অন্তরালের অনুরাগ ❤ পর্বঃ১৮

0
8140

গল্পঃ #অন্তরালের_অনুরাগ
লেখনীতেঃ #নাহিদা_নীলা
#পর্বঃ ১৮

সাদিদ জেগে উঠে নির্নিমেষ প্রাণপাখির ঘুমন্ত স্নিগ্ধ মুখটার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। আর নীলা সাদিদের বুকে মুখ গোঁজে গুটিশুটি মেরে শুয়ে রয়েছে। গতরাতের কথা ভাবতেই সাদিদের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটল। তৃপ্তিদায়ক হাসি। তার জীবনের মধুর রাতগুলোর মধ্যে নিঃসন্দেহে সেটি পাকাপোক্তভাবে জায়গা করে নিয়েছে। ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা টেনে সাদিদ নিজের ডানহাতটা নিয়ে নীলার মাথায় রাখল। অনেক ভালোবাসায় এবং যত্নে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। নীলা ঘুমের মধ্যেই আরাম পেয়ে সাদিদের সাথে আরও মিশে গেল। সাদিদ মৃদু হেসে নীলার মাথায় চুমু খেল। বুকের মধ্যে আরেকটু টেনে নিয়ে খুব যত্নে হাত বুলাতে লাগল।
কিছু সময় পর নীলার ঘুমটাও ভেঙে গেল। ঘুম ভাঙার পরপরই সে যে জিনিসটা উপলব্ধি করল সেটা হলো কারও হৃদয়ের ধুকপুকানি। নীলা পিটপিট করে চোখ খোলে তাকালো। তাকে কেউ নিজের সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে। সে মাথা উপরে তুলে তাকাতেই সাদিদের সঙ্গে দৃষ্টি মিলিত হলো। সাদিদ নীলার এলেমেলো চুলের সাথে ঘুমে হালকা ফোলে উঠা মুখটা একপলক দেখে নিয়ে মিষ্টি হেসে বলল,

— ‘ গুড মর্নিং সুইটহার্ট। ‘

নীলারও হাসল। কিন্তু পরমুহূর্তেই রাতের কথা আবারও মাথায় চলে আসতে তার দৃষ্টি নত হলো। এলেমেলো চোখে সাদিদের উন্মুক্ত বুক দেখতে লাগল। সঙ্গে ঠোঁটের কোণায় এসে যুক্ত হলো লাজুক রেখা। সাদিদ তীক্ষ্ণ চোখে নীলার সবটা পরখ করছে। তাকে অবাক করে দিয়ে নীলা নিজেকে সাদিদ থেকে ছাড়িয়ে নিলো। অন্যপাশে মুখ ফিরিয়ে চোখ বন্ধ করল। সাদিদ প্রথমে ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলেও পরমুহূর্তেই বিষয়টা আঁচ করতে পারল। নীলা রাতেও একবার এমনটা করেছে। সাদিদ নিচের ঠোঁট কামড়ে হাসল। তারপর নীলার দিকে এগিয়ে গেল। সাদিদের কাছে আসা টের পেয়ে নীলার শরীর মৃদু কাঁপতে লাগল। সাদিদ একেবারে নীলার শরীর ঘেঁষে এসে, তাকে পিছন থেকে টেনে নিজের বুকের সাথে চেপে ধরল। কম্বলের ভেতর দিয়ে হাত নিয়ে নীলার কামিজ বেধ করে পেট জড়িয়ে ধরল। সাদিদের উষ্ণ স্পর্শ পেতেই নীলা আবারও থেকে থেকে কেঁপে উঠল। সরতে চাইলে সাদিদ বাধা দিলো। নীলার কাঁধে মুখ গোঁজে দুষ্টুস্বরে বলল,

— ‘ মর্নিং ও বললে না আবার গিফটও দিলে না। এটা কেমন অভদ্রতা? ‘

নীলা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। কিন্তু দৃষ্টি স্থির রাখতে পারল না। আবারও লজ্জায় মুখ ফিরিয়ে আনল। সাদিদ এবার একটু উচ্চস্বরেই হাসল। নীলা তাতে আরও লজ্জা পেল। সাদিদ কম্বল পেঁচিয়ে নীলাকে টেনে বুকের উপর নিয়ে আসলো। তার গালে হাত রেখে মিহি স্বরে বলল,

— ‘ আমার লজ্জাবতী লাজুকলতা। ‘

নীলা বিনাবাক্য সাদিদের বুকে মুখ গোঁজল। সাদিদ হাসতে হাসতেই তার মাথায় চুমু দিলো। তারপর বলল,

— ‘ আমার গিফট? তোমারটা তো দিয়ে দিলাম। ‘

নীলা বুঝতে পেরে হাসল। লজ্জা লাগছে প্রচুর। তারপরও সাদিদের উন্মুক্ত বুকে ছোট্ট করে চুমু এঁকে দিলো। সাদিদ প্রশান্তিতে নীলাকে আরও শক্ত করে আগলে নিলো। প্রতিটি সকাল মনোমুগ্ধকর হওয়ার জন্য এর থেকে বেশি সাদিদের আর কি চাওয়ার আছে?

_______________

নাস্তা খাওয়ার সময় ঘটে গেল আরেক বিপত্তি। সাদিদ-নীলা টেবিলে আসতেই দুষ্টুগুলোর মিটমিটানি শুরু। সাদিদ দুই বন্ধুকে বার কয়েকবার চোখ রাঙিয়েছে। কিন্তু কে শুনে কার কথা! তারা তাদের দুষ্টুমিতে মসগুল। নীলা লজ্জায় পারে না এখান থেকে দৌড় লাগাতে। তানবীরের হঠাৎ করে সাদিদের গলায় চোখ পরতেই তার চোখজোড়া তীক্ষ্ণ হলো। দার্জিলিয়ে বেশ ঠান্ডা। তাই দুইজনে এমন প্যাকেট হয়ে আসলেও কেউ কিছু মনে করেনি। কিন্তু সাদিদের গলায় মাফলারটা তার ঠিক মাথায় আসছে। ছোটবেলার বন্ধু হিসেবে সে ভালোই জানে এমন ঠান্ডাতে সাদিদ গলায় মাফলার পেঁচাবে না। তুষারপাত ব্যতিত তাকে মাফলাতে খুব কম-ই দেখা যায়। সে আচমকা সাদিদের গলার মাফলারে টান দিয়ে সেটা নিজের হাতে নিলো। বিষয়টা এতটাই দ্রুততার সহিত ঘটেছে যে সাদিদ সেটা আঁচ করতে পারেনি। সে কিছু বলবে তার আগেই তানবীর বলে উঠল,

— ‘ তোর তো ঠান্ডা কম তুই এসব পরেছিস কেন…

সে কথা থামিয়ে দিলো। একদৃষ্টিতে সাদিদের দিকে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ করে ঠোঁট কামড়ে হাসতে লাগল। সাদিদের ইচ্ছে করছে এই মুহূর্তে ফাজিল ছেলেটাকে পাহাড়ের চূড়া থেকে ফেলে দিতে। তানবীরের দেখাদেখি সবাইও বিষয়টা খেয়াল করল। আর বুঝতে পেরে সবাই-ই মাথা নিচু করে ঠোঁট চেপে হাসতে লাগল। নীলার লজ্জায় মরে যাবার অবস্থা। সে দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে বলল,

— ‘ আ..আমার শেষ। কাজ..

সে কথা অসম্পূর্ণ রেখেই দৌড়ে রুমে গেল। সাদিদ বন্ধুুগুলোর দিকে একবার চোখ রাঙিয়ে নীলার পিছু গেল। নীলা সোজা বিছানায় গিয়ে উপুড় হয়ে শুয়েছে। দ্রুত শ্বাস উঠানামা করছে তার। সাদিদ দরজায় এসে দাঁড়াতেই নীলাকে দেখতে পেল। দরজাটা লক করে এসে সে নীলার পাশে বসল। আদরমাখা কন্ঠে ডেকে উঠল,

— ‘ পাখি? ‘
— ‘ জ্বি। ‘
— ‘ এই বউ?
— ‘ জ্বি। ‘
— ‘ এই প্রাণপাখি? ‘
— ‘ জ্বি। ‘
— ‘ এই বাবাইয়ের আম্মু? ‘
— ‘ জ…

নীলা এবার মুখ তুলে তাকালো। সাদিদের দুষ্টুমি বুঝে উঠতে পেরে লাজুক হাসল। সাদিদ নীলার পাশে শুয়ে পড়ল। একহাতে ভর দিয়ে নীলার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল নির্নিমেষ। নীলা লজ্জা পেয়ে হাসল। নিচুস্বরে বলল,

— ‘ সবাই কি ভাবছে? আমার খুব লজ্জা লাগছে। ‘
— ‘ কি ভাববে? এটা আমাদের জন্য নরমাল বিষয়। দুষ্টুগুলো এমনিতে ফাজিল হলেও তোমার সামনে কিছু বলবে না। তাই তুমি নিশ্চিতে থাক। ‘
— ‘ তারমানে আপনার সামনে বলবে? ‘

সাদিদ ঠোঁট চেপে হাসল। নীলার কানের সাথে মুখ লাগিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,

— ‘ শুধু বলবে না। বহুত কিছু করবে। তোমার হয়তো সেসব হজমে কোলাবে না। ‘

বলেই সাদিদ নীলার কানের লতিতে আলতো করে কামড় বসাল। নীলা তার কথায় এবং কাজে আরও লজ্জিত হলো। সাদিদ উঠে দাঁড়িয়ে বলল,

— ‘ আর লজ্জা পেয়ে লাভ নেই ম্যাম। এবার আমাদের যেতে হবে। তাই উঠুন। ‘

নীলা লজ্জারাঙা মুখটা নিয়ে সাদিদের সাথে চলে আসলো। সবার কাছে আসতেই তারা টেক্সিতে গিয়ে বসল।

.

সাদিদরা পদ্মজা নাইডু হিমালয়ান জুওলজিকাল পার্কের সামনে এসে থামল। এটি দার্জিলিং চিড়িয়াখানা নামে বেশি পরিচিত। প্রায় ৬৭.৫৬ একরের এই পার্ক হিমালায়ান পার্ক নামেও পরিচিত। দার্জিলিয়ে যত টুরিস্ট স্পট রয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি সময় লাগে এই দার্জিলিং জু দেখতে। কেননা এখানে এত বেশি দেখার জিনিস রয়েছে যে দেখে কূল করা যায় না। মোটামোটি ৩ ঘণ্টার উপর সময় লাগে এখানের সবকিছু ঘুরে দেখতে। পাহাড়ে অবস্থিত এই পার্কে হিমালায়ান অঞ্ছলের স্নো লিওপার্ড, সাইবেরিয়ান টাইগার, হিমালায়ান নেকড়ে, ক্লাউডেড লিওপার্ড, কালো ভাল্লুক ও রেড পাণ্ডার মতো বিরল কিছু প্রাণীসহ পাখি ও সরীসৃপ জাতীয় প্রাণীদের দেখা মিলবে।
এই জুলজিকাল পার্কে ছড়িয়ে আছে দুই শতাধিক প্রজাতির উদ্ভিদ, একশো বছরের পুরোনো বহু ওক গাছ এবং ৫০ এর বেশি প্রজাতির অাছে।
জুএর বার্ড সেকসনে আছে গোল্ডেন ফিজেন্ট, সিলভার ফিজেন্ট ও কালিজ ফিজেন্ট, আছে ব্লু গোল্ড ম্যাকাও, রেড আইড কুকু, বিভিন্ন ধরনের প্যারাকিট, গ্রে পিকক,হিমালয়ান মোনাল, হিল ময়নার মতন চোখ ধাঁধানো রংবেরংএর কিছু সুন্দর পাখি।
এটি বৃহস্পতিবার ব্যতিত সাপ্তাহিক বাকি দিন খোলা থাকে। উল্লেখ্য যে এখানে জু, হিমালায়ান মাউন্টেননিয়ারিং ইনস্টিটিউট এবং বেঙ্গল ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়াম একই সঙ্গে অবস্থিত। তাই ঘুরে দেখতে সময়ও লাগে প্রচুর। এখানে প্রবেশ টিকেটের মূল্য মাথাপিছু ভারতীয়দের জন্য ৬০ রুপি এবং বিদেশিদের জন্য ১০০ রুপি করে। ছয় বছরের ছোট্ট বাচ্চাদের জন্য টিকেটের প্রয়োজন হয় না। আর ক্যামেরার জন্য বাড়তি ১০ রুপি দিতে হয়। চিড়িয়াখানায় ঢুকার পরই দেখা যায় অনেকগুলো রাস্তা চিড়িয়াখানার বিভিন্ন দিকে চলে গিয়েছে। একটি সোজা উপরে, একটি ডানদিকে এবং একটি পিছনের দিকে। সোজা রাস্তাটাতেই প্রথমে যান। একটু এগিয়েই যান। দেখতে পাবেন তারের ফিল্ডের ভিতরে রয়েল বেঙ্গল টাইগারদের। সাদিদরা সবাই ঘুরে ঘুরে সকল সংরক্ষিত প্রাণীগুলোকে দেখতে লাগল।
হঠাৎ একটা টাইগার খাঁচার মধ্যে থেকেই সামান্য আওয়াজ করতে শান্ত প্রায় লাফিয়ে উঠল। তারপাশে তানবীর থাকাতে সমস্ত আক্রমণ গিয়ে পড়ল তার উপর। তানবীর চোখ গরম করে ধমক দোওয়ার জন্য তার দিকে তাকালো। কিন্তু পরমুহূর্তেই মনোভাব বর্জন করে নিষ্পলক তাকালো। কয়েক মুহূর্ত পর শান্তর বর্তমান পরিস্থিতি খেয়াল হতেই ধুকপুক করা বুক চেপে ধরে ভয়ার্ত চোখে তানবীরের দিকে তাকালো। অপরাধী কন্ঠে তার বাহু ছেড়ে দিয়ে নিচুস্বরে বলল,

— ‘ সরি। ‘

তানবীর আবারও শান্তকে একপলক দেখে নিয়ে প্রতিউত্তর না দিয়ে সামনে চলে গেল। শান্ত প্রকাশ না করলেও ভিতর ভিতর আহত হলো। তানবীরের এমন দায়সারা এড়িয়ে যাওয়া মনোভাব তাকে বড্ড পীড়া দিচ্ছে। এটলিস্ট সমস্যা কোন জায়গায় সেটাতো বলবে!

সাদিদ নীলাকে একহাতে জড়িয়ে নিয়ে হাঁটছে। নীলা নিচুস্বরে বলে উঠল,

— ‘ এভাবে ধরে আছেন কেন? সবাই কি ভাবছে? ‘

সাদিদ নীলার কথা শুনে তাকে নিজের সাথে আরেকটু জড়িয়ে নিলো। বুকে চেপে ধরে বলল,

— ‘ কি ভাববে? ভাববে বরটা তার পাখিবউটাকে ভীষণ ভালোবাসে। ‘
— ‘ কচু। ভাববে বরটা একটা নির্লজ্জের কারখানা। ‘

সাদিদ নীলার কথায় শব্দ করে হাসল। তাকে আরও ক্ষেপাতে ফিচেল কন্ঠে বলল,

— ‘ বউ কিউট হলে শুধু নির্লজ্জ নয় আরও বহুত কিছু হওয়া লাগে। ‘

নীলা আস্তে করে সাদিদের বাহুতে কিল বসাল। তাতে সাদিদ আরও জোরে হাসল। উপস্থিত অনেকেই তাদেরকে খেয়াল করছে বিধায় দুষ্টু সাদিদ আপাতত দুষ্টুমি বন্ধ করল।

তারা আরও এগিয়ে যেতে যেতে বিপন্ন প্রায় প্রাণী স্নো লেপার্ড, রেড পান্ডা, শিয়াল, হিমালয়ের স্যালামাণ্ডার, ব্ল্যাক প্যান্থার, তিব্বতীয় নেকড়ে, নীল ভেড়া, হিমালয়ের মোনাল, ধূসর ময়ূর, রক্ত রঙ্গীন পক্ষীসহ আরও অনেক বিপন্ন প্রাণীদের দেখতে পেল। এককথায় অসাধারণ এক অবিজ্ঞতা।
নীলার তাদেরকে দেখে ভালো লাগলেও হঠাৎ মনটা খারাপ হলো। সাদিদ টের পেয়ে বলল,

— ‘ কি হয়েছে? ‘
— ‘ না কিছু না। ‘
— ‘ একদম মিথ্যা কথা বলবে না। তোমার চোখ স্পর্শ অন্য কিছু বলছে তাই চুপচাপ বলে ফেল কি হয়েছে। ‘
— ‘ এদেরকে খাঁচায় বন্দি ছাড়া আর কোনো রাস্তা নেই? এদেরকে এভাবে দেখে আমার খারাপ লাগছে। ‘

সাদিদ নীলার মনোভাব বুঝতে পেরে তাকে বুকে আগলে নিয়ে বলল,

— ‘ পাখি, সবকিছুতো আমাদের হাতে থাকে না। এইটাও সেইরকম। এদের দায়িত্ব সরকারের উপর। আমরা চাইলেও এদের দায়িত্ব নিতে পাড়ব না। কিন্তু হ্যাঁ অবশ্যই আমরা তাদের ভালো থাকার জন্য আর্থিক সহায়তা করতে পারব। এবং আমরা সেটাই করব। ‘
— ‘ সত্যিই? ‘

সাদিদ হেসে নীলার নাক টিপল। তারপর বলল,

— ‘ আমার পাখি সত্যি। ‘

নীলাও হাসল। এবার সেও সাদিদের পিঠে হাত দিয়ে তার সাথে আরও মিশে দাঁড়াল। মাথা উঁচিয়ে নির্নিমেষ দেখতে লাগল সাদিদ নামক এই সুপুরুষটাকে। যে শুধুমাত্র নীলাকেই ভালোবাসতে জানে না বরং সবাইকে ভালোবেসে আগলে রাখাটাই তার চরিত্রের বৈশিষ্ট্য। ভালোবাসে সে। এই ছেলেটাকে সে ভীষণ ভালোবাসে।
সাদিদ নীলার এমন চাহনি দেখে ভ্রুজোড়া নাচিয়ে বলল,

— ‘ কি? ‘
— ‘ না, কিছু না। ‘
— ‘ আমার উত্তর করে পাব? নাকি এখনও সময় হয়নি? ‘

নীলার মনের কথাটা আচমকা সাদিদের কন্ঠে শুনে নীলা হকচকিয়ে গেল। সাদিদ তার অবস্থা দেখে ঠোঁট কামড়ে হাসল। কপালের একপাশে আদর দিলো। নীলা সাদিদের বুকে মুখ গোঁজে লাজুক হেসে নিচুস্বরে বলল,

— ‘ অপেক্ষা করুন। সবুরের ফল মিষ্টি হয়। ‘
— ‘ এমনিতেই ডায়বেটিসের আশংকায় চিন্তিত বউ। আর মিষ্টি হলে যে নামহীন রোগে আক্রান্ত হবো। ‘

নীলা এবার জোরেই সাদিদের বুকে চিমটি কাটল। মিনমিনিয়ে বলল,

— ‘ অসভ্য পুরুষ। ‘

.

তারা হিমালায়ান মাউন্টেননিয়ারিং ইন্সটিটিউটে পৌঁছাতেই এভারেস্ট বিজয়ী শেরপা তেনজিং নোরগের স্মৃতিস্তম্ভটি দেখতে পেল। কি সাহসী মানব। ১৯৫৩ সালে পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথমবার মাউন্ট এভারেস্ট জয় করেছিল এডমন্ড হিলারি এবং শেরপা তেনজিং নোরগে। তারই স্মৃতিচরণে এবং সাধারণ মানুষকে পর্বতারোহণের ব্যাপারে উৎসাহিত করাই ছিল এর লক্ষ্য। বিশ্বের অন্যতম পর্বতারোহণ কেন্দ্র হিসেবে স্বীকৃত এই ইন্সটিটিউটের ভিত্তিস্তর স্থাপিত হয়েছিল ১৯৫৪ সালে। বিশ্বের অসংখ্য পর্বতারোহী তাদের দক্ষতা বিকাশের জন্য এখানে আসে। বর্তমানে এখানে বেসিক ক্লাইম্বিং থেকে অ্যাডভান্স লেভেলের ক্লাইম্বিং সহ বিভিন্ন ধরনের ট্রেনিং দেওয়া হয়। আর বর্তমানে পর্যটন স্পট হিসেবেও এই ইন্সটিটিউট যথেষ্ট জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। এই ইন্সটিটিউটের ভিতরে একটি মিউজিয়ামও রয়েছে। যেখানে পর্বত আহরণের জন্য বিখ্যাত বিভিন্ন জিনিস রাখা হয়েছে।
পর্বতারোহীদের জন্য বা সাধারন ট্রেকারদের জন্য এই মিউজিয়াম খুঁটিয়ে ঘুরে দেখা অবশ্যই উচিত। তাদের কাছে এটা সোনার খনির সামিল। স্যার হিলারি এবং তেনজিং নোরগের ব্যবহৃত পর্বতারোহণের সরঞ্জাম, এবং পর্বতারোহণের জন্য সে যুগে ব্যবহৃত বিভিন্ন ধরনের সরঞ্জাম, দুষ্প্রাপ্য ছবি, এবং শিক্ষামূলক বেশ কিছু বিষয় জানা যায় এখানে আসলে। কিন্তু এই মিউজিয়ামের ভিতরে ছবি তোলা এলাউড নয়।

সাদিদরা বেঙ্গল ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামও পরিদর্শন করল। ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগল নাম না জানা অনেক কিছু। বিভিন্ন পশু পাখির দেখা পাওয়া যায় এই মিউজিয়ামে। ১০০-১৫০ রুপি খরচ করে ঐতিহ্যবাহী পোশাক পড়ে ছবি তোলারও সুযোগ আছে।
নীলারা উৎসাহ নিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল। সবাই যখন মিউজিয়াম দেখতে মসগুল তখন তানবীর এবং অর্ণব সাদিদকে টেনে সাইডে আনল।

— ‘ কি করিস? এমন টানাটানি করছিস কেন? ‘
— ‘ নাইলে আর কি করব? তোর তো দর্শন-ই পাওয়া যাচ্ছে না। ‘

সাদিদ তানবীরের কথায় হাসল। হাসিমুখেই বলল,

— ‘ আচ্ছা বল, কি বলতে চাস। ‘

এবার তানবীর আর অর্ণব একে অপরের দিকে তাকিয়ে মিচকে হাসি হাসল। তানবীর পকেট থেকে কাগজে মুড়ানো একটা পেকেট নিয়ে সাদিদের হাতে তোলে দিলো। সাদিদ প্রশ্নবোধক দৃষ্টি তাকাতেই সে বলল,

— ‘ খোলে দেখ। ‘

সাদিদ আর কিছু না বলে পেকেটটা ছিড়তেই ভিতরের জিনিস দেখে দ্রুত তার পকেটে ঢুকাল। দুই বন্ধুর পিঠে ঘুষি বসাতে বসাতে বলল,

— ‘ হারামির দল, এসব কি? ‘
— ‘ আরে শালা মারস ক্যান। এই লাইগা কয় আজকাল কারও ভালা করন নাই। ‘
— ‘ লাথি খাবি। এসবকে ভালো বলে? নীলাঞ্জনা দেখতে কি ভাববে বুঝতে পাড়ছিস। ‘
— ‘ হারামি এবার থাম। হাড়গোড় ভাইঙা ফেলতাছস। তোর নীলাঞ্জনার জন্যই এই উপকার করলাম। এখন ধন্যবাদ না জানিয়ে আমাদেরকেই মারছিস। ‘
— ‘ সাদি থাম। এবার কিন্তু আসলেই ব্যাথা লাগছে। ‘

সাদিদ এবার থামল। এখনও চোখ গরম করে তাদের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। বন্ধুগুলো আসলেই এক একটা বদমাশের অংশবিশেষ। তানবীর শার্টের কলার ঠিক করতে করতে আবারও সাদিদের পাশ ঘেঁষে দাঁড়াল। নিচুস্বরে মিনমিন করল,

— ‘ শালা তোর লাইগ্গা চুরি করি আর তুই কস চোর? ‘

সাদিদ আবারও চোখ গরম করে তাকাতেই তানবীর তার কাঁধ জড়িয়ে ধরে দুষ্টু হেসে বলল,

— ‘ আরে চেতস ক্যান? তুই তো বউ পাইয়া বেসামাল হইয়া গেছস। তাই আমরা দোস্তরা তোর উপকারের লাইগ্গা এই মহৎ কাজটা করলাম। ‘
— ‘ হারামি এটাকে মহৎ কাজ বলে? ‘
— ‘ ঐ মহৎ নয়তো আর কি? যদি কোনো অঘটন ঘটাইয়া ফেলস! তাইলে কি হইবো? তোর তো ইদানিং কোনো কিছুতেই হুঁশ নাই। আমরাও এসব ভুললে চলব? ‘

সাদিদ এবার হেসে ফেলল। তানবীর আর অর্ণবকে হাসতে হাসতেই আরও একদফা উত্তম-মাধ্যম দিলো। সাদিদ মার দিয়ে হাসছে আর তারা বিনিময়ে মার খেয়েও হাসছে। এ যেন বন্ধুতের এক সুন্দরতম দৃশ্য। সাদিদ দুইবন্ধুর কাঁধ জড়িয়ে ধরে হেসে বলল,

— ‘ ইডিয়টের দল আমাকে কি তোদের গর্দভ মনে হয়? আমাদের বিয়েটা যেহেতু এখনও পরিবারের সবাই জানে না, তাহলে তোদের কি মনে হয় আমি এইসব দিকে খেয়াল রাখব না? আমার সব দিকেই খেয়াল আছে। তাই তোদের এমন মহৎ চিন্তার প্রয়োজন নেই। ‘

— ‘ আরে দোস্ত রাইখা দে। তুই যা চিজ একস্ট্রা থাকা দরকার। বলা তো যায় না…

সাদিদ এবার কথা শেষ করবার আগেই দুটুকে দৌড়ানি লাগাল। তারা দম ফাটানো হাসিতে মেতে উঠে দৌড়াচ্ছে। সাদিদের ঠোঁটের কোণায়ও হাসির রেখা। অবশ্য তাতে লজ্জার ছিটেফোঁটাও নেই। সে কি আর নীলা নাকি?

মিউজিয়াম থেকে বাহির হয়ে তারা সেন্ট জোসেফ কলেজটা দেখে আসতে গেল। বহু পুরনো এই কলেজটার নামডাক অনেক। বছর পুরনো এই কলেজটি অনেকেই হয়তো মুভিতে দেখেছেন। শাহরুখ খানের সেই বিখ্যাত মুভি ‘ম্যায় হু না’ এটার কথা কার অজানা? এই কলেজেই সেটির শুটিং হয়েছিল। কিন্তু কলেজের ভিতরে প্রবেশের অনুমতি নেই। কিন্তু সাদিদ কি না দেখে এমননি ফিরে যাবার লোক? দারোয়ানের সাথে ভাব করে মোটা অঙ্কের রুপি ঘুষ দিয়ে নীলাদের নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে। কলেজ প্রাঙ্গন থেকেই চোখে পড়ে কাঞ্চনজঙ্ঘার মনোমুগ্ধকর রূপ। সাদিদরা বহু পুরনো এই কলেজটা ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগল। নীলার এনার্জি লেবেল এবার জিরোতে এসে দাঁড়িয়েছে। তাই সে একসাইডে বসে পড়ল। আচমকা এমন হওয়াতে সাদিদ দ্রুত কাছে আসলো। চিন্তিত হয়ে বলল,

— ‘ এই পাখি, কি হয়েছে? ‘
— ‘ কিছু না। একটু পানি দিন। ‘

নীলা মুখে হাসি নিয়েই বলল। সাদিদ দেরী না করে পানির বোতল খোলে নিজেই তাকে খাইয়ে দিলো। নীলা পানি খেয়ে সাদিদের বুকে হেলে পরে জোরে জোরে শ্বাস টানতে লাগল। সাদিদ তাকে একটু রেস্ট নিতে দিলো। মিনিট দশেক পর নীলা বুকের থেকে মুখ তুলে হাসল। সাদিদ তীক্ষ্ণ চোখে তাকাতেই বলল,

— ‘ সরি সকালের নাস্তাটা ভালো করে করিনি। তাই বোধহয় একটু খারাপ লেগেছিল। ‘

সাদিদের চোখে-মুখে এতক্ষণ চিন্তারা বাসা বাধলেও এবার রাগের কুন্ডলী প্রকাশ পেল। সম্ভব হলে নীলাকে তোলে সে এখনই আছাড় মারে। সাদিদ দ্রুত উঠে গিয়ে অর্ণবের ছোট কাঁধ ব্যাগ থেকে কেক নিয়ে আসলো। নীলার উপর রেগে মেগে একশেষ। তারপরও রাগ নিয়ে নিজেই কেক খাইয়ে দিতে লাগল। নীলা বিনাবাক্য নতজানু করে খেতে লাগল। এখন কিছু বলা-ই মানে ফ্রিতে মাইর।
কলেজ দেখা ইতিমধ্যে হয়ে গিয়েছিল। তাই সাদিদ বলেছিল ফিরে যাবে। কিন্তু তাদের এখনও কেবেল কার যাওয়া বাকি। তাই নীলা অনড় থাকল। কেননা সে ভালো-ই জানে সাদিদ এমনটা তার জন্য বলছে। কিন্তু নিজের জন্য সবার আনন্দ মাটি হবে তাই নীলা জেদ ধরেছিল। যাবে মানে যাবেই। যার জন্য শেষ পর্যন্ত সাদিদ রাজি হয়েছে। কিন্তু নীলার সাথে একটা কথাও বলেনি।

তারা রোপওয়ের জন্য গেল সিংহমারি নর্থ পয়েন্টে, যা সেন্ট জোসেফ কলেজের কাছেই।
রোপওয়ে বা কেবেল কার যা কিনা দেশের প্রথম কেবেল কার সার্ভিস। এর যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯৬৮ সালে। কলেজের উল্টোদিকে একটা খাড়া সিঁড়ি উঠে গেছে উপরে। ২০-২৫টা ধাপ, উঠে বাঁ দিকে একটু এগোলেই চোখে পড়বে রোপওয়েতে ঢোকবার গেট যার পোশাকি নাম রংগিত ভ্যালি প্যাসেঞ্জার কেবেল কার। পাশেই রয়েছে টিকিট কাউন্টার।
নীলা এতক্ষণ মেনে নিলেও এবার এসে সাদিদের পাশ ঘেঁষে দাঁড়াল। ইনিয়েবিনিয়ে বলল,

— ‘ শুনছেন? না মানে…

সাদিদ চোখ গরম করে তাকাতেই সে আবারও চুপসে গেল। এমন করে তাকায় কেন? মনে হয় চোখ দিয়েই খেয়ে ফেলবে!
নীলার প্রচন্ড খারাপ লাগছে। না হয় একটা মিথ্যা কথা বলেই ফেলেছে। সেই জন্য সবার সামনেও এমন করবে? নীলার চোখ ছলছল করে উঠল। কিন্তু সাদিদের আড়ালে চোখ মুছে সামনে এগিয়ে গেল। কিন্তু সাদিদ যে তার প্রাণপাখিকে ছায়ার মতো আগলে রাখতে চায়। তাই তার লোকানো অশ্রুজলও স্বামীর নিকট প্রকাশিত হলো।
নীলা মনমরা হয়ে সবার সাথে হাঁটতে লাগল। সাদিদ থেকে খেয়াল রাখছে কিন্তু শব্দছাড়া। তাদেরকে রোপরয়ের জন্য লাইনে দাঁড়াতে হলো।
সিজেন টাইমে বেশ বড়ো লাইন হয় টিকিটের। রাউন্ড ট্রিপের ভাড়া বড়দের জন্য ২০০/- এবং ছোটোদের (৩-৮ বছর) ১০০/-
সিজেনের সময় সকাল ১০টা থেকে দুপুর ২টো পর্যন্ত টিকিট কাউন্টার খোলা থাকে। অফ সিজেনে (বর্ষাকালে এবং শীতকালে) ১০টা থেকে ৪টে পর্যন্ত এই পরিসেবা পাওয়া যায়। কিন্তু প্রতি মাসের ১৯ তারিখ এই পরিসেবা বন্ধ থাকে রক্ষণাবেক্ষণের জন্য।
সিংহমারি বেস স্টেশন (৭০০০ ফিট) থেকে কেবেল কার যায় নীচের তুকভার (৬০০০ ফিট) টি এস্টেট স্টেশনে। এই আড়াই কিলোমিটার যাত্রাপথে সময় লাগবে মিনিট ১৫। এখানে নেমে কিছুটা সময় কাটানো যায়, ঘোরা যায় চা বাগানে, চাইলে টি প্রসেসিং দেখার গাইডেড ট্যুর নেওয়া যায়। বেঞ্চে বসেও উপভোগ করা যায় রংগিত ভ্যালির অপার সৌন্দর্য। আর যদি ইচ্ছা করে তবে পাশেই একটি বাড়ির ছাদে ক্যাফেটেরিয়া আছে, সেখানে গিয়ে চা, কফি বা মোমো খেয়ে দেখতে পারবেন।
এই কেবেল কার চড়ার কিন্তু বেশ একটা অন্যরকম মজা আছে, বেস স্টেশন থেকে চলা শুরু করে কেবেল কার আপনাকে নিয়ে হটাৎ করে ঝুলে পড়বে রংগিত ভ্যালির উপর। প্রায় ১০০ ফিট নীচে পাহাড়ের ঢালে চা বাগান, বাঁশের ঝার, জংগলের উপর দিয়ে ঝুলে ঝুলে কিন্তু ধীর গতিতে যেতে থাকবেন তুকভারের দিকে। প্রথম প্রথম একটু ভয় লাগতে পারে তবে দার্জিলিঙয়ে ৩৬০ ° প্যানোর‍্যামিক ভিউ সেই ভয়কে জয় করবেই আর যদি আকাশ পরিষ্কার থাকে তাহলে তো কথাই নেই, দূরে চোখে পড়বে কাঞ্চনজঙ্ঘার বরফাবৃত্ত শৃঙ্গরাজি। চারপাশের রুদ্ধশ্বাস দৃশ্যতে মন নেচে উঠতে বাধ্য। কিন্তু এত সৌন্দর্যও দুইজন ব্যক্তি অনুভব করতে পাড়ছে না। তাদের মন খারাপে উপস্থিত বাকি সবারও আনন্দে ভাটা পড়েছে। নীলা অনুভূতিহীন দৃষ্টি নিয়ে কেবেল কারের বাহিরে দিয়ে তাকিয়ে আছে। কত এক্সাইটেড ছিল এই রোপওয়ে নিয়ে। অথচ এখন কিছুই ভালো লাগছে না। সাদিদের রাগ থাকলেও আপাতত সেটাকে এক সাইডে রেখে নীলাকে টেনে বুকে আনলো। একহাতে জড়িয়ে নিয়ে বাহিরে তাকালো। আচমকা সাদিদের স্পর্শে নীলা অবাক হয়ে তার দিকে তাকায়। কিন্তু সাদিদের এমন একটা ভাব যেন এই মুহূর্তে বাহিরে তাকানো ছাড়া তার অন্য কোনো কাজ নেই। নীলা নিঃশব্দে হাসল। সাদিদের বুকে মুখ গোঁজল। তারপর আশেপাশে সবার দিকে একবার আড়চোখে তাকালো। একটি কেবেল কারে ছয়জন বসতে পারে। তাই তারা সকলেই এখানে রয়েছে। কিন্তু সবাই অন্যদিকে দৃষ্টি রেখে সৌন্দর্য উপভোগ করছে। নীলা একবার সাদিদের দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে তার বুকে চুমু দিলো। সাদিদ মাথা নিচু করে তাকালো। হাসি পাচ্ছে তারপরও সে রাগী দৃষ্টি রেখে গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠল,

— ‘ আমি কিছু ভুলিনি। মিথ্যা বলার শাস্তি হাড়ে হাড়ে টের পাবে। ‘

নীলার মুখটা চুপসে গেল। মাথা নিচু করে বিড়বিড় করল।

— ‘ খারাপ একটা। ‘

সাদিদ আবারও অন্যদিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে হাসল।

সাদিদ-নীলার এক হওয়াতে যেন সবার মাঝেও আনন্দের ঢেউ নেমে এসেছে। সবাই এখন সত্যিকার অর্থই রোপওয়ের আসল আনন্দ উপলব্ধি করছে।
বাকি সময়টুকু তারা বেশ আনন্দের সাথে কাটালো। তারপরও ঘুরে ফিরে আজকের মতো হোটেলে ফিরল। রাতের খাবার খেয়ে সবাই যার যার রুমে চলে গেল।
সাদিদ রুমে এসেই ওয়াসরুমে গিয়ে ফ্রেস হলো। এখনও চাপা রাগে নীলাকে এড়িয়ে চলছে। মেয়েটা কেন তাকে বুঝে না? নিজের প্রতি অবহেলা কেন করবে সে?
সাদিদ ফ্রেস হয়ে এসে বিনাবাক্য বিছানায় শুয়ে পড়ল। নীলার এবার খারাপের সাথে সাথে রাগও হচ্ছে। সে ধুম করে গিয়ে বাহিরের কাপড় নিয়েই বিছানায় শুয়ে পড়ল। সাদিদ চোখের উপর থেকে হাত সরিয়ে নীলার ভাবসাব দেখল। কিছু সময় পার হলো তারপরও তাকে এভাবেই থাকতে দেখে সাদিদ বলল,

— ‘ ড্রেস চেইঞ্জ করে এসে ঘুমাও। ‘

নীলার কোনো আওয়াজ পাওয়া গেল না। সাদিদের রাগ লাগছে। তাই আবারও ধমকের স্বরে বলল,

— ‘ যেতে বলেছি না? ‘

নীলা এবারও কিছু না বলাতে সাদিদ রেগে কাছে আসতেই সে থমকে যায়। নীলার শরীরে হাত দিতেই তার বুকটা কেঁপে উঠে। কেননা তার প্রাণপাখিও নিঃশব্দে কেঁদে কেঁপে কেঁপে উঠছে। সাদিদ আর রাগ ধরে থাকতে পারল না। তাকে টেনে সোজা করে শুইয়ে সমস্ত মুখে আদর দিতে লাগল। নীলার হেঁচকি উঠে গিয়েছে। সাদিদ তার লাল হওয়াতে নাকটাতেও চুমু দিয়ে বলল,

— ‘ প্লিজ আর না। অনেক কেঁদেছ। পুরো মুখ লাল হয়ে গিয়েছে। ‘
— ‘ আপনি খুব খারাপ, খুব। ‘
— ‘ আচ্ছা আমি খারাপ। এবার চুপ করো। নতুবা কিন্তু আবারও ধমক দিব। ‘

নীলা চোখ ছোট্ট ছোট্ট করে তাকাতেই সাদিদ হাসল। দুই চোখের পাতায় চুমু খেয়ে বলল,

— ‘ কথা না শুনলে তো ধমক দিব-ই। ‘
— ‘ সবকথা-ই তো শুনি। কোনটা না শুনলাম। ‘
— ‘ তাহলে আজ মিথ্যা বললে কেন? না খেয়ে বলেছ তুমি খেয়ে নিয়েছ। এতবড় মিথ্যা? ‘
— ‘ আমার খিদে ছিল না। ‘
— ‘ দেখ পাখি, ভালোবাসি বলে ভেব না মাইর দিতে পারব না। আর কখনও খাবার নিয়ে মিথ্যা না ফাঁকিবাজ করলে তোলে আছাড় মারব। ‘

নীলা রাগ মিশেলে চোখ ছোট করে তাকালো। সাদিদ মৃদু হেসে নীলার কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলল,

— ‘ জ্বি এমনটাই হবে। এইক্ষেত্রে আপনাকে বিন্দুমাত্র ছাড় দেওয়া হবে না। তোমার জন্য হলে মাফ করতাম। কিন্তু আমার প্রাণপাখির ক্ষতি আমি কখনোই হতে দিতে পারি না। তাই নো ছাড়াছাড়ি। ‘

নীলা অবাক হলো। সাথে প্রশ্ন এসে ভির জমালো। তাহলে সে কে? তার তো কোনো দাম-ই দেখা যাচ্ছে না।
সাদিদ নীলার নাকটা টেনে দিয়ে বলল,

— ‘ এবার যাও। নাকি সকালের মতো আমি আসব? ‘

নীলা সাইড থেকে একটা বালিশ নিয়ে সাদিদকে আস্তে করে আঘাত করল। সাদিদ পেট ধরে হাসছে। নীলা লজ্জা পেয়ে ওয়াসরুমে ছুটল। খোলা চুলগুলোকে হাত খোঁপায় পেঁচাতে পেঁচাতে বেড়িয়ে আসলো। সাদিদ অপলক চেয়ে থাকল। নীলা ভেজা চোখ-মুখ টাওয়েল দিয়ে মুছে ড্রেসিংটেবিলের সামনে বসল। ঠান্ডা প্রচুর। তাই হাত পায়ে লোশন লাগিয়ে বিছানায় উঠে আসলো। বালিশে মাথা রাখতেই সাদিদ এসে তার উপর ঝুকল। নিষ্পলক কিছু সময় চেয়ে থেকে কানের কাছে মুখ লাগিয়ে বলল,

— ‘ এই? ‘
— ‘ হুম? ‘
— ‘ তুমি কি খুব ক্লান্ত? ‘

নীলা উত্তর দেওয়ার জন্য সাদিদের মুখের দিকে তাকালো। তার চোখের ভাষা বুঝতে পেরে লজ্জায় লাল-নীল হলো। লাজুল হেসে অপরদিকে মুখ ফিরাল। নীলার অবস্থা দেখে সাদিদও নিঃশব্দে হাসল।

#চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here