#শঙ্খচিল
#Ruhi_Jahan_Maya
পর্ব–৩৩
রাত দশটা কি সারে দশটা বাজে…
রাস্তায় তেমন একটা ভীর নেই। প্রায় এক ঘন্টা যাবৎ হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে দাঁড়িয়ে আছে ওয়াহাব। ভাবসা গরমে ঘেমে একাকার, রাত হওয়াতে মানুষ জনের তেমন ভীর নেই। বাইরে আর বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না, সে। ওয়াহাব এয়ারপোর্টে ভেতরে যাবে ঠিক তখনি কেউ একজন বললো,
” ওয়াহাব। ”
ওয়াহাব ঘুরে তাকিয়ে, অস্ফুট কণ্ঠে বললো, ” শাহেদ দুলাভাই।”
শাহেদ ( তানিয়ার স্বামী) স্মিথ হেসে ইলহামের কাধে হাত রেখে বললো, ” কংগ্রাচুলেশনস মাই ডিয়ার শালোক। ”
ওয়াহাব এক গাল হেসে বললো, ” থ্যাংক ইউ দুলাভাই। কেমন আছেন আপনি? ”
” ভালো মন্দের মাঝামাঝি আছি। বউ বাচ্চার মুখ দেখতে পেলে ভালো আছি বলতে পারবো মনে হয়। ”
ওয়াহাব বললো, ” আপনাকে দেখার পর তানিয়া আপা যে সীন ক্রিয়েট করবে। সেই ঝড় সামলাবেন কি ভাবে সেটা চিন্তা করছেন নিশ্চয়ই। ”
” এতোক্ষণ চিন্তা করি নি। তুমি চিন্তাটা মাথায় ঢুকিয়ে দিলে। চলো চিন্তা করতে করতে বাসায় যাই। ”
ওয়াহাব শাহেদের লাগেজ গাড়িতে তুলে নিলো, অতঃপর গাড়িতে বসলো,
” বাই দা ওয়ে, হলুদের প্রোগ্রাম রেখে আমাকে রিসিভ করতে এসেছো, আমি কৃতজ্ঞ তোমার কাছে৷ ”
ওয়াহাব হাসলো। গাড়ি ড্রাইভিং করতে করতে বললো,
” কোন ব্যাপার না দুলাভাই। আমার বোনের জন্য এতোটুকু করতেই পারি। ”
” কত বছর পর যে ছেলেটাকে দেখবো। শিহাব বড় হয়ে গেছে তাই না? ”
” হু দুলাভাই। ”
—————————————————
ঘন্টা খানেক আগেই মানহার হলুদ শেষ হয়েছে৷ মুখ, গাল, কপাল হাতে কাঁচা হলুদের ছোঁয়া লেগে আছে। আয়নার সামনে বসে হাত থেকে একটা একটা করে চুড়ি খুলছে। কিছু একটা ভেবেই চলেছে।
মনের ভেতর প্রশ্নের জাল, ধীরে ধীরে বেরেই চলেছে তবে কোন উত্তর মেলাতে পারে নি সে। আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে মনে মনে ভাবলো, সে কি এতো টাই ওয়াহাবের অযোগ্য , ওয়াহাব তাকে প্রত্যাখ্যান করে দিলো।
ফুলের তোরার মতো অভিমান সাজিয়ে রেখেছে, মনে মনে এই তোরার নাম দিয়েছে অভিমানের তোরা।
কত বার ভেবেছে ওয়াহাবের কথা সে ভাববে না, ঠিক তত বার তার ভাবনার মাঝে ওয়াহাব চলে আসে?
ওয়াহাবের কঠিন প্রতাক্ষানের কথা মনে করতেই শ্বাস রুদ্ধ কর পরিস্থিতিতে পড়ে যায় সে৷ কয়েক মূহুর্তের জন্য মনে হয় সে মারাই যাবে।
মানহা আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব কে বললো, ‘মানহা ওয়াহাব যদি তোকে প্রত্যাখ্যান করতে পারলে, তুই ও পারবি ওয়াহাবের ভাইয়ের সাথে সংসার করে সুখি হতে, বল পারবি না?’
মানহা শ্বাস ফেলে বললো, ” হ্যা পারবো। আমাকে পারতে হবেই৷
পাষাণ লোকটাকে আমার ভুলতেই হবে। ”
” কাকে ভুলবে মানহা?”
হঠাৎ বাবার প্রশ্নে চমকে উঠলো মানহা। কি উত্তর দেবে তা বুঝে উঠতে পারছে না সে। আমতা আমতা করে বললো,
” তোমাদের সবাই কে ভুলে আমি কি ভাবে থাকবো অন্য এক পরিবেশে…”
মুকুল সাহেব স্মিথ হেসে বললো, ” আহা ভুলবি কেনো? আমরা সব সময় তোর পাশে আছি৷ তোর সাথে আছি। ” বলেই মানহার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন মুকুল সাহেব। মানহা বাবাকে জরিয়ে ধরে বললো,
” তোমাদের অনেক মিস করবো বাবা। ” বলেই মানহা কেঁদে দিলো।
মেয়ের কান্না দেখে মুকুল সাহেব কেঁদে দিলেন, পরক্ষনেই চোখ মুছে নিলেন। মানহা চোখের পানি দেখলে আরো কষ্ট পাবে এই ভেবে।
” ছেলেটা অনেক ভালো বুঝলি, তোকে একজন দ্বায়িত্ববান মানুষের হাতে তোকে তুলে দিচ্ছে এই ভেবে শান্তি হচ্ছে রে খুব। ”
মানহা চুপ করে রইলো কিছু বললো না। মুকুল সাহেব বললেন,
” ফ্রেশ হয়ে রেস্ট নে৷ আমি এখন ছাদে গিয়ে দেখি কেমন ডেকরেশন হলো। ”
” আচ্ছা বাবা। ”
মুকুল সাহেব মানহার রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। মানহাও ফ্রেশ হতে চলে গেলো৷
তানহা এবং মানহার কয়েক জন বান্ধবি ওপরে নিচে বেডিং করে ঘুমিয়ে পড়েছে। শুধু মানহার চোখেই ঘুম নেই। মানহা দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকালো রাত একটা ছুই ছুই…
মানহা পা টিপে টিপে হেটে বারান্দায় চলে এলো৷ বাইরে ফুর ফুরে বাতাস বইছে, অথচ রুমে কি ভাবসা গরম। জোছনার আলো বারান্দার গ্রীল ভেদ করে ভেতরে প্রবেশ করছে, মানহা রকিং চেয়ারে বসে পড়লো। আনমনে গুন গুনিয়ে গাইতে শুরু করলো…
—– এই অবেলায়, তোমারি আকাশে,
নিরব আপোষে ভেসে যায়।
সেই ভীষন শীতল ভেজা চোখ
কখনো দেখাইনি তোমায়।
কেউ কোথাও ভালো নেই যেন সেই,
কতকাল আর হাতে হাত অবেলায়?
কতকাল আর ভুল অবসন্ন বিকেলে
ভেজা চোখ দেখাইনি তোমায়।
সেই কবেকার ভায়োলিন,
বেজে যায় কতদিন
প্রানে চাপা ঢেউ, দেখেনি আর কেউ।
কখনো অভিমান, অবাধ্য পিছুটান
জানিনা কি কষ্টে এই অবেলায়।
তবুও নির্বাসন বাসর সাজিয়ে,
ঠোঁটে চেপে ধরা থাক ভালোবাসায়।—
শাহেদ ড্রইংরুমে বসে আছে, তার বরাবর সোফায় বসে আছে তানিয়া৷ সে কখনো ভাবে নি, আজকের দিনে সে এভাবে সারপ্রাইজ পাবে। শাহেদর সাথে সে এখনো একটা কথাও বলে নি, অবশ্য শাহেদ তানিয়ার সাথে কথা বলার চেষ্টা করে ছিলো তবে পারে নি। তানিয়া তার একটা কথার জবাব দেয় নি।
অনেক টা অভীমান, আর চাপা রাগের কারনেই। মানুষ বড়-ই অদ্ভুত যার জন্য একসময় পাগলের মতো ভালোবাসা অনুভব করে, জীবন নাম সমীকরণ তার বিরুদ্ধেই নিয়ে যায়। ভাবতে ভাবতেই তানিয়ার চোখ দিয়ে টুপ করে পানি পড়লো৷ তার ভীষণ ইচ্ছে করছে কান্না করতে কিন্তু সে চায় না শাহেদ তার কান্না দেখুক৷ আর এক মূহুর্ত সাহেদের সামনে তার বসে থাকতে ইচ্ছে করছে না। তানিয়া উঠে দাঁড়ালো, শাহেদ কিছু বলতে যাবে ঠিক তখনি তানিয়া তীক্ষ দৃষ্টিতে তাকালো। শাহেদ কিছু বলতে গিয়েও চুপ করে রইলো। তানিয়া বড় বড় কদমে হেটে রুমে গিয়ে দরজা আটকে দিলো, তানিয়া এখন খুব কান্না করবে। লুকিয়ে কান্না করার জন্যই সে রুমে চলে গেছে, তা খুব ভালো ভাবেই জানে শাহেদ।
শাহেদ তার ক্যারিয়ার গড়ার জন্য বউ, বাচ্চা কে ছেড়েছে বিদেশ পারি জমিয়ে ছিলো, আজ ক্যারিয়ার আছে তবে স্ত্রী -পুত্র তার সাথে নেই৷ ভাবতে ভাবতেই দৈর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো শাহেদ। ওয়াহাবের দিকে তাকিয়ে বললো,
” মেয়ে মানুষের রাগ অভিমান ভাঙ্গানো, আর আর মাউন্টেন এভারেস্ট জয় করা একই ব্যাপার বুঝলে ওয়াহাব, তবে মাউন্টেন এভারেস্ট তো জয় করার পথ আছে তানিয়ার রাগ অভিমান ভাঙ্গাবো কি ভাবে সে পথ আমার জানা নেই…”
ওয়াহাব স্মিথ হাসলো, শাহেদ আবার বললো, ” তুমি হাসতেই পারবে, বিয়ে -টিয়ে তো হয় নি, আমার যন্ত্রনা টা বুঝবে না ভাই। ”
ওয়াহাব পূর্ণরায় হেসে বললো, ” দুলাভাই আমারও কিন্তু লাভ ম্যারেজ হচ্ছে, আমার হবু বউ জানে না আমি তার বর। জানলে কি একটা অবস্থা হবে বুঝতে পারছেন৷”
শাহেদ অবাক হয়ে বললো, ” তোমার বউ তো তোমাকে ধরে পেটাবে ভাই। মেয়ে মানুষের রাগ-অভীমান বড়-ই মারাত্মক জিনিস। ”
” সে দেখা যাবে। এখন চলেন শিহাবের রুমে যাই। ”
” হ্যাঁ চলো, এসেছি পরে একটু দেখেছিলাম ছেলেটা কে আর তো দেখাই হয় নি। ”
” চলুন দুলাভাই। ”
বলেই শাহেদ ওয়াহাববের সাথে শিহাবের রুমে গেলো৷ এতো রাতেও শিহাব ঘুমায় নি। ড্রয়ইং খাতা নিয়ে টেবিলে বসে আছে, হঠাৎ বাবা কে দেখে হাসি দিয়ে বললো, ” বাবাই তুমি এতক্ষণে আমার কাছে এসেছো৷ আমি তোমার জন্যই বসেছিলাম। ”
শাহেদ অবাক হয়ে বললো ” আমার জন্য?কেনো বাবাই? ”
” আমার ড্রইং খাতা তোমাকে দেখাবো বলে, মা যখন কান্না করতো তখন আমারো খুব কান্না পেতো তাই আমি বসে ছবি আকঁতাম। ”
শাহেদ ড্রয়ইং খাতাটা হাতে নিলো, তার ছেলেটা কি সুন্দর ছবি আঁকতে পারে তা অবাক হয়ে দেখছে, প্রতিটা দৃশ্য একটা ছেলে এবং তার বাবা – মা। দৃশ্য গুলোতে শিহাব, তার বাবা মাকে কল্পনা করে, ভাবতে ভাবতেই শাহেদ ছেলে কে জিরিয়ে কপালে চুমু দিলো।
———————————-
” দুলাভাই৷ আপু আপনাকে রুমে যেতে দেবে না। ”
” জানি আমি। ”
ওয়াহাব চিন্তিত হয়ে বললো,” আমাদের বাসায় চারটা বেড রুম চার টা রিজার্ভ আপনি কোথায় ঘুমাবেন?”
” তোমার রুম আছে কি করতে?তোমার রুমে ঘুমাবো।”
” আজকের রাতটা থকতে পারেন তবে কালকে? ”
” কেনো কালকে কি? বলো তো?”
” ওমা আমার বউ থাকবে না। ” বলেই ওয়াহাব হেসে দিলো। শাহেদ হেসে বললো,
” হ্যাঁ তাই তো। ”
।
।
চলবে
অনেক বড় পর্ব দিয়েছি, কেমন হয়েছে জানাবেন সবাই 😊