আনকোরা পর্ব-৩৫

0
1651

#আনকোরা
#রূবাইবা_মেহউইশ
৩৫.

নির্মল বাতাসে ওড়না ওড়ছে চৈতীর এলোমেলোভাবে। কতদিন পর ঠিক জানে না আজ সেলোয়ার-কামিজ পরেছে সে। মাথার ছোট ছোট চুলগুলোতে কেমন আজব লাগছে তার এই পোশাকে। তার কেমন চুল পছন্দ তাও মনে নেই কিন্তু আজ এই পোশাকের সাথে তার খুব করে মনে হচ্ছে লম্বা চুল বেশ লাগতো। আর পরনের পোশাকটাও তার গায়ে খুব আঁটসাঁট হয়ে আছে এতে অস্বস্তিও হচ্ছে খুব। তার কোন জামাকাপড়ই ঠিকঠাক গায়ে লাগে না। তার বক্ষস্থল, পেট বিশেষ করে তলপেটে অবস্থা দেখে সে অবাক হয়। ঘরে যতগুলো ফটো আছে কোনটাতেই তার এতোটা মেদবহুল দেহ চোখে পড়ে না। অসুস্থ হয়ে মানুষ শুকিয়ে যায় কিন্তু তার হয়েছে উল্টো আর পেটের সেই সার্জারির দাগ! কোথাকার কোন মেহমান আসবে তাই মা এই জামাটাই পরতে বলল। চৈতী যখন জামাটা পরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়েছিলো তখন তার মনে হচ্ছিলো মা মিথ্যে বলেছে তাকে। পেটের সেই চিহ্ন শুধু দূর্ঘটনার অপারেশনে নয় ওটা সিজারিয়ান পেশেন্টের থাকে। তার স্মৃতিভ্রষ্টতার সুযোগে তাকে এত মিথ্যা বলা কেন হচ্ছে! তার বড় ফুপি মানসিক রোগী এ নিয়েও তাকে একটা মিথ্যে ঘটনা বলা হয়েছে। আর দিহান ভাই কোথায় এখানেও একটা লুকোচুরি চলছে সবার মাঝে। মনের ভেতর অস্থিরতা সেই সাথে চাপা কষ্ট অনুভব হয় তার ঝাপসা স্মৃতি মনে পড়লেই। গলায় বিঁধে যাওয়া কাঁটার মত এমন অর্ধেক মনে পড়া স্মৃতিগুলো। যখনই এমন আবছা স্মৃতি মনে তখনই তার চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে। দুনিয়াটাকে অসহ্য লাগে তখন খুব৷ আজ মা যখন বলল গোসলটা সেরে জামা পরো আজ আর টি শার্ট, স্কার্ট এসব পরতে হবে না। চৈতী বুঝলো বাড়িতে আত্মীয়রা কেউ আসবেন না। অনাত্মীয় কেউ আসছে হয়তো তাই মা তাকে একটু দেখতে ভদ্রস্থ করতে চাচ্ছে। হয়তো বলবে ওড়না দিয়ে চুলগুলো ঢাকো কিংবা বা গালের দাগগুলো? মন খারাপ হয় তার এ নিয়ে। যেদিন থেকে ইউনিভার্সিটিতে যায় সেদিন থেকেই মা তাকে কোন না কোনভাবে চুলগুলো ঢাকতে ইঙ্গিত দেয়। সেতো ইচ্ছে করে তার চুল আর চোখের এমন হাল করেনি! মায়ের আচরণে কষ্ট পেয়েই চৈতী জামাকাপড় পরে ছাঁদে উঠে এসেছিলো৷ বিকেলের পশ্চিমে হেলা মরা রোদের তাপ মোটেই লাগছে না গায়ে আর বাতাসটাও চোখে ঘুম নিয়ে আসছে যেন! মেহমান কখন আসবে তার ঠিক নেই ভেবেই চৈতী নিজের ঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো।

সন্ধ্যার ঠিক আগ মুহূর্তে চাঁদ খানের বাড়ি এসে উপস্থিত হলো মিস্টার এন্ড মিসেস খন্দকার। কথা ছিলো তারা বিকেলেই আসবে কিন্তু অনামিকা দোনোমোনো করছিলো তখনও তাই আরো অনেকটা সময় লেগে গেছে। এ বাড়িতে আসার উদ্দ্যোগটা নিয়েছেন অভির বাবা নিজেই। অভিনবের জন্মের পর থেকেই তার সকল ভালো,মন্দ তার চাওয়া-পাওয়া সবটাই পূরণ হয়েছে অনামিকার হাতেই। আজ জীবনের অনেকগুলো বছর পর এসে একমাত্র সন্তানের কথা ভেবে সবচেয়ে বড় সিদ্ধান্তটাই নিয়ে নিলেন তিনি। সেদিন সকালে অভিনবের মায়ের পা জড়িয়ে কান্না আর পুনরায় দেশ ত্যাগের সিদ্ধান্তে তার বাবা আর চুপ থাকতে পারলেন না। আজ হুট করেই তিনি চাঁদকে ফোন করলেন। বিগত সময়ে বার কয়েক সাক্ষাৎ হয়েছে চাঁদের খন্দকার সাহেবের সাথে। কিন্তু সেই সাক্ষাৎ তেমন একটা সুখকর হয়নি অভিনবের সাথে অনামিকার এক স্নায়ুযুদ্ধের বদৌলতে। কিন্তু প্রশ্ন যখন একটিমাত্র সন্তানের ভালো থাকার তখন তিনি বাবা হিসেবে সবটা মতবিরোধিতা সরিয়েই চাঁদের সাথে কথা বলেছেন। ঠিক সেই কলেজের বন্ধুটি হয়েও ফোন করে দীর্ঘ আলাপ করেছেন এবং এক ফাঁকে বাড়ি আসবেন বলে জানিয়েছেন। কিন্তু অনামিকা তা শুনেই ক্রোধে ফেটে পড়লেন। তিনি বারংবার মনে করিয়ে দিচ্ছিলেন চৈতীকে নিয়ে না ভাবতে চাওয়ার কারণটা। সে নিজে ট্রিটমেন্ট করেছে চৈতীর। সেই দূর্ঘটনায় চৈতী শুধু তার গর্ভের সন্তানকেই হারায়নি হারিয়েছে তার পরবর্তী মাতৃ ক্ষমতাও। আর কোন মা জেনেশুনে নিশ্চয়ই তার একমাত্র সন্তানের জীবনে এমন কাউকে চাইবে না! অনামিকা অনড় তার সিদ্ধান্তে সেই সাথে তার স্বামীও অনড় তিনি অভিনবের জন্য চৈতীকেই আনবেন যদি চৈতীর পরিবার রাজী হয়। ছেলেকে না জানিয়েই অনেক বড় সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আর অনেকটা ইমোশনাল ব্ল্যাকমেল করেই অনামিকাকে নিয়ে পৌঁছেছেন চাঁদ খানের বাড়ি। সুইটি তারা আসবে বলেই অনিচ্ছা সত্ত্বেও কিছু আয়োজন করেছেন। সুইটি অনেকটাই জানে অভিনব আর তার মায়ের মধ্যকার নিরব দ্বন্দ আর সেই দ্বন্দ্বের কারণ। আর তারপর থেকেই সে অনামিকাকে সহ্য করতে পারে না। এমনিতেও ডাক্তার অনামিকা যে একটা সময় চাঁদকে মনে মনে চাইতেন সে খবরটাও তার জানা।

চারধারে অন্ধকারের চাদর পড়ছে; সন্ধ্যে হলো বলে। খন্দকার সাহেব চৈতীদের বসার ঘরে ঢুকে চারপাশে চোখ বুলালেন। প্রধান দরজা দিয়ে ঢুকতেই চমৎকার একটি খুব বড় মাটির ফুলদানি। হঠাৎ দেখলে সেটাকে একটা ফুল গাছ বলে ভ্রম হবে। একটু ভেতরে ঢুকতেই এল আকৃতিতে দু সেট রঙিন সোফা আর তার কর্ণারে টেবিলেও ফুলদানি সাজানো। ড্রয়িংরুমের দেয়াল জুড়ে অনেকগুলো চিত্রকর্ম আর সবগুলোই আর্মিদের বিভিন্ন আর্মস আর জিপের। বেশিরভাগই অয়েলপেইন্ট। খন্দকার সাহেব চারদিকে ভালো করে তাকিয়ে মুগ্ধ হলেন দেয়ালে একটা পারিবারিক ছবি দেখে। ছবিতে একজন মুরুব্বি গোছের মানুষ বসা। অনামিকা আর তার স্বামী দুজনেই চেনেন মানুষটাকে। ইনি চাঁদের বাবা আর তাঁর দু পাশে দুই মেয়ে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে একজন দিলশাদ আপা অন্যজন দিথি আপা। আর পেছনে দাঁড়ানো দীর্ঘকায় ছেলেটা চাঁদ। ছবিতে তাদের বয়স পনেরো, আঠারো, বিশ হবে! তাদের মা মারা গেছেন অনেক আগেই তাই এই ছবিতে তিনি নেই৷ অনামিকা বসার ঘরে ঢুকেই বসে পড়লো সোফায়। সুইটি এসে হাসিমুখে অভ্যর্থনা জানালো দুজনকে পাশে চাঁদও ছিলো। খন্দকার সাহেব অনেকটা দিহানের বাবার মত। আচরণে কোমল আর হাস্যমুখ মানুষ। তিনি এসেই হাসিমুখে চাঁদ আর সুইটির সাথে কুশল বিনিময় করলেন। অত্যধিক আন্তরিকতার সাথে তিনি চৈতীর শারীরিক অবস্থা জেনে নিলেন৷ এরপরই পুরনো অনেক গল্পেই সময় কেটে গেল। অনামিকা রিজার্ভড রইলো পুরোটা সময়ই সুইটি তা খেয়াল করলেন। কথার মাঝেই খন্দকার সাহেব চৈতীকে দেখতে চাইলে সুইটি জানালো চৈতী ঘুমিয়ে আছে। রাত যখন নয়টা কি তার একটু বেশি তখন অভিনব ফোন দিলো মাকে। জানতে চাইলো তারা কোথায় বাড়িতে কেউ নেই কেন? অনামিকা বলল চৈতীদের বাড়ি এসেছে। তৎক্ষনাৎই অভিনব ফোন কেটে দিলো। অনামিকার কথা শেষ হতেই সুইটি বলল, “অভিনবকেও সাথে নিয়ে আসতেন আপা।”

“ও ব্যস্ত,,,”

অনামিকা কথা শেষ করার আগেই অভিনবের বাবা বলল, ” ব্যস্ত বলতে আসলে সে এম্ব্যাসিতে ছোটাছুটি করছে তো তাই আর বলিনি আসার কথা।”

অনামিকা আর মুখ খুলল না। সে তার স্বামীর মুখের দিকে আগ্রহী দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো৷ লোকটা আর কি কি অভিনয় করতে পারে তাই দেখবে সে।

চাঁদ আর সুইটি দুজনেই অবাক হয়ে একসাথেই প্রশ্ন করে বসলো, “এ্যাম্বেসিতে কেন!”

ফিচেল হাসলেন অভিনবের বাবা৷ তারপরই খুব সাবলীল ভঙ্গিতে বললেন, “তোমাদের তো কারো অজানা নয় আমার ছেলেটা চৈতীকে ভালোবাসে!”

কথাটা বলেই অভিনবের বাবা থেমে গেলেন।বসার ঘরে উপস্থিত সুইটি আর চাঁদ তেমন একটা বিষ্মিত হয়নি কিন্তু দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা দিশান হয়েছে। অভিনবের বাবা অনামিকা, অভিনব এমনকি চাঁদকেও না জানিয়ে দিশানকে ফোন করেছেন। দিশানের ফোন নাম্বারটা জোগাড় করেছিলেন অভিনবের কাছ থেকেই। ছেলে কৌতূহলী হয়ে জানতে চেয়েছিলেন কি প্রয়োজন তিনি কথাটা এড়িয়ে গেছেন।

দিশান দরজায় থমকে দাঁড়িয়ে আছে তা প্রথমে দেখলো সুইটি।

“দিশান তুমি! আপা, দুলাভাই আর ঐশী কেমন আছে?”

সুইটি একসাথে জানতে চাইলেন সবার কথা। আর সুইটির দৃষ্টি অনুসরণ করে সবাই দরজায় তাকিয়ে দিশানকে দেখলো।

“এসো দিশান তোমার অপেক্ষাতে থেকেই আমি কথা শুরু করেছি।”

“জ্বী আঙ্কেল আমি শুনেছি। আর বুঝতেও পারছি আপনাদের এখানে উপস্থিতির কারণ কিন্তু আমাকে জরুরিভাবে তলবের কারণটা!”

“তুমি বোসো। আমি তোমার মামা-মামী আর অনামিকাকেও বলিনি তোমাকে আসার কথা বলেছি সেটা। তোমাদের আর বেশিক্ষণ বিব্রত না করে সরাসরিই বলি এবার।” শেষের বাক্যটা চাঁদকে উদ্দেশ্য করে বলল অভিনবের বাবা। অফিস থেকে সোজা মামার বাড়ি এসে উপস্থিত হয়েছে দিশান। বাইরে তেমন গরম নেই তবুও তার মুখটা ঘামে ভেজা লাগছে। সুইটি বসা থেকে উঠে এক গ্লাস লেবুর শরবত এনে দিলো দিশানকে। এক ঢোকে পুরোটা শরবত শেষ করে দিশান বলল, “দুঃখিত আমার কারণে আপনাদের অনেকটা সময় নষ্ট হলো। আঙ্কেল আপনি আপনার কথাটা আবার শুরু করুন।”

চাঁদ খান ধৈর্য্য ধরে আছেন অনেকক্ষণ ধরে আসল কথা জানার জন্য কিন্তু অনামিকার মুখ দেখে মনে হলো সে নেহায়েতই বিরক্ত। অভিনবের বাবা আবার বলা শুরু করলেন, ” চাঁদ আমার পুরো কথা না শুনে রিয়াক্ট করবে না প্লিজ। আমার ছেলে চৈতীকে ভালোবাসে অনেক আগে থেকেই তখন দিহান ছিলো। কিন্তু সে যখন প্রথম দেখে তখন সে জানতো না চৈতী বিবাহিত। আমার ছেলে কখনোই মেয়ে ঘটিত কোন ব্যপারে জড়িত ছিলো না কিন্তু চৈতীকে ভালো লাগায় সে তার মাকে দিয়ে সরাসরি বিয়ের প্রস্তাবও পাঠিয়েছিলো।”

অনামিকা হঠাৎ নিজের স্বামীকে থামিয়ে দিয়ে বলল, পুরনো কাসুন্দি না ঘেঁটে সরাসরি কথা বলো। বিয়ের প্রস্তাব পর্যন্ত সবারই জানা আমি নিজে দিলশাদ আপাকে আর তিনি চাঁদকেও জানিয়েছিলেন।”

দিশান এ কথা জানতো ঐশীর মুখেই শুনেছিলো। কিন্তু সে আগ্রহী পরবর্তী কথা জানার জন্য। অভিনবের বাবা বললেন, “হ্যাঁ সবাই জানে আর আমরাও তখনই জেনেছি চৈতী বিবাহিত। কিন্তু একটা দূর্ঘটনা সবই তো শেষ করে দিলো৷ আমার ছেলে চৈতীর সুখ দেখে সে বিবাহিত জেনেই দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছিলো। কিন্তু এই দূর্ঘটনার কথা শুনে সে আবার পাগলের মত ছুটে এসেছে আর দিনরাত এক করেই সে চৈতীর পেছনে পড়ে ছিলো তাকে একটু সুস্থ করার জন্য কিন্তু!”

গলা ধরে এসেছে অভিনবের বাবার। তাঁর কন্ঠস্বর শুনে চমকে উঠেছে অনামিকা। সেই সাথে বাকিদেরও মুখের রঙ বদলে গেল। এখানে কারোই অজানা নয় অভিনবের চৈতীর পেছনে করা পরিশ্রমের কথা। দিশান বলল, “আমরা জানি আঙ্কেল অভিনব চৈতীর জন্য কতোটা করেছে ইভেন সে আমার মায়ের জন্যও কম করেনি। আর অভিনবের অনুভূতি যতোটা সে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করেছে ততোটা পারেনি। আমি নিজে অনুভব করেছি সে চৈতীকে কতোটা ভালোবাসে।”

“আর এদিক ওদিকের আলাপ করতে পারবো না। সরাসরিই বলি আমি তোমাদের কাছে একটা প্রস্তাব নিয়ে এসেছি। আমার ছেলেটা কখনোই চৈতীকে নিয়ে কোন কথা নিজে বলবে না। সে ভাবে চৈতীর জীবনে তার অস্তিত্ব ভাবাও গুনাহ। সে দেশ ছেড়ে আবারও দূরে পাড়ি জমাতে চাইছে। চাঁদ আমি আমার ছেলের জন্য তোমার মেয়েকে চাই। না কোরো না ভাই, আমার ছেলেটা অযোগ্য নয় তুমি যাচাই করে নাও তবুও তোমার মেয়েকে আমার বাড়ির সদস্য করার অনুমতি দাও।” বসার ঘরের সামনের দেয়ালটা সম্পূর্ণ গ্রিল আর থাই কাঁচের। বিকেল থেকেই সেই বড় স্লাইড জানালাটা খোলা ছিলো। বাইরের শনশনিয়ে বইতে থাকা বাতাসে আর মাথার ওপরের সিলিং ফ্যানের বাতাস মিলিয়ে ঘরটা একদম শীতলই ছিলো। কিন্তু অভিনবের বাবার কথা শুনতেই আচমকা ঘরের আবহাওয়া উষ্ণ হলো। অনামিকা স্বামীর দিকে তাকাতেই তার চোখ ছলছল হলো। এত শান্ত, এত কোমল মনের মানুষটা আজ ছেলের জন্য কেমন যেন আদ্র আচরণ করছে। এই প্রথম তার মনে হলো অর্ধশত বয়সে এসে সে মানুষটার প্রেমে পড়লো। সে মা হয়েও ছেলের আকুলতায় গলতে পারেনি অথচ তার স্বামী মানুষটা চৈতীর সমস্যা জেনেও আজ ছেলের জন্য এখানে এসে উপস্থিত হয়েছে। চাঁদ আর সুইটি জানে অভিনব চৈতীকে ভালোবাসে বলেই দিনরাত এক করে হাসপাতালে পড়েছিলো। তারা এও জানে অনামিকার আর অভিনবের মধ্যে চৈতীকে নিয়ে কিছুদিন খুব মনোমালিন্যতাও ছিলো। তাই তারা খন্দকার সাহেবের প্রস্তাবটা শুনেও তেমন একটা আমোদিত হননি। তবে দিশান কিছুটা আনন্দিত চৈতীর জন্য প্রস্তাব এসেছে বলে। তারওপর অভিনবের মত একটা মানুষ নিঃসন্দেহে উত্তম হবে। সবাইকে অবাক করে দিয়ে চাঁদ খান প্রস্তাব নাকোচ করলেন। অতি চমৎকারভাবে বলে দিলেন চৈতী এখনো অসুস্থ তার ওপর সে তার অতীতের স্মৃতির বাইরে বাস করছে। চৈতীর সমস্যাটা সাময়িক তা ডাক্তার স্পষ্টভাবেই বলে দিয়েছে। আর এ অবস্থায় তাকে নতুন একটা সম্পর্কে বাঁধার কথা বলাটা হাস্যকর। যে মানুষটা আজ নয় কাল নিজের সম্পূর্ণ অতীত মনে করতে পারবে সেই মানুষটাকে আরেকজনের সাথে জড়িয়ে দিলেই হলো নাকি! চৈতীর যখন মনে পড়বে দিহানের কথা তার সন্তানের কথা তখন তার অবস্থা কি হবে ভাবলেই গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে৷ তারওপর যখন দেখবে তার পাশে দিহানের জায়গাটা অন্য একজন নিয়েছে তখন তো পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। বলতে নেই, চাঁদ তো ভাবছে এ অবস্থায় বিয়ের মত কোন সম্পর্কই তৈরি সম্ভব নয়। সে নিজেই একবার ভুল করেছে জোর করে চৈতীর বিয়ে দিয়ে৷ সেই ভুল শুধরানোর সুযোগ তার হয়নি আবার নতুন কোনো ভুলে কি করে জড়াবেন!

অভিনবের বাবা বিষন্ন চোখে চেয়ে আছেন চাঁদের দিকে। অনামিকা মনে মনে প্রচণ্ডরকম খুশি হয়েছেন চাঁদের সিদ্ধান্তে কিন্তু আপাতত তা প্রকাশ করা অনুচিত বলেই সেও বিষন্নভাব নিয়েই আছেন। দিশান বলল এই আলোচনায় তাকে কেন ডাকা হলো! অভিনবের বাবা আবারও দারুণভাবে নিজের অমায়িক ভাবনার প্রকাশ ঘটালেন। তিনি জানালেন চৈতী হোক চাঁদের মেয়ে কিন্তু দিহানের বিধবা স্ত্রীও। সে হিসেবেই দিহানের অভিভাকদেরও জানিয়েই প্রস্তাবটা রাখতে চেয়েছিলেন। দিলশাদ অস্বাভাবিক দিহানের বাবাও তেমন একটা সুস্থ নেই আর তাই সে অনেক বিবেচনা করেই দিশানকে সামনে রেখেছেন। দিশান যথেষ্ট বুদ্ধিমান আর দ্বায়িত্ববান ছেলে। চাঁদও বলল চৈতীর বিষয়ে সে নিজেও তার আপা কিংবা দিশানকে জানিয়েই সব করবে।

সে রাতে আলোচনা দির্ঘায়িত হলো অনেক কিন্তু কোন সিদ্ধান্তই অভিনবের অনুকূলে এলো না। দিশানও তার মামার সিদ্ধান্তকেই সঠিক মনে করলো তবে আরও একটা পথ বলেছিলো। চৈতীর কবে সবটা মনে পড়বে তা কারো জানা নেই। কিন্তু চৈতীর মানসিক অবস্থার ওপর ডাক্তার যেদিন বলবে চৈতীকে দিহানের আর বাচ্চার কথা বলা যাবে সেদিন তাকে সবটা জানিয়ে পরেই অভিনবের জন্য প্রস্তাব রাখা যায়। আর এটা একটা অনিশ্চয়তার পথ তাই অভিনবের বাবাকে আশা না রাখতেই অনুরোধ করলো দিশান। চৈতী ঘুম থেকে উঠে ঘরে মেহমান বলতে কাউকেই দেখতে পায়নি। সুইটিকে অনেক প্রশ্ন করে সে জানতে পারলো তার বাবার বন্ধুরা এসেছিলো।

পরেরদিন দুটো ক্লাস ছিলো চৈতীর। এগারোটা পঁয়ত্রিশে তার ক্লাস তাই ক্যাম্পাসে বসে গল্প করছিলো চৈতী, দিথি আর আহানা। তাদের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু চৈতীর গালের কাটা দাগ। আহানা বলল লেজার ট্রিটমেন্ট করিয়ে নিতে দাগটার ওপর। চৈতী বিশেষ আগ্রহ দেখালো না কিন্তু দিথি বেশ উত্তেজিত হয়ে বলল, “চৈতী তোমার লম্বাটে চোখ মুখে সবচেয়ে সুন্দর হলো তোমার নাক আর গাল। এই গালটাকে এমন রাখলে ভালো দেখায় না। তুমি সত্যিই ট্রিটমেন্ট করাও।”

দিথির কথায় বিরক্ত হলো চৈতী। সে জবাব দিলো, ” জানি না কবে থেকে ঔষধ গিলছি এখনও তা চলমান। আবার এই ট্রিটমেন্টের চক্করে আর কত গিলবো?”
আহানা বলতে যাচ্ছিলো, এতে তো মার খাওয়ার না ত্বকের বাহ্যিক কাজ বেশি। কিন্তু তার কথা সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই দিথি চিৎকার করে ডাকলো, “এ্যাই আপনি কালকের সেই ড্রাইভার না!”

দিথির চিৎকারে চৈতী আর আহানাও ফিরে তাকালো। আহানা চৈতীর কনুই ধরে ফিসফিস করলো, “কোন ছেলে গো!”

দিথিই জবাব দিলো চৈতীর দিকে তাকিয়ে, “কালকে ওই যে কালি মাখা মুখে যে ড্রাইভারকে পরিচিত বলছিলে সেই তো এটা।”

অভিনব ডাক শুনে ফিরে তাকালো। চৈতীর দিকে তাকিয়ে দু কদম এগিয়ে সামনে এসেই জবাব দিলো, “হ্যাঁ আমিই সেই ড্রাইভার।”

দিথির মুখ হা হয়ে গেল অভিনবের দিকে তাকিয়ে। এই লোকটাকে কাল সে যতোটা হ্যান্ডসাম ভেবেছিলো লোকটা তার চেয়েও বেশি। আর অবাক করা বিষয় হলো আজ আর একে ড্রাইভার না কোন অফিসের নামীদামী বস মনে হচ্ছে। আহানা আবারও ফিসফিসিয়ে বলল, “কি বলছিস দিথি এটা ড্রাইভার! আল্লাহ, আমি তো ফিদা।”

চৈতী নিশ্চুপ নিষ্পলক চেয়ে আছে অভিনবের দিকে। লোকটা মিথ্যে বলেছে কাল। এই মুখ সে আগেও দেখেছে।কিন্তু কোথায়! এবার চৈতী নিজেই প্রশ্ন করে বসলো, “আপনি সত্যি সত্যি অন্যের গাড়ি চালান?”

“হ্যাঁ।”

“আপনার বাবা-মা আছে?”

“হ্যাঁ”

“তারা কি করেন?”

চোখের পলক না ফেলেই চৈতী লাগাতার প্রশ্ন করছে। অভিনবও চমৎকারভাবে মুখে সারল্যের ছাপ ফেলে জবাব দিচ্ছে, “আমার বাবা আর আমি দুজনেই গ্যারেজে কাজ করি। আর মা সেলাই করেন।”

“কি?”

“আরে ওই যে শাবানার মত ঘরে বসে কাপড়চোপড় সেলাই করে। আমার বাবাও অনেকটা জসিমের মত গরীব গ্যারেজের মিস্ত্রি।”

মুখটা কুমিরের মত মস্ত হা করে দিথি আর আহানা তাকিয়ে রইলো অভিনবের দিকে। একজন গ্যারেজ মিস্ত্রি এত সুন্দর কেন রে ভাই!

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here