অপেক্ষা পর্ব-৩২+৩৩ (স্পেশাল পর্ব)
লেখিকা: সামিয়া বিনতে হামিদ
৩২।
দিব্য আর ইশার আনুষ্ঠানিক ভাবে বিবাহ উৎসবের আয়োজন শুরু হয়। যেহেতু দিব্য জব পেয়েছে তাই এখন সে ইশার দায়িত্ব নিতে পারবে। এতোদিন বৈধভাবেই তাদের প্রেম চলছিলো। রাজিয়া রহমানও এখন পুত্রবধূকে ঘরে তুলতে চান। তাই আর দেরী করলেন না।
এক সপ্তাহের মধ্যে তাদের বিয়ের কার্ড ছাপানো হয়ে যায়। এরপর দিব্য আর ইশার বিয়ের বাজার করা শুরু হয়। আরো একসপ্তাহ চলে যায় তাদের বিয়ের বাজার, সব ধরণের আয়োজন, সবাইকে দাওয়াত করা এসবে।
রোহানও মুখে প্লাস্টিক হাসি ঝুলিয়ে দিব্যের খুশিতে অংশ নিচ্ছে। আজ সারাদিন দিব্যের সাথেই ছিলো। অনেক রাত করেই বাসায় আসে রোহান। রাত দেড়টা বেজে যায়। বাসায় এসে যা দেখলো তা দেখার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলো না রোহান।
ঊষা ফয়সালের পা ধরে বসে আছে। অনেক কান্না করছিলো সে। রোহান দৌঁড়ে এসে ঊষাকে উঠিয়ে চেয়ারে বসায়।
রোহান: ঊষা মা, তুমি এভাবে কাঁদছো কেন?
ফয়সাল আহমেদের দিকে তাকিয়ে বলল,
রোহান: বাবা, কি হয়েছে? আমি না কিছুই বুঝতে পারছি না।
ফয়সাল: তোর ঊষা মাকে জিজ্ঞেস করে দেখ।
ঊষা: আমাকে কেন জিজ্ঞেস করবে, ফয়সাল? উত্তর তোমার কাছে। সব প্রশ্নের উত্তর তোমার কাছে আছে। এতোটা বছর তোমার অপেক্ষায় ছিলাম। আর কতো? আমার একটা জীবন আছে তো? সমাজের মানুষ কতো কথা রটিয়ে যাচ্ছে। আমার কথা তুমি কি একবারো ভাবো নি? শুধু রাজিয়া রাজিয়া রাজিয়া। সারাদিন রাজিয়া। চলে গিয়েছে তোমাকে ছেড়ে তোমার রাজিয়া। তারপরও তুমি ওই মহিলার অপেক্ষায় আছো?
রোহান একটু গরম গলায় বলল,
রোহান: ইনাফ, ঊষা মা। আমার মাকে নিয়ে আর একটাও বাজে কথা বলবে না। তুমি কী জানো আমার মায়ের সম্পর্কে?
ঊষা: রোহু। তুইও এখন তোর বাবার মতো হয়ে গেছিস? যে মা তোকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলো, তোর কথা ভেবেও দেখে নি, আজ সেই তোর জন্য এতো গুরুত্বপূর্ণ?
ফয়সাল: ঊষা, খবরদার আমার ছেলেকে যদি কোনো উল্টাপাল্টা কথা বোঝাও। ভালো হবে না কিন্তু। আর এতোরাতে অভদ্রের মতো আমার বাসায় এসে আমাকে বিরক্ত কেন করছো? লোকে কথা না রটিয়ে আর কি করবে বলো? এখন বাসায় যাও। আমি তোমায় এতো রাতে আমার বাসায় থাকতে দিতে পারি না।
ঊষা: আমি তোমাকে ভালোবাসি ফয়সাল।
ফয়সাল: আমি আর কতো বার বলবো আমি তোমাকে ভালোবাসি না। ঊষা তুমি আমাকে বাধ্য করো না কঠোর হতে। বেশি বাড়াবাড়ি করছো তুমি। আজিজ ভালো ছেলে, ওকে বিয়ে করার পর তুমি সুখী হবে। এখন যাও।
ঊষা: তোমাকে ছাড়া আর কারো সাথেই ভালো থাকবো না আমি।
রোহান ঊষার হাত ধরে তাকে সোফায় বসালো।
রোহান: ঊষা মা, ভালোবাসায় কোনো জোর খাটানো যায় না। তুমি যাকে ভালোবাসো, সে তোমাকে ভালো না বাসলে এখানে তোমার কোনো অপরাধ নেই। ভাগ্য হয়তো তোমার সাথে ছিলো না। কিন্তু ভাগ্য পরিবর্তন করা যায়। তুমি হয়তো বাবাকে ভালোবাসো, বাবাও তো মাকে ভালোবাসে। একটা পরিবার ছিলো আমাদের। শেষ হয়ে গেছে সব। কিন্তু আমি আবার সব ঠিক করে দিতে চাই। আমারও অনেক ইচ্ছে হয় বাবা-মা, ভাই, বোনকে নিয়ে একসাথে থাকার। একটা নরমাল পরিবার হোক আমার। আমার বাবা-মা দুইটিই চাই। বাবা-মার এখনো তালাক হয়নি। হয়তো আল্লাহ চান না তারা আলাদা হোক। হয়তো এতোটা বছর তাদের অপেক্ষার কোনো ভালো সমাপ্তি হবে। তুমি বাঁধা দিও না প্লিজ। তখন কেউ ভালো থাকবে না। আমি তোমাকে মায়ের জায়গায় কখনো বসাতে পারবো না। দিয়া আর দিব্যকে বলেছি আমার বাবার কোনো দোষ নেই। তারা ভুল বুঝেছে আমার বাবাকে। এখন তোমার জেদ আমাকে তাদের সামনেও ছোট করে দেবে। আর মা? মাকে আমি কিভাবে মুখ দেখাবো? এতোবছরেও মা তৃতীয় কোনো ব্যক্তিকে তার জীবনে আসতে দেয় নি। একাই বড়ো করেছে দিব্য আর দিয়াকে। হয়তো তিনি বাবার অপেক্ষায় ছিলেন। এভাবে মনটা ভেঙে দিও না তার। তুমি অন্যকে কষ্ট দিয়ে সুখী হবে না। ভালোবাসা ত্যাগ করে অন্যকে ভালোবাসার সুযোগ দাও। দেখবে তোমার জীবনে ভালোবাসার অভাব হবে না। আমিও ত্যাগ করেছি আমার ভালোবাসা। জানো আমি বিনিময়ে আমার মাকে পেয়েছি, একটা আদরের ছোট বোন পেয়েছি, জীবনের চেয়ে প্রিয় একটা ভাই পেয়েছি, যে আমাকে নিজের চেয়ে বেশি ভালোবাসে। ঊষা মা, তোমাকে সম্মান করি আমি। প্লিজ তুমি চলে যাও আমাদের জীবন থেকে। আমার পরিবারটা জোড়া লাগানোর ইচ্ছে আছে আমার। দয়া করে সব ধ্বংস করে দিও না। কিছুদিন পর দিব্যের বিয়ে। বাবাকে দেখো কতো দুর্ভাগ্য তার। তোমার চেয়ে বহুগুণ কষ্টে আছে সে। নিজ ছেলের বিয়েতে যাওয়ার কোনো অধিকার নেই তার। তুমি তো বাবাকে ভালোবাসো, তাই না? কিভাবে পারবে তাকে কষ্ট দিতে? বলো।
রোহানের বলা কথাগুলো আজ ঊষা বুঝতে পারছে। কি করেছে এতোটা বছর? কার জন্য অপেক্ষায় ছিলো? যাকে পাওয়ার জন্য এতো কিছু করেছে সে, আজ তাকে পেয়েও হারিয়ে ফেলেছে। রাজিয়া নেই তাদের দুইজনের মাঝে,তবুও ফয়সালের মনে এখনো রাজিয়ায় আছে। ঊষা আর পারছে না দাঁড়িয়ে থাকতে। লজ্জায় নিজেকে খুন করে ফেলতে মন চাইছে তার। এতোটা নির্লজ্জ হয়ে পড়েছে যে আজ রোহানও তাকে বোঝা ভাবছে। এতোটুকু বাচ্চা যাকে ছেলের মতো ভালোবেসে ছিলো। আজ সেও চায় না ঊষাকে। ঊষা বেরিয়ে গেলো কিছু না বলে।
রোহান ফয়সালের কাছে এসে বলল,
রোহান: বাবা, তুমি চিন্তা করো না। ঠিক হয়ে যাবে সব।
ফয়সাল: অনেক বড়ো হয়ে গিয়েছিস। সব বুঝিস। তোর মা কেমন আছে রে? অনেক ব্যস্ত তাই না? ছেলের বিয়ে, সব একা একা সামলাচ্ছে, না?
রোহান: আমি আছি তো। আর দিব্য নিজেই করছে অনেকটা কাজ। আর অনিকও আছে। তুমি চিন্তা করো না। ঘুমোতে যাও।
সকালে ফোন বাজার শব্দে ইশার ঘুম ভাঙলো।
ঘুম ঘুম কন্ঠে বলল,
ইশা: কে?
মারিয়া: তোর বরের শালী।
ইশা: মারিয়া, তুই এতো সকাল সকাল?
মারিয়া: তুই বিয়ে করতেছস বলে কি আমাদের ভুলে যাবি?
ইশা বিছানা ছেড়ে উঠে বসলো।
ইশা: ভুলে কই গেলাম? বিয়ের দাওয়াত তো দিলাম।
মারিয়া: দাওয়াত না, তোকে চায়।
ইশা: আমাকে নিয়ে কি করবি?
মারিয়া: আমাদের জন্য একটা দিন উৎসর্গ কর। দেখা করবি আমাদের সাথে।
ইশা: কবে?
মারিয়া: আজকে।
ইশা: আচ্ছা, কোথায় আসবো?
মারিয়া: আমি তোকে নিতে আসবো। সো এখন ঘুমা। রাখছি।
ইশা: হুম।
ইশা ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে নিলো। বিকেলে মারিয়া এসে ইশাকে নিয়ে গেলো রাইসাদের বাসায়। ইশা সেখানে সবাইকে দেখে খুব খুশি হলো। ইশার বিয়ে উপলক্ষে এই পার্টি রেখেছে ইশার বান্ধবীরা। রাইসার বাসায় কেউ ছিলো না, রাইসার বাবা-মা আর ছোটবোন গ্রামের বাড়ী ছিলো। তাই রাইসাদের বাসায় এই পার্টি করার প্ল্যান হয়েছে।
তারা সবাই সেজেগুজে শাড়ী পড়লো। ইশা লাল পাড়ের হলুদ শাড়ী পড়েছে। সবাই কেক কাটলো, ইশাকে হলুদ লাগালো, অনেক মজা করেছে আজ ইশা। সাদিয়া বসে বসে ইশার ভিডিও করে সব দিব্যকে পাঠিয়ে দেয়।
দিব্য ভিডিও গুলো দেখে হাসছে। দিব্য ইশাকে প্রথম নাচতে দেখেছে। আজ তার অপ্সরীকে বেশিই সুন্দর লাগছে। মনে হচ্ছে একটি হলুদ পরী, পৃথিবীতে নেমে এসেছে শুধু দিব্যের জন্য।
দিব্য মনে মনে বলছে,
দিব্য: আর মাত্র তিন দিন, এরপর তুমি দিব্যের রাজ্যের পার্মানেন্ট বাসিন্দা। আর পালানোর উপায় নেই। সারাদিন বসিয়ে রাখবো চোখের সামনে।
দুইদিন পর ইশা-দিব্যের মেহেদী রাত্রি। মেহেদী একসাথেই হয়। ইশা অফ হোয়াইট লেহেঙ্গা পড়েছে, দিব্য সাদা পাঞ্জাবী। দুইজনকে একসাথে খুব মানিয়েছে।
রোহান আজ নীল রঙের পাঞ্জাবী পড়েছে। রোহানকে দেখে ইশার বান্ধবীরা ইশাকে গুঁতাগুঁতি দিচ্ছে।
ইশা বিরক্ত হয়ে বলল,
ইশা: কি করছিস এসব? আজকের দিনটা অন্তত আমার মান-সম্মানের খেয়াল রাখ।
সাদিয়া: দিব্য ভাইয়ার ভাইটা না কিউটের ডিব্বা। আমার সাথে একটু…..
ইশা: খবরদার একদম নজর দিবি না। তোকে আমি আমার জা বানাবো না। সারাদিন ঘুমাবি আর আমাকে দিয়ে কাজ করাবি। হুহ।
সাদিয়া: এমন করে বলবি না, নজর লাগিয়ে দেবো কিন্তু। তখন আর বিয়েই হবে না তোর দেবরের। আর তোর সাহায্য লাগবেও না আমার, দিব্য ভাইয়া আছে না!
ইশা: হুহ, আমার বর থেকে দূরে থাক। আর পটানো এতো সহজ না রোহান ভাইয়াকে। মাথার তাপমাত্রা সবসময় উপরে থাকে। চটকা মেরে দেবে একেবারে। তখন তোকে খুঁজে পাওয়া যাবে শরণার্থী শিবিরে।
দিব্য আর ইশা পাশাপাশি বসে আছে। রোহান তাদের দিকে তাকিয়ে হাসলো।
মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে বলল,
রোহান: আজকের রাতটা অনেক স্পেশাল আমার ভাইয়ের জন্য। আগামীকাল সে তার ভালোবাসার মানুষটির সাথে নতুন জীবন শুরু করবে। তাদের নতুন জীবন সুখের হোক এই দোআ করি।
রোহান গিটার হাতে নিয়ে দিব্যের দিকে তাকিয়ে বলল,
রোহান: তোদের জন্য।
“এ যেন সহজ
স্বীকারোক্তি আমি যুগান্তরি নই
এ যেন ভীষণ আক্ষেপ আমার
আমি দিগ্বীজয়ী নই
শুধু একটাই আশা আমি বুকে জড়িয়ে রব
সারাটি জীবন তোমায় নিয়ে
.
কোন এক নিঃসঙ্গ
রোদেলা রাতে দেখেছি
প্রিয়তমা তোমার চোখে মিষ্টি হাসি
কোন এক দুঃসহ
জোছনা দিনে বাতি নিভে গেলে
কড়া নেড়েছি তোমার হাতের ঘরে
কিছু অর্থহীন শব্দ বুনে ডেকেছি তোমায়
প্রেম তুমি কোথায়
.
বিন্দু আমি, তুমি আমায় ঘিরে
বৃত্তের ভেতর শুধু তুমি আছো
মাতাল আমি তোমার প্রেমে
তাই অর্থহীন সবই যে প্রেম লাগে।”
মেহেদী অনুষ্ঠান শেষ হলে রোহান বাসায় চলে যায়। আগামীকাল দিব্য-ইশার বিয়ে। কালকের রাতটা তাদের জন্য স্পেশাল আর রোহানের জন্য বেদনার।
ইশার রেকর্ড করা কবিতা, গান এখনো আছে মোবাইলে। রোহান শুনছে মনোযোগ দিয়ে, আর জ্বলছে বিরোহ শোকে।
কাঁপা গলায় আকাশের দিকে তাকিয়ে ইশার জন্য একটা গান গাইবে সে। ইশা শুনবে না। ইশার জানা হবে না আজ একটা নিঃসঙ্গ মানুষ তার ভালোবাসার ত্যাগ দিচ্ছ। ইশা দেখবে না সেই অশ্রু সিক্ত চোখ যে চোখ ইশাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছিলো। একটি ভাঙা মন যেখানে বসিয়ে রেখেছিলো ইশা নামের একটি মেয়েকে খুব যত্নের সাথে।
রোহান: ইশা তোমার জন্য একটা গান গাইবো আজ। শুধু তোমার জন্য।
“যখন নিঝুম রাতে
সব কিছু চুপ,
নিষ্প্রাণ নগরীতে
ঝিঝিরাও ঘুম!
আমি চাঁদের আলো হয়ে,
তোমার কালো ঘরে;
জেগে রই সারা নিশি
এতটা ভালবাসি…
এতটা ভালবাসি…
.
এ কি অপরূপ সুন্দর
তার স্বপ্নের বর্ষা রাতে;
আমি ভিজে ভিজে মরি
মিছে মগ্ন প্রভাতে…
দেখি ভিষণ অন্ধকার মাঝে
আলো ছায়ায় তার নূপুর বাজে!
আমি যে ভেবে ভেবে শিহরিত…
আমি সূর্যের আলো হয়ে
তোমার চলার পথে
ছায়া হয়ে তোমায় দেখি
এতটা ভালবাসি।
হুম….. এতটা ভালবাসি…”
এক দীর্ঘ হতাশায় কেটে যায় রোহানের জন্য আসা এই কালো রাতটি।
পরের দিন রাতেই দিব্য- ইশার বিয়ে। খুব ধুমধাম করেই বিয়ে হয়।
ইশাকে আনা হয় তার শ্বশুর বাড়ী। দিব্যের রুমে ইশাকে নিয়ে যায় দিয়া।
দিয়া: ভাবী, তুমি ফ্রেশ হয়ে নাও।
ইশা: আচ্ছা।
দিব্য বেশি দেরী করে নি তার অপ্সরীর কাছে আসতে। দিব্যকে দেখে ইশা বিছানা ছেড়ে উঠল। দিব্যকে সালাম করলো।
দিব্য: আজ আর তোমার প্রশংসা করবো না। কারণ আজ সব ভাষায় কম পড়ে যাবে তোমার ব্যাখ্যা দিতে।
ইশা: তোমার চোখে আমি এমনিতেই সুন্দর। ভালো না লাগলেও তুমি অপ্সরীই বলবে।
দিব্য: হ্যাঁ, আমার ভালোবাসাটা সবসময় থাকবে তাই। কারণ ভালোবাসার মানুষ কখনো অসুন্দর হয় না।
ইশা মুচকি হাসলো। আজ এই রাতটি দিব্য আর ইশার। দিব্য আজ ইশাকে খুব ভালোবাসবে। ভালোবাসার সাগরে ডুবে গেলেও দিব্যের কোনো আপত্তি নেই। দিব্য-ইশার অপেক্ষার সমাপ্তি হলো আজ। তাদের ভালোবাসার শেষ সমাপ্তি হলো আজ রাতে। এই সমাপ্তির পর শুরু হবে নতুন ভালোবাসার গল্প, যেখানে অতীতের কোনো ছায়া নেই, সুখের কোনো সীমা নেই। এখানে শুধু ভালোবাসাই মুখ্য, বাদবাকি সব সূক্ষ্ম।
৩৩।
ভার্সিটিতে যাওয়ার জন্য আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চোখে কাজল দিচ্ছিলো রিধি। নতুন নতুন অনেক বন্ধু-বান্ধবী জুটিয়েছে সে। তাদের সাথে আড্ডা দিতে খুবই ভালো লাগে তার। তাই ক্লাস না থাকলেও চলে যায় ক্যাম্পাসে। মাঝে মাঝে ক্যাম্পাসের ইটের রাস্তায় দিয়া আর রিধি খালি পায়ে হাঁটে, গল্প করে। অনেক ভালোই কাটছে রিধির দিন।
এখন আর রিধির জীবনে কোনো কষ্ট নেই। কারণ রক্তিমের সাথে সব কিছু ঠিক হয়ে গিয়েছে। তাই তো রিধির মনে এতো আনন্দ।
মন থেকে খুশি থাকলে মানুষের মুখের চাকচিক্য বেড়ে যায়। রিধিরও মন এখন চাকচিক্যময়। রিধি আর রক্তিমের জীবনে এসেছে নতুন প্রেমের অধ্যায়।
তাদের এই নতুন প্রেমের গল্প শুরু হয় দুই সপ্তাহ আগে। রক্তিম তিন মাস পর যখন দেশে এসেছিলো তখন।
দুই সপ্তাহ আগে-
রক্তিম দেশে আসার পর থেকে রিধি রুম বন্ধ করে বসে থাকতো। রক্তিমের সামনে আসতো না। একদিন রাতে রিধি পানি খাওয়ার জন্য রুম থেকে বের হয় পা টিপে টিপে। রক্তিম সুযোগ খুঁজছিলো রিধির সাথে কথা বলার। সে সবসময় নজর রাখতো রিধির উপর। আজ সুযোগ পেয়েও যায়। রিধি রুমে এসে দরজা বন্ধ করে দিয়ে ঘাড় ফিরিয়ে রক্তিমকে দেখলো। রিধি যেই মাত্র ভয়ে চিৎকার করবে রক্তিম তাড়াতাড়ি তার হাত দিয়ে রিধির মুখ চেপে রিধির উপর ঝুঁকে দাঁড়ায়। নিশ্বাসবন্ধ হয়ে আসছে রিধির। কয়েক সেকেন্ডের জন্য ঘোরের মাঝে চলে যায় রিধি-রক্তিম।
রিধির হুঁশ আসলে রক্তিম থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু রক্তিম রিধিকে শক্ত করে চেপে ধরে দরজার সাথে। বহু দিন পর রিধিকে কাছে পেয়েছে রক্তিম, এতো সহজে ছেড়ে দেবে না সে।
রিধি উপায় না পেয়ে রক্তিমের হাত কামড়ে দেয়।
রক্তিম: আহ, রিধি লেগেছে খুব।
রিধি: লাগুক। খুনী একটা, আমি এখন মা-বাবাকে ডেকে বলবো আপনি আমার শ্বাসরোধ করে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করছেন। আপনার উপর মামলা করবো আমি।
রক্তিম রিধির কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলল,
রক্তিম: আর কি কি করবে?
রিধি কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলল। কি বলবে মাথায় আসছে না। মাথাটা একেবারে ফাঁকা ফাঁকা লাগছে।
রক্তিম রিধিকে ছেড়ে মাথায় একটা ঠুকা দেয়।
রক্তিম: এতো রাগ আমার রিধির?
রিধি: আমার রিধি, আমার রিধি কি? আমি আপনার রিধি না।
রক্তিম: কার রিধি তাহলে?
রিধি: কারো না, এখন যান নিজের রুমে। কেনো বিরক্ত করছেন আমাকে? অদিতি আপু নেই তাই?
রক্তিম: অদিতির সাথে আমার কিছু নেই রিধি।
রিধি: যা বুঝার আমি বুঝেছি। প্লিজ আমার আবেগ নিয়ে খেলবেন না। আমি কোনো খেলনা না।
রক্তিম: তোমার সাথে আমি কি খেলতে পারি? আই লাভ ইউ রিধি। অনেক ভালোবাসি তোমায়।
রিধি রক্তিমের সামনে থেকে সরে যায়।
রিধি: মিথ্যে কথা। আমাকে পটানোর চেষ্টা করবেন না।
রক্তিম: যে আগে থেকেই পটে আছে, তাকে নতুন করে আর কি পটাবো?
রিধি: হুহ, আমি আপনাকে ভালোবাসি না।
রক্তিম: তোমার চোখ তো অন্য কিছু বলছে।
রিধি: এসব মুভির ডায়লগ আমার সামনে বলবেন না।
রক্তিম: জীবনটা তো একপ্রকার মুভি। কখনো কষ্ট, কখনো খুশি।
রিধি: হয়েছে আপনার? এখন যান। আমার ঘুম পাচ্ছে।
রক্তিম: সত্যি ভালোবাসি। আমি এতোদিন অভিনয় করেছিলাম। যাতে তুমি বুঝতে পারো আমার প্রতি তোমার অব্যক্ত অনুভূতিগুলো। আমি জানতাম, আমাকে কারো সাথে দেখলেই তুমি ঠিক তেমন কষ্ট পাবে যেমনটা আমি পেয়েছিলাম। তুমি যখন রাত জেগে ইফতির সাথে কথা বলতে, যখন মিথ্যে বলে ইফতির সাথে দেখা করতে যেতে! অনেক কষ্ট পেয়েছিলাম ওইদিন যেদিন তুমি চুলগুলো কেটে ছোট করে ফেলেছিলে, এটা জানার পরও যে তোমার লম্বা খোলা চুলগুলো আমার নেশা। তোমাকে বলেছিলাম আমি, তারপরও। একটা মেয়ে যাকে আমি ভালোবাসি না সেও আমার জন্য নিজেকে সাজায়। আর তুমি? অন্যের জন্য নিজেকে রাঙাও। অনেক বলেছিলাম তোমাকে শাড়ি পড়তে। কখনো পড়ে আমার সামনে এসে দাঁড়াও নি। আর ওই ইফতির জন্য তুমি শাড়ি পড়েছিলে। অনেক কষ্ট পেয়েছিলাম রিধি, যখন তুমি আমার অনুভূতিগুলো হাসি-তামাশায় উড়িয়ে দিয়েছিলে। আমাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য প্রতিদিন একটা না একটা প্ল্যান থাকতো তোমার মাথায়। দিয়ার সাথে হাসাহাসি করতে আমাকে নিয়ে, আমাকে তোমার ইমোশনাল কান্নায় ফাঁসিয়ে ফেলার পর।
রিধি অবাক হয়ে তাকালো রক্তিমের দিকে।
রিধি: আপনি কিভাবে জানলেন?
রক্তিম: রিধি, আমার নজর সবসময় তোমার উপর থাকে।
রিধির চোখ ছলছল করে উঠলো। এতো কষ্ট দিয়েছে সে রক্তিমকে? রক্তিম যে কষ্ট দিয়েছে এর চেয়ে বেশি তো সে নিজেই দিয়েছিলো।
হ্যাঁ, রক্তিমের ভালোবাসা নিয়ে অনেক তামাশা করেছিলো সে। কিন্তু এখন সে নিজেও যে সেই ভালোবাসায় ধরা দিয়েছে! এখন বুঝতে পারছে অনুভূতি নিয়ে তামাশা করলে কতো কষ্ট হয়। আজ বুঝেছে সে, ভালোবাসার মানুষ যখন দূরে সরিয়ে দেয় মন কিভাবে ভাঙে। এ এক অদ্ভুত অদৃশ্য যন্ত্রণা!
রিধির অশ্রু ঢলে পড়লো চোখের পাতা বন্ধ করার সাথে সাথেই।
রিধি: আই এম সরি রক্তিম। আমি আপনাকে কষ্ট দিয়েছি অনেক।
রক্তিম: রিধি একদম কাঁদবে না। আমার রিধিটা কাঁদলে আমার ভালো লাগে না।
রিধি চোখ মুছে ফেললো।
রিধি: তার মানে আপনি আমাকে ভালোবাসেন?
রক্তিম: হ্যাঁ, অনেক ভালোবাসি।
রিধি: হুহ, ভালো হয়েছে। যান এখন বের হয়ে যান। আমি ঘুমাবো।
রক্তিম: রাক্ষসী।
রিধি: কি বললেন আমাকে? আমি রাক্ষসী? এতো বড়ো কথা?
রক্তিম: আরে আরে, আমি রাক্ষস হলে তুমি তো রাক্ষসী হবেই। রাক্ষসের বউ তো রাক্ষসী হয়।
রিধি: আপনি হচ্ছেন টিকটিকির লেজ, ডাস্টবিনের পলিথিন, হুহ।
রক্তিম হেসে বলল,
রক্তিম: আমি টিকটিকির লেজ হলে তুমি টিকটিকি। কারণ টিকটিকির লেজ যখন টিকিটিকি থেকে আলাদা হয়ে যায় তখনই লেজটা লাফায়। তোমার থেকে আলাদা হলে আমিও এভাবে লাফাবো। আর লাফিয়ে লাফিয়ে তোমার কাছে চলে আসবো। আর ডাস্টবিনের পলিথিন যদি হই, তাহলে তুমি হচ্ছো আবর্জনা। কারণ আবর্জনাহীন পলিথিনকে তো আর ডাস্টবিনের পলিথিন বলে না।
রিধি: আপনি আমাকে এতো বড়ো বড়ো কথা বললেন?
রক্তিম: আরে লক্ষীটি, যেখানে আমি সেখানেই তুমি। এটিই তো ভালোবাসার বাণী। এখন তুমি আমি আলাদা থাকলে যদি কেউ এসে পড়ে আমাদের মাঝে? তাই এখন থেকে আমাদের পাশাপাশি থাকতে হবে। বুঝেছো?
রিধি ভেংচি দিয়ে বলল,
রিধি: আপনি ভালোবাসেন না আমাকে।
রক্তিম: বাসি তো।
রিধি: এভাবে কেউ বলে? সুন্দর হয় নি। মুভি তে দেখেন নি কিভাবে প্রপোজ করে?
রক্তিম: ওইটা তো মুভি, ওভাবে কি হয়?
রিধি কোমরে হাত দিয়ে বলল,
রিধি: কিছুক্ষণ আগে কেউ একজন বলেছিলো, জীবনটা একপ্রকার মুভি।
রক্তিম: ওহ হ্যাঁ।
রক্তিম হাঁটু গেড়ে বসে রিধির হাতদুটি নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বলল,
রক্তিম: রিধি, তুমি কি এই রাক্ষসের রাজ্যের রাক্ষসী হবে?
রিধি হেসে দিলো। মাথা নেড়ে বলল,
রিধি: হ্যাঁ, খুশি খুশি হবো।
রক্তিমের হাতে গোলাপ ফুল ছিলো না। তাই সে রিধির হাতে তার পকেটে থাকা রোমালটি বেঁধে দিলো।
রক্তিম: ফুল তো শুকিয়ে যাবে, কিন্তু রোমালটি থেকে আমার স্পর্শ হারাবে না। ফুল তো বাইরের জিনিস, অনেকে এটি স্পর্শ করে। অনেকের কাছে একই রঙের গোলাপ থাকে। এই রোমালটি কিন্তু তোমার রক্তিমের, এখানে অন্য কারো স্পর্শ নেই।
রিধি চোখ ছোট করে বলল,
রিধি: রোমালটি যে বুয়া ধুয়েছিলো একদিন?
রক্তিম মাথায় হাত দিয়ে বলল,
রক্তিম: তোমার কি সমস্যা রিধি? পানি ঢেলে দিলে তো এখন আমার রোমান্টিকতায়।
রিধি দাঁত বের করে হেসে দিলো।
তারপর কান ধরে বলল,
রিধি: আচ্ছা, আচ্ছা, সরি। আমি তো এমনই। এখনই বিরক্ত হয়ে গেলে, সারাজীবন কিভাবে সহ্য করবে বলো?
রক্তিম: কি বললে?
রিধি: বলছি আমাকে কিভাবে সহ্য করবে? এখন পারছো না।
রক্তিম: আবার বলো তো।
রিধি: কানে কি তুলা দিয়ে রেখেছেন?
রক্তিম: আরে, আমাকে তুমি করে বললে না? আবার বলো না ওভাবে। ভালো লাগে শুনতে।
রিধি: তুমি না অনেক ভালো রক্তিম ভাইয়া।
রক্তিম দাঁত কড়মড় করে বলল,
রক্তিম: রিধি!
রিধি হাসতে হাসতে বলল,
রিধি: আচ্ছা, এখন যাও, ঘুমাও। মা-বাবা আসলে কিন্তু আমি বলবো তুমি আমায় বকেছো। তখন সব কথা তোমায় শুনতে হবে। আমি বকা শুনার সঙ্গী হবো না কিন্তু।
রক্তিম: আচ্ছা, যাচ্ছি। গুড নাইট মাই লাভ।
রক্তিম বের হয়ে যাওয়ার সময় রিধি রক্তিমের হাত ধরে বলল,
রিধি: দাঁড়াও।
রক্তিম: কিছু বলবে?
রিধি: আই লাভ ইউ টু।
কথাটা বলেই রক্তিমের মুখের উপর দরজা বেঁধে দিলো। রক্তিম মুচকি হেসে চলে গেলো।
আজ রাতে তারা ভালোই ঘুমোতে পারবে, বহুদিন তারা শান্তিতে ঘুমায় নি। তাদের অপেক্ষার সমাপ্তি হলো আজ। এখন শুরু হবে নতুন প্রেমের গল্প।
এই দুই সপ্তাহে তাদের জীবনে তুমুল ভালোবাসার ঢেউ বয়ে গেছে।
বর্তমানে-
রক্তিম: রিধি আমি চলে যাচ্ছি, তাড়াতাড়ি করো।
নবনী: মেয়েটাকে ঠিকমতো নামিয়ে দিস। বকা দিবি না একদম।
রক্তিম: না, রাস্তার উপরে রেখে আসবো। আর একদম মারতে মারতে নামাবো সিঁড়ি দিয়ে।
নবনী: তুই সবসময় এমন ট্যারা কথাবার্তা না বলে থাকতে পারিস না?
রক্তিম: মা, প্রতিদিন একই কথা কিভাবে বলো? আমি ওকে প্রতিদিন ঠিকমতো নামিয়ে দেই, তাই ও এখনো তোমার সামনেই আছে। আর তুমি কি ভাবছো আমি ওকে শুধু বকাঝকা করি? তোমার মেয়েরও কিন্তু দোষ আছে।
রিধি: দেখেছো মা, আমার অনুপস্থিতিতে আমার নামে তোমাকে প্যাঁচ লাগাচ্ছে। একদম বিশ্বাস করবে না। হুহ।
নবনী: আমি জানি, আমার মেয়েটা খুব লক্ষী। এখন যা মা ঠিকমতো। মনোযোগ দিয়ে ক্লাস করবি।
রিধি: আচ্ছা, আল্লাহ হাফেজ।
রক্তিম আর রিধি গাড়িতে উঠলো। রক্তিম রিধির হাত ধরে গাড়ী চালাচ্ছে।
রিধি: মায়ের সামনে আমাকে পঁচানোর পর এখন মলম লাগাতে আসছে। হুহ।
রক্তিম: তোমাকে আমি ছাড়া আর কেউ মলম লাগাতে পারবে না। তাই আমিই লাগাচ্ছি। কেন জ্বলছে খুব?
রিধি: না, ভালো লাগছে।
এভাবেই ভালোবাসার সাগরে ডুবে থাকুক রিধি-রক্তিম। নতুন করে না আসুক কোনো অপেক্ষার মোড়। কারণ অপেক্ষা যে বড়োই মারাত্মক কষ্টের।
চলবে–
আগের পর্বের লিংক:
https://www.facebook.com/groups/371586494563129/permalink/374487984272980/