আয়নামতি পর্ব-৩

0
2362

#আয়নামতী
#পর্ব_৩
#পুষ্পিতা_প্রিমা

বিয়ে ভাঙার পর আর বিয়ের কথা তোলার সাহস কারো হয়ে উঠেনি অনুরাগের সামনে। উপরে তাকে দেখতে যতটা ঠান্ডা স্বভাবের দেখায় একবার রেগে গেলে তার উল্টোটা সে। তাই কেউ ভয়ে কিংবা লজ্জায় অমন কথা মুখে আনেনি।
বিয়ে ভাঙার প্রায় দুইমাস পার হয়ে গিয়েছে। শায়খ চৌধুরী একটা মেয়ের খোঁজ পেয়েছেন। যদি ও মেয়েটির খোঁজ আর ও আগেই পেয়েছেন। আনহিতা বারণ করেছেন মেয়েটা সিনেমায় যোগ দেওয়ার কথা ছিল তাই। সিনেমার কাজ খারাপ না শায়খ চৌধুরীর মতে। অমন মেয়ে নিজের পুত্রবধূ করে আনতে পারলে বেশ নাম হবে। কন্যার বাবার বিস্তর টাকা পয়সা। উপঢৌকন দিয়ে ভরিয়ে দেবে, সুনাম তো আছেই। মেয়ে ও যথেষ্ট রূপবতী, সিনেমায় কি এমনি এমনি যোগ দিয়েছে?
অনুরাগের অনুপস্থিতিতে মেয়েটাকে নিয়ে কথাবার্তা চললো বাড়িতে। শায়খ চৌধুরী অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে আনহিতাকে রাজী করালেন কিন্তু আনহিতার মন উপরে সায় দিলেও ভেতরে ভেতরে সায় দিল না। মেয়েটা তার কথা কি শুনবে? কথায় কথায় বাপের বাড়ির টাকার গরম দেখাবে না তো? তার ছেলেকে তার কাছ থেকে দূরে নিয়ে যাবে না তো? ভয় কাজ করলো আনহিতার মাঝে।

কন্যার পিতা বেশ খুশি হলেন চৌধুরী সাহেবের বাড়ি থেকে সম্বন্ধ যাওয়ায়। ছেলে ও শিক্ষিত, সুদর্শন। বনেদী পরিবার। গ্রামের প্রতাপশালী ব্যাক্তি। মেয়ের জন্য আপাতত এর চাইতে ভালো প্রস্তাব আর নেই। তার উপর ছেলে সরকারি চাকরি করে। শিক্ষিত হওয়ায় তার কন্যাকে সিনেমার কাজে বাঁধা দেবেনা। স্বাধীনতা দেবে। যা একজন প্রতাপশালী বিজনেসম্যানের কাছে ও আশা করা যায় না। অতঃপর তারা মেয়ে দিতে রাজী হলো। তবে মেয়ে তাদের মডার্ন। সে ছেলেকে বুঝার জন্য, জানার জন্য সময় চায়। ছবি দেখে সে বিয়ের পিড়িতে বসতে পারবেনা। অন্তত দুই তিনমাস তো সময় লাগবেই তার পাশাপাশি ছেলের সাথে মাঝেমধ্যে দেখা করার সুযোগ দিতে হবে।
শায়লা বেগম এমন কথা শুনে তওবা তওবা করলেন। বিয়ের আগে দেখাদেখি? মেলামেশা? এটা কোনো কথা? এমন অসভ্য মেয়ে তার বাড়ির বউ হবে? তার বাড়ির বউকে হতে হবে পর্দাশীল, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে এমন,কপাল অব্দি ঘোমটা টেনে রাখে এমন, স্বামী ভক্তি করতে হবে, স্বামী সেবা করতে হবে, অন্যথায় দরকার নেই।
শায়লা বেগম বয়স্কা মানুষ। ছেলে আর ছেলের বউ তাকে খুবই মান্য করে চলে। তার কথার উপর কথা বলার সাহস করে উঠতে আজ অব্দি পারেননি। কিন্তু এই কথাটা তারা মানতে পারলেন না। সবাই তো আর মনের মত হয় না।
আজকাল অত সতীসাবিত্রী পাওয়া যায় নাকি? শায়লা বেগম মনঃক্ষুণ্ন হলেন ছেলে আর ছেলে বউয়ের সিদ্ধান্তে। তাই বললেন
‘ ঠিক আছে। ভালো কথা। কিন্তু আমার দাদুভাই কি রাজী হবে? যে বিয়ে করবে তাকে বলেছ? তার মত না নিয়েই এতদূর আগানোর কোনো দরকার ছিল?
শায়খ চৌধুরী বললেন
‘ আমার উপরে কথা বলার স্পর্ধা এখনো ওর হয়নি।
যদিও কথাটা তিনি মনের মাঝে তীব্র সংশয় নিয়ে বললেন। স্পর্ধা তো অনুরাগ অনেকবার দেখিয়েছে। গতবার ভরা বিয়ের আসরে তার মুখের উপর কথা বলেছে। বলেছে
‘ আমি বিয়ে করতে এসেছি, কনে কিনতে নয়। আপনাদের দেনাপাওনার হিসেবে আমার কিছু যায় আসেনা। আমাকে জড়াবেন বাবা।
শায়খ চৌধুরী ভাবলেন ছেলে এবার ও তার মুখের উপর জবাব দেবে? না কি ওই মেয়েকে বিয়ে করতে রাজী হবে?

অনুরাগকে জানানো হলো সপ্তাহ খানেক পর। তার মাঝে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না। অন্যবারের মতো বলল না, আপনাদের পছন্দ আমার পছন্দ।
তবে শায়লা চৌধুরীর সাথে তার বেশি ভাবসাব। তাই শায়লা বেগমকে বললেন
‘ দাদীজান বিয়ে আমি তাকেই করব, যে আমার কাছে দামী, মূল্যবান। যাকে ছুঁতে গেলে শুনতে হয়, বামন হয়ে চাঁদ ছুঁতে এসেছ?
শায়লা বেগম অবাক নাতির মুখে এমন কথা শুনে। তিনি বিস্ময় নিয়ে বললেন
‘ এ কেমন কথা দাদুভাই? এরকম কথা কেউ বলার সাহস করতে পারবে?
চমৎকার করে হাসলো অনুরাগ। বলল
‘ জানিনা। আমি কিচ্ছু জানিনা। তবে এমন একজন তো কোথাও না কোথাও আছেই।
এভরিথিং ইজ পসিবল। নাথিং ইজ ইম্পসিবল দাদীজান।
শায়লা বেগম চুপিসারে বললেন
‘ আমি তোমার সাথে আছি দাদুভাই।
আবার ও চমৎকার হাসলো অনুরাগ। শায়লা বেগম বললেন
‘ বেঁচে থাকো। ভালো থাকো দাদুভাই। সুবাসিনী আসুক তোমার জীবনে,রাঙিয়ে দিক তোমার জীবন । ভালোবাসুক। তুমিও বেসো।
অনুরাগ এই প্রথম একটা খুব সুন্দর শব্দ নিজের মগজের খাতায় লিপিবদ্ধ করে নিল। সেটি হলো ” ভালোবাসা! ”
এটি আবার কেমন ভাষা? খুব কঠিন নাকি খুবই সোজা?
বাংলার চাইতে ও দেখি ইংরেজি খুব সোজা। ইংরেজিতে এর অর্থ লাভ। লাভ এর প্রতিশব্দ বাংলায় আসে অনুরাগ,পছন্দ, আসক্তি,অনুষঙ্গ, প্রণয়,প্রীতি। তারমানে ইংরেজিতেই সহজ। বাংলায় মনে রাখার মতো একটাই যথেষ্ট সেটা হচ্ছে অনুরাগ।

___________

চারার দোকান থেকে চারা কিনতে গিয়েছিল আয়না। সময়টা দুপুর বারোটার দিকে। বিশটা গাঁদাফুলের চারা কিনলো নিজের জমানো টাকায়। বাকিগুলো আয়ানের চাকরিটা হয়ে গেলে সে কিনে দেবে বলেছে। এগুলো আপাততঃ। ভরদুপুরে রিকশা পাওয়া ও দুরূহ। আয়না এদিকওদিক হেঁটে একটি ভ্যানগাড়ি দেখতে পেল। ভ্যানগাড়িওয়ালাকে ডাকতেই ভ্যানগাড়িওয়ালা এল। আয়না বলল
‘ উত্তর পাড়ার দিকে যাবেন? চারাগুলো একা নিয়ে যেতে কষ্ট হচ্ছে তাই। ভাড়া দিয়ে দেব।
ভ্যানগাড়িওয়ালা বলল
‘ পঞ্চাশ টাকা দিলেই যামু।
আয়না ভেংচি কেটে বলল
‘ মারেম্মা আমার তিনটা চারার দামই তো পঞ্চাশ টাকা। পনের টাকা দেব। হবে?
ভ্যানগাড়িওয়ালা বলল
‘ হইবো না।
আয়না বলল
‘ তাহলে যান। লাগবে না। একাই নিয়ে যাব।
ভ্যানগাড়িওয়ালা বিড়বিড় করলো
‘ আমার ভ্যানগাড়ি এমনিতেই ভাঙা। এই মেয়ে ধপাস কইরা পইড়া গেলে আমারে কেলানি দিবো। যাহ বজ্জাত মাইয়্যা, ওইদিন কালু মিয়ার হাত পুড়াইয়া দিল।
আয়না একহাতে চারাগুলো নিয়ে হাঁটা ধরলো। বাজারের দুই থলেতে করে দশটা দশটা নিয়েছে। ভার ও কম না। কিছুদূর গিয়ে আবার থামলো আয়না। আবার থলে দুটো নিয়ে হাঁটা ধরতেই দুটো স্কুলের পোশাক পড়া বাচ্চা ছেলে এসে তাকে ধাক্কা দিল পেছন থেকে। অবশ্য ইচ্ছে করে দেয় নি। তারা দুজন দৌড় প্রতিযোগীতা দিয়ে আসছিল, যে কে কার আগেই ওই থলে হাতে আন্টিকে আগে গিয়ে ছুঁতে পারে। কিন্তু স্বয়ং আন্টিকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেবে এমনটা ভাবেনি তারা। কি হবে এখন? ভয়ে দুজন কাঁচুমাচু করে দাঁড়িয়ে রইলো।
চারাগুলো ছিটকে রাস্তার মাঝখানে পড়ে রয়েছে।

ইটের ঘষা লেগে ছিলে গেল আয়নার হাত। হয়তো পায়ের হাঁটু। বাচ্চাদুটো ভয়ে আয়নাকে তুলতে গিয়ে আবার গুটিয়ে গেল। আয়না নিজের হাতের উপর ভর দিয়ে উঠে বসলো। বোরকা ঝাড়তে ঝাড়তে বলল
‘ এই বাচ্চা তোমাদের সাহস কত? হ্যা? কি করেছ? তোমাদের আমি ছাড়ব না।
বাচ্চাদুটো ভয়ে ভয়ে কাঁদোকাঁদো হলো। আয়না কোমরে হাত দিয়ে বলল
‘ কান ধরো আর উঠবস করো। করো। তোমাদের মা বাবা কোথায়? রাস্তাঘাটে দুষ্টুমি করো ওগুলো দেখেনা? কান ধরো। পঞ্চাশ বার উঠবস করো।
বাচ্চা দুটো কান ধরলো। বলল
‘ আন্টি শুধু বিশবার। কেমন?
আয়না ধমকে বলল
‘ নাহহ। ৫০ বার। করো।
বাচ্চাদুটো উঠবস করতে লাগলো। আয়না কোমরে হাত দিয়ে চেয়ে রইলো। তাদের পাশ দিয়ে একটা গাড়ি শাঁ করে চলে গেল। আয়না গাড়িটাকে উদ্দেশ্য করে বলল
‘ এই বড়লোকের বাচ্চা, এটা কি করে দিলেন? এই ড্রাইভার? আল্লাহ এখন কি হবে? আমার চারা?
আয়না রাগে ফোঁসফোঁস করতে লাগলো। বাচ্চাদুটো উঠবস করা থামিয়ে দিয়ে গাড়িটার দিকে চেয়ে হেসে দিল। গাড়ির ড্রাইভার আয়নার চেঁচামেচি শুনে গাড়ি থামিয়ে দিল। গাড়ি থেকে নেমে আসলো। আয়না ভদ্রলোককে দেখে খানিকক্ষণের জন্য চুপসে গেল।

অনুরাগ তার ভাগিনাকে ডাকল হাত নেড়ে। বলল
‘ অমি উঠবস করছিলে কেন?
আয়না ফুলেফেঁপে দাঁড়িয়ে রইলো। অমি তার পাশের ছেলেটাকে দেখিয়ে বলল
‘ মামা আমরা কম্পিটিশন করছিলাম কে আগে দৌড়ে এসে রাগী আন্টিকে ছুঁতে পারে। কিন্তু আমাদের ধাক্কায় রাগী আন্টি পড়ে গেল। তাই রাগী আন্টি পানিশমেন্ট দিচ্ছে।
অনুরাগ ভুরু কুঁচকে আয়নার দিকে তাকালো। আয়না নাকমুখ ফুলিয়ে বলল
‘ আমার চারা!
আয়নার দুঃখী দুঃখী মুখখানা দেখে অনুরাগের প্রচন্ড হাসি পেল। হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেতে ইচ্ছে হলো। আয়নামতীর আবার মনও খারাপ হয়?
আয়না রাস্তায় পড়ে থাকা চারাগুলো তুলে নিল। আবার রেখে দিল। দেখলো পুরো পিষে গিয়েছে। প্রচন্ড মন খারাপে মেজাজ বিগড়ে গেল তার। নিজেকে শান্ত করে হাঁটা ধরতেই অনুরাগ ডাকলো
‘ শুনুন!
আয়না দাঁড়ালো। তবে পিছু ফিরলো না। অনুরাগ বলল
‘ আমি ইচ্ছে করে করিনি। চারাগুলো সরিয়ে নেওয়া দরকার ছিল। দুঃখিত আমি।
আয়না কথা বলল না। নিজের উপর রাগ লাগছে তার চোখ দিয়ে কেন হুটহাট জল আসেনা? অন্তত কেঁদে কেঁদে রাগ কমানো যেত। জল বেরোনোর বদলে আগুন বেরোচ্ছে যেন৷ অনুরাগ তার কিছুটা পিছু গিয়ে দাঁড়িয়ে বলল
‘ দুঃখিত বলেছি আমি।
আয়না গটগট পায়ে হাঁটা ধরলো। একবার ও পিছু ফিরে তাকালো না। অনুরাগ হতাশ হয়ে তার যাওয়া দেখলো। রাস্তায় পড়ে থাকা চারাগুলো তুলে নিল হাতে। ভালো করে দেখে একটা নিয়ে বলল
‘ এইটা তো ঠিক আছে। বাগানে লাগানো যেতে পারে।

অমি এসে বলল
‘ মামা রাগী আন্টি তো আমার মামিমা হতো তাই না?
অনুরাগ মাথা দুলালো। বলল
‘ পাকনামি রাখো। দুজন গাড়িতে উঠে বসো। আর কক্ষণো একা একা রাস্তা দিয়ে হেঁটে আসবে না। মনে থাকবে?
অমি মাথা দুলালো। তার বন্ধুকে বলল
‘ তানিম তোমাকে তোমার বাড়ির সামনে মামা নামিয়ে দেবে। আসো।
অনুরাগ দুজনকে গাড়িতে বসিয়ে দিয়ে গাড়ি ছাড়লো। অমি বলল
‘ মামা রাগী আন্টি তোমার সাথে কথা বললো না কেন?
অনুরাগ গাড়ি চালানোয় মনোযোগ দিয়ে বলল
‘ রাগী আন্টি দামী মানুষ তাই।

___________

আয়ান বাড়ি ফিরলো দুপুর দুইটার দিকে। বন্ধুর বাবার যে কোম্পানিতে তাকে চাকরি দেওয়ার কথা ছিল সেই কোম্পানিতে নামিরার বাবার শেয়ার আছে। ওখানের চেয়ারম্যান পদে নামিরার ছোট চাচা আছেন অতএব আয়ান সেখানে চাকরি করতে পারবে না। প্রচন্ড হতাশ হয়ে বাড়ি ফিরলো আয়ান। নামিরা তাকে দেখে কল থেকে ঠান্ডা জল এনে বাতাবি লেবুর শরবত করে দিল। বলল
‘ চাকরি হয়ে গেছে?
আয়ান মাথা দুলালো। নামিরা বলল
‘ ওখানে চাচ্চু আছে তাই না?
আয়ান মাথা নাড়লো। বলল
‘ তুমি জানতে?
নামিরা বলল
‘ হ্যা। থাক। বাদ দাও। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে একটা ছাপাখানা দাও। ছাপাখানার অনেক সংকট সেখানে। অনেক ভালো চলবে। তুমি তো ছাপাখানার কাজ পারো।
আয়ান বলল
‘ হ্যা।
নামিরা বলল
‘ বুদ্ধিটা ভালো না?
আয়ান বলল
‘ হ্যা, আমি তো ভেবে দেখিনি।। নামিরা বলল
‘ আমি আজ কলেজ থেকে ফেরার সময় বিষয়টা ভেবে দেখেছি। তুমি পারবে।
আয়ান বলল
‘ ভেবে দেখছি। টুনি কোথায়? তার আওয়াজ শুনিনা কেন?
নামিরা বলল
‘ চারা কিনতে গেল। ফিরে এল খালি হাতে। আম্মা আমি আব্বা অনেক জিজ্ঞেস করলাম কি হয়েছে, কিচ্ছু বলছেনা। থম মেরে বসে আছে।
আয়ান গেল। আয়নাকে ডাকল
‘ টুনি? তোকে আমি চারা কিনে দেব বলেছি নাহ? মন খারাপ করিস কেন? এই টুনি?
আয়না থম মেরে বসে রইলো। আয়ান এসে বসলো তার পাশে। বোনের মাথা ঝাকিয়ে বলল
‘ টুনি মন খারাপ কেন?
আয়না বলল
‘ কোথায় মন খারাপ? এমনি বসে আছি, ভালো লাগছেনা কিছু।
আয়ান বলল
‘ চারা আমি কিনে দেব। ছাপাখানা দেব একটা।
আয়না তাকালো ভাইয়ের দিকে।
‘ ছাপাখানা দিতে গেলেও তো টাকা দরকার।
আয়ান বলল
‘ মিরার গয়না গুলো বন্ধক রেখে সরঞ্জাম কিনব।
আয়না বলল
‘ শুধু গয়না গয়না। আর কোনো কথা নেই। ভাবিকে একটা শাড়ি ও তো দিতে পারলে না এখনো। শুধু তার গয়না নিয়ে টানাটানি।
আয়ান বলল
‘ দেওয়ার জন্যই তো ছাপাখানা দিচ্ছি। মিরার যাহ, আমার ও তা। আমার যাহ, মিরার ও তা।
আয়না মাথা রাখলো ভাইয়ের কাঁধে। বলল
‘ আমার চারা!
আয়ান হেসে দিল। বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল
‘ আমি কিনে দেব বলেছি না?

_______

টিনের একটি দরজা আয়নাদের বাড়িতে ঢুকার আগে। তারপর উঠোন,বাগান, তারপরেই ঘর। মাগরিবের আজানের সময় হয়েছে ইতোমধ্যে। টিনের দরজাটিতে টংটং আওয়াজ হওয়ায় ঘর থেকে বের হয়ে এল আয়না। ওড়না ভালো করে মাথায় পেঁচিয়ে উঠোন পেরিয়ে টিনগেইট খুলে দিল। দেখলো একটি প্রকান্ড ভ্যানগাড়ি। পুরো ভ্যানগাড়িতে সব চারা আর চারা, সাথে কন্দ।
আয়না ভ্যানগাড়িওয়ালার দিকে তাকিয়ে বলল
‘ এগুলো কাদের?
ভ্যানগাড়িওয়ালা বলল
‘ আয়নামতী কার নাম?
আয়নার কপালে ভাঁজ পড়লো। সে বলল
‘ আমার।
লোকটা পকেট থেকে একটা কাগজ বের করলো। আয়নার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল
‘ এইডা আপনারে ছোডসাহেব দিতে কইছে। আর চারা আর কন্দগুলো আপনার বাড়ির উঠোনে রাখতে কইছে।
আয়না হা করে দাঁড়িয়ে থাকলো। কিছুক্ষণ পর বলল
‘ আমি কেন এত চারা নেব? দাঁড়ান। ওগুলো নামিয়েন না।
লোকটা বলল
, আপনার প্রশ্নের উত্তর ওই ছেঁড়া কাগজটাতে আছে কইছে ছোডসাহেব।

আয়না কাগজটার দিকে তাকালো। কাগজটা মেলতেই গুটিগুটি অক্ষরে লেখা দেখলো। সে মনোযোগ সহকারে পড়লো কাগজটি। তাতে লেখা,

‘ আয়নামতী “আমি আপনাকে চারা দিলাম, আপনি আমাকে ফুল দেবেন। চৌধুরী বাড়ির ছেলের বিয়েতে অনেক ফুলের দরকার পড়ে। জানেন তো? তখন না হয় ফুল দিয়ে ঋণ শোধ করে দেবেন।

আয়না কাগজটা হাতের মুঠোয় মুচড়ে নিল। সে এখন আম্মা আব্বা আর ভাবিকে কি বলবে?
ভ্যানগাড়িটা থেকে দু তিনশত চারা নামালো লোকটা। গাঁদাফুলের চারা আর রজনীগন্ধার কন্দ । আয়শা বেগম আর নামিরা এসে অবাক হয়ে বলল
‘ এগুলো কোথা থেকে?
আয়না বলল
‘ আম্মা আমি ধার করেছি একজনের কাছ থেকে। ফুল দিয়ে শোধ করে দেব বলেছি।
আয়শা বেগম বিস্ময় নিয়ে বললেন
‘ যদি ফুল না ধরে হারামজাদি? তোকে এত পন্ডিতগিরি দেখাতে কে বলেছে?
আয়না কাঁচুমাচু করলো। তারপর ঘরে চলে গেল। খাতা কলম নিয়ে বিরাট বিরাট গালি লিখল । তারপর লিখে নিজে নিজে পড়লো। তারপর আবার ছিঁড়ে ফেলল। এর চাইতে ও সুন্দর সুন্দর গালি দেওয়া দরকার। কিন্তু সে সুন্দর সুন্দর গালি পারে না। তাই আর লিখলো না। সুযোগ পেলে সামনাসামনি দিয়ে দেবে। সে যাইহোক চারা আর কন্দগুলো লাগানোর জন্য মাটি যোগাড় করে নিতে হবে। ফুল না আসলে ও পিটিয়ে পিটিয়ে ফুল আনতে হবে নইলে আয়না শেষ। আয়না থেকে সে আয়নামতী হয়ে যাবে। না না আয়নামতী হওয়া যাবেনা।
লোকটা চলে গিয়েছে কিনা দেখতে গেল আয়না। দেখল চল যাবে এক্ষুণি। সে গিয়ে বলল
‘ একটু দাঁড়ান। আমি এক্ষুণি আসছি।
ভ্যানগাড়িওয়ালা দাঁড়িয়ে থাকলো। আয়না ঘরে গেল। কি কি যেন লিখে লোকটার হাতে দিয়ে বলল
‘ দিয়ে দেবেন।
লোকটা বলল
‘ জ্বি আপা দিমুনে।

লোকটা চৌধুরী বাড়িতে এল। অনুরাগ তাকে দেখে বাইরে বের হয়ে এল। বলল
‘ কিছু বলেছে?
লোকটা কাগজটা দিয়ে বলল
‘ আপা এইডা দিছে ছোডসাহেব।
অনুরাগ কাগজটি নিয়ে নিল। বলল
‘ আচ্ছা আপনি যান।
লোকটা চলে গেল। অনুরাগ কাগজটি খুলে পড়লো

‘ আর জীবনে যদি আয়নামতী ডাকেন, আপনার খবর আছে বেকুব পুরুষ মানুষ।

অনুরাগ আচমকা আওয়াজ করে দিয়ে হেসে দিল।
তারপর ঘরে গিয়ে কলম খাতা নিয়ে লিখলো।
‘ ডাকব। সেই অপরাধে ফুল না দিয়ে নাহয় ফুলের কাঁটা দেবেন। আমি নিতে রাজী আছি ” আয়নামতী “।

চলবে,,
টাইপিং মিসেটক থাকিতে পারে পাঠক।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here