#নীল_অপরাজিতা
#পার্টঃ১৩
#Rifat_Amin
সারা বাস জার্নিতে তাদের একদম ঘুম হলো না। বাস থেকে নেমে সোজা বাসায় পৌঁছে গেছে মিষ্টিরা। মাহবুব সাহেব তার ড্রাইভারকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন বাসস্ট্যান্ড থেকে তাদের আনানোর জন্য। গাড়ি থেকে নেমে অভি তার ফোন চেক করলো। মা’য়ের তিনটা মিসকল দেখে বুকটা কেপে উঠলো অভির৷ এত সকাল সকাল তো ফোন দেয়ার কথা না। নিশ্চই কোনো জরুরী বিষয়ে কল করেছে। অভি নিজের ব্যাগ মিষ্টির দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো –
-নিয়ে আয় আমার রুমে।
অভির এমন কান্ডে হতবাক মিষ্টি। সে নিজেও অভিকে দিয়ে ব্যাগটা রুমে পাঠানোর ধান্দা করছিলো। সে বিষ্ময় কন্ঠে বললো-
– আমি কেনো তোর ব্যাগ নেবো? কাল তো খুব ভাব মেরে বললি ‘ আমাকে কি তোর চাকর মনে হয়? ‘। তাহলে আজ আমিও বলতে পারি যে আমাকে কি তোর চাকর মনে হয়?
– দেখ, আমি বলেছি কারণ তার যথেষ্ট কারণ আছে। পুরো ট্যুরটা আমি এ্যারেন্জ করেছি ঠিক আছে? একটা টাকাও তো তুই খরচ করিস নি।
– তুই আমাকে টাকা দেখাচ্ছিস? কত টাকা হয়েছে বল। সব টাকা তোর মুখের উপর ছিটিয়ে দেবো।
অভি আর মিষ্টির এই ঝগড়া মন দিয়ে দেখছে মাহিন। এখানে তার বলার কিছুই নেই। জন্মের পর থেকেই এসব দেখে আসছে সে। তাই সময় নষ্ট না করে সেখান থেকে দৌড়ে উপরে উঠে আসলো। গেম খেলে শান্তি পাইনা অনেকদিন।
ড্রাইভারও এই ঝগড়ায় হতাশ। বাসায় ফিরতে না ফিরতেই শুরু করে দিলো। তিনি অভির দিকে দৃষ্টি রেখে বললেন-
-বাবা তুমি রুমে যাও। আমি ব্যাগ নিয়ে আসছি।
– না আঙ্কেল। আপনি রেস্ট করুন। আমি’ই নিয়ে যাচ্ছি। আসলে অকর্মার ঢেকি’কে দিয়ে তো আর কিছু হয় না। ওরা বসে বসে শুধু গিলতে জানে।
মিষ্টি অভির দিকে চঞ্চল দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো –
– কি বললি তুই? আর একবার বল শুনি?
– অভিরাজ শেখ এক কথা দুইবার বলে না। তার থেকে নিজের কানকে হসপিটালে পাঠিয়ে ঠিক দিস।
অতঃপর মিষ্টিকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই হনহন করে নিজের রুমে চলে অভি। এদিকে মিষ্টি রাগে ফুঁসছে। অগত্যা নিজের ব্যাগটাকে একটা লাথি দিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে নিজের রুমে চলে আসলো সে৷
সৌমিত্র বাস থেকে নেমে একটা রিক্সায় করে মিথিলাকে বাসায় পৌঁছে দিয়েছিল। অতঃপর নিজের বাসায় এসে শান্তিতে সিগারেট টানতে লাগলো। এই কয়েকটা দিন শান্তিতে সিগারেট না খেতে পেয়ে পুরো অস্থির অস্থির লাগছিলো । ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে সকালের সূর্য দেখছে আর সিগারেট টানছে সে। ফোনের আওয়াজ পেয়ে পকেট থেকে ফোন বের করে দেখলো মিথিলা ফোন করেছে। সৌমিত্র ফোন রিসিভ করার সাথে সাথেই ওপাশ থেকে মিথিলা বললো-
– হ্যালো। পৌঁছে গেছো ঠিকমতো?
– হ্যা অনেক আগেই পৌঁছে গেছি। বাসায় কেউ সন্দেহ করে নি তো?
মিথিলা বিছানায় কম্বলের নিচে ঢুকে পরে বললো-
– ওহহ। অনেক আগেই পৌঁছে গেছো অথচ জানাও নি। জানাবা কিভাবে? সব গার্লফ্রেন্ডকে এক এক করে জানাতেই তো ক্লান্ত হয়ে গেছো।
– মিষ্টি তোমার মাথায় কি বিষ ঢালছে বলোতো? সন্দেহ শব্দটা তো দেখি মাথায় একদম সেভ হয়ে গেছে। ডিলেট হওয়ার নাম গন্ধ নাই।
– সত্য কথা বললে এমন কথা সবাই বলে।
সৌমিত্র সিগারেটে শেষ টান দিয়ে মুখ দিয়ে ধোঁয়া ছাড়বে এমন সময় হঠাৎ কাশি উঠে গেলো। কাশির আওয়াজ শুনে ওপাশ মিথিলা চেঁচিয়ে বললো-
– সিগারেট খাইতেছো তাইনা?
মিথিলার কথা শুনে কাশি আরো বেড়ে গেলো যেনো। কলিজায় পানি শুকিয়ে গেছে এই কথা শুনে। সিগারেট খাই এটা জানলো কিভাবে। সেদিন মিষ্টি কি সত্যি সত্যি জানায় দিছে? সর্বনাশ। সৌমিত্র কাশি থামিয়ে নম্রভাবে বললো-
– আরে না। সিগারেট তো খাইনা জান। ওসব কেউ খায়?
– তো কাশি উঠলো কিভাবে? মানুষ হঠাৎ এমন কাশি কেনো দেয় তা কি আমি জানি না?
-আরে এমনি হঠাৎ কাশি উঠে গেলো। খেয়েছো এসে?
– বাহ! ভালোই তো কথা এড়িয়ে চলতে পারো।
– বললাম তো খাইনি। কি করছো?
– শুয়ে শুয়ে চিপস খাচ্ছি। খাবা তুমি? আচ্ছা এসব বাদ দাও, আমি তোমাকে ১ প্যাকেট সিগারেট কিনে দেবো এখন।
আরো কিছুক্ষণ কথা বলে ফোন কাটলো সৌমিত্র। মেয়েটা পুরো জ্বালিয়ে মারলো। বিয়ে করলে দারুণ বিপদে পরে যাবো দেখছি। তখন তো এমনিই বুঝে যাবে আমি সিগারেট খাই। অতঃপর নিজেই নিজের মনকে বুঝালো ‘ ধুর কি ভাবছি আমি? বিয়ে করার পর যা হবার হবে। তখন ধরা খেলেও তো হারানোর ভয় থাকবে না।
সকাল ১১ টা বেজে ১৪ মিনিট। অভি নিজের রুমে বসে পিসিতে গেম ভ্লক ইডিট করছে। এমন সময় মাহিন হাতে ফোন নিয়ে হাজির। তার অভি ভাইকে ভিডিও ইডিট করতে দেখে খুশিতে বাকুম বাকুম হয়ে একটা চেয়ার নিয়ে সামনে বসলো সে। বললো-
– ভিডিও ইডিট করছো ভাইয়া?
অভি পুরো মনোযোগ সামনে রেখেই জবাব দিলো –
– দেখতেই পারছিস। এখন তোর কোনো হেল্প করতে পরবো না। ভাগ এখান থেকে।
অভির শক্ত জবাব শুনে হাস্যজ্বল মুখটা নিমিষেই চুপসে গেলো মাহিনের। সে কপট অভিমানি স্বরে বললো-
– আমি কি শুধু তোমার কাছ থেকে হেল্প নিতে আসি ভাইয়া? আসলে নিজের ভাই হই না’তো। তাই এভাবে বলছো।
– বাহ! ভালোই তো একটিং শিখেছিস রে। তোর বোন শিখিয়েছে বুঝি? আচ্ছা আমি তোর একটিংয়ে খুশি হয়েছি বুঝলি? কি বলবি বল।
– মানে তুমি তোমার ভিডিওর ডেসক্রিপশন বক্সে আমার চ্যানেলের লিংক দিবা শুধু। এটাই বলছিলাম আরকি।
– হয়ে যাবে। আর কিছু বলবি?
গেমের ইডিট দেখে কি বলতে এসেছিলো সেটাই ভুলে গিয়েছিল মাহিন। সে অতিদ্রুত বললো-
– তোমাকে খেতে ডাকছে আপু। তারাতারি ডাকছে। আসো, আমি গেলাম।
বলেই রুম থেকে দৌড়ে বেরিয়ে এলো মাহিন। অভি রুমের দরজা অফ করে উপরের তলায় উঠে গেলো৷ ডাইনিংয়ে একা বসে আছে মিষ্টি। সামনে খাবার সাজানো। মিষ্টি একা একা খাবার নিয়ে খাচ্ছে। অভি একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসলো-
– বুয়া কই রে ? একা একা নিয়ে খেতে পারিস? বাব্বাহ! কাজ করা শিখে গেলি দেখছি। ভালো ভালো।
মিষ্টি অভির কথা শুনেও শুনলো না। কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। মাহিনকে দিয়ে ডেকে পাঠিয়েছি সেই কখন আর এখন আসার সময় হলো রাজপুত্রের। মনে হয় যেনো রাণী এলিজাবেথ এর একাদশ পুত্র। অতঃপর নিজেই ভাবলো একাদশ নাম্বার পুত্র কি তার আছে?
অভি মিষ্টিকে চুপ থাকতে দেখে খাবার খাওয়া শুরু করলো৷ বাঁকাচোখে একবার মিষ্টির দিকে তাকিয়ে বললো-
– কি’রে কথা বলছিস না কেনো? একা একা নিয়ে খেতে পারিস?
অভির খোঁচামার্কা কথা শুনে কি হলো জানি না। হঠাৎ কান্না পেয়ে গেলো মিষ্টির। সাথে রাগ তো আছেই –
– কি করবো? আমার জন্য কি আমার মরা মা উঠে আসবে? শিখতে হবে না?
হঠাৎ কাঁদতে দেখে আর এমন কথা শুনে হতভম্ব হয়ে গেলো অভি। হায়রে, কোথায় একটু জ্বালাবো! সেখানে এখন শান্তনা দেয়া লাগছে।
– আচ্ছা খাওয়ার সময় কথা বলিস না। খেয়ে কথা হবে।
– কেন? চুপ করে থাকবো কেন? তোর তো বাপ-মা সব আছে৷ তুই কি করে বুঝবি মা না থাকলে কেমন লাগে! এখন আর শান্তনা দিতে হবে না প্লিজ। বাবা অসুস্থ! আর এই সময়ে তার মাথায় ভূত নামছে আমাকে বিয়ে দিয়ে বাড়ি ছারা করাবে৷ দে শান্তনা দে।
বলেই কাঁদতে থাকলো মিষ্টি। চোখ দিয়ে অনবরত পানি পড়ছে। কথায় কথায় হিচকি উঠে যাচ্ছে। অভি মিষ্টির কথায় কি বলবে ভাষা যেনো খুঁজে পেলো না। অভি চুপচাপ খেতে খেতে বললো-
– আমার মা কি তোর মা নয়? আমার তো মাঝে মাঝেই সন্দেহ হয় আম্মু আমাকে জম্ম দিয়েছে নাকি তোকে জন্ম দিয়েছে! যাই হোক, আঙ্কেলের সাথে আমি কথা বলবো। তিনি তো সুস্থ ছিলেন। তাহলে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পরলেন’ই বা কেনো? কান্না থামা। চুপচাপ খেয়ে আঙ্কেলের রুমে আয়, কথা আছে।
মিষ্টি কান্না থামিয়ে মাথা নাড়ালো। কিছুটা অপমানিত হলো যেনো। মনে মনে ভাবলো, আমার বয়স যখন ১১ বছর তখন মা মারা গেলেন । তখন আমি সবেমাত্র ক্লাস ৬ এ। সদ্য জন্ম নিয়েছে মাহিন আর তারপর হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পরলেন তিনি। তার কিছুদিনের মাঝেই মারা গেলেন। এক মা’কে হারিয়ে আরেকটা মা ভাগ্যে জুটেছিলো৷ আজ যদি আন্টি না থাকতো তাহলে মাহিনের কি হতো? অভির মা এই বাড়িতেই থাকায় দ্বিতীয় বিয়ে করেন নি বাবা । তখন যদি তিনি বিয়ে করতেন তাহলে হয়তো আজ আমার এই এত স্বাধীনতা থাকতো না। অথচ আন্টি আমাকে নিজের মেয়ের মতো ভালোবেসেছেন। তার একটা মেয়ের শখ ছিলো। সেখানে মিষ্টিকে পেয়ে আর বাচ্চা নেয়ার চিন্তাভাবনাও বাদ দিয়ে দিলেন। সব থেকে বড় কথা মাহিনকে তিনি মানুষ করছেন৷ বাবা অফিসে গেলে সারাটাদিন মাহিনের পিছনে পরে থাকতেন তিনি। নিজের ছেলেকেও অতোটা সময় হয়তো দেননি।
চলবে?