বেখায়ালি ভালোবাসা পর্ব-৩১

0
2311

#বেখেয়ালি_ভালোবাসা,
#পর্ব_৩১
#লেখাঃসাবেরা_সুলতানা_রশিদ
.
মেঘ দের কক্সবাজার পৌঁছাতে পরের দিন সকাল হয়ে যায় । আগে থেকে হোটেলে যার যার নিজস্ব রুম বুক করাই ছিল। কেউ ডাবল কেউ সিঙ্গেল রুমে।
মেঘ আগে থেকেই বলেছিল তার জন্য যেন সিঙ্গেল রুম বুক করা হয় ।
এতোটা পথ জার্নি করে এসে সবাই খুব ক্লান্ত অনুভব করছে ।
কোনরকম সকালের নাস্তাটা শেষ করে সবাই বিশ্রাম করতে চলে গেল।
প্লান করলো এক ঘুম দিয়ে সবাই এক সঙ্গে ঘুরতে বের হবে ।
মেঘ নিজের রুমে এসে ফ্রেশ হয়ে কিছুক্ষণ বেলকনিতে দাড়িয়ে খোলা ঠান্ডা হাওয়ায় বুক ভরে নিশ্বাস নিচ্ছে।
মন ভাল করার জন্য এতদূর আশা কিন্তু সেই মনটাই যে অন্যে কোথাও পড়ে আছে সেটা যদি কেউ জানতো তাহলে হয়তো —
মেঘের খারাপ লাগছে কারণ
গতকাল থেকে এ পর্যন্ত ও বাড়িতে একটা বারের জন্যেও কথা বলতে পারেনি।
বাবা এখন কেমন আছে তাও জানিনা।
ফোনটাও রেখে চলে আসলাম। ইডানিং ফোনের কথা মনেই থাকে না মেঘের । কারণ ফোন করার মত কেউ তো নেই যে ফোন করবে। বাড়ি ফেরার পর থেকে তো ঐ বাড়ির সবার সঙ্গে টেলিফোনে কথা হয় তাই। আর সৈকত সে তো এ পর্যন্ত একটা বারের জন্য ও খোজ নেয়ার কোন প্রয়োজন বোধ করে নি।
হঠাৎ দরজায় টোকা পড়ার শব্দ হয় ।
এখন আবার কে আসবে !!??
ভাবতে ভাবতে দরজা খুলে দেখে ভাইয়া দাড়িয়ে আছে ।
—কি রে ভাইয়া তুই ঘুমাস নি?
—কি করে ঘুমাবো??
—কেন কি হয়েছে?
—মা ফোন করেছিল ,বললো তোর শ্বশুর বাড়ি থেকে অনেক বার ফোন করেছে । তুই ঘুরতে এসেছিস জেনে তাদের অনেক চিন্তা হচ্ছে।
—আমারই ভুল হয়েছে । তাড়াতাড়ি করে চলে আসার আগে যদি সবটা ভাবি আর রোজি কে বলে আসতাম তাহলে আর এরাকম হতো না।
—এত চিন্তার কিছু নেই । তুই আমার ফোন থেকে কথা বল। আমি ঘুমাতে গেলাম।
—আচ্ছা।
মেঘ দরজা আটকে বেলকনিতে ফিরে আসে । তারপর ঝিনুকের নম্বরে ফোন দিয়ে সবার ভালমন্দ জিঙ্গাসা করে ।
আর বলে সে যে এখানে তার ভাইয়া আর কলেজ ফ্রেন্ডের সাথে ঘুরতে এসেছে এ নিয়ে যেন চিন্তা না করে ।
সৈকতের কথা জিঙ্গাসা করতে গিয়েও থেমে যায় । কথা বলা শেষ করে ফোনটা রেখে ভাবে সে যদি আমাকে ছেড়ে ভাল থাকতে পারে তাহলে আমি কেন পারবো না??
মেঘ সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকে ।
এখন সমুদ্র শান্ত হয়ে আছে । ছোট ছোট ঢেউ এসে কিনারায় আছড়ে পড়ছে ।
শুকনো বালুচর ভিজিয়ে আবার ফিরে যাচ্ছে।
মনে হচ্ছে যেন ওদের মধ্যে ভালবাসার বিনিময় হচ্ছে। ভালবাসাটা লুকোচুরির ভালবাসা ।
সমুদ্র পাড়ের বালু গুলো যখন রোদের প্রখর তাপে শুকিয়ে যাচ্ছে হঠাৎ কোথা থেকে ঢেউ গুলো এসে তাকে ভিজিয়ে আবার দূরে সরে যাচ্ছে।
কি এক অদ্ভুত রকমের মিল!!
এই সমুদ্র আর ঐ মানুষটার ভিতরে।
সমুদ্র যেমন এই শান্ত আবার এই অশান্ত ঠিক সৈকতটাও এমন ,এই চেনা আবার অচেনা।
বড্ড বেশী খামখেয়ালি আর আমার প্রতি বেখেয়ালি।
হঠাৎ করে মেঘের সেদিনের রাতের কথা মনে পড়তেই ঠোটের কোনে হাসি ফুটে।
সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে ভাবে তুই যেমন আদর করে ভিজিয়ে দিচ্ছিস বালুকণা গুলো কে , তোর মত করে সেদিন আমাকেও ভিজিয়ে দিয়েছিল তার সবটুকু ভালবাসা দিয়ে ।
হঠাৎ ফোনটা বেজে ওঠে।
মেঘ ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখে একটা আন নোন নম্বর থেকে ভাইয়ার ফোনে ফোন এসেছে।
ফোনটা রিসিভ করা ঠিক হবে কিনা বুঝতে পারছে না।
একটু ভেবেই ফোনটা রিসিভ করতেইঃ
—হ্যা ভাইয়া আমি পৌঁছে গেছি ।
মেঘ কথাটা শুনে একটু অবাক হয় ।
—কে আপনি??কাকে চাইছেন??
ওপাশ থেকে আর কোন কথা না বলে ফোনটা কেটে দেয় ।
মেঘ ফোনটা রেখে বিছানায় গিয়ে কিছু সময়ের জন্য শরীরটাকে এলিয়ে দেয়।
শরীর ক্লান্ত থাকায় কিছু সময়ের মধ্যে ঘুমের রাজ্যে প্রবেশ করে মেঘ।
হঠাৎ ফোনের রিং বাজার শব্দে কাচা ঘুমটা ভেঙ্গে যায় ।
ফোনটা রিসিভ করে বুঝতে পারে মিতু(বান্ধবী ) ফোন করেছে ।
মেঘ তাড়াতাড়ি করে উঠে দরজা খুলে দেখে সবাই রেডি হয়ে ওর দরজার সামনে দাড়িয়ে আছে।
—সরি রে ,একটু ঘুমিয়ে পড়ে ছিলাম।
—ঠিক আছে তাহলে তুই রেডি হয়ে নে আমরা হোটেলের বাইরে অপেক্ষা করছি।
—ওকে।
মেঘ রেডি হয়ে বের হয়ে আসার সময় নজর পড়ে ।
মেঘ থমকে দাঁড়ায় । একটা ছেলে আর একটা মেয়ে বসে গল্প করছে। ছেলেটির মুখ দেখা যাচ্ছে না।
ছেলেটিকে পিছন থেকে দেখতে হুবহু সৈকতের মতো ।
দুর থেকে কথা বোঝা যাচ্ছে না।
কিন্তু মেয়েটার হাস্যোজ্জ্বল চেহারা আর গেট আপ দেখে মনে হচ্ছে নতুন বিয়ে হয়েছে ।
মেঘ কিছুক্ষন দাড়িয়ে ভাবে সৈকত এখানে কি করে এলো?
আর সাথের ঐ সুন্দরী মেয়েটিই বা কে??
ধূর কি যে ভাবছি!!?
এটা সৈকত হতে যাবে কেন?
এটা তো সৈকত নাও হতে পারে।
মনের মধ্যে শুধু সৈকত ঘুরছে তাই
হয়তো —–
মেঘ মনে মনে বলেঃ
মেঘ তুই পাগল হয়ে যাচ্ছিস। যেখানে সেখানে সৈকত এখন সৈকত কে দেখতে শুরু করেছিস।
এসব বাদ দে । যে কাজ যাচ্ছিস সে কাজে যা।
মেঘ হাটতে শুরু করে । আবার কি ভেবে যেন ফিরে আসে। মনের মধ্য সন্দেহ রাখতে নেই । তাই মনের সন্দেহ দূপ করার জন্য মেঘ ফিরে এসে দেখে মেয়েটি একাই বসে আছে ছেলেটি নেই ।
মেঘ মেয়েটির দিকে এগিয়ে যায়ঃ
—হাই
—হ্যালো
—আমি মেঘ।
—নীলা হাসান।
—আমি একটু কথা বলতে পারি যদি কিছু মনে না করেন।
—না ,কি মনে করবো!!বলুন কি বলবেন?
—আসলে আমরা এখানে আজই এসেছি ঘুরতে । আশেপাশে ঠিক ভাল কি দেখার মতো আছে । আর ভাল মার্কেট কোথায় সেটা কি বলতে পারবেন??
—সরি টু সে আই ডোন্ট নো। আসলে আমরাও আজ এখানে এসেছি।
—ও আচ্ছা। ফ্যামিলি নিয়ে নাকি ফ্রেন্ডদের সাথে।
—হানিমুনে
—ওয়্যাও। কনগ্রাচুলেশন।
—ধন্যবাদ,আপনি কার সঙ্গে এসেছেন
জানতে পারি?
— ভাইয়া আর আমার কিছু ইউনিভার্সিটির ফ্রেন্ডের সঙ্গে। তা আপনার সাহেব কোথায় ?
—আছে একটা জরুরি ফোন আসছে তাই কথা বলতে গেছে।
—ও
—আসলে ও প্রফেশনে ডাক্তার তাই সবসময় খুব ব্যস্ত থাকে। দেখুন এখানে এসেও কোন অবশর নেই।
—বুঝলাম। আচ্ছা আপু আমি এখন আসি । একটু বাইরে যেতে হবে আমার জন্য ওরা সবাই অপেক্ষা করে আছে ।
—ঠিক আছে ।
—আপনার সঙ্গে কথা বলে খুব ভাল লাগলো। ধন্যবাদ
মেঘ কথা শেষ করে চলে আসে আর ভাবে যাক, অন্তত এটা যে সৈকত ছিলনা সেটা তো নিশ্চিত হওয়া গেল।
সারাদিন ঘুরাঘুরি করে সবাই সন্ধ্যার পরে হোটেলে ফেরে ।
মেঘের আর ভাল লাগছে না ।
হঠাৎ বিকালে রাজুর একটা ফোন আসে । রাজু কথা শেষ করে মেঘকে বলে তার অফিসে জরুরী কাজ পড়ে গেছে তাই এক্ষনি চলে যেতে হবে ।
মেঘ ওর ভাইয়াকে বলেছিল ওকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে কিন্তু ভাইয়া রাজি হলো না। বললো তোর ফ্রেন্ডরা কি মনে করবে।
মেঘের অনিচ্ছা সত্বেও তাই থাকতে হলো।
মেঘ রাতের খাবার না খেয়েই শুইয়ে পড়ে ।
হোটেলের ছাদে অনেক জোরে জোরে গান চলছে বাহারি রঙের আলোর ও ব্যবস্থা করা হয়েছে।
মেঘের ফ্রেন্ডরা এখানে বসে আড্ডা দিচ্ছে । মেঘকে বলে ছিল যেতে কিন্তু কেন যানি মনটা ভাল লাগছে না।
মিস করছে !!
হ্যা মেঘ সত্যিই কাউকে মিস করছে এই মুহূর্তে এই অবস্থায় এরাকম অন্ধকার বদ্ধ রুমে ।
ইচ্ছে করছে মানুষটির সঙ্গে হাত ধরে সমুদ্রের পাড় ধরে হেটে বেড়াতে ।
ইচ্ছে করছে সমুদ্রের পাড়ে দাঁড়িয়ে ,তার বুকে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে বুক ভরে নিশ্বাস নিতে ।
কিন্তু——
দরজার ওপাস থেকে শব্দ আসছে
—মেঘ দরজা খোল।
সৈকতের কথা ভাবতে ভাবতে কখন যে চোখের কোনে জল জমা হয়েছিল সেটা মেঘ নিজেও বুঝতে পারে নি।
দরজার ওপারের শব্দ কানে এসে পৌছাতে মেঘ উঠে বসতেই টুপ করে জল গড়িয়ে নিচে পড়লো।
মেঘ উঠে স্বাভাবিক হয়ে দরজা খুলতেই
মিতু,রেনু,বৃষ্টি মেঘ কে জোর করে ধরে বাইরে নিয়ে এলো।
—এই কি করছিস?কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস আমাকে ?
—কথা বলবি না। তোর সঙ্গে আমাদের কি কথা ছিল ভুলে গেছিস?
—দেখ আমার ভাল লাগছে না।
—আমরা এসব কিছু শুনতে চাই না। চল আমাদের সঙ্গে । আজ সারা রাত সবাই মিলে জমিয়ে আড্ডা দিব।
—আজ না ।
—উহু শুনবো না । বলে মেঘের হাত ধরে টানতে টানতে ছাদে নিয় গেল।
সবাই ছাদে বসে আড্ডা দিচ্ছে আর তুই একা রুমে শুইয়ে আছিস। এটা কি আমাদের ভাল লাগে বল??
মেঘ আর কোন কথা না বলে ওদের সঙ্গে বসে ।
সারা রাত আড্ডাবাজি হবে কিন্তু কি নিয়ে ।
সবাই মিলে ঠিক করলো
১। প্রথমে গানের কলি খেলবে।
২। ট্রুথ এন্ড ডেয়ার
৩। কবিতা
৪। নাচ
ছাদের এরিয়া অনেক । মেঘরা ছাড়াও আরো অনেক মানুষ সেখানে উপস্থিত তারাও তাদের মত করে সময় কাটাচ্ছে।
মেঘ বসে আছে কিন্তু মনে হচ্ছে কেউ একজন তাকে গভীর দৃষ্টিতে দেখছে ।
মেঘ আশেপাশে তাকালো কিন্তু তেমন কিছু দেখলো না ।
এক এক করে খেলা শেষ হতে চলেছে ।
মেঘের ফ্রেন্ডরা সবাই মিলে মেঘকে রিকুয়েস্ট করলো নাচ করতে । মেঘ অনেক ভাল নাচ করতে পারে । স্কুল কলেজে পড়ার সময় যে কোন অনুষ্ঠানে প্রধান চমক হিসাবে থাকতো মেঘের নাচ।
মেঘের নাচের জন্য এখনো স্কুল কলেজে তার সুখ্যাতি আছে।
মেঘ না বলে দিল। আমি নাচ অনেক আগেই ছেড়ে দিয়েছি তাই আর এতদিন পরে সেটা আমাকে দিয়ে হবে না।
মেঘের বন্ধুরা অনেক জোরাজুরি করেও মেঘকে রাজি করাতে পারলো না।
হঠাৎ পিছন থেকে কেউ একজন বলে উঠলো মেঘ আমার জন্যেও না——–
(চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here