অপেক্ষা পর্ব-(১৮+১৯+২০)
লেখিকা: সামিয়া বিনতে হামিদ
১৮।
দিব্য আর ইশার ইয়ার ফাইনাল এক্সাম শেষ হওয়ার পর দিব্যের মা রাজিয়া রহমান ইশার বাবা-মার কাছে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যান। কামাল উদ্দীন আর ইশিতা পারভিনও এ প্রস্তাবে অনেক খুশি হলেন। তারাও মেয়ের জন্য দিব্যের মতো ছেলেই খুঁজছিলেন।
রাজিয়া: আপনাদের যেহেতু কোনো সমস্যা নেই, তাহলে আর দেরী না করে শুভ কাজটি সেরে ফেললে ভালো হয়।
কামাল: দিব্য আর ইশার মত জানা খুব দরকার।
রাজিয়া: দিব্য এ প্রস্তাবে রাজি আছে। ওর মত নিয়েই এসেছি।
ইশিতা: আলহামদুলিল্লাহ। আপনি বসুন। আমি ইশাকে নিয়ে আসছি।
মিসেস ইশিতা ইশার কাছে গিয়ে বিয়ের ব্যাপারে কোনো আপত্তি আছে কিনা আর দিব্যকে পছন্দ কিনা তা জিজ্ঞেস করলেন। ইশা মনে মনে খুব লজ্জা পাচ্ছিলো, তবুও লজ্জা এক পাশে ফেলে ইশিতাকে জানায় তার কোনো সমস্যা নেই।
ইশিতা পারভিন মেয়েকে গোলাপী রঙের একটি শাড়ি পড়িয়ে আনলেন।
মিসেস রাজিয়া ইশাকে দেখে বললেন,
রাজিয়া: মাশাল্লাহ। খুব সুন্দর লাগছে মা তোমাকে।
রাজিয়া রহমান ব্যাগ থেকে স্বর্ণের চেইন বের করে ইশাকে পড়িয়ে দিলেন।
রাজিয়া: আপনাদের সমস্যা না থাকলে সামনের শুক্রবার মসজিদে আক্দ অনুষ্ঠানটা হয়ে যাক।
কামাল: আমাদের কোনো সমস্যা নেই।
ইশা তার ঘরে গিয়ে দিব্যকে ফোন করলো।
ইশা: হ্যালো।
দিব্য: হাই অপ্সরী। কেমন আছো?
ইশা: ভালো ছিলাম। এখন আরো বেশি ভালো আছি।
দিব্য: আমি কি হ্যাঁ বুঝে নেবো?
ইশা লজ্জা মাখা হাসি দিয়ে বলল,
ইশা: হুম।
দিব্য: আলহামদুলিল্লাহ। আমার অপেক্ষার অবসান হতে চলল।
ইশা: আমার অনেক নার্ভাস লাগছে, প্রথমবার তো।
দিব্য হেসে বলল,
দিব্য: আরে পাগলী বিয়ে কি দুই তিনটে করে অভিজ্ঞতা নেবে নাকি? আমারও তো প্রথমবার। কিন্তু আমি অনেক খুশি।
ইশা আর দিব্য এখন নতুন স্বপ্ন বাঁধায় ব্যস্ত।
এদিকে রাজিয়া রহমান ফয়সাল আহমেদকে বিষয়টি না জানিয়ে কিভাবে পারবেন? কতোবছর মানুষটিকে দেখেন নি। তার উপর কোনো অধিকার না থাকলেও সন্তানের উপর তো ঠিকই আছে।
রাজিয়াকে চিন্তিত দেখে দিব্য বলল,
দিব্য: কি ব্যাপার মা? বিয়ে করছে তোমার ছেলে, যুদ্ধে যাচ্ছে না যেভাবে ভাবছো।
রাজিয়া: ভাবছিলাম তোর বাবাকে একবার…..
দিব্য: কখনো না। তুমি ভাবছো উনি আমার বিয়েতে আসবে? যে মানুষ নিজের সংসার সামলাতে পারে নি, তিনি আমার জন্য মঙ্গল কামনা কিভবে করবে, মা? না, আমি চাই না তিনি আমার বিয়েতে আসুক।
রাজিয়া: তোর বাবার সাথে আমার সমস্যা, তোদের না। তোদের উপর পুরোপুরি অধিকার আছে তার।
দিব্য: তুমি খুশিতো?
রাজিয়া: আমি কেন খুশি হবো না। আমি অনেক খুশি।
দিব্য: আমার আর কিছুই লাগবে না। তোমার খুশি থাকাটাই যথেষ্ট।
দিব্যের আক্দের দাওয়াত রাজিয়া রহমান পরিচিত বন্ধুদের দেন। রক্তিমদের পরিবার আর দিব্যের ঘনিষ্ঠ বন্ধুরাসহ, ইশার পরিবারের সবাই আক্দ অনুষ্ঠানে আসে। রোহানকেও দাওয়াত করা হয়।
যখন থেকে সে শুনেছে দিব্য আর ইশার বিয়ে ঠিক হয়েছে, ভালো মতো খেতে পারছে না, ঘুমের মাঝেও সে শুধু ইশাকেই দেখছে। মাঝ রাতে ঘুম ভেঙে যায় এখন রোহানের। কি পরিমাণ কষ্ট পাচ্ছে সে কাউকে বোঝাতে পারছে না। এতো দু্র্ভাগা সে, কষ্টগুলো বুঝানোর মতোও কেউ নেই তার জীবনে।
আক্দের আগের দিন রাতে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে অনেকক্ষণ কান্না করেছিলো রোহান। অশ্রু যেন বাঁধা মানছে না আর। কালো আঁধারের মাঝে সুখ খোঁজার ব্যর্থ চেষ্টা করছে সে। চোখ বুজে জীবনের সমীকরণ মেলানোর চেষ্টা করছে।
গিটারে সুর তুললো, আজ গলা ছেড়ে গাইবে সে। এই গান শুনার কেউ নেই আজ, কেউ নেই রোহানের পাশে।
“আজ এই আকাশ কালো হয়ে বৃষ্টি ঝরে তোকেই ধরে,
ছন্দ ছাড়া হয়ে আমি খুঁজি তোরে আপনমনে,
মাঝে মাঝে মনে পড়ে সেইসব দিনগুলো তুই ছিলি না যখন,
মাঝে মাঝে কড়া নাড়ে সেইসব দিনগুলো তুই ছিলি না যখন,
তুই রবি আমারই,
তুই ছবি আমারই,
তোরে ছাড়া বাঁচি আমি কেমনে?
আজ এই আকাশ কালো হয়ে বৃষ্টি ঝরে তোকেই ধরে,
ছন্দ ছাড়া হয়ে আমি খুঁজি তোরে আপনমনে।”
শুক্রবার যোহরের নামাজের পর মসজিদে আক্দ সম্পন্ন হলো। তিনবার কবুল বলার পর দিব্য আর ইশা একে অপরের হয়ে গেল।
রোহান বসে বসে শুধু নিজের ভালোবাসার সমাপ্তি হতে দেখছে। এখন আর ইশার উপর তার কোনো অধিকার নেই। সৃষ্টিকর্তা ইশার জন্য দিব্যকেই লিখে রেখেছিলো।
রোহান চলে যাওয়ার সময় দিব্য এসে বলল,
দিব্য: কোথায় যাচ্ছিস? আজ বাসায় যাবি।
রোহান: তুই জানিস আমি কারো বাসায় যায় না।
দিব্য: সবাই আর আমি কি এক? চল দোস্ত। মার সাথে কখনো দেখা করিস নি। আর আঙ্কেলও আসে নি আজকে, দেখাও হয়নি কখনো। আমার বিয়ের খবর দিয়েছিলি তো?
রোহান: বাবা বাসায় নেই, একসপ্তাহ হচ্ছে সিলেট গিয়েছেন?
দিব্য: তুই বাসায় একা?
রোহান: হ্যাঁ, অভ্যাস আছে আমার একা থাকার।
দিব্য: আজ আমার বাসায় থাকবি। আমার সাথে।
রোহান: ইশা?
দিব্য: আরে শ্বশুর বাড়ী আসবে না এখন সে। আগে ইশার বর চাকরী খুঁজে পাক তারপর বউকে নিয়ে আসবে। ততোদিন বিবাহিত সিঙ্গেল পুরুষ হয়ে থাকবে।
রোহানকে আর কিছুই বলতে দেয় নি দিব্য। জোর করে নিয়ে আসে তার বাসায়।
আজ রোহান প্রথম কোনো বন্ধুর বাড়ী এসেছে। ছোটবেলা থেকেই তার নিজের বাড়ি আর ঊষার বাড়ি ছাড়া সে কোথাও যায় নি। বন্ধুদের সাথে পিকনিকে গেলেও একা একা বসে ছিলো এককোণে। দিব্য আসার পর হয়তো সে অনেক বেশি কথা বলেছে তার জীবনে। হ্যাঁ দিব্য খুব স্পেশাল তার জন্য। এই ছেলেটিকে হাসতে দেখলেই তার কষ্ট অনেকটা কমে যায়। কি এমন অদ্ভুত টান দিব্যের জন্য সে নিজেও বুঝে না।
আজ রোহানের জন্য কেমন সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছে সে হয়তো ভাবতেও পারবে না।
এদিকে আজকাল রিধিও রক্তিমের ভাবনায় ডুবে থাকে। একদিন রক্তিমের সাথে ঝগড়া না করলে যেন তার চলেই না। তবে ইফতির সাথে এখন খুব ভালোই বন্ধুত্ব হয়েছে রিধির। ফোনেও কথা হয় তাদের। পড়ার বিষয়েই বেশি কথা হয়। ওখান থেকেই হাসি তামাশা শুরু হয়ে যায়। রক্তিম ইদানীং রিধিকে বেশি ফোনে কথা বলতে দেখছে। যখন তখন কল আসে রিধির। রক্তিমের এখন সন্দেহ শুরু হয়, রিধি কারো সাথে প্রেম করছে না তো? রাতে ঘুমোতেও পারে না এখন রক্তিম। মনের মধ্যে একটাই চিন্তা, রিধি কারো সাথে রাত জেগে কথা বলছে হয়তো।
আর এদিকে রিধি সারারাত জেগে পড়াশুনো করে আর কোনো সমস্যা থাকলে ইফতিকে দেয় সমাধান করতে। এভাবেই তারা পড়া ভাগ করে নেয়।
দুজনেই রাত জেগে পড়ে,
রক্তিমের ঘুম হারাম করে।
১৯।
রিধি আর ইফতি ইশাদের বাসার নিচে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলো। রক্তিম মসজিদ থেকে দিব্যদের বাসার সামনে এসে রিধি আর ইফতিকে কথা বলতে দেখে ফেলে। রিধি রক্তিমকে খেয়াল করে নি। রক্তিমের এসব সহ্য হচ্ছে না।
রক্তিম মনে মনে বিড় বিড় করছে,
রক্তিম: আমার সাথে তো হেসে হেসে কখনো কথাও বলে নি। যখনই কথা বলতে আসবে মনে হবে খুন করতে আসছে। আর এখন মনে হচ্ছে লটারি জিতেছে! যত্তসব।
রিধি রক্তিমকে দেখে ফিক করে হেসে দিলো। রক্তিমও রাগ নিয়ন্ত্রণ করে দাঁতে দাঁত চেপে হাসি ফেরত দিলো।
ইফতি রক্তিমকে দেখে ঢুক গিলছে একটু পর পর। রক্তিমকে একটু বেশিই ভয় পায় সে।
রিধির কানের কাছে এসে বলল,
ইফতি: রক্তিম ভাইয়া এভাবে দেখছে কেন? মনে হচ্ছে এখনই এসে আমার বারোটা বাজাবে।
রিধি: কালো বিড়াল পাশ কাটলে যেমন অশুভ কিছু ঘটার সম্ভাবনা থাকে, ঠিক উনার নজর কারো উপর পড়লে দুর্ঘটনা ঘটার আভাস পাওয়া যায়।
ইফতি: কি বলো এসব?
ইফতি একটু ভীতু স্বভাবের, রিধি তাই মাঝেমাঝেই ইফতিকে ভয় দেখিয়ে মজা নেয়।
রিধি: হ্যাঁ, একদিন এভাবেই আমার দিকে পেঁচার মতো তাকিয়ে ছিলো, ওমনি পা পিছলে পড়ে গিয়েছিলাম। আরেকবার খাওয়ার সময় ঘুরে ঘুরে দেখছিলো আমাকে। ওমা, প্রচণ্ড ভাবে পেট ব্যথা শুরু হয়ে যায়।
ইফতি ভয়ে ভয়ে বলল,
ইফতি: আমাকে দেখে এখন কি ভাবছে বলো তো?
রিধি: তোমার পাঞ্জাবীটা ভারী সুন্দর। হয়তো…..!
ইফতি: না, না, ইশা আপু বার্থডে গিফট করেছিলো। আমার পাঞ্জাবি টা নষ্ট হয়ে যাবে না তো এখন?
রিধির এখন খুব হাসি পাচ্ছে।
রিধি: কারো উপকার করলে আর কিছু হবে না হয়তো। ফিজিক্সের যে ম্যাথ গুলো দিয়েছি তোমায়, ওগুলো সব আজকে রেডি করে আমাকে বুঝিয়ে দেবে। দেখবে আর কিছু হবে না।
ইফতি: এতগুলো ম্যাথ?
রিধি: ওই যে দেখছো, তোমার রক্তিম ভাইয়া? উনি দিয়েছেন। এখন উনার থেকে বাঁচার উপায়, উনার দেওয়া ম্যাথগুলো সমাধান করা। করবে তো তুমি?
ইফতি: অবশ্যই করবো।
রিধি ইফতি থেকে বিদায় নিয়ে রক্তিমের কাছে আসলো।
রিধি: আমি বাসায় চলে যাচ্ছি।
রক্তিম: এতো কিসের কথা ইফতির সাথে?
রিধি রক্তিমের কানের কাছে এসে বলল,
রিধি: সিক্রেট।
তারপর রিধি এক গাল হেসে চলে গেলো।
রোহান দিব্যের বাসায় ঢুকতেই ইতস্তত করছে। রাজিয়া রহমান মেহমানদের সাথে কথা বলছিলেন আর খুব ব্যস্ত ছিলেন। ছেলের বিয়ে বলে কথা। সময় পাবে কিভাবে!
দিব্য রোহানকে নিয়ে রাজিয়া রহমানের কাছে গেলো।
রাজিয়াকে দেখে রোহান কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলল।
দিব্য: মা, আমার বন্ধু, রোহান।
রাজিয়া ব্যস্ততার মধ্যে রোহানকে দেখেই জিজ্ঞেস করল,
রাজিয়া: কেমন আছো বাবা?
রোহান কিছু বলতেই পারছে না, কথা যেন আটকে গিয়েছে গলার মধ্যে।
দিব্য রোহানকে ঝাঁকুনি দিয়ে বলল,
দিব্য: কোথায় হারিয়ে গিয়েছিস?
এমন সময়, রাজিয়া রহমানের এক বান্ধবী তাকে ডেকে নিয়ে গেলো।
যাওয়ার সময় শুধু রোহানের দিকে মায়া ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন,
রাজিয়া: কিছু লাগলে জানাবে! সংকোচ করবে না। আমি তোমার মায়ের মতোই।
রোহানকে এভাবে রোবটের মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে, দিব্য টেনে রোহানকে তার ঘরে নিয়ে গেল।
দিব্য: এভাবে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলি কেন? মায়ের সাথে কথাও বলিস নি। আচ্ছা বুঝলাম তোর নার্ভাস লাগছিলো। তাই বলে এভাবে নার্ভাস হয়ে যাবি? একদম কথাই বলবি না? একদম স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে ছিলি।
রোহানের দিব্যের দিকে তাকাতেই কষ্ট হচ্ছে। দিব্যই তার ভাই। যাকে এতোদিন বন্ধু ভেবে এসেছে। যার জন্য তার এতো মায়া। এতো ভালোবাসে যে বন্ধুটিকে। সব ভালোবাসায় ত্যাগ করেছিলো রোহান, শুধু এই বন্ধুটির জন্য। আর এই বন্ধুটিই তার ভাই।
দিব্য: তুই ঠিকাছিস তো? কি হয়েছে?
রোহান: আমার শরীর ভালো লাগছে না। আমি বাসায় যাবো।
দিব্য: মাত্র এসেছিস। কিছু খাবি? আমি কিছু নিয়ে আসছি।
রোহান: না, প্লিজ। আমার বাসায় যাওয়া উচিত।
দিব্য: তোর খারাপ লাগছে, তোর বাসায়ও কেউ নেই। তোকে দেখবে কে? কিছুক্ষণ পর সব গেস্ট চলে যাবে। একটু বিশ্রাম করলে তোর ভালো লাগবে।
রোহানের এখন মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। একটু উঁচু গলায় বলল,
রোহান: সমস্যা কি তোর? বললাম না আমি বাসায় যাবো। এইটা কি আমার বাসা? তুই কি আমার ভাই? তোর মা কি আমার মা, যে আমার সেবা করবে রাতভর? বল? আর কতোবার বলবো আমার একা থাকার অভ্যাস আছে? আমার কেউ ছিলো না দিব্য, আমি একাই বড়ো হয়েছি, এখনো কারো দরকার নেই।
দিব্য রোহানের ব্যবহারে খুব অবাক হয়ে যায়। রোহান কখনো দিব্যের সাথে এভাবে কথা বলে নি।
দিব্য: এভাবে কথা বলছিস কেন আমার সাথে?
এমন সময় অনিক দিব্যের রুমে এলো। তাদের দুইজনের চেহারা দেখেই বুঝতে পেরেছে যে কোনো গণ্ডগোল লেগেছে।
অনিক: কি হয়েছে? তোদের এমন বিধ্বস্ত চেহারা কেন?
দিব্য: রোহান, দোস্ত কি হয়েছে একটু বল? আমার কোনো বিষয়ে তুই কষ্ট পেয়েছিস?
অনিক মনে মনে ভাবছে, ইশার ব্যাপার নিয়ে কোনো সমস্যা হয়নি তো?
অনিক দিব্যকে বলল,
অনিক: আমি দেখছি।
রোহানকে কিছু বলার আগেই রোহান বের হয়ে গেলো। অনিক রোহানের পেছন পেছন গেলো।
অনিক: আমি চাই না, তোর কারণে দিব্য কষ্ট পাক। আর তুই আজকেই ওর সাথে এমন করছিস? আজকে দিব্যের বিয়ে হয়েছে। আচ্ছা, আমি বুঝি না ছেলেটা তোর এতো কেয়ার করে, তোকে ভালো বন্ধু মনে করে, আর তুই কিনা ওর ভালোবাসা নিয়ে পড়ে আছিস?
রোহান অনিকের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকায়,
রোহান: মানে?
অনিক: মানে তুই ইশাকে ভুলে নতুনভাবে জীবন শুরু কর। প্লিজ দোস্ত দিব্যের ভালোবাসায় নজর দিস না। ইশা এখন দিব্যের বউ।
রোহান অনিককে ধাক্কা দিয়ে বলল,
রোহান: কি ইশা ইশা লাগিয়ে রেখেছিস? ইশা ছাড়া কি আর মেয়ে নেই? কি মনে করেছিস আমাকে? মানুষ মনে হয় না? হ্যাঁ? আমার কি কোনো আবেগ অনুভূতি নেই? দিব্যের মা আছে, পরিবার আছে, ভালোবাসাও আছে। আমার তো কিছুই নেই। ভাবছিস আমি কেঁড়ে নেবো সব? বল? এতোটাই তুচ্ছ আমি? একটা কথা শুনে রাখ, রোহানের কোনো কিছুর প্রয়োজন নেই। নজর তারা দেয় যাদের পাওয়ার লোভ আছে। আমার কোনো লোভ নেই। আমার কোনো আশা কোনোদিন ছিলো না, এখনো নেই, থাকবেও না। সো স্টেই আউয়েই ফ্রম মাই লাইফ!
রোহান বাসায় গিয়ে চুপচাপ বসে আছে। মাকে এতোদিন পর দেখেছে সে। পনেরো বছর শুধু ছবি দেখেই কাটিয়ে দিয়েছিলো। দিব্য আর দিয়া তার ভাইবোন। দিব্যকে ঘৃণা করতে পারছে না। ভালোবাসারও ইচ্ছে নেই আর। দিব্যকে দেখে খুব হিংসে হচ্ছে এখন। একাই সব পেয়েছে সে, রোহানের জন্য কিছুই রাখেনি। মা এতো ভালোবাসে দিব্যকে? একটিবারো তার কথা মনে পড়ে নি? কখনো জানতে চায় নি রোহান কেমন আছে? কতোরাত সে নির্ঘুম কাটিয়েছে, মা এসে তাকে ঘুম পাড়িয়ে দেয় নি। অসুস্থ হলে বাবা নার্স নিয়ে আসতো। মায়ের হাতে একটু পানি খাওয়ার কতো ইচ্ছে জাগতো তার। কখনো তো সে ছায়াটিও দেখে নি মায়ের।
মায়ের পুরোনো শাড়ি বের করে, তা জড়িয়ে ধরে রাখতো, আর এভাবেই ঘুমিয়ে পড়তো। কতোরাত শুধু মায়ের স্বপ্ন দেখেছে। ঘুম ভাঙলেই নিজেকে ছন্নছাড়া মনে হতো তখন। আর নিতে পারছে না রোহান।
রাগের মাথায় ঘরের জিনিসপত্র ভাংচুর শুরু করে দেয় সে। শব্দ শুনে দারোয়ান চলে আসে। রোহানকে শান্ত করার চেষ্টা করেও কোনো লাভ হচ্ছে না। তাই ফয়সাল আহমেদকে ফোন দিয়ে জানায়। সাথে সাথেই রওনা দেন তিনি।
সকালে বাসায় এসে দেখেন বাসার অবস্থা খারাপ।
দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করলে বলে, রোহান সবকিছু ভাংচুর করে ছাদে চলে যায়। এর পর আর কোনো খবর নেই তার।
ফয়সাল ছাদে উঠে দেখেন রোহান একপাশে পড়ে আছে। ছেলের মুখের অবস্থা দেখে আরো বিচলিত হয়ে পড়েন তিনি। দারোয়ানের সাহায্যে রোহানকে তার ঘরে নিয়ে আসেন। এর মধ্যে দিব্য রোহানকে অনেকবার ফোন দিয়েছিলো। কিন্তু কেউ ধরে নি। দুপুরেই ফয়সাল আহমেদ দেখেন দিব্যের কল আসছে রোহানের ফোনে। ছেলের নাম দেখেই খুশি হয়ে যান।
ফয়সাল: হ্যালো।
দিব্য: হ্যালো। কে বলছেন আপনি?
ফয়সাল: আমি রোহানের বাবা।
দিব্য: ওহ, আসসালামু আলাইকুম আংকেল। কেমন আছেন?
ফয়সাল: ওয়ালাইকুম আসসালাম। ভালো আছি। তুমি কেমন আছো বাবা?
দিব্য: ভালো আছি। রোহান বলল আপনি সিলেট গিয়েছিলেন!
ফয়সাল: হ্যাঁ, আজ সকালেই এসেছি।
দিব্য: আমি বলেছিলাম গতকাল আপনাকে সাথে নিয়ে আসতে। আপনি ছিলেন না তাই আপনার সাথে আর দেখাও হয়নি।
ফয়সাল: গতকাল? কোথায়?
দিব্য: আসলে আংকেল, গতকাল আমার আক্দ অনুষ্ঠান ছিলো। ছোট করেই হয়েছে। ঘরোয়া আয়োজন ছিলো।
ফয়সাল: মানে?
দিব্য: রোহান আপনাকে বলে নি? ও এসেছিলো কাল বাসায়।
ফয়সাল: রোহান তোমাদের বাসায় গিয়েছিলো? তোমার পরিবারের সাথে দেখা হয়েছে?
দিব্য: জি, মায়ের সাথে দেখা হয়েছিলো। আর ওর শরীর খারাপ লাগছে তাই চলে যায়। এখন রোহান কেমন আছে? অনেকবার ফোন দিয়েছিলাম। ধরছিলো না।
ফয়সাল: ও এখন ঘুমোচ্ছে। ও জাগলে তোমার কথা বলবো।
দিব্য: আচ্ছা, আংকেল। রাখছি।
ফয়সাল: ভালো থেকো। নতুন জীবন সুখের হোক।
ফোন রাখার পর ফয়সাল আহমেদ বসে পড়েন সোফায়। দিব্যের বিয়ে হয়ে গিয়েছে? তার ছেলের বিয়ে হয়েছে রাজিয়া তাকে জানানোর প্রয়োজন মনে করে নি? আর তিনি বুঝতে পেরেছেন, রোহানের এই অবস্থা তার মাকে দেখেই হয়েছে। ফয়সাল আহমেদ বুঝতে পারছেন না কিভাবে সামলাবে বিষয়টা? রোহানের বিধ্বস্ত মুখ দেখবেন নাকি দিব্যের বিয়ের ব্যাপারটা গোপন রাখার জন্য রাজিয়াকে দোষ দেবেন? তবে কি একবার রাজিয়ার সাথে কথা বলা দরকার? কি অপরাধের শাস্তি দিয়েছিলো রাজিয়া? যে অপরাধ কখনো তিনি করেননি সেই অপরাধের শাস্তি এতো বছরের? একবার কি প্রশ্ন করা উচিত নয়?
এতোবছরের অপেক্ষা আজ নিজ হাতে দূর করতে মন চাইছে।
অতীত, বর্তমানে উঁকি দিলেই মানুষ আবেগে বেয়ে যায়। ফয়সালের আবেগও হয়তো আজ বয়ে নিয়ে যাচ্ছে তাকে অতীতের সুখের দিনগুলোতে।
সন্ধ্যায় রোহানের জ্ঞান ফিরে। রোহান ফয়সালকে দেখেই এক প্রশান্তির হাসি দেয়। যেন সে গভীর জংগলে নিজেকে হারিয়ে এখন নিরাপদ আশ্রয় পেয়েছে। এই পরিচিত আশ্রয়টি এখন তার খুব প্রয়োজন। কারণ আজ মাথা রাখার কোনো জায়গা পাচ্ছে না সে। বড়ো ভারী লাগছে মাথাটি। এই ভার শুধু তার বাবাই তুলতে পারবে।
২০।
রাত বাজে ১২ টা। এমন সময় রিধির ফোনে ইফতির কল আসে। ওইসময় রিধি রান্নাঘরে গিয়েছিলো পানি খাওয়ার জন্য। রক্তিম রিধির রুমের দরজা খোলা দেখে রুমে ঢুকে। ইফতির কল দেখেই রক্তিমের মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। সে রাগে কল কেটে দেয়। আবার কল আসলে, মোবাইল বিছানায় ছুঁড়ে ফেলে দেয় সে। রিধি এসে তা দেখে ফেলল।
রিধি: হ্যালো, মিস্টার ওল্ডম্যান। আমার মোবাইল কি কোনো খেলনার জিনিস? রিধির সম্পত্তি ওকে? এভাবে ছুঁড়ে মারলেন কেন? আমি কিন্তু উঠিয়ে নিতে পারি সব।
রক্তিম: কি উঠিয়ে নেবে? বলো? কি করবে? আমার মোবাইল ভাঙবে?
রিধি: এতো রাতে কুকুরছানার মতো করছেন কেন?
রক্তিম: তুমি আমাকে কি বললে? কুকুরছানা?
রিধি: রাত ১২টায় নিরব শান্ত পরিবেশ কে নষ্ট করে? মানুষ? নাকি কুকুরছানা?
রক্তিম: এই মেয়ে, তুমি আমাকে এতো বড়ো কথা বললে?
রিধি: দোষ কি আমার নাকি আপনার? এতো রাতে আমার রুমে এসে গণ্ডগোল না করলে আমি ওমন করে বলতাম? আপনি নিজেই নিজের ফালুদা বানান।
রক্তিম: তুমি দিন দিন খুব বেড়ে যাচ্ছো, রিধি।
রিধি: অদ্ভুত তো! বেড়ে যাবো না? কোষ বিভাজন হচ্ছে নিয়মিত। আমি কিভাবে কন্সট্যান্ট থাকবো তাহলে?
রক্তিম: তোমার সাথে বাড়াবাড়ি করা মানে সময় নষ্ট।
রিধি: নিজে নিজেই ঝগড়া করতে আসেন। আমি যায় আপনার সাথে কথা বলতে?
রক্তিম: এতো রাতে ইফতি তোমাকে কেন কল দেবে?
রিধি: আমার বন্ধু। যখন ইচ্ছে তখন কল দেবে। আপনার কি সমস্যা?
রক্তিম: রিধি এতো রাতে ভদ্র ঘরের ছেলে-মেয়েরা কথা বলে না।
রিধি রক্তিমের কথা শুনে খিলখিলিয়ে হেসে দেয়।
রক্তিম: তুমি হাসছো কেন? আমি কি জোকস বলছি?
রিধি: তাহলে আপনি মেনে নিয়েছেন আপনি অভদ্র।
রক্তিম: মানে?
রিধি: রক্তিম, আপনাকে সবাই ব্রিলিয়ান্ট কেনো বলে? আমার তো আপনাকে টিউবলাইট মনে হয়। একটা সহজ কথাও বুঝেন না। মানে হচ্ছে এতো রাতে ভদ্র ঘরের ছেলে মেয়েরা কথা বলে না। আর আপনিও অভদ্রের মতো আমার রুমে এসে আমার সাথে ঘ্যানঘ্যান করছেন। এইটিতো আরো অভদ্রতা। ইফতির সাথে কথা বলতে ভালোই লাগে আমার। আর আপনি হচ্ছেন বিরক্তিকর।
রিধি মুখ ভেংচি দিয়ে বিছানা থেকে ফোন নিতে যাবে, তখনই রক্তিম ছোঁ মেরে ফোন নিয়ে নেয়।
রক্তিম: আমি বিরক্তিকর? আচ্ছা! এখন থেকে রাতে আমার কাছেই থাকবে তোমার ফোন। বাবা-মা জিজ্ঞেস করলে বলে দেবো, তুমি রাত জেগে মোবাইল চালাও। তখন আমাকে আর বাঁধা দেবে না।
রিধিকে কিছু বলতে না দিয়ে রক্তিম চলে যায়।
রিধি মনে মনে বিড়বিড় করছে,
রিধি: রক্তিমের বাচ্ছা রক্তিম, তুমি হচ্ছো একটা কৃমি। যখন তখন অন্যের সম্পত্তি আত্মসাৎ করতে আসো। বাট ডোন্ট ওয়ারী। কালকে আমিও তোমার বারোটা না বাজিয়ে থাকছি না।
আজ একটু ভোরেই ঘুম ভাঙলো ইশার। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে ভালো মতো দেখছে সে।
আর মনে মনে ভাবছে,
ইশা: আমি এখন কারো বউ। আমার উপর কারো অধিকার আছে। দিব্যের অধিকার আছে। বিশ্বাসও হচ্ছে না দিব্য আমার বর।
আজকে দিব্যের সাথে সকালে বের হবে ইশা। তাই সে গোসল করে নিলো। সাদারঙের একটি জামা পড়েছে লাল রঙের উড়না আর সেলোয়ার। নাস্তা করেই বের হয়ে গেল। ইশার বাসায় ভালো লাগছিলো না। দিব্যকে ভালো মতো দেখার জন্য মন ছটফট করছিলো।
ইশা নিচে নেমে দিব্যকে কল দিলো। দিব্য রেডি হয়ে নিচে নামলো।
দিব্য: অপ্সরী তুমি এতো তাড়াতাড়ি নিচে নেমে গেলে? আমাকে অপেক্ষা করাও নি কেন?
ইশা: অপেক্ষা কেন করাবো?
দিব্য: আমার বউটার জন্য অপেক্ষা করবো না? বউয়ের জন্য অপেক্ষা করতেও ভালো লাগে বুঝেছো!
ইশা: আচ্ছা এখন চলো।
দিব্য ইশার হাত ধরলো শক্ত করে।
দিব্য: এখন কিন্তু হাত ধরায় বাঁধা নেই।
ইশা মুচকি হাসলো।
দিব্য আর ইশা রিক্সায় উঠল। দিব্য মাথা ঝুঁকিয়ে ইশার দিকে তাকিয়ে আছে। ইশা লজ্জায় দিব্যের হাতটি চেপে ধরলো। দিব্য ইশার কাছে এসে ইশার সামনে আসা চুলগুলো ফুঁ দিয়ে সরিয়ে দেয়। ইশা এবার চোখ বন্ধ করে ফেলল।
দিব্য মুচকি হেসে বলল,
দিব্য: বরকে এতো লজ্জা পেতে নেই। আমি না তোমার বর এখন?
ইশা: হুম।
দিব্য: তুমি আমার দিকে তাকাও। চোখে চোখ রেখে যদি কথা বলো ভেতর থেকে নাড়া দেয়। তোমার চোখের ভাষা বুঝতে চাই আমি। তাকাও আমার দিকে।
ইশা চোখ উঠিয়ে দিব্যের দিকে তাকালো। সেকেন্ডেই চোখ নামিয়ে ফেলল।
দিব্য: এটা কি হলো?
ইশা: আমার লজ্জা লাগছে। আর এভাবে কেউ তাকিয়ে থাকতে পারে?
দিব্য: আচ্ছা, দেখতে হবে না আমাকে।
দিব্য মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার পর ইশার আর ভালো লাগছে না। ভালোই তো লাগছিলো যখন তাকিয়ে ছিলো।
মনে মনে নিজেকে বকছে ইশা, তাকিয়ে থাকলে কি এমন হতো? বরকেই তো দেখছি।
জোরে শ্বাস নিয়ে আস্তে করে ছাড়লো ইশা। এরপর দিব্যের মুখ নিজের দিকে ফিরিয়ে নিলো।
ইশা: তাকিয়ে থাকো আমার দিকে, আশেপাশে দেখতে হবে না। তোমার বউ কি রাস্তায় নাকি তোমার পাশে?
দিব্য মুচকি হেসে বলল,
দিব্য: আমার বউ, আমার অপ্সরী সবসময় আমার পাশেই থাকে।
দিব্য আর ইশা মেলায় গেলো। দিব্য ইশার জন্য লাল রঙের চুড়ি কিনলো। নিজ হাতে পড়িয়ে দিলো ইশাকে। তারপর ইশার হাত দুটি ঝাঁকালো।
দিব্য: যখন তোমাকে বাসায় নিয়ে আসবো, তখন প্রতিদিন চুড়ি পড়বে আর আমার কানের কাছে এসে এভাবে হাত দুটি ঝাঁকাবে, আর তখন আমার ঘুমও ভেঙে যাবে। ইশা, তুমি পাশে থাকলে না আমার কোনো এলার্ম ঘড়ির দরকার নেই।
এরপর দিব্য উড়না দিয়ে ইশার মাথায় কাপড় টেনে দিলো।
দিব্য: এখন লাগছে একদম দিব্যের বউয়ের মতো।
সারাদিন তারা অনেক ঘুরলো। ইশার প্রতিটি ইচ্ছেই যেন দিব্য পূর্ণ করতে পেরে খুব খুশি।
অন্যদিকে রোহান সারাদিন আজ বাসা থেকে বের হয়নি। ফয়সাল আহমেদ দুকাপ চা বানিয়ে আনলেন। রোহানের হাতে এক কাপ ধরিয়ে দিয়ে তার পাশে বসলেন। দুজনেই চুপচাপ।
রোহান নিরবতা ভেঙে বলল,
রোহান: বাবা, তুমি কেন বলেছিলে মা দেশের বাইরে থাকে? আর দিব্যকে তুমি চিনতে? তুমি জানতে দিব্য আমার ভাই?
ফয়সাল: হ্যাঁ, জানতাম। তারা দেশেই ছিলো। কিন্তু রোহান আমি তোকে হারাতে চাই নি। আমি চাই না তুইও আমাকে ছেড়ে চলে যাস। আমি একা একা কি নিয়ে থাকবো?
রোহান চেয়ার ছেড়ে ফয়সালের পায়ের কাছে এসে বসলো।
রোহান: আমি তোমাকে ছেড়ে যাবো না, বাবা। তুমি ছাড়া আর কেউ নেই আমার।
কিছুক্ষণের জন্য তারা নিজেদের দ্বীপের বাসিন্দা মনে করছে। আশেপাশে কেউ নেই, যেন তারা একে অপরের হাত ছাড়লেই হারিয়ে যাবে।
রোহান: বাবা, মা আমাদের ছেড়ে কেন চলে গিয়েছে? আমাদের কি কোনো দোষ ছিলো? বলো না?
ফয়সাল আহমেদ কিছু বলার আগেই পেছন থেকে ঊষা বলে উঠল,
ঊষা: কে বলেছে ছেড়ে গিয়েছে, আমি কি নেই? আমি এখনো আছি। তোর মা আছে।
ঊষাকে ইদানীং রোহান সহ্য করতে পারছে না। আগে সে ছোট ছিলো তাই হয়তো বুঝতো না, কিন্তু এখন সে ঠিকই বুঝতে পারছে ঊষা কি বুঝাতে চায়। রোহান ঊষার কথার উত্তর না দিয়ে চলে যায়।
ঊষা রোহান চলে যাওয়ার পর ফয়সাল আহমেদকে বলল,
ঊষা: আজকাল রোহু আমার সাথে তেমন কথায় বলে না ফয়সাল।
ফয়সাল: রোহান বড়ো হয়েছে। এখন কি ও কিছু বুঝবে না ভাবছো?
ঊষা: তোমাকে আমি বলেছিলাম রোহু যখন ছোট ছিলো তখনই যদি আমরা বিয়ে করে ফেলতাম…..
ফয়সাল: যাস্ট স্টপ ইট ঊষা। রাজিয়া এখনো আমার স্ত্রী।
ঊষা: তুমি কি বুড়ো বয়সে ওকে ডিভোর্স দেবে ভাবছো? আশ্চর্য তো তুমি! এতোবছর আলাদা থাকছো, ডিভোর্স দিয়ে দিলে সারাজীবনের সমস্যা শেষ।
ফয়সাল: রাজিয়া আমার জন্য সমস্যা নই। আর আমি রাজিয়াকে ডিভোর্স দিবো কিনা দিবো না সেটি আমার একান্ত ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। তোমার সমস্যা কোথায়?
ঊষা: আমি তোমার অপেক্ষায় আছি ফয়সাল।
ফয়সাল: আমি তো তোমাকে বলি নি অপেক্ষা করতে! আমি এখনো রাজিয়াকেই ভালোবাসি।
ঊষা: আমার ভালোবাসার কি কোনো মূল্য নেই তোমার কাছে?
ফয়সাল: যে মানুষটি নিজের ভালোবাসা বাঁচাতে পারে নি, তার কাছে তুমি কিসের ভালোবাসা আশা করছো ঊষা?
ঊষা: রাজিয়া তোমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছে, ভুলে যাচ্ছো?
ফয়সাল: আমিও তো তাকে ফেরাতে যায়নি। আমারও তো দোষ আছে।
ঊষা: তোমার উপর মিথ্যে অপবাদ দিয়েছে।
ফয়সাল: ঊষা আমি চাই না, তুমি আমার পরিবারসংক্রান্ত কোনো ব্যাপারে জড়াও।
ঊষা: আজ এতোবছরেও তুমি আমাকে পর ভাবছো? আর এখনো রাজিয়াকে নিয়েই ভাবছো? আমার এতোবছরের অপেক্ষার সমাধান দাও।
ফয়সাল: আমার বন্ধু আজিজ, খুব ভালো ছেলে। তোমাকে খুব পছন্দও করে। খালাকে বলে বিয়ের কথা এগিয়ে নিতে পারি।
ঊষা রেগে ফয়সালের চায়ের কাপ ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়।
ঊষা: আই হেইট ইউ।
ফয়সাল ঠান্ডা স্বরে বলল,
ফয়সাল: আই লাইক ইট। এখন তুমি তোমার বাসায় যেতে পারো। আমি চাই না রোহানের কোনো সমস্যা হোক তোমাকে নিয়ে।
এদিকে দুপুরে রক্তিম গোসলে ঢুকে। বাসায় নবনী আর জুনাইয়েত ছিলো না। এই সুযোগে রিধি ছাদে উঠে পানির পাইপ লাইন বন্ধ করে দেয়।
হঠাৎ পানি চলে যাওয়ায় রক্তিম অবাক হয়ে যায়।
রক্তিম: রিধি, এই রিধি, কয় তুমি?
রিধি মুখ চেপে হাসছে,
রিধি: জি, ভাইয়া আমাকে ডেকেছেন?
রক্তিম: ভাইয়ার বাচ্চা, পানি কেন চলে গেছে?
রিধি: আমি কি পানি গবেষক? আমি কিভাবে বলবো?
রক্তিম: দুই মিনিটের মধ্যে পানি না আসলে তুমি আজকে মারা খাবে।
রিধি: আচ্ছা, দেখছি।
রক্তিম: তাড়াতাড়ি দেখো।
রিধি: আরে বাবা দেখছি, কিভাবে মারা খায়।
রক্তিম: রিধি মাথা গরম করবে না বলছি। পানি ছাড়ো।
রিধি: এক শর্তে।
রক্তিম: তোমার শর্তের বারোটা বাজাবো আমি।
রিধি: আচ্ছা, আপনার তখন চৌদ্দটা বাজবে বের হতে।
রক্তিম: কি শর্ত?
রিধি: আজকে থেকে আমার মোবাইল নিয়ে যাবেন না রাতে।
রক্তিম: আচ্ছা, একবার বের হতে দাও। তারপর বোঝাবো মোবাইল ফোন কাকে বলে।
রিধি: ওকে বাই বাই। আমি তো মুভি দেখবো এখন।
রক্তিম বাসি কাপড় পড়ে বের হয়ে যায় আর রিধির রুমে আসে।
রিধি রক্তিমকে দেখে ভয়ে চিৎকার করে উঠে,
রিধি: ভুত, ভুত, ভুত। আ আ আ আ।
টেবিলের নিচে ঢুকে কান্নাকাটি শুরু করে দেয়।
রক্তিম: রিধি আমি রক্তিম। কি করছো, রিধি?
রিধি কান্নামাখা কন্ঠে বিড়বিড় করছে, আর তার হাত পা কাঁপছে, রক্তিম রিধির অবস্থা দেখে ভাবছে রিধি হয়তো ভয় পেয়েছে। তাই শক্ত করে রিধির হাত ধরে রিধির পাশে বসলো। আর রিধির মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো।
রক্তিম: আচ্ছা ভয় পেয়ো না। আমি আছি। কিছু বলবো না রিধি। আর কেঁদো না প্লিজ।
রিধি মনে মনে হাসছে,
রিধি: আমি আর ভয় তাও এই রাক্ষসকে। হুহ একটু নাটক না করলে আজ আমাকে মেরে চ্যাপটা করে দিতো। আমিও বোকার মতো রুমের দরজা খোলা রেখেছিলাম। আমার মাথায়ও আসে নি এই রাক্ষসটা বের হয়ে যাবে তাও এমন অবস্থায়। আল্লাহ ধন্যবাদ তোমাকে। এমন সময় মাথায় বুদ্ধি এসেছিলো, তা না হলে আমার কি অবস্থা করতো!
আহা, কি ভালোবাসা, ভুলেই গিয়েছে কিছুক্ষণ আগে আমি কি করেছিলাম। বেঁচে থাকো বাবা, সারাজীবন এভাবেই আমার থেকে পঁচা বাঁশ খাও।
চলবে–
আগের পর্বের লিংক:
https://www.facebook.com/groups/371586494563129/permalink/373832644338514/