সেই সন্ধ্যা পর্ব-৩৩

0
1690

#সেই_সন্ধ্যা
#সুমাইয়া_সিদ্দিকা_আদ্রিতা
#পর্ব_৩৩
.
গাড়ি চলছে আপন গতিতে। গাড়ির কাচ খোলা থাকায় বাইরের হালকা ঠান্ডা বাতাস নির্বিঘ্নে ভেতরে প্রবেশ করছে। নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে গাড়ির ভেতরে। সকাল সেই কখন থেকে স্নিগ্ধর দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কিন্তু স্নিগ্ধর চোখ সামনে রাস্তার দিকে। গাড়িতে ওঠার পর একবারও তাকায়নি সে সকালের দিকে। বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পরও যখন স্নিগ্ধর কোনো হেলদোল দেখলো না সে তখন মন খারাপ করে এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাইরে তাকালো। একটা অস্বাভাবিক কারণে স্নিগ্ধ রেগে আছে তার উপর। কিন্তু এই মুহূর্তে শরীরে বিন্দুমাত্র শক্তি নেই স্নিগ্ধর রাগ ভাঙানোর। শরীরটা ভীষণ ক্লান্ত লাগছে তার। মাথাটা ভনভন করছে। যেকোনো মুহূর্তে পড়ে যাবে মনে হচ্ছে। চোখের সামনে সব ঝাপসা ঝাপসা লাগছে। চোখ দুটো বন্ধ করে সিটে মাথা হেলিয়ে বসলো সকাল, এভাবে থাকলে হয়তো কিছুটা ভালো লাগবে এই ভেবে।

আড়চোখে বেশ কয়েকবার সকালের দিকে তাকালো স্নিগ্ধ। সকালের উপর তার মূলত রাগ হচ্ছে তখন ছেলেটাকে মারা থেকে আটকানোর জন্য। কিসব বলছিল ছেলেটা সকালের নামে। এ-ও বলছিল যে সে সকালকে একরাত তার সাথে থাকার জন্য অফার করবে। স্নিগ্ধর মূল রাগটা এখানেই। এজন্যই ছেলেটাকে বেধড়ক পেটাচ্ছিল। কিন্তু সকাল এসে তাকে আটকে ফেললো। তা-ও থামতো না যদি না সে সকালের চোখে আবার পানি দেখতো। যা হওয়ার তা হয়ে গেছে ভেবে এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে গলা ঝেড়ে নিলো স্নিগ্ধ। অনেক্ক্ষণ যাবৎ এভাবে চুপ করে বসে আছে। সকাল কষ্ট পাচ্ছে ভেবে স্নিগ্ধ তাকে নরম গলায় ডাকলো। কিন্তু কোনো সাড়াশব্দ পেলো না। সকালের দিকে তাকিয়ে আবারও স্নিগ্ধ তাকে ডেকে উঠলো। কিন্তু তখনো সকালকে চোখ বুঁজে থাকতে দেখে অবাক হলো। রাস্তার একপাশে গাড়ি থামিয়ে সকালের দিকে ঘুরে বসে ওর দিকে ঝুঁকে আলতো ভাবে ওর গালে হাত রাখলো স্নিগ্ধ। নরম সুরে তাকে ডাকতে লাগলো। কিন্তু তা-ও কোনো নড়াচড়া করলো না সকাল। তা দেখে স্নিগ্ধর বুকটা ধক করে উঠলো। আরও কয়েকবার ডেকেও যখন সাড়া পেলো না তখন স্নিগ্ধর বুঝতে বাকি রইলো না যে সকাল আবারও জ্ঞান হারিয়েছে। দ্রুত হসপিটালের দিকে গাড়ি ঘুরিয়ে নিলো স্নিগ্ধ।

হসপিটালের বেডে শুয়ে আছে সকাল। পাশেই স্নিগ্ধ বসে আছে। স্নিগ্ধ বসে বসে কিছু একটা লিখছে কাগজে। আর একটু পর পর সকালের দিকে তাকাচ্ছে।
কিছুক্ষণ বাদেই পিটপিট করে চোখ মেললো সকাল। ডান হাতটা নাড়াতে পারছে না ব্যথায়। তাকিয়ে দেখে হাতে ক্যানেলা লাগানো। ওপরে স্ট্যান্ডের দিকে তাকিয়ে দেখে স্যালাইন চলছে। তার কি হয়েছিল কিছুই মনে নেই। শুধু এতটুকুই মনে আছে গাড়িতে খারাপ লাগছিল বলে সে চোখ বন্ধ করে শুয়ে ছিল। এরপর কি হয়েছে! কিছুই মনে পড়ছে না তার। সকাল বুঝতে পারলো সে এখন হসপিটালে। পাশে তাকিয়ে স্নিগ্ধকে দেখতে পেলো। হাতে কলম নিয়ে কি যেন করছে। স্নিগ্ধ কাগজ থেকে চোখ সরিয়ে আবারও সকালের দিকে তাকিয়ে দেখতে পেলো সকাল তার দিকে তাকিয়ে আছে। তাড়াতাড়ি খাতা-কলম রেখে সকালের কাছে এসে তার গালে হাত রাখলো স্নিগ্ধ।

-“ঠিক আছো এখন!”
অস্ফুটস্বরে সকালের জবাব, “হু!”
-“যখন খারাপ লাগছিল তখন আমাকে বলোনি কেন? জানো কতটা চিন্তায় ছিলাম আমি!”
সকাল স্মিত হেসে বললো,
-“আপনি তো রেগে পণ করে বসেছিলেন যে সকালের সাথে কথা বলবেন না।”
-“তাই বলে তুমি নিজের অসুস্থতার কথাও লুকিয়ে যাবে!”
-“আমি কখন অজ্ঞান হয়ে গিয়েছি আমি নিজেই জানি না। আমার শুধু এতটুকুই মনে আছে যে আমি চোখ বন্ধ করে সিটে মাথা হেলিয়ে রেখেছিলাম।”
-“আচ্ছা এখন আর কথা বলো না। বিশ্রাম করো তুমি। কিছু লাগলে আমাকে জানিও। আমি এখানেই আছি, তোমার পাশে।”
সকাল অসুস্থ গলায় জিজ্ঞেস করলো,
-“কি হয়েছে সকালের! স্যালাইন কেন হাতে?”
-“তোমার আবার কি হবে! তুমি তো একদম ফিট তাই না? তার নমুনা দেখছিলাম আমি যে তুমি কতটুকু ফিট।”
-“উফফ… মজা না করে বলুন না কি হয়েছে?”
-“প্রেশার লো। আর বেশি চিন্তা করার কারণে তোমার ব্রেইন তা সহ্য করতে পারেনি। তাই এখন হসপিটালের বেডে শুয়ে স্যালাইন দিতে হচ্ছে তোমাকে।”

সকাল হাত নাড়ানোর চেষ্টা করতে লাগলো। স্নিগ্ধ টেবিলের উপর থেকে একটা কাগজ নিয়ে ওর সামনে এগিয়ে দিল। সকাল কাগজটা দেখে চোখ দুটো বড় বড় করে স্নিগ্ধর দিকে তাকালো।
-“ডায়েট চার্ট!”
-“জ্বি। এই ডায়েট চার্ট অনুযায়ী না চললে তোমার ওজনও বাড়বে না আর তোমার প্রেশারও জীবনে স্বাভাবিক হবে না। তাই তোমাকে এই চার্ট অনুযায়ী অবশ্যই চলতে হবে।”
-“ডাক্তার সাহেব! আপনি চার্টে যা যা লিখেছেন এত খাবার আমি খাবো কীভাবে? আর সব থেকে বড় কথা হলো আমি সবজি খাই না। আর আপনি এখানে তো দেখি শুধু সবজি দিয়েই ভরে রেখেছেন।”
-“এখন থেকে এগুলোই খেতে হবে। সেটা তুমি চাও বা না চাও। আমার বউয়ের ভালোটা আমাকেই দেখতে হবে। কারণ আমার বউ নিজের ভালোটা বুঝে না।”

সকাল মুখ ভেঙিয়ে আবারও কাঁদো কাঁদো চেহারা বানিয়ে ডায়েট চার্টের দিকে তাকালো। স্নিগ্ধ সকালের চেহারার অবস্থা দেখে না হেসে পারলো না।

আফি মেডিকেল থেকে বাসায় যাওয়ার সময় ঘড়িতে সময় দেখে দাঁড়িয়ে গেল। গতকাল পরশকে ওইভাবে রেখে আসার পর থেকে এখন অব্দি একবারও কথা হয়নি। একা একা কি করছে ছেলেটা কে জানে! সকাল থেকে তো মনে হয় কিছুই খায়নি এখনো। কথাটা মাথায় আসতেই দ্রুত পা চালিয়ে পরশের বাসার দিকে রওয়ানা হলো।
সাত তলায় এসে লিফট থামতেই পরশের বাসার সামনে এসে কলিংবেল দিতে গেলে আফির মনে পরলো, গতকাল পরশ তার বাসার চাবি দিয়ে লক খুলতে দিয়েছিল। এরপর চাবি আর পরশকে ফিরিয়ে দেয়নি সে। নিজের মাথায় একটা থাপ্পড় মেরে চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলো। পরশের রুমে এসে দেখে পরশ কম্বল জড়িয়ে ঘুমোচ্ছে প্লাস্টার করা পা-টা বালিশের উপর নামানো। পাশেই খাবারের ট্রলি রয়েছে। সেটা সম্পূর্ণ খালি। ব্যাগটা টেবিলের উপর নামিয়ে রেখে ওড়নাটা কোমড়ে গুঁজে, হাতখোঁপা করতে করতে রান্নাঘরে গেল আফি।
পরশের ঘুম ভাঙতেই হালকা করে চোখ খুলে আবারও চোখ বন্ধ করে নিলো সে। গতকাল আফির বানিয়ে দিয়ে যাওয়া চিকেন রোল ছিল দুটো। সেগুলো সকালে খেয়ে নিয়েছে। তবুও খিদে যায়নি। পেটের ইঁদুরগুলো যেন তীব্র বেগে দৌড়াচ্ছে। গতরাতে তার বাবা-মা অফিস থেকে এসে একবারও খোঁজ নেয়নি তার। হয়তো তারা বেশী ক্লান্ত ছিল। এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে পরশ আবারও ঘুমানোর চেষ্টা করলো। ঘুমিয়ে থাকলে খিদের ভাবটা বুঝতে পারবে না। চোখ বন্ধ করার কিছু সময় পরেই তার নাকে খুব সুন্দর খাবারের ঘ্রাণ আসতে লাগলো। সাথে আসছে কিছু টুং টাং আওয়াজ। পরশ ভ্রু কুঁচকে দরজার দিকে তাকালো। শব্দটা বাইরে থেকে ভেসে আসছে। হয়তো রান্নাঘর থেকে আসছে। কিন্তু এই সময়ে বাসায় কে থাকবে! চোর ঢুকলো না তো বাসায়! চিন্তাটা মাথায় আসতেই চোখ বড় বড় করে ফেললো সে। এই ভাঙা পা নিয়ে চোরের হামলা থেকে বাঁচবে কি করে? নাহ তাকে ঘুমিয়ে থাকতে দেখলে চোররা তাকে কিছুই করবে না। জেগে থাকতে দেখলে মেরেও ফেলতে পারে। এই ভেবে পরশ চুপটি করে কম্বলের নিচে ঢুকে, কম্বল দিয়ে মাথা ঢেকে ফেললো।
আফি রান্না শেষ করে ট্রলিতে সাজিয়ে নিলো। টেবিল থেকে পানির গ্লাস আর জগ ভরতি পানি ট্রলিতে নিয়ে পরশের রুমে চলে এলো। রুমে এসে এখনো পরশকে ঘুমিয়ে থাকতে দেখে ট্রলি পাশে রেখে সে নিজে যেয়ে পরশের পাশে বসলো। কম্বলের ভেতর থেকে চুলগুলো বেরিয়ে আছে পরশের। আফি আলতো হাতে পরশের চুলে হাত বুলিয়ে ডাক দিতেই লাফিয়ে উঠলো পরশ। আফি নিজেও ভয় পেয়ে গেল পরশকে লাফিয়ে উঠতে দেখে। লাফিয়ে ওঠার কারণে হাতে ব্যথা পেয়ে আবারও শুয়ে পরলো পরশ। চোখ পিটপিট করে পাশে তাকিয়ে দেখে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে আফি। বিষ্মিত হয়ে গেল পরশ।

-“আফি তুমি! তুমি বাসায় ঢুকলে কীভাবে?”
-“তার আগে তুমি বলো, তুমি লাফিয়ে উঠলে কেন?”
-“আ..আমি ভেবেছিলাম চোর এসেছে বাসায়।”
-“কিহ! ওই আমাকে দেখে তোমার চোর মনে হয়?”
-“না মানে আমি তোমাকে বলিনি। আমি সত্যি সত্যি চোরকেই ভেবেছিলাম। আচ্ছা বাদ দাও। তুমি বলো! তুমি কখন এলে?”
-“এইতো ঘন্টা দুয়েক আগে। ভাবলাম তোমাকে দেখে যাওয়া উচিৎ একবার। এসে দেখি তুমি ঘুমিয়ে আছো। তাই আমি রান্নাঘরে গিয়েছিলাম কিছু বানাতে।”
-“ওহ আচ্ছা। কিন্তু বাসায় ঢুকলে কীভাবে? চাবি কোথায় পেলে!”
-“গতকাল তুমি দরজা খোলার জন্য চাবি দিয়েছিলে। চাবিটা আর তোমাকে ফিরিয়ে দেয়া হয়নি। আমার কাছেই রয়ে গিয়েছিল।”
-“ওহ! আমি তো ভেবেছিলাম কোন চোর-ডাকাত ঢুকলো। তাই ঘাপটি মেরে ছিলাম কম্বলের নিচে।”
-“সিরিয়াসলি পরশ! তুমি পারোও। আচ্ছা উঠো এখন। ফ্রেস হয়েছো?”
-“না। এখনো উঠতে পারছি না।”
-“আচ্ছা আসো আমি সাহায্য করছি।”

আফি পরশকে ধরে ওয়াশরুমে নিয়ে গেল। পরশকে ফ্রেস হতে সাহায্য করে আবারও রুমে এনে খাটে বসিয়ে দিল। নতুন একটা টি-শার্ট পড়িয়ে দিয়ে ট্রাউজার ওর হাতে ধরিয়ে দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল আফি। কিছুক্ষণ পরে পরশের ডাকে রুমে ঢুকে পরশের পাশে বসলো সে। পরশ অসহায় চেহারা বানিয়ে বললো,
-“কি বানিয়েছো?”
-“উম… নিজেই দেখে নাও।”

খাবার ঢাকনাগুলো উঁচু করতেই পরশ আফির দিকে তাকিয়ে ‘বিরিয়ানি’ বলে চিল্লিয়ে উঠলো। আফি হেসে একটা প্লেটে বিরিয়ানি নিয়ে পরশের দিকে এগিয়ে দিল। পরশ ঠোঁট উল্টে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো আফির দিকে। যার অর্থ আমাকে খাইয়ে দাও। বুঝতে পেরে গাল ফুলিয়ে হাত ধুয়ে আসলো আফি। পরশকে যত্ন সহকারে খাইয়ে দিল। সাথে নিজেও খেলো। আজও পরশের সাথে অনেক্ক্ষণ আড্ডা দিয়ে বের হলো সে। আসার সময় পরশের বাসার চাবি নিয়ে এসেছে। কারণ সে আবারও আসবে আগামীকাল। বিভিন্ন রকমের স্ন্যাকস বানিয়ে দিয়ে এসেছে আফি পরশের জন্য। যাতে পরশকে শুধু বিরিয়ানি খেয়ে না থাকতে হয়।

একটি অন্ধকার রুমে চেয়ারের সাথে বেঁধে রাখা হয়েছে তিনজন লোককে। তাদের সবার মুখে স্কচটেপ লাগানো রয়েছে। লোকগুলো সমানে মুখ দিয়ে আওয়াজ বের করার চেষ্টা করছে আর নড়াচড়া করছে ছাড়া পাওয়ার জন্য। দরজা খোলার শব্দে একরাশ আতঙ্ক এসে ঘিরে ধরলো তাদের। মৃত্যু নিজের চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে তারা। এখন হাজার চেষ্টা করেও এখান থেকে না পারবে পালাতে, আর না পারবে বেঁচে ফিরতে। দরজা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো মুখে মাস্ক পরিহিত একজন ব্যক্তি। রুমে ঢুকে সোজা টেবিলের দিকে এগিয়ে গেল সে। সেখানে বিভিন্ন রকমের অস্ত্র রয়েছে। সবগুলো অস্ত্র দেখে বেছে বেছে মাঝারি আকারের একটি ধারালো নতুন ছুরি হাতে নিয়ে নাড়িয়ে দেখতে লাগলো। ধার পরীক্ষা করার জন্য নিজের হাতের তালুতে হালকাভাবে ছুরিটা চাপ দিয়ে ধরতেই হাতের তালু কেটে রক্ত ঝরতে লাগলো। হাত অনেকটাই কেটে গেছে তার। হাতের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে চোখ বন্ধ নিজের মাস্ক খুলে হাতের রক্তগুলো গালে লাগিয়ে নিলো। দেখতে কোনো উম্মাদের চেয়ে কম লাগছে না তাকে। চোখ খুলে লোকগুলোর দিকে তাকাতেই ভয়ে কেঁপে উঠলো তারা। চোখ দুটো একদম রক্তবর্ণ ধারণ করে আছে। অজানা ব্যক্তিটি তাদের সামনে এসে দাঁড়িয়ে বাঁকা হাসতে লাগলো।

-“তোদের সাহস দেখে আমি অবাক না হয়ে পারলাম না। তোরা আমার জানকে মিথ্যে অপবাদ দিয়ে ফাঁসাতে চাইছিলি! তোদের কলিজা কত বড় হয়েছে হ্যা? আজকে যদি আরিফুল ইসলাম সত্যিটা খোলসা না করতো তাহলে আমার জানের কি হতো? ওর তো জীবনটাই বরবাদ হয়ে যেতো। বিনা অপরাধে সমাজের কাছে অপরাধী হয়ে থাকতে হতো ওকে। তোদেরকে শাস্তি হিসেবে ওই আরিফুল ইসলাম মেডিকেল থেকে বের করে দিয়েছে তাই না! কিন্তু এটাতো কোনো শাস্তির ভেতরেই পড়েনা। শাস্তি তো এবার আমি দিব তোদেরকে। ভয়ানক শাস্তি। আর সেটা হলো মৃত্যু। শুধু তোদের মেরে আমার শান্তি হবে না। তাই তোদের স্ত্রী আর ছেলেমেয়েকে তুলে নিয়েছি। তাদের সাথে আমি ঠিক কি কি করবো তা জানলে তোরা এমনিতেই মরে যাবি। তবে এত সহজ মৃত্যু আমি তোদের দিতে চাই না। আমি এমনভাবে তোদের মারবো যে মৃত্যুও ভয় পাবে। তোরা ভুল মানুষকে আঘাত করতে চেয়েছিস। আমার জানের জন্য আমি সবকিছু করতে পারি। সবকিছু! গেট রেডি টু ডাই প্রফেসরস।”

প্রথম প্রফেসরের কাছে গিয়ে তার সামনের চেয়ারে বসলো অজানা ব্যক্তিটি। গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে প্রফেসরের হাতের এবং পায়ের নখগুলো তুলে ফেললো। তারপর হাতের দশটা আঙুলই কেটে আলাদা করে ফেললো। প্রফেসর চিৎকারও করতে পারছে না মুখ বেঁধে রাখার কারণে। ঠিক একইভাবে তার পায়ের আঙুলগুলোও সব কেটে আলাদা করে ফেললো। হাত থেকে শুরু করে পুরো শরীরে ছুরি দিয়ে গভীরভাবে আঘাত করলো। কিন্তু মেরে ফেলেনি এখনো। উঠে যেয়ে একটা বোয়াম নিয়ে এসে তার ভেতর থেকে মরিচগুঁড়ো বের করে সম্পূর্ণ শরীরে ছিটিয়ে দিল অজানা ব্যক্তিটি। লোকটার আর্তনাদ মুখ বাঁধার পরও হালকা শোনা যাচ্ছে। আর সেই আর্তনাদ শুনে বেশী করে হাসছে অজানা ব্যক্তিটি। এবার লোকটা গলাকাটা মুরগীর মতো ছটফট করছে। বেশ কিছুক্ষণ এই দৃশ্য দেখার পর ছুরির এক আঘাতে লোকটার গলার রগ কেটে ফেললো। কিছুক্ষণের মধ্যেই মারা গেল লোকটি।
প্রথমজনের এই অবস্থা দেখে বাকি প্রফেসরদের অবস্থা এমনিতেই খারাপ হয়ে গেছে।
অজানা ব্যক্তি এবার দ্বিতীয় জনের কাছে এসে ছুরি দিয়ে তার মুখে কিছুক্ষণ স্লাইড করে হঠাৎই ছুরিটা লোকটির চোখে ঢুকিয়ে দিল। লোকটির চাপা আর্তনাদে বাকি একজন চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে দিল। কিন্তু তাদের চিৎকার এই রুমের বাইরে যাওয়ার কোনো উপায় নেই। দুটো চোখ তুলে ফেলার পর অজানা ব্যক্তিটি তার গার্ডদের ইশারা করলো। প্রায় সাথে সাথেই গার্ডরা এসে চেয়ারসহ লোকটাকে তুলে ফুটন্ত গরম পানিতে ছুড়ে ফেললো। দ্বিতীয় লোকটিও পানির ভেতর কিছুক্ষণ ছটফট করার পর মারা গেল।
তৃতীয় লোকটির কাছে এসে তার মুখের উপর এলোপাতাড়ি ছুরি চালাতে লাগলো অজানা ব্যক্তিটি। চেহারা বিকৃত করে ফেলার পর ছুরিটা একদম কপাল বরাবর ঢুকিয়ে দিল। ফলে সেই লোকটিও মারা গেল।
অজানা ব্যক্তি তিনটি লাশের দিকে তাকিয়ে গার্ডদের ডেকে লাশগুলোকে নদীতে ফেলে দিতে বলে চলে গেল।

গোসল করে তাওয়াল দিয়ে মাথা মুছে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এলো স্নিগ্ধ। আসমা বেগমকে নীলামের ছবির সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চমকে উঠলো সে। আজ অনেকদিন পর ছবিটা দেখছে স্নিগ্ধ। তা-ও ওর মা ছবি থেকে পর্দা সরিয়েছে বলে। নাহলে এতদিনে একবারও নীলামের কথা তেমন একটা মনে পড়েনি তার। তবে আজ তার মা-কে এভাবে নীলামের ছবির সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অনেক অবাক হলো স্নিগ্ধ। মায়ের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো সে।
-“হঠাৎ নীলামের ছবি দেখছো যে!”
-“ভাবছি, তুই কি সকাল মায়ের সাথে বিয়ের পরেও নীলামের ছবিটা এখানেই রাখবি?”
-“পাগল তুমি! মিস বিকাল বাচ্চা মেয়ে মা। ও যদি নীলামের ব্যাপারটা জানতে পারে তাহলে অনেক কষ্ট পাবে। আমি চাইলেই নিজের অতীতটা ওকে বলতে পারি। তবে আমি চাইনা বলতে। কারণ এই নয় যে আমি ওর কাছ থেকে নীলামের ব্যাপারটা লুকোতে চাই। বরং, আমি এই জন্য বলতে চাইনা যাতে মিস বিকাল কোনো কষ্ট না পায়। হ্যা আমি ওকে এতটুকু নিশ্চয়ই বলবো যে আমার একটা অতীত ছিল। কিন্তু সেই অতীতে আমি অন্য কারও থাকলেও বর্তমানে আমি শুধু মিস বিকালের। আর আমার বিশ্বাস মিস বিকাল আমার এই কথা শোনার পর আর কোনো প্রশ্ন করবে না।”
-“তাহলে এখনি কেন সরিয়ে ফেলছিস না ছবিটা?”
-“হ্যা খুব শীঘ্রই সরিয়ে ফেলবো, চিন্তা করো না।”
-“বউমা এখন ঠিক আছে? আজকে যা হলো তোদের সাথে! এরপর বউমাকে দেখতে যাওয়া উচিৎ ছিল আমার। কিন্তু আমি একটু ব্যস্ত ছিলাম।”
-“বউ হলো না এখনি বউমা?”
-“হতে কতক্ষণ! আর তো মাত্র কিছুদিন। তারপরেই সকাল মা তোর বউ হবে। আর আমার বউমা। সকাল মা ডাকটা বড় বড় লাগে। তাই বউমা বানিয়ে ফেলেছি ছোট করে।”
-“হ্যা ভালো করেছো। আর সমস্যা নেই। তুমি চাইলে আগামীকাল বিকেলে যেয়ে দেখে আসতে পারো তোমার বউমাকে। ওর ক্লাস কালকে দুপুরেই শেষ হয়ে যাবে।”
-“ঠিক আছে তাহলে কালই যাবো। আর সাথে তুইও যাবি।”
-“যদি হসপিটালে কোনো কাজ না থাকে তাহলে যাবো।”
-“আচ্ছা। আমি নিচে গেলাম, তুই খেতে আয়।”
-“তুমি যাও আমি আসছি।”
আসমা বেগম চলে যেতেই স্নিগ্ধ নীলামের ছবির দিকে তাকিয়ে এক দীর্ঘশ্বাস ফেললো। মলিন হেসে বলতে লাগলো,
-“এতদিন তোমার সাথে দেখা করিনি বলে তুমি রাগ করেছো তাই না! জানি আমি। কিন্তু কি করব বলো! তোমার কথা ভেবে ভেবে এতদিন তো অনেক কষ্ট পেলাম। এখনো পাই। তবে আগের মতো তেমন একটা না। তুমি আমার প্রথম ভালোবাসা হলেও আমি এখন অন্য কারও ভালোবাসায় আসক্ত হয়ে গিয়েছি। জানো ওর নাম সকাল। আমি ওকে মিস বিকাল বলে ডাকি। আমি নিজেও জানি না কীভাবে ওর মায়ায় পড়ে গেছি। ডুবে গেছি ওর মধ্যে। ও নিজে অর্জন করে নিয়েছে আমাকে। মেয়েটা ঠিক তোমার মতো চঞ্চল। কিন্তু দুষ্টুমি তোমার থেকে একটু বেশীই করে। আমাকেও বুড়ো বয়সে ভীমরতিতে পেয়েছে। একটা বাচ্চা মেয়েকে বিয়ে করতে যাচ্ছি। বয়সে তো বাচ্চাই কিন্তু ওর কথাবার্তা শুনলে তুমি বুঝবে ও ঠিক কতটা বাচ্চামি করে। তবে মাঝে মাঝে বড়দের মতো কথা বলতেও জানে। যা শুনে আমি নিজেই অবাক হই। জানি হয়তো আমার কাছ থেকে মিস বিকালের কথা শুনে তোমার খারাপ লাগছে। কিন্তু আমি চেয়েও মিস বিকালকে নিজের মাথা থেকে সরাতে পারিনা। তোমাকে ভালোবেসে কথা দিয়েছিলাম আমি তোমারই থাকবো। কিন্তু তুমি নিজেই কথা রাখোনি। আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছো। তাই নিজের জীবনটাকে নতুন করে নতুনভাবে সাজাতে চাইছি মিস বিকালকে নিয়ে। আমি জানি আমি ওর সাথে ভালো থাকবো। আর তুমি তো এটাই চাইতে সব সময় যাতে আমি ভালো থাকি।”

কথাগুলো নীলামের চোখের দিকে তাকিয়ে বললো স্নিগ্ধ। আজ তার চেহারায় কষ্টের ছাপ নেই; বরং আছে একরাশ প্রশান্তি আর মুখে হাসি। আজ তার চোখে জল নেই; বরং খুশির ঝলক রয়েছে। স্নিগ্ধ মুচকি হেসে ছবির ওপর পর্দা টাঙিয়ে দিয়ে নিচে চলে গেল।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here