ঘাসেদের ফাগুন পর্ব ১০

0
317

ঘাসেদের ফাগুন পর্ব ১০
_________🖌️নাজনীন নাহার
২২.০৩.২০২২

আমার বিয়ের একমাস পরে আমি আমার বাবার সাথে শ্বশুর বাড়ি থেকে ফিরে এলাম বাবার বাড়ি। পরের দিন আমি আমার লেখাপড়ার বিষয়ে কিছু ইনফরমেশন জানার জন্য কলেজে যেতে চাইলে মা আমাকে কলেজে যেতে বারণ করলেন। কারণ আমার এখন বিয়ে হয়ে গেছে। আমাকে এখন কোথাও যেতে হলে আমার স্বামী বা শ্বশুর বাড়ির অনুমতি নিতে হবে। কী অদ্ভুত! আমার নিজস্ব কোনো ইচ্ছে বা মতামত থাকতে পারবে না আমার জীবনে। কারণ আমি মেয়ে।
যেই আমি গত দুই মাস আগেও নিজের কলেজে যেতে পারতাম মা’কে জাস্ট ইনফর্ম করে। সেই আমি আমার বিয়ের অনুষ্ঠানের মাত্র একমাস পরেই কলেজে যেতে পারব না শ্বশুর বাড়ির অনুমতি ছাড়া।
মা’কে খুব সহজ শব্দে ঠাণ্ডা মাথায় জিজ্ঞেস করলাম।
——-কেন মা! আমি কেন যেতে পারব না!
মা বললেন।
————এটাই নিয়ম।
——–কার নিয়ম মা!
———কার আবার সকলের।
——-সকল কে কে মা! আমি কী সকলের মধ্যে পড়ি না!
——–তুমি তো মেয়ে। মেয়েরা আবার এসবের মধ্যে কেন যাবে।
———কোন সবের মধ্যে মা! এটা তো আমার জীবন। তার মধ্যে আমি যাবো না কেন!
——–তোমার জীবন তো কী হয়েছে! এটা তো সমাজের নিয়ম। মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেলে তারা স্বামীর আর স্বামীর বাড়ির হয়ে যায়।
———সমাজ কে বানিয়েছেন মা! কাদের জন্য বানিয়েছে?
——–কারা আবার! সমাজের গণ্যমান্য মানুষেরা।
———-কারা তারা! তাহলে আপনিও তো গণ্যমান্য মানুষ মা। আপনি আমাকে এখন যেতে দিন।
——–মেয়েরা ওইরকম গণ্যমান্য হয় না।পুরুষরা হয় সমাজের নিয়মের গণ্যমান্য। তুমি এতো কথা প্যাচাইও না তো। তুমি সকাল থেকে কিচ্ছু খাওনি ইলোরা। যাও খেয়ে নাও।
———মা আমার কলেজে যাওয়াটা খুব জরুরি। আমি এসে খাব।
———-তুমি কখন বুঝবা বাবা। মেয়েদেরকে স্বামীর অনুমতি ছাড়া কোথাও যাওয়া বারণ করেছে আল্লাহ। আর তাছাড়া তুমি এখন তোমার শ্বশুর বাড়ির আমানত। একটা সামাজিকতা আছে।
———-আর ছেলেদেরকে! তারাও কী বিয়ের পরে তার বউয়ের অনুমতি নিয়ে কোথাও যাবে! তাহলে যে আপনাদের জামাই নিজের ইচ্ছেতে চলে। এটা কী তাহলে ঠিক না মা!
আচ্ছা মা আমি যদি এখন আপনাদের জামাইয়ের অনুমতি ছাড়া কলেজে যাই।তাহলে তাতে কী সমস্যা হবে!
——–এটা ঠিক না মা। এটা বেয়াদবি হবে।
———আপনারা অনুমতি দিলেও বেয়াদবি হবে মা!
——উফফ ইলোরা! তুমি যাও তো খেয়ে নাও।
——না মা আমি খাবো না। আপনিই বলুন তো মা।আপনাদের জামাই এখন ঢাকায় আছে। আমার শ্বশুর তাদের বাড়িতে আছে। আমি এখন কীভাবে তাদের অনুমতি নেব! আর আমি এদিক থেকে গিয়ে তাড়াতাড়ি চলে আসব। তারা তো কেউ জানবেও না।আর আপনাদের জামাই তো বলেছে আমাকে ডাক্তারি পড়াবে। তাহলে আর সমস্যা কী!
———–তুমি এতো কিছু বুঝবা না বাবা। তারা জানলে তোমার বাবা ছোটো হয়ে যাবে। তারা বলবে মেয়েকে এতো পড়ানোর শখ থাকলে আবার বিয়ে দিলো কেন! এসব তোমার বাবার মান সম্মানের বিষয়। তুমি এখন যেতে পারবা না।

আমি কী করবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। আমার খুব অসহায় লাগছিল।কয়েকদিনের মধ্যে আমার এইসএসসির রেজাল্ট দেবে। আমাকে মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষা দিতে হবে। আমাকে কলেজে গিয়ে সব খবরাখবর নিতে হবে। এটা তো আর মোবাইল ফোনের যুগ ছিলো না। আমি এখন কী করব! মা যেতে দেবে না। তার মানে আব্বাকে বলে তারপর যেতে হবে। আমি আব্বার কাছে গিয়ে বললাম।
———আব্বা আমি একটু কলেজে যাব। বেশিক্ষণ দেরি হবে না। দরকারি কাজগুলো সেরেই চলে আসব।
আব্বা হাদিস শরিফের একখানা বই পড়ছিলেন। ডান হাতের তর্জনী বইয়ের মধ্যে চিহ্ন স্বরুপ ঢুকিয়ে রেখে বইটি বন্ধ করে বেশ বিরক্তি নিয়ে আমার দিকে তাকালেন। আব্বা কোনো জবাব না দিয়ে আবারও হাদিসের বই খুলে বইয়ে ডুবে গেলেন। আমার ভীষণ অস্থির লাগছিল। আমি আবারও আব্বাকে বললাম।
———আব্বা আমি তাহলে গেলাম।তাড়াতাড়ি চলে আসব।
সাথে সাথে হাদিসের বইয়ের চিহ্ন টিহ্ন ছাড়াই বিছানার একপাশে বন্ধ করে রেখে মোটামুটি উচ্চ গলায় চিৎকার করে উঠলেন।
———এসবের মানে কী ইলোরা! তোমার কেন অসময়ে কলেজে যেতে হবে!
আমার অগ্রসর পা থেমে গেল। আমি অনেকটা স্তব্ধ হয়ে গেলাম। মা দৌড়ে এই ঘরে এলেন।
——-কী হলো আবার! আপনি এমন চিৎকার করছেন কেন!
——–তোমার মেয়েকে জিজ্ঞেস করো! তোমার মেয়ে নাকি কলেজে যাবে। ওকে বিয়ে দেয়া হয়েছে। এখন ও সংসার করবে। তা না সে কলেজে যাবে! জামাইকে আমি মুখ দেখাব কী করে! কত্ত ভালো একটা জামাই পেয়েছি। নিজের ছেলের মতো। নিজের ছেলেদের কথা আর কী বলব! তারাও তো মানুষ হলো না এখনো।
মা গলা নামিয়ে আব্বাকে বললেন।
———-আহ্ আস্তে কথা বলেন। মানুষ জন শুনলে কী বলবে!
——-আমি বুঝি না এতো লেখা পড়া লেখা পড়া করে কী হবে! আরে বাবা মেয়ে মানুষ তুমি। তোমার বিয়ে দিয়েছি। সামনে তোমার ছেলেপুলেকে তুমি ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার বানাও। সমস্যা কী!
না তা নয়। সে ডাক্তার হবে! ডাক্তার হবে!
শ্বশুর বাড়ি থেকে এসেছ খাও দাও আনন্দ করো। না সে এখন কলেজ কলেজ করে অস্থির করছে।

কথাগুলো শুনে আমার কেমন গা গুলিয়ে উঠল।আমার আর আব্বা ও মায়ের সাথে কোনো কথা বলতে ইচ্ছে হলো না। আমি আমার কান্না চেপে নিজের রুমে চলে এলাম। আমার নিজের বাবার কাছে আমি মেয়ে মানুষ হয়ে গেলাম! বাবা হয়তোবা এই শব্দের অপমানের চুড়ান্ত ভেবে শব্দটা ব্যাবহার করেনি। কিংবা করেছে হয়তো! নইলে বলবে কেন!আমাকে জব্দ করতেই তো বাবা এই শব্দটা প্রয়োগ করলেন। আমাকে তো কতাটা আমার বাবা আমার মেয়ে জীবনের সীমাবদ্ধতা মনে করিয়ে দেয়ার জন্যই বললেন।
হায়! যেখানে আমাদের সমাজে নিজের জন্মদাতা বাবা নিজের মেয়েকে মুখ ফস্কে মেয়েমানুষ বলে ফেলে। নিজেই কন্যা সন্তানের অসহায়ত্ব বুঝিয়ে দেয় পদে পদে। সেখানে আমি কীভাবে অন্য পুরুষের কাছে আমার সম্মান চাইব!
রুমের দরজা বন্ধ করে খুব কাঁদলাম। কাঁদতে কাঁদতে একসময় ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়লাম। কতক্ষণ ঘুমিয়েছিলাম জানি না।
ঘুমের মধ্যে থেকে আমি একটা শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। কিন্তু ক্লিয়ার বুঝতে পারছিলাম না। ঘুমটা একটু একটু করে ভাঙছে আর শব্দটা স্পষ্ট হচ্ছে।
————–ইলোরা।ইলোরা। দরজা খোলো মা। দুপুর গড়িয়ে গেল। উঠে আসো। খেতে হবে। ইলোরা! মা ইলোরা!
ঘুমটা ভাঙ্গলো আমার। মা ডাকছেন। ডাকুক। আজ আমি খাবো না। চুপ করে বসেই রইলাম রুমে। আবারও আমার খুব শূন্য লাগতে লাগলো সব। আবারও সেই তেঁতুল গাছটার কথা মনে পড়ল। তার মানে আত্মহত্যা। তার মানে হুতুম পেঁচা। তার মানে দোজখ!

আমি উঠে বসলাম। মনে মনে একটা সিদ্ধান্ত নিলাম। কাউকে কিছু জিজ্ঞেস না করে আমি আমার বান্ধবীর বাড়ি যাব। দরজা খুলে বাইরে এলাম। এখনও পুরোপুরি বিকেলটা নামেনি উঠোনে। ডানে বামে তাকিয়ে দেখলাম কেউ নেই।
পুকুর ঘাটে গিয়ে মুখে খুব করে পানির ঝাপটা দিয়ে ঘরে চলে এলাম।মা’কে দেখলাম পাশের রুমে আমার ছোট বোনকে কুশিকাটার সেলাই কাজ শেখাচ্ছেন। বুঝলাম আমাকে খাবারের জন্য ডেকে ডেকে এখন নিজের কাজে ডুবে আছেন। আব্বা এখন কোথায় তাও জানি না। কিছুই আন্দাজ করতে পারছি না। রুমে ঢুকে মাথাটা আঁচড়ে নিলাম। একটু স্নো বের করে মুখে ঘষলাম। আয়নায় তাকিয়ে মনে হলো।আমার চেহারায় অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে ইতোমধ্যে। নাকে সোনার নাকফুল, গলায় লকেট সহ সোনার মোটা চেইন। কানে সোনার ঝুমকা। শাড়ি আর এতোগুলা গহনায় আমাকে কেমন কিছুটা অচেনা লাগছিল আমার আয়নায়। বিয়ের আগের সেই সহজ তারুণ্যটা আর নেই।
ভাবলাম আমি এভাবে শাড়ি পরে বান্ধবীর বাড়ি যাব না। আমার কেমন লজ্জা লাগছিল। তাই আমার আলনা থেকে একটা সেলোয়ার-কামিজ পরে নিলাম।এবার খুব ভালো করে মাথা ও শরীরে ওড়না পেঁচিয়ে রুমের দরজাটা টেনে চুপচাপ বেরিয়ে পড়লাম।

বান্ধবীর বাসা আমাদের বাসা থেকে বেশি দূরে না। মাথার ওড়নায় মুখের অধিকাংশ অংশ ঢেকে খুব জোরে পা চালিয়ে বান্ধবীর বাড়ি গিয়ে বান্ধবীকে সব বুঝিয়ে বলে আসলাম। আগামীকাল আমার বান্ধবী আল্পনা কলেজে গিয়ে আমার জন্য সব খবর নিয়ে আসবে। এদিকে বিকেল ঢলে সন্ধ্যা হচ্ছে প্রায়।
আমি দ্রুত পায়ে বাড়ি ফিরছিলাম। বাড়ির থেকে একটু বাইরের দিকের মাসজিদে তখন মাগরিবের নামাজের জন্য মুরব্বিরা জড়ো হয়েছেন। এখনি মাগরিবের আযান পড়লো বলে। হঠাৎ চোখ পড়লো আব্বার দিকে।আমি ঘোমটা টেনে মাথা নিচু করে বাড়ি চলে এলাম।
বাড়ি এসে আমার খুব ভালো লাগছিল। থাক কলেজে না গিয়েই সব খবর নেয়া যাবে।

ঘরের দরজায় পা ফেলতেই মা বেশ কড়া গলায় জিজ্ঞেস করলেন।
——কোথায় গিয়েছিলে তুমি!
আমি কোনো জবাব দিলাম না। সোজা নিজের রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলাম। মা আর চেঁচামেচি করলেন না। আমার মা এমনিতেই খুব শান্ত মেজাজের মানুষ।
প্রায় মিনিট ত্রিশ পরেই আমার দরজায় দুম দুম করে ধাক্কা। আব্বা ডাকছেন।
——-ইলোরা! ইলোরা! দরজা খোলো! দরজা প্রায় ভেঙে ফেলার মতো অবস্থা।
আমি গিয়ে দরজা খুলতেই আব্বা আমার গালে সজোড়ে একটা চড় বসিয়ে দিলেন। আমি শুকনা পাতলা মেয়েটা আব্বার হাতের চড় খেয়ে মাটিতে পড়ে গেলাম। মা দৌড়ে এলেন। আব্বা চিৎকার করছেন।
———তোমার মেয়ের কতোবড় আস্পর্ধা! সে একা বাড়ির বাইরে গেল। আর সবচেয়ে বড়ো কথা সে বোরকা ছাড়া বাইরে গেছে! মসজিদের সামনে কতগুলো মানুষের সামনে তোমার মেয়ে আমাকে অপমান করল। আমার কী বেইজ্জতটাই না হলো। জামাই বাড়িতেও আমার আর কোনো ইজ্জত থাকবে না। আব্বা অনবরত তার রাগ ঝেড়েই যাচ্ছেন।
সারাদিনের না খাওয়া আমি হঠাৎ চড় খেয়ে মাটিতে পড়ে গিয়ে মাথাটা ঘুরছিল। দুই হাতে আমি মাটি কামড়ে নিজের ব্যালেন্স খোঁজার চেষ্টা করছি। আব্বা আমাকে আরও মারতে চাচ্ছেন কিনা বুঝতে পারছি না। তবে মা খুব চেষ্টা করছেন আব্বাকে শান্ত করার জন্য। ভাগ্যিস সন্ধ্যা হয়ে গেছে। আশেপাশের বাড়ির মানুষগুলো তাই ছুটে আসলো না। আমার কানে বারংবার শুধু একটা শব্দই ভেসে আসছে। আমার ইজ্জত, আমার সম্মান, বেয়াদব মেয়ে, কথা শুনে না ইত্যাদি। মা আব্বাকে থামাতে পারছেন না।
আমার মাথায় আস্তে আস্তে অনেকটা ব্যালেন্স চলে আসছে।আমি শুনতে পাচ্ছি আব্বা এবার মা’কে আক্রমণ করেছেন।
না আব্বা কখনোই মায়ের গায়ে হাত তুলেনি জীবনেও। আমাদের বোনদেরকেও গায়ে হাত দিয়ে মারেননি এর আগে।আমার সেভাবে মনে পড়ছে না। কিন্তু আব্বা দিন দিন কেমন বদলে যাচ্ছেন।
আব্বা মা’কে বলেই যাচ্ছেন।
——সব তোমার দোষ। মেয়েকে মানুষ করতে পারোনি। ইত্যাদি।
আমি মাটিতে বসেই রইলাম। চোখ দিয়ে অনবরত পানি পড়ছে।আমি ভাবতে থাকলাম।
আব্বা কেন আজকে তার ইজ্জত আর সম্মান গেলো গেলো করল! আমি তো আমার বাবার ইচ্ছেতে দেয়া বিয়েটা মেনে নিয়ে বাবার সম্মান বাঁচালাম। আবার আমি সেই সম্মান হারিয়ে ফেললাম কী করে! মনে হলো আসলে মান ইজ্জত কী এতো সহজ বিষয়! সামান্য সামান্য কারণে তা চলে যায়! তাহলে নিজের সাধ ও স্বপ্ন বিসর্জন দিয়ে আমি কেন বিয়ের সব মেনে নিলাম! হায়রে মেয়ে জীবন! মান ইজ্জত জিনিসটা পুরুষের বানানো জিনিস। আর তা খুইয়ে ফেলার সরঞ্জাম হলো মেয়েরা!
আচ্ছা আব্বা কেন আমার কারণে মা’কে কথা শোনাল! কেন বার-বার মা’কে বলছে। মা আমাকে মানুষ করতে পারেনি।আমার সব দোষের দোষী বানানো হচ্ছে আমার মা’কে। কেন! কেন সন্তান খারাপ হলে তার জন্য মা’কে দোষারোপ করা হয়! বাবাকে কেন নয়! সন্তানকে ভালো মানুষ বানানোর দায় কী কেবল মায়ের! বাবার কেন নয়! মা নরম মানুষ বলে! আমাদের সমাজের মায়েরা কী কথায় কথায় সন্তানের পিতাকে সন্তানের জন্য দোষারোপ করতে পারে! আমি তো দেখিনি!
আমার কেমন নারী জন্মের প্রতি বিতৃষ্ণা এসে যেতে লাগল। মনে পড়লো আমার মা বাবার পরিবর্তনগুলো। আমার আব্বা এমনটা ছিলেন না। আব্বা অনেক আধুনিক মন মানসিকতার মানুষ ছিলেন। আব্বার সময়ের তিনি আইএ পড়া মানুষ। মা ক্লাস সেভেন। কত কত নভেল আমার মায়ের আলমারিতে। দেশি বিদেশি কত কত রোমান্টিক আর শিক্ষা মূলক উপন্যাস সব। আব্বা মা একসাথে পাশাপাশি শুয়ে বইগুলো পড়তেন, গান শুনতেন আমরা ছোটবেলা থেকে দেখেছি। কেসেট প্লেয়ারে ভারতীয় বাংলা গান বাজতো, উর্দু গজল ও গান বাজত। মা শুনতেন আর কাজ করতেন। আব্বা আমাকে কোলের উপরে বসিয়ে বসিয়ে ডাক্তার বানানোর স্বপ্ন দেখাতেন। ঢাকা থেকে সুন্দর সুন্দর আধুনিক ফ্যাশনের জামা জুতা এনে দিতেন। ব্যাবসায়ের জন্য আব্বা কলকাতায় যেতেন।কত কী আমাদের জন্য নিয়ে আসতেন।

আমার সেই বাবাটা গত কয়েক বছরে কেমন বদলে গেলেন। তার চিন্তা ভাবনা জীবন যাপন, বিশ্বাস ও আচরণ সব।

আমার আব্বার ব্যাবসা খুব ভালো চলছিল। আমরা ভাই বোনেরা সবাই একরকম ছোটো ছোটোই বলা যায়।সবাই পড়াশোনা করছি। হঠাৎ জানতে পারলাম আব্বা হজ্জ করতে যাবেন। আমি সেভাবে কিছুই বুঝলাম না। কারণ গাঁয়ের মানুষরা সবাই বৃদ্ধ বয়সে হজ্জে যায় এসবই দেখেছি। মা প্রথমে খুব কান্নাকাটি করলেন। পরে শান্ত হয়ে আব্বাকে সমর্থন দিলেন। আব্বা হজ্জ করে ফিরে এলেন। সেই থেকে আব্বার পোশাক পরিবর্তন হলো। আব্বা আর আগের মতো শার্ট প্যান্ট পরেন না। সৌদি আরবের লোকজনের মতো লম্বা লম্বা সাদা ও ক্রিম কালারের গলা থেকে পা পর্যন্ত সব পোশাক পরেন। আমার দাদাও হজ্জ করেছিলেন। কিন্তু আব্বা হজ্জ করে আসার পরে আমাদের বাড়ি অটোমেটিক হাজি বাড়ি হয়ে গেল। আব্বার ধ্যান ধারণার পরিবর্তন এলো ভীষণ। আব্বার ব্যাবসা প্রতিষ্ঠান তার পার্টনার বন্ধু নিজে কব্জা করে নিলেন। আব্বা নিজে আর ব্যাবসা করবেন না বলে বাড়িতেই থেকে গেলেন।কারণ তিনি হজ্জ করেছেন।এখন আর কোনো বানিজ্যিক কারবারে যাবেন না। কোনটা থেকে কী ধরনের গুনাহ চলে আসে। তাই নিজের সহ আমাদের জীবন গুটিয়ে নিতে লাগলেন। মেয়েদেরকে আর লেখাপড়া করাবেন না বলে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন। মা বোরখা পরা শুরু করলেন। আব্বা ও মায়ের আর কোনো গান শোনা হয় না। আমরাও বাড়িতে আর গান ও রেডিও বাজাতে পারি না। আব্বা দিনের বেশির ভাগ সময় ধর্মীয় বই পুস্তক নিয়ে ডুবে থাকেন। আমাদের এতোদিনের পরিচিত বাবাকে আমরা হারিয়ে ফেললাম।

আমার সেই হারিয়ে ফেলা আব্বার হাতে আজ চড় খেয়ে আমি কতক্ষণ মাটিতে বসে ছিলাম জানি না। অনবরত মশার কামড়ে আমার ভাবনায় ছেদ পড়ল। আমি উঠে হাতমুখ ধুয়ে রুমে এসে দেখি মা আমার পড়ার টেবিলে ভাত তরকারি রেখে গেছেন। আমার খুব কান্না পেলো আবারও। তবে ক্ষুধাটাও পেয়েছে ভীষণ। নাকের পানি চোখের পানি মুছতে মুছতে আমি খাবার খেয়ে নিলাম। হঠাৎ খুব শীত অনুভব করলাম। এই গরমের দিনে এতো কাঁপিয়ে শীত করবে কেন! বুঝলাম আমার শরীরে খুব জ্বর উঠেছে।
আমার খুব রাশেদের কথা মনে পড়ল। আমার খুব করে রাশেদের স্পর্শ পেতে ইচ্ছে করল। পারলে আমি এখনই একটা ভোঁদৌড়ে পৌঁছে যেতাম আমার প্রিয় স্বামী রাশেদের কাছে। রাশেদ আমাকে কত্ত ভালোবাসে। মনে হলো এই একটা মানুষের ভালোবাসার জন্যও তো একটা দু’টো জীবন বেঁচে থাকা যায় অনায়াসে। আমি কাঁথা বের করে শরীরে পেঁচিয়ে নিলাম।চিঠি লেখার জলছাপের নীল রঙা প্যাড আর কলম নিয়ে আমার স্বামী রাশেদকে আবারও চিঠি লিখতে বাসলাম।

আমার প্রিয় রাশেদ,
তোমাকে……………

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here