#শঙ্খচিল
#Ruhi_Jahan_Maya
পর্ব–১৫
বিকাল চার টা কি সারে চার টা বাজে৷ বাইরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি বইছে। তানহা যাত্রী ছাউনির এক পাশে মনে এক রাশ বিরক্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে । বৃষ্টি থামবার নাম নেই। অসময়ের বৃষ্টি, কি পরিমাণে বিরক্তিকর তা হারে হারে টের পাচ্ছে তানহা।
সকাল বেলা রিকশা দিয়ে কলেজে আসার সময় শাহবাগ থানার দিকে চোখ পড়তেই হঠাৎ তার জিডি টার কথা মনে পড়লো৷।এক সমপ্তাহ শেষে দু সপ্তাহে পর্যন্ত পার হতে চললো পুলিশ কোন হদীস দিতে পারলো না।
তানহার ইচ্ছে করছে এই পুলিশ গুলো কে গালি দিতে৷ দোষ আসলে পুলিশের না দোষ সিস্টেমের। যদি সিস্টেম টা ঠিক থাকতো তাহলে হয়তো সবাই জাস্টিস পেতো।
ভাবতে ভাবতেই শ্বাস ফেললো তানহা। হঠাৎ সামনে দিয়ে রিকশা যেতেই তানহা হাত দিয়ে থামতে ইশারা করলেই বৃদ্ধ রিকশা ওয়ালা, রিকশা থামিয়ে দিলো।
তানহা দ্রুত রিকশায় উঠে পরলো, অন্য সব দিন হলে দর দাম করে রিকশা উঠতো, তবে আজ এই বৃষ্টির মধ্যেযে রিকশা পেয়েছে এই তো বেশি৷ তানহা রিকশায় উঠে বসলো, ব্যাগের ভেতর ফোনটা ভু ভু করে শব্দ করছে তানহা ব্যাগটা খুলে ফোনটা হাতে নিয়ে নিলো, বাবা ফোন করেছে ফোনটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে বাবা বললো,
” তানহা তুমি কোথায় এখন?”
” ধানমন্ডি দুইয়ে আছি বাবা৷ ”
” ও আচ্ছা। রিকশা নিয়ে বাসায় চলে এসো তাড়াতাড়ি। ”
” আচ্ছা ঠিক আছে বাবা। কিন্তু কোন সমস্যা?”
” না। বৃষ্টি হচ্ছে তাই বললাম। ”
” আমি বাসায় যাচ্ছি বাবা। ”
” সাবধানে যেও… ” বলেই মুকুল সাহেব কল টা কেটে দিলো। তানহা ফোন টা কেটে ব্যাগে ঢুকাতে যাবে ঠিক তখনি পেছন থেকে দুটো বাইক জোড়ে শব্দ করা শুরু করলো।
রিকশার গতিও হঠাৎ বেড়ে গেলো, বৃদ্ধ রিকশা চালক হঠাৎ এতো জোরে কি ভাবে রিকশা চালাতে পারে। ক্ষানিক বাদেই বাইক দুটো সামনে দিয়ে চলে গেলো। রিকশার গতিও স্বাভাবিক হয়ে গেলো।
তানহা কৌতুহল বসত বৃদ্ধ লোকটা কে বললো, ” চাচা হঠাৎ এতো দ্রুত কেনো রিকশা চালাতে শুরু করলেন? ”
বৃদ্ধ কিছু বললো না৷ ছেঁড়া গেঞ্জির ভেতর থেকে উজ্জ্বল চামরার মাঝের কালো রগ গুলো ভাস্যমান দেখা যাচ্ছে। যেনো মনের রাগ শরিরের ওপর মেটাচ্ছে। তানহা লোকটার নিস্তব্ধতা দেখে অনেকটা অবাক হয়ে গেলো। বাইক দুটোর সাথে পাল্লা দিয়ে লোকটা রিকশা চালাচ্ছে। শাহবাগ পেরিয়ে আজীম পুর আসতেই হটাৎ একটা প্রশ্ন তানহার মনে নাড়া দিয়ে উঠলো, তানহা তো লোকটাকে এক বার ও বলে নি তার বাসা কোথায়, কোথায় সে নামবে৷
লোকটা নিজ মনে রিকশা চালিয়ে-ই যাচ্ছে। বাসার গলির সামনে রিকশা থামিয়ে লোকটা ঘুরে তাকালো, এতোক্ষণ যাকে তানহা বৃদ্ধ ভেবেছে আসলে সে বৃদ্ধ না। মাঝ বয়সী একটা লোক মুখে গামছা পেচিয়ে রিকশা চালাচ্ছে। চোখ দুটোর কনিকায় লাল আভা ফুটে উঠেছে। কপালে ভাজ। লোকটা ইশারা করে নামতে বললো,
তানহা নেমে গেলো, কিন্তু লোকটার চোখের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। কোথায় যেনো এই চোখ সে দেখেছে, তা ছাড়া সবচেয়ে বড় অবাক করা বিষয় হলো, তানহার বাড়ির ঠিকানা এই লোক জানলো কি ভাবে…
তানহা লোকটার যাবার পানে তাকিয়ে রইলো। লোকটা দ্রুত রিকশা চালিয়ে বাইক দুটোকে অনুসরণ করার চেষ্টা করছে। তানহা হঠাৎ কিছু একটা মনে করে দ্রুত অটো গাড়িতে চেপে বসলো৷ বৃষ্টি থেমে যাওয়ার কারনে গাড়ি পেতে খুব একটা সময় লাগলো না। মিনিট দুয়েক পড়েই তানহা মাঝ বয়সী লোকটার রিকশা দেখতে পেলো। বাইক দুটো থমে যেতেই ছেলে দুটো কোথাও চলে গেলো। হঠাৎ রিকশা হঠাৎ করে থেমে গেলো রিকশা ওয়ালা ছেলে দুটোকে অনুসরণ করে চলে গেলো। তানহা দ্রুত ভাড়া দিয়ে রিকশা ওয়ালাকে অনুসরণ করে একটা ফাঁকা রাস্তায় ঢুকে গেলো।
এই অদ্ভুত লোকটা কে, কিভাবে তার বাড়ির ঠিকানা জানলো৷ কেনোই বা তখন তার কথার উত্তর দিলো,কেনোই বা এই লোকটার চোখ দুটো চেনা চেনা লাগছিলো?
এই সব গুলো প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে তাকে এই লোকটার কে ফলো করতে হবে। লোকটা কে জানতে হবে৷ ভাবতে ভাবতেই গলির ভেতরে ঢুকে গেলো। সুনসান গলির চার পাশ সন্ধ্যা হতে চলেছে, চারিদিক অন্ধকার হতে শুরু করে দিয়েছে, তানহা হাটতে হাটতে থমকে দাঁড়ালো, গলির শেষ মাথায় চলে এসেছে সে। এখান থেকে তিনটা রাস্তা শুরু তানহা কোন রাস্তা দিয়ে যাবে বুঝতে পারলো না। মাথা চেপে দাঁড়িয়ে রইলো এই কোন গোলক ধাঁধাঁয় আটকে গেলো সে, চারি দিক অন্ধকার প্রায়, হঠাৎ…
।
।
নাকে টিস্যু চেপে হাঁচি দিলো মানহা। বিকেলে বাড়ি ফের পর থেকে শর্দিটা যেনো দ্বিগুণ বেড়ে গেছে। নাক থেকে রুমাল সরাতে পারছে না। নাক ফুলে লাল হয়ে গেছে, চুল গুলো মৃদু ভেজা।
” কি ভাবে এমন সর্দি লাগালি বল তো? ”
এক নজর দাদীর দিকে তাকিয়ে মানহা বললো, ” সকাল বেলা কলেজে পৌঁছাতে পৌঁছাতে বৃষ্টি শুরু হয়ে গিয়েছিলো। একটু ভিজে গেছিলাম। ”
” ওমনি ঠান্ডা সর্দি লেগে গেলো। তোদের দু বোন কে নিয়ে আর পারি না। ”
শেহতাজ বেগম রহিমা খালার উদ্দেশ্য বললেন,
” রহিমা পানি গরম দে। ”
মানিহা হাঁচি দিয়ে বললো, ” গরম পানি দিয়ে কি হবে দাদী? ”
” গরম পানির ভাব নিলে নাক পরিষ্কার হয়ে যাবে৷ আমাদের সময় কালে তো এতো ঔষধ ছিলো না। সর্দির প্রথমিক চিকিৎসা হিসেবে গরম পানি ভাব নিলে, নাক পরিষ্কার হয়ে যেতো। ”
মানহা নাক মুছতে মুছতে দাদীর দিকে তাকিয়ে রইলো। ক্ষানিক পরে রহিমা খালা গরম পানি নিয়ে এলেন, দাদীর কথায় মানহা গরম পানির ভাব নিলো। কিছুটা ভালো লাগলেও সর্দি পুরোপুরি ঠিক হলো না।
ধুমিয়ে জ্বর উঠলো মানহার, চোখ দুটো ঘুমে ক্লান্তিতে বুজে রাখলো, কিন্তু ঘুম এলো না মানহার।
শেহতাজ বেগম জোরে শ্বাস ফেলে মানহার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। যদি রেহানা ( তানহা মানহার মা) বেঁচে থাকতো তাহলে এই সময় টায় মানহার কত-ই না যত্ন নিতো।
তানহার জন্মের বছর পাঁচেক পর হঠাৎ করে রেহানা অসুস্থ হয়ে পড়লো। প্রথমে খুব একটা পাত্তা না দিলেও, দিন দিন রেহানার শরির -স্বাস্থ ভাংতে শুরু করে৷ ধীরে ধীরে চুল ঝড়ে পড়তে শুরু করে৷ ডাক্তারর পরামর্শে বিভিন্ন টেস্ট করার পর রেহানার ব্লাড ক্যান্সার ধরা পরে৷ শরিরের ৭০% রক্ত দূষিত হয়ে যায়, টাকার অভাবে মুকুল সাহেব ঠিক মতো স্ত্রীর চিকিৎসা ও করাতে পারেন নি। বাধ্য হয়ে চার বিঘা জমি বিক্রি করে দেন। তাতে খুব একটা লাভ হয় না টানা ছয় মাস মৃত্যুর সাথে লড়াই করে, রেহানা মারা যায়৷ তখন মানহার বয়স দশ কি এগারো। ভালো মন্দ বুঝতে শিখেছে মাত্র, মায়ের মৃত্যুতে ছোট্ট মেয়ে টা দৈঘ্য সময়ের জন্য মানুষীক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে, ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতো, চোখের কোনে বেয়ে অশ্রুমালা গড়িয়ে পড়তো।
মুকুল সাহেব হয়ে যান একজন গম্ভীর স্বভাবের মানুষ, প্রিয় মানুষ টির মৃত্যু তাকে পাথর মনা তৈরি করে ফেলেছেন।
সেই সময় টা-তে শেহতাজ বেগম যে ভাবে সবাই কে সামলিয়ে রাখার চেষ্টা করেও পারে নি।
অতীতের কথা স্মৃতি চারণ করতেই শেহতাজ বেগমের চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে এলো।
মানহার কপালে দু ফোটা পানি পড়তেই পিট পিট করে দাদীর মুখ পানে তাকালো সে৷ দাদীর চোখের পানির ফোটা তার কপালে পড়েছে। মানহা দাদীর হাত ধরে বললো,
” দাদী তুমি কান্না করছো কেনো?”
” হঠাৎ তোর মায়ের কথা মনে পড়লো রে মানহা৷ ”
মানহা চুপ করে রইলো, চোখ বন্ধ করে মায়ের চেহারা টা কল্পনা করার চেষ্টা করলো। কিন্তু পুরোপুরি মনে করতে পারলো না, সব কিছু যেনো আবছা লাগছে। হয়তো অসুস্থতার কারনেই এমন টা হচ্ছে। পরক্ষণেই মানহার মনে পড়লো, তার মায়ের চেহারা টা অবিকল তানহার মতো। মানহা দেখতে তার মায়ের মতো না হলেও গায়ের রঙ চাপা শ্যামলা তার বাবার মতো।
তবে তানহা দেখতে তার মায়ের মতোই মিষ্টি…
হঠাৎ কোন কিছুর ধপাশ শব্দ শুনে তানহা চমকে উঠলো, শব্দটা অনুসরণ করে যেতেই তানহা দেখতে পেলো….
।
।
চলবে