# ছায়াকরী
# পর্বঃ১৮
লেখনীতেঃ তাজরিয়ান খান তানভি
প্রিয় জেহেন,
অবাক হচ্ছ? হওয়ারই কথা। একজন বদ্ধ উন্মাদ কী করে চিঠি লিখতে পারে! এটাই তো ভাবছ? তোমার ভাবনা ভুল নয়। তবে আমি উন্মাদ নই। বাধ্য হয়েছি।
ভাবছ, তোমাকে কেন বলছি? এই মহলে আমি একমাত্র তোমাকেই ভরসা করতে পারি। হ্যাঁ, আমি জানি তোমার দ্বিতীয় সত্তা সম্পর্কে। আর এটাও জানি, আমার তোভিয়া এই মহলে সবচেয়ে বেশি তোমাকে বিশ্বাস করে। তাই তো আমি তোমাকেই সব বলতে চাই। ভরসা করি তোমাকে। তুমি জেনে খুশি হবে, আমি তোমাকে খু/নি ভাবিনি। তোভিয়ার বাবার মৃ/ত্যু/র জন্য তুমি দায়ি নও। তুমি তাকে খু/ন করোনি। কিন্তু কেউ তো করেছে, সে এই মহলেই আছে। আমি জানি না সে কে।
তোমাকে বিশ্বাস করার মূল কারণ, স্বয়ং জোবায়ের হাসনাত। বাবা তোমাকে বিশ্বাস আর ভরসা দুটোই করেন। এজন্যই তো তোমাকে ওই লকেট দিতে বলেছেন। তুমি তা আগলে রেখো। বাবা কেন আমাকে তা দিয়েছেন তা আমি জানি না। শুধু বলেছেন, সুযোগ হলে এই লকেট তোমার কাছে পৌঁছে দিতে। আমি সেই সুযোগের অপেক্ষায় ছিলাম। তিনি নিশ্চয়ই কোনো কিছু ভেবেই এই পদক্ষেপ নিয়েছেন। তুমি তো তার ছায়া। আমার বিশ্বাস তুমি বুঝে নেবে, কী করা উচিত তোমার, কীভাবে করা উচিত।
নুয়ায়াম আমার গর্ভজাত সন্তান নয়। বাবার অভ্যাস ছিল মহাচ্ছায়া জঙ্গলে যাওয়ার। তিনি বিভিন্ন ঔষধি গাছের সাথে পরিচিত ছিলেন। সেই জঙ্গল থেকে তিনি তা সংগ্রহ করতেন। একদিন সকালে তিনি নুয়ায়ামকে নিয়ে ফিরলেন। আর আমার কোলে তুলে দিয়ে বললেন, আমি যেন নিজ সন্তানের মতো তাকে লালন-পালন করি। তবে এটাও সত্য, আমি কখনো নুয়ায়ামকে নিজের সন্তানরূপে মেনে নিতে পারিনি। তোমার বাবারও জঙ্গলে যাওয়ার বাতিক ছিল। বাবার পথেই হাঁটতে চেয়েছিল জুহায়ের। প্রায়ই তোমাকে নিয়ে সে জঙ্গল যেত।
হঠাৎ করেই সব এলোমেলো হয়ে গেল। নুয়ায়াম এই মহলে আসার কিছু দিন পর বেগমরাণির মৃত্যু, বাবার পূণর্বিবাহ, তোমার আর জুহায়েরের নিখোঁজ হওয়া, তোমার মায়ের মৃত্যু, তোমাদের ফিরে আসা, তারপর তো সব তোমার জানা। সবকিছু এত দ্রুত ঘটল যে আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না। বাবার হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে যাওয়া, তোভিয়ার বাবার মৃত্যু সবকিছু আমাকে ভীত করে তুলল। তারপর সেই রাত! সে এসেছিল আমার কাছে। বলেছে, নুয়ায়ামের সত্য কাউকে না বলতে। সে এই মহলে তার জন্য এসেছে। নিয়ে যাবে নুয়ায়ামকে। নুয়ায়াম কে আমি জানি না। তবে সে বলেছে, নুয়ায়াম চাইলে আমাদের রক্ষা করতে পারবে।
আমার তোভিয়াকে বাঁচাতেই আমি চুপ হয়ে যাই। এই মহলে কী চলছে আমি জানি না। তবে ভয়ংকর কিছু হচ্ছে। আমার তোভিয়াকে বাঁচাও। তুমি আমার জন্য চিন্তা করো না। আমার জীবন তো শেষ হয়ে এসেছে। তুমি তোভিয়ার খেয়াল রেখো। ওকে এই মহল থেকে দূরে কোথাও নিয়ে যাও। তুমিও চলে যাও। অনেক দূরে।
আমার তোভিয়া তোমাকে ভালোবাসে। এতদিনেও যখন তোমার হিংস্র সত্তা আমার পদ্মকুমারীর কোনো ক্ষতি করেনি, তাহলে আগেও করবে না। ও তোমার সাথে নিরাপদে থাকবে। ওকে তোমার পাশে রেখো। ছায়া হয়ে থেকো ছায়াকর!
ইতি তোমার
বড়ো বেগম।
বুক ভর্তি দীর্ঘশ্বাস ফেলল জেহেন। রাতের আকাশে ভরাট চাঁদ। তার নিরহঙ্কার জোছনাতে সয়লাব আঁধার। জানালার কাছে দৃঢ়চিত্তে দাঁড়িয়ে আছে জেহেন। মানসলোকে ভাসছে রাদিয়াতে চিরকুটের সেই বাক্যগুলো। জেহেন অবিচলিত, নিরুদ্যম। তাকে পেছন থেকে আলিঙ্গন করল তোভিয়া। আচানক নারীদেহের কোমল স্পর্শে সপ্রতিভ হলো জেহেন। ঘণ্টা খানেক পূর্বেই বিবাহ হয়েছে তাদের।
জেহেন দেহভঙ্গি বদলে দাড়াল। এক টুকরো চাঁদ যেন উজ্জ্বল করে দিয়েছে তার কক্ষের সমস্ত অন্ধকার। জেহেন চোখের তারায় নম্রতা রেখে চেয়ে রইল। তোভিয়া মোহবিষ্ট হাসে। তাকে বক্ষপাঁজরে জড়িয়ে নেয় জেহেন। ক্ষীণ শ্বাস ফেলছে তোভিয়া। লজ্জার প্রজাপতিরা যেন দূরে উড়ে গেছে। জেহেনকে দুই হাতে শক্ত করে জড়িয়ে রাখল তোভিয়া। বুকের স্পন্দন গতি বাড়াচ্ছে। প্রলয়কারী সংসর্গের আকাঙ্ক্ষায় তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে গহন কাঁপন উঠছে। জেহেন নরম গলায় বলল—
“ভয় করে না তোমার?”
আবছা আঁধার ভেদ করল জেহেনের পুরুষালী স্বর। তোভিয়া নাক ঘষল জেহেনের বুকে। আধো স্বরে বলল—
” উহু।”
“যদি আমি আমার নিয়ন্ত্রণ হারাই?”
“আমি উৎসর্গ করেছি নিজেকে।”
“তুমি ভুল করেছ তোভিয়া।”
“এই ভুল যদি আমাকে আপনাকর নিকটে নিয়ে আসে, তাহলে সহস্রবার আমি এই ভুল করতে রাজি।”
জেহেন ছোট্ট শ্বাস ফেলল। আরো দৃঢ় করে তোভিয়াকে নিজের বুকে গেঁথে নিল। তোভিয়ার মাথার খোঁপা খুলে দিলো। ঝট করেই তোভিয়ার দীঘল কালো চুল নেমে গেল তার নিতম্ব ছাড়িয়ে। জেহেন ঘাড় কাত করে হালকা ঝুঁকে ওষ্ঠাধরের প্রেমময় স্পর্শ এঁকে দেয় তোভিয়ার গ্রীবাদেশে। তরতর করে মাঘের শীতের কাঁপন ছড়িয়ে পড়ল তোভিয়ার সারা অঙ্গে।
,
,
,
ফুঁসে যাচ্ছে তেহজীব। তার চোখে- মুখে তীব্র, প্রগাঢ়, অস্থির হিং/স্র/তা। মেহেক সান্ত্বনার সুরে বলল—
“তেহজীব, নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করো।”
তেহজীব ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলল—
“নিয়ন্ত্রন! কী করেছেন আপনারা? কেন এই বিবাহ হতে দিলেন?”
মেহেক কণ্ঠে শীতলতা রেখে বললেন—
” এই বিবাহ হওয়া জরুরি। তুমি কেন বুঝতে পারছ না?”
“তোভিয়াকে আমি ভালোবাসি।”
মেহেক নিঃশ্বাস ফেললেন। শ্রান্ত স্বরে বললেন—
“তুমি কেন ওর মায়ায় পড়ছ? ওই মেয়ে অভিশপ্ত। ওকে ফিরে যেতে হবে। আমাদেরও আমাদের রাজ্যে ফিরে যেতে হবে। রাজ্যের সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ের সাথে আমি তোমার বিবাহ দেবো।”
তেহজীব খটমট করে তাকাল। তেজী গলায় বলল—
“আমার অন্য কাউকে চাই না। আমার তোভিয়াকেই চাই।”
মেহেক জোর গলায় বলে উঠে—
“তেহজীব! সীমা লঙ্ঘন করছ তুমি। এক মনুষ্য কন্যার প্রেমে মত্ত হয়ে যাচ্ছ। ভুলে যেয়োনা তোমার অস্তিত্ব !”
তেহজীব শ্লেষমিশ্রিত হাসল। বক্রোক্তি করল—
“কী করেছেন এতগুলো বছর আপনারা? কিছুই করতে পারেননি। কাকে ধ্বং/স করতে এসেছেন আপনারা? যে নিজেই আপনাদের ধ্বং/সদূত হয়ে দাড়াবে! মনে রাখবেন আম্মি। ভুল তো করেছেন জেহেনকে সরল ভেবে। ও কখনো আপনাদের কথা শুনবে না। ও যদি কখনো জানতে পারে, ওকে এই অভিশপ্ত জীবন থেকে মুক্তি দেওয়ার ক্ষমতা যুবরাজ মায়ং রাখেন, তাহলে ও আপনাদের সাথে কখনো হাত মেলাবে না। পস্তাবেন আপনারা। ওকে সেদিনই মে/রে ফেলা উচিত ছিল।”
রোষে ফেটে পড়ে তেহজীব। দপদপ করে পা ফেলে মেহেকের কক্ষ থেকে বের হয় সে।
চলবে,,,