আয়নামতি পর্ব-৭

0
1848

#আয়নামতী
#পর্ব_৭
#পুষ্পিতা_প্রিমা

সূর্য হেলে পড়ছে পশ্চিমাকাশে। পাখিদের তখন নীড়ে ফেরার তাড়া। হাঁটুরে যাচ্ছে হাঁটে। রাস্তায় দু একটা রিকশা যাচ্ছে। আয়ানের হাতের মুঠোয় নামিরার হাত। রিকশা ডাকতেই রিকশাওয়ালা এল। জিজ্ঞেস করল
‘ কই যাইবেন?
আয়ান বলল
‘ শেখ বাড়ির দিকে যাব। যাবেন?
রিকশাওয়ালা বলল
‘ হ যামু। আপনে কি শেখ বাড়ির জামাই?
আয়ান নামিরার দিকে তাকালো। পরে বলল
‘ জ্বি।
রিকশায় উঠে বসলো দুজন। আয়ান রিকশার হুড নামিয়ে দিল। বলল
‘ মিরা, চাইলে নিকাব খুলে ফেলতে পারবে। কেউ দেখবে না।
নামিরা মাথা নাড়ালো।
‘ না না। খুলবো না। খারাপ লাগছেনা।
আয়ান বলল
‘ ঠিক আছে।
নামিরা তার অন্য হাত রাখলো আয়ানের হাতের উপর। বলল
‘ আমার ভয় লাগছে আয়ান। বাবা যদি তোমাকে কিছু বলে?
হাসলো আয়ান। বলল
‘ আবার ভয়? তুমি কি বাচ্চা মিরা? আর তাছাড়া বলবে না কেন? আমি উনার মেয়েকে তো রাজরানী করে রাখতে পারিনি।
নামিরা কড়া গলায় বলল
‘ কি বলছ এসব? বাবা বলার আগে তুমি নিজেই এসব বকবক করতে থাকো। আমি কি কখনো বলেছি আমি অসুখী? আমি ভালো নেই। বলেছি?
মৃদু হাসলো আয়ান। বলল
‘ আচ্ছা ঠিক আছে। বলব না আর।
নামিরা রেগেই থাকলো। আয়ান বলল
‘ রাগ কেন মিরা? আমাদের তো অনেকদিন দেখা হবে না। এসময় রাগ করা শোভা পায়?
নামিরা তাকালো আয়ানের দিকে। বলল,
‘ কয়দিন দেখা হবে না?
আয়ান বলল
‘ এইতো বেশিদিন না। তোমাকে আমি নিজে গিয়ে নিয়ে আসব। চিন্তা করো না তো ওসব নিয়ে। যতদিন ওখানে থাকো ততদিন সবার সাথে হাসিখুশি থেকো।
নামিরা তার বাহু জড়িয়ে ধরলো। কাঁধে আলতো করে মাথা রেখে বলল
‘ আম্মা আসার সময় কি বলেছে জানো? বলেছে, শোনো বউ যাচ্ছ যাও। কিন্তু মনে রেখো এটাই তোমার ঘর, এটাই তোমার বাড়ি। বাপের বাড়ি বেশিদিন থাকতে নেই। তাড়াতাড়ি চলে আসবে। আমার এখনো অমন খারাপ অবস্থা হয়নি যে ছেলের বউকে বাপের বাড়ি রেখে আসতে হবে৷
কথাটা বলেই নামিরা হাসলো। আয়ান ও হাসলো। বলল
‘ আম্মা ভালো কথা ও কড়া করে বলে।
নামিরা বলল
‘ আমি বুঝে গেছি আম্মাকে। চিনি ও। আর এটাও বুঝে গেছি, আমি সত্যিই সত্যি একটা ভালো সংসার পেয়েছি।
আয়ান শক্ত করে তার হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিল। হাতের উল্টো পিঠে বিশ্বাস, ভরসা, আস্থা, ভালোবাসা এঁকে দিয়ে বলল
‘ মিরা কাঠফাটা রোদেলা একটা দিনে তোমার সাথে আমার প্রথম দেখা হয়েছিল কলেজের বারান্দায়। মনে আছে তোমার?
নামিরা ছোট্ট করে আওয়াজ করল
‘ হুহ।
আয়ান বলল
‘ তুমি আচমকা কোথা থেকে এসে জিজ্ঞেস করে বসলে, শুনুন ১ম বর্ষের ক্লাসরুমটা কোথায়?
আমি হঠাৎ চমকালাম। কারণ, আমাদের ক্লাসের কোনো মেয়ের সাথে ও আমি কখনো কথা বলিনি। আসলে জমতো না। একরোখা ছিলাম প্রচন্ড। পরে দেখলাম এ মেয়েটা তো ১ম বর্ষের। তাই দেখিয়ে দিলাম রুমটা।
নামিরা বলল
‘ যাহ। আর বলবে না ওসব। ওগুলো মনে পড়লেই আমার কেমন জানি লাগে। ভয় করে।
আয়ান হেসে উঠলো উচ্চস্বরে। বলল
‘ আবার ও ভয়?

শেখ বাড়িতে পৌঁছাতেই রিকশা থেমে গেল। বাড়ির সামনের গেইটে দাড়োয়ান দাঁড়ানো। নামিরাকে আর আয়ানকে দেখে ছুটে বাড়ির ভেতর চলে গেল। হন্তদন্ত এলোমেলো পায়ে হেঁটে কিংবা দৌড়ে ছুটে এল নামিরার মা নাজমা বেগম। নামিরাকে দেখে শাড়ির আঁচল টেনে মুখে গুজলো। কেঁদে দিল। নামিরা মাকে দেখে থমকে দাঁড়ালো। মায়ের ভেজা চোখ দেখে ভিজে উঠলো তার চোখ ও। মায়ের দিকে এগিয়ে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করার আগেই নাজমা বেগম জড়িয়ে ধরলো মেয়েকে আষ্টেপৃষ্টে। মুখটা দুহাতের আজলে ধরে চুমু আঁকলো অসংখ্য। নামিরা মায়ের মুখ মুছে দিয়ে বলল
‘ কেমন আছ মা?
নাজমা বেগম কাঁদতে কাঁদতে বললেন
‘ তোর এখন আসার সময় হলো? মাকে দেখতে ইচ্ছে করেনা তোর। পরের ছেলে পেয়ে আমাদের ভুলে গেলি কি করে?
নামিরার জমানো অভিমান উপচে পড়লো। বলল,
‘ বিয়ে দিলে মা। বিয়ের পর দিন ও গেলে না কেউ। আমি ভাবলাম পরে যাবে। তারপরও গেলে না। তোমরা তো আমার খোঁজ নাওনা মা। বাবা ও নেই না। বাবা এই গ্রাম ওই গ্রামে কতদিকে যায়। অথচ নিজ গ্রামের ভেতরেই নিজের মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে যেতে পারেনা। বিয়ে দিয়ে দিয়েছ তাই কি পর হয়ে গেলাম মা?
আয়ান এগিয়ে গেল। নামিরাকে বলল
‘ মিরা এসব কথা থাক না।
নাজমা বেগম তাকালো আয়ানের দিকে। আয়ান সালাম করলো। নাজমা বেগম মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল
‘ বেঁচে থাকো। ভালো থাকো বাবা। আসো বাড়িতে।
আয়ান বলল
‘ নাহ। আমি যাব না। আমার একটু কাজ আছে।
নামিরার মা বলল
‘ নাহ। এখন যেওনা। থাকো না বাবা ?
আয়ান নামিরার দিকে তাকালো। বলল
‘ মিরা,,
নামিরা কিছু বলতে দিলনা।
নাজমা বেগম যেতে যেতে বলল
‘ আয়। আয়। আমি তোর বাবাকে ফোন করে বলি।
নামিরা আয়ানের হাত থেকে ফলমূল আর ব্যাগটা নিয়ে যেতে যেতে বলল
‘ আসো। আজ থেকে যাবে।
আয়ান জোরে ডাকল
‘ মিরা?
নামিরা ফিরলো। আয়ান হেঁটে তার সামনে গিয়ে বলল
‘ এমনটা কথা ছিল না মিরা। আমি যাব না।
নামিরার দুচোখ ছলছল করে উঠলো। আয়ান বলল
‘ মিরা আমি আসব তো। কিন্তু এখন না।
নামিরা রেগে বলল
‘ যাও। বাঁধা দেব না। যাও না।
আয়ান বলল
‘ আচ্ছা আচ্ছা। ঠিক আছে। যাচ্ছি। কিন্তু থাকব না আমি। বলে রাখলাম।
নামিরা কিছু বলল না।

সন্ধ্যায় ফিরল নাওয়াজ শেখ আর নওফুজ শেখ। আয়ানকে দেখলো। আয়ান সোফায় বসা ছিল। নামিরা আসলো। নাওয়াজ শেখ মেয়ের দিকে তাকিয়ে আবার চোখ ফিরিয়ে নিল। নওফুজ শেখ বলল
‘ নামিরা কখন এলে?
নামিরা এগিয়ে গেল। বাবা চাচার পা ছুঁয়ে সালাম করলো। বলল
‘ এইতো আছরের আযানের পর।
নওফুজ শেখ বলল
‘ আচ্ছা। সবার জন্য চা নিয়ে এসো।
নামিরা মাথা দুলালো। আয়ানের দিকে তাকিয়ে বলল
‘ আয়ান বাবা আর চাচ্চু।
আয়ান দাঁড়িয়ে পড়লো। আঁড়চোখে নাওয়াজ শেখের দিকে তাকালো। তারপরেই চোখ ফিরিয়ে নিয়ে বলল
‘ আমাকে যেতে হবে মিরা।
নওফুজ শেখ বলে উঠলেন
‘ ভারী বেয়াদব ছেলে তো। একটা সালাম দেওয়ার ও প্রয়োজন মনে করলে না। এই তোমার মা বাবার শিক্ষা?
আয়ান তীক্ষ্ণ চোখে তাকালো। নামিরা গিয়ে দাঁড়ালো আয়ানের পাশে। হাতটা ধরে বলল
‘ আয়ান চলো আমার ঘরে।
আয়ান হাতটা ছাড়িয়ে নিল। নওফুজ শেখের উদ্দেশ্যে বলল
‘ সালাম? আপনি সালামের মর্ম বুঝেন? সালাম শুধু একটা ফর্মালিটি নয়। আমি সালাম দিলে আপনি নিতেন?
নওফুজ শেখ হেসে উঠলেন উচ্চস্বরে। বললেন
‘ কেন নিতাম না?
ঠোঁট বাঁকা করে হেসে উঠলো আয়ান। বলল
‘ তাহলে চাকরি খুঁজতে গিয়ে যখন আপনাকে সালাম দিয়েছিলাম তখন কেন বলেছিলেন ছোটলোকদের সালাম আপনি পায়ে ঠেলে দেন।
‘ ছোটলোক এটা তাহলে স্বীকার করছ?
নাওয়াজ শেখ বিরক্তিসূচক শব্দ করলেন। বললেন
‘ নওফুজ তুই যাহ ঘরে।
নওফুজ শেখ ধারালো চোখে আয়ানকে দেখে চলে গেল। আয়ান বলল
‘ আমি আসছি মিরা।
নাওয়াজ শেখ বললেন
‘ দাঁড়াও।
নামিরা ভয়ে ভয়ে ঢোক গিলল। আয়ান দাঁড়ালো। নাওয়াজ শেখ বলল
‘ নামিরা তুমি উপরে যাও।
নামিরা ভয়ে ভয়ে বলল
‘ বাবা আমি,
নাওয়াজ শেখ গর্জন করে বললেন
‘ কথা একবারের চাইতে দুইবার বলতে পছন্দ করিনা আমি।
নামিরা আয়ানের দিকে তাকালো ভেজা চোখে। আয়ান চোখ সরিয়ে নিল। নামিরা অনিচ্ছা স্বত্ত্বেও চলে গেল। কিন্তু আড়ালে দাঁড়িয়ে চোখ রাখলো আয়ান আর বাবার উপর।
নাওয়াজ শেখ সোফায় বসলেন। আয়নাকে বললেন
‘ বসো।
আয়ান বসলো না। বলল
‘ আমাকে যেতে হবে। যা বলার তাড়াতাড়ি বলুন।
‘ কি করছ আজকাল? শুনেছি ছাপাখানা দিয়েছ।
আয়ান সরাসরি বলল
‘ জ্বি। আমার তো আর ঘুষখোর মামা চাচা নেই যে সরকারি চাকরি দেবে।
নাওয়াজ শেখ নিজেকে শান্ত রাখলেন। বললেন
‘ ছাপাখানা দিতে টাকা কোথায় পেয়েছ?
নামিরা দৌড়ে এল। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল
‘ বাবা ওর বড় খালাম্মার স্বামীর কাছ থেকে ধার নিয়েছে।
নাওয়াজ শেখ বললেন
‘ তুমি কেন এলে? তোমাকে কে বলতে বলেছে? যাও।
নামিরা আবার চলে গেল। আয়ান বলল
‘ নামিরার গয়না বন্ধক দিয়েছি।
নাওয়াজ শেখ হেসে ফেললেন। বললেন
‘ তাই নাকি? বাহ। দারুণ কাজ করেছ।
আয়ান সরু চোখে তাকালো। নাওয়াজ শেখ বললেন
‘ এমএল কোম্পানিতে চাকরি নাওনি কেন? বার হাজার বেতন ছিল।
আয়ান বলল
‘ ইচ্ছে হয়নি।
‘ ইচ্ছে হয়নি? নাকি নওফুজকে দেখে?
আয়ান বলল
‘ জানেন যখন আবার জিজ্ঞেস করছেন কেন?
নাওয়াজ শেখ বললেন
‘ সংসার চলে কিভাবে? তোমার আব্বা তো পঙ্গু। টাকা কোথায় পাও? নাকি চুরিচামারি করো?
আয়ানের আত্মসম্মানে তীব্র আঘাত হানলো যেন। নামিরা আবার ছুটে এল। বলল
‘ বাবা এভাবে কথা বলছ কেন? ও চুরিচামারি কেন করবে?
নাওয়াজ শেখ ধমকে বললেন
‘ চোপ। তুমি আমার মুখে মুখে তর্ক করতে এসেছ?
আয়ান বলল
‘ মিরা।
নামিরা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। নাজমা বেগম আর নওফুজ শেখের স্ত্রী হামিদা বেগম চলে আসলেন। নামিরাকে নিয়ে গেলেন। আয়ান বলল
‘ আপনি কি আমাকে অপমান করার জন্য দাঁড় করিয়েছেন?
নাওয়াজ শেখ বলল
‘ কোনটা অপমান? সত্যি বললে তুমি এত অপমানবোধ করো কেন? আমার মেয়েকে বিয়ে করে কি কি দিয়েছ তুমি? চেহারাটা দেখেছ ওর? কোথায় আগের নামিরা কোথায় এখনকার নামিরা? শুকিয়ে গেছে মেয়েটা। আর গায়ে এটা কি ধরণের শাড়ি? আমি এরকম কাপড়চোপড় কখনো পড়িয়েছি আমার মেয়েকে? তোমার মনে হচ্ছে না তুমি শেষ করে দিয়েছ ওর জীবনটা। খাইয়ে দাইয়ে আদর যত্ন করে বড় করেছি কি ওই কুঁড়েঘরে পড়ে থাকার জন্য?
আয়ান বলল
‘ আর কতবার কথাগুলো বলবেন? বিয়ের আগে ও একবার বলেছেন। তাছাড়া সব জেনেশুনেই তো বিয়ে দিয়েছেন।
‘ বাধ্য হয়ে দিয়েছি। বাধ্য। বাধ্য। নাহলে এত ছোটলোকদের সাথে সম্পর্কে জড়ায় কে?
আয়ান গটগট করে হেঁটে বের হয়ে গেল বাড়ি থেকে। নামিরা ভাই নাবিল আয়ানকে দেখে দৌড়ে গেল। বলল
‘ ভাইয়া চলে যাচ্ছেন কেন? আজকে থাকেন ৷
আয়ান হাসলো মৃদু। মাথা চাপড়ালো। বলল
‘ ইনশাআল্লাহ থাকব একদিন। তবে আজ না।
নাবিল মাথা দুলিয়ে চলে গেল। আয়ান বাড়ির গেইট পেরোনোর আগেই নামিরার গলার আওয়াজ শোনা গেল। আয়ান পিছু ফিরলো। নামিরা দ্রুত পায়ে দৌড়ে এসে ঝাপটে পড়লো তার বুকে। এলোমেলো সুরে কেঁদে দিল।
আয়ান হাত রাখলো তার মাথায়। বলল
‘ মিরা শুধু শুধু আমাকে থাকতে বললে।
নামিরার কান্না থামে না। আয়ান তার মুখ তুললো। চোখের পানি মুছে দিতে দিতে বলল
‘ আসি। ভালো থেকো।
নামিরা আবার শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। বলল
‘ নাহ।
আয়ান বলল
‘ আমি নিয়ে যেতে আসব। ছাড়ো। দারোয়ান আছে।
নামিরা ফোঁপাতে ফোঁপাতে মুখ তুললো। আয়ান দুই হাতের বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে মুখ মুছে দিল। সাথে আবার ভিজলো দুগাল। আয়ান বলল
‘ তোমার বাচ্চামো গেল না মিরা।
নামিরা বলল
‘ আমার জন্য তোমাকে কটু কথা শুনতে হয়। আমি তোমার জীবনে না আসলে এমনটা হতো না।
আয়ান বলল
‘ একদম না। তুমি আমার জীবনে বা আসলে আমি এত ভালোবাসা কোথায় পেতাম? এই ছোটলোকদের ভালোবাসার জন্য অনেক বড় মনের দরকার পড়ে মিরা। কয়জনের আছে?
নামিরা আবার ও জড়িয়ে ধরলো তাকে। আয়ান নিজেকে ছাড়িয়ে নিল। নামিরার ললাটে দীর্ঘ চুম্বন করে বলল
‘ ভালো থেকো মিরা। কোনো চিন্তা না। হ্যা? আমি নিয়ে যেতে আসব।
নামিরা এদিকওদিক তাকিয়ে আবার ও শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো তাকে। মুখ তুলে আয়ানের মাথা নিচে নামিয়ে এনে কপালে চুমু খেল দীর্ঘসময় ধরে। গলা জড়িয়ে ধরে মুখের সাথে মুখ লাগিয়ে বলল,
‘ আমি অপেক্ষায় থাকব শ্বশুরের ছেলে।
আয়ান হাসলো। নামিরার মুখ তুলে বলল
‘ এবার হাসো তাহলে।
নামিরা হাসার চেষ্টা করলো। ব্যর্থ হলো। হাসতে গিয়ে আবার কেঁদে দিল।
আয়ান বের হয়ে গেল তাকে রেখে । আবার পিছু ফিরে নামিরাকে দেখল। বলল
‘ আল্লাহ হাফেজ মিরা৷
নামিরা শাড়ির আঁচল টেনে মুখে দিল। চোখমুখ মুছতে মুছতে ভার গলায় বলল
‘ আল্লাহ হাফেজ।

_______________

বাড়ির সামনের উদ্যান থেকে চেঁচামেচি ভেসে আসছে। আনহিতা আর অনিমা ভ্যাবাছ্যাঁকা খেল। অনিমা বলল
‘ মা ভাইয়ের গলা না? আবার কি হয়েছে?
আনহিতা চলে গেল বাইরে। দেখলো অনুরাগকে। পায়ে গোড়ালির উপর তোলা প্যান্ট, হাতে পানির জার। মালিকে ভীত দেখাচ্ছে। আনহিতা আর ও কাছে গিয়ে বুঝার চেষ্টা করলো। অনুরাগের গলা ভেসে এল।

‘ চারাগাছে পানি দিতে হয় সকাল আর সন্ধ্যায়। বেলা দশটায় কেউ চারাগাছে পানি দেয়? না জানলে শিখে নেবেন। উল্টাপাল্টা কাজ করে চারা নষ্ট করেন।

আনহিতা আর ও একটু কাজে গিয়ে ডাকল অনুরাগকে।

‘ কি হয়েছে সোহাগ? রাগারাগি কেন?

অনুরাগের মাকে দেখে শান্ত হয়ে গেল। পানির জার রেখে দিয়ে বের হয়ে এল বাগান থেকে। জুতো পায়ে দিয়ে প্যান্ট নামালো। তারপর মায়ের কাছে এসে বলল

‘ মালির সাথে কথা বলছিলাম। আর কিছু না।

আনহিতা বলল

‘ সে ঠিক আছে কিন্তু তোমাকে যে ছবি দিয়েছিলাম। দেখেছ?

অনুরাগ বলল

‘ নাহ দেখিনি। কেন দেখব?

আনহিতা বলল

‘ ওমা দেখবেনা? কি সুন্দর মেয়ে তুমি জানো? তোমার মতামতের অপেক্ষায় আছি আমরা। বিয়েটা করিয়ে দিতে পারলেই শান্তি আমাদের।

অনুরাগ বলল

‘ আচ্ছা। দেখে জানাবো। এবার ও কি পণ নিচ্ছ?

আনহিতা না না করে উঠলো। বলল

‘ না না। নিচ্ছি না। ওরা খুশি হয়ে যা দেবে আর কি আমি তো একদম কিছু না নেওয়ার জন্য বলেছি তোমার বাবাকে।

অনুরাগ মাথা দুলালো। বলল

‘ ঠিক আছে। তাহলে ছবি দেখার দরকার কি? তোমাদের পছন্দ আমার ও পছন্দ।

আনহিতা খুশিতে ছেলেকে ঝাপটে জড়িয়ে ধরলো ৷ ছেলের কপালে আদর এঁকে দিয়ে বলল

‘ এজন্যই তুমি আমার সোহাগ। আমি তোমার বাবাকে বিয়ের তারিখ ফেলতে বলছি।

অনুরাগ হাসলো মায়ের সাথে। আনহিতা বলল
‘ তাও। একটা ছবি আমি তোমার বালিশের নিচে রেখে চলে এসেছি৷ একটু দেখে নিও। হ্যা?
অনুরাগ বলল
‘ আচ্ছা।

অনুরাগ চলে গেল ঘরে। হাত পা ধুয়ে নিল। গায়ের শার্ট পাল্টানোর সময় খেয়াল হলো ছবির কথা। বালিশ সরাতেই দুই কোণায় দুইটা উল্টো হয়ে থাকা ছবি দেখলো। দুইটা হাতে নিল। একটা কলমদানিতে রেখে দিয়ে অপরটি সোজা করে দেখতেই ঠোঁটে চওড়া হাসির দেখা মিলল। ছবিটা দেখেই সে আওড়ালো।
‘ আরেহ আয়নামতী যে! আপনাকেই কেন রোজ রোজ আমার চোখে পড়তে হয়? আপনি আমাকে দেখেন না অথচ আমি আপনাকে দেখি। ” আয়নামতী ” আপনিই বলুন ব্যাপারটা কেমন না? সে যাইহোক শীঘ্রই ফুল পাঠিয়ে দেবেন। চৌধুরী বাড়ির ছেলের বিয়ে অতিনিকটে।

________

ফজলু মিয়ার বাগান বাড়ির পশ্চিম দিকে মোটা আম গাছটার একটা রশি ঝুলিয়ে বাঁধা দোলনা। সেখানে চড়তে চড়তে আয়না বাগান পর্যবেক্ষণ করছে। সব কাজ শেষ। এবার অপেক্ষা কখন কুঁড়ি গজাবে। হাজার হাজার ফুল ফুটবে। রেণু পেছন থেকে জোরে ধাক্কা দিয়ে বলল
‘ আপা একশ হইলে আমি চড়ুম।
আয়না বলল
‘ না না দুশো দুশো৷ কেমন?
রেণু খিক করে হেসে ফেলল। বলল
‘ বিশ পঞ্চাশ করতে করতে দুশোতে চলে আসলা? হইবো না। তুমি নামবা।
আয়না বলল
‘ নাহ নাহ দুশোবার।
রেণু তার কথা শুনে হাসলো। রহমত মিয়া এল। কাঁধে কোদাল তার। পড়নে লুঙ্গি। মাথায় গামছা বাঁধা। আয়না ডাকল
‘ ভাইজান আমাকে খুঁজতেছেন?
রহমত মিয়া গলার আওয়াজ অনুসরণ করে এগিয়ে আসলো। আয়নার কাছে এসে বলল
‘ আপা ছোডসাহেব কত ফুল পাইবে?
আয়না দোলনা থামিয়ে দিয়ে বলল
‘ কেন?
‘ ছোডসাহেবের লগে বউ ঠিক হইয়্যাছে। কইছে শিগগির ফুল পাঠাইতে।
আয়নাকে চিন্তিত দেখালো। বলল
‘ কিন্তু ফুল ধরতে তো এখনো অনেক দেরী। তাছাড়া আমার বাড়ির আশেপাশে যা আছে তা তো অল্প। উফফ উনি বিয়ে করার আর সময় পেলেন না?
রহমত মিয়া বলল
‘ ফুল ফুটেনি এইডা তাইলে বইলা আসি।
আয়না বলল
‘ আমার কাছে তো আর টাকা ও নেই। ইতোমধ্যে ধার করেছি পাশের বাড়ির চাচীর কাছ থেকে। টাকা থাকলে ফুল কিনে পাঠিয়ে দিতাম।
রহমত বলল
‘ আইচ্ছা আমি ছোডসাহেবরে বুঝাইয়া কমু।
আয়না বলল
‘ ইশশ এই মোক্ষম সুযোগ ছিল ঋণ শোধ করে দেওয়ার।
রহমত মিয়া বলল
‘ আইচ্ছা আমি গিয়া কইয়া আসি।
আয়না মাথা দুলালো। চার পাঁচদিন পার হলো।
আলসে দুপুরের কাঠফাটা রোদের মাঝে নেয়েঘেমে রহমত মিয়া এল আয়নার বাড়িতে। হাতে একটা কাগজ। আয়নাকে দিল রহমত মিয়া।
আয়না কাগজ খুলে পড়লো।
‘ ‘ আয়নামতী ‘ আপনার বাগানের ফুল আসা পর্যন্ত বিয়ে স্থগিত রইলো।
আয়না উচ্চস্বরে হেসে উঠলো আচমকা। সবাই চেয়ে রইলো তাকে হতভম্ব চোখে।
আয়শা বেগম ভাবলো হায়হায় কি হলো মেয়েটার?

চলবে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here