান বলে, “হ্যাঁ তোমার মেয়ের যেই রাগ। বাব বাহ..!”
আরিয়ানের বাবা হেসে বলে, “তোর কি কম রাগ নাকি! আচ্ছা আমি আসছি। আমার অফিসে কাজ আছে।ইশা,মামুনি টা টা..”
ইশা হেসে বলে, “টা টা বড়আব্বু”
আরিয়ানের বাবা চলে গেলে ইশা ভার্সিটির ভিতরে যায়।আরিয়ান ইশার পাশে হাঁটতে হাঁটতে বলে,
“বাবাকে পছন্দ!তার সাথে মিষ্টি করে কথা বলতে পারো আর তার ছেলের সাথে কথা বলতে পারো না?”
ইস বিরক্ত মুখে বলে, “কারন বাবা ভালো আর ছেলেটা অসভ্য”
আরিয়ান রেগে বলে, ” আমি অসভ্য?”
ইশা ভাবলেশহীনভাবে বলে, ” আমিতো আপনাকে বলিনি”
তারপর একটা মুখ ভেংচি দিয়ে ইশা চলে আসে। আরিয়ার হা করে ইশার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। মেয়েটা বড্ড বাড় বেড়েছে! ওকে অপমান করা?
ইশা ক্লাসে গিয়ে দেখে রাইমা এখনো আসেনি।ইশা একটা খালি বেঞ্চে চুপচাপ বসে।রাইমা বাদে ক্লাসের আর কারো সাথে ওর খুব একটা বন্ধুত্ব নেই।তাই চুপচাপ বসে থাকে।যেদিন রাইমা আসে না সেদিন ইশার ভার্সিটিতে নিজেকে এতিম এতিম লাগে!ইশা ফিক করে হেসে দেয় তখন রাইমা এসে ইশার পাশে বসতে বসতে বলে,
” কিরে হাসছিস কেনো?”
ইশা হাসি থামিয়ে বলে, “না কিছু না। আজকে এতো লেট হলো কেনো?রিহান ভাইয়ার সাথে দেখা করে আসলি নাকি?”
রাইমা লজ্জিত মুখে বলে, ” হুমম..”
ইশা দুষ্টু হেসে বলে, “ও বুঝতে পেরেছি”
রাইমা ইশার পিঠে একটা কিল বসিয়ে দে।ইশা কিছুক্ষণ হাসাহাসি করে বলে,
“আচ্ছা শোন তোকে একটা ইমপোর্টেন্ট কথা বলার ছিল”
রাইমা একটু সিরিয়াস ভঙ্গিতে বসে বলে, “হ্যাঁ বল কি হয়েছে”
ইশা একটু এদিক ওদিক তাকিয়ে হাত কচলে বলে,”রাইমা…”
“কি?বললল..”
“আ আরিয়ান ভাইয়া আমার চাচাতো ভাই হয়”
“ওহ.. কি?কি বলছিস?সত্যি?”
রাইমার রিয়েকশন দেখে ইশার হাসি পাচ্ছে।রাইমা ইশার হাত ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলে,
” কি বলছিস তুই?সত্যি ?আর কিভাবে কি হলো? আমাকে সব বলনা প্লিজ..তাড়াতাড়ি বল।আমার আর সহ্য হচ্ছে না”
“আরে রিল্যাক্স রিল্যাক্স বলছি,দাঁড়া”
“দাঁড়াতে পারবো না বসেই বল”
ইশা হেসে গতকালকের সব কথা বলে। ইশা ভেবেছিল রাতে রাইমাকে ফোনে সব বলবে।কিন্তু ফোনে বলার থেকে সরাসরি বলাই ভালো।তাই আজকে সরাসরি বলছে।ইশা সকালের কথাও বলে সব। রাইমার মুখ হা হয়ে যায়।ওর বিশ্বাসই হচ্ছে না আরিয়ার আর ইশা চাচাতো ভাই বোন।রাইমা ইশাকে বলে,
“তুই তো তাহলে অনেক বড় লোকের মেয়ে। আমার সাথে আর বন্ধুত্ব রাখবি তো?”
ইশা রেগে বলে, “বোকা বোকা কথা বলিস না তো। তুই আমার ভার্সিটি লাইফের প্রথম বন্ধু।তোকে কি কখনো ভুলতে পারি?”
রাইমা একটু হাসে তারপর উত্তেজিত হয়ে বলে,
“তুই আর আরারিয়ান ভাই চাচাতো ভাই বোন? ও মাই গড!আমার তো বিশ্বাস হচ্ছে না!”
“বিশ্বাস না হলেও এটাই সত্যি ডিয়ার”
“আচ্ছা তোর কি মনে হয় তোর বাবা-মা ওই বাড়িতে যাবে?”
ওদের কথার মধ্যে ক্লাসে স্যার আসে।ইশা বলে,
“জানিনা রে। আচ্ছা যা হবে পরে দেখা যাবে।আমাদের এখন এসব নিয়ে ভেবে লাভ নেই। ক্লাসে মন দে”
রাইমা স্যারের দিকে তাকিয়ে বলে, “হম..”
চলবে…