#আয়নামতী
#পর্ব_১৯
#পুষ্পিতা_প্রিমা
স্টেশনের কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই পায়ের কাছে এসে পড়লো কারো পানের পিচকিরি। আয়না দ্রুত পা সরিয়ে নিল। বিরক্তি নিয়ে বলল
‘ এসব ফেলার আর জায়গা পায় না মানুষ।
বাসে ঠেলাঠেলি করে লোকজন উঠা শুরু করেছে।
আয়না কোনোমতেই সুযোগ পাচ্ছে না। তাই দাঁড়িয়ে থাকলো। ভীড় কমে আসলে উঠবে। কিন্তু ততক্ষণে যদি বাসে সিট খালি না থাকে?
রূপা রান্নাঘরে ছিল। আয়শা বেগমের জন্য রঙ চা করার পানি বসিয়েছে। তখনি ফোন এল। শব্দ শুনে এক দৌড়ে আয়নার ঘরে থাকা মুঠোফোনটা কুড়িয়ে নিল রূপা। ফোন তুলে কানে দিতেই অনুরাগের গলা শুনতে পেল। সালাম দিয়ে বলল
‘ আপা তো সেই কখন বের হয়ে গেছে সাহেব। ঘন্টাখানেক হবে।
অনুরাগ কারখানায় এসেছিল কাজে। ভারী আওয়াজ পেরিয়ে আয়না বের হয়ে গেছে শব্দটা কানে আসলো তার। মেজাজ চটে গেল। হাতে যে সমস্ত কাগজপত্র ছিল সব ম্যানাজারকে দিয়ে গাড়ি নিয়ে বের হয়ে গেল সে৷ স্কুলের পেছনে গিয়ে দেখলো আয়না সেখানে কোথাও নেই। তাহলে কোথায় গেল মেয়েটা? বিরক্তি আর রাগ তরতরিয়ে বাড়লো তার। শায়খ চৌধুরীর ফোন এল। তিনি বললেন
‘ অনুরাগ তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরে আসো। তোমার মামারা এসেছে। অনেক কাজের কথা আছে।
অনুরাগ বলল
‘ বাবা আমি এখন যেতে পারব না। কাজ আছে আমার।
ছেলে মুখের উপর এভাবে না বলে দেওয়ায় শায়খ চৌধুরী বেজায় অসন্তুষ্ট হলেন। ঘরে গিয়ে আনহিতার উপর চটে গিয়ে বললেন
‘ আনহিতা তোমার ছেলে বেশ বাড়াবাড়ি করছে এইবার। আমি এসব সহ্য করব না।
আয়না বাসে পা রাখার আগে মোটা একটা মহিলা এসে হাত ধরে টেনে নামিয়ে দিল তাকে। নিজে উঠে গেল। আয়না হা করে তাকিয়ে থাকলো। যখনি আবার উঠতে গেল তখুনি শক্তপোক্ত একটা হাত ধরে ফেলল তার হাত। টেনে নামিয়ে আনলো। টেনে নিয়ে গেল। তারপর ঝেড়ে ফেলে দিল গাড়ির কাছে এনে। কর্কট গলায় বলল
‘ তুমি নিজে নিজে যেতে পারলে আমার সাহায্য নিলে কেন? আশ্চর্য তো। এজন্যই বলে যেচে যেচে কারো ভালো করতে নেই।
আয়না মিনমিন করে বলল
‘ এখানে অনেক মানুষ। অশান্তি করবেন না। সবাই আপনাকে চেনে।
অনুরাগ দাঁত চেপে বলল
‘ চিনলে চিনুক। সোজা গাড়িতে গিয়ে বসো। মাথা খারাপ করবে না।
আয়না উঠতে চাইলো না। সে আর সাহায্য নেবেনা এই লোকের। অনুরাগ ধমকালো। আয়না গাড়িতে উঠে বসলো। এইবার শেষবারের মতো সাহায্য নিয়েছে সে। আর জীবনে ও নেবে না।
গাড়িতে উঠে বসলো অনুরাগ। আয়না বলল
‘ আপনার সব ঋণ আমি শোধ করে দেব। পুরো বাগানে এবার ফুল এসেছে। দেখবেন একটা টাকা ও নিজের কাছে রাখব না আমি।
অনুরাগ সিটবেল্ট পড়তে পড়তে বলল
‘ কথা আর খুঁজে পেল না। ঢং।
আয়না চেঁচিয়ে বলল
‘ কি বললেন?
‘ তোমার সাথে কে ঝগড়া করতে যায় ভাই?
আয়না আবার খ্যাঁক করে উঠলো।
‘ আমি আপনার ভাই হলাম কেমনে?
‘ চুপ। একদম চুপ করে বসে থাকো।
ধমক খেয়ে চুপ করে গেল আয়না। তবে ফোঁসফোঁস করে বিড়বিড় করল
‘ আপনার কপালে আর জীবনে ও বউ জুটবে না।
অনুরাগ বলল
‘ শুনতে পাইনি। জোরে বলো।
‘ কান থাকলেই তো শুনতে পাবেন।
অনুরাগ আর কথা বাড়ালো না। তবে ছোট্ট করে আওড়ালো
‘ ওরেহ সর্বনাশী, পড়াইলা মোরে ফাঁসির রশি।
___________
সায়ান ঘুম এখনো। নামিরাকে চুপচাপ খাটের এককোণে বসে থাকতো দেখে হীরা এগিয়ে এল। হাসিমুখে বলল
‘ কিছু মুখে দিন। ড্রাইভার কিছুক্ষণের মধ্যে নিয়ে যাবে আপনাকে। আসলে আজকে সব গাড়িই কাজে লেগে পড়েছে তো তাই। চিন্তা করবেন না আপনি।
নামিরা বলল
‘ আমাকে তাড়াতাড়ি পৌঁছে দিন। আমার দমবন্ধ লাগছে এখানে।
হীরা আগ্রহ দেখিয়ে বলল
‘ কেন? এখানে কি সমস্যা?
নামিরা তাকালো হীরার দিকে। ভেজা চোখ বন্ধ করে সময় নিয়ে খুললো। বলল
‘ অর্ক, ওই অর্ক লোকটাকে দেখলে আমার কষ্ট হয়। দম বন্ধ লাগে।
হীরা দ্রুত সরে পড়লো অজানা কোনো আশঙ্কায়।
তখনি সামনাসামনি পড়লো অর্কর। অর্ক কৌতূহল দেখিয়ে বলল
‘ এভাবে দৌড়াচ্ছেন কেন হীরা?
হীরা চোখ তুলে তাকালো। ঠোঁটের কোণায় হাসির রেখা টেনে বলল
‘ দায়বদ্ধতা বলতে কোনো শব্দ হয় না অর্ক। আপনি খুব বুদ্ধিমান একজন মানুষ।
অর্ক কিছু বলতে চাইলো। হীরা তার আগেই চলে গেল।
সেলিনা বেগম দাঁড়ানো ছিল পেছনে। তিনি এগিয়ে আসলেন।
অর্কর সামনে দাঁড়িয়ে বললেন
‘ আমি তোমাকে খুব বিশ্বাস করি অর্ক। আমাদের বিশ্বাসের মর্যাদা রেখো। আমাদের ভরসাস্থল তুমি।
অর্ক বলল
‘ আমি তো,,,
সেলিনা বেগম বললেন
‘ আমি চিনি তোমাকে। খুব করে চিনি অর্ক।
বলেই চলে গেলেন তিনি।
অর্ক গিয়ে দাঁড়ালো ওই ঘরটার সামনে। বাচ্চাটা খেলছে মায়ের সাথে। বাচ্চাটার হাসিটা কেমন বিষাদ ঠেকছিল না কাল? অথচ আজকে কেমন যেন ভীষণভাবে উপলব্ধি হচ্ছে বাচ্চাটা তার । তার রক্ত বইছে। আর ওই মেয়েটি, মেয়েটি নাকি তার প্রণয়িনী ছিল? সুখ দুঃখের সারথী ছিল?
_________
উঠোনে গাড়ি থামার আওয়াজ পেয়ে হীরা বের হয়ে এল বাড়ি থেকে। নিজের বাড়ির ড্রাইভারকে না দেখে দেখলো অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো এক লোককে। খুব চেনা চেনা লাগছে। চিনেই ফেলল হীরা। এ তো অনুরাগ চৌধুরী? চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি প্রফেসর! যিনি সম্প্রতি তরুণ রাজনীতিবিদ হিসেবে যোগদান করেছেন। খুশিতে চোখজোড়া চকচক করে উঠলো হীরার। দৌড়ে গেল সে। অনুরাগের কাছে গিয়ে বলল
‘ আসসালামু আলাইকুম স্যার। আমি আপনাকে তো চিনি।
অনুরাগ গাড়ির দরজা খুলে আয়নাকে বের হতে বলল। তারপর হীরার দিকে তাকিয়ে হেসে বলল
‘ তাই নাকি? চিনলে তো খুব ভালো।
হাসলো হীরা। আয়না বের হলো। হীরা ভুরু কুঁচকে তাকালো। বলল
‘ ইনি আমাদের ম্যাডাম? মাশাল্লাহ খুব সুন্দর।
আয়না রেগে অনুরাগের দিকে তাকালো। অনুরাগ বলল
‘ নাহ ভুল বুঝছেন আপনি। ওনি আমার কেউ না।
কপাল ভাঁজ করে তাকালো হীরা। আয়না বলল
‘ আমি ওনার প্রতিবেশী, অন্য কিছুনা।
হীরা ঠোঁট গোল করে বলল
‘ ওহ। হঠাৎ আমাদের এখানে? আমি তো খুব খুশি হয়েছি স্যার।
অনুরাগ বলল
‘ এখানে যে মহিলাটি এসেছেন আমরা তাকে নিয়ে যেতে এসেছি।
হীরা বলল
‘ ওহ হ্যা নামিরা? বাবুর কে হন আপনারা?
আয়না বলল
‘ ও আমার ভাইয়ের ছেলে। আমি ওর ফুপী। আমি কি যেতে পারব ওর কাছে?
হীরা মাথা দুলালো।
‘ কোন ঘরে?
‘ দোতলায় যান। ডানপাশের ঘরটা। বাবু খেলছে এখন।
আয়না এদিকওদিক না তাকিয়ে চলে গেল। অনুরাগ ডাক দিল
‘ আরেহ? আয়নাম,,,,,
হীরা তাকাতেই আর বাকিটা ডাকলো না অনুরাগ।
দ্রুত পায়ে দোতলায় উঠে গেল আয়না। ডানপাশের ঘরটা থেকে বাবুর গলার আওয়াজ শোনা গেল। খুশিতে পা কেঁপে উঠলো আয়নার। ওই ঘরের দিকে ছুটতেই কারো সাথে জোরে ধাক্কা লেগে গেল। আয়না দুঃখিত বলেই চলে গেল৷ ফিরে তাকালো না। অর্ক তাকিয়ে রইলো মেয়েটার যাওয়ার দিকে।
ঘরে ঢুকেই বিছানার কাছে গিয়ে বসলো আয়না। বিছানা থেকে কোলে তুলে নিল সায়ানকে। সারামুখে অজস্র আদরে ভরিয়ে দিয়ে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরলো শক্ত করে। নামিরা হা করে চেয়ে রইলো আয়নাকে। গলা শুকিয়ে এল। তাকে বকবে না তো?
সায়ান হাত পা নেড়ে চেঁচিয়ে উঠলো আয়নাকে দেখে। আয়না বলল
‘ একা একা কি করছিল আব্বাটা? দাদু তো তার ভাইকে না দেখে পাগল হয়ে যাচ্ছে। আমরা এক্ষুণি চলে যাব কেমন?
সায়ান বলে উঠলো।
‘ এ্যাহ এ্যাহ।
আয়না হাসলো। টুপুস করে নাকের উপর চুমু খেয়ে বলল
‘ হ্যা।
নামিরা উঠে দাঁড়ালো। বলল
‘ তুমি? কার সাথে এসেছ আয়না?
আয়না তাকালো না নামিরার দিকে। বলল
‘ বোরকা পড়ে নাও। নিচে গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে।
নামিরার চোখজোড়া ছলছল করে উঠলো। বলল
‘ হ্যা চলেই যাব। আর আসব না।
আয়না বলল
‘ কেন এসেছ সেটা এখানে জিজ্ঞেস করব না। বাড়ি চলো আগে।
নামিরা ব্যাগ হাতে নিল। ঘনঘন চোখ মুছতে মুছতে হাঁপালো। আয়না আঁড়চোখে তাকিয়ে থাকলো।
বলল
‘ তুমি কাঁদছ কেন ভাবি?
নামিরা জবাব দিল না। বোরকা পড়ে নিল তখুনি হীরা এসে উপস্থিত হলো। আয়নাকে বলল
‘ কিছুক্ষণ বসুন না।
আয়না বলল
‘ না আমার আম্মার ভীষণ জ্বর। ফিরতে হবে।
হীরা চুপ করে থাকলো। নামিরা দাঁড়িয়ে থাকলো। হীরা স্পষ্ট দেখলো নামিরার চোখদুটো। বুক ধ্বক করে উঠলো তার। আয়না সায়ানকে ভালোভাবে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে আদর করলো। নামিরার কোলে দিয়ে ফেলল। তারপর ব্যাগ হাতে নিল। তারপর রুম থেকে বের হয়ে বলল
‘ আসো।
নামিরা কাঁপা-কাঁপা পায়ে বের হলো রুম থেকে। বারবার ফিরে তাকালো হীরার দিকে। হীরা বলতে চাইলো
‘ আপনি বোধহয় কিছু ফেলে যাচ্ছেন মিরা।
কিন্তু বলতে পারলো না। আয়না ব্যাগ নিয়ে নিচে চলে এল। অনুরাগ সোফায় বসা ছিল। আয়নাকে দেখে দাঁড়িয়ে পড়লো। সেলিনা বেগম আয়নাকে বলল
‘ আবার এসো তোমার ভাবিকে নিয়ে।
আয়না হাসলো। বলল
‘ ধন্যবাদ আমার ভাবিকে আশ্রয় দেওয়ার জন্য।
সেলিনা বেগম বলল
‘ ঝড়বৃষ্টির রাতে এভাবে এই বাড়িতে আসার রহস্যটা জানা হলোনা। আসলেই কি বিপদে পড়ে এসেছে?
আয়না বলল
‘ হয়ত। আচ্ছা আজকে খুব তাড়া আছে। কোনো একদিন আসা হবে।
নামিরা ভেতরে ভেতরে ধুঁকে মরলো। এদিকওদিক তাকালো বারবার। কাউকে দেখলো না। দেখা দিল না হয়ত।
শেষমেশ গাড়িতে গিয়ে বসলো নামিরা । তারপর কাঁদলো হিঁচকি তুলে। আয়না হতভম্ব। অনুরাগ ও। আয়না অনুরাগকে ইশারা করলো গাড়ি ছেড়ে দেওয়ার জন্য। অনুরাগ গাড়িতে উঠে বসলো। ঘনঘন ফোন এল বাড়ির ফোন থেকে। বিরক্তিতে মেজাজ খারাপ হলো অনুরাগের। এরা শান্তিতে থাকতে দেবে না তাকে।
গাড়িটার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকলো হীরা। তার পেছনে উপস্থিতি টের পেল কারো। খুব আলগোছে কেউ একজন এসে দাঁড়িয়েছে স্পষ্ট বুঝতে পারছে সে। ফিরলো। চোখাচোখি হলো। চোখ নামিয়ে নিল হীরা। বলল
‘ এখন কি বলবেন অর্ক ?
জবাব দিল না অর্ক। হীরা চোখ তুললো। বলল
‘ আপনি বড্ড অবুঝ অর্ক। বড্ড।
মুখ খুললো অর্ক। বলল
‘ আমি ভীষণ অসুস্থবোধ করছি হীরা।
মৃদু হাসলো হীরা। বলল
‘ আপনি যেদিন কোমা থেকে উঠলেন সেদিন আমাকে মিরা বলে ডেকেছিলেন আমার স্পষ্ট মনে আছে। আমি সেদিনই বুঝে নিয়েছিলাম মিরা নামের কেউ একজন আপনার সাথে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে। আপনি অসুস্থ তাই বোধহয় টের পান না, আপনি এখনো মাঝেমাঝে সেই ভুল করেন। আমাকে মাঝেমাঝে মিরা ডেকে ফেলেন। গতকাল ও ডেকেছিলেন। গতপরশু ও ডেকেছিলেন। মিরা আপনার মনমস্তিষ্কে সারাক্ষণ বিচরণ করে। আর আপনি?
অর্ক মাথা নামিয়ে নিল। কিছু বলল না।
হীরা নিজেই চলে যেতে নিল।
অর্ক ডাকল
‘ হীরা দাঁড়ান।
দাঁড়ালো না হীরা। কিছু না বলেও অনেক কিছু বলে গেল অর্ককে।
_________
নামিরা বাড়ি ফিরে আসাতে প্রাণ ফিরে পেল আয়শা বেগম। নাতিকে পেয়ে তিনি খুশিতে আত্মহারা। সবকিছু ভুলে গেলেন। আয়না চুপচাপ, নামিরাকে পর্যবেক্ষণ করছে শুধু। নামিরা ঘরে গিয়ে এককোণায় বসে থাকলো। আয়শা বেগম যখন নিজের ঘরে সায়ানকে তেল মালিশ করছিলেন তখন আয়না গিয়ে বসলো মায়ের পায়ের কাছে। বলল
‘ এভাবে চলতে পারেনা আম্মা। আমাদের ভাবির বাবার কথাটা মাথায় নেওয়া উচিত।
আচমকা চোখের জল গড়িয়ে পড়লো আয়শা বেগমের। সায়ানকে বুকের সাথে জড়ালো। মুখে আদর দিতে দিতে বলল
‘ আমি আমার মানিকরে ছাড়া কেমনে থাকুম? আল্লাহ আমার সাথে ক্যান এমন করলো?
আয়না বলল
‘ আম্মা ভাবির বাকিটা জীবন পড়ে আছে। আমরা এভাবে স্বার্থপর হতে পারিনা আম্মা। ভাবির অন্য কোথাও বিয়ে হয়ে গেলে, ভাবি স্বাভাবিক হতে পারবে। নইলে এভাবে আয়ান আয়ান করে কোথায় কোথায় চলে যাবে ঠিক নেই তার।
আয়শা বেগম চোখ মুছলেন। আজহার সাহেব বিছানায় শুয়ে আছেন। চোখের কোণাটা ভেজা, লাল।
আয়না তাকাতে পারলো না বেশিক্ষণ। আয়শা বেগম ফুঁপিয়ে কাঁদলো।
সাদাটে আকাশি রঙের শাড়িটা পড়ে এলোমেলো হেঁটে আয়শা বেগমের কাছে এসে বসলো নামিরা। একরাশ দুঃখ, আর বেদনা নিয়ে বলল
‘ আম্মা আমি তোমাদের আর কষ্ট দেব না। তোমরা যা বলো তাই শুনবো আমি। তোমাদের উপর বোঝা হয়ে থাকব না আর। অশান্তিতে রাখব না।
আয়শা বেগম কেঁদে ফেললেন জোরে। আয়না চলে গেল সায়ানকে নিয়ে। সে সায়ানকে দেবে না। ভাবি চলে যাক। সে দেবে না সায়ানকে,কিছুতেই দেবে না।
নাওয়াজ শেখ সবটা শুনে খুশি হলেন। নামিরাকে তিনি এবার ভালো পাত্রে বিয়ে দেবেন। নিজের পছন্দমতো ছেলের হাতে মেয়ের দায়ভার তুলে দেবেন। এবার সব তার মর্জিমতো হবে।
তবে আয়শা বেগম শর্ত দিলেন। তার নাতিকে তিনি কোথাও দেবেন না। তার বংশের প্রদীপ। তিনি সায়ানকে নিজের কাছে রাখবেন। নামিরা চুপচাপ পাথরের মতো সব দেখতে থাকে। সে ভেবে পায় না তার মতো এই জীবন্মৃত মানুষটাকে নিয়ে এরা কেন পড়ে থাকে?
আয়না লুকিয়ে লুকিয়ে দেখে থাকে। ভাবে কতটা কষ্ট পেলে মানুষ এতটা শক্ত পাথরের মতো ব্যবহার করে। নাওয়াজ শেখ যেদিন নিতে আসলেন সেদিন আয়নার হাতটা শক্ত করে ধরলো নামিরা। বলল
‘ তোমাদের সব ইচ্ছা আকাঙ্খা আমি পূরণ করে দেব আয়না। আয়ান ফিরলে শুধু একটা কথা বলে দিও, আমি ওকে কখনোই ভালোবাসিনি।
আয়না বহুকষ্টে কান্না চেপে বলল
‘ মিথ্যে বলছ তুমি। আমি বিশ্বাস করিনা।
নামিরা তার হাতটা ঝাঁকিয়ে বলল
‘ সত্য বললে কি আমার যাওয়া আটকে দেবে? বলো?
আয়না বলল
‘ তোমাকে ভালো থাকতে দেখলে ভাইয়া যেখানেই থাকুক খুশি হবে। তুমি ভালো থেকো। সায়ান আমাদের কাছে ভালো থাকবে।
পাগলের মতো হাসলো নামিরা। হাসতে হাসতে আয়নার কোল থেকে কেড়ে নিল সায়ানকে। রক্তবর্ণ চোখে তাকিয়ে বলল
‘ আমি আমার ছেলেকে কাউকে দেব না। কোনোদিন ও না। তোমাকে না। তোমার ভাইকে ও না। মরে গেছে আয়ান। মৃত।
আয়শা বেগমের আহাজারিতে ভারী হয় চারপাশ। নামিরা ছেলেকে জড়িয়ে ধরে কাঁদলো। নাওয়াজ শেখ এসে বললেন
‘ আইনের মতে ছেলে নামিরা পাবে। থাকুক সমস্যা নেই। বাচ্চা সহ বিয়ে হতে পারে। আপনারা দোয়া করবেন।
আয়শা বেগম বুক কিলিয়ে কাঁদেন। আয়নাকে জড়িয়ে ধরে কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে বলেন
‘ ওরা আমার মানিকরে দূরে ফেলে রাখবে। আমার বাবুর মতো কেউ ওরে নিজের ছেলের চোখে দেখবেনা। আল্লাহ আমার মানিকরে তুমি ভালা রাইখো।
চারপাশটা খালি খালি লাগলো আয়নার। খা খা করতে লাগলো। বুকটা কেন যেন খালি হয়ে গেল। যেন নিজের সন্তান কোথায় হারিয়ে গেছে। কেউ না দেখে মতো লুকিয়ে কাঁদলো আয়না।
সপ্তাহ খানেক পার হয়েছে নামিরা নিজের বাড়িতে এসেছে। সায়ানকে নাজমা বেগমই সামলায়। নামিরা থাকে নিজের মতো। কেউ কিছু বলেও না। নাওয়াজ শেখ ভালো পাত্রের খোঁজে লেগে পড়েছেন। চেয়ারম্যান হওয়ার সুবাদে তার মেয়েকে যে কেউ ঘরে তোলার জন্য প্রস্তুত যদিও এক বাচ্চার মা। তাতে কি স্বামী তো মরেছে। ডিভোর্স তো হয়নি।
____________
ঠিক তখন গোধূলি লগ্ন। মিঠে হলুদ কমলা রঙের সূর্যটা হেলে পড়ছে পশ্চিমাকাশে। চারপাশে কাঠালচাঁপার মৃদুমন্দ সুবাসে ভরপুর । এই ছোটখাটো বাড়িটার উঠোনে এসে থামলো কালো রঙের একটা গাড়ি। আয়না আর আয়শা বেগম বাড়ি থেকে বের হয়ে এল। রূপা ও বের হলো। যাকে দেখলো বিস্ময়ে হা হয়ে এল তাদের মুখ। বিস্ফোরিত নয়নে হা করে শুধু চেয়ে রইলো আয়শা বেগম। আয়না ধীরে ধীরে পা ফেলে উঠোনে নামলো। চোখের সামনে দাঁড়ানো মানুষটি তো তার সেই ছোট্টবেলার খেলার সঙ্গী। খাবার টেবিলে মাছ নিয়ে ঝগড়া করা মানুষটা। টুনি ডেকে ডেকে তাকে রাগিয়ে দেওয়া মানুষটি। তার সাথে দুষ্টুমিষ্টি খুনসুটিতে মেতে থাকা ভাইটি। শতশত আবদারের ঝুড়ি যার কাছে জমা থাকতো। যার হাতটা মাথার উপর অনুভব হতেই যেন মনে হতো এক আকাশ সমান একটা আশ্রয়ের জায়গা আছে তার। এই তো সেই মানুষটা যে ঢাল ছিল তার। যে মন খারাপের দিনে একটুকরো হাসির বন্যা হতো। খুব খারাপ সময়ে বুকে টেনে নিয়ে বিলি কাটতো চুলে। কপালে স্নেহের পরশ এঁকে দিয়ে বলতো
‘ এই টুনি আমি আছি তো। চিন্তা কিসের?
এই ভালোবাসার ভাইটি চোখের সামনে? উপরওয়ালা কি অলৌকিক কোনোকিছু করলো?
আয়শা বেগম একদৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন উঠোনে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটির দিকে। মা হওয়ার তৃপ্তি দেওয়া, আর প্রথম তাকে মা বলে ডেকে উঠা তার বাবুটা না?
তার কোলে মাথা রেখে ঘুমানোর আবদার করা তার সোহাগ না?
কোথাও বেরোনোর আগে মায়ের হাত মিনিটখানেক মাথায় লাগিয়ে রাখা ছেলেটা না।
মায়ের হাতের রান্না খেতে না পারলে মন খারাপ হওয়া ছেলেটা না?
এ তো সত্যিই তার নাড়িছেঁড়া ধন। তার মানিক। তার আব্বা।
কতদিন দেখেনা, কতদিন ধরেনা, কতদিন একটু আদর করেনা, কতদিন বুকে জড়িয়ে ধরেনা,কতদিন নিজের হাতে খাওয়ায় না। কতদিন একটু জিজ্ঞেস করা হয় না
‘ কেমন আছিস আব্বা? কেমনে ছিলি তুই আমাদের ছাড়া?
কতগুলো দিন, মাস আম্মা ডাকটা শোনা হয়না। বুকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখা হয়না। কতগুলো দিন শান্তিতে ঘুম হয় না। হাত বাড়িয়ে দিলেন আয়শা বেগম। ডাকলেন
‘ আমার বাবু, আয়। আমার বুকে আয়।
মায়ের এমন আদুরে ডাক অগ্রাহ্য করার মতো ক্ষমতা উপরওয়ালা কোনো সন্তানকে দিয়েছেন বলে মনে হয় না। মায়ের কোলে সন্তান ফিরলো মানেই খাঁ খাঁ করা সেই শুকিয়ে থাকা মরুভূমিতে আজ বৃষ্টি নামলো।
কত মানুষ যে জড়ো হলো শুধু এক মায়ের এই খুশির কান্না দেখার জন্য তার হিসেব নেই।
চলবে,
টাইপিং মিসটেক হতে পারে। রিচেক করা হয়নি।