গল্পঃ #অন্তরালের_অনুরাগ
লেখনীতেঃ #নাহিদা_নীলা
#পর্বঃ ১৩ ❤প্রপোজ❤
সাদিদ আজ সারাটাদিন নীলাকে নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে। এতটা লং ডাইভের জন্য নীলা সন্ধ্যার পরপরই না খেয়ে ঘুম দিয়েছে। নার্গিস খাতুন একদফা ডেকে গিয়েছে, কিন্তু নীলার উঠবার নামগন্ধ নেই। তাই তিনি সেন্টার টেবিলে একগ্লাস দুধ রেখে গিয়েছেন। যদিও দুনিয়া উল্টিয়ে গেলেও নীলা এই দুধের গ্লাস খালি করবে না। তারপরও যদি খিদে লাগলে খেতে পারে সেইজন্যই রাখা। ঘড়ির কাটা টিকটিক করে দশটা পনেরোতে এসে ঠেকেছে। নার্গিস খাতুনও এবার ডাইনিং টেবিল গুছিয়ে শুবার রুমে গিয়েছেন। সারাদিন তো আর বসে থাকেন না। মানুষ কম হলেও তাকে একহাতে সবকিছু সামলাতে হয়।
নার্গিস খাতুন নীলার রুমের সবুজ রঙের ডিমলাইটটা জ্বালিয়ে গিয়েছেন।
তাই আধ-অন্ধকার রুমে একজন মানুষের ছায়া স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। রুমের বারান্দায় অল্প আওয়াজ হতেই নীলা আরেক পাশ ফিরে কাঁথা মুড়ি দিলো।
ছায়াটা গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে এসে বিছানার সামনে দাঁড়াল। নীলাকে এলেমেলো হয়ে ঘুমাতে সে দেখে নিঃশব্দে হাসল। তারপর এগিয়ে গিয়ে দরজাটা লক করে দিলো।
নীলা বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। চুল বিনুনি পর্যন্ত করেনি। তাই একেবারে এলেমেলো হয়ে আছে। মধ্যরাতে প্রেয়সীর রুমে হামলাকারী প্রেমিক মুগ্ধ চোখে তার প্রাণপাখিকে দেখছে।
সাদিদ এবার এগিয়ে এসে বিছানায় বসল। নীলার মুখের উপর পরে থাকা এলেমেলো চুলগুলোকে আলতো হাতে সরিয়ে দিলো। একদৃষ্টিতে অপলক চেয়ে থেকে নিচু হয়ে নীলার কপালে গভীর ভালোবাসায় চুমু এঁকে দিলো। ঘুমের মধ্যে উষ্ণ স্পর্শে নীলা মৃদু কেঁপে উঠতেই সাদিদ আবারও নিঃশব্দে হাসল।
প্রাণপাখিকে সুন্দর ঘুমটা থেকে জাগানোর তার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে করছে না। কিন্তু তারপরও যে কাজটা করা অতিবজরুরি।
সাদিদ নীলার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে মৃদুস্বরে ডাকল,
— ‘ প্রাণপাখি? ‘
নীলা অপরপাশ হয়ে শুয়ে পড়ল। কিন্তু তার ঘুম ভাঙল না। সাদিদ উঠে গিয়ে অপরপাশে আসলো। নীলার গালে আলতো করে হাত বুলাতে বুলাতে আবারও ডাকল,
— ‘ প্রাণপাখি উঠ। আমি এসেছি। ‘
নীলা এবার ঘুমঘুম চোখে চোখ খোলে তাকাবার চেষ্টা করল। হালকা আলোয় সাদিদের প্রতিৎছবি দেখে সে ভাবল স্বপ্ন দেখছে। তাই মৃদু হেসে আবারও চোখ বন্ধ করল।
সাদিদ নীলার কর্মকান্ড দেখে এবার ছোট্ট করে একটা শ্বাস টানল। পাশের টেবলি থেকে পানি নিয়ে অল্প একটু পানি ছিটা দিতেই নীলা দ্রুত চোখ খোলে তাকালো। অবিশ্বাসের ন্যায় সাদিদকে দেখে চিৎকার দিতে গেলেই সাদিদ তার মুখ চেপে ধরল।
— ‘ এই একদম না। আমিতো, ভয় পাচ্ছ কেন? ‘
— ‘ উমম উম..
সাদিদ মুখ থেকে হাত সরিয়ে নিতেই নীলা ঘুম জড়ানো কন্ঠে ফিসফিসিয়ে বলে উঠল,
— ‘ ভয় পাব না? এমন ভূতের মতো এতরাতে এখানে কি করছেন? ‘
— ‘ ফোন কই তোমার? ‘
— ‘ কেন, ফোন দিয়ে কি কাজ? ‘
— ‘ কেননা সেইটা দিয়ে এখন তোমার মাথা ফাটাব। ‘
নীলার এবার কন্ঠ খানিকটা খাদে নেমে গেল। ফোন সংক্রান্ত কোনো বিষয় নিয়ে হয়তো সাদিদ এতরাতে এসেছে। তাই পাশের ড্রয়ার থেকে চুপচাপ ফোনটা হাতে নিলো। কিন্তু ফোনের লক খোলে স্ক্রিনে চোখ যেতেই নীলা একটা শুকনো ঢুক গিলল। ভয়ে ভয়ে সাদিদের দিকে তাকাতেই সাদিদের কপাল কুঁচকে রাগ প্রকাশ করার পদ্ধতিটা দেখতে পেল।
— ‘ কি? এবার বুঝতে পেরেছ এতরাতে এখানে কেন? ‘
— ‘ সরি আসলে ফোন সাইলেন্ট মুডে ছিল। কলেজ থেকে তো সোজা আপনার সাথেই ছিলাম। তারপর আর জেনারাল মুড অন করতে ভুলে গিয়েছি। ‘
নীলার এলেমেলো দৃষ্টি দেখে সাদিদ এবার মুচকি হাসল। কাছে বসে নীলার সামনে আসা চুলগুলো কানের পিছনে খোঁজে দিলো। নীলাও এবার মৃদু হাসল। কিন্তু পরমুহূর্তেই প্রায় চেঁচিয়ে উঠল,
— ‘ আপনি এতরাতে আমার রুমে কিভাবে আসলেন? ‘
— ‘ যেভাবে বাকি মানুষজন আসে। আই মিন হেঁটে হেঁটে। ‘
— ‘ এটা আমার প্রশ্নের উত্তর নয়। সত্যি করে বলুন। ‘
— ‘ আমার হাতে কোনো রাস্তা ছিল না। তুমি ফোন ধরছিলে না, তারউপর তোমার জন্য বাসার সবাইকেও এখন জানাতে পারব না। তাহলে বারান্দা ছাড়া আর উপায়টা কি? ‘
— ‘ আপনি বারান্দা দিয়ে এসেছেন? কিন্তু কিভাবে? ‘
— ‘ একটু কষ্ট হয়েছে। বাট ব্যাপার না। ‘
নীলা এবার উঠে গিয়ে রুমের এলইডি লাইটটা দিয়ে দিলো। তীক্ষ্ণ চোখে সাদিদকে উপর থেকে নিচ পরখ করতে লাগল।
— ‘ আরে বেবি, এভাবে দেখার কি আছে? আ’ম টোটালি ফাইন। এভাবে গুটুরগুটুর করে দেখো না তো৷ ইটস এম্বাররেসিং মি। ইউ নো না আ’ম এ সাই বয়। ‘
সাদিদের বলার ধরণ আর এক্সপ্রেশন দেখে নীলা মুখ চেপে হাসল। কিন্তু তারপরও কপট রাগ দেখিয়ে বলল,
— ‘ আপনি লাজুক হলে পৃথিবীতে নির্লজ্জের ডেফিনেশন পাল্টে যাবে। ‘
— ‘ কেন? আমি এমন কি কাজ করলাম যে আমার নামে এমন অপবাদ রটাচ্ছ? বলো, আমি কি তোমাকে কখনও ঝাপটে ধরে এলোপাতাড়ি চুমু খেয়েছি? নাকি কখনও ফাঞ্চ কিস করেছি না তোমাকে বেডে নিয়ে…
— ‘ দোহায় লাগি থামুন। এমন লাজুক ছেলে আমি পৃথিবীর আনাচে-কানাচেতে অণুবীক্ষণযন্ত্র দিয়ে খোঁজলেও পাব না। ‘
নীলা দুইহাত কানে চেপে ধরে প্রায় চেঁচিয়ে কথাটা বলল। নীলার এমন অবস্থা দেখে সাদিদ বেশ ভাব নিয়ে বলল,
— ‘ আরে আস্তে, প্রশংসা করতে চাও ভালো কথা এমন চিল্লাচিল্লি করছ কেন? আমি এতটা করতেও বলিনি। বুঝলে, আমি অনেক দয়ালু মানুষ। অল্প করলেই সন্তুষ্ট। ‘
সাদিদের এমন বেপরোয়া ভাব দেখে নীলা পারছে না নিজের চুল টেনে ছিড়তে। সবটা যে নীলাকে হেনস্তা করার পায়তারি সেটা তার বুঝতে কষ্ট হচ্ছে না। নীলার এমন অসহায় ফেইস দেখে সাদিদ এবার হেসে দিলো। এগিয়ে এসে নীলার গালে হাত রেখে কপালে ছোট্ট করে চুমু খেল।
— ‘ আচ্ছা আর বলব না। এখন এখানে এসে বসো। একটা ইম্পরট্যান্ট কাজ আছে। ‘
সাদিদ নিজেই নীলাকে টেনে এনে বিছানায় বসাল। তারপর নীলার পড়ার টেবিলের উপর থেকে নীল রঙের একটা শপিং ব্যাগ নিয়ে আসলো। নীলা অবাক চোখে দেখছে। নিজের রুমে এই জিনিসটা রাখা কিন্তু সে তো ঘুমানোর সময় দেখল না। এখন কোথায় থেকে আসলো? নীলার চিন্তা-ভাবনার মধ্যেই সাদিদ এসে তার পাশে বসল। ব্যাগটা নীলার হাতে দিয়ে বলে উঠল,
— ‘ তোমার জন্য। ‘
— ‘ কি এটা? ‘
— ‘ খোলে দেখ। ‘
নীলা ব্যাগটা খোলতেই অবাক চোখে সাদিদের দিকে তাকালো। অপরদিকে সাদিদের ঠোঁটের কোণে মিষ্টি হাসি।
একটা রেড কালারের ওয়েটলেস জর্জেট শাড়ি। যার ফ্রুল বর্ডার গোল্ডেন স্টোনের কারুকার্যে তৈরি করা। নীলা শাড়িটার উপর আলতো হাতে ছুঁয়ে দিলো। শাড়িটা খুব সুন্দর হয়েছে। সাদিদের পছন্দ আছে বলতে হবে। কিন্তু শাড়ির সাথে মেচিং করা টাইআপ ব্লাউজ সহ অনন্য প্রয়োজনীয় জিনিস দেখে নীলা লজ্জা না পেয়ে থাকতে পারল না। নীলার মুখে ঈষৎ লালাভ বর্ণ দেখে সাদিদ দুষ্টু হেসে বলল,
— ‘ লজ্জা পাওয়ার কি আছে? এগুলো ছাড়া কি শাড়ি পরা যায় নাকি? ‘
— ‘ আপনি একটা নির্লজ্জ। ‘
— ‘ এটা কেমন কথা? যদি বাকি জিনিসগুলো না আনতাম তাহলে হয়তো এই অপবাদটা মানা যেত। উইথআউট ব্লাউজে তোমাকে কতটা লোভনীয় লাগত সেটা আন্দাজের বাহিরে৷ আমি এত কষ্ট করে নিজেকে সংবরণ করলাম আর তুমি কি-না আমাকেই এমনটা বলছ? ‘
নীলার কান দিয়ে মনে হচ্ছে গরম ধোঁয়া বের হচ্ছে। দোষটা তারই, কেননা সে ভালোই জানে সাদিদ কেমন ঠোঁট কাটা স্বভাবের। তারপরও সে যেচে গিয়ে বারবার লজ্জায় পড়ে।
নীলার অবস্থা দেখে সাদিদ ঠোঁট টিপে হাসছে। প্রাণপাখিটাকে আর জ্বালাতে চায় না৷ তাই উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
— ‘ পাখি, শাড়িটা দ্রুত পরে নাও। আমি বারান্দায় ওয়েট করছি। হয়ে গেলে বলে দিও। ‘
— ‘ মানে? এখন শাড়ি পরব? ‘
— ‘ জ্বি, মহারাণী এখনই পরবেন। ‘
— ‘ কিন্তু সেটা সম্ভব নয়। ‘
— ‘ কেন, অসম্ভবের কি আছে? ‘
নীলা এদিক-সেদিক তাকিয়ে হাতের নখ খুঁটে যাচ্ছে। নীলার এমন ভাবসাব দেখে সাদিদের কপাল কুঁচকে এলো।
— ‘ কি হয়েছে পাখি, কোনো সমস্যা? ‘
— ‘ না মানে.. আসলে আমি শাড়ি পরতে পারি না। ‘
সাদিদের মাথায় হাত পড়ার অবস্থা। তাহলে এখন কি হবে? সাদিদের সব প্ল্যানে জল পড়বার জোগাড়। সাদিদ কপালে দুই আঙ্গুল দিয়ে স্লাইড করে সমস্যা সমাধানের উপায় খোঁজে চলছে। হঠাৎ মাথায় কিছু আসতেই সে বলে উঠল,
— এককাজ করো, বাকি সব জিনিসগুলো পরে আস। তারপর দেখছি কি করা যায়। ‘
— ‘ মানে? ‘
সাদিদের কথা শুনে নীলার চোখ বেড়িয়ে আসার উপক্রম। সাদিদ দ্রুত বলে উঠল,
— ‘ পাখি, এমন করে চেঁচাও কেন? ‘
— ‘ নতুবা কি করব? আপনার কথা শুনে আমার এখনই হার্ট অ্যাটাক করার অবস্থা হয়েছিল। ‘
— ‘ খালি আজেবাজে কথা। দ্রুত যাওতো, তোমার জন্য এমনিতেই অনেক লেইট হয়ে গিয়েছে। ‘
— ‘ আরে আমি শাড়ি পরতে পারি না তো৷ ‘
— ‘ আমি আছি কি করতে? আমি পরিয়ে দেব। ‘
— ‘ কি? ‘
সাদিদ এবার দ্রুত এসে নীলার মুখ চেপে ধরল। চোখ রাঙিয়ে বলে উঠল,
— ‘ আর একবার চেঁচালে বারান্দা দিয়ে নিচে ফেলে দিব। চুপচাপ বাকি জিনিসগুলো পরে আস। ‘
নীলা এবার চুপচাপ এগিয়ে যেতে লাগল। সে জানে সাদিদ কখনও এমনটা করবে না। তারপর সাদিদের রাগীস্বরে তার চোখ ম্লান হয়ে গেল। নীলা মাথা নিচু করে ওয়াসরুমের দিকে এগিয়ে যাওয়া ধরতেই সাদিদ এসে তাকে আটকে দিলো। নীলাকে পিছন থেকে হালকা করে জড়িয়ে ধরে তার কাঁধে নিজের থুতনি রাখল। নীলা এখনও চুপচাপ মাথা নিচু করে আছে।
— ‘ রাগ করেছ? ‘
নীলা শুধু ডানে-বামে মাথা নাড়ল। কিন্তু মুখে কিছু বলল না। সাদিদ নিঃশব্দে মৃদু হাসল। নীলাকে পিছন থেকে ঘুরিয়ে এনে নিজের মুখোমুখি দাঁড় করাল। সাদিদ নীলার মুখটা উঁচু করে ধরতেই তার অশ্রুসিক্ত চোখগুলো দেখতে পেল। সাদিদ নিচু হয়ে নীলার দুই চোখের পাতায় চুমু দিলো। গালে হাত রেখে আদরমাখা কন্ঠে বলল,
— ‘ এইটুকু ধমকে কেউ কান্না করে? ‘
নীলা অভিমানে চুপ করে রয়েছে। সাদিদ এবার তাকে বুকে টেনে নিয়ে বলে উঠল,
— ‘ আচ্ছা সরি। আসলে অনেক রাত হয়ে যাচ্ছে। তারউপর তুমি এটা সেটা বলে সময় নষ্ট করছ। নতুবা রাগ দেখাতাম না। বিষয়টা গুরুত্বপূর্ণ, না হয় এত রাতে শাড়ি পরতে জোর করতাম না। ‘
— ‘ না সমস্যা নেই। আসলে যারা খুব আদর করে হঠাৎ করে তাদের শাসনগুলো সহ্য করা যায় না। ‘
— ‘ ইশশ কি পাকামো কথাবার্তা! আচ্ছা তাহলে এবার যান, আমি ওয়েট করছি। ‘
নীলা এবার মৃদু হেসে চুপচাপ ওয়াসরুমে চলে গেল। নীলা যেতেই সাদিদ ছোট্ট আরেকটা ব্যাগ থেকে একজোড়া হুয়াইট এন্ড গোল্ডেন পুলকিসের সাথে আইভরি পার্লের স্পিনডিড মাল্টি স্টেরন্ড ঝুমকা এবং কাচের লাল দুই চুড়ি বের করল। মুখে তার মিষ্টি হাসি। তারপর নিজের ফোনটা পকেট থেকে নিয়ে কতগুলো এনিমেশনে ক্রিয়েট করা শাড়ি পরানোর ভিডিও দেখতে লাগল। দেখতে দেখতে সেন্টার টেবিলে রাখা দুধের গ্লাসটাও তার চোখে পড়ল।
কিছুসময় পর দরজা খোলার আওয়াজে সাদিদ পিছনে ফিরল। নীলাকে দেখে তার মুহূর্তেই ঘাম বের হবার অবস্থা।
মাথাটা বারকয়েক ঝাকিয়ে আবারও সে নীলার দিকে তাকালো। নীলা টাওয়েল দিয়ে নিজেকে কভার করার চেষ্টা করছে। সাদিদ ফোনটা রেখে দিয়ে ধীরপায়ে নীলার দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। সাদিদের উপস্থিতি টের পেয়ে নীলা আরও জড়সড় হয়ে দাঁড়াল। সাদিদ এগিয়ে এসে নীলাকে উপর থেকে নিচ আবারও একবার দেখে নিলো। তারপর নীলার হাত টেনে বিছানার সামনে নিয়ে আসলো। বিছানার পাশে নীলার সাদা-আকাশি উড়নাটা রাখা ছিল। সাদিদ সেটা হাতে নিয়ে নিজের চোখের উপর ভালোকরে বেঁধে নিলো।
তারপর শাড়িটা হাতে নিয়ে নীলার শরীর থেকে তোয়ালেটা নিচে ফেলে দিলো। সাদিদ চোখ বন্ধ রেখেই নীলাকে শাড়িটা পরাতে লাগল। সাদিদের হাতের স্পর্শ নীলার শরীরে লাগছে আর নীলা বারবার কেঁপে কেঁপে উঠছে। সাদিদ যে সেটা বুঝতে পারছে না এমনটা নয়। সেও নীলার কম্পন অনুভব করছে। কিন্তু হাতে যে আর কোনো রাস্তা নেই৷ নীলা এবার কাঁপা কাঁপা স্বরে বলল,
— ‘ আমাকে দিন। যতটা পারব চেষ্টা করব। ‘
— ‘ তুমি ভালোকরে শাড়িটা গুঁজে নাও। আমি এটা ঠিকভাবে পারছি না। ‘
সাদিদের কথায় নীলা ভীষণ লজ্জা পেল। তারপর সেও যতটুকু পারে সাদিদের সাথে সহায়তা করতে লাগল।
শাড়ি পরানো শেষ হতেই সাদিদ চোখের উপর থেকে উড়নাটা সরাল। নিজের প্রাণপাখিকে এতটা সুন্দর লাগছে যে সাদিদের বোধহয় নিজের চোখ-ই লেগে যাবে। সাদিদ নীলার গালে হাত রেখে কপালে দীর্ঘ চুমু খেল। নীলা লাজুক হেসে মাথা নিচু করল।
সাদিদ তার হাতে ধরে ডেসিংটেবিলের সামনের ছোট্ট টোলে বসিয়ে দিলো। তারপর উঠে গিয়ে দুধের গ্লাসটা নিয়ে আসলো।
— ‘ রাতের খাবার যে খাওনি সেটা আর বলতে হবে না। চুপচাপ দুধটা শেষ করো। ‘
— ‘ আম্মুর মাথা নষ্ট। তাই বোধহয় এই অখাদ্যটা এখানে রেখেছি। আমি সজ্ঞানে এই জঘন্য জিনিস খেতে পারব না। ‘
— ‘ আমার হাতের কয়েকটা থাপ্পড় খেলে সব খেতে পারবে। জলদি শেষ করো। ‘
— ‘ প্লিজ না। এটা ছাড়া সব। ‘
— ‘ কোনো কথা নয়। শেষ মানে শেষ। ফিনিস ইট কুয়েকলি। ‘
নীলার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা না থাকলেও নাক চেপে ধরে আধা গ্লাস শেষ করল।
— ‘ আর পারব না। নতুবা বমি আসবে। ‘
সাদিদ আর জোর করল না। গ্লাসটা রেখে দিয়ে নিজেই যত্ন নিয়ে নীলাকে দুইহাতে চুড়ি, কানের দুল পড়িয়ে দিলো।
— ‘ পাখি সাজতে হবে না। শুধু কাজল থাকলে অল্প একটু লাগাতে পার। ‘
নীলা মৃদু হেসে চোখে কাজল টানল। তারপর একপলক সাদিদকে দেখে নিয়ে শাড়ির সাথে মেচিং করে গাঢ় লাল লিপস্টিকও দিলো। তারপর চুলগুলোকে সাইড সিঁথি করে, খোলা রেখে ব্রাশ করে নিলো।
নীলার শেষ হতেই আয়নায় সাদিদের দিকে তাকালো। সাদিদ নেশাক্ত চোখে নীলার দিকে তাকিয়ে আছে৷ নীলা দ্রুত চোখ নামিয়ে নিলো। তার বুকে টিপটিপ আওয়াজ হচ্ছে। সাদিদ সময় বিবেচনা করে বারকয়েক মাথা ঝাকালো। নীলাকে এভাবে দেখে নিজেকে তার উন্মাদ মনে হচ্ছে। কোনোভাবেই নিজেকে সামলিয়ে রাখতে পারছে না। তার নিজেকে বড্ড এলেমেলো লাগছে।
সাদিদ এগিয়ে এসে নীলাকে দাঁড় করালো।
— ‘ পাখি চলো। ‘
— ‘ কিন্তু যাব কিভাবে? আমিও কি আপনার মত বেয়ে বেয়ে নামব নাকি? খবরদার আমি এসব পারি না৷ ‘
— ‘ ইশশ পারি না! এভাবেই আসতে হবে। নতুবা চলো আঙ্কেল-আন্টিকে বলে তারপর অনুমতি নিয়ে যাব। ‘
— ‘ এই না, না। আম্মু-আব্বু জানলে আমি লজ্জায় মরে যাব। ‘
— ‘ একদিনতো জানবেই। আজ জানলে সমস্যা কি? ‘
— ‘ না প্লিজ। যখনেরটা তখন দেখা যাবে। এখন এসব না। ‘
— ‘ তাহলে তুমি নামবে কিভাবে? আচ্ছা আঙ্কেল-আন্টি বোধহয় এতক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছে। তুমি মেইন ডোর দিয়ে বের হও। ‘
— ‘ যদি ধরা পরে যাই? ‘
— ‘ তাহলে খুব ভালো হয়। যত তাড়াতাড়ি সবাই জানবে ততই মঙ্গল। ‘
— ‘ ইহ্ আসছে আমার মঙ্গল। মেরে হাড্ডি ভাঙবে। ‘
— ‘ মোটেই না। গিয়ে দেখ জামাই আদর করার জন্য বসে রয়েছে। ‘
নীলা লাজুক হাসল। তারপর সাদিদকে সহ দুইজনে একসঙ্গে বাসা থেকে বের হলো।
— ‘ লক করবে না? ‘
— ‘ হ্যাঁ করব। এইতো চাবি এনেছি। ‘
সাদিদ গাড়ির দরজা খোলে নীলাকে সিটে বসিয়ে নিজেও ডাইভিং সিটে বসল।
— ‘ বললেন না যে, আমরা কোথায় যাচ্ছি? ‘
— ‘ গেলেই দেখতে পাবে। ‘
— ‘ তাই বলে বলবেন না? ‘
সাদিদ নীলার দিকে তাকিয়ে হাসল। কিন্তু উত্তর দিলো না। সাদিদ যত এগিয়ে যাচ্ছে নীলার অজানা কারণে বুক ধুকপুক করছে। সাদিদের ভয়ে নয় রাতের জন্য ভয়। এতরাতে সাদিদ কোথায় যাচ্ছে?
— ‘ বলুন না কোথায় যাচ্ছি? অনেক রাত হয়েছে। এতদূর যাওয়া কি ঠিক হচ্ছে? ‘
— ‘ সরি পাখি। আমি নিজেও এতটা লেইট করতে চাইনি। কিন্তু তুমি সন্ধ্যার পর থেকে ফোন তুলছিলে না৷ তাই এতটা লেইট হয়ে গেল। ‘
নীলাকে ভয় পেতে দেখে সাদিদ গাড়ির স্পিড আরও বাড়িয়ে দিলো। রাতের পরিবেশে গাড়ির সংখ্যা কম। তাই ট্রাফিক প্রবলেম না হলে আর কোনো সমস্যা হবে না। প্রায় অনেকটা সময় ডাইভ করে সাদিদ আরকান বাজারে আসলো। নীলার কাছে জায়গাটা সম্পূর্ণ অপরিচিত। তাই সে এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখছে। সাদিদ আরও খানিকটা এগিয়ে গিয়ে অটো-রিক্সাটা দেখতে পেল। গাড়ি থামিয়ে সাদিদ নিচে নেমে নীলাকে হাত ধরে নিচে নামালো। শাড়ি পরে তার হাঁটতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। সাদিদ নীলার হাতে ধরে তাকে এগিয়ে আসতে সাহায্য করছে।
— ‘ ধীরে আস। নতুবা শাড়ি পায়ে লেগে পড়ে যাবে। ‘
সাদিদ নীলাকে নিয়ে অটোরিক্সাতে উঠল। নীলার অবাক লাগছে। সাদিদের হাবভাব তার কাছে সুবিধার ঠেকছে না। সাদিদ নীলার সন্দেহ প্রবল দৃষ্টি দেখে মৃদু হাসল। তাকে একহাতে জড়িয়ে নিয়ে বলল,
— ‘ মামা, একটু দ্রুত চলেন। ‘
অটো-রিক্সাটা একটা গ্রামঞ্চল হয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। কিছু সময় যাওয়ার পর নীলার নাকে গোলাপের ঘ্রাণ এসে লাগতে লাগল। মনে হচ্ছে সাদিদ তাকে কোনো গোলাপের রাজ্যে নিয়ে যাচ্ছে। গোলাপের ভীষণ কড়া ঘ্রাণ। নীলা উৎসাহ থামাতে না পেরে বলে উঠল,
— ‘ এত ঘ্রাণ? আমরা এটা কোথায় আসলাম? ‘
সাদিদ নীলাকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে নিয়ে এবার রহস্যের উদঘাটন করতে লাগল,
— ‘ এটা সাভারের বিরুলিয়া ইউনিয়নের সাদুল্লাহপুর গ্রাম। এটাকে গোলাপ গ্রামও বলা হয়। রাতের অন্ধকার বিধায় তোমার পাশের গোলাপের বাগানগুলো দেখতে পারছ না। ‘
— ‘ সত্যিই আমরা গোলাপ গ্রাম এসেছি? আমারতো বিশ্বাস-ই হচ্ছে না৷ ফোনে এই গ্রামের কত ছবি দেখেছি! ‘
নীলা এবার উৎসুক চোখে রাতের গোলাপ গ্রাম দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। সাদিদ কিছুদূর আসার পর গাড়ির চালককে থামাতে বলল।
নীলাকে নিয়ে একটু দূর এগিয়ে এসে সাদিদ তাকে আচমকা পাঁজাকোলে নিয়ে নিলো।
— ‘ আরে কি করছেন? নামান আমাকে। কেউ দেখবে। ‘
— ‘ এখন রাত। এই মুহূর্তে এখানে লোকজন নেই বললেই চলে। কিছু বাগানে হয়তো কয়েকজন কর্মচারী থাকবে, কিন্তু আমাদেরকে এই অন্ধকারে দেখবে না৷ ‘
— ‘ প্লিজ তারপরও নামিয়ে দিন। ‘
— ‘ চুপ। আর একটা কথা নয়। ‘
নীলা এবার চুপসে গেল। সাদিদের ধমক খেলে অটোমেটিকলি তার হাওয়া টাইট হয়ে যায়। সে চুপচাপ সাদিদের গলা জড়িয়ে ধরল। সাদিদ মৃদু হেসে নীলাকে নিয়ে সামনে এগিয়ে গেল। নীলাকে বাগানের মাঝখানে এনে দাঁড় করিয়ে সাদিদ একটু পিছিয়ে গেল।
আচমকা নীলার চারপাশে অসংখ্য ছোট্ট ছোট্ট লাল, সবুজ মরিচ বাতি জ্বলে উঠল। পুরোটা বাগান জুড়ে অসংখ্য মরিচ বাতি। নীলা এখন লাল-সবুজ আলোয় সবটা ভালোভাবে দেখতে পাড়ছে।
নীলা ঘাড় ঘুরিয়ে আশেপাশে দেখছে। একটা গোলাপ বাগানের মাঝখানে অল্প একটু ফাঁকা যায়গায় সাদিদ তাকে দাঁড় করিয়েছে। নিচে মাটি দেখা যাচ্ছে না। কেননা সম্পূর্ণটা অসংখ্য লাল গোলাপের পাপড়ি দ্বারা আবৃত। আশেপাশে হাজারো ফুল, পায়ের নিচে ফুলের বন্যা, মাঝখানে লাল টুকটুকে শাড়িতে নীলা অপলক দৃষ্টিতে এই সৌন্দর্য অবলোকন করছে৷ মুখে দিয়ে তার কোনো কথা বের হচ্ছে না। পুরো বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছে।
সাদিদের দিকে তাকাতেই সাদিদ মৃদু হাসল। এগিয়ে এসে নীলার গালে হাত রেখে কপালে চুমু দিলো। নীলা আবেশে চোখ বন্ধ করে ফেলল। সাদিদ তার বন্ধ চোখেও চুমু খেল। তারপর নীলার মুখটা আঁজলাভরে ধরে বলে উঠল,
— ‘ বহুবছর আগে কোনো এক কিশোরীকে দেখে এই বুকের হৃদস্পন্দন বেড়ে গিয়েছিল। সর্বপ্রথম নিজেকে কোনো মেয়ের প্রতি আসক্ত মনে হয়েছিল। সেই সময় নিজেকে আমার পুরোপুরি মাতাল মনে হয়েছিল। কিন্তু জানো, সেটা ছিল একটি পিচ্চি মেয়ে। বয়সেও পিচ্চি, কাজকর্মেও পিচ্চি। সে বান্ধবীদের হাত ধরে এখানে সেখানে দৌড়াদৌড়ি করত। তার শরীরে যৌবনের কোনো মাদকতা ছিল না। কিন্তু তারপরও আমি তাতে মাদকাসক্ত হয়ে পরেছিলাম। অনেক চেষ্টা করেছি এই নেশা থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে। নিজেকে তার থেকে হাজার মাইল দূরে রেখেছি। সবটাই ছিল তার আসক্তি পরিত্রাণ পাবার আকাঙ্ক্ষা। কিন্তু আমি পারিনি। সেই কৈশোরের পাগলামিতে ব্যস্ত মেয়েটি আমাকে পুরোপুরি এলেমেলো করে দিয়েছিল।
লোকে বলে দূরত্বে নাকি সম্পর্কের টান কমে যায়। লং ডিসটেন্স রিলেশনশিপে বিচ্ছেদ ঘটনাটা প্রায় অহরহ ঘটিত বিষয়। কিন্তু আমাদের মধ্যে কোনোরকম নামধারী সম্পর্ক ছিল না। দুইজন দুইজনের কাছে অপরিচিত আগন্তুক। কিন্তু তারপরও যেন দিনশেষে সেই মেয়েটি আমার সবচেয়ে কাছের। সম্পর্কবিহীন এতদূরে থেকেও তার প্রতি আমার আকর্ষণ বলো আর প্রীতি বলো কোনোটাই বিন্দুমাত্র কমেনি। বরং দিনকে দিন যেন তার প্রতি আরও আসক্ত হয়েছি। আর তার সংস্পর্শে নিজেকে জড়াতে পাগল হয়েছি৷
তাই এখন আর সম্পর্কের দূরত্বের সাথে ভালোবাসার টান এই কথাটাতে বিশ্বাস করি না। যদি ভালোবাসা অন্তরালের হয় সেটা কেবল চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়তেই থাকে। জায়গা, স্থান, কাল সেটাতে বিন্দুমাত্র পার্থক্য আনতে পারে না। আমি সেই অন্তরালের প্রেমিক। যে তার প্রাখপাখিকে নিজের সর্বোচ্চটা দিয়ে কাছে পেতে চাই। তার প্রতি আমার অনুরাগ সীমাহীন। এর সীমা যদি অন্তরাল অক্ষায়িত করে সঠিক নির্ধারণ করা যায়, তাহলে তার প্রতি আমার অন্তরালের অনুরাগ।
নীলার কথা থেমে গিয়েছে। চোখের পাতার নড়চড় খুবই ধীর। সে মুগ্ধ চোখে নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে দেখছে। নীলা এতটা বছর এই মানুষটাকে উপরে উপরে কত ঘৃণা করে গিয়েছে। অথচ সে তাকে কতটা চেয়েছে। দূরে থেকে একা একা কতটা সহ্য করেছে। নীলার চোখগুলো ম্লান হয়ে পড়ল। মুহূর্তের মধ্যে গাল বেয়ে কয়েকফোটা নোনাজল গড়িয়ে পড়ল। সাদিদ মৃদু হেসে যত্নে নীলার চোখের পানি মুছিয়ে দিলো। নীলার কপালে নিজের কপাল ঠেকিয়ে বলে উঠল,
— ‘ ভালোবাসি। ভীষণ ভালোবাসি। ‘
নীলা এবার আর সহ্য করতে পারল না। সাদিদ তাকে আজকেই প্রথম এই ম্যাজিকেল ওর্য়াডটা বলল। ” ভালোবাসি ” এতটা মধুর কোনো শব্দ হতে পারে? নীলার সত্যিই জানা নেই। খুশিতে নীলা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। সাদিদ বুঝতে পারছে নীলার কান্নার কারণটা। তারপরও সে মজা করতে বলল,
— ‘ এটাকে বলে মেয়ে মানুষ। সুখে কাঁদবে, দুঃখের সময়তো নিমন্ত্রণ ছাড়া কাঁদবে। এককথায় যেকোনো অযুহাতে তাদের কান্না করা অতি জরুরি। ‘
নীলা অশ্রুসিক্ত চোখে হেসে দিলো। সাদিদকে জড়িয়ে ধরে তার বুকে মুখ গুঁজল। সাদিদও নীলাকে শক্ত করে বাহুবন্ধনে জড়িয়ে নিয়ে তার মাথায় চুমু দিলো।
— ‘ বিধাতা নাকি জোড়ায় জোড়ায় নারী পুরুষ সৃষ্টি করেছে, তোমাকে দেখে আমার মনে হয় তুমি শুধু আমার জন্যই বিধাতার হাতে সৃষ্টি হয়েছ। তাইতো এত চেষ্টা করেও তোমার থেকে নিজেকে দূরে সরাতে পারিনি। বরং চুম্বকের ন্যায় বারবার আকর্ষণ করেছ। মধ্যকার দূরত্ব ছিল। কিন্তু ভালোবাসায় বিন্দুমাত্র দূরত্ব ছিল না। খুব ভালোবাসি। এতটা যা হয়তো বলে বুঝানো সম্ভব নয়। ‘
নীলা সাদিদের বুকে মুখ খোঁজে নিঃশব্দে সুখের অশ্রুজল ফেলছে। আওয়াজ না হলেও সাদিদের বুঝতে বিন্দুমাত্র সমস্যা হলো না। সে নীলাকে স্বাভাবিক করতে প্রসঙ্গ পাল্টালো,
— ‘ পাখি, আমাকে এই কথাটা বলবে না? ‘
— ‘ আপনি এই শব্দটা শুনার জন্য এখনকার মতো বঞ্চিত। আপনি নিজের মনের কথা এতটা আয়োজন করে বলেছেন। তাহলে আমি কি এমনি এমনি বলে দিব নাকি?’
— ‘ আরে ব্যস! প্রাণপাখি দেখি যথেষ্ট হিসাবি। ‘
— ‘ যেটা ইচ্ছা বলুন৷ কিন্তু এত সহজে বলব না। ‘
— ‘ তাহলে মহারাণী, আপনার মুখ থেকে এই ম্যাজিকেল ওর্য়াডটা শুনতে আমাকে কতদিন অপেক্ষা করতে হবে? ‘
— ‘ সেটা যে বলা মুশকিল। ‘
— ‘ এই জীবন থাকতে শুনতে পারব তো? ‘
নীলা ভয়ার্ত চোখে সাদিদের মুখ চেপে ধরল। মাথা ডানে-বামে করে এমনটা বলতে না করছে। সাদিদ মৃদু হেসে নীলার হাতে চুমু খেয়ে তাকে নিজের বুকে আগলে নিলো।
— ‘ বললেই সত্যি হয়ে যাবে নাকি? ‘
— ‘ প্লিজ আমি এমনটা আর কখনও শুনতে চাই না। ‘
— ‘ আচ্ছা যাও বলব না। কিন্তু এক শর্তে। ‘
— ‘ কি শর্ত?
সাদিদ নীলার ছেড়ে এককদম পিছিয়ে গেল। তার ঠোঁটে মুচকি হাসি। নীলা কেবল অবাক চোখে সাদিদকে দেখছে।
সাদিদ একহাঁটু গেঁড়ে নিচে বসে পকেট থেকে একটা রিং বক্স বাহির করল। নীলার সামনে আংটিটা এগিয়ে দিয়ে বলে উঠল,
— ‘ উইল ইউ মেরি মি? ‘
নীলা এখনও অবাক চোখে সাদিদের দিকে তাকিয়ে আছে। অতিরিক্ত শকে নীলা হিতাহিতজ্ঞান শূন্য হয়ে পড়েছে। একবার সাদিদের মুখের দিকে তাকাচ্ছে তো আর একবার সাদিদের হাতের আংটিটার দিকে তাকাচ্ছে। আংটিটা রাতের অন্ধকারে ঝিকমিক করছে। নীলাকে এমন একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে সাদিদ মৃদু হেসে বলে উঠল,
— ‘ পাখি, গিভ মি ইউর এন্সার। আ’ম ইগারলি ওয়েটিং। ‘
সাদিদের কথায় নীলার চোখজোড়া আবারও ম্লান হলো। অশ্রুসিক্ত চোখে নিজের বামহাতটা সাদিদের দিকে এগিয়ে দিলো। সাদিদ হাসিমুখে নীলার অনামিকা আঙ্গুলে আংটিটা পরিয়ে দিলো। নীলার গাল বেয়ে এবার চেপে রাখা অশ্রুকণাগুলো গড়িয়ে পরল। সাদিদ নীলার অবস্থা দেখে আবারও হাসল। কিন্তু আর কিছু বলল না। থাক না কিছু অশ্রুজল। সুখের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে যদি কয়েকফোটা নোনা জল গড়িয়ে পড়ে তাহলে তাতে ক্ষতি কি?
সাদিদ উঠে দাঁড়িয়ে নীলার বামহাতটা নিজের হাতে নিলো। তারপর রিং ফিঙ্গারটাতে শব্দ করে একটা চুমু দিলো।
— ‘ সিল করে রাখলাম। খুব শীঘ্রই নিজের বউ আনতে হাজির হব। তোমার এই লজ্জাবতী লাজুকলতার টাইটেলটা সরানোর সময় খুব শীঘ্রই নিয়ে আসব পাখি। তারপর দেখি তুমি কোথায় যাও। ‘
নীলা লাজুক হেসে সাদিদের বুকে কিল বসাল।
— ‘ অসভ্য একটা। এমন করলে বিয়ে ক্যান্সেল। ‘
— ‘ আসছে আমার রাণী এলিজাবেথ! সোজা উঠিয়ে নিয়ে যাব। তারপর একেবারে ছেলে-মেয়ে নিয়ে সবার সামনে হাজির হব। ‘
— ‘ ইশশ চুপ করুন তো। আপনি এতো ঠোঁট কাটা কেন? ‘
— ‘ বারে বিয়ে করব অথচ বাচ্চার বাবা হবো না? এটা কেমন বিয়ে? ‘
নীলার পক্ষে আর এসব লজ্জাজনক কথা শোনা সম্ভব নয়। তাই সাদিদকে ছাড়িয়ে পিছিয়ে যেতে চাইলে সাদিদ আবারও তাকে আটকে ধরল। পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে সে নীলার কাঁধে ঠোঁট ছোঁয়াতে লাগল। সাদিদের এমন স্পর্শে নীলা শাড়ি খামচে ধরল। সাদিদ নীলার উন্মুক্ত কাঁধে ঠোঁট স্পর্শ করে চুমু দিতেই নীলা কেঁপে উঠে সরে যেতে চাইল। কিন্তু সাদিদ শাড়ির উপর দিয়ে পেট জড়িয়ে ধরে, তাকে বুকের সাথে আরও মিশিয়ে নিয়ে নীলার গলায় চুমু দিতে লাগল। সাদিদের স্পর্শে নীলার নিঃশ্বাস ক্রমশ ঘন হয়ে আসছে। সাদিদ তাকে চুমু খেতে খেতেই নেশাক্ত কন্ঠে বলে উঠল,
— ‘ আমি আর অপেক্ষা করতে পারব না পাখি। অপেক্ষার প্রহর বড্ড পীড়াদায়ক। আগামীকালকেই মা-বাবার সাথে কথা বলব। পাখি তোমাকে খুব দ্রুত নিজের করতে চাই। এতটা বছর কতটা যন্ত্রণায় ছিলাম তোমাকে বলে বুঝানো সম্ভব নয়। কিছু মুহূর্ত তোমার একান্ত সংস্পর্শ পেতে বড্ড ছটফট করেছি। সেই রাতগুলোর কথা আর কখনও স্মরণ করতে চাই না পাখি। এখন শুধু ভালোবাসতে চাই। খুব ভালোবাসায় তোমাকে নিজের সাথে বেঁধে ফেলতে চাই। তোমার সর্বাগ্রে নিজের ভালোবাসার পরশ এঁকে দিতে চাই। ‘
নীলা জোরে জোরে শ্বাস ফেলতে লাগল। এমন কথা শুনে শরীর তার ঘেমে যাচ্ছে। সাদিদ চোখ বন্ধ করে পিছন থেকে নিজের গাল নীলার
গালে ঘষতে লাগল। সাদিদের খোঁচা দাড়িতে নীলার গালে হালকা লাগছে। আর সে কেঁপে উঠছে। নীলা বুঝতে পাড়ছে সাদিদ ক্রমশ নিজের উপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছে। তাকে এখনই বাঁধা দিতে হবে। নতুবা ভয়াবহ কিছু ঘটিয়ে বসবে। নীলা কাঁপা গলায় বলল,
— ‘ এবা..র আমাদের যেতে হ..বে। ‘
— ‘ নিশ্চয়ই যাব। তার আগে আমার ভিতরটা একটু শীতল করতে দাও। সেই কবে থেকে ভিতরটা পুড়ছে। আজকে যে সহ্য সীমার বাহিরে চলে যাচ্ছে। একটু ভালোবাসতে দাও। নতুবা দম আটকে মারা যাব। ‘
সাদিদের নেশালো কন্ঠে এমন কথা শুনে নীলা এবার কাঁপতে লাগল। নীলার শরীরের মৃদু কম্পন সাদিদকে আরও উত্তেজিত করে তুলছে। সে নীলাকে দ্রুত ঘুরিয়ে নিয়ে নিজের মুখোমুখি দাঁড় করালো। সাদিদের চোখে ক্রমশ ঘোর লেগে যাচ্ছে। সে নীলাকে বুকে চেপে ধরে তার পিঠের উন্মুক্ত দুই তৃতীয়াংশে হাত বুলাতে লাগল। নীলা চোখ বন্ধ করে সাদিদের জ্যাকেট খামচে ধরল। সাদিদ নীলার গলায় মুখ গুঁজল। সাদিদের খোঁচা খোঁচা দাড়ির আঘাত নীলার নরম গলায় লাগছে। আর নীলা শিহরিত হচ্ছে। সাদিদ তার গলায় চুমু খেতেই নীলার মেরুদণ্ড বেয়ে শীতল একটা শিহরণ বয়ে গেল। নীলা সাদিদের কাঁধের পিছনে হাত রেখে কাঁপা স্বরে অনুরোধ করল,
— ‘ প্লিজ এ..বার ছাড়ু..ন। ‘
— ‘ সম্ভব নয় পাখি। আরও ভালোবাসতে চাই। আরও অনেক বেশি। ‘
— ‘ অনে..ক রাত হচ্ছে। আমা..দের ফিরতে হবে। ‘
— ‘ এতো নির্দয় কেন তুমি? ভালোবাসিতো। আজকে একটু উষ্ণতা না পেলে বোধহয় দম আটকে যাবে। কিন্তু আমি যে আমার প্রাখিকে নিয়ে অনেকটাপথ হাঁটতে চাই। তাই তোমার এই নির্দয়তা মানব না। ‘
বলেই সাদিদ নীলার গলায় আস্তে করে একটা কামড় বসাল। আর নীলা সহ্য করতে না পেরে সাদিদের পিঠ শক্ত করে আঁকড়ে ধরল।
#চলবে…
[ প্রিয় পাঠকগণ, আপনাদের পাঠপ্রতিক্রিয়াগুলো আমাকে জানাবেন। আমি আপনাদের ভালোলাগা মন্দলাগাগুলো জানতে আগ্রহী। ]